Saturday 10 December 2016

সুমনের ' গানওলা' ও ডিলানের 'Mr Tambourine Man -------পলাশকান্তি বিশ্বাস

সুমনের ' গানওলা' ও ডিলানের 'Mr Tambourine Man
অনেকেই অনেক সময় জিজ্ঞেস করেছেন কবীর সুমনের ' ও গানওলা, আর একটা গান গাও' গানটা Bob Dylan এর Mr. Tambourine Man গানের অনুসরণ বা অনুকরণ কি না।
সুমনের গানটা সবাই শুনেছেন, এমন ধরে নিয়েই কথাগুলো লিখছি।
সুমনের গানের প্রথম দুলাইনের মধ্যে ডিলানের গানের কথার বেশ কিছুটা ছায়া পাওয়া যায়। কিন্তু তফাতও আছে। দুলাইনের পর থেকে কিন্তু সুমন তার নিজস্ব পথে হেঁটেছেন অন্য মহান স্রষ্টাদের মতই। অন্য কোন সূত্র থেকে ভাব বা ভাবনার কণামাত্র নিয়ে একটা নিজস্ব নবনির্মিতি। সব শিল্পীর ক্ষেত্রেই এমন ঘটা স্বাভাবিক ও স্বীকৃত।
দুটো গান আমি বারবার শুনেছি। দুটো গগানই মহৎ সৃষ্টি তার তার দেশকালের নিরিখে। প্রকৃতপক্ষে দুজনই মহান স্রষ্টা। সুর ও পরিবেশনে দুটোর আমেজ আলাদা।
আমার মনে হহয়েছে এটা বাংলায় অনুবাদ করে দিলে বেশ হয়। যারা ডিলানের গলগানটা শোনেন নি, অথচ সেটা কেমন তা জানতে ইচ্ছে আছে, তাদের ভালো লাগবে। আর সেই ফাঁকে পাঠকদের একটা নতুন বিষয় পাওয়া হয়ে যাবে।
আমেরিকার জীবনাচরণ আমার তেমন জ্ঞাত নয়, কিছুটা অনুমান করে আমার দেশের জীবন-পরিবেশের সঙ্গে যতটা সম্ভব মেলানোর চেষ্টা করেছি। ছন্দটাও এমন রাখার চেষ্টা করেছি যাতে গাইতে চাইলেও তেমন হোঁচট না খেতে হয়।
বন্ধুরা মতামত দিলে খুশি হব। আশা থাকবে, মূল গান বুঝতে বা আমার শব্দপ্রয়োগে অজ্ঞানতা বা অনবধানতাবশত কোন ভুল করে থাকি, তারা আমাকে মন্তব্যে সতর্ক করবেন। হ্যাঁ, অনুবাদকের স্বাধীনতা কিছুটা তো আমায় নিতেই হছে, বিশেষত ছন্দ- অন্ত্যমিল রাখার ক্ষেত্রে।
বন্ধুদের ভালো লাগলে আমার চেষ্টার সার্থকতা।
খঞ্জনি-বৈরাগী**
--- পলাশকান্তি বিশ্বাস
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
আমি জানি এখন সন্ধ্যাবাসর বালি-ধূসরিত
দুহাত নিঃশেষিত
অন্ধ খাড়া অবাঞ্ছিত তবু ঘুমটা অজানা
অবাক-করা ক্লান্তি আমার, পায়ে ক্ষত পোড়ার
কেউ নেই তো দেখা করার।
পুরনো শুনশান রাস্তা মড়ার মত শুয়ে, যেন স্বপ্ন দেখাও মানা।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
তোমার যাদু-দোলের নায়ে একবার নাও আমায় উঠায়ে
আমার হৃত অনুভূতি আমার হাত ভুলেছে মুঠি
পায়ের আঙুল চাইছে ছুটি,
দাঁড়াও, বুট-গোড়ালিই ভরসা এখন হাঁটতে কদম-পথ
যাব যে কোন জায়গায়, মিলিয়ে যাব অজানায়
আমার নিজস্ব যাত্রায়
দেখাও তোমার নাচের চলন-- শিখবই, শপথ।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
হয়তো তুমি মাঝে মধ্যে
দেখেও থাকবে বহাল রৌদ্রে ছুটোছুটি হাসি মজা গান
তাতে নেই তো আমন্ত্রণ ,
সে সব নিছক পলায়ন
লক্ষ্য আকাশ নেই যেখানে বেড়ার অসম্মান।
যদি শোনে তোমার কান অস্পষ্ট ছড়ার গান,
তোমার খঞ্জনিটার কাছে
মিথ্যে কাঙাল জোকার নাচে; আমার নেই যে তাতে মন।
তুমি দেখেছ যা ছায়াবাজির ব্যর্থ অনুসরণ।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
তারপর, নাও আমায় লুকিয়ে মনের ধোঁয়ার বৃত্ত দিয়ে
কুয়াশা-ধ্বংস-কাল পেরিয়ে চলো সাগরতীরের হাওয়ায়
হিমে-জমাট পাতার কাঁড়ি
ভূতে-পাওয়া গাছের সারি
দুঃখের কামড়-মোচড় ভারি ফেলে যাব চলে দূরের ইশারায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হীরের আকাশতলায় সাগরপটে, তটরেখায়
সোনা-বালির চবুতরায় হবে হাত দুলিয়ে নাচ
সব ভাগ্য, স্মৃতির রাশি হোক তরঙ্গে বানভাসি
আগামীকাল আসার আগে ভুলতে দাও না আজ।।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।

**(বব ডিলানের ‘মিঃ টাম্বুরিন ম্যান’ অনুসরণে)
................................................
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Though I know that evenin's empire has returned into sand,
Vanished from my hand,
Left me blindly here to stand but still not sleeping.
My weariness amazes me, I'm branded on my feet,
I have no one to meet
And the ancient empty street's too dead for dreaming.
Bringing It All Back Home
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Take me on a trip upon your magic swirlin' ship,
My senses have been stripped, my hands can't feel to grip,
My toes too numb to step, wait only for my boot heels
To be wanderin'.
I'm ready to go anywhere, I'm ready for to fade
Into my own parade, cast your dancing spell my way,
I promise to go under it.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Though you might hear laughin', spinnin', swingin' madly across the sun,
It's not aimed at anyone, it's just escapin' on the run
And but for the sky there are no fences facin'.
And if you hear vague traces of skippin' reels of rhyme
To your tambourine in time, it's just a ragged clown behind,
I wouldn't pay it any mind, it's just a shadow you're
Seein' that he's chasing.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Then take me disappearin' through the smoke rings of my mind,
Down the foggy ruins of time, far past the frozen leaves,
The haunted, frightened trees, out to the windy beach,
Far from the twisted reach of crazy sorrow.
Yes, to dance beneath the diamond sky with one hand waving free,
Silhouetted by the sea, circled by the circus sands,
With all memory and fate driven deep beneath the waves,
Let me forget about today until tomorrow.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.

Sunday 4 December 2016

শুদ্ধ প্রকল্প ---------------------------------------পলাশকান্তি বিশ্বাস

শুদ্ধ প্রকল্প
--- পলাশকান্তি বিশ্বাস
ব্যাংক বলে টাকা নেই, এটিএম বন্ধ।
ফিসফিস, গুঞ্জন, ফিশিফিশি গন্ধ।
কার ঘাড়ে কোপ প’ল, পোয়াবারো কার ?
কেউ বলে ত্রাহি ত্রাহি--- এবারটি ছাড়।
কেউ বলে ঠিক ঠিক, কেউ বলে ধিক !
কারো ক্ষতি কম কিছু, কারো বা অধিক।
কেউ বলে, মেনে নিই কিছু লোকসান
অসাধুর ঘরে যত পাহাড়-প্রমাণ
কালাধন গচ্ছিত, হোক উদ্ধার --
ঘুরপথে জোটে যদি কিছুটা আমার।
অসাধু মুচকি হাসে, কচুপোড়া খা গে,
পোড়া যে কপাল তোর, সামলে নে আগে।
ভাবিস আমার কথা কিছুদিন গেলে--
আমি তো খাচ্ছি মাছ ভেজে মাছ-তেলে।
ছিল বা কতটা তোর ? --- তিন-আনি পাই !
তাই নিয়ে কেঁদে যাস ধানাই পানাই ।
আমি তো কোটির শোক করিনি কখনো,
আসলে তো মাটি সব যেভাবেই গোনো।
ঝটকায় গেল যেটা ঝটকাতে আসবে
তোদের মতন কিছু অকারণে ফাঁসবে।
এটিএম, পেটিএম, প্লাস্টিক মানি
মন্ত্রীর পেটে যা তা সবকিছু জানি।
মগজটা ট্যাড়া তাঁর, ‘সাফা সাফা’ বলে
মাঝরাতে ঝ্যাঁটা হাতে ঘোরে জঙ্গলে।
ময়লা বা ছেঁড়া-ফাটা নকলি বা কালো
হঠাৎ ইচ্ছে, সাইক্লিং বিনে ঢালো
সব শ্বেত-পারাবত শান্তি-আকাশে
যে পারো যতটা ধরো, নয় মরো ত্রাসে।
আমরা দিব্যি আছি বড় বেওসায়ী,
হা-ঘরে জনতা রাতারাতি ধরাশায়ী।
ইন্ডিয়া শাইনিং চিরকাল রবে
ভাবি, ওহে ভারতীয়, তোদের কী হবে।
তোরা থাক তোরা হয়ে, থাক কুঁড়েঘরে
আমরা আমরা থাকি আকাশশহরে।
প্রোমোটার তাল বুঝে খেদাল শ্রমিক,
রেস্তোরাঁ মাড়ায়না প্রেমিকা-প্রেমিক।
টাকা আছে, টাকা নেই মুশকিল ধাঁধা!
একশো’র পায়ে পড়ে দুহাজারি দাদা।
কোথা কালো, কোথা সাদা, কে বেড়ায় মেপে!
বাজারের গলা যেন ধরেছে কে চেপে!
ক্রেতা নেই বলে কাঁদে দোকানি-বাজারি
ক্রেতার কাতরধ্বনিঃ আছে দু-হাজারি!
হাজারপকেটী নেতা ফুলোচ্ছে গাল
আহা কী নেতা রে আমি, তিল থেকে তাল
তাল কেটে বেপরোয়া গমক-ঠমক
দ্যাখো রে দ্যাখো রে চাল, বেতাল-চমক!
ছত্রিশ ইঞ্চির বুক ঠুকে মন্ত্রীঃ
মিথ্যে চেঁচাও বাপু জন-গণতন্ত্রী !
প্রধান করলে যদি, সব সিদ্ধান্ত
আমাকেই নিতে দাও, থাকো চুপ শান্ত।
বিদেশে যা গচ্ছিত আনিব রে দেশে
বলে বলে শেষমেশ গিয়েছি তো ফেঁসে।
বিদেশের পারিনি যা, দেশের তো পারি!
কিরকম ভেবে ভেবে সকলের হাঁড়ি
হাটের মাঝারে এনে ফাটিয়ে দিলাম !
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলো সবে, বলো রাম রাম।
বেওসায়ি বেরাদার--- তাদের যা ঋণ
আগেই মকুব আহা, পথ মসৃণ।
বেকুব জনতা, বাছা, পঞ্চাশ দিন
থাক না সিকিটা খেয়ে প্রতিবাদহীন।
এমনি তো আধপেটা সারাটি বছর;
কটা দিন দেশপ্রেমে--- মরেও অমর।
দেখিস না কিরকম সীমান্তে-মাঠে
শ্রমিক-সেনারা সব বেমালুম খাটে !
দেশপ্রেম খাঁটি কিনা বোঝা যায় কিসে?
নেতার আদেশে যদি মুখ দাও বিষে
তবেই তো খাঁটি তুমি, মিনিমিনি পুষি!
দেশপ্রেমে ভোট বাড়ে, আমরাও খুশি।
সীমান্তে মরে সেনা বিনা প্রতিবাদ
তোমরাও নাও যদি তার কিছু স্বাদ
তবে তো পূর্ণ হয় ষোল-বিশ কলা
না হলে মহান দেশে কমে শৃঙ্খলা ।
শৃঙ্খলা শৃঙ্খল যত বাড়ে, বেশ তো
শাসকের ঘুম জমে, বাড়ে কিছু রেস্তও।
এতকাল মনে মনে যা রেখেছি পুষে
নিন্দুকে বলে কি না সব রাক্ষুসে!
ঘরে ঘরে ফেরি করি দেশপ্রেম-খেলা
অবোধ বোঝে না কিছু, শুধু অবহেলা।
সেনা পাক, পাকসেনা বলি যতবার
দেশজুড়ে হাততালি, ভাবের জোয়ার।
সে জোয়ার-মন্থনে তুললে মাখন
তোদের কি এসে যায়?--- বড় জ্বালাতন!
কিছু জ্বালা সকলের হবে সেটা জানা
তাবলে প্রেমের মালা, ভেট-নজরানা
স্বদেশ ও বিদেশের শিল্পপতিরা
দিচ্ছে যা নেব না কি? সব শিরঃপীড়া
বলে দূরে ছুঁড়ে দেব, নেব না গলায়
শুধু কি গরীব ভজে থাকব তলায়?
ভুবন তো গ্রাম এক। সে গ্রামের যত
ধনী আছে ডাক পাড়ি প্রেমসম্মতঃ
ভাইয়োঁ বহনোঁ, আনো তোমাদের ধন
আমাদের দেশে ঢালো বীজের মতন
কোটি কোটি লোক আছে – সোনাফলা মাঠ
দশগুণ ফিরে পাবে, বিনা বিভ্রাট।
প্রাচীনসভ্য, বড় উদার প্রজাতি
একবার কর যদি ছোট খয়রাতি
আজীবন কৃতজ্ঞ বংশানুক্রমে
তোমারো মুনাফা দ্যাখো কত ওঠে জমে।
বেওসার নামে করো শোষণ-শাসন
পদেপদে নাফা, নেই বিরোধাচরণ।
আমিও মসীহা বেশ, নয়া অবতার
মন-কি-বাত ধর্ম করছি প্রচার
আধুনিক যুগ, হতে হবে আধুনিক,
নোট ছেড়ে দ্রুত ধরো মানি প্লাস্টিক।
এটিএম, পেটিএম, স্মার্টফোন ধরো
ডিজিটাল হয়ে বাঁচো, ডিজিটাল মরো।
স্লোগানে স্লোগানে ভরি দেশের বাতাস
ও আমার ভাই-বোন নাও নয়া শ্বাস
গ্লোবাল ভিলেজ মানে বহু সম্ভাবনা
যুবক যুবতী পাবে হাতে হাতে সোনা
রামরাম নামে করি স্বপ্নের ফেরি
মাঝে মাঝে হুঙ্কার— বাজে রণভেরি
আমার স্বদেশ জেনো স্বভাবে মহান
অতিথিকে দেব ভাবি, দেব সে প্রমাণ।
নাও বাবা লুটে নাও ধন-মান-প্রাণ
গরীব না থাকে দেশে--- ধৌত শ্মশান।
স্বচ্ছতা-অভিযান শুদ্ধ প্রকল্প,
হাজার বছর পরে শোনাবে তা গল্প।
.....................

Thursday 1 December 2016

বাংলাদেশ-----------------------সৈকত ব্যানার্জি

বাংলাদেশ

লিখেছেন সৈকত ব্যানার্জি।
প্রকল্প ১
বাংলাদেশ আমার জাতিপ্রীতির মোক্ষম নমুনা। হলাম না হয় আলাদা দেশ। তবু একই রাণীর দুই রাজপুত্তুর বটে। বাংলাদেশ আমার বাঙালিয়ানার গদগদ প্রতীক।পদ্মা মেঘনার জলে আমার মানস সাঁতার, জারুল হিজল ছুঁয়ে আসা বাতাসে আমার ফিনফিনে ভালো লাগা, বাপ-পিতেমোর আদিবাড়ির অলৌকিক টান রক্তে মিশিয়ে নেওয়া, আর ওই ভাষা দিবসের সাতসকালে সারা বছরে নাক সিঁটকে রাখা ভাষাতেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। রাগ করেন না কত্তা, বাংলাদেশ আমার এক সপাট ন্যাকামো।
প্রকল্প ২
বাংলাদেশ আমার চোখে পাকিস্তানের ছোট ভাই। গিজগিজ করছে মুসলমান। দাড়ি, টুপি, কোরাণ আর হুমায়ুন আহমেদ। উফ!… এই এই এই। নো নো। নো মোর ট্যক। জানো না ওরা সবকটা সন্ত্রাসবাদী! এক্ষুনি চাপাতি কিংবা সুইসাইড বোমে পিণ্ডি চটকে রেখে দেবে।
প্রকল্প ৩
বড় ভাইয়ের প্রতি ঘেন্না ঘেন্না খেলায় ছোট ভাই আবার আমার দোসর। সেই ৭১ এ পাকিস্তানকে যা এক হাত নিয়েছিল না! অবশ্য আমাদের দেশব্রতী, উদার, ভোলেমন সেনা জওয়ানরা নেহাত ছিল তাই! তা সে উপকারের দক্ষিণা নিতেই তো ওই বাংলাদেশ বর্ডারে আমাদের সেনারা, ওই আর কি…নিন্দুকেরা  কি সব বর্ডার রেপ টেপ বলে যেন। যত্তসব বাজে কথা। রাতবিরেতে একটু বাই উঠতে পারে না নাকি মানুষের! বেচারারা ঘরদোর ছেড়ে অত্তদূরে থাকে… কি আর করবে!
হাতের কাছে সুবর্ণ সব সুযোগেরা আছে। তাই আরো খান কতক প্রকল্প চাইলেই বানিয়ে নেওয়া যায়। কোন প্রকল্পে বাংলাদেশ আমাদের অতিরিক্ত কাছে চলে আসে, এতটাই কাছে যে আলাদা করে আর চিহ্নিত করতেই পারি না। ওটা যে আলাদা একটা দেশ, আমার থেকে স্বতন্ত্র তার যে একটা গতি আছে, রক্তাক্ত একটা ওঠাপড়ার ইতিহাস আছে তা আমার আর চোখেই পড়ে না। অথবা,  কোন প্রকল্পে বাংলাদেশ হয়ে যায় ওপারের ‘ওরা’। তখন আমি আশঙ্কিত। আমার নিরাপত্তার বলয়ে  তখন ঘনিয়ে ওঠে সন্দেহ। কাঁটাতারের সীমান্তটা নড়বড়ে লাগে। আগলে রাখতে অক্ষম মনে হয় আমাকে।
বাংলাদেশকে কাঁটাতারের এপার থেকে, এই অশিক্ষিত – অদীক্ষিত চোখ নিয়ে কিভাবে দেখব তবে? মানে নেহাত ওই ভাব-গদগদ আধবোজা চোখ নিয়ে যদি না দেখতে চাই আর কি। তা দেখতেই বা হবে কেন? দিব্যি তো চলছে রসে বসে। বাংলাদেশের ধম্মকম্ম, সাহিত্য, রাজনীতি কিংবা ক্রিকেট এসব কিছুর থেকেও বেশি খোঁজ তো অন্য কিছুর চলতে দেখা যায়। সেটা বাংলাদেশি পর্ণ ভিডিও সার্চিং এর রমরমা দেখলেই দিব্বি ঠাওর হয়। তবু নাছোড় কতকগুলো পরিচয় সেই মোক্ষম মুহুর্তের দৃশ্যেও জুড়ে থাকে যখন, তখন ভয় লাগে। পর্ণ সাইটে মেয়ে শরীর চেখে দেখতে দেখতেও ধর্মের টাকনাটা যখন মুখরোচক হয়ে ওঠে, যখন সায়া ব্লাউজ সালোয়ারের আধা নগ্নতার সঙ্গে সঙ্গে সাপটে থাকে ‘মুসলমান মেয়ে’ কিংবা ‘মালাউন বউ’ এর ধর্মীয় ট্যাগ, তখন খোশমেজাজি তোফা বাংলাদেশকে নিয়ে ন্যাকামো না করে একটু ছরে কেটে ঘা হয়ে থাকা বাংলাদেশটার দিকে তাকানোটা জরুরী হয়ে যায়। এপারের হিন্দু মৌলবাদের কথা বললেই যখন যুক্তি হিসেবে উঠে আসে ওপারের ইসলাম মৌলবাদ, ব্লগার হত্যা, ধর্ষণ, আর লাগাতার হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ তখন যন্ত্রণা হয়। মনে হয় বাংলাদেশ যেন সেই আধ লেখা অসমাপ্ত একটা কবিতা হয়েই রয়ে গেছে, যার প্রতিটি লাইন আমরা যে যার প্রয়োজন মতো ব্যাখা করে নিচ্ছি।
আচ্ছা কোথায় তাকাই তবে বাংলাদেশকে খুঁজতে হলে?  বাঁদরের পিঠে ভাগ হওয়া মানচিত্রের দিকে? একুশের ভাষা আন্দোলন আর তার শহীদ তালিকার দিকে?  শহীদের স্মৃতিতে গড়ে ওঠা মিনারের দিকে?  সে তাকানোয় কোন পূর্ণতার হদিশ আর আজকে মিলবে? সেই হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন না, যে কাফনে মোড়া অশ্রবিন্দুর মতো শহীদ মিনার, সকলকেই আজ যেতে হয় সেখানে, শাসককেও যেতে হয়। ভোটবাক্সের স্বার্থ, জনআবেগের চাপ সকলকেই বাধ্য করে সেখানে যেতে। ‘ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে মনে ঘেন্না করে এ-অশ্রুবিন্দুকে, কিন্তু ফুল নিয়ে না এসে পারে না’।
তবে কি ৬৯ এর আন্দোলন? ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ?  জাতীয়তাবাদের প্রবল ঝলকানি সেখানে ঢেকে রেখেছে যাবতীয় বাঁকাচোরা গলিঘুঁজি।এত আলো,  এত্তো আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু তারপর?  আলোর উৎস থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসে অন্ধকার। ৭১ থেকে ৭৮এর সেনা অভ্যুত্থান, হত্যা,গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে হাত বদল হতে হতে শেষে ক্ষমতা গিয়ে পড়ল এরশাদের হাতে। পাকিস্তান প্রত্যাগত, স্বৈরাচারী এরশাদ। মৌলবাদ পেশী ফুলিয়ে উঠে দাঁড়াল সে আমলে। ৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শাসন কাঠামোকে হাসান আজিজুল হক বলেছেন, রীতিমত রপ্তানি করার যোগ্য ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার’। আর তারপরের অংশ? ৯০ এ না হয় স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে এল গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্রের সেই জয়ে দুহাত তুলে নাচার আগে পায়ে যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকছে হাসান আজিজুল হকেরই আশঙ্কিত প্রশ্ন, গ্যাংগ্রীন ছড়াচ্ছে,
“….. আজ কারো কারো কি মনে হচ্ছে বর্তমান গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনায় স্বৈরাচার আর একটু গণতান্ত্রিক ছিল?”
মাইল মাইল ছড়িয়ে আছে ভিজে মাটি। নরম নদী আঁকিবুঁকি কেটে রেখেছে তাতে। মাঠে মাঠে বোনা হচ্ছে ধান। নৌকাও বুঝি ভাসছে দু এক খানা। এমন পেলব দৃশ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা আবহ সঙ্গীত হিসেবে ভালোই জমত। কিন্তু খটকা যতই লাগুক মিউজিক তো খানিক উলটে পালটে গেছেই। কানে এনতার সুড়সুড়ি দিচ্ছে ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’। পাকিস্তানের দিকে ফিরতি টান আজ কোথাও চোরাগোপ্তা, কোথাও বা বেশ স্পষ্টই। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পরিচয় বানানোর চেষ্টায় আর. এস. এস. আর জামাত এমনিতে ভাই ভাই। ধর্ম দুটোর নাম আলাদা এটুকুই যা ফারাক। আর ইসলামই যদি হবে আমার আসল পরিচয় তবে ইসলামের পুণ্যভূমি ‘পাক-ইস্তান’ই বা আমার থেকে আলাদা থাকে কেন?  মুক্তি যুদ্ধের যে চেতনা মাতিয়ে দিয়েছিল ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল, আজ সে মাতমের ওপর ভণভণ করছে ধর্মের মাছি। আর ধর্মের কলেরা একবার ছড়ালে তা কতদূর কুৎসিত রূপ নিতে পারে তা বাবরি আর গুজরাট দাঙ্গার পর আর বলতে লাগে না বোধহয়। তবু এ রোগ ছড়াচ্ছে। শুধু  সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার নয়, ধর্মীয় মৌলবাদের চিরায়ত লক্ষণ যে কোন যুক্তিবাদী, মুক্ত চিন্তার ওপর আঘাত আনা। সেখানে পাস্কালের যুক্তিকে নাস্তিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করায় অভিজিৎ ও যেমন রেহাই পায়না, তেমনি হুমায়ুন আজাদের হত্যাকারীর ও হদিশ মেলেনা কোনো।
ধর্মও খুঁজে নেয় যোনীদেশ। খুঁজে নেয় বিধর্মীর লিঙ্গ পরিচয়। ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়ের সাথে ‘মেয়ে’পরিচয় যখন মিশে যায় তখন আক্রমণটা যোনীতেই গিয়ে ঠেকে। জেহাদের সে উল্লাস আমরা দেখতে পাই ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসে, দশজন জেহাদি যেখানে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় দশ বছরের শিশুকন্যার ওপর। আর সেই ‘মালাউন’ মেয়ের মা শুধু অসহায় অনুরোধটুকুই করতে পারে তাদের, “হুজুর, আমার মাইয়াডা কচি, আপনেরা একজন একজন কইর‍্যা যান। একলগে মাইরেন না হুজুর।” উদাহরণের ভার বাড়াতে চাই না। ছোবলের পর ছোবল খেতে হবে তাতে। শুধু এটুকুই বলি উদাহরণ চয়নে আমিও কিঞ্চিত পক্ষপাতী হয়ে উঠেছি। নয়ত আমার হাতের কাছেই খোলা ছিল হুমায়ুন আজাদেরই আরেক উপন্যাস ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’। যেখানে ময়নাকে ধর্ষণ করতে করতে সাদ্দাম তার সঙ্গীদের বলে “মালাউন মাইয়াগুনিও এইডার কাছে কিছ না”। আর আলতাপ বলে “আমরা ইসলামিক নাশালিজম কায়েম কইর‍্যা ছারুম।” সে ‘ইসলামিক নাশালিজম’-এর হাত থেকে হিন্দু কিংবা মুসলমান মেয়ে কারুরই রেহাই নেই।
এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের এক বড় অংশের প্রকল্পের গলদ। যে গলদ প্রতিদিন পাল্টে দিচ্ছে আমার বিবেচনার ভঙ্গী। প্রতিবেশীকে দেখার আন্দাজ। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের কথা শুনছি। তাদের যন্ত্রণার ভাষ্য পড়ছি। আর রাগে ঘেন্নায় থুতু ছেটাতে ছেটাতে মেপে নিচ্ছি আমার পাড়ার রহমন চাচাকে, যিনি এই ভারতবর্ষের নিরিখে সংখ্যালঘু। যাঁকে ঘরের ফ্রিজে মাংস রাখার আগে চিন্তা করতে হয় গোমাংস রাখার ‘অপরাধ’ তার ঘরে কোন গুজরাট ডেকে আনবে। আর্টিজান রেস্তরায় হামলার পর আমরা গোটা বাংলাদেশের সমস্ত মুসলমানকে চিনতে শিখছি সন্ত্রাসবাদী বলে। অথচ সেই ছেলেটিকে ভুলে যাচ্ছি, যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বন্ধুদের ছেড়ে রেস্তোরা থেকে পালায়নি। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হয়েছে। ধর্মে সেও মুসলমানই ছিল। আর তারও দেশের নাম বাংলাদেশ। ‘সমস্ত সন্ত্রাসবাদী মুসলমান’। আর সন্ত্রাসবাদের হাতে খুন হওয়া বিপুল পরিমাণ মানুষ? মুসলমান নন তারা?  ক্ষমা করবেন স্যার, আমি একটা গোটা ধর্মের সমস্ত মানুষকে সন্ত্রাসী বলে ট্যাগিয়ে দিতে পারছি না। আমার সামনে ভেসে উঠছে ‘সংসপ্তক’ এর সেকেন্দার মাস্টারের মুখ। ভেসে উঠছে গালিবের কবিতা। মহম্মদ রফির গলা। আর আমার একলা চিলেকোঠার বিপ্রতীপে ক্রমশ হরাইজেন্টালি বাড়তে থাকা হাড্ডি খিজিরের দল।
তবে কোন প্রত্যাশা নিয়ে তাকাবো আমরা বাংলাদেশের দিকে? আস্থা রাখব কোথায়? আবুল ফজল কথিত মানবতন্ত্রে? চিলেকোঠা থেকে কোন উন্মাদ বেরিয়ে আসায়?  হেলাল হাফিজের মিছিলগামী যৌবনের স্পর্ধায়?  জানি না। দিকনির্দেশ করা সমাজবিপ্লবীর কাজ। আমার সাধ্য নয় তা। আমি শুধু অপার যন্ত্রণা নিয়ে সেই বাংলাদেশের ছেলেটার দিকে তাকাতে পারি। আর্টিজানের সন্ত্রাসের পর প্রতিটি মুসলমানকে সন্ত্রাসবাদী জেনে কোতল করার নিদান দিচ্ছি যখন আমরা, সেই ছেলেটি তখন ফেসবুকে একের পর এক লিঙ্ক শেয়ার করে চলেছে, কত কত কত মুসলমান মানুষ খুন হয়েছে এই ইসলাম মৌলবাদীদের হাতে। বাংলাদেশে। গোটা বিশ্বে। যেন চিৎকার করে বলে চলেছে, দেখুন আমি প্রতিদিন মরে মরে প্রমাণ করছি আমি সন্ত্রাসবাদী নই। আমি কোন সংখ্যালঘুকে ঘৃণা করি না। আমার জেহাদ নেই। শুধু বাংলাদেশ আছে।

Sunday 20 November 2016

প্রসঙ্গ;কালো টাকা,চমকের রাজনীতি ------------------- কল্যাণ সেনগুপ্ত

চমকের রাজনীতির শিকার গোটা দেশ -কল্যাণ সেনগুপ্ত।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটিও বোধকরি অতীতে কখনো নোট বাতিলের ফলে এমন দুর্ভাগ্যের ও উদ্বেগের শিকার হন নি, যেমনটি এবার হচ্ছেন। এমন অবিবেচক, এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রধানমন্ত্রী দেশবাসী এর আগে দেখেনি। প্রথমেই একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। প্রচন্ড ভিড় এড়াতে প্রথম দুদিন ব্যাংকমুখো হবার সাহস পাইনি। তৃতীয় দিনে গিয়েও ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরতে হলো। চতুর্থ দিনে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অনেক কষ্টে সাকুল্যে দশ হাজার পাওয়া গেল, কিন্তু তার মধ্যে চারটি 2000এর নোট, বাকিটা 100 । এবার বলুন, কোন বাজারে দু-চারশো টাকার মাল কিনলে 2000এর নোট ভাঙিয়ে দেবে? এখন আমাকে বাধ্য হয়ে সবার দয়া ভিক্ষা চাইতে হবে। এই পরিস্থিতি যে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অসহনীয়। আমার মতো অনেককেই অসৎ না হয়েও এমন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এভাবে আরো কতদিন চলবে বোঝা যাচ্ছে না আদৌ। প্রথম দিকে অরুনhim জেটলি বলেছিলেন- এইসা ঘাবরানেকা কুছ নেহি, দো-চার দিনমে সব কুছ সামান্য হো জায়েগা। এখন আবার শুনছি 15/20 দিন। মোদীজি মাঝে বললেন- মুঝে পাচাস দিনকা সময় দিজিয়ে, ম্যায় এক নয়া ভারত সবকো দেঙ্গে। কতদিনে এই সমস্যা শেষ পর্যন্ত মিটবে কেও নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা। উল্টে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, পরিস্থিতি ক্রমশঃ আরো খারাপ হবে। সবাই একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বাজারে পাঁচশর নোট নেই আর একশোর জোগানও সামান্য। নোট বাতিলের আগে এর প্রয়োজনীয় যোগানের কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্য ও দৈনিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে সেই বিষয়টিকেও কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কোনো দায়িত্বশীল সরকার যে এমনটা করতে পারে, তা প্রায় অকল্পনীয়। এই অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা ঢাকতে এখন দেশপ্রেমের দোহাই দেওয়া হচ্ছে এবং যারাই এবিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে, তারা নাকি সব দেশদ্রোহী। এই জবরদস্তি উচ্চকিত দেশভক্তি কি ফ্যাসিজমের পদধ্বনি নয়! ইতিহাস কিন্তু সেই আশঙ্কার কথাই বলে।
একবার এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত বলেছিলেন- এটা গণতন্ত্রের যুগ। কিন্তু বিভিন্ন রকম আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখাও এক বড় সংগ্রাম। আমাদের আশেপাশে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বেশ নড়বড়ে। যদিও আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ভিত বেশ সুদৃঢ়। এখানে বহু ধর্মের মানুষ, বহু ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে একত্রে শান্তিতে বাস করছে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে অবলম্বন করে। এখানে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ঠাঁই নেই। রাজনীতি বা সেনাবাহিনীর যে কেউ হোক, স্বৈরতন্ত্রঈ হয়ে উঠতে চাইলে মুশকিল হচ্ছে, তিনি যদি উত্তর ভারতের মানুষ হন তবে অচিরেই দক্ষিণের প্রায় সবাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, আবার দক্ষিণের হলে বিদ্রোহ করবে উত্তরের মানুষ। ফলে এখানে স্বৈরতন্ত্রের সফল হবার আশা নেই। কিন্তু কখনো কারো মাথায় যদি ভুত চাপে তখন আর অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা থাকেনা। যেমনটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মাথায় চেপেছে, আশঙ্কা হচ্ছে। নইলে কোনো দায়িত্বশীল সুস্থমস্তিস্কের মানুষের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব নয়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেও যদি তিনি কোনো বাধা না পান বা পার পেয়ে যান, তাহলে কিন্তু আগামী দিনে দেশকে আরো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা ছেড়ে দিলেও শুধুমাত্র দৈনিক ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেনে ইতিমধ্যেই কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে, তা আন্দাজ করলে শিউরে উঠতে হয়। আগামীদিনে কিন্তু সব হিসেব নিকেশ করতেই হবে। এই পদক্ষেপের ফলে কতটা লাভ হলো আর কতটা ক্ষতি, তারও হিসেব। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পঞ্চাশ দিন পরে অর্থাৎ 2017তে তিনি নতুন ভারত উপহার দেবেন। নতুন ভারত বলতে কি কালোটাকা, নকল টাকা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত ভারত? তাহলে বলতে হয়, এটিও তবে ওই '১৫ লক্ষ প্রত্যেককে' এর মতোই আর একটি ধাপ্পা। বর্তমান অবস্থায় দেশকে সম্পূর্ন কালো টাকা মুক্ত করা অসম্ভব। কারণ ধনীদের থেকে 100% কর আদায় প্রায় অসম্ভব। কর বহির্ভুত অঘোষিত টাকাই হচ্ছে কালো টাকা। সবাই যে সে টাকা ঘরের মধ্যে থরেথরে সাজিয়ে রাখে, এমনটা নয়। বিদেশে পাচার করে, সোনা কিনে মজুত করে, রিয়েল স্টেটের ব্যবসা ইত্যাদিতে লগ্নি করে। নোট বাতিলের ফলে কালোটাকার একটা ক্ষুদ্র অংশ হয়তো নষ্ট হবে বা ধরা পরবে। তবে হ্যাঁ, নকল টাকার ক্ষেত্রে সাময়িক সুফল পাওয়া যাবে। তবে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বড় চালু নোটের নকল আবার চালু হবে। চালু হবে সন্ত্রাসও। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি কোনো পদক্ষেপই নয়। সম্প্রতি গুজরাটেও দুলক্ষ টাকার অধিক ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং সেই ঘুষে সবই ছিল নতুন দুহাজার টাকার নোট। কোথা থেকে এল এত দুহাজারের নোট, সেও এক রহস্য! অর্থাৎ সর্ষে ভুতের সক্রিয়তা এতটুকু কমেনি, আর দুর্নীতিতো দূরস্থান।
আজ একথা প্রমাণিত যে, যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়েই এই নোট বাতিলের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাকে বলা যায়, রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি। এমনটি আমাদের দেশে অতীতে কখনও হয়নি। এর মধ্যেও সারাদিন লাইন দিয়ে যারা টাকা পাচ্ছেন, তাদেরকেও 80% ₹2000 নোটেই দেওয়া হচ্ছে জবরদস্তি। মনে হচ্ছে যেন, ₹2000 নোট চালু করতেই এই ₹500 ও 1000 নোট বাতিল করা হলো। বর্তমানে এই ₹2000 নোট সাধারণ মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্তটি নাকি ঐতিহাসিক, এর ফলে নাকি ধনী ও দারিদ্রের ব্যবধান কমবে! এসব অবান্তর দাবি করা হলেও অর্থনীতির কোনো পন্ডিত কিন্তু এর সপেক্ষে মুখ খোলেননি। অপরদিকে অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, স্বামীনাথন আইয়ার বা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতির বিশিষ্ট মানুষেরা বরং আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন। মনমোহন সিং শুধুমাত্র কংগ্রেস নেতা নন, তিনি একজন অর্থনীতির পণ্ডিতও বটেন। তিনি নিজের অতীত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেছেন, আমি যখন নরসীমা রাও মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হয়ে আসি, তখন আমার মনে হয়েছিল অতিশীঘ্রই কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। কিন্তু নরসীমাজি আমাকে বলেন, এটা ভারতবর্ষ। এখানে কিছু করতে হলে প্রথমেই ভাবতে হবে দেশের সুদূর প্রান্তে উঃ পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্রতম মানুষটির কথা, তার যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সেসব ভাবার প্রয়োজন মনে করেন নি। তিনি বিশ্বাস রাখেন সাফল্যের বাজিতে, চমকের রাজনীতিতে।

রোহিঙ্গারা নিখিল বাঙালির অংশ ------------------------গোলাম কিব্রিয়া

         একটা জনগোষ্ঠী হরেদরে অপরাধপ্রবন হয়না। আনরুলি নেটিভ, লেজি নেটিভ এগুলো কলোনাইযারদের কয়েন করা টার্ম। গভর্নমেন্টালিটির স্বার্থে তারা এটা করতো। বঞ্চনা, রেইসিজম ইকোনমিক সেগ্রিগেশন থেকে দরিদ্র মানুষ ইনফর্মাল ইকোনমিতে জড়িয়ে পড়ে, ব্ল্যাক মার্কেটে অংশী হয়। ইউরোপীয়ান ঘেঁটোতে, নিউইয়র্কের হার্লেমে, আগারগাঁও বস্তিতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বেশী হয়, কারন তারা ইকোনিমিক মেইনস্ট্রিমে আসতে পারেনা। পভার্টি ও ক্রাইম কো-রিলেটেড। রোহিঙ্গারা ততটুকুই অপরাধপ্রবন যতটুকু বাঙালীরা, তারা ততটুকুই শান্তিপ্রিয় যতটুকু বাঙালীরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যদি কয়েক বছর প্রলম্বিত হত, তাহলে ত্রিপুরা, কলকাতার বাঙালী শরনার্থী ক্যাম্পগুলো থেকে মাদক বিক্রি হতো। এটাই স্বাভাবিক, ব্যাতিক্রম না।
মায়ানমারকে পশ্চিমারা বেশী প্রেশার দেবেনা কারন তারা মার্কেট খুলে দিয়েছে রিসেন্টলি। তাদের ন্যাচারাল রিসোর্সে এখন চীনের সাথে পশ্চিমারা ও ভাগ পাবে। সেমি-গণতান্ত্রিক মিলিটারি সরকার এথনিক ক্লিনজিংয়ে বিশ্বাসী। রোহিঙ্গাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, জাতিসংঘ ও তাদের নেবেনা। আমরা সীমান্ত খুলে দিতে পারি এবং তারপর পশ্চিমাদের সাথে দেন দরবারে যেতে পারি তাদের ভরনপোষনের ব্যাপারে। জাতিসংঘ নৈতিক সংকটে আছে, এই অস্বস্তি কাটাতে তারা একটা থোক বরাদ্দ দিতে রাজী হওয়ার কথা। এটা কঠিন কোন বিষয় না, কঠিনতর হচ্ছে ইন্টিগ্রেশন। ইন্টিগ্রেশন একটা পেইনফুল ও প্রলম্বিত প্রসেস। এর মাঝখানে তারা ইয়াবাসম্রাট ও পূর্ববাঙলার এসকোবার বদি ভাইয়ের মতন সরকারের স্নেহধন্য লুটেরাদের দ্বারা ব্যাবহৃত হবে, যেটা পিউরলি আইন শৃঙ্খলার প্রশ্ন, বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কুফল। একটা মার্জিনাল, মানবেতর জীবন যাপন করা, পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে এর জন্য দায়ী করা ভিক্টিম ব্লেইমিং। পশ্চিম যখন সিরিয়ান রিফিউজি নিতে অস্বীকার করে, তখন তারা এই যুক্তি দেয় এবং আমরা তার প্রতিবাদ করি।
রোহিঙ্গারা নিখিল বাঙালী জাতির অংশ। মগ দস্যুদের সময়ে, ব্রিটিশ রাজের সময়ে তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দাস হিসেবে। বিখ্যাত বাঙালী কবি আলাওলকে ও কিশোর বয়সে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো দস্যুরা। পূর্ববাংলা ছাড়া ও বাঙালীরা পশ্চিম বাংলায় আছে, ত্রিপুরায় আছে, আসামে আছে, আরাকানে আছে, পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ডায়াসপোরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাস্ট্র ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু দেশ এক। যতটুকু দূরত্ব হলে গণহত্যায় নির্বিকার থাকা যায়, ততটুকু দূরত্ব আমাদের সাথে রোহিঙ্গাদের নেই। আমাদের আত্মীয় তারা।
রোমান আফ্রিকাতে টেরেন্স নামে একজন দাস ছিলেন, যিনি নিজেকে টেরেন্স দ্যা আফ্রিকান বলতেন। স্ব-উদ্যোগে তিনি গ্রীক শিখেছিলেন এবং গ্রীক ক্লাসিক্যাল টেক্সটগুলো ল্যাটিনে অনুবাদ করতেন। দাসেরা সেইসময় প্রকৃতার্থেই দাস ছিলেন, উপমার্থে না। পশুসম্পদের মতই মালিকদের সম্পত্তি ছিলেন তারা। মানুষের মতন দেখতে একটা সাব হিউম্যান জীব। এই পরিমান লাঞ্ছনার মাঝে থাকার পরে ও টেরেন্স বলেছিলেন, "নাথিং হিউম্যান ইজ এলিয়েন টু মি" । এই কথাটা খুব গুরুত্তপূর্ন। যে জাতির কালচারাল মেমোরিতে গণহত্যা ও শরনার্থী ক্যাম্পের দগদগে ক্ষত, তারা কিভাবে সীমান্তের ওপারের এমন হিউম্যান ক্যাটাস্ট্রোফিতে ও এতটা নির্বিকার থাকে? যশোর রোডের পথে পথে ছড়ানো লাশ ও শকুনদের তুমি ভুলে গেলে বাঙালী?

Thursday 17 November 2016

ইরম শর্মিলার রাজনৈতিক দল --------------পোর্টাল ইউকেবেঙ্গলি

রাজনৈতিক দল গঠন করলেন 'মণিপুরের লৌহমানবী' ইরম শর্মিলা
irom_shormila.jpg
ইউকেবেঙ্গলি, লণ্ডন - ১৮ অক্টোবর ২০১৬, মঙ্গলবারঃ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন 'মণিপুরের লৌহমানবী' ইরম শর্মিলা চানু। ভারত সরকারের 'নিগ্রহমূলক' বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি দীর্ঘ ষোল বছর অনশন করেন। গত অগাষ্টে অনশন ভেঙ্গে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন রাজনীতিতে প্রবেশের।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে সেনাবাহিনীর সন্দেহিত নিগ্রহমূল আচরণ বন্ধ ও বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করার দাবীতে ইরম শর্মিলা ষোল বছর ধরে অনশন পালন করেন। এই সময়কালে দেশটির সরকার তাঁর নাকে নল ঢুকিয়ে জোর করে খাবার প্রবেশ করিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
আরও কয়েকটি রাজ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অনুরূপ নিগ্রহের অভিযোগ থাকলেও, ইরমের আন্দোলনের কল্যাণে মণিপুরে পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচার ও সহানুভূতি পেয়েছে। দু'মাস আগে অনশন ভঙ্গ করার সময় তিনি বলেছিলেন, এবার রাজনীতির মাঠে লড়বেন।
আজ ইম্ফলের প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে পিপল্‌স রিসার্জেন্স এ্যাণ্ড জাষ্টিস এ্যালায়েন্স সংক্ষেপে 'প্রজা' নামের রাজনৈতিক দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ৪৪ বছর বয়ষ্ক ইরম। তিনি জানান, আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য মণিপুর রাজ্য নির্বাচনে তাঁর দল ৬০টি আসনের মধ্যে অন্ততঃ ২০টিতে প্রার্থী দেবে। তিনি নিজে দাঁড়াবেন দু'টি আসনে, যার একটির বর্তমান এমপি হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইববি সিং।
রাজনীতির মাঠেও ইরমের মূল লক্ষ্য - অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করা - অবিচ্যুত থাকবে। তিনি জানান, তাঁর দলের ভিত্তি হবে ন্যায়বিচারের নীতি, ভালোবাসা ও শান্তি।
সরাসরি দলভিত্তিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা না থাকার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ইতিমধ্যেই ইরম বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। দ্য হিন্দু পত্রিকা জানিয়েছে, অনশন ভাঙার পর তিনি দিল্লীর আম আদমী পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিবালের সাথে দেখা করে জানতে চেয়েছেন বড়ো দলকে পরাজিত করার কৌশল সম্পর্কে।
অনশনের ষোল বছর মণিপুরের জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছেন ইরম শর্মিলা। তাদের সেই সমর্থন রাজনীতিক শর্মিলার প্রতি অটুট থাকে তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের নির্বাচ পর্যন্ত।

আত্মপরিচয়ের দুই শিবিরঃ বাঙালির রাজনৈতিক মেরুকরণ ______________ মাসুদ রানা

আত্মপরিচয়ের দুই শিবিরঃ বাঙালীর রাজনৈতিক মেরুকরণ
মাসুদ রানা
বাঙালীর আত্মপরিচয় সঙ্কটযেখানেই বাঙালীর রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন বা চর্চার প্রশ্ন আসে, সেখানেই দু’টি আত্মপরিচয় পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব প্রবৃত্ত হয়ে সঙ্কট সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে। এদের একটি হচ্ছে তার ধর্মীয় আত্মপরিচয়, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি। আর, অন্যটি তার জাতিসত্তাগত আত্মপরিচয়, অর্থাৎ বাঙালী। এটি শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্র সত্য, তা নয়। এটি ব্রিটেইনের বাঙালীর ক্ষেত্রেও সত্য।
সমাজমনোবিজ্ঞানে এটি একটি আইডেণ্টিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয় সঙ্কট। আমি আমার এ্যাকাডেমিক গবেষণায় এর তত্ত্বায়ন করেছি ‘এ্যাম্বিভ্যালেণ্ট আইডেণ্টিটি’ বা ‘দোদুল্যমান আত্মপরিচয়’ নামে। আমি দেখিয়েছি, এর উদ্ভব হয়েছে ধর্মীয় ক্যাটেগোরাইজেশন ও এথনিক ক্যাটেগোরাইজেশনের মিশ্রণ বা ক্রস-ক্যাটেগোরাইজেশনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত বিরোধ থেকে।
দ্বন্দ্বে লিপ্ত ও দোদুল্যমান দুই আত্মপরিচয় গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে (১) দু’টি ঐতিহাসিক বঞ্চনাবোধ, (২) দু’টি ঐতিহাসিক আন্দোলন ও (৩) দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এই তিনটির (৪) ‘ভিভিড মেমোরি’ বা ‘বিশাল স্মৃতি’, যা 'সৌশ্যাল রিপ্রেজেণ্টেশন' বা সামাজিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে বাঙালীর সামাজিক সংবোধ পরস্পর বিরোধী দু’টি আত্মপরিচয় গঠন ও আবেগ সঞ্চারের মাধ্যমে তীব্র প্রেষণা তৈরি করে দু'টি ক্যাম্পে বা শিবিরে মেরুকৃত করে চলছে। আমি এক্ষণে দুই ক্যাম্প বা শিবিরকে ১৯৪৭-শিবির ও ১৯৭১-শিবির বলে চিহ্নিত করছি।
বাঙালী একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে যে সঙ্কটে নিপতিত হয়, একই বাঙালী ব্রিটেইনে একটি সম্প্রদায় হিসেবে বাস করেও একই সঙ্কটের সম্মুখিন হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসকে বাঙালীর রাজধানী বলা হয় তার জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতাজাত রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে। আমার তত্ত্বানুসারে, এখানেও বাঙালীর মধ্যে আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বপ্রসূত সঙ্কট রয়েছে। আর, এর এর ফলে এখানেও বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্তর-শিবির বনাম সাতচল্লিশ-শিবিরে বিভক্তি রয়েছে।
এখানে সাতচল্লিশ-শিবির সংগঠিত রয়েছে সদ্য মেয়র-পদচ্যুত ও লেবার দলের বহিষ্কৃত নেতা লুতফুর রহমানকে ঘিরে। এই শিবিরের বিপরীতে একাত্তর-শিবির জড়ো হচ্ছে লেবার দলের এমপি রুশনারা আলিকে ঘিরে।
আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিকতা
ব্রিটিশ ভারতে বাঙালী মুসলমানের মধ্যে বঞ্চনাবোধ ছিলো বাঙালী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। কারণ, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ বাঙালী মুসলমানকে অস্পৃশ্য ‘যবন’ মনে করে বাঙালীত্বের পরিচয় থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছিলো, যা তৎকালীন সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।
হিন্দু সন্ত বিকেনান্দ স্পষ্ট বলেছেন, বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেছেনে আছে হিন্দু বর্ণবাদ। শতোশতো বছর ধরে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে হিন্দু বর্ণাশ্রমের অধীনে নিম্নবর্ণভূক্ত রেখে নিপীড়ন করার কারণে বাইরে থেকে আসা মুসলিম বিজয়ীদের দেওয়া ইসলামিক সাম্যের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা লাখে লাখে মুসলমান হয়েছিলেন। 
বস্তুতঃ হিন্দুত্ব ছেড়ে মুসলমান হলেও বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ বাস্তবে সেই মর্য্যাদা পাননি। তাই রূপান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে আদি হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ কাজ করে। কারণ, হিন্দুত্ব ছেড়ে গেলেও বর্ণহিন্দুর কাছে রূপান্তরিত মুসলিম অস্পৃশ্যই রয়ে গিয়েছিলো বা আছে।
সামন্ত স্থবির সমাজে মুষ্ঠিমেয় সম্পদশালী ও ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠের বিক্ষোভ নানা সময়ে নানাভাবে স্বল্পমাত্রায় প্রকাশিত হলেও, পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে-সাথে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রবর্তন ও বিকাশ হতে শুরু করলে, সেই নিম্নবর্গের শক্তি ও ক্ষোভের প্রকাশ পেতে শুরু করে। বাংলায় ব্রিটিশ শাসকদের প্রস্তাবিত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সেই সুযোগের সূচনা করে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কোলকাতায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম তরঙ্গ হিন্দুত্বাবাদী ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে শুরু হলে, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠন করে মুসলমানত্ববাদী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয়।
দীর্ঘ চার দশক ধরে বাঙালীর মধ্যে হিন্দু-পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলন ও মেরুকরণের ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙালী জাতি ও বাংলার স্থল-জল-অন্তরীক্ষ বিভক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয় বিভক্ত বাংলা ও বিভক্ত বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ড এবং পশ্চিম খণ্ড থাকে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হয়ে।
বিভক্তির প্রায় সাথে-সাথেই উভয় খণ্ডে শুরু হয় নতুন বঞ্চনাবোধ - এবং পূর্বখণ্ডে দ্রুত কিন্তু পশ্চিম খণ্ডে ধীরে (১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এবং পরে উত্তরাপথ তথা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে)। পূর্ববাংলায় বঞ্চনাবোধের সূচনা হলো বাংলাভাষা নিয়ে ১৯৪৮ সালে। সে-বছর পাকিস্তানের পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বললেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। আর এর প্রতিবাদে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপরই ‘না, না’ বলে প্রতিবাদের মুখর হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ।
পূর্ববাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালীর বঞ্চনাবোধ শতোরূপে প্রকাশ পেতে পেতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এলো তখন, যখন বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানের সাধারণ ও সাংবিধানিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা থেকে তাঁকে - তথা বাঙালীকে - বঞ্চিত করে গণহত্যা শুরু করলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে। এই পর্যায়ে বাঙালী মুসলমান উপলদ্ধি করলো, মুসলমানত্ব তার মৌলিক পরিচয় নয়। তার মৌলিক পরিচয় বাঙালীত্ব। আর এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই সে যুদ্ধ করে স্বাধীন করলো মাতৃভূমি এবং হয়ে উঠলো একটি স্বীকৃত জাতি।
কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিকশিত বাঙালী জাতিয়তাবদের  ঐতিহাসিক দ্বিতীয় তরঙ্গ বাঙালী জাতিকে মুসলিম পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত করলেও পাকিস্তান-পূর্ব অখণ্ড বাংলা ও বাঙালীত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পারলো না। ফলে, পূর্বখণ্ডের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশ’ রূপতঃ ইতিহাস ও ভূগোলের আয়নায় যখন পশ্চিমখণ্ডের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশ’ দেখে, তখন আত্মপরিচয়ের আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি হতে বাধ্য।
১৯৭১ সালের বাঙালী জাতীয়তবাদী আন্দোলনে যেহেতু এই প্রশ্নের উত্তর ছিলো না, কিংবা থাকলেও স্পষ্ট ছিলো না, তাই বাংলার ও বাঙালী জাতির খণ্ডতার জাষ্টিফিকেশনের জন্যে যুদ্ধে পরাজিত দ্বিজাতি তত্ত্বের নীরব পুনরুত্থান ঘটলো। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে পূর্বখণ্ডের বাঙালীর মুসলিম পরিচয়কে আন্তর্জাতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। পরিবর্তীতে জিয়াউর রহমান জাতির আত্মপরিচয়ের সঙ্কট মোচনের চেষ্টায় ‘বাঙালী’র বদলে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন।
কিন্তু দুই রহমানের প্রচেষ্টা বাঙালী জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে যায় বলে, সঙ্কট কাটেনি। তাই একাত্তরের সীমাবদ্ধতা কাটাতে সাতচল্লিশ, আর সাতচল্লিশের সীমাবদ্ধতা কাটাতে একাত্তরে শরণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের দোদুল্যতা অব্যাহত রয়েছে।
নির্বাচনে বাঙালী আত্মপরিচয়
ব্রিটেইন যখন পার্লামেণ্টারি নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে, তখন টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালী আত্মপরিচিতি ক্রিয়া করতে শুরু করেছে রুশনারা আলির সমর্থনে। কিন্তু এর মধ্যে বাঙালী বংশোদ্ভূত লুতফুর রহমানকে ইসলামবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে কারচুপি এবং ধর্ম ও বর্ণের খেলা খেলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার অভিযোগের পক্ষে রায় দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তাঁকে আগামী পাঁচ বছরের জন্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এষ্টাব্লিশমেণ্টের এই রায়ের পেছনে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে লুতফুর রহমানের দুই দু'বার বিজয়। লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ নিয়মে লুতফুর রহমান মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পরও তাঁর ইসলামবাদী-সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে তাঁর প্রার্থিতা তুলে নিলে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গণরায়ে বিজয়ী হন। দ্বিতীয়বারও তিনি বিজয়ী হন ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্ষ্ট’ নামে সংগঠন গঠন করে ব্রিটেইনের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসমূহের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ বাঙালী সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে।
লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এষ্টাবলিশমেণ্টের আঘাত ব্রিটেইনের বাঙালীর মধ্যে দ্বিধার তৈরি করেছে। সাতচল্লিশ-শিবির এটিকে মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসবে প্রচার করছে। আর, সে-কারণে একাত্তর শিবির স্বস্তিবোধ করছে।
একাত্তর শিবির রুশনারা আলিকে ঘিরেই তাঁদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন চায়। রুশনারা আলিও বাঙালীত্বের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। তিনি গতবারের নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে অধিক মাত্রায় বাঙালী।
রুশনারা আলি তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই ইসলামিক আইডেণ্টিক নিতে পারবেন না, যা লুৎফুর রহমান নিয়েছিলেন। কিন্তু লুতফুর রহমান যেহেতু বাঙালী আইডেণ্টিটিও ব্যবহার করেছিলেন, তাই লুতফুর রহমানকে রুশনারা আলির বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করার অনুরোধে রুশনারা আলির বাঙালী আইডেণ্টিটি কাজ করেছে। বাঙালী হয়ে বাঙালী এমপির প্রার্থিতার বিরোধিতা করলে লুৎফুর রহমানের বাঙালী আইডেণ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
কিন্তু ব্রিটিশ এষ্টাব্ললিশমেণ্টের হাতে লুতফুর রহমান ‘ভিক্টিম’ হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষিত হওয়ার কারণে, সাধারণভাবে বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তা রুশনারা আলির বিরুদ্ধে যেতে পারে ধারণা করে একাত্তর-শিবির। তাই, একাত্তর-শিবিরের পক্ষ থেকে লুতফুর রহামানকে সাতচল্লিশ-শিবিরের লোক হিসেবে দেখানো চেষ্টা চলছে। সহজ বাংলায় তাঁকে ‘রাজাকার’ও বলা হচ্ছে।
বাঙালী আত্মপরিচয়ের প্রায়োগিক প্রশ্ন
মে মাসের নির্বাচনকে সামনে রেখে এই যে বাঙালী আইডেণ্টির আবেদন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বাস্তব তাৎপর্য কী, তা নিয়েই কেউ প্রশ্ন করছেন না। একজন প্রার্থী বাঙালী বলেই বাঙালী সম্প্রদায়কে সম্প্রদায়গতভাবে ভৌট দিতে হবে, এমন আবেদন যৌক্তিক নয়। যাঁরা এই আবেদন নিয়ে ভৌটারদের কাছে যান, তাঁদের এই যাওয়াও নৈতিক নয়।
আমি মনে করি, ব্রিটেইনের বহুসাংস্কৃতিক সমাজে প্রতিটি এথনিক বা জনজাতিক গোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির চাওয়া শুধু ন্যায্য নয়, আবশ্যকও বটে। ডাইভার্সিটি বা বিভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়ে ও বিকাশ ঘটিয়ে সমন্বিত হওয়াই সভ্যতা ও মানবিকতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঈর্ষণীয় হলেও বাঙালীর ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সমাজের মূলস্রোত ধারায় স্থান করে নেওয়ার প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না।
লুতফুর রহমান থেকে শুরু করে রুশনারা আলি সকলেই বাঙালী আইডেণ্টিটি 'কার্ড' ব্যবহার করলেও বাস্তবে তাঁরা তেমন কোনো কাজই করেননি। কারণ, বাঙালী সম্প্রদায়ের লোকেরা নির্বাচনের প্রার্থীদের বাঙালী চেহারা দেখেই তৃপ্ত। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাঙালী নাম দেখেই তাঁরা সন্তুষ্ট। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রশাসনে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিফলন ঘটছে কিনা, না ঘটলে কীভাবে তা আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে ঘটানো যায়, সেদিকে তাদের কোনো আগ্রহ কিংবা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
২০১৭ সাল থেকে স্কুল-কলেইজে এ্যা-লেভেলের কারিক্যুলাম থেকে বাংলাভাষা প্রত্যাহার করা হবে বলে ফেব্রুয়ারীতে ঘোষণা এসেছে। বাংলার শিক্ষকগণ এনিয়ে তাঁদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে হলেও বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু বাঙালী রাজনীতিকদের কাছ থেকে কোন বজ্রকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না বাংলা পক্ষে।
এটি বলা অন্যায্য হবে না যে, প্রাক্তন মেয়র লুতফর রহমান ও তাঁর অনুসারীগণ যতোটুকু না বাঙালী, তার চেয়েও অধিক মুসলমান। তাঁদের সাতচল্লিশ-শিবিরভূক্তির কারণে, বাংলার প্রতি তাঁদের আগ্রহ কম। এটি স্পষ্ট।
কয়েক বছর আগে যখন ব্রিটেইনের নতুন ভাষানীতি প্রকাশিত হলো এবং প্রাইমারী পর্যায়ে একটি ইংরেজির অতিরিক্তি একটি দ্বিতীয় ভাষা শেখা আইন করা হলো, তখন কিছু শিক্ষক ও সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে সেমিনার করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন নিবেদন ও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন (সেই সেমিনার পেপারটি আমি পরবর্তীতে প্রকাশ করবো)।
কিন্তু আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোনো শিবিরই এতে ন্যুনতম আন্তরিকতা দেখাননি। একদল মনে করেন বাংলার চেয়ে ইউরোপীয় ভাষা শেখা উত্তম। আরেক দল বাংলার চেয়ে আরবি ভাষা শেখা কর্তব্য বলে মনে করেন। এদের উভয়ের কাছে বাংলা একটি অপাংক্তেয় ভাষা।
কিন্তু নির্বাচন এলে উভয় দলই বাঙালী আত্মপরিচয়ে বাঙালী সম্প্রদায়ের কাছে ভৌট চাইতে যান। বাংলা গণমাধ্যমগুলোও তারস্বরে ‘তিনি আমাদের বাঙালী’ বলে উচ্ছাস প্রকাশ করে। নির্বাচন শেষে বাংলাভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতি যে তিমির থাকে, সে তিমিরেই হারিয়ে যায় - অনেকটা একুশে ফেব্রুয়ারীতে তিন সপ্তাহ ব্যাপী রূপতঃ প্রাদুর্ভাবিত বাংলাপ্রীতি রোগের মতো।
আমি মনে করি, প্রার্থী বাঙালী কি না, তা ততো গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাঙালী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন। বাঙালী ভৌটারদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে অন্ততঃ ৫টি প্রশ্নঃ
(১) বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে আপনি কী করেছেন?
(২) বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে কী কর্মসূচি আছে আপনার?
(৩) প্রাইমারী স্কুলের শিশুরা যেনো বাংলা শিখতে পারে তা নিশ্চিত করতে আপনি কী করবেন?
(৪) ২০১৭ সালে যে এ্যা-লেভেল থেকে বাংলা তুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে, তার রোখার জন্য আপনি কী করবেন?
(৫) বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য নিয়ে চর্চা ও গবেষণার জন্যে একটি এ্যাকাডেমি বা ইনষ্টিটিউশন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কিনা, করলে এই প্রয়োজন মেটাতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
উপরের প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক জবাব ছাড়া কোনো প্রার্থীকেই শুধু বাঙালী হওয়ার কারণে ভৌট দেওয়া হবে জাতিসত্তায় জাগ্রত বাঙালীর জন্যে অর্থহীন। আমি মনে করি, উপরের প্রশ্নমালার ইতিবাচক উত্তর নিয়ে যদি কোনো অবাঙালীও নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আসেন, সকল বাঙালীর উচিত হবে সেই অবাঙালীকেই ভৌট দেওয়া। যে-রাজনীতিক চর্মে বাঙালী কর্মে নন, রাজনৈতিকভাবে তিনি বাঙালী নন।

শনিবার ২৫ এ্যাপ্রিল ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড

অসাম্প্রদায়িক চেতনাপ্রসগে-২______________________________মাসুদ রানা

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে (১)
মাসুদ রানা
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্মেলন
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ১৫ নাগরিক - বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী - উদ্যোগী হয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলন' অনুষ্ঠিত করেছেন আজ ঢাকায়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিডিনিউজ টুয়ান্টিফৌর জানাচ্ছে, এই সম্মেলন থেকে বুদ্ধিজীবীরা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক' দিয়েছেন। ডাক দেয়া হয়েছে দেশবাসীর প্রতি।
ডাক-দেয়া এই পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী হলেনঃ (১) সালাহউদ্দিন আহমেদ, (২) সরদার ফজলুল করিম, (৩) মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, (৪) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, (৫) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, (৬) সৈয়দ শামসুল হক, (৭) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, (৮) কাইয়ুম চৌধুরী, (৯) হামিদা হোসেন, (১০) আনিসুজ্জামান, (১১) কামাল লোহানী, (১২) রামেন্দু মজুমদার, (১৩) সেলিনা হোসেন, (১৪) সুলতানা কামাল ও (১৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' বহু-উচ্চারিত দু'টি শব্দবন্ধ। এ-দু'টি শব্দবন্ধের ‘এ্যাফেক্টিভ' বা আবেগিক আবেদন বিশাল হলেও এদের ‘কগনিটিভ' বা বোধিক অবয়ব অস্পষ্ট। ফলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ও ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' হচ্ছে অনির্দিষ্ট ও বিমূর্ত ধারণা, যা বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে বিকশিত আকাঙ্খাসমূহের নিতান্ত বায়বীয় উপস্থাপন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ সন্ধান
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী?' তাহলে, এর স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছেঃ ‘যে চেতনা সাম্প্রদায়িক নয়'। স্পষ্টতঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' কোনো স্ব-ব্যাখ্যাত ধারণা নয়। যেহেতু ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থ ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থের উপর নির্ভরশীল, তাই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ‘সাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ছাড়া সম্ভব নয়।
শব্দ হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক' স্বনির্ভর নয়। এটি ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের আগে তৎসম উপসর্গ ‘অ' যোগে গঠিত। এই শব্দের অর্থ এর ভিতরে নিহিত নয়। ফলে, ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দটি বলে না এটি কী; বরং বলে এটি কী নয়।
নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ, বুদ্ধিজীবীরা চাইছেন, শিশুদের চেতনা যেনো ‘সাম্প্রদায়িক' না হয়। উত্তম প্রস্তাব! ‘সাম্প্রদায়িক' নাই-বা হলো। কী হবে তাহলে? এর উত্তর আছে? অন্যত্র না হাতড়িয়ে প্রস্তাবিত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ভিতর কি এর উত্তর আছে?
‘সাম্প্রদায়িক' হিসেবে যে-সকল চেতনা চিহ্নিত করা যায়, তা বাদ দিয়ে যা থাকে, তার সবকিছুকেই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' রূপে নির্দেশ করা সম্ভব। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নেতিবাচক সংজ্ঞায়ণের এই হচ্ছে সমস্যা। সে-কারণে, বিজ্ঞানে ইতিবাচক বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞা ছাড়া অন্য কোনো রকম সংজ্ঞা গ্রহণীয় নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ‘বাঙালী' বলতে একটি বিশেষ জাতির মানুষ বুঝায়। কিন্তু ‘অবাঙালী' দ্বারা হাজার-হাজার জাতির মানুষ বুঝাতে পারে। সুতরাং, ‘তিনি অবাঙালী' কিংবা ‘ইনি অমুসলিম' বলে কোনো পরিচয় হতে পারে না। একইভাবে ‘আমি অসাম্প্রদায়িক' বললে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্দেশ করে না। স্পষ্টতঃ ‘নিগেটিভ কনস্ট্র্যাক্ট' বা নেতিবাচক ধারণা হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' অতি সহজেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। সুতরাং, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্ত নয়, একটি অকার্যকর ধারণাও বটে।
‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উৎস সন্ধান
এবার আলোকপাত করা যাক ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উপর। ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দটি বাংলার রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্সে' বা ভাষ্যে সরাসরি ইংরজি ‘কম্যুনাল' শব্দ থেকে এসেছে, যা শতাধিক বছর আগে খোদ ইংল্যাণ্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্রিটিশ ঔনিবেশিক কালে ভারতে প্রবর্তিত হয়েছিলো।
ইংরেজি ভাষায় ‘কম্যুনাল' শব্দের উৎপত্তি কাল ‘অক্সফৌর্ড ডিকশনারী'তে দেখানো হয়েছে ঊনিশ শতক। ‘কম্যুনাল' শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ‘কমিউন' থেকে। বলা হয়েছে, এই ‘কমিউন' হচ্ছে সেই ‘কমিউন' যা ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্যারি কমিউন' নামে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, প্যারি কমিউন ছিলো ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত বেঁচে থাকা পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, ‘কমিউন' শব্দের মধ্যে সাম্যবাদী উপাদান আছে।
তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ১নং অর্থ হচ্ছে ‘shared by all members of a community; for common use' অর্থাৎ, ‘কমিউনিটির সকল সদস্যের অংশীদারিত্বে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য'। সেই কারণেই, ইংল্যাণ্ডে ‘কম্যুনাল' একটি ইতিবাচক ধারণা।
বিশ্বজুড়ে নানা দেশে ‘কম্যুনাল চাইল্ড রীয়ারিং' (শিশুপালন), ‘কম্যুনাল এডুকেশন' (শিক্ষা), ‘কম্যুনাল হাউজিং (আবাসান)' ‘কম্যুনাল লিভিং' (বসবাস), ‘কম্যুনাল কুকিং (রান্না)' ‘কম্যুনাল ঈটিং' (ভোজন) ‘কম্যুনাল স্লীপিং' (নিদ্রা), ‘কম্যুনাল পার্কিং' (গাড়ী রাখা), ‘কম্যুনাল সেইফটি' (নিরাপত্তা), ইত্যাদি ‘প্র্যাক্টিস' বা চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
‘কম্যুনাল' শব্দের এতো ইতিবাচক ব্যবহার দেখে হয়তো ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার' বাঙালীরা হতাশ হবেন। কিন্তু তাঁদের নিরাশ হবার কারণ নেই - অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় একটি অর্থ আছে, যেটির ব্যবহার ইংল্যাণ্ডে হয় না বললেই চলে। ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থটির উদ্ভব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্স' বা ভাষ্য থেকে।
অভিন্ন ভারতীয় জাতীয় পরিচয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে, প্রাদেশিক পরিচয়ে কিংবা ভাষিক পরিচয়ে বিভক্তিমূলক ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন, কর্মসূচি ও তৎপরতার ‘নিগেটিভ ব্র্যাণ্ডিং' বা নেতিবাচক চিহ্নায়ণে ‘কম্যুনাল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ২ নং অর্থ নির্দেশ করে বলা হয়েছে ‘ (of conflict) between different communities, especially those having different religions or ethnic origins' - অর্থাৎ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সংঘাত বিষয়ক - বিশেষ করে যাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ও জনজাতিক ভিন্নতা। এই ঐতিহাসিক কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক শব্দ।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় অর্থে ‘কম্যুনাল' বা ‘সাম্প্রদায়িক' হতে হলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রয়োজন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বাস অনেক দিনের। কিন্তু ‘কম্যুনাল' শব্দ তখনই রাজনৈতিক ভাষ্যে এসেছে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর সাথে সংখ্যালঘু মুসলমান ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে।
যেহেতু ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক বিশেষণ, তাই কেউই নিজেকে ‘কম্যুনাল' হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এটি হচ্ছে বিপরীত সম্প্রদায়ের দ্বারা আরোপিত ‘স্টিগমা' বা কালিমা, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পারস্পরিক ‘ন্যারেশন' বা বর্ণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও তাদের আপেক্ষিক শক্তির উপর নির্ভর করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দূর্বলের চেয়ে প্রবলের বর্ণনই বেশি প্রতিষ্ঠা পায়।
সুতরাং, এই কালিমা যেভাবে সংখ্যালঘুর গায়ে সেঁটে বসে, সংখ্যাগুরুর গায়ে ততো নয়। ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রাজনীতির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকাতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। আর এ-দুটি ধারার শাব্দিক প্রতীকায়ণ ঘটেছিলো যথাক্রমে ‘বন্দে মাতরম' ও ‘আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দ্বারা। তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের গায়ে কালিমা লেগেছে বেশি, কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে তেমন লাগেইনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা
‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দল নির্দেশ করতে গেলে, সংজ্ঞানুসারে প্রথমেই নির্দেশ করতে হবে কোন্‌ সম্প্রদায়ের সাথে কোন্‌ সম্প্রাদায়ের রাজনৈতিক সংঘাত হচ্ছে। জাতীয় পরিধিতে এদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ ব্রিটিশ ঔপনেবিশিক আমলে। এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ভিত্তি ছিলো ধর্ম।
পাকিস্তান সৃষ্টির কালে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হয়েছে, তাতে হিন্দুরা পরাস্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আর কখনও ১৯৪৭-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা দিন-দিন আরও প্রান্তিক হচ্ছে। সম্প্রদায়গত ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবৃত্ত হবার মতো জনের ও মনের শক্তি এঁদের নেই।
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ বাঙালীর সাথে বিহারীর। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, কারণ বিহারী সম্প্রদায়ও ছিলো মুসলমান। বাঙালী-বিহারী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভিত্তি ছিলো তাঁদের জনজাতিক ভিন্নতা। বিহারী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও এঁদের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষপাত ছিলো। তাই, বিহারী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালী নিধনে ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিহারী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিধন করা হয়েছে, একটি অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছে, আর অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশ প্রান্তিক হয়ে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে প্রধানতঃ পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র-সমর্থিত বাঙালীর সাথে পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলোর। এর মধ্যে জনজাতিক ও ধর্মীয়, এই দুটো উপাদনই বর্তমান, যদিও প্রথমটিই প্রধান। তবে এই সংঘাত ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত নয়। কারণ, পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলো জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে বাঙালীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নয়।
পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঘিরে বাঙালীর সাথে পাহাড়ীদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, যার স্রষ্টা হচ্ছে রহমানবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাহাড়ীদের নায্য দাবি অগ্রাহ্য করে তাঁদেরকে ‘বাঙালী হয়ে' যেতে বললেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে বাঙালী অভিবাসনের সূচনা করলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। পরবর্তী সরকারগুলো সেই নীতিই অনুসরণ করে আসছে, যদিও মাঝখানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি অকার্যকর পার্ব্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলনের যে বিবরণ সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা পাঠের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে এই মুহূর্তের জনজাতিক সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ব্যাপারে বোধ ও বুদ্ধি গড়ে তোলার পরিবর্তে অতীতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্মৃতি রোমন্থন করে একটি বিমূর্ত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কথা বললেন, এর মধ্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী মানুষের উপর চালিত রহমানবাদী সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ‘এথনিক ক্লিনসিং' বা জনজাতিক নিশ্চিহ্নায়ণের বিরুদ্ধে কোনো বোধ কি প্রতিফলিত হয়েছে? পাঠ থেকে বলছিঃ না, হয়নি। সুতরাং বুদ্ধিজীবীদের ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্তই নয় কপটও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী অসাম্প্রদায়িক?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘অসাম্প্রদায়িক' ছিলো বলে বিষয়টিকে ছোটো করা হয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে সঠিক বোধ থেকে এ-কথা বলা সম্ভব নয়। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে ‘প্রিন্সিপল অফ ইনভেলিডেশন এ্যাণ্ড জাস্টিফিকেশন' - অর্থাৎ বাতিলায়ণ ও ন্যায্যায়ণ নীতির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া বুঝা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘আণ্ডারপিনিং' বা টিকিয়ে রাখার সমর্থনে ক্রিয়াশীল থাকে একটি আদর্শবাদ। প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় তার পক্ষের আদর্শবাদটির ‘ইনভেলিডেশন' বা বাতিলায়ণ। কিন্তু এই বাতিলায়ণ সম্ভব হয় না, যদি-না একটি বিকল্প প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ‘জাস্টিফিকেশন' বা ন্যায্যায়ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলায়ণের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিলো না।
আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতার বাতিলায়ণ। বাঙালীকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে - অর্থাৎ, ধর্মবাদের উপর -আঘাত করতে হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিলো কি-না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জনজাতিক পরিচয়ের ন্যায্যতাদায়ী যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালী পাকিস্তান গড়েছিলো, তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিলো অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব ছিলো না।
আজ যাঁরা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‘অসাম্প্রদায়িক' বলে চিহ্নিত করছেন, তাঁরা বুঝে কিংবা না বুঝে ইতিহাস বিকৃত করছেন। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো বলেই যুদ্ধ-বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূল-নীতির দ্বিতীয়টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রথম আঘাত হানেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যেখানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্তিকরণ বুঝায়, সেখানে তিনি বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়'। এই কথা বলে তিনি রাষ্ট্রীয় আচারে-অনুষ্ঠানে ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রবর্তন করলেন কুরআন-পাঠ, গীতি-পাঠ, ত্রিপিটক-পাঠ, বাইবেল-পাঠ ইত্যাদির বহু-ধর্মবাদী চর্চা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে ও ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির চরম লঙ্ঘন করলেন। কোথায়? সে-ও আবার পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই কর্মটি বাঙালী জাতির জন্য গৌরবের ছিলো না।
শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ১৯৭১ সালের ধর্মবাদী দালালদের ‘সাধারণ ক্ষমা'ই করেননি, তিনি অনুমোদন দেন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠার, যার মধ্য দিয়েই সদ্য স্বাধীন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলামবাদীরা নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে।
একনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর পূর্বসূরী একনায়ক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আরও এক কদম এগিয়ে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি হত্যা করলেন সংবিধান থেকে শব্দটিকে প্রত্যাহার করে এবং কুরআনের পংক্তি যুক্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় একনায়ক হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এসে রহমানবাদের হাতে আহত ও নিহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দিলেন ইসলামকে ‘রাষ্ট্র-ধর্ম' ঘোষণার মাধ্যমে।
এরশাদ-পরবর্তী শাসক খালেদা জিয়া এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সেই উত্তরাধিকারের সংরক্ষা করলেন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসার ও থাকার তাগিদে শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সেখান থেকে কু্রআনের পংক্তি ও ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম করার ঘোষণা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করতে পারলেন না। তিনি বরং এখন শারিয়া আইন প্রবর্তনের অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দ নেই। তার বদলে এসেছে ‘অসাম্প্রদায়িক' ধারণা। আওয়ামী লীগের অনুসারী বাম ও অভিসারী বামেরা পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি তেমন আর ব্যবহার করছেন না। তাঁরা বলছেন ‘অসাম্প্রদায়িকতা'র কথা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তোলার কথা বলছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূর্ত-নির্দিষ্ট রূপে ধারণ করেন না। তাহলে কেনো তারা এই চেতনার কথা বলছেন, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পরবর্তী পর্বে দেখানো হবে।
রোববার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com
 

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে-১------------------------------ মাসুদ রানা

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে (১)
মাসুদ রানা
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্মেলন
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ১৫ নাগরিক - বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী - উদ্যোগী হয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলন' অনুষ্ঠিত করেছেন আজ ঢাকায়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিডিনিউজ টুয়ান্টিফৌর জানাচ্ছে, এই সম্মেলন থেকে বুদ্ধিজীবীরা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক' দিয়েছেন। ডাক দেয়া হয়েছে দেশবাসীর প্রতি।
ডাক-দেয়া এই পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী হলেনঃ (১) সালাহউদ্দিন আহমেদ, (২) সরদার ফজলুল করিম, (৩) মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, (৪) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, (৫) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, (৬) সৈয়দ শামসুল হক, (৭) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, (৮) কাইয়ুম চৌধুরী, (৯) হামিদা হোসেন, (১০) আনিসুজ্জামান, (১১) কামাল লোহানী, (১২) রামেন্দু মজুমদার, (১৩) সেলিনা হোসেন, (১৪) সুলতানা কামাল ও (১৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' বহু-উচ্চারিত দু'টি শব্দবন্ধ। এ-দু'টি শব্দবন্ধের ‘এ্যাফেক্টিভ' বা আবেগিক আবেদন বিশাল হলেও এদের ‘কগনিটিভ' বা বোধিক অবয়ব অস্পষ্ট। ফলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ও ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' হচ্ছে অনির্দিষ্ট ও বিমূর্ত ধারণা, যা বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে বিকশিত আকাঙ্খাসমূহের নিতান্ত বায়বীয় উপস্থাপন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ সন্ধান
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী?' তাহলে, এর স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছেঃ ‘যে চেতনা সাম্প্রদায়িক নয়'। স্পষ্টতঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' কোনো স্ব-ব্যাখ্যাত ধারণা নয়। যেহেতু ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থ ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থের উপর নির্ভরশীল, তাই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ‘সাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ছাড়া সম্ভব নয়।
শব্দ হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক' স্বনির্ভর নয়। এটি ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের আগে তৎসম উপসর্গ ‘অ' যোগে গঠিত। এই শব্দের অর্থ এর ভিতরে নিহিত নয়। ফলে, ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দটি বলে না এটি কী; বরং বলে এটি কী নয়।
নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ, বুদ্ধিজীবীরা চাইছেন, শিশুদের চেতনা যেনো ‘সাম্প্রদায়িক' না হয়। উত্তম প্রস্তাব! ‘সাম্প্রদায়িক' নাই-বা হলো। কী হবে তাহলে? এর উত্তর আছে? অন্যত্র না হাতড়িয়ে প্রস্তাবিত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ভিতর কি এর উত্তর আছে?
‘সাম্প্রদায়িক' হিসেবে যে-সকল চেতনা চিহ্নিত করা যায়, তা বাদ দিয়ে যা থাকে, তার সবকিছুকেই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' রূপে নির্দেশ করা সম্ভব। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নেতিবাচক সংজ্ঞায়ণের এই হচ্ছে সমস্যা। সে-কারণে, বিজ্ঞানে ইতিবাচক বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞা ছাড়া অন্য কোনো রকম সংজ্ঞা গ্রহণীয় নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ‘বাঙালী' বলতে একটি বিশেষ জাতির মানুষ বুঝায়। কিন্তু ‘অবাঙালী' দ্বারা হাজার-হাজার জাতির মানুষ বুঝাতে পারে। সুতরাং, ‘তিনি অবাঙালী' কিংবা ‘ইনি অমুসলিম' বলে কোনো পরিচয় হতে পারে না। একইভাবে ‘আমি অসাম্প্রদায়িক' বললে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্দেশ করে না। স্পষ্টতঃ ‘নিগেটিভ কনস্ট্র্যাক্ট' বা নেতিবাচক ধারণা হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' অতি সহজেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। সুতরাং, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্ত নয়, একটি অকার্যকর ধারণাও বটে।
‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উৎস সন্ধান
এবার আলোকপাত করা যাক ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উপর। ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দটি বাংলার রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্সে' বা ভাষ্যে সরাসরি ইংরজি ‘কম্যুনাল' শব্দ থেকে এসেছে, যা শতাধিক বছর আগে খোদ ইংল্যাণ্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্রিটিশ ঔনিবেশিক কালে ভারতে প্রবর্তিত হয়েছিলো।
ইংরেজি ভাষায় ‘কম্যুনাল' শব্দের উৎপত্তি কাল ‘অক্সফৌর্ড ডিকশনারী'তে দেখানো হয়েছে ঊনিশ শতক। ‘কম্যুনাল' শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ‘কমিউন' থেকে। বলা হয়েছে, এই ‘কমিউন' হচ্ছে সেই ‘কমিউন' যা ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্যারি কমিউন' নামে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, প্যারি কমিউন ছিলো ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত বেঁচে থাকা পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, ‘কমিউন' শব্দের মধ্যে সাম্যবাদী উপাদান আছে।
তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ১নং অর্থ হচ্ছে ‘shared by all members of a community; for common use' অর্থাৎ, ‘কমিউনিটির সকল সদস্যের অংশীদারিত্বে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য'। সেই কারণেই, ইংল্যাণ্ডে ‘কম্যুনাল' একটি ইতিবাচক ধারণা।
বিশ্বজুড়ে নানা দেশে ‘কম্যুনাল চাইল্ড রীয়ারিং' (শিশুপালন), ‘কম্যুনাল এডুকেশন' (শিক্ষা), ‘কম্যুনাল হাউজিং (আবাসান)' ‘কম্যুনাল লিভিং' (বসবাস), ‘কম্যুনাল কুকিং (রান্না)' ‘কম্যুনাল ঈটিং' (ভোজন) ‘কম্যুনাল স্লীপিং' (নিদ্রা), ‘কম্যুনাল পার্কিং' (গাড়ী রাখা), ‘কম্যুনাল সেইফটি' (নিরাপত্তা), ইত্যাদি ‘প্র্যাক্টিস' বা চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
‘কম্যুনাল' শব্দের এতো ইতিবাচক ব্যবহার দেখে হয়তো ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার' বাঙালীরা হতাশ হবেন। কিন্তু তাঁদের নিরাশ হবার কারণ নেই - অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় একটি অর্থ আছে, যেটির ব্যবহার ইংল্যাণ্ডে হয় না বললেই চলে। ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থটির উদ্ভব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্স' বা ভাষ্য থেকে।
অভিন্ন ভারতীয় জাতীয় পরিচয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে, প্রাদেশিক পরিচয়ে কিংবা ভাষিক পরিচয়ে বিভক্তিমূলক ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন, কর্মসূচি ও তৎপরতার ‘নিগেটিভ ব্র্যাণ্ডিং' বা নেতিবাচক চিহ্নায়ণে ‘কম্যুনাল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ২ নং অর্থ নির্দেশ করে বলা হয়েছে ‘ (of conflict) between different communities, especially those having different religions or ethnic origins' - অর্থাৎ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সংঘাত বিষয়ক - বিশেষ করে যাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ও জনজাতিক ভিন্নতা। এই ঐতিহাসিক কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক শব্দ।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় অর্থে ‘কম্যুনাল' বা ‘সাম্প্রদায়িক' হতে হলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রয়োজন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বাস অনেক দিনের। কিন্তু ‘কম্যুনাল' শব্দ তখনই রাজনৈতিক ভাষ্যে এসেছে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর সাথে সংখ্যালঘু মুসলমান ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে।
যেহেতু ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক বিশেষণ, তাই কেউই নিজেকে ‘কম্যুনাল' হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এটি হচ্ছে বিপরীত সম্প্রদায়ের দ্বারা আরোপিত ‘স্টিগমা' বা কালিমা, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পারস্পরিক ‘ন্যারেশন' বা বর্ণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও তাদের আপেক্ষিক শক্তির উপর নির্ভর করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দূর্বলের চেয়ে প্রবলের বর্ণনই বেশি প্রতিষ্ঠা পায়।
সুতরাং, এই কালিমা যেভাবে সংখ্যালঘুর গায়ে সেঁটে বসে, সংখ্যাগুরুর গায়ে ততো নয়। ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রাজনীতির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকাতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। আর এ-দুটি ধারার শাব্দিক প্রতীকায়ণ ঘটেছিলো যথাক্রমে ‘বন্দে মাতরম' ও ‘আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দ্বারা। তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের গায়ে কালিমা লেগেছে বেশি, কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে তেমন লাগেইনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা
‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দল নির্দেশ করতে গেলে, সংজ্ঞানুসারে প্রথমেই নির্দেশ করতে হবে কোন্‌ সম্প্রদায়ের সাথে কোন্‌ সম্প্রাদায়ের রাজনৈতিক সংঘাত হচ্ছে। জাতীয় পরিধিতে এদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ ব্রিটিশ ঔপনেবিশিক আমলে। এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ভিত্তি ছিলো ধর্ম।
পাকিস্তান সৃষ্টির কালে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হয়েছে, তাতে হিন্দুরা পরাস্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আর কখনও ১৯৪৭-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা দিন-দিন আরও প্রান্তিক হচ্ছে। সম্প্রদায়গত ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবৃত্ত হবার মতো জনের ও মনের শক্তি এঁদের নেই।
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ বাঙালীর সাথে বিহারীর। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, কারণ বিহারী সম্প্রদায়ও ছিলো মুসলমান। বাঙালী-বিহারী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভিত্তি ছিলো তাঁদের জনজাতিক ভিন্নতা। বিহারী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও এঁদের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষপাত ছিলো। তাই, বিহারী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালী নিধনে ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিহারী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিধন করা হয়েছে, একটি অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছে, আর অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশ প্রান্তিক হয়ে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে প্রধানতঃ পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র-সমর্থিত বাঙালীর সাথে পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলোর। এর মধ্যে জনজাতিক ও ধর্মীয়, এই দুটো উপাদনই বর্তমান, যদিও প্রথমটিই প্রধান। তবে এই সংঘাত ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত নয়। কারণ, পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলো জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে বাঙালীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নয়।
পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঘিরে বাঙালীর সাথে পাহাড়ীদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, যার স্রষ্টা হচ্ছে রহমানবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাহাড়ীদের নায্য দাবি অগ্রাহ্য করে তাঁদেরকে ‘বাঙালী হয়ে' যেতে বললেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে বাঙালী অভিবাসনের সূচনা করলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। পরবর্তী সরকারগুলো সেই নীতিই অনুসরণ করে আসছে, যদিও মাঝখানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি অকার্যকর পার্ব্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলনের যে বিবরণ সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা পাঠের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে এই মুহূর্তের জনজাতিক সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ব্যাপারে বোধ ও বুদ্ধি গড়ে তোলার পরিবর্তে অতীতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্মৃতি রোমন্থন করে একটি বিমূর্ত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কথা বললেন, এর মধ্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী মানুষের উপর চালিত রহমানবাদী সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ‘এথনিক ক্লিনসিং' বা জনজাতিক নিশ্চিহ্নায়ণের বিরুদ্ধে কোনো বোধ কি প্রতিফলিত হয়েছে? পাঠ থেকে বলছিঃ না, হয়নি। সুতরাং বুদ্ধিজীবীদের ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্তই নয় কপটও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী অসাম্প্রদায়িক?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘অসাম্প্রদায়িক' ছিলো বলে বিষয়টিকে ছোটো করা হয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে সঠিক বোধ থেকে এ-কথা বলা সম্ভব নয়। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে ‘প্রিন্সিপল অফ ইনভেলিডেশন এ্যাণ্ড জাস্টিফিকেশন' - অর্থাৎ বাতিলায়ণ ও ন্যায্যায়ণ নীতির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া বুঝা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘আণ্ডারপিনিং' বা টিকিয়ে রাখার সমর্থনে ক্রিয়াশীল থাকে একটি আদর্শবাদ। প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় তার পক্ষের আদর্শবাদটির ‘ইনভেলিডেশন' বা বাতিলায়ণ। কিন্তু এই বাতিলায়ণ সম্ভব হয় না, যদি-না একটি বিকল্প প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ‘জাস্টিফিকেশন' বা ন্যায্যায়ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলায়ণের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিলো না।
আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতার বাতিলায়ণ। বাঙালীকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে - অর্থাৎ, ধর্মবাদের উপর -আঘাত করতে হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিলো কি-না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জনজাতিক পরিচয়ের ন্যায্যতাদায়ী যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালী পাকিস্তান গড়েছিলো, তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিলো অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব ছিলো না।
আজ যাঁরা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‘অসাম্প্রদায়িক' বলে চিহ্নিত করছেন, তাঁরা বুঝে কিংবা না বুঝে ইতিহাস বিকৃত করছেন। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো বলেই যুদ্ধ-বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূল-নীতির দ্বিতীয়টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রথম আঘাত হানেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যেখানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্তিকরণ বুঝায়, সেখানে তিনি বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়'। এই কথা বলে তিনি রাষ্ট্রীয় আচারে-অনুষ্ঠানে ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রবর্তন করলেন কুরআন-পাঠ, গীতি-পাঠ, ত্রিপিটক-পাঠ, বাইবেল-পাঠ ইত্যাদির বহু-ধর্মবাদী চর্চা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে ও ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির চরম লঙ্ঘন করলেন। কোথায়? সে-ও আবার পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই কর্মটি বাঙালী জাতির জন্য গৌরবের ছিলো না।
শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ১৯৭১ সালের ধর্মবাদী দালালদের ‘সাধারণ ক্ষমা'ই করেননি, তিনি অনুমোদন দেন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠার, যার মধ্য দিয়েই সদ্য স্বাধীন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলামবাদীরা নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে।
একনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর পূর্বসূরী একনায়ক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আরও এক কদম এগিয়ে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি হত্যা করলেন সংবিধান থেকে শব্দটিকে প্রত্যাহার করে এবং কুরআনের পংক্তি যুক্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় একনায়ক হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এসে রহমানবাদের হাতে আহত ও নিহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দিলেন ইসলামকে ‘রাষ্ট্র-ধর্ম' ঘোষণার মাধ্যমে।
এরশাদ-পরবর্তী শাসক খালেদা জিয়া এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সেই উত্তরাধিকারের সংরক্ষা করলেন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসার ও থাকার তাগিদে শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সেখান থেকে কু্রআনের পংক্তি ও ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম করার ঘোষণা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করতে পারলেন না। তিনি বরং এখন শারিয়া আইন প্রবর্তনের অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দ নেই। তার বদলে এসেছে ‘অসাম্প্রদায়িক' ধারণা। আওয়ামী লীগের অনুসারী বাম ও অভিসারী বামেরা পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি তেমন আর ব্যবহার করছেন না। তাঁরা বলছেন ‘অসাম্প্রদায়িকতা'র কথা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তোলার কথা বলছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূর্ত-নির্দিষ্ট রূপে ধারণ করেন না। তাহলে কেনো তারা এই চেতনার কথা বলছেন, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পরবর্তী পর্বে দেখানো হবে।
রোববার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com
 

Friday 11 November 2016

হামলার প্রতিক্রিয়া - নির্মলেন্দু গুণ,জাকির তালুকদার,সাখাওয়ত টিপু ও স্বকৃত নোমান

হামলার প্রতিক্রিয়া : সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক

০৬ নভেম্বর ২০১৬, ২৩:৪২
ফিচার ডেস্ক
গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ১৫টি মন্দির ও সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি আপলোডকে কেন্দ্র করে এই হামলা চালানো হয়। এর কদিনের মাথায় নতুন করে ১১টি বাড়িতে গভীর রাতে দেওয়া হয় আগুন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন দেশের প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও তরুণ লেখকরা। তাঁদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া নিচে দেওয়া হলো।
নির্মলেন্দু গুণ
কবি
পাকবাহিনীও তাদের স্থানীয় দোসরদের অত্যাচারে জন্মভূমিতে টিকতে না পেরে, ১৯৭১ সালে তো আমরা মালাউনরা ভারতেই চলে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম- কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, কিছুটা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য।
ভারত আমাদের খুব বেশিদিন থাকতে দিল না। নয় মাসের মাথায়, ১৬ ডিসম্বরে পাকি মুচুয়ার দল মিত্রবাহিনীর কাছে ( মতান্তরে ভারতের কাছে) রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে বসল।
আর সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থী শিবিরগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভারত ভদ্রভাবে আমাদের সদ্যোজাত বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিল। মানে push back করল।
সবাই যে ধাক্কা খাইয়া দেশত ফিইরা আইল, তা কিন্তু না। অনেকেই আমার মতো, আপনের মতো মহানন্দে নাচতে নাচতে ফিইরা আইল তার সাত পুরুষ ( মতান্তরে সাতশ' পুরুষ)-এর জন্মভিটায়।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগও অন্তত মুখে মানা করল না। বলল- ‘আয়, আয়। ভোটের সুময় তোরারে কামে লাগব। তয় দেহিস আবার ইলেকশনে দাঁড়াইচ না কুনু। তোরা দরকার পড়লে ভোট দিবি, আর মাঝেমইধ্যে আমলীগের পক্ষে মিছিল করবি, কবিতা, গান, নাটক এসব লেখবি। আয়। আইয়া পড়।’
আমরা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’তে হাসতে হাসতে, লাফাইতে লাফাইতে ফিইরা আইলাম।
এর পরের কাহিনী, যে কাহিনীর শেষ নাই, তা আপনে বলেন। আমারে একটু লুকায়া-লুকায়া কাঁদতে দেন।
আমি চাই না কবির চোখের জল সাধারণ মানুষে দেখুক।
আমাকে স্মরণ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জাকির তালুকদার
কথা সাহিত্যিক
নাসিরনগরের ঘটনা এই দেশে প্রথম নয়। আবার এটাই যে শেষ ঘটনা হবে, এমনটি মনে করা সবচাইতে নির্বোধ আশাবাদীর পক্ষেও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই রকম অপঘটনা ঘটে চলেছে বহুদিন ধরে।
কিন্তু এসব বন্ধ হয় না কেন?
বন্ধ হয় না, কারণ আমাদের অপরাজনীতি এবং লুটপাটের অর্থনীতি এসব ঘটনার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। আর ‘এই দেশের সাধারণ মানুষ পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক’- এই দাবি নিয়ে আমরা যতই গলা ফাটিয়ে চেঁচাই না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রক্রিয়ার দীর্ঘ সক্রিয়তা আমাদের সাধারণ মানুষের মননকেও বিষাক্ত করে তুলেছে।
গণতন্ত্র বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা না জেনেই আমরা গণতন্ত্রের নামে দেশের সবকিছুকে তুলে দিয়েছি কিছু রাজনীতিবিদের হাতে। আর চোখের সামনে তো দেখতেই পাচ্ছি যে, ক্ষমতা-সংশ্লিষ্ট শাসক দলগুলোর রাজনীতিতে ন্যূনতম রুচিশীলতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, মানবিকতার বিন্দুমাত্র জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। যে মানুষগুলো রাজনীতিকে মানবকল্যাণের সাথে এক করে দেখতে অভ্যস্ত, তারা হয় এসব দল থেকে অপসারিত, অথবা কোণঠাসা।
সাহিত্য-সংস্কৃতি যে মানুষের মনে শুভবোধ সৃষ্টি করবে, তারও কোনো অবকাশ নেই। কারণ সত্যিকারের সাহিত্য এবং সংস্কৃতি যাতে মানুষের কাছে পৌঁছুতে না পারে, তার সার্বিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র সম্পন্ন করেছে।
তাই আমাদের পক্ষ থেকে শুধু ঘৃণা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। বরং জনপ্রতিরোধের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার কাজটি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সাখাওয়াত টিপু                
কবি
সম্প্রতি নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নিন্দনীয়। আগেও রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম হামলা হয়েছে। বাংলাদেশ বহু জাতিগোষ্ঠী আর বহুভাষিক জনগণের রাষ্ট্র। সর্ব ধর্মের মানুষের রাষ্ট্র বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্ব ধর্মের মানুষের অধিকারের কথা বলা আছে। তারপরও কেন সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো ঘটছে? নানাবিধ কারণ থাকলে কিছু সংকটকে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকা। দলীয় লুটপাততন্ত্র আর ক্ষমতাকেন্দ্রীক সুবিধাবাদীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, দেশে সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রায়ণ নেই। অন্তত বুর্জোয়া গণতন্ত্র ব্যক্তি-মানুষের বিকাশের মূল্যবোধকে আমলে নেয়। সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে তার সামাজিক পরাগায়ন ঘটে। এই পরাগায়নে মানুষের প্রতি মানুষের দায়বোধ প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে এই সাংস্কৃতিক সংকট জায়মান।
তৃতীয়ত, নাগরিক অধিকার ভুলণ্ঠিত করে অন্যের সম্পদ আর জমি জবরদস্তি করে ভোগ-দখলের লালসা। ফলে নির্বাচনী ক্ষমতা বদলের রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িক চেহারা প্রকাশ্য হয়। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা, বিচার আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা তো গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। সব বর্ণ, সম্প্রদায় আর ভাষিক জনগোষ্ঠীর অধিকারও তাই। দুর্বলের ওপর হামলা-নির্যাতন-লুটপাট করে সবলেরাও সুখে থাকতে পারে না। তাই প্রয়োজন সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সবার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
স্বকৃত নোমান
কথাসাহিত্যিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এই বাণীটি কি শুধুই যুদ্ধকালের জন্য প্রযোজ্য ছিল? নাকি চিরকালের জন্য? মনে তো হয় না বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে তাঁর এই বাণীর কোনো গুরুত্ব আছে। ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের যে ঘটনাটি ঘটল তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যে ছেলেটি ইসলামের ‘অবমাননা’ করেছে তাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি অপরাধী হলে আইন মোতাবেক তাঁর বিচার হবে। কিন্তু তাঁর একার ‘অপরাধের’ জন্য এতগুলো বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা কেন? ঘটনার বিচার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে এই হামলা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ক্ষমতাসীন দলের অনেকে এর সঙ্গে জড়িত। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধগোষ্ঠী।
আমাদের মনে রাখা দরকার, এই দেশ শুধু মুসলমানের না। কখনো ছিল না। এই দেশ বহু জাতিগোষ্ঠীর। কতিপয় ধর্মোন্মাদ এই সত্যটি স্বীকার করতে চায় না। আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে এদের। স্বীকার করতে যাতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তারা কাণ্ডজ্ঞানহীন। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়, সরকারকে সেই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই বহু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কীভাবে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা যায়, অবশ্যই সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।