Wednesday 27 July 2016

চারু মজুমদার- মৃত্যুহীন ২৮ জুলাই------------- দেবব্রত চক্রবর্তী

মৃত্যুহীন ঃ- ২৮শে জুলাই
আজ থেকে ৪৪ বছর পূর্বে প্রায় ১২ দিন ধরে লকআপে অকথ্য অত্যাচারের অবশেষে ভোর ৪টের সময় কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাস্তা ব্যারিকেড করে সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তার নশ্বর দেহ । মাত্র ৯৬ পাউন্ড ওজনের ,অত্যন্ত দুর্বল শারীরিক কাঠামোর অধিকারী এই হাঁপানি আক্রান্ত মানুষটি তাঁর মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে আজকেও রাষ্ট্রের কাছে এক আতঙ্কের স্বরূপ । আজকেও তাঁর নাম নেওয়া এই দেশে নিষিদ্ধ। তাকে স্মরণ করা এই দেশের আইন মোতাবিক বিপদজনক। তাঁর নীতিতে বিশ্বাস করার অর্থ এই দেশের শাসকশ্রেনীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া । তাঁর লেখাপত্তর আপনার হেফাজতে পাওয়া গেলে আজকেও আপনি যে কোন মুহূর্তে গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন ,রাষ্ট্র দুয়ে দুয়ে চারের সরল অঙ্কে আপনাকে ৭-৮ বছর অনায়াসে জেলে আটকে রাখতে পারে । বাঙলার বুদ্ধিজীবী কুল পৃথিবীর সমস্ত ব্যক্তির বিষয়ে গম্ভীর আলোচনায় যুক্ত থাকলেও ,স্যাটানিক ভার্সেস থেকে তসলিমা নাসরিন নিষিদ্ধ কেন এই নিয়ে পাতার পর পাতা ভরালেও সযত্নে এড়িয়ে চলেন এই ব্যক্তিত্বকে অথবা নস্যাৎ করবার প্রতিযোগিতায় নাম লেখান দলে দলে । অথচ স্বাধীন ভারতবর্ষের এই সাত দশকের ইতিহাসে যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন ইনি তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব -এক এবং অদ্বিতীয় - ‘ চারু মজুমদার ‘ । আজকে তার হত্যার ৪৪ বছর পূর্ণ হোল ।
কলকাতা এবং দেশজুড়ে আজকের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সূচিতে -অমুক শোভাযাত্রা , তমুক শিল্প প্রদর্শনী , হাবিজাবি প্রতিবাদ , মাথা ধরানো সেমিনার ,বস্তাপচা নাটক ,দলিত নির্যাতন, এইডস বিষয়ক সচেতনতা সমেত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি খুঁজে পেলেও কোথাও চারু মজুমদারের স্মৃতিতে পথসভা , আলোচনা , সেমিনার , ধর্না , চিত্র প্রদর্শনী কিছুই আপনি খুঁজে পাবেননা । ধুপকাঠি গুচ্ছ জ্বালিয়ে নেত্রীর শ্রদ্ধা অবনতা মাল্যদানের যে প্রাত্যহিকতার ফটো সেশন তাতে উনি স্বযত্নে প্রত্যাখ্যাত । কোন খবরের কাগজে তাঁর বিষয়ে কোন নিবন্ধ , ছবি বা ইতিহাস আলোচনার প্রশ্নই ওঠেনা আর উঠবেই বা কেন ? চারু মজুমদার তো এই শাসক শ্রেনীর করুণা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তাদের উৎখাত করতে । চারু মজুমদার তো আর মধ্যবিত্তের নায়ক হতে চাননি তিনি চেয়েছিলেন নিপীড়িত মানুষ কে নায়ক বানাতে । সংসদীয় গণতন্ত্রের অসারতা চারু মজুমদার ছিঁড়ে ফালাফালা করেছিলেন আর তাই ভারতের সমস্ত সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল চারু মজুমদারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ । এই হাড় জিরজিরে লোকটির আত্মা এখনো তাদের তাড়া করে বেড়ায় । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে চারু মজুমদার একমাত্র ব্যক্তি মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও এদেশে যার নাম ফিস ফিস করে উচ্চারণ করতে হয় ।
১৯৭০ এর দশকের নক্সালবাড়ি আন্দোলন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম ভদ্রলোক নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ,বুদ্ধিবৃত্তি এবং স্থবির সামাজিক জগতের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল । ১৮-২৫ বছরের যুবাদের উৎসাহ , উচ্ছ্বাস এবং বিদ্রোহের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল এতদিনের সযত্ন লালিত মিথ । বিদ্যাসাগর থেকে রামমোহন ,সাহিত্য থেকে সিনেমা , শিক্ষা থেকে রাজনীতি ,সমাজনীতি থেকে অর্থনীতি সমস্ত কিছু আর প্রশ্নের উর্ধে নয় । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম সমস্ত কিছু কে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবার মানসিক ক্ষমতা , বিদ্রোহের ন্যায় সঙ্গত জন্মসিদ্ধ অধিকারের উল্লেখ এবং নূতন মানুষে উত্তরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন চারু মজুমদার । চারু মজুমদার এবং নক্সাল আন্দোলনের প্রায় সমস্ত প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্ব তাদের অসংখ্য লেখায় এতদিনের স্থবিরতা , স্ট্যাটাস কো কে অগ্রাহ্য করবার , চ্যালেঞ্জ করবার বারুদ যোগাচ্ছিলেন অবিরত । বিপ্লবী কারা ? কারা কাঁধ মিলিয়ে লড়বেন নিপীড়িত কৃষক শ্রমিক এবং দেশ ব্যাপী অত্যচারের বিরুদ্ধে ? কারা স্বার্থ ত্যাগ করে নূতন সমাজের বীজ বুনবেন ? চারু মজুমদারের "New Man” তারাই যারা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাধারন মানুষের স্বার্থে চরম আত্ম্ত্যাগ করবার মত ক্ষমতা অর্জন করে । ছাত্র এবং যুবা -যাদের কাঁধে প্রতিক্রিয়াশীল অতীতের বোঝা নেই । ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের প্রবণতা নেই । শিক্ষার দক্ষতায় বিভিন্ন তত্ব এবং অবস্থান বিশ্লেষণে সক্ষম সেই যুবক -ছাত্র -তরুণ সম্প্রদায় কৃষকের সাথে শ্রমিকের সাথে দীর্ঘ আত্মত্যাগের মাধ্যমে , বিপ্লবের আগুনে পুড়ে নিজেদের নতুন মানুষে , বিপ্লবী চরিত্রে পরিবর্তিত করবেন । আর এই সমস্ত বিপ্লবী চরিত্র , ছাত্র -যুবা সেই অগ্রণী শ্রেণী যারা বিদ্রোহের প্রথম আগুন জ্বালাবেন ,রাষ্ট্রের কাগুজে বাঘের চরিত্র উন্মলিত করবেন এবং সাধারন জনতাকে নিজেদের স্থাপিত দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হতে উৎসাহিত করবেন ।
ইতিহাস স্বাক্ষী চারু মজুমদার এবং তার বিপ্লবী আগুনে ব্যক্তিত্ব , স্বার্থ ত্যাগ করে ‘নূতন ‘ মানুষে পরিবর্তিত হওয়ার আহ্বান কত অসংখ্য ছাত্র -যুবককে ক্যারিয়ার তুচ্ছ করে স্থবির সমাজের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেওয়ার ভাবনায় অনুপ্রাণিত করেছিল । স্বছল ,সুখী নিশ্চিন্ত জীবনের মায়া ত্যাগ করে দুর্গম গ্রামে কৃষকের দাওয়ায় নিজেদের শ্রেণী চরিত্র পরিবর্তন করবার সেই প্রয়াসে কোন ছল বা ধান্দাবাজি ছিলোনা। কিছু পাওয়ার আশায় কেউ শখ করে গ্রামে যাননি । গিয়েছিলেন নূতন মানুষে পরিবর্তিত হওয়ার অন্তরের তাড়নায় । চারু মজুমদার সেই আগুনের মত ব্যক্তিত্ব যিনি একটা গোটা প্রজন্মকে শ্রমিক ,কৃষক ,দলিত ,নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন । নক্সাল আন্দোলনে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা বা স্ট্রেটেজিক দুর্বলতা ছিল নিশ্চয়ই ,পরিকল্পনা বা সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রমাণিত সত্য কিন্তু বিপ্লব তো কেবল যেন তেন পথে ক্ষমতা দখল নয় “ The struggle of ours is not only [for] a seizure of power. Comrade Charu Mazumdar has said that we must become new men. This is a struggle for the birth of new men” ।
নক্সাল আন্দোলনের ব্যর্থতা , রাষ্ট্রীয় নির্মম সন্ত্রাস , রাজনৈতিক হটকারিতা ,সাংগঠনিক দুর্বলতা সমস্ত বাস্তব সত্য এবং তথ্য সমেত বর্তমান । চারু মজুমদারের হত্যার ইতিমধ্যে ৪৪ বছর অতিক্রান্ত । তার নির্দেশিত পথের অধিকাংশ আজকে পরিত্যক্ত ,পার্টি শতধা বিভক্ত , কিন্তু তবুও কেন এখনো “ চারু মজুমদার’ নাম উচ্চারণের পূর্বে আসে পাশের শ্রোতাকে দেখে নিতে হয় ? কেননা সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সমবেত বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেওয়ার সচেতন প্রয়াসকর্তারা জানেন চারু মজুমদার কেবল মাত্র একটি সত্যের জন্য বেঁচে থাকবেন - তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন বিদ্রোহ আমাদের ন্যায় সঙ্গত জন্মসিদ্ধ অধিকার এবং কেবল ক্ষমতা দখল নয় “ We must become new men .This is a Struggle for the birth of new men” ।
তবে কি এখানে ওখানে ইতিউতি কিছু পোস্টার , সস্তার কাগজে ছাপা কিছু লিফলেট , লোক চক্ষুর অন্তরালে কোন জঙ্গলে তার স্মৃতিচারণ আর প্রায় বৃদ্ধ কিছু মানুষের স্মৃতিতেই কি কেবল বেঁচে আছেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা ? নাকি আমাদের জ্ঞাত জগতের বাইরে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ চারু মজুমদারের নাম, লেখা ,দর্শনের সাথে পরিচিত হন ? নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে তাঁর জীবন উৎসর্গ কে স্মরণ করেন। নতুন নতুন মানুষ চারু মজুমদারের নীতিকে সঠিক মেনে ক্ষেতে খামারে খেটে খাওয়া মানুষদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত হন ? রাষ্ট্রর আধিপত্য একই ঔদ্ধত্যে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য দল বাঁধেন এবং শুরু করেন “ Struggle for the birth of new men “?
চারু মজুমদার সেই ধরনের বিরল বিস্ফোরক যাকে নিষ্ক্রিয় করবার ক্ষমতা রাষ্ট্র তাঁর মৃত্যুর ৪৪ বছর পরেও আয়ত্ত্বে আনতে অক্ষম ।

Tuesday 26 July 2016

ওয়ালিউল্লাহর লালশালু আর এই সময় --------স্বকৃত নোমান

ইসলামি জঙ্গিবাদ বিরোধী চর্চা
ওয়ালীউল্লাহ 'লালশালু' আর এই সময়
স্বকৃত নোমান
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউনের ওয়েবসাইট
(বাংলা ট্রিবিউনে স্বকৃত নোমানের একটা অসাধারণ লেখা। লিখেছেন ঐ বাংলার ইসলামি জঙ্গিবাদ বিষয়ে, কিন্তু তাঁর লেখা এ বাংলার জন্যও প্রযোজ্য, বিশেষ করে ফকির-বাউলদের বিরুদ্ধে যেভাবে কট্টরপন্থীরা কয়েক বছর আগে হিংসক আন্দোলন করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতে স্বকৃতের এই লেখাটা উতসাহ জাগায়, আমাদের পরম্পরা ফিরে দেখতে সাহায্য করে। লেখাটা একটু বড় কিন্তু ধৈর্য ধরে পড়লে অনেক ধন্ধ কাটিবে বিশ্বাস করি।)
...প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে ধর্মব্যবসাকে আক্রমণ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে বসলেন। এটি ওয়ালীউল্লাহর বিভ্রান্তি, কট্টরপন্থী আরবীয় ও সহজিয়া বঙ্গীয় ইসলামের সুক্ষ্ম ফারাকটাকে না বোঝার ফল।
প্রিয় পাঠক, শুরুতেই আমাকে মূর্খ আর বেয়াদব বলে গালি দেওয়ার আগে পুরো লেখাটা আগে পড়ুন, ওয়ালীউল্লাহর বিভ্রান্তিটা কোথায় তা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। খুব গভীরভাবে খেয়াল করতে হবে যে, মোদাচ্ছের পীরের কল্পিত মাজারের খাদেম হচ্ছে মজিদ। উপন্যাসে মজিদ যেসব উগ্র কথাবার্তা বলে, কট্টরপন্থী সালাফি অনুসারীদের মতো, বাংলাদেশের কোনো মাজারের কোনো খাদেম এমন উগ্র কথাবার্তা বলে না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে এই দেশের মাজারগুলো ঘুরে দেখা যেতে পারে, মাজারভক্ত বা মাজারের খাদেমদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে এমনকি ভারতের মাজারগুলোতে মজিদ-কথিত ওসব ইসলামি উগ্রবাদ অতীতে কখনো চর্চা হয়নি, বর্তমানেও হচ্ছে না। যারা মাজারভক্ত বা মাজারের খাদেম তারা উগ্রপন্থী নন, তারা সহজিয়া বঙ্গীয় মুসলমান। ঠিক এই কারণেই সিলেট শাহ্ জালালের মাজারে বোমা মেরেছিল জেএমবি। মাজারকেন্দ্রিক যে ইসলাম, তা বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলাম। জামায়াত-হেফাজত-জেএমবির অনুসারীরা বঙ্গীয় ইসলামকে স্বীকার করে না, মাজারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে হিন্দুদের জন্য টয়লেট নির্মাণের কথা বলে। মাজারভক্তরা বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, তারা কথায় কথায় কাউকে কাফের বলে না, মজিদ যেমন বলে। ওয়ালীউল্লার বিভ্রান্তিটা এখানেই। তিনি মজিদকে দেখিয়েছেন আরবীয় কট্টরপন্থী ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি তিতুমীরের অনুসারী তথা অধুনা জামায়াত-হেফাজত ও জঙ্গিদের অনুসারী হিসেবে। অথচ মজিদকে তিনি যেখানে বসালেন, অর্থাৎ মাজারে, সেই জায়গাটা বঙ্গীয় ইসলামের জায়গা। এই মাজার সমন্বয়বাদের জায়গা, উদারতাবাদের জায়গা, গান-বাজনার জায়গা, হিন্দু-মুসলমানের জায়গা। মজিদ বলছে, গান-বাজনা হারাম। অথচ বাংলাদেশে একটা মাজারও নেই যেখানে গান-বাজনা হয় না, ওরস হয় না, হিন্দুরা যায় না। ‘লালসালু’তে ওয়ালীউল্লাহ সহজিয়া বঙ্গীয় ইসলামের সঙ্গে কট্টরপন্থী আরবীয় ইসলামের তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। উপন্যাসটিতে মারাত্মকভাবে সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যিক এবং ঐতিহাসিক বিপর্যয় ঘটেছে।
বিপর্যয়টা কিভাবে ঘটেছে? তার আগে বোঝা দরকার বঙ্গীয় ইসলামের স্বরূপ। বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সুফিদের ভূমিকা যে মুখ্য ছিল সেই বিষয়ে এখন আর কোনো দ্বিমত নেই। সুফিরা শরীয়ত অপেক্ষা ঈশ্বরপ্রেমের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং স্থানীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতেন। তাতে শরীয়তপন্থী ওলামাদের চেয়ে সুফিরা অনেক বেশি গ্রহণীয় ছিলেন জনসাধারণের কাছে। সুফিরা আবার সালিক ও মজ্জুব দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন। সালিকেরা সুফি হলেও শরিয়তে পুরোপুরি বিশ্বাসী, আর মজ্জুবেরা শরিয়তে তত আস্থাশীল ছিলেন না। মজ্জুব বা বেশরা ফকিররাই ছিলেন জনসাধারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আদৃত। কারণ তারা ছিলেন ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ সম্পন্ন, যাকে বলা হয় কারামত। আদৌ তারা অলৌকিক কিছু দেখাতে পারতেন কিনা, এই কালে এসে সেই বিচারে আমরা যাব না। তবে এ কথা সত্য, গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেত। এই বেশরা ফকিররাই বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং মুসলমানদের পাশাপাশি বহু হিন্দুকেও তাঁদের মুরিদ বানান।
সুফিদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলাম ছিল উদার। কট্টরপন্থাকে তারা প্রশ্রয় দিতেন না। তারা ছিলেন সমন্বয়বাদী। তাদের প্রচারিত ইসলামে যারা দীক্ষিত হয়েছিল ইসলাম ধর্ম-শাস্ত্রদি চর্চা না করে তারাও পূর্ব-পুরুষদের মতোই রামায়ণ-মহাভারত পাঠ করত। হিন্দুরা যেমন গুরুর প্রতি ভক্তিশীল, তেমনই মুসলমানরা গুরুর পরিবর্তে পীরের প্রতি ভক্তিশীল ছিল। ফলে মুসলমানের পীর হলো হিন্দু গুরুর বিকল্প এবং ক্রমে ক্রমে সত্যপীর, মানিকপীর, ঘোড়াপীর, মাদারীপীর ও কুমিরপীর নামে পাঁচ পীরের পূজা আরম্ভ হলো। মাছ ও কচ্ছপকে খাদ্য দেয়া, গাছের ডালে সুতো বাধা ইত্যাদি গ্রামীণ হিন্দু সমাজে প্রচলিত নানা ‘কুসংস্কার’ বাঙালি মুসলমানরা মেনে থাকে ইসলামের নির্দেশে নয়, পূর্ব-পুরুষের ধারাবাহিক বিশ্বাসে। এভাবে হিন্দুদের বনদুর্গা, ওলাইচণ্ডী প্রভৃতি লৌকিক দেবী মুসলমানদের বনবিবি, ওলাবিবির রূপ নিয়েছে। শ্রীচৈতন্যের শ্রীকৃষ্ণ নাম সংকীর্তনের মতো মুসলমানদের মধ্যেও প্রচলিত হলো মিলাদ অনুষ্ঠান। এই মিলাদ কিন্তু আরবীয় ইসলামে নেই, আছে শুধু বঙ্গীয় ইসলামে।
আবার মিলাদ ‘কেয়াম’ বা মিলাদ পড়াকালীন নবীকে হাজির-নাজির মেনে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করারও একটা নিয়ম প্রচলিত হয়, যা এখনো প্রচলিত। এটির প্রচলন হয় স্পষ্টতই শ্রীচৈতন্যের নাম সংকীর্তনের রীতি থেকে। শ্রীচৈতন্য ও তার ভক্তরা নাম সংকর্তীন করতে করতে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নৃত্য করতেন। মুসলমানদের মিলাদের মধ্যে এটিও প্রবিষ্ট হলো। মিলাদ পাঠের একটা পর্যায়ে তারা দাঁড়িয়ে যায়। সালিক সুফিরা মিলাদকে ‘বেদায়াত’ বা ইসলামে নতুন আবিষ্কার হিসেবে দেখতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজে মিলাদের রেওয়াজটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে সালিক সুফিরা মিলাদকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারেননি। মিলাদকে স্বীকৃতি দিলেও মিলাদের মধ্যে ‘কেয়াম’কে তারা স্বীকৃতি দিলেন না। কেয়ামের মধ্যে তারা স্পষ্টতই হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির, যা শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত, প্রভাব দেখতে পেতেন।
অপরদিকে জন্মাষ্টমির মতোই উদযাপিত হতো নবীর জন্মদিন, যা এখনো উদযাপিত হয়। হিন্দুদের শ্রাদ্ধের মতোই ছিল পীরের মৃত্যু দিন উপলক্ষে ওরস। বিষ্ণুপাদপদ্মের মতো পূজ্য ছিল নবীর পায়ের ছাপ, কদম রসুল। চট্টগ্রামের ‘কদম রসুল’ মসজিদ আজও বর্তমান। গৌড়ের একটি সৌধে আছে পাথরের কদম রসুল বা নবীর পায়ের ছাপ। ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবারের বেরা ভাসান উৎসব আসলে ইসলামি মিথের সমুদ্র শাসক খোয়াজ খিজিরের উপাসনা। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উৎসব বেরা ভাসানে মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজউদদ্দৌলাও যোগ দিতেন। মুর্শিদাবাদের নবাব-প্রাসাদে দেওয়ালীও উদযাপিত হতো। দেওয়ালী লঙ্কা বিজয়ের পর রামচন্দ্রের রাজ্যভিষেকের উৎসব। তার মানে এটি হিন্দু সংস্কৃতির উৎসব। মুসলমানরাও এটিকে গ্রহণ করল।
এছাড়া নবীকন্যা ফাতেমাও বিবি ফাতেমা নামে পূজিত হতেন বাংলাদেশে। কারবালার যুদ্ধের মহররম ও হাসান হোসেনের প্রাণদানের কাহিনি প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল বাংলাদেশের জনমানসে। তারই প্রভাবে মীর মশাররফ হোসেন রচনা করলেন ‘বিষাদ সিন্ধু’। বেগম রোকেয়াও লিখেছেন হাসান-হোসেনের কাহিনি। হাসান-হোসেন ও অন্যান্য ইমামরা নবী ও তার খলিফাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বাংলার মুসলিম জনমানসে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে। তখন গ্রামীণ সমাজে যাত্রা এবং বারোয়ারী পূজার মতো আমোদ-প্রমোদ হিন্দু ও মুসলমানরা একত্রে সমভাবে উপভোগ করত। মুসলমানরা হিন্দুদের মতো সমভাবে চাঁদাও দিত এসব ব্যাপারে, যদিও হিন্দুরাই ছিল এসব উৎসবের সংগঠক। মূর্তিপূজা এবং হিন্দু পুরাণের বিষয়বস্তু নিয়ে পৌরাণিক পালা ও কবিগান মুসলমানরাও উপভোগ করত। এছাড়া ছিল মুসলমানদের গাজীরামের গান এবং হিন্দুদের কীর্তনের দল। এভাবে গ্রাম বাংলার কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন ছিল। পরম শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের মধ্যে বাস করত দুটি সম্প্রদায়। বলা বাহুল্য, মানুষের সহজাত এসব প্রবৃত্তি শরিয়ত বিরোধী, কিন্তু রক্তগত হিন্দু চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই ধরনের হিন্দু মুসলমান সমন্বয় সম্বলিত বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল মূর্তিমান বিচ্ছিন্নতাবাদ-তিতুমীরের শরিয়তী আন্দোলন তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া। তিতুমীরের আগে এই বিচ্ছিন্নতাবাদ বা কট্টরপন্থার প্রচারক ছিলেন শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি, সায়িদ আহমদ বেরলবি প্রমুখ। বঙ্গীয় মুসলমান আচরিত এসব সংস্কৃতিকে তারা কুসংস্কার হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। এরা বঙ্গীয় সমন্বয়বাদী ইসলামের পরিবর্তে প্রচার করলেন তথাকথিত বিশুদ্ধ আরবীয় ইসলাম। এই শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি ও তিতুমীরের উত্তরসূরী হচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশের ওয়াহাবি বা খারেজি বা কওমি তরিকার অনুসারীরা, অধুনায় যারা হেফাজতে ইসলামের অনুসারী এবং জামায়াতে ইসলামির অনুসারী।
জামায়াত ও হেফাজত একই ইসলামী তরিকার অনুসারী। অর্থাৎ তারা শিরহিন্দি, দেহলভি, বেরলবি ও তিতুমীরের অনুসারী। কিন্তু পরবর্তীকালে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর কিছু কিছু বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করতে না পেরে প্রচণ্ড জামায়াত-বিদ্বেষী হয়ে পড়ে কওমি তরিকার অনুসারীরা। মওদুদীকে তারা কাফের বলতেও ছাড়ে না। বর্তমানে হেফাজত ও জামায়াতের নীতিগত ধারা দুটি হলেও মৌলিক ধারা কিন্তু এক, অর্থাৎ তারা বঙ্গীয় সমন্বয়বাদী ইসলামকে স্বীকার করে না। তার পরিবর্তে এদেশে আরবীয় কট্টরপন্থী ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। হেফাজতের অনুসারী সালিকীয় তরিকার সুফিবাদকে স্বীকার করলেও এবং এই ধারার চর্চা করলেও মজ্জুব তরিকাকে তারা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে। মজ্জুবীয় সংস্কৃতিকে তারা বেশরা কাজ বা বেদাত হিসেবে সাব্যস্ত করে এবং এসবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। অপরপক্ষে জামায়াতের অনুসারিরা মনে করে, সালিক বা মজ্জুব তরিকা কোনোটাই আরবীয় ইসলামের মধ্যে নেই। জামায়াত এ দুটি তরিকাকেই অস্বীকার করে। তার মানে আদর্শগতভাবে তারা পরিপূর্ণভাবে আরবীয় ইসলামের অনুসারী, যদিও বাস্তবে আরবীয় ইসলামের ছিঁটেফোটাও তাদের মধ্যে নেই।
উপরে সমন্বয়বাদী বঙ্গীয় ইসলামের যেসব সংস্কৃতির কথা বলা হলো, সেসব আগে ছিল, এখন নেই, বিষয়টা এমন নয়। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে এখনো বঙ্গীয় ইসলামের এই সহজিয়া সমন্বয়বাদী ধারা প্রচলিত রয়েছে। যেমন মাজার সংস্কৃতি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত মাজার। যেমন চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারের মাজার, সিলেটের শাহ্ জালালের মাজার, রাজশাহীর শাহ্ মাখদুমের মাজার, খুলনার খান জাহান আলীর মাজার। এছাড়াও বাংলাদেশের কত জায়গায় কত নামে কত মাজার যে আছে তার প্রকৃত কোনো শুমার নেই। এসব মাজারকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিটা এখনো জারি রয়েছে। যেমন মাজার ভক্তদের মধ্যে রয়েছে মিলাদ, কেয়াম, ওরস, গান-বাজনার প্রচলন। সাংস্কৃতিকভাবে তারা উদার। মাজারে মুসলমানরা যেমন যায় তেমনি হিন্দুরাও যায়। তাতে মুসলমান ভক্তদের ধর্মানুভূতিতে কোনো আঘাত লাগে না। মাজারভক্তরা জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না, ইসলামের কোনো বাড়াবাড়িকে তারা প্রশ্রয় দেয় না। মাজারে গিয়ে তারা পীরের সমাধীর সামনে সেজদায় উপনীত হয়। অর্থাৎ পীরকে তারা সেজদা দেয়। কারণ পীরের মধ্যেই তারা ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজে পায়। এই কারণে মাজার-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আরবীয় কট্টরপন্থী জামায়াত-হেফাজতের যত ক্ষোভ। সিলেটে শাহ্ জালালের মাজারে জেএমবি বোমা মেরিছিল এ কারণেই। মাজারগুলোকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল জেএমবি এই কারণেই। উল্লেখ্য, জেএমবি কিন্তু সালাফি ইজমের অনুসারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। প্রকাশ্যে না হলেও নৈতিকভাবে জামায়াত এই সন্ত্রাসকে সমর্থন দিয়ে থাকে। আগেই বলেছি, আদর্শগত কিছু কিছু দ্বন্দ্ব থাকলেও তাদের মৌলিক আদর্শ এক। উভয়পক্ষই এ দেশকে দারুল ইসলাম বানাতে চায়।
অপরদিকে, মাজার কেন্দ্রিক এই সংস্কৃতিকে আদর্শিকভাবে সমর্থন দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের একটি ইসলামিক দল। গ্রাম বাংলায় তাদেরকে ‘সুন্নি’ বলা হয়। এই সুন্নি কিন্তু সালাফিদের মতো সুন্নি নয়। আহলে সুন্নাতের অনুসারীরা কিন্তু প্রগতিশীল। বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিকে তারা মনে প্রাণে সমর্থন করে। তারা কখনোই জামায়াত-হেফাজত বা সালাফি ইজমকে সমর্থন করে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে। ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো রকমের বাড়াবাড়ি নেই। আহলে সুন্নাতের অনুসারী মৌলানারা যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য প্রদান এবং সাঈদীর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এই কারণেই চট্টগ্রামে শীর্ষ দশ আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জামায়াত। বঙ্গীয় ইসলামি সংস্কৃতিকে জারি রেখে তারা ইসলামী কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। জামায়াত-হেফাজতের বিরুদ্ধে তারা নীরবে চালিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। রাজধানী ঢাকায় বসে আমরা যারা ইসলামী কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে কথা বলছি, সাদা চোখে আমরা সেই লড়াই দেখতে পাই না, বুঝতে চাই না। কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে যে সাংস্কৃতিক মোকাবিলা বা লড়াইটা দরকার সেটা আমরা দিচ্ছি না, দিচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, দিচ্ছে মাজারভক্ত হাজার হাজার বাঙালি মুসলমান।

এই হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানের চরিত্র কিন্তু মজিদের মতো নয়। মজিদ যেসব কথাবার্তা বলে, এই মাজারপন্থী মুসলমানরা সেসব কথার ধারে কাছেও যায় না। প্রিয় পাঠক, এবার আপনারাই বিচার করুন ‘লালসালু’র মজিদ কি হেফাজত-জামায়াত বা সালাফিদের অনুসারী, নাকি মাজার কেন্দ্রিক বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলামের অনুসারী? এই বিষয়ে সবাই একমত হবেন যে, মজিদ সালাফিবাদী কট্টরপন্থার অনুসারী। তার কথাবার্তায় অন্তত তা-ই প্রতিভাত হয়। অথচ ওয়ালীউল্লাহ মজিদকে বসালেন মাজারে, বঙ্গীয় ইসলাম চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। মজিদের চরিত্রের সঙ্গে মাজার কোনোভাবেই যায় না। মাজারের পরিবর্তে যদি মজিদকে একটা মসজিদে বা মক্তব্যে বসানো হতো, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না। সুতরাং ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’তে যে সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তিটা ঘটিয়েছেন তার পুনর্পাঠ, পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ে দাবি।

Sunday 17 July 2016

পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে ------------ মুহম্মদ তকিউয়াল্লাহ

পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে
মুহম্মদ তকীয়ূলাহ
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে আমাকে বহিস্কার করা হয়
১৯৪৮ সালে। এর কয়েক মাস পরেই আমার নামে হুলিয়া জারি হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ
থেকে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হলো ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যাবার।
এরপর কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে আমি যখন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেই তখন আমাকে জীবিত বা মৃত
ধরিয়ে দেবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সেসময় পাঁচহাজার টাকায় ঢাকা শহরে একটি মাঝারি
আকারের বাড়ি কেনা যেত।
১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হলো আমার পলাতক জীবন। সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথচলা সেই
জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে আতংক, বিপদের হাতছানি আর পাশাপাশি কত না ঘটনা, কত আনন্দ বেদনার গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয়েরহল থেকে বের করে দেওয়ার পরও আমি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে হলে যেতাম। অবশ্য সে সময় ছাত্ররা
প্রায়ই আমাকে সাবধান করে দিতেন যে ‘আপনাকে পুলিশের লোক খোঁজে’। সেসময় আমি মাঝে মাঝে
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বাসস্থানে থাকতাম। কখনও সুইপার কলোনিতে লুকিয়ে থাকতাম। আমরা
শ্রমিক কর্মচারীদের দাবীদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সহায়তা দিতাম। এটাই ছিল কমিউনিস্ট
পার্টির কর্মকাÐ। সেসময় দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা জড়িত ছিলেন। পার্টি নিষিদ্ধ
ছিল। কিন্তু আন্দোলনগুলোতে পার্টি কর্মীদের অংশগ্রহণ তা সে ছদ্ম পরিচয়েই হোক আর প্রকৃত নামেই হোক ছিল
আনন্দপাঠ ২০১৬ ঈদ সংখ্যা ২৬
স্মৃতিকথা
পুরো মাত্রায়। এইভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে একদিন বৃহত্তর বিপব হবে আমরা সেই স্বপ্নই
দেখতাম।ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের যোগ ছিল। কলকাতার নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে অনেক সময়
নির্দেশ আসতো। মস্কো এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। আগেই বলেছি আমার সরাসরি
নেতা ছিলেন নেপাল নাগ।মণিসিংহ ছিলেন আরও উচ্চ পর্যায়ের নেতা। নেপাল নাগের ছদ্মনাম ছিল রহমান ভাই।
আমার ছদ্মনাম ছিল ইউসুফ আনোয়ার খান বা ওয়াই এ খান। বিহারী বা অবাঙালী সাজতাম মাঝে মধ্যে। আবার
কখনও কখনও অমরবাবু নামেও পরিচয় দিতাম। কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ম অনুসারে এসব ছদ্মনাম এবং প্রকৃত পরিচয়
কঠোরভাবে গোপন রাখা হতো। ফলে আমার অধিকাংশ কমরেড জানতেন না আমার প্রকৃত নাম কী বা কী আমার
পরিচয়। সেসময় পরিচয় গোপন রাখার জন্য আমি কখনও গোঁফ দাঁড়ি রাখতাম, কখনও বা ক্লিনড শেভ। আমি
সিগারেট খাই না। কিন্তু ছদ্মবেশ ধরার জন্য কখনও কখনও সিগারেট বা চুরুট খেতে হতো। ভীষণ বাজে লাগতো
বিষয়টা। কখনও ধুতি চাদর পরে হিন্দু ভদ্রলোক সাজতাম। অভিনয় শিখেছিলাম বন্ধু খান আতার কাছ থেকে। ঢাকা
কলেজে পড়ার সময় সে আমার সহপাঠী ছিল। আমরা দুজনে একসাথে নাটক করেছি। নাটকে আমি মেয়ে সাজতাম।
যাই হোক। চেহারার গড়ন বদলানোর জন্য কপালের সামনের দিকের চুল পাক করে তুলে চওড়া কপাল
বানালাম। এ কাজে আমাকে সাহায্য করলেন বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সার। আমি এবং শহীদুল্লাহ কায়সার অনেকদিন
একসঙ্গে পলাতক জীবন যাপন করেছি। আমাদের আরেক কমরেড ছিলেন নাদেরা বেগম। এই সাহসী নারী
কমরেডের গল্প সেসময় ছিল আরও অনেক কর্মীর অনুপ্রেরণার উৎস। একবার একটি বাড়িতে নাদেরা বেগম পলাতক
ছিলেন। সে বাড়িতে পুলিশ হানা দিলে তিনি দেয়াল টপকে পালাতে যান। তখন পুলিশ তার শাড়ি চেপে ধরলে তিনি
শাড়ি ফেলে বাউজ পেটিকোট পরেই পালিয়ে ছিলেন।
আমি এবং নাদেরা অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী সেজেও থেকেছি। তিনি খুব দৃঢ় চরিত্রের সাহসী কমিউনিস্ট
ছিলেন।
শহীদুল্লাহ কায়সার ও আমি ছিলাম ঘনিষ্ট বন্ধু। সে কথা আগেই বলেছি। আমাদের কাজ ছিল শ্রমিক
ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ করা। সেসময় জেল পুলিশ ইউনিয়ন ও রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন হয় আমাদের দুজনের
উদ্যোগে। আমরা দুজন সচিবালয়ের কর্মচারীদের মধ্যেও সংগঠন গড়ে তুলি।সেসময় ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির
নেতৃত্বে ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। তিনি ছিলেন পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সেক্রেটারি। সেক্রেটারিয়েটে
আরও ছিলেন জ্ঞান চক্রবর্তি, অনিল মুখার্জি আমি ও শহীদুল্লাহ কায়সার। আরও অনেকে ছিলেন কিন্তু তাদের নাম
এখন ভুলে গেছি।
সেটা সম্ভবত ১৯৫০ সাল। ইসলামপুরের এক বাড়িতে আমাদের পার্টির গোপন মিটিং হয়। নিয়ম ছিল
মিটিং শেষ করে কয়েকজন সে বাড়িতে থেকে যাবে। আবার কয়েকজন ধীরে ধীরে মানে একজন একজন করে সে
বাড়ি থেকে গোপনে বের হবে। একসঙ্গে একবাড়িতে অনেক লোক ঢুকলে বা বের হলে তো পুলিশের সন্দেহ হবে।
তাই এই ব্যবস্থা। সে রাতে আমার সেই বাড়িতেই থেকে যাবার কথা। কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সার বললো, ‘তকি চলো।
আজ অন্য কোথাও থাকবো। রাতে কাবাব খাবো’। আমি আর কায়সার বেরিয়ে গেলাম। সেই রাতেই বাড়িতে পুলিশ
হানা দিল। সরদার অ্যারেস্ট হলো। আমি শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে ছিলাম বলে বেঁচে গেলাম। পলাতক জীবনে
আমিও অনেক বার কায়সারকে পালাতে সাহায্য করেছি। দুজনে একসঙ্গে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি গ্রামের পথে,
শ্রমিক বস্তিতে থেকেছি ছদ্মপরিচয়ে। তখন ভেবেছিলাম কমরেডবন্ধুকে সবসময় এইভাবেই রক্ষা করতে পারব। কিন্তু
১৯৭১ সালে আলবদর ঘাতকরা যখন তাঁকে নিয়ে যায় তখন তো আমি তাকে রক্ষা করতে পারিনি। এমনকি ১৬ই
ডিসেম্বর রায়ের বাজারের সেই বধ্যভূমিতে আমি প্রিয় বন্ধুর মৃতদেহটিও খুঁজে পাইনি। কিন্তু প্রিয় বন্ধু, সাম্যবাদী
সমাজের স্বপ্নের ভিতর আজও তুমি বেঁচে আছ।
ইসলামপুরের সেই বাড়ি থেকে পুলিশ সরদার ফজলুল করিমকে অ্যারেস্ট করার পর পার্টির পক্ষ থেকে
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং আমাকে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি করা হয়।
সেসময় আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমার বড়বোনের বাসায় যেতাম। তার বাড়ি ছিল আলি নেকির দেউড়িতে।আমার
মাথার দাম তখন পাঁচ হাজার টাকা। ছোটবু ও বড়বু ঠাট্টা করে বলতেন ‘বেলাতকে ধরিয়ে দিয়ে আমরাই টাকাটা
নিয়ে নেই।’ তারা ঠাট্টা করলেও আমার অনেক আত্মীয় কিন্তু সত্যিই একথা ভাবতেন। বিশেষ করে একজন আত্মীয়
ছিল পুলিশের ইনফরমার। সেকথা অবশ্য তখন আমার মা এবং ভাইবোনরা জানতেন না। এই আত্মীয়ই আমাকে
পুলিশের কাছে ধরিযে দিয়েছিল। শুনেছি পাঁচ হাজার টাকায় সে ঢাকা শহরে একটা বাড়িও কিনেছিল।
আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকার সময় বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিতাম। কখনও ইউসুফ আনোয়ার খান কখনও অমরবাবু নামে।
আনন্দপাঠ ২০১৬ ঈদ সংখ্যা ২৭
স্মৃতিকথা
এসব বাড়িতে যারা আশ্রয় দিতেন তারা ছিলেন ‘সিমপ্যাথাইজার’। তার মানে তারা হয়তো পার্টির কমরেড নন কিন্তু
পার্টির প্রতি বা আমাদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল। হয়তো বাড়ির কোনো ছেলে পার্টির প্রতি সিমপ্যাথাইজার
বা কোনোভাবে ছাত্র সংগঠন বা শ্রমিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যরা কোনোভাবে পার্টির সঙ্গে
যুক্ত নয়। কিংবা হয়তো কোনো কমরেডের আত্মীয় বাড়ি। সেখানে তারা আমার প্রকৃত পরিচয় জানতেন না। যে
কমরেড আমাকে সেখানে নিয়ে গেছেন তিনি তার আত্মীয় বা বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনিও জানতেন না আমার
প্রকৃত নাম কী। হিন্দু ধর্মের কারও বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার সময় হিন্দু পরিচয় দিয়েই থাকতাম। খেতে বসে খুব
সতর্ক থাকতে হতো পাছে বাম হাত দিয়ে পানির গাস বা চামচ ধরে ফেলি। অধিকাংশ বাড়িতেই বাড়ির মেয়েরা
আমাকে খুব আদর যতœ করতেন।
একবার এমনি একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলাম। সে বাড়ির তরুণী মেয়েটি আমার প্রেমে পড়লেন। তার
বাবা-মা আমার সঙ্গে তাদের আদরের মেয়ের বিয়ে দিতেও প্রস্তুত। কারণ তারা মনে করেছিলেন আমি কোনো সম্ভ্রান্ত
হিন্দু পরিবারের সন্তান। এদিকে তখন আমি বিয়ে করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। আমার এই অনিশ্চিত জীবনের
সঙ্গে কি কাউকে জড়ানো চলে? হাই কমান্ডের কাছে আমার করণীয় জানতে চাইলাম। পার্টির জরুরি নির্দেশে আমি
সেই বাড়ি ত্যাগ করে চলে আসি। পরে শুনেছি তারা সপরিবারে কলকাতায় চলে যায়। ভুল সময়ে, ভুল মানুষের
প্রেমে পড়া সেই তরুণীর সঙ্গে জীবনে আর কখনও দেখা হয়নি। তার জন্য এখানে রইল একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস।
পলাতক জীবনের প্রসঙ্গে শহীদুল্লাহ কায়সারের একটি কথা মনে পড়ছে। তার হাতের রান্না বিশেষ করে
ডাল রান্না ছিল অপূর্ব। চুলায় রান্না বসিয়ে আমাকে বলতো ‘তকি একটু খেয়াল রাখো’। তারপর ঝটপট লিখতে বসে
যেত এবং কি দ্রæত যে লেখা শেষ করতো সেটা এখনও অবাক বিস্ময়ে মনে পড়ে।
১৯৫১ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পলাশী ব্যারাক ও নীলক্ষেত ব্যারাকে সরকারী সচিবালয়ের
কর্মচারীদের বাসস্থান ছিল। সেখানে কর্মচারী ইউনিয়নের গঠনমূলক কাজ এবং কর্মচারীদের দাবীদাওয়া নিয়ে
আন্দোলনের পরিকল্পনা বিষয়ে একটা মিটিং ছিল। গোপন মিটিং। মিটিংয়ের নিয়ম হলো যারা কর্মী তারা ধীরে ধীরে
একজন দুজন করে আগে আসবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা সবাই উপস্থিত হবে। আমি যাবো পরে। তারপর
মিটিং শেষ হলে আমি আগে বেরিয়ে যাবো। অন্যরা ধীরে ধীরে একজন দুজন করে বের হবে এবং বিভিন্ন গন্তব্যে চলে
যাবে।
আমার ওই দিন রাতে মিটিং শেষ করে ভোরে ভাইয়ার (মুহম্মদ সফীয়ূল্লাহ) বাড়িতে যাবার কথা। ভাইয়া
তখন থাকতেন লালবাগে। আবার পরদিন যেতে হবে জয়নুল আবেদীনের (শিল্পাচার্য) শ্বশুর বাড়িতে। তার শ্যালিকা
রওশন আরা বাচ্চু আমাদের পার্টির সমর্থক। বাচ্চু এবং তার আরেক বোন ওদের বাড়িতে আমাকে দাওয়াত
করেছিল।তারা প্রায়ই আমাকে দাওয়াত করতো এবং চমৎকার রান্না করে খাওয়াতো। এই রওশন আরা বাচ্চু বায়ান্নর
ভাষা আন্দোলনের একজন সাহসী সৈনিক।
দিনটা ছিল শনিবার। মিটিং শেষ হলো বেশ রাতে। নীলক্ষেত ব্যারাক থেকে বেরিয়ে উপাচার্যের বাড়ির
সামনে দিয়ে ঘুরে এস এম হলের পিছন দিয়ে লালবাগের দিকে যাচ্ছি। পলাশী ব্যারাকের ভিতর দিয়ে লালবাগ
যাবো। নির্জন রাস্তায় হাঁটছি আর বারে বারে পিছু ফিরে দেখছি কেউ ফলো করে কিনা। এসএম হলের গেট পার
হলাম তখনও কাউকে দেখিনি। ইকবাল হলের সামনে দিয়ে তখন রেল লাইন ছিল। রেল লাইন পার হলাম। ভোরের
আলো ফুটছে একটু একটু করে। পলাশী ব্যারাকে উনুনের ধোঁয়া।রান্নার কাজ চলছে কোনো বাড়িতে।হঠাৎ একটা
লোক এসে আমাকে জাপটে ধরলো। সাদা পোশাকে পুলিশের লোক। আমি প্রবল ধস্তাধস্তি করছি তার সঙ্গে। পলাশী
ব্যারাকের সামনে চায়ের দোকানের লোকরা ছুটে এলো। ওরা আমাকে চেনে। বাঁচাতে এসেছে। বেগতিক দেখে
লোকটি রিভালবার বের করলো। রিভালবার দেখে আমাকে বাঁচাতে আসা লোকরা থমকে গেল। পুলিশ আমাকে
একটা রিকশায় উঠালো। আমার চিন্তা হচ্ছে। কারণ পকেটে একটা কাগজে মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত এবং কয়েকজন
কমরেডের নাম রয়েছে। পুলিশের লোকটির অগোচরে খুব সাবধানে পকেটে থাকা কাগজপত্র চুপিসারে রাস্তায় ফেলে
দিলাম। আজাদ পত্রিকার অফিসের সামনে দিয়ে যখন রিকশা যাচ্ছে, আমি চিৎকার করে উঠলাম। বললাম ‘ভাই
আমি ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে। আমি সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি এবং মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছি
এই জন্য পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’ বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিৎকার করে অনেক কথা বললাম। আমার উদ্দেশ্য
ছিল যদি পত্রিকা অফিসে কোনো সাংবাদিক থাকেন তাহলে তিনি যেন খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
ততোক্ষণে বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাকে লালবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। থানার ওসি কাকে যেন
ফোন করে বললেন ‘আমরা তকিয়ূল্লাহকে অ্যারেস্ট করেছি’। এদিকে থানার সামনে বেশ জটলা বেঁধে গেছে তখন।
আনন্দপাঠ ২০১৬ ঈদ সংখ্যা ২৮
স্মৃতিকথা
আমি চিৎকার করে বক্তৃতা দিতে দিতে থানায় ঢুকেছি। আমার চিৎকারে পথচলতি বেশ কিছু লোক জমা হয়েছে।
সেই ভিড়ের ভিতর ঘটনাক্রমে আমার এক আত্মীয় ছিলেন। তিনি বাজার করতে যাচ্ছিলেন। তিনি ভাইয়াকে গিয়ে
আমার গ্রেপ্তারের খবরটা দিলেন। লালবাগ থানায় দুপুর পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখা হলো। এদিকে আমাকে উদ্ধারের
জন্য শ্রমিকরা জড়ো হচ্ছিলেন। পাছে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় সেজন্য বিকালে তোপখানা রোডের পুলিশঅফিসে
নিয়ে যাওয়া হলো। সেটা ছিল ডিবির অফিস।সেখানে আনোয়ারুল আজিম নামে এক ডিবি অফিসার খুব জেরা শুরু
করলো।বিকেল থেকে সারা রাত।
কমরেডদের নাম কি? তোমাদের নেতা কে? কে কে আছে তোমার সাথে, আপনি দেশের শত্রু, আপনার
ফাঁসি হবে। কখনও আপনি, কখনও তুমি। আমি সব কথাতেই শুধু বলি ‘আমি জানি না’। এইভাবে সেখানে সারা
রাত জেরা চললো।
আমাকে বলে তুমি শুধু একটা বিবৃতি দাও, বলো যে ভুল করেছ। বলো কমিউনিস্ট পার্টির লোকরা
ভারতের গুপ্তচর। তোমরা নাস্তিক। বলো যে, সমাজতন্ত্র একটা ভুল পথ। এই বিবৃতি দিলে তোমাকে ছেড়ে দিব।
তোমার কোনো শাস্তি হবে না। না হলে কিন্তু তোমাকে দেশদ্রোহী বলে ফাঁসি দেওয়া হবে।
আমি বললাম, ‘সমাজতন্ত্রকে আমি ভুল বললেই তো আর সেটা ভুল হয়ে যাবে না। আমি যদি বলি কাল
ভোরে সূর্য উঠবে না তাহলে কি সূর্যের উদয় বন্ধ থাকবে? সমাজতন্ত্র কোনো ভুল আদর্শ না। এটাই একমাত্র সঠিক
পথ। আর আমি এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছি। আমি দেশদ্রোহী না। আমি দেশপ্রেমিক।’
আনোয়ারুল আজিম বললো ‘তুমি পাগল। তোমাকে পাগলাগারদে পাঠাবো।’
এর পরদিন দুপুরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিবির হেডঅফিসে। ডিবির হেড অফিস তখন ছিল সদরঘাটের
ওয়াইজঘাটে। পরে যেখানে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি হয়।
ওয়াইজঘাটের ডিবির অফিসে নিয়ে আমাকে আবার রিমান্ডে নেওয়া হলো। একটা কড়া ইলেকট্রিক আলো সোজা
চোখের উপর জ্বালিয়ে রেখেছে। একটা চেয়ারে বসিয়ে আমার হাত পা বেঁধে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে। অনিল মুখার্জি
কোথায়? মণি সিংহ কে?, ফণী গুহ কোথায়? সরদার ফজলুল করিম কি তোমার আত্মীয়? শহীদল্লাহ কায়সার
কোথায়? তোমাদের নতুন পরিকল্পনা কি? ভারতে কবে যাবে?ভারত থেকে কত টাকা পেয়েছ? এই সব প্রশ্ন। ঘুরে
ঘুরে একই কথা বারে বারে বলে। চোখের উপর কড়া আলো। বললাম, জানি না। পুলিশটি আমাকে প্রচন্ড জোরে
চড় কষালো। ঘাড়ের রগ চেপে ধরে যন্ত্রনা দিতে লাগলো। হাতের নোখের নিচে সুই ফোটানো হলো। আরও নানা
কায়দায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলতে লাগলো। এইভাবে সারা রাত রিমান্ড চললো। ভোরে ফজরের আজান
পড়ছে। আমি বললাম ‘আমি নামাজ পড়বো’। তারা বলে, ‘তুমি তো নাস্তিক, তোমার আবার নামাজ কিসের?’
আমি বললাম ‘আমি নাস্তিক নই, আমি কমিউনিস্ট।’
আমার হাত খুলে দেওয়া হলো।আমি নামাজ পড়লাম। নামাজের পর আবার টর্চার ও জেরা শুরু হলো।
এদিকে আমাকে নামাজ পড়তে দেখে সাধারণ কয়েকজন সেপাইয়ের মধ্যে মৃদু প্রতিবাদ ও গুঞ্জন শুরু হলো। একজন
তো বলেই ফেললো, ‘কেমন কমিউনিস্ট যে নামাজ পড়ে? এই নিরীহ ভদ্রলোকের ছেলের উপর অযথা জুলুম করা
হচ্ছে।’
সকাল দশটার দিকে আমাকে ঢাকা জেল হাজতে নিয়ে আসা হলো। ৪০ নম্বর সেল। এরপর নিয়ে গেল
যেখানে অপরাধী পাগলদের আটকে রাখা হয় সেই ওয়ার্ডে। বলা হলো আমি পাগল। সেখানে পাগলা গারদে আটকে
রাখা হলো আমার চারিদিকে পাগলের মেলা। সুস্থ মানুষ সেখানে দিনের পর দিন থাকলে সত্যিই পাগল হয়ে যাবে।
কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আসলে এটাও নির্যাতনের একটা কৌশল।
সেখানে একজন কয়েদি যে কিছুটা সুস্থ। সে আমাকে বললো, আপনাকে এখানে রেখেছে কেন? আপনি তো পাগল
না। আপনি তো রাজবন্দী।
সে আমাকে বুদ্ধি দিল। তার পরামর্শমতো আমি রাজবন্দীর মর্যাদা দাবী করলাম।বললাম,‘আমার দাবী না
মানলে অনশন করবো।’
কেউ কোনো কথা শোনে না। তখন আমি সত্যিই অনশন শুরু করলাম। তিনদিন অনশন পালন করার পর
কারা কতৃপক্ষ ভয় পেয়ে গেল যে অনশনে হয়তো আমার মৃত্যু হবে। সন্ধ্যায় আমাকে রাজবন্দীর মর্যাদা দিয়ে ‘নিউ
২০ ওয়ার্ডে’ নেওয়া হলো। এখানে সব রাজবন্দীরা ছিলেন। শুরু হলো আমার টানা পাঁচ বছরের জেলজীবন।
অনুলিখন: শান্তা মারিয়া

Tuesday 12 July 2016

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ------- মুনতাসির মামুন

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা
প্রকাশ: ১২:৪০ pm ২২-০৬-২০১৬ হালনাগাদ: ১২:৪০ pm ২২-০৬-২০১৬
 
 
 
  
  Print
 
 
 


(গতকালের পর)
মুনতাসীর মামুন॥
॥ পাঁচ ॥
বাঙালী হিসেবেই আমরা দেশটি স্বাধীন করেছিলাম। হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়নি। সেই প্রশ্ন বড় করে দেখা দিয়েছিল বা সৃষ্টি করা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমল থেকে। স্টান্টবাজ এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে সেই পার্থক্যটি বড় করতে চেয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখা দরকার, সেই সময় এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যারা মামলা করেছিলেন তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দু’সম্প্রদায়েরই বুদ্ধিজীবী ছিলেন।
খালেদা জিয়া ও নিজামী-খালেদা জিয়ার আমলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হিন্দুদের টার্গেট করা হয়। খালেদা-নিজামী বা অন্য কথায় বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের এই দুটি দল রাজনীতিতে পাকিস্তান আমলের মতো ধর্মকে টেনে এনেছিল। তাদের বিভিন্ন হামলার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলেছেন এবং হিন্দু নেতৃবর্গও যে, হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, সুতরাং, তাদের তাড়াতে পারলে বা ভোট দেয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারলে আওয়ামী লীগের ভোট কমে যাবে। দুই, জমিজমা দখল করা যাবে। তিন, হিন্দু-মুসলমান ফারাক সৃষ্টি করা যাবে। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করতেন। কিন্তু, বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। এ চিন্তা একরৈখিক।
প্রচুর হিন্দু এখন আওয়ামী লীগে ভোট দেন না। বিএনপিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন। গয়েশ্বর রায় বা নিতাই রায়রা তো আওয়ামীবিরোধী নেতৃত্বে আছেন। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের জমিজমা কী এমন বেশি আছে? জমিজমা কি শুধু হিন্দুদেরই দখল হচ্ছে? মুসলমানদের কী পরিমাণ জমি দখল হচ্ছে? জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সীমিত জমির কারণে, জমি এখন মহার্ঘ বস্তু। কক্সবাজারে আমি, জাফর ইকবাল, গাজী সালাহউদ্দিন প্রমুখ অনেকে মিলে ছোট এক টুকরো জমি কিনেছিলাম শখ করে। বিএনপি-আওয়ামী দুই আমলেই তা বারবার দখল হয়েছে। এখনও হামলা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়, হিন্দু কেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক মুসলমানরাও বিতাড়িত হয়েছেন। খালেদার আমলে সেনাবাহিনী ও মার্কিন দূতাবাসের সহায়তায় [বিএনপি নেতা মিলন মার্কিন দূতাবাসের এক মহিলাকর্মীকে নিয়ে এসেছিলেন ভোটের দিন] বিএনপি জেতে। আমাদের গ্রাম থেকে আমাদের চলে আসতে হয়। প্রায় পাঁচ বছর আমাদের এলাকার অনেক আওয়ামী লীগার [হিন্দু নয়] এলাকায় ফিরতে পারেননি। আমরাও নয়। সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনে সারাদেশে প্রায় ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে হিন্দু কয়জন? সবই মুসলমান এবং অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক। সুতরাং, প্রচলিত সব ধারণা সত্য নয়।
মূল রাজনীতিটা আমাদের অনুধাবন করা দরকার। স্বদেশ রায় এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। আগ্রহী পাঠক তার প্রবন্ধটি পড়লে সব তথ্য পাবেন। আমি সংক্ষিপ্তভাবে বলি-
মূল বিষয়টি হলো, বাংলাদেশের রাজনীতি বনাম পাকিস্তানের রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনীতির ধারক ১৪ দল ছাড়াও অন্যান্য ক্ষুদ্র বামপন্থী দল যেমন, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি। এর বিপরীতে আছে পাকিস্তানের রাজনীতির ধারক-বাহক। এরা হলো জামায়াত-বিএনপি ও তাদের সমর্থক ধর্ম ব্যবসায়ীদের ছোটখাটো দল। এই রাজনীতি পাকিস্তান আমলেও ছিল। বঙ্গবন্ধু এর বিনাশ ঘটিয়েছেন যার প্রমাণ ১৯৭০ সালের নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২-এর সংবিধান। জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কারণে দরকার ছিল ঐ ঐক্য বিনষ্ট করা। পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এনে জাতিকে তিনি দ্বিখ-িত করেন। সেই থেকে লড়াইটা শুরু যা এখনও চলছে। মনে রাখা দরকার ঐ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে জিয়াকে সমর্থন করেছিলেন, পরবর্তীকালে এরশাদ-খালেদাকেও।
শেখ হাসিনা যেদিন থেকে ক্ষমতায় এসেছেন সেদিন থেকে তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে তাকে উৎখাতে অগ্রসর হয়েছে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, তাকে বিএনপি-জামায়াতের আটকে পড়া পাকিস্তানীরা ২০ বার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মহিলা। কিন্তু, আমরা মার খেয়েও দেশত্যাগ করিনি। অনেকে করেছেন, এখানে থেকেই লড়াই করে করে নিজেদের জমি উদ্ধার করেছি। কারণ, আমরা মনে করেছি দেশটা আমাদের, বাঙালীদেরই। আটকে পড়া পাকিস্তানীদের দল বিএনপি-জামায়াতের নয়।
প্রচ- ভায়োলেন্সের মাধ্যমে তারা যুদ্ধাপরাধ বিচার নস্যাৎ করতে চেয়েছিল, নির্বাচনও। অনেক হিন্দু নেতা বলেছেন, ১৯৭১ সালের মতো এখনও হিন্দু টার্গেট করা হচ্ছে, গণহত্যা হচ্ছে। এটি অত্যন্ত আপত্তিজনক কথা। প্রাক ২০১৪ এবং ২০১৪ পরবর্তী সময়ে ভায়োলেন্সে কতজন হিন্দু মারা গেছেন? যদি শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ই টার্গেট হতেন তাহলে এতো মুসলমান, নিরাপত্তা বাহিনীর এতো মুসলমান কেন মারা গেলেন? বাড়িঘর তাদের কতগুলো পুড়েছে? হ্যা, হিন্দুদের পুড়েছে। অন্যদেরও পুড়েছে। ১৯৭১-এর মতো এসব পাকিস্তানীরা টার্গেট করেছিল আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থক ও হিন্দুদের।
২০১২ থেকে এ পর্যন্ত মন্দির আক্রান্ত হয়েছে, হিন্দু এলাকায় আক্রমণ হয়েছে এ সবই সত্য। কিন্তু, আমরা যদি শুধু একরৈখিকভাবে তা দেখি তবে তা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। এদের পাশে সব সময় দাঁড়িয়েছেন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন, ১৪ দল, নাগরিক সমাজ। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান পরিষদ বিবৃতি ছাড়া আর কতটুকু সাহায্য করেছেন? প্রতিটি ঘটনার পর আর কেউ না থাক নির্মূল কমিটির নেতৃবর্গ গিয়েছেন। এবং এটা সত্য সংখ্যাগরিষ্ঠরা যেখানে মার খেয়েছেন সেখানে তারা তেমন যাননি।
কারণ, তারা মনে করেছেন আগে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এটাতো মিথ্যা হয়ে যায় না, সংখ্যাগরিষ্ঠের মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনও নির্যাতিত হয়েছে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ গঠনে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তিটা হলো তারা মনে করিয়ে দিলেন, আবারও বিষয়টা বাঙালী বনাম পাকিস্তানের নয় এটি ইসলাম বনাম অন্য ধর্মের। এখন আলাদা নির্বাচন, কমিশন ইত্যাদি গঠনের দাবিও জানানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে আবার পাকিস্তানী আমলেই ফিরে যাচ্ছি। এতে তারা লাভবান হয়েছেন বলে আমার মনে হয় না, বরং তারা নিজ সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন করেছেন। তারা যদি বাঙালিত্বের ওপর জোর দিতেন ধর্মের ওপর নয় তাহলে এ প্রশ্নগুলো জাগত না। হাটহাজারীর এক সময়ের মুজাহিদ এখন হেফাজতি নেতা জনাব আহমদ শফি প্রথমদিন বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাকে-শাহরিয়ারকে শুধু নয় অজয় রায়কেও মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কাউকে তো মুরতাদ ঘোষণা করা যায় না। তারপরও তারা করেছেন। সুতরাং বোঝা যায় তারা কী পরিমাণ ক্রুদ্ধ মুক্তবুদ্ধির রাজনীতির প্রতি। এবং সেখানে তারা হিন্দু-মুসলমান থেকে মৌলবাদ বিরোধীদেরই টার্গেট করেছেন।

॥ ছয় ॥
শেখ হাসিনাকে এখনও উৎখাত করা যায়নি। মানবতাবিরোধীদের বিচার চলছে শুধু তাই নয়, তাদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হচ্ছে। জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির প্রবক্তাদের বিচার চলছে। জঙ্গীদের ধরা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক কমেছে। জামায়াতী শীর্ষ নেতারা সাজা পাচ্ছেন। শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে তারা এখন গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়েছে।
গুপ্তহত্যার জন্য তারা কি শুধু হিন্দু বা খ্রীস্টানকে বেছে নিচ্ছে তাতো নয়। তারা মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষজনকে, ভিন্ন মতাবলম্বীদেরও বেছে নিচ্ছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষকরাও আছেন। দুজন বিদেশীও ছিলেন। এমন কী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও তাদের টার্গেট। এ কারণে, শুধু সংখ্যালঘুরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তা বলা একরৈখিক চিন্তাই হবে। তারা বলছেন, রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এ কারণে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করছেন। এ যুক্তিতো অস্বীকার করি না। ধর্ম অনুসারেও সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। কেননা তারা আমানত। রসুল (দ.) নিজে তা মেনেছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কথা বিদেশী রাষ্ট্রদূতরাও বলেছেন। আমাদের বিদেশ পছন্দ সাংবাদিকরাও ফলাও করে তা প্রচার করেছেন। এখন ফ্লোরিডায় ৪৯ জন হত্যা ও ইংল্যান্ডে এমপি হত্যার পর তারা নিশ্চুপ।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বা বর্ণবিদ্বেষ, ধর্ম বিদ্বেষের কারণে পৃথিবীজুড়েই সন্ত্রাসী কর্মকা- চলছে। এখন ঐ কূটনীতিকরা তার কথা বলছেন। আগে কিন্তু বলেননি। আমাদের বুম বহনকারী সাংবাদিকরা আর এখন জিজ্ঞেস করছেন না। তাহলে আইএস এসবের সঙ্গে যুক্ত নয়? বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা হলেই তা হয়, ভিন্ন মতাবলম্বীদের রাজনৈতিক স্পেস না দেয়ার জন্য, গণতান্ত্রিক নির্বাচন না হওয়ার জন্য, আইএস থাকার জন্য। অন্যদেশে হলে হয় তা সন্ত্রাসী কর্মকা-। আমাদের প্রিয় সাংবাদিকদের সে সব বলে লাভ নেই, তারা শুধু বুম বহন করতে শিখেছেন, প্রশ্ন করতে বা চিন্তা করতে নয়।
সরকার সন্ত্রাসী বা জঙ্গী ধরছে কিনা সেটা জিজ্ঞাস্য। হ্যাঁ, ধরছে। এরি মাঝে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি কেউ খুন হয় [সংখ্যালঘু হলে বেশি হৈ চৈ, মুক্তবুদ্ধির হলে তেমন নয়] এবং সেটি যদি সরকারী ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাহলে কোন সরকারই ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা শুধু নয়, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতও যে ভূমিকা পালন করছেন তাও খুব যথার্থ বলে অনেকে মনে করেন না। হিন্দু পুরোহিত হত্যা হলে তিনি সমবেদনা জানাতে যাচ্ছেন। অন্যরা হলে তা নয় কেন? শাহরিয়ার কবিরই এ প্রশ্ন তুলেছেন। ভিন্ন জীবন ধারার সমর্থককে হত্যা করা হচ্ছে। যেমন জুলহাস। মিতুর যে ছবি ছাপা হয়েছে তাতে বোঝা যায় খুব ধর্মপরায়ণ ছিলেন তিনি। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত সেখানে যাননি। জুলহাসের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। এসব কিছুর মধ্যে মতলববাজি আছে। এসব কিছুই সমাজে রাষ্ট্রে বিভিন্নতা ছড়াচ্ছে, সন্দেহ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে।
এখন প্রতিদিন খালেদা জিয়া সংখ্যালঘু হত্যার কথা বলছেন। হিন্দু নেতারাও বলছেন। অন্যদের হত্যার কথা বলছেন না। এমনকী রানা দাশগুপ্ত বিএনপি-জামায়াতের নাম নিতেও কুণ্ঠা বোধ করেছেন। তিনি বলছেন ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের প্রতি আন্তরিক ও যথেষ্ট সদিচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু এখন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা দল যারা আগে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারা বিভিন্ন সময় সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালিয়েছে। তারা ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে সংখ্যালঘুপ্রধান এলাকাগুলোয় একের পর হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে। এরপর ২০১৪ সাল থেকে একের পর এক চলতে থাকা টার্গেট কিলিংয়ে আনুপাতিক হারে সংখ্যালঘুরাই বেশি হত্যার শিকার হয়েছেন।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন]
২০১৪ সাল থেকে টার্গেট কিলিংয়ে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেশি এটি সঠিক তথ্য নয়। ঐ সময় যত ভায়োলেন্স হয়েছে সেগুলোও টার্গেট কিলিং ছিল। তিনি স্বীকার করছেন নাম না উল্লেখ করে বিএনপি-জামায়াত সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করতে। তাহলে নালিশটা তার বিরুদ্ধে না হয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে হবে কেন?
বিএনপি-জামায়াতে তো হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন। গয়েশ্বর রায়, নিতাই রায়Ñ এরা অন্যতম। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের কোন নেতা এইসব হিন্দু নেতাদের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। রানা দাশগুপ্ত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হিন্দু মন্দির ও জমি দখলের অপবাদ দিয়েছেন, আন্দোলন করেছেন, মেয়র নির্বাচনে তাকে হারাতেও সচেষ্ট থেকেছেন। কিন্তু, ঐ আমলে যারা হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানী রাজনীতি করছে সেই গয়েশ্বরদের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি।
আমাদের মিডিয়াও বিভিন্নতা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখছে। ‘আদিবাসী তরুণী ধর্ষিত’, ‘হিন্দু বালিকা ধর্ষিত’, ‘সংখ্যালঘুর জমি দখল’- এ ধরনের শিরোনাম দেখলে যে কারও ধারণা হবে বাংলাদেশে বেছে বেছে শুধু এ ধরনের কর্মকা- চালানো হয়। মুসলমান তরুণী কি ধর্ষিত হচ্ছেন না বা খুন হচ্ছেন না বা তাদের জমি দখল করা হচ্ছে না। কিন্তু সেভাবে শিরোনাম হয় না। এতে সমাজে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হয়। যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে তাদের কাছে ধর্মবোধগুরুত্বহীন। তারা বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তা করছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা মতাদর্শের সবাই তাদের টার্গেট। এটি ভুললে চলবে না।

প্রসঙ্গঃ সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িকতা --------------------- বদরুদ্দীন উমর


বদরুদ্দীন উমর।।
৫ জুন যুগান্তরে আমার প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ প্রকাশিত হওয়ার পর তার বক্তব্য নিয়ে ‘ফেসবুকে’ বহু মন্তব্য ও প্রবন্ধ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজে ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করি না। কয়েকজন বন্ধু কতকগুলো লেখার প্রিন্ট কপি আমাকে দেয়ায় আমি তার মধ্যে বাছাই করে কয়েকটি পড়েছি। এত অধিক সংখ্যায় এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হতে দেখে আমি একটু বিস্মিত হয়েছি। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অনেকগুলো আমার বক্তব্যের বিরূপ সমালোচনা, যার মধ্যে গালাগালিও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে মননশীলতা ও সিরিয়াস চিন্তার অভাব খুব প্রকট। যে ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক ব্রিটিশ, এমনকি পাকিস্তানি আমলেও দেখা যেত তার কোনো ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা বাংলাদেশে আর থাকেনি বললেই চলে। রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই প্রকৃত বিতর্কের স্থান দখল করেছে গালাগালি। অবস্থা এমন যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবতারণা কেউ করলেও তার জবাবে বিতর্কের পরিবর্তে পাওয়া যায় গালাগালি, এমনকি ব্যক্তিগত কুৎসা। শুধু তাই নয়, দর্শন, সাহিত্য সমালোচনা বলেও কোনো কিছু বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার মধ্যে নেই। চিন্তা ও মননশীলতার এ হতদরিদ্র অবস্থায় বাংলাদেশকে মনে হয় একটা ডোবার মতো স্থির ও নিস্তরঙ্গ। এ নিস্তরঙ্গ ডোবায় তরঙ্গ সৃষ্টির একটা পথ হল, চিন্তা ক্ষেত্রে যথার্থ বিতর্ক এবং মননশীলতার গুরুতর চর্চা। এ পরিস্থিতিতে গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক ভালো। আমার প্রবন্ধটি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ব্যক্তিই বিতর্কের ব্যাকরণ বিষয়ে নিরীহ। কাজেই তাদের ক্ষেত্রে বিতর্কের নামে এমন বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে যাতে তথ্যের উপস্থিতি ও যুক্তির জোর নেই। এটা বিদ্বেষেরই পরিচায়ক। মূল বিষয়ে আলোচনার আগে এসব কথা কেন বলা প্রয়োজন হল, এটা ফেসবুকে প্রকাশিত লেখাগুলো যারা পড়েছেন তাদের পক্ষে বোঝার অসুবিধা হবে না। কিন্তু যারা সেগুলো পড়েননি, তাদেরও এ বিষয়ে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা এখানে করা হল।

সংখ্যালঘু প্রশ্ন নতুন নয়, যদিও ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে এ প্রশ্ন ছিল না। ভারতে শব্দটির প্রচলন করেছিল ইংরেজরা। তারা ভারতীয়দের শিখিয়েছিল সংখ্যালঘুর অর্থ হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে কোনো দেশে যাদের সংখ্যা কম। সংখ্যাগুরু তারা যাদের সংখ্যা বেশি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকে ভারত ত্যাগের আগ পর্যন্ত তাদের এ তালিম শিরোধার্য করেই ভারতে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলতে সব সময়েই এ বিভাজনের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে ধর্মকে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও হয়েছে এভাবে। রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণও ঘটেছে এরই সূত্র ধরে। ইংরেজের দেয়া শিক্ষা যে ১৯৪৭ সালের এতদিন পরও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষিত লোকদের- বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ইত্যাদির- মস্তিষ্ক শাসন করছে তার প্রমাণ এখনও পর্যন্ত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বলতে তারা বোঝেন, বা প্রধানত বোঝেন, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু। যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মবিযুক্ত (Secular) বলেন, তারাও চিন্তার এই বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খান! ইংরেজের ধর্ম শিক্ষার হাত থেকে তাদেরও নিস্তার নেই!!

এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী নমঃনম করে অন্য ধরনের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর একটা অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তারা ধর্মীয় মানদণ্ডেই জনগণকে বিভক্ত করে অন্যদের বোঝাতে চান, এটাই সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কাজেই এ সমস্যার সমাধান হলেই সমাজে সমতা, ঐক্য, শান্তি সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হবে! এ চিন্তা করতে গিয়ে সমাজের সব থেকে মৌলিক দ্বন্দ্ব, শ্রেণী দ্বন্দ্বের বিশেষ কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। এ বিষয়ে একটু পরেই আরও কিছু আলোচনার প্রয়োজন হবে।

‘ফেসবুকে’ যারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য পৃথকভাবে আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়। তার অন্যতম কারণ এসব লেখালেখির সংখ্যা। কাজেই আমি তাদের বিতর্কের মধ্যে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি সেগুলো নিয়েই কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করব। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বলা দরকার, বেশ কয়েকটি লেখা বা কিছু মন্তব্য একেবারেই আবর্জনাতুল্য। আমার প্রবন্ধটির ওপর যোগ্যতার সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে এসব লেখার মালিকরা আমার সারা জীবনের যা কিছু কাজ সব শিকেয় তুলে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছে যে, আমি ‘দগদগে হিন্দু-বিদ্বেষে পূর্ণ’, ‘মুসলিম জাত্যাভিমানের কারণে আমি মাংসকে গোস্ত বলি’, আমি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অর্থাৎ হিন্দুদের খারিজ করেছি, আমি বলেছি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মূল নিয়ামক, আমি বলেছি বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি, হিন্দুরা বাংলাদেশে মহাসুখে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের মিথ্যা ও উদ্ভট আবোলতাবোল কথার শেষ নেই। এসব যারা লিখেছেন তাদের মন্তব্য ও বক্তব্য আলোচনার সম্পূর্ণ অযোগ্য।

কোনো কোনো বক্তব্য আছে যা অজ্ঞতার ফল। যেমন একজন বলছেন, আমার যুক্তি ‘সাম্প্রদায়িকতাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিচার থেকে দেখার দোষে দুষ্ট’। আমার অবস্থান সম্পর্কে এর থেকে বিভ্রান্তিকর ও অজ্ঞ বক্তব্য আর কী হতে পারে? আমিই এ দেশে প্রথম সাম্প্রদায়িকতার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশ করে তার হাজারো দিক সম্পর্কে আলোচনা করে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান আমলে ষাটের দশক থেকে সংগ্রাম করে আসছি। পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমার প্রথম তিনটি বইয়ের নাম ছিল ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’। সে বইগুলোতে সাম্প্রদায়িকতাকে কি শুধু অর্থনৈতিক বিচারে দেখা হয়েছে? এ দেশের সাম্প্রদায়িকবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে একজন কতখানি অজ্ঞ থাকলে একথা বলা সম্ভব এটা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, আমি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছিলাম এবং তার ভিত্তিতে শুধু সাম্প্রদায়িকতাই নয়, পরবর্তীকালে ধর্মের সব ধরনের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেই যেভাবে সংগ্রাম করেছি তার পরিচয় আমার অজস্র প্রবন্ধের মধ্যে আছে যেগুলো গ্রন্থবদ্ধও হয়েছে। কাজেই আমি সাম্প্রদায়িকতাকে শুধু অর্থনৈতিক বিচারেই দেখি এটা অজ্ঞতাপ্রসূত ফল যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই দুরভিসন্ধিমূলক।

এটা আমি অবশ্যই বলেছি যে, সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তি অর্থনৈতিক এবং সে ভিত্তি অপসারিত হলে সাম্প্রদায়িকতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাম্প্রদায়িকতার অন্য কোনো দিক নেই। শুধু তাই নয়, এ অন্য দিকগুলোর আলোচনাই আমার উপরোক্ত তিনটি বইয়ের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে আছে। বাইরের পরিচয় যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদবিরোধী লোকদের এক পরিচিত অভ্যাস হল এটা বলা যে, মার্কসবাদীরা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে গ্রাহ্য মনে করে না। খোদ মার্কসের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সমালোচকদের এ ধরনের কথাবার্তার অভাব নেই, যাকে মিথ্যা ও কুৎসা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

এ দেশে বামপন্থীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, গ্রামাঞ্চলে এখনও জনগণের সঙ্গে প্রধান দ্বন্দ্ব সামন্তবাদের। এ বক্তব্যের যে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে যাদের যথার্থ পরিচয় আছে এবং এ পরিস্থিতি ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তারা জানেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে অর্থনীতি ক্ষেত্রে সামন্তবাদের অতি সামান্য কিছু অবশেষ থাকলেও সমাজের উপরিকাঠামোতে সামন্তবাদের প্রভাব এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের একটা বিরাট অংশের চিন্তা-চেতনাতেও সামন্তবাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। এ উপস্থিতির মূলে তাদের মধ্যে এক ধরনের ধার্মিকতারও অভাব নেই। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। অর্থনীতিতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি না থাকলেও সমাজের উপরিকাঠামোতে তার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, যা আমি আমার অনেক লেখাতেই বলেছি। ভিত্তিভূমিতে বিপ্লবী পরিবর্তন হলেও উপরিকাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে।

সাম্প্রদায়িকতা হল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের একটি রূপ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মের সব থেকে পরিচিত ও শক্তিশালী রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে যেভাবে ভারত বিভক্ত করেছিল, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত ছিল। সে চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেরই স্বাধীনতা-উত্তর রূপ। এদিক দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির মধ্যে প্রথম থেকেই পার্থক্য সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলায় অধিকাংশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকরা ছিল ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং মুসলমানরা ছিল বিপুল অধিকাংশই প্রজা, ভাগচাষী, খাতক ও দরিদ্র ক্রেতা। ১৯৪৭ সালের পর এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য দ্রুত কমে এসে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলমান জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব যেভাবে ছিল তার অবসান ঘটে। সাম্প্রদায়িকতার অর্থনৈতিক ভিত্তি অপসারিত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির অসাম্প্রদায়িকীকরণ। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের ভিত্তি বিনষ্ট হওয়ার ফলে মুসলিম লীগ পাকিস্তানে শাসক দল হলেও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিলুপ্ত হয়। তারপর এখানে উত্থান হয় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির, যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে অগ্রসর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর না থাকায় তারা নাম পরিবর্তন করে হয় ‘আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িকীকরণ ছাড়াও পূর্ববাংলায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং গণ ও শ্রেণী সংগঠন গড়ে ওঠে। এক কথায়, সাম্প্রদায়িকতার পর এখানে উত্থান ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জনগণ সাম্প্রদায়িকতা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত হয়ে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাঙালিরই রাজনৈতিক বিজয় হয়েছিল। তারা এ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল শাসক শ্রেণীতে। এ কথা কি বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শুধু মুসলমান বাঙালিরাই ক্ষমতাসীন হয়েছিল, আর হিন্দুরা পাকিস্তান আমলের মতোই থেকে গিয়েছিল শাসক শ্রেণীর বাইরে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু হিসেবেই? সেটাই কি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ‘মহান’ বিজয়? আমি হিন্দুদের বাঙালি শাসক শ্রেণীর অংশ বলায় যারা আমার ওপর গালিবর্ষণ করে নিজেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, তারা কি এভাবে হিন্দুদেরকে বাঙালি মুসলমান থেকে পৃথক করে বাঙালি হিন্দুকে হিন্দু হিসেবে শাসক শ্রেণীর বাইরে রেখে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার অপচেষ্টায় লিপ্ত নন?

কেউ কেউ বলেছেন, আমি হিন্দুদের শাসক শ্রেণীর অংশ বলেছি; কিন্তু হিন্দু গরিব ও শোষিত-নির্যাতিতরা কি শাসক শ্রেণীর অংশ? এ ধরনের বালখিল্য কথাবার্তা থেকে মনে হয়, বাংলাদেশে বিতর্কের মানের কোনোই উন্নতি হয়নি। যারা এভাবে প্রগতিশীলতার নামে বিতর্ক করেন, বিতর্কের ব্যাপারে তাদের দক্ষতার নামগন্ধ নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হল ‘শ্রেণী’। আমি শাসক শ্রেণীর কথা বলেছি। বাংলাদেশের হিন্দুদের মতো মুসলমান বাঙালিরা শাসক শ্রেণীর অংশ। তার অর্থ কি এই যে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, এরশাদ এবং তাদের দলের সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিদের মতো গ্রামের গরিব, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ নিু মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগণও শাসক শ্রেণীর লোক? তারা একই শ্রেণীভুক্ত? তাই যদি হয়, তাহলে শাসক শ্রেণী কাকে শাসন করে? এসব খুব মামুলি কথা। এখন যারা এ বিতর্কের নামে আমার ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সমালোচনার নামে গালাগালি করছেন, তাদের চিন্তায় তো এটা নেই যে, শ্রেণী ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের ও বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উপরন্তু হিন্দু ধর্মে বর্ণ প্রথার জন্য উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সঙ্গে নিুবর্ণের হিন্দুর পার্থক্য আরও বেশি। তাদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আরও দুস্তর। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গয়েশ্বর রায় এবং তাদের মতো হিন্দুরা কি বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর লোক নন? তা যদি না হয়, তাহলে যারা এ নিয়ে বিতর্ক করছে, তারা শ্রেণী ও শাসক শ্রেণী বলতে কী বোঝেন?

আমার মূল বক্তব্য এ ক্ষেত্রে হচ্ছে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকের ওপর নির্যাতন হলে সেটা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হবে এমন কোনো কথা নেই! শ্রেণী নির্যাতনই সব থেকে নিষ্ঠুর নির্যাতন, হিন্দু ধর্মে যার একটা পরিচয় পাওয়া যায় নিু বর্ণের হিন্দু বা দলিতদের ওপর উচ্চ বর্ণের নির্যাতনের মধ্যে। এ নির্যাতন কি বাংলাদেশের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা নিু বর্ণের হিন্দুর ওপর করেন না? গরিব হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর যে চরম নির্যাতন হয়, এটা অস্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে না। দীর্ঘদিন ধরে এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি লিখেছি অসংখ্যবার। আমার এসব লেখা আমার অনেক বইয়ের মধ্যে আছে। বেশি আগের কথা বাদ দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির লোকজন ক্ষমতায় এসে যখন হিন্দুদের বাড়িঘরের ওপর আক্রমণ ও তা লুটপাট করেছিল, তখন আমি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লিখেছিলাম। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে পাবনা জেলার সাতক্ষীরায় গরিব হিন্দুদের ওপর আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ও নেতারা যে আক্রমণ করেছিল, তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে তাদের ঘরছাড়া করেছিল, তার বিরুদ্ধেও আমি একইভাবে আমার একাধিক লেখায় প্রতিবাদ করেছিলাম। এসব কথা যে আমাকে এখানে লিখতে হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের জবাবে, এটা এ দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এক মস্ত ট্রাজেডি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিপুলসংখ্যক হিন্দু দেশ ত্যাগ করছেন, এটা এক মহাসত্য। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে গিয়ে এ কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন হিন্দুদের দেশত্যাগের জন্য আমিই দায়ী! হিন্দুরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেন দেশত্যাগ করছেন, এটা জিজ্ঞেস করতে হবে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বকে। স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের শাসনভার তাদের ওপর থাকার সময় এ ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কার? ক্ষমতাসীন বাঙালিদের সরকারের, না যে পাকিস্তানিদের এখান থেকে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের? এটা তো এখন বেশ পরিষ্কার, এমনকি হিন্দুদের কাছেও পরিষ্কার, ১৯৭২ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের লোকজন, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং গুণ্ডাপাণ্ডারা হিন্দুদের সম্পত্তি ব্যাপকভাবে লুটপাট করেছে, তাদের জমিজমা, ভিটেবাড়ি দখল করেছে। এ অপকর্ম যাতে কিছুটা আইনের আওতায় সম্পূর্ণভাবে করা যায় সেজন্য ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানি আমলের ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র বাংলাদেশে উচ্ছেদ না করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে তাকে পুরোপুরিই বহাল রেখেছিল। এভাবে রেখে আওয়ামী লীগের লোকেরা যেভাবে হিন্দু সম্পত্তি লুটপাট ও দখল করেছিল সেটা পাকিস্তানি আমলেও দেখা যায়নি। এছাড়া হিন্দুদের দেশত্যাগের অন্য একটি কারণ হল, ভারতে বর্ণবাদী হিন্দুদের দ্বারা এখানকার হিন্দুদের দেশত্যাগের জন্য উসকানি দেয়া। এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার কারণে হিন্দুদের বসবাস অসম্ভব এ কথা অহরহ প্রচার করা। এ উসকানি ও প্রচারণার স্পষ্ট ও প্রকাশ্য প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে ভারতের বিজেপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের এ মর্মে ঘোষণা থেকে যে, বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা ভারতে যাবে শরণার্থী হিসেবে, তাদের স্বাগত জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে এবং যে মুসলমানরা যাবে, যেমন আসামে, তাদের সেখান থেকে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হবে!! কিন্তু এ প্রসঙ্গে অবশ্য বলা দরকার, হিন্দুদের দেশত্যাগের প্রধান কারণ গরিব হিন্দুদের জমিজমা, ভিটেবাড়ির ওপর আক্রমণ ও তা দখল করা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রত্যেক সরকারের আমলে এটা হলেও আওয়ামী লীগই সব থেকে বড় আকারে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এ অপরাধমূলক কাজ করেছে। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের নিকট সম্পর্কের জন্য এখানকার হিন্দুরা বরাবর আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে এসেছেন। মাত্র কিছুদিন আগে বিজেপির এক নেতা তথাগত রায় (এখন ত্রিপুরার রাজ্যপাল) বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের এক সভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে হিন্দুরা বরাবর ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন তাদের উচিত প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়ানো এবং তাকে ভোট দেয়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ হিন্দুদের ওপর সব থেকে বেশি ও বিপজ্জনক নিপীড়নকারী হলেও ভারত সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এ সম্পর্কের কারণে হিন্দুদের মধ্যে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের চরিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি থেকেছে। এখনও তা আছে, তবে আগের মতো যে আর নেই এটা এখন বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন ও নেতার কিছু বক্তব্য থেকেই দেখা যাচ্ছে।

আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে এখন যারা সব থেকে কুৎসিত ভাষায় বিষোদগার করছে এবং নানা ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা বলছে, তারা আওয়ামী ঘরানার লোক ও প্রধানত সিপিবির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা সবারই জানা, তবু গুরুত্বের জন্য এখানে আবার বলা দরকার, আওয়ামী লীগ ও সিপিবি প্রকৃতপক্ষে আদর্শগতভাবে অভিন্ন। পাকিস্তান আমল থেকেই তাদের এ অবস্থা। বাংলাদেশ হওয়ার পর তারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে আর কোনো রাখঢাক না করে নিজেদের পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদান করেছিল। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাদের নেতা মণি সিং সামরিক বাহিনীর জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, পুলিশের আইজি, উচ্চপর্যায়ের আমলা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বসে সেই ফ্যাসিস্ট দলটির গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। তাদের ‘মার্কসবাদী’ চিন্তাধারায় বাকশালকে আলোকিত করেছিলেন!! ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবের হত্যা এবং বাকশাল উচ্ছেদ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগ ও সিপিবি উভয়েই বাকশালের গর্ভ থেকে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল যমজ ভাই হিসেবে। দল হিসেবে স্বতন্ত্র হলেও তারা উভয়েই ‘মুজিববাদী’ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও তার অনুসারী। এ কারণে বাকশালের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসার পর সিপিবির নামকরণ যথার্থভাবে হয়নি। তার নামকরণ হওয়া দরকার ছিল সিপিবি (মুজিববাদী)। আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদী সিপিবি এখন প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার এক প্রবল আবহ তৈরি হয়েছে, হিন্দুরা এ সাম্প্রদায়িকতার নির্যাতনে অতিষ্ঠ ও আতংকিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে, অনেকে দেশত্যাগ করছে! তারা নিজেরাই যে হিন্দুদের ওপর সব থেকে বড় নির্যাতক এ কথা ধাপাচাপা দেয়ার জন্যই তারা এসব করছে এবং হিন্দুদের ওপর নির্যাতনকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে একে আখ্যায়িত করছে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে। নির্যাতন হলেই যে তা সাম্প্রদায়িক হবে, তার অন্য কোনো চরিত্র থাকবে না বা থাকতে পারে না, এ বক্তব্য হাজির করে তারা নিজেদের লুটতরাজ ও হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক হামলা ও নির্যাতন আখ্যা দিয়ে দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই কুৎসা রটনা করছে।

তাছাড়া সাম্প্রায়িকতার কথা যদি বলা হয়, তাহলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকলে এখানে মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল থাকত? সেরকম কিছুই নেই। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মতো অন্য দলগুলো হল মৌলবাদী টার্গেট হিন্দুরা নয়। টার্গেট হল কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, যে কোনো ধরনের প্রগতিশীল। আওয়ামী লীগ কিসের অসাম্প্রদায়িক? এটা ঠিক, এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। কিন্তু শুধু বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীই নয়, আওয়ামী লীগ তার তিনদফা সরকারের আমলে কি সে আইন বাতিল করেছে, না সেটা বহাল রেখেছে একইভাবে? পঞ্চদশ সংশোধনীতে ভেল্কিবাজি দেখিয়ে একদিকে তারা বাংলাদেশকে বলেছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, আবার অন্যদিকে তারা বহাল রেখেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে!! সিপিবি (মুজিববাদী)ও এদিক দিয়ে একই গর্তের শেয়াল। কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে নির্যাতন এখন হচ্ছে তাকে সাম্প্রদায়িক না বলে শাসক শ্রেণীর লোকদের সম্পত্তি, জমিজমা দখল, দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক তৎপরতা বলে আখ্যায়িত করায় তাদের গায়ে জ্বালা ধরেছে। তাদের লেজে আগুন লেগেছে। আমার বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝার ধারেকাছে না গিয়েই বিতর্কের নামে তারা আমার বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছে। শুধু শব্দ নয়, আমার কোনো কোনো বাক্য পর্যন্ত মোচড় দিয়ে তারা আমার বক্তব্যের যুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং অর্থকে বিকৃত করেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে শিক্ষিত লোকের নিদারুণ অভাবের কারণে সিপিবি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক অঙ্গসংগঠন বা Cultural Wing হিসেবেই কাজ করে এসেছে। আমার বিরুদ্ধে তাদের লোকজনই এখন নানা ধরনের কুৎসা প্রচার করে আওয়ামী লীগের ‘সাম্প্রদায়িক’ চরিত্র আড়ালের চেষ্টা করছে। তাদের এ ‘সাম্প্রদায়িকতার’ সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলাদেশে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ নামে যে সংগঠনটি আছে তার মধ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের উপস্থিতি নামমাত্র। এটা আসলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ বন্ধের জন্য ভারতের পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এবং অন্যরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় রানা দাশগুপ্ত পিটিআইয়ের এ রিপোর্টকে মিথ্যা বলেছেন। কিন্তু পিটিআই এরপর বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছে, রানা দাশগুপ্ত যা বলেছেন তারা সেটাই রিপোর্ট করেছে। তাদের কাছে নিশ্চয়ই সাক্ষাৎকারের রেকর্ডকৃত ভাষ্য আছে। কাজেই পিটিআইয়ের এ দাবিতে তিনি কোনো প্রত্যুত্তর দেননি। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হল, রানা দাশগুপ্ত যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজীকে কোনো এক সূত্র থেকে হুমকি দেয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মিশনের সন্ন্যাসীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। (যুগান্তর, ১৮.০৬.২০১৬)। এসব থেকে বোঝার অসুবিধে নেই যে, ভারতের বিজেপি সরকার ও বাংলাদেশে আরএসএস ও বিজেপি মার্কা উচ্চ বর্ণের কিছু হিন্দু একজোট হয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছে এবং এ সূত্র ধরে বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপের শর্ত তৈরি করছে।

ভারতে যেমন চরম সাম্প্রদায়িকতা আছে, আছে নিুবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের ওপর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের প্রধান অংশের ভয়াবহ নির্যাতন, তেমনি সেখানে আছে এসবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন। সেখানে আছেন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রাম ও প্রতিবাদ করার মতো অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষ- লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনৈতিক ব্যক্তি। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির চরম সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ৪৫ জন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়া লেখক এবং আরও অনেক শিল্পী তাদের পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে ফেরত দিয়েছেন সুদসহ তার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ। বাংলাদেশে যারা নানা ধরনের বড় বড় পুরস্কার পেয়েছেন, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নামে পরিচিত ব্যক্তি, তারা কি আওয়ামী লীগের চরম ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজেদের পুরস্কার ফেরত দিতে পারেন? এ রকম একজনও কি আছেন? শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে তদবির করে পুরস্কার পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে যা ভারতে নেই। ভারতে যারা পুরস্কার পান তারা নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতেই সেটা পেয়ে থাকেন। এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণার পর এক লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কবি পুরস্কার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্লজ্জভাবে শেখ হাসিনার কাছে পুরস্কার দাবি করেছিলেন! হাসিনা সে দাবি মঞ্জুর করে তাকে পুরস্কার দিয়েছেন!! যারা এভাবে পুরস্কার পান তারা কবি সাহিত্যিক হিসেবে যতই গুণী হন, তাদের চরিত্রের খবর কী? যা হোক, এ প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার, ভারতে কোনো গুরুতর বিষয়ে বিতর্ক হলে সে বিতর্কে সাধারণভাবে বিতর্কের ব্যাকরণ ও নিয়ম-কানুন মান্য করেই তা করা হয়। এখানে তার সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। এখানে মননশীলতার চর্চা, সিরিয়াস চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তার কোনো ঐতিহ্য যে এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি, এটা আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে সমালোচনার নামে যে গালাগালি হচ্ছে তার থেকেই বোঝা যায়।

এরপর একটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করব। ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ নামক প্রবন্ধে আমি সংখ্যালঘু সমস্যার ওপর যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম, তার কোনো দেখা এসব বিতর্কের মধ্যে নেই। হিন্দুদের ওপর নির্যাতনকে কেন আমি সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বলছি না, এটাই হল এসব লেখার উত্তেজিত বক্তব্য। যারা এভাবে বিতর্ক করেছেন তারা যে বাংলাদেশে সব থেকে নিপীড়িত জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের বন্ধু নন, এটা তারা এ প্রসঙ্গ তাদের আলোচনায় উহ্য রেখেই প্রমাণ করেছেন। এর মূল কারণ হিন্দুরা জাতিগতভাবে বাঙালি এবং মুসলমানদেরই জাতভাই যা অন্যেরা নয়। বাঙালি উচ্চ ধর্মের হিন্দুরা এখানকার শাসক শ্রেণীর অংশ। কাজেই সাঁওতাল, হাজং, রাখাইন, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরার ওপর নির্যাতন এদের কাছে বিবেচনার বিষয় কীভাবে হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমস্যার প্রকৃত বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ও সব থেকে নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য। এ কর্তব্যবোধের কোনো দেখা আমার বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদের বক্তব্যের মধ্যে পাওয়া গেল না।



বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, বাংলাদেশ মুক্তি কাউন্সিল

কিছু বাঙালি যা বলেছিলেন------- পুষ্কর দাশগুপ্ত

কিছু (হয়ত অল্পবুদ্ধি ) বাঙালি যা বলেছিলেন:
যে মধুসূদন দত্ত প্রথম যৌবনে ইংরেজি ভাষার কবি হবার স্বপ্ন দেখতেন, যিনি ইংরেজি বাদ দিয়েও সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষা জানতেন, তিনি ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভের্সাই শহর থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন:
তুমি জান, গৌর আমার, গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা ইয়োরোপীয় ভাষায় জ্ঞান হল বিরাট আর আবাদ করা একটা ভূখণ্ড অধিকার করার মতো — ঐ ভূখণ্ড অবশ্যই বৌদ্ধিক ।… ইয়োরোপ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য প্রশংসনীয় ব্যাপার, … কিন্তু আমরা যখন পৃথিবীকে কিছু বলব তখন তা যেন আমরা আমাদের নিজের ভাষায় বলি। নিজেদের ভেতরে নতুন চিন্তার উত্সার রয়েছে বলে যারা বোধ করে তারা যেন অবিলম্বে নিজেদের মাতৃভাষার দিকে যাত্রা করে।… নিজের ভাষায় দক্ষতা নেই এমন কোনো ব্যক্তির ‘শিক্ষিত’ বলে পরিচিত হতে চাওয়ার আত্মম্ভরিতাকে আমি ঘৃণা করি…
শেষ পর্যন্ত, আমাদের নিজেদের ভাষার চর্চা আর তার সমৃদ্দ্ধি-সাধনের তুলনীয় আর কিছুই হতে পারে না। তুমি কি ভাব যে ইংল্যাণ্ড কি ফ্রান্স অথবা জার্মানি কি ইতালির কবি আর প্রবন্ধকারের দরকার আছে ? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি মিল্টনের নিজের মাতৃভাষা আর জন্মভূমির জন্য কিছু করার মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে তাবৎ প্রতিভাধর মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক।
[European scholarship is good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have springs of fresh thought in them, fly to their mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated” who is not master of his own language….
After all, there is nothing like cultivating and enriching our own tongue. Do you think England, or France or Germany or Italy wants Poets and Essayists? I pray God, the noble ambition of Milton to do something for his mother-tongue and his native land may animate all men of talent among us.]
যোগীন্দ্রনাথ বসু: মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন-চরিত, পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, চক্রবর্তী চাটার্জ্জি এণ্ড কোং, ১৯২৫, পৃ. ৫৭৪-৫৭৫।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অভিভাষণে বলেন:
I firmly believe that we cannot have any thorough and extentsive culture as a nation, unless the knowledge is disseminated through our own vernaculars. Consider the lesson the past teaches. The darkness of Middle Ages of Europe was not completely dispelled until the light of knowledge shone through the medium of the numerous modern languages. So in India, ― the dark depth of ignorance all round will never be illuminated until the light of knowledge reaches the masses through the medium of their own vernaculars.
― Gurudas Bandyopadhay: Convocation Address , 1891. Hundred Years of the University of Calcutta, 1957,
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের মাতৃভাষাগুলির মাধ্যমে জ্ঞান প্রচারিত না হলে জাতি হিসেবে আমরা কোনো সর্বব্যাপ্ত আর বিস্তৃত কৃষ্টির অধিকারী হতে পারব না।অতীত আমাদের যে শিক্ষা দেয় তার কথা ভেবে দেখুন। অসংখ্য আধুনিক ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দীপ্তিময় হয়ে ওঠার আগে অব্দি ইয়োরোপে মধ্যযুগের অন্ধকার সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, ― তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জনসাধারণের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত চারপাশের অজ্ঞানের গভীর অন্ধকার কখনোই আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে না ।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে উদ্বুদ্ধ তরুণ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে মাতৃভাষা বাংলা, হিন্দি বা উর্দুকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন, বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু ইত্যাদি কয়েকজন সমর্থন করলেও মেকলের জারজ বাঙালিদের দলবদ্ধ বিরোধিতায় সে প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়।
১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকায় লেখেন:
…বঙ্গ বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক। ইংরাজিতে শিক্ষা কখনোই দেশের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না। তোমরা দুটি-চারটি লোক ভয়ে ভয়ে ও কী কথা কহিতেছ, সমস্ত জাতিকে একবার দাবি করিতে শিখাও কিন্তু সে কেবল বিদ্যালয় স্থাপনের দ্বারা হইবে, Political agitation-এর দ্বারা হইবে না।
(ন্যাশনল ফন্ড , ভারতী, কার্তিক, ১২৯০)।
এর পর সারা জীবন তিনি সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন:
আমাদের ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? ভরসা করিয়া এটুকু কোনোদিন বলিতে পারিব না যে, উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে? পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাঁধাই করিতে পারিয়াছে। …আমরা ভরসা করিয়া এ পর্যন্ত বলিতেই পারিলাম না যে, বাংলাভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।…আমি জানি তর্ক এই উঠিবে তুমি বাংলা ভাষার যোগে উচ্চশিক্ষা দিতে চাও কিন্তু বাংলাভাষায় উঁচুদরের শিক্ষাগ্রস্থ কই? নাই সে কথা মানি কিন্তু শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রস্থ হয় কী উপায়ে? শিক্ষাগ্রস্থ বাগানের গাছ নয় যে, শৌখিন লোকে শখ করিয়া তার কেয়ারি করিবে,–কিংবা সে আগাছাও নয় যে, মাঠে বাটে নিজের পুলকে নিজেই কণ্টকিত হইয়া উঠিবে!…. বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষাগ্রন্থ বাহির হইতেছে না এটা যদি আক্ষেপের বিষয় হয় তবে তার প্রতিকারের একমাত্র উপায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষা প্রচলন করা।
(শিক্ষার বাহন, ১৩২২)।
ছিয়াত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেন:
…আজ কোনো ভগীরথ বাংলাভাষায় শিক্ষাস্রোতকে বিশ্ববিদ্যার সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে চলুন, দেশের সহস্র সহস্র মন মূর্খতার অভিশাপে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে, এই সঞ্জীবনী ধারার স্পর্শে বেঁচে উঠুক, পৃথিবীর কাছে আমাদের উপেক্ষিত মাতৃভাষার লজ্জা দূর হোক, বিদ্যাবিতরণের অন্নসত্র স্বদেশের নিত্যসম্পদ হয়ে আমাদের আতিথ্যের গৌরব রক্ষা করুক।
(শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ, ভাষণ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী:
পাশ্চাত্য জাতির উপার্জিত জ্ঞানরাশি আত্মসাৎ করিবার জন্য আমাদিগকে পাশ্চাত্য ভাষার অনুশীলন করিতে হইবে। কিন্তু ওই বিজাতীয় ভাষা কখন আমাদের আপনার ভাষা হইবে না;... যদি আমাদের স্বজাতিকে... পাশ্চাত্য জাতির উপার্জিত জ্ঞান-সম্পত্তির অধিকারী করিতে চাই , তাহা হইলে আমাদের মাতৃভাষাকে এইরূপে সংস্কৃত মার্জিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে সেই মাতৃভাষা এই জ্ঞানবিস্তার কর্মের ও জ্ঞানপ্রচার কর্মের যোগ্য হয়। এই বঙ্গ ভাষারই অঙ্গে নূতন রক্ত সঞ্চালিত করিয়া, তাহাকে পুষ্ট সমর্থ করিয়া তুলিতে হইবে।
(বৈজ্ঞানিক পরিভাষা,১৮৯৪)।
ইংরাজের প্রদত্ত শিক্ষা হইতে... আমরা শিখিয়াছি অনেক ও পাইয়াছি অনেক; কিন্তু তাহাতে বাহ্য ব্যতীত আভ্যন্তরিক বিশেষ কিছু হয় নাই।...
আমরা জানিয়াছি অনেক ও শিখিয়াছি অনেক; কিন্তু কিরূপে জানিতে হয় ও কিরূপে শিখিতে হয়, তাহা শেখা আবশ্যক বোধ করি নাই। মনুষ্যজাতির জ্ঞানের রাজ্য আমাদের কর্তৃক এক কাঠা, কি এক ছটাক পরিমাণেও বিস্তার লাভ করে নাই।...
ইংরাজের প্রসাদে শিখিয়াছি যথেষ্ট....কিন্তু হায়! আমাদের গড়িবার শক্তি কই, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় কোথায়! আমরা শোনা কথা ও শেখা কথা ভিন্ন জগতে নূতন কথা কি বলিলাম! উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় ত কিছুই দেখি না, এবং আরও কিছু দিনের মধ্যে যে পরিচয় পাওয়া যাইবে, তাহারও কোন শুভ লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি না। ইংরাজী শিক্ষার কি এই পরিণাম?
...সম্প্রতি বাঙ্গালা সাহিত্যে আছে কি ? উপন্যাস ও কাব্য ? তাই বা কয়খানা ? …
ষাট বত্সরের ইংরাজী শিক্ষার ফলে আমরা ভাঙ্গিতে শিখিয়াছি , গড়িতে শিখি নাই,... আমরা পরের কথা আবৃত্তি করিতে পারি, কিন্তু স্বয়ং বাক্য রচনা করিতে জানি না।... (ইংরাজী শিক্ষার পরিণাম, ১৮৯৫)
LikeShow more reactions
Comment

Monday 4 July 2016

উনি অধ্যাপক আমরা ছাত্রও------ পুষ্কর দাশগুপ্ত

"উনি" অধ্যাপক, অতএব আমরা সবাই ছাত্র
পুষ্কর দাশগুপ্ত
আমি পেশাদারি জ্ঞানচর্চার জগতের বাইরের লোক। স্বভাবতই ওই জগতের কাউকেই প্রায় চিনিনা। আমি থাকি কলকাতা থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে। তাই পেশাদারি জ্ঞানচর্চার ওই জগতে আমাকে যে কেউ চেনেনা তা বলাই বাহুল্য। হঠাৎ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেখলাম তপোব্রত ঘোষ নামে এক ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখার ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর ব্যাখ্যার মন্তব্যকারীদের "স্যার" সম্বোধন আর মন্তব্যের ভাষা থেকে বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক খ্যাতনামা রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক। কৌতূহলী হয়ে তাঁর ৩০-এ এপ্রিলের পোস্টটি পড়লাম। এখানে তপোব্রতবাবুর আলোচ্য হল রবীন্দ্রনাথের একটি গান, যার শুরু, "নাচ শ্যামা তালে তালে..."। তপোব্রতবাবু আলোচনায় জানান যে কয়েক বছর আগে কালিপূজার আগের দিন একটা বেসরকারি টেলিভিশনে শান্তিনিকেতন থেকে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী এক মহিলা আলোচ্য গানটিকে হাস্যকরভাবে রবীন্দ্রনাথের শ্যামাসঙ্গীতের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত করেন। তপোব্রতবাবুর মনে হয়েছে ঘটনাটি প্রসঙ্গ বা রচয়িতার জীবনের পরিপ্রেক্ষিত না জেনে "বাঙালির টেক্সট পড়ার একটা নমুনা ।" বর্তমান রচনায় তপোব্রতবাবু আরো দুবার "টেক্ট" শব্দটি ব্যবহার করেছন "এইবার আমার উদ্দিষ্ট টেক্সটে আসা যাক", "টেক্সটাকে বাঙালি কীভাবে পড়ে তার"... । এছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি আলোচনায় "টেক্ট" শব্দটির ব্যবহার দেখতে পেলাম। বহিরাগত আমি তাঁকে "তাঁর বাংলা ভাষায় লেখা আলোচনায় গল্প, কবিতা, নাটক ইত্যাদি বর্গ-পরিচয়ের বদলে তিনি কেন টেক্সট্ শব্দটি ব্যবহার করেন তা বুঝিয়ে বলতে অনুরোধ করলাম।
অপরিচিতের অনধিকার-চর্চার উত্তরে উষ্মা ও শ্লেষ মিশ্রিত ভঙ্গীতে তপোব্রতবাবু জানালেন, "আমি 'টেক্সট'-এর বদলে 'বাঙ্ময়' লিখতে পারি,শব্দ-গ্রথিত কাব্যশরীর অর্থে, যদি অনুমতি করেন তাই লিখব এখন থেকে,অনেকের চোখ হোঁচট খাবে এই আগাম আশঙ্কায় লিখি না এই আর কি।" তিনি আরো যোগ করলেন , "আমি যে কোনো স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ লিখছি না সেটা তো আমার লেখাগুলোর ধরন থেকেই স্বয়ম্প্রকাশ - কেননা আমি তো 'তন্ময়ীভবন'-কে মানি,একটা 'তত'[দ্বিতীয় 'ত'-টি খণ্ড 'ত'] আছে,'that-ness', যাকে বলি কাব্যের মধ্যে কবির সত্য,ওই সত্যের দিকে অনবরত চলতে থাকাই সহৃদয়-রসিকের কৃত্য,এইরকম কোনো সত্যের অস্তিত্বকে কি স্ট্রাকচারালিস্টরা স্বীকার করবেন? আমি একেবারেই কবির লিখিত বাণীপ্রকাশ অর্থেই 'টেক্সট' শব্দটি লিখছি,যদি এই অর্থে আরো যথাযথ কোনো বিকল্প শব্দের খোঁজ কেউ দেন,আমি তাই লিখব।" আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের একজনের প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ঘোষ জানালেন যে 'টেক্সট' বলতে যদি 'রচনা' ব্যবহার করা হয় তাহলে তা 'প্রবন্ধ' থেকে স্বতন্ত্র বর্গ 'রচনা' বা personal essay-র সঙ্গে আবার অনেকের গুলিয়ে যেতে পারে।
আমি আমার বক্তব্যকে কিছুটা সাজিয়ে তপোব্রতবাবুর সামনে পেশ করলাম:
১.'টেক্সট' শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার রয়েছে। জটিলতার মধ্যে না গিয়ে বলা যায় , 'টেক্সট' হল বাচিক ( বা অবাচিক) সংকেত-শৃঙ্খল যাকে একটি স্বায়ত্ত সংজ্ঞাপক একক হিসেবে গণ্য করা ষায়। বাচিক বা ভাষিক সংজ্ঞাপনের ভিত্তিমূলক একক হল বাক্য, তার পরের ধাপের একক বাচন (discourse), আর বাচনের পরবর্তী ধাপের একক হল 'টেক্সট'।
২, "বাঙ্ময়" শব্দটি কোনো "শব্দ-গ্রথিত" একক নির্দেশ করে না, শুধুমাত্র বাগবয়ব বোঝাতে পারে।
৩. "স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ" এবং "কবির লিখিত বাণীপ্রকাশ অর্থেই 'টেক্সট' শব্দটি" বলতে তপোব্রতবাবু কী বুঝিয়েছেন তা বুদ্ধিদোষে আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
৪. "text বলতে যে অর্থ তাৎপর্য বোঝায়, তার যথার্থ কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। ফর্মালিস্ট বা স্ট্রাকচারালিস্টরা যে অর্থে টেক্সট বলতে চান, তা বাঙ্ময় নয়।" এই মত যিনি প্রকাশ করেছেন সেই ঋতংকরবাবু যদি text শব্দের অর্থ তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ফর্মালিস্ট বা স্ট্রাকচারালিস্টরা যে অর্থে টেক্সট বলতে চান তা কেন বাঙ্ময় হতে পারবে না সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন তা হলে ভালো হয়।
৫.যে 'তন্ময়ীভবন' আর 'সহৃদয়-রসিকের কৃত্যের' কথা তপোব্রতবাবু বলেছেন তা সক্রিয় পঠন-পরিগ্রহণের (পুনর্নির্মাণ) অঙ্গ, একথা তথাকথিত সংস্থানবাদীরা কি অস্বীকার করেছেন?
৬. 'টেক্সট' শব্দের পারিভাষিক প্রতিশব্দ হিসেবে "রচনা" ব্যবহার করা যায়। 'টেক্সট' শব্দের মতো "রচনা" শব্দটিও প্রসঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। যাঁরা 'টেক্সট' শব্দ ব্যবহার সুবিধাজনক বলে মনে করেন তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন : কোনো একটা বিদেশি পারিভাষিক শব্দকে ঘিরে একাধিক নতুন বিদেশি শব্দ গড়ে ওঠে, বাংলায় ওই শব্দগুচ্ছের কেন্দ্রীয় বিদেশি শব্দটি ব্যবহার করলে বাকিগুলির বিদেশি রূপও রাখতে হয়। তখন বাংলা বাচন আর বাংলা থাকে না।text শব্দটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা যে শব্দগুলি এখনি মনে পড়ছে: text রচনা, textual রাচনিক, textualilty রাচনিকতা, তারপর পূর্বোক্ত শব্দগুলিতে meta, trans, inter, intra, para, archi, hyper, hypo, geno, pheno, peri, epi.ইত্যাদি(বাংলায় অধি, পরি, আন্তঃ-, অন্তঃ-, উপ- ইত্যাদি) উপসর্গযোগে বহু শব্দ।
তপোব্রতবাবুর তির্যক উত্তর: আমি যারপরনাই বিনীতভাবে স্বীকার করছি যে,১ -নম্বরের শেষাংশ,২ -নম্বর,৪ -নম্বর এবং অবশই ৫ -নম্বর আমারই বুদ্ধিদোষে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।আর ৬ -নম্বর অনুযায়ী 'রচনা' কিংবা 'পরিরাচনিক' ইত্যাদি লিখতেও মন খুঁতখুঁত করছে।আমার বিনম্র নমস্কার গ্রহণ করুন।...
***
প্রসঙ্গত মনে হল জাতি ও স্তরভেদে বিভক্ত এই বাংলাদেশে (রাজনৈতিক দুই বাংলায়) গুরুবাক্য বিচারহীন ভাবে মেনে নেওয়াটা কর্তব্য বলে বিবেচিত : বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। চৈতন্যের উপাসক এই দেশে রঘুনাথ শিরোমণি বিস্মৃত। তর্কেতে মিলায বস্তু বিশ্বাসে ক্রমশ বহু দূর: এ জাতীয় চিন্তা ধর্মবিরোধী। "উনি" অধ্যাপক অতএব আমাদের ছাত্র না হওয়া অবৈধ, গুরুবাক্য মানতেই হবে — বিশ্বাসে মিলায় বস্তু ।
ছাত্রের ভূমিকা নিতে পারলাম না বলে অধ্যাপক ঘোষের বাচনের বিপ্রতীপ অক্ষের অবস্থান থেকে আমার বা/ এবং আমাদের কিছু প্রশ্নভিত্তিক বক্তব্য থেকে গেল:
১. বাংলা ভাষায় লেখা রচনায় ফরাসির মাধ্যমে ইংরেজিতে আসা ল্যাটিনমূল শব্দ 'টেক্সট' ব্যবহারের কারণ বা প্রয়োজনটা কী তা বোঝা গেলনা। কয়েকজন ছাত্র স্যারের সামনে কিছুটা আমতো আমতো করে "রচনা" শব্দটি প্রস্তাব করল। অধ্যাপক ঘোষ তা বাতিল করে দিলেন, "রচনা" বলতে নাকি personal essay বোঝায় , আমদের প্রশ্ন স্কুলে যে "রচনা" লিখতে বলা হয় তা কি personal essay অথবা "বঙ্কিম রচনাবলী" বা "রবীন্দ্র রচনাবলী" কী যথাক্রমে বঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথের personal essays-এর সংকলন।
যে কোনো ভাষায় প্রশাসন, বিচার-ব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ঠার্থক বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। সমবেতভাবে এই শব্দগুলিকে শ্রেণী হিসেবে বলা হয় পরিভাষা , আলাদাভাবে বলা হয় পারিভাষিক শব্দ। সংস্কৃত (দর্শন. সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি) আর আরবি-ফার্সি (বিচার, প্রশাসন, ইসলাম ইত্যাদি) থেকে আসা বিভিন্ন পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হত এবং হয়। তারপর ঔপনিবেশিক যুগে গত দু শ বছর ধরে ইংরেজি থেকে (সরাসরি ইংরেজি শব্দ, ইংরেজি শব্দের অনুবাদ বা অনুবাদ-অনুকৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে) বাংলা ভাষায় ইংরেজি আর ইয়োরোপীয় জীবনযাপন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রের পারিভাষিক শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে। জীবনের সংঙ্গে যোগহীন বিদেশি ইংরেজি ভাষার মাধ্যম ঔপনিবেশিক ও তার পর নয়া-ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বাংলায় পরিভাষা সৃষ্টির ব্যাপারটা ব্যাপ্তি ও যথোপযুক্ত গুরুত্ব লাভ করে নি। এছাড়া নয়া-ঔপনিবেশিকতার ভিত্তি ভাষিক -সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের (The empires of the future are the empires of the mind. Winston Churchill, speech at Harvard University, Sept. 6, 1943) প্রতিষ্ঠা বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা কি পরিভাষা তৈরির প্রয়াস প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। "'রচনা' কিংবা 'পরিরাচনিক' ইত্যাদি লিখতেও মন খুঁতখুঁত করছে" তপোব্রতবাবুর এই উক্তি বা তাঁর ছাত্র অরুণাভ ঘোষের সমর্থন "বাংলায় নতুন কিছু এবং বাস্তবিকভাবেই উদ্ভট পরিভাষায় ধরা সম্ভব" বা "উদ্ভট বাংলা " মনে হয় ইংরেজি শব্দগুলো রাখার পক্ষাবলম্বী মনোভাবের প্রকাশ । Text , transtextual, transtextuality, metatext , intertext , intratext , paratext , architext , hypertext , hypotext , genotext , phenotext , peritext , epitext ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ-কণ্টকিত ওই বাংলাকে কি বাংলা বলা যাবে আর তাতে কি প্রথম থেকেই যারা ইংরেজি জানে না তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে না? পরিভাষা তৈরির সমস্যা সব ভাষাতেই বর্তমান। রোলঁ বার্ত-এর "রচনার সুখ " (Le Plaisir du texte) অনুবাদ করতে গিয়ে ব্রিটিশ অনুবাদের অনুবাদক স্টেফান হিথ আর রিচার্ড মিলার-এর মার্কিন অনুবাদের ভূমিকা-লেখক রিচার্ড হাওয়ার্ড jouissance (রাগমোচন) শব্দের ইংরেজি অনুবাদের অসুবিধা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। তবে ওঁরা অনুবাদ না করে উৎসভাষার শব্দটি ব্যবহার করে দায় সারেন নি। মার্কিন অনুবাদক ব্যবহার করেছেন ধর্মীয় অনুষঙ্গযুক্ত bliss, ব্রিটিশ অনুবাদক প্রস্তাব করেছেন thrill বা প্রসঙ্গ অনুযায়ী অন্য কোনো শব্দ। এছাড়া ব্যবহারের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পারিভাষিক শব্দ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তা আর "উদ্ভট" মনে হয় না, শব্দগুলির অর্থপরিধিও নির্দিষ্ট হয়। Edaphology, nyctalopia, intersubjectivity, simulacrum – এসব পারিভাষিক শব্দ ইংরেজিতে জ্ঞান -বিজ্ঞানের চর্চায় উদ্ভট বলে বোধ হয় না। আবার " বিন্দুর অনুভব এবং নাদের অনুভব একপ্রকার নহে।...নাদভূমি হইতে বিন্দুভূমিতে নামিয়া আসাও তত সহজ নয়।" গোপীনাথ কবিরাজের তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে লেখা রচনা থেকে উদ্ধৃত বাক্য দুটোও পারিভাষিক শব্দের কারণে সবার কাছে বোধ্য নয় কিন্তু সংস্কৃতমূল পারিভাষিক শব্দগুলিকে "উদ্ভট" বলা যাবে কি? স্যারের হয়ে যিনি বাংলা ভাষায় " উদ্ভট" পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারের বিরোধিতা করোছেন সেই অরুণাভ ঘোয কি "নাদভূমি", "বিন্দুভূমি" ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দকে " উদ্ভট" মার্কা মেরে বিদায় করবেন।
" টেক্সট " শব্দটির ব্যবহার নিয়ে তপোব্রতবাবু আর তাঁর ছাত্ররা অনেক কথা বললেও বোঝা গেল না গান, রচনা, কবিতা ইত্যাদির বদলে " টেক্সট " বলতে তাঁরা কি বোঝাতে চেয়েছেন, অর্থাৎ তপোব্রতবাবুর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে " টেক্সট " -এর সংজ্ঞার্থ কী। বাঙালির বিশেষ পরিচিত SOED -এর 'টেক্সট' শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে ভাষাতত্ত্বে ব্যবহারের (কিছুটা মামুলি হলেও) সংজ্ঞার্থ দেখা যায়:
[Old Northern French tixte, (also mod. French) texte from Latin textus tissue, style of literary work, (in medieval Latin) the Gospel, written character, from text- pa. ppl stem of texere weave.]
Linguistics. (A unit of) connected discourse whose function is communicative and which forms the object of analysis and description.
তপোব্রতবাবু বলেছেন : 'টেক্সট' ='বাঙ্ময়', "শব্দ-গ্রথিত কাব্যশরীর" (যা কিছু বলা বা লেখা হয় তাই বাগ্ময়, হরিচরণ অর্থ হিসেবে প্রায় সমার্থক "বাগবয়ব " ব্যবহার করেছেন), কিন্তু তা বিশেষণ, তাকে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করতে "মন খুঁতখুঁত করা" সত্ত্বেও যদি ব্যবহার করা হয় তাহলেও তা ভাষা-ব্যবহারের কোনো স্বায়ত্ত্ব (autonomous) একক (unit) নির্দেশ করে না। "শব্দ-গ্রথিত কাব্যশরীর" শ্রুতিমধুর হলেও অস্পষ্ট বা বলা যায়, অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট। যে কোনো বাক্য বা এবং বাচনই তো "শব্দ-গ্রথিত শরীর"। এছাড়া না neither না nor নেতি নেতি পদ্ধতিতে ("আমি যে কোনো স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ লিখছি না...এইরকম কোনো সত্যের অস্তিত্বকে কি স্ট্রাকচারালিস্টরা স্বীকার করবেন?" এই না না-র (নানাবাদ) পদ্ধতিতেও তপোব্রতবাবু 'টেক্সট' বলতে অন্যদের থেকে আলাদা কী বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়।
তপোব্রতবাবুর বেশির ভাগ বাক্যের তির্যক সংগঠনের উষ্মা-মিশ্রিত শ্লেষ (যদি..করেন, চোখ হোঁচট খাবে, এই আর কি) সব ধরনের জাতিভেদ দ্বারা বিভক্ত আমাদের সমাজের স্তরভেদ নির্দেশ করে, নির্দেশ করে উনি অধ্যাপক অতএব তার উদ্দিষ্ঠ বাকিরা হল শিক্ষার্থী ছাত্র।
"আমি যারপরনাই বিনীতভাবে স্বীকার করছি ...অবশ্যই ৫ -নম্বর আমারই বুদ্ধিদোষে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।আর ৬ -নম্বর অনুযায়ী 'রচনা' কিংবা 'পরিরাচনিক' ইত্যাদি লিখতেও মন খুঁতখুঁত করছে।আমার বিনম্র নমস্কার গ্রহণ করুন।" এই আপাত বিনয়ের মধ্যেও অস্মিতার প্রকাশ স্পষ্ট।
তপোব্রতবাবুর বাচনের ভঙ্গি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এই সংজ্ঞাপনের বার্তার উদ্দেশক "উনি" একজন অধ্যাপক (অতএব বিদ্যায়তনিক ঐতিহ্য অনুসারে) উদ্দিষ্ট পরিগ্রাহকরা ছাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। "কোনো স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ লিখছি না ", "... কোনো সত্যের অস্তিত্বকে কি স্ট্রাকচারালিস্টরা স্বীকার করবেন?" অনুপস্থিত (বিদেশি) স্ট্রাকচারালিস্টদের প্রতি এই যুদ্ধং দেহি মনোভাব, "কাব্যের মধ্যে কবির সত্য" এই রোমান্টিক রাবীন্দ্রিক কাব্যচিন্তা (স্মরণীয় ওয়ার্ডসওয়ার্থ- এর উক্তি Aristotle … has said, that Poetry is the most philosophic of all writing: it is so: its object is Truth.) , বা অন্য একটি রচনায় উনিশ শতকীয় biographical criticism-র প্রয়োগের কথা ইত্যদি সব মিলিয়ে রাসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রেইমোঁ পিকার (Raymond Picard) সাহেবের "নতুন সমালোচনা না নতুন ভণ্ডামি" (Nouvelle critique ou nouvelle imposture) বইয়ে নতুন সমালোচনা আর বিশেষ করে তার অন্যতম পথ-প্রদর্শক রোলঁ বার্তকে (Roland Barthes) আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তাছাড়া অধ্যাপক ঘোষের উষ্মা আর শ্লেষ মেশানো ধমক বোধ হয়, একদিকে সংজ্ঞাপন /communication- এর ইয়াকবসন নির্দেশিত অভিযোজক/phatic বৃত্তি যাচাই করার অধ্যাপকীয় পদ্ধতি আর অন্যদিকে যারাই তাঁর আলোচনা পড়তে চাইবে তাদের সবাইকে শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা হবে তার ইঙ্গিত ।
শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গানের বাণীকে রচনা (text) হিসেবে তপোব্রতবাবুর পঠন (reading) অনেকটাই রোমান্টিক, জীবনকাহিনী নির্ভর প্রথাগত পঠন। তন্ময়ীভবন ও সহৃদয় (…যেষাং কাব্যানুশীলনাভ্যাসবশাদ্বিশদীভূতে মনোমুকুরে বর্ণনীয়তন্ময়ীভবনযোগ্যতা তে সহৃদয়সংবাদভাজঃ সহৃদয়াঃ) ভারতীয় কাব্যমীমাংসার ধ্বনি প্রস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও ভারতীয় কাব্যমীমাংসা রচয়িতার জীবনবৃত্তান্ত, কবির সত্যের সন্ধানের ভাববাদী রোমান্টিক পঠনের বদলে, বলা যায়, আধুনিক রচনাকেন্দ্রিক পঠনের পক্ষপাতী। তাছাড়া কালিদাসের "মেঘদূত" পড়তে গেলে যদি কালিদাসের জীবনকাহিনির প্রয়োজন হয় তাহলে তা আর পড়া হবে না।
সব শেষে "স্যারের" পক্ষ নিয়ে অরুণাভ ঘোষের বক্তব্য ছিল: ইংরেজি পরিভাষা যা বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের চর্চায় ব্যবহৃত হয় সেগুলি মুলত ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে থেকে আসায় তার সঙ্গে ইংরেজির একটা নিবিড় মিল আছে ... সেগুলির ব্যঞ্জনা কি সত্যিই বাংলায় নতুন কিছু এবং বাস্তবিকভাবেই উদ্ভট পরিভাষায় ধরা সম্ভব? তাই সেগুলির ব্যবহার করলেই "রবীন্দ্রভক্ত বাঙালি আজ তার বিপরীত পথে এগিয়ে চলেছে" এমন কথা বলাটা একটু অতিসরলীকরণ... আর স্ট্রাকচারালিস্ট বা ফর্মালিস্টরা "টেক্সট" বলতে কোনোকিছু ধ্রুবক বোঝাননি, নানা ব্যঞ্জনায় শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যা মূলত প্রসঙ্গ বা কনটেক্সট-এর উপরে নির্ভরশীল ... অতি সাধারণ কথায়, একটা বই আর একটা টেক্সটের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায় যখন বইটি শুধু একটি 'বস্তু' হিসেবে আলমারীতে পড়ে থাকে ... তখন সেটিকে বই হিসেবেই দেখা যায়, একটা 'কমোডিটি' বা বস্তু হিসেবে দেখা যায়, 'রচনা' হিসেবে না ... কিন্তু সেটার ব্যাখ্যামূলক আলোচনা এবং তার ব্যবহার সেটাকেই 'টেক্সট' করে তোলে ... অর্থাৎ টেক্সট নির্ভর করে তার ব্যাখ্যা ও আলোচনার উপরে ... সেই অর্থে একটা কলমও টেক্সট হতে পারে, একটা বালিশও ... এখন স্যারের এই লেখায় একটি গানের কথা এসেছে যা্র অর্থ জনৈক গায়িকা ভুল বুঝেছেন এবং সেটিই ধরে রেখেছেন ... এখানে "টেক্সট" শব্দের ব্যবহার, মানে স্যারের এই লেখার মধ্যে "টেক্সট" শব্দের ব্যবহার কোনোভাবেই কি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে? বরং আরো অনেক বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়েছে যা ঐ উদ্ভট বাংলা ব্যবহারে হতে পারত ... আরো একবার সকলে ভাবতে পারেন …
এর পর অরুণাভবাবুর বক্তব্য সম্পর্কে আমি যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত করেছিলাম, অবান্তর বা এহো বাহ্য বোধে তার কোনো প্রত্যুত্তর দেওয়া হয়নি। বস্তুত মাননীয় অরুণাভ ঘোষ মহাশয়ের বক্তব্য পড়ে আমার মনে পড়েছিল ছোটবেলায় আমার মাতামহ আমাদের বলতেন , কী সব উদ্ভট শব্দ তোরা শিখছিস : বীজগণিত, ভূগোল, আলজেব্রা, জিওগ্রাফি... কী সুন্দর! তার বহুকাল পরে ভাবতাম দাদু যদি জানতেন আলজেব্রা আরবি আল্-জাব্র্ ওয়াল শব্দ থেকে আসা তাহলে হয়তো শব্দটি তাঁর তালিকা থেকে বাদ দিতেন । ঘোষ মশায় জানিয়েছেন, "ইংরেজি পরিভাষা যা বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের চর্চায় ব্যবহৃত হয় সেগুলি মুলত ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে থেকে আসায় তার সঙ্গে ইংরেজির একটা নিবিড় মিল আছে" ... এখানে প্রথম প্রশ্ন হল কেন, তারপর এই ফরাসি "ভাষাতাত্ত্বিক" কারা আর নিবিড় মিল বলতে কী বোঝানো হয়েছে? "সেগুলির ব্যঞ্জনা কি সত্যিই বাংলায় নতুন কিছু এবং বাস্তবিকভাবেই উদ্ভট পরিভাষায় ধরা সম্ভব?" এই দ্বিতীয় বাক্যে ব্যঞ্জনা বলতে কি শব্দের অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা , এই তিন বৃত্তির অন্যতম ব্যঞ্জনাবৃত্তি বোঝানো হয়েছে না বাচ্যার্থ , লক্ষ্যার্থ বাদ দিয়ে ব্যঙ্গার্থ নির্দেশ করা হয়েছে (সংস্কৃত শব্দার্থতত্ত্বও উদ্ভট ?)। বাংলা ভাষায় ওই ধারণাগুলো নতুন কিছু নয় এটাই কি ঘোষ মশায়ের বক্তব্য? তা যদি হয় সেই বক্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত? এর পর ঘোষ মশায় জানিয়েছেন যে 'কমোডিটি' বা বস্তুর ব্যাখ্যামূলক আলোচনা এবং তার ব্যবহার তাকে 'টেক্সট' করে তোলে, একটা কলমও টেক্সট হতে পারে, একটা বালিশও—ঘোষ মশায় যদি টেক্সট-এর এই ব্যাখ্যার সূত্র জানান তাহলে আমরা উপকৃত হই। তবে "কমোডিটি' বা বস্তু হিসেবে দেখা যায়, 'রচনা' হিসেবে না" এই বাক্যাংশে ঘোষ মশায় নিজেই "রচনা" ব্যবহার করে শব্দটির স্বাভাবিকতা আর যাথার্থ্য প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া "ধ্রুবক" ও "ব্যঞ্জনা", এ দুটি পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে।
শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার সমস্ত ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পক্ষপাতী রবীন্দ্রনাথের "ভক্ত বাঙালি আজ তার বিপরীত পথে এগিয়ে চলেছে" অমিতাভবাবুর মতে, "এমন কথা বলাটা একটু অতিসরলীকরণ"। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা যে কোনো বিষয়ে জটিল তোমরা কী বুঝবে, তাচ্ছিল্যের স্মিত হাসি সহ "সরলীকরণ", "অতিসরলীকরণ" শব্দে এই মনোভাব প্রকাশ করছেন। আমার প্রশ্ন কেন, কীভাবে "অতিসরলীকরণ"?