Sunday 20 November 2016

প্রসঙ্গ;কালো টাকা,চমকের রাজনীতি ------------------- কল্যাণ সেনগুপ্ত

চমকের রাজনীতির শিকার গোটা দেশ -কল্যাণ সেনগুপ্ত।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটিও বোধকরি অতীতে কখনো নোট বাতিলের ফলে এমন দুর্ভাগ্যের ও উদ্বেগের শিকার হন নি, যেমনটি এবার হচ্ছেন। এমন অবিবেচক, এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রধানমন্ত্রী দেশবাসী এর আগে দেখেনি। প্রথমেই একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। প্রচন্ড ভিড় এড়াতে প্রথম দুদিন ব্যাংকমুখো হবার সাহস পাইনি। তৃতীয় দিনে গিয়েও ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরতে হলো। চতুর্থ দিনে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অনেক কষ্টে সাকুল্যে দশ হাজার পাওয়া গেল, কিন্তু তার মধ্যে চারটি 2000এর নোট, বাকিটা 100 । এবার বলুন, কোন বাজারে দু-চারশো টাকার মাল কিনলে 2000এর নোট ভাঙিয়ে দেবে? এখন আমাকে বাধ্য হয়ে সবার দয়া ভিক্ষা চাইতে হবে। এই পরিস্থিতি যে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অসহনীয়। আমার মতো অনেককেই অসৎ না হয়েও এমন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এভাবে আরো কতদিন চলবে বোঝা যাচ্ছে না আদৌ। প্রথম দিকে অরুনhim জেটলি বলেছিলেন- এইসা ঘাবরানেকা কুছ নেহি, দো-চার দিনমে সব কুছ সামান্য হো জায়েগা। এখন আবার শুনছি 15/20 দিন। মোদীজি মাঝে বললেন- মুঝে পাচাস দিনকা সময় দিজিয়ে, ম্যায় এক নয়া ভারত সবকো দেঙ্গে। কতদিনে এই সমস্যা শেষ পর্যন্ত মিটবে কেও নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা। উল্টে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, পরিস্থিতি ক্রমশঃ আরো খারাপ হবে। সবাই একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বাজারে পাঁচশর নোট নেই আর একশোর জোগানও সামান্য। নোট বাতিলের আগে এর প্রয়োজনীয় যোগানের কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্য ও দৈনিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে সেই বিষয়টিকেও কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কোনো দায়িত্বশীল সরকার যে এমনটা করতে পারে, তা প্রায় অকল্পনীয়। এই অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা ঢাকতে এখন দেশপ্রেমের দোহাই দেওয়া হচ্ছে এবং যারাই এবিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে, তারা নাকি সব দেশদ্রোহী। এই জবরদস্তি উচ্চকিত দেশভক্তি কি ফ্যাসিজমের পদধ্বনি নয়! ইতিহাস কিন্তু সেই আশঙ্কার কথাই বলে।
একবার এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত বলেছিলেন- এটা গণতন্ত্রের যুগ। কিন্তু বিভিন্ন রকম আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখাও এক বড় সংগ্রাম। আমাদের আশেপাশে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বেশ নড়বড়ে। যদিও আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ভিত বেশ সুদৃঢ়। এখানে বহু ধর্মের মানুষ, বহু ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে একত্রে শান্তিতে বাস করছে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে অবলম্বন করে। এখানে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ঠাঁই নেই। রাজনীতি বা সেনাবাহিনীর যে কেউ হোক, স্বৈরতন্ত্রঈ হয়ে উঠতে চাইলে মুশকিল হচ্ছে, তিনি যদি উত্তর ভারতের মানুষ হন তবে অচিরেই দক্ষিণের প্রায় সবাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, আবার দক্ষিণের হলে বিদ্রোহ করবে উত্তরের মানুষ। ফলে এখানে স্বৈরতন্ত্রের সফল হবার আশা নেই। কিন্তু কখনো কারো মাথায় যদি ভুত চাপে তখন আর অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা থাকেনা। যেমনটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মাথায় চেপেছে, আশঙ্কা হচ্ছে। নইলে কোনো দায়িত্বশীল সুস্থমস্তিস্কের মানুষের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব নয়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেও যদি তিনি কোনো বাধা না পান বা পার পেয়ে যান, তাহলে কিন্তু আগামী দিনে দেশকে আরো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা ছেড়ে দিলেও শুধুমাত্র দৈনিক ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেনে ইতিমধ্যেই কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে, তা আন্দাজ করলে শিউরে উঠতে হয়। আগামীদিনে কিন্তু সব হিসেব নিকেশ করতেই হবে। এই পদক্ষেপের ফলে কতটা লাভ হলো আর কতটা ক্ষতি, তারও হিসেব। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পঞ্চাশ দিন পরে অর্থাৎ 2017তে তিনি নতুন ভারত উপহার দেবেন। নতুন ভারত বলতে কি কালোটাকা, নকল টাকা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত ভারত? তাহলে বলতে হয়, এটিও তবে ওই '১৫ লক্ষ প্রত্যেককে' এর মতোই আর একটি ধাপ্পা। বর্তমান অবস্থায় দেশকে সম্পূর্ন কালো টাকা মুক্ত করা অসম্ভব। কারণ ধনীদের থেকে 100% কর আদায় প্রায় অসম্ভব। কর বহির্ভুত অঘোষিত টাকাই হচ্ছে কালো টাকা। সবাই যে সে টাকা ঘরের মধ্যে থরেথরে সাজিয়ে রাখে, এমনটা নয়। বিদেশে পাচার করে, সোনা কিনে মজুত করে, রিয়েল স্টেটের ব্যবসা ইত্যাদিতে লগ্নি করে। নোট বাতিলের ফলে কালোটাকার একটা ক্ষুদ্র অংশ হয়তো নষ্ট হবে বা ধরা পরবে। তবে হ্যাঁ, নকল টাকার ক্ষেত্রে সাময়িক সুফল পাওয়া যাবে। তবে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বড় চালু নোটের নকল আবার চালু হবে। চালু হবে সন্ত্রাসও। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি কোনো পদক্ষেপই নয়। সম্প্রতি গুজরাটেও দুলক্ষ টাকার অধিক ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং সেই ঘুষে সবই ছিল নতুন দুহাজার টাকার নোট। কোথা থেকে এল এত দুহাজারের নোট, সেও এক রহস্য! অর্থাৎ সর্ষে ভুতের সক্রিয়তা এতটুকু কমেনি, আর দুর্নীতিতো দূরস্থান।
আজ একথা প্রমাণিত যে, যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়েই এই নোট বাতিলের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাকে বলা যায়, রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি। এমনটি আমাদের দেশে অতীতে কখনও হয়নি। এর মধ্যেও সারাদিন লাইন দিয়ে যারা টাকা পাচ্ছেন, তাদেরকেও 80% ₹2000 নোটেই দেওয়া হচ্ছে জবরদস্তি। মনে হচ্ছে যেন, ₹2000 নোট চালু করতেই এই ₹500 ও 1000 নোট বাতিল করা হলো। বর্তমানে এই ₹2000 নোট সাধারণ মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্তটি নাকি ঐতিহাসিক, এর ফলে নাকি ধনী ও দারিদ্রের ব্যবধান কমবে! এসব অবান্তর দাবি করা হলেও অর্থনীতির কোনো পন্ডিত কিন্তু এর সপেক্ষে মুখ খোলেননি। অপরদিকে অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, স্বামীনাথন আইয়ার বা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতির বিশিষ্ট মানুষেরা বরং আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন। মনমোহন সিং শুধুমাত্র কংগ্রেস নেতা নন, তিনি একজন অর্থনীতির পণ্ডিতও বটেন। তিনি নিজের অতীত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেছেন, আমি যখন নরসীমা রাও মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হয়ে আসি, তখন আমার মনে হয়েছিল অতিশীঘ্রই কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। কিন্তু নরসীমাজি আমাকে বলেন, এটা ভারতবর্ষ। এখানে কিছু করতে হলে প্রথমেই ভাবতে হবে দেশের সুদূর প্রান্তে উঃ পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্রতম মানুষটির কথা, তার যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সেসব ভাবার প্রয়োজন মনে করেন নি। তিনি বিশ্বাস রাখেন সাফল্যের বাজিতে, চমকের রাজনীতিতে।

রোহিঙ্গারা নিখিল বাঙালির অংশ ------------------------গোলাম কিব্রিয়া

         একটা জনগোষ্ঠী হরেদরে অপরাধপ্রবন হয়না। আনরুলি নেটিভ, লেজি নেটিভ এগুলো কলোনাইযারদের কয়েন করা টার্ম। গভর্নমেন্টালিটির স্বার্থে তারা এটা করতো। বঞ্চনা, রেইসিজম ইকোনমিক সেগ্রিগেশন থেকে দরিদ্র মানুষ ইনফর্মাল ইকোনমিতে জড়িয়ে পড়ে, ব্ল্যাক মার্কেটে অংশী হয়। ইউরোপীয়ান ঘেঁটোতে, নিউইয়র্কের হার্লেমে, আগারগাঁও বস্তিতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বেশী হয়, কারন তারা ইকোনিমিক মেইনস্ট্রিমে আসতে পারেনা। পভার্টি ও ক্রাইম কো-রিলেটেড। রোহিঙ্গারা ততটুকুই অপরাধপ্রবন যতটুকু বাঙালীরা, তারা ততটুকুই শান্তিপ্রিয় যতটুকু বাঙালীরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যদি কয়েক বছর প্রলম্বিত হত, তাহলে ত্রিপুরা, কলকাতার বাঙালী শরনার্থী ক্যাম্পগুলো থেকে মাদক বিক্রি হতো। এটাই স্বাভাবিক, ব্যাতিক্রম না।
মায়ানমারকে পশ্চিমারা বেশী প্রেশার দেবেনা কারন তারা মার্কেট খুলে দিয়েছে রিসেন্টলি। তাদের ন্যাচারাল রিসোর্সে এখন চীনের সাথে পশ্চিমারা ও ভাগ পাবে। সেমি-গণতান্ত্রিক মিলিটারি সরকার এথনিক ক্লিনজিংয়ে বিশ্বাসী। রোহিঙ্গাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, জাতিসংঘ ও তাদের নেবেনা। আমরা সীমান্ত খুলে দিতে পারি এবং তারপর পশ্চিমাদের সাথে দেন দরবারে যেতে পারি তাদের ভরনপোষনের ব্যাপারে। জাতিসংঘ নৈতিক সংকটে আছে, এই অস্বস্তি কাটাতে তারা একটা থোক বরাদ্দ দিতে রাজী হওয়ার কথা। এটা কঠিন কোন বিষয় না, কঠিনতর হচ্ছে ইন্টিগ্রেশন। ইন্টিগ্রেশন একটা পেইনফুল ও প্রলম্বিত প্রসেস। এর মাঝখানে তারা ইয়াবাসম্রাট ও পূর্ববাঙলার এসকোবার বদি ভাইয়ের মতন সরকারের স্নেহধন্য লুটেরাদের দ্বারা ব্যাবহৃত হবে, যেটা পিউরলি আইন শৃঙ্খলার প্রশ্ন, বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কুফল। একটা মার্জিনাল, মানবেতর জীবন যাপন করা, পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে এর জন্য দায়ী করা ভিক্টিম ব্লেইমিং। পশ্চিম যখন সিরিয়ান রিফিউজি নিতে অস্বীকার করে, তখন তারা এই যুক্তি দেয় এবং আমরা তার প্রতিবাদ করি।
রোহিঙ্গারা নিখিল বাঙালী জাতির অংশ। মগ দস্যুদের সময়ে, ব্রিটিশ রাজের সময়ে তাদের জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দাস হিসেবে। বিখ্যাত বাঙালী কবি আলাওলকে ও কিশোর বয়সে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো দস্যুরা। পূর্ববাংলা ছাড়া ও বাঙালীরা পশ্চিম বাংলায় আছে, ত্রিপুরায় আছে, আসামে আছে, আরাকানে আছে, পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন ডায়াসপোরায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাস্ট্র ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু দেশ এক। যতটুকু দূরত্ব হলে গণহত্যায় নির্বিকার থাকা যায়, ততটুকু দূরত্ব আমাদের সাথে রোহিঙ্গাদের নেই। আমাদের আত্মীয় তারা।
রোমান আফ্রিকাতে টেরেন্স নামে একজন দাস ছিলেন, যিনি নিজেকে টেরেন্স দ্যা আফ্রিকান বলতেন। স্ব-উদ্যোগে তিনি গ্রীক শিখেছিলেন এবং গ্রীক ক্লাসিক্যাল টেক্সটগুলো ল্যাটিনে অনুবাদ করতেন। দাসেরা সেইসময় প্রকৃতার্থেই দাস ছিলেন, উপমার্থে না। পশুসম্পদের মতই মালিকদের সম্পত্তি ছিলেন তারা। মানুষের মতন দেখতে একটা সাব হিউম্যান জীব। এই পরিমান লাঞ্ছনার মাঝে থাকার পরে ও টেরেন্স বলেছিলেন, "নাথিং হিউম্যান ইজ এলিয়েন টু মি" । এই কথাটা খুব গুরুত্তপূর্ন। যে জাতির কালচারাল মেমোরিতে গণহত্যা ও শরনার্থী ক্যাম্পের দগদগে ক্ষত, তারা কিভাবে সীমান্তের ওপারের এমন হিউম্যান ক্যাটাস্ট্রোফিতে ও এতটা নির্বিকার থাকে? যশোর রোডের পথে পথে ছড়ানো লাশ ও শকুনদের তুমি ভুলে গেলে বাঙালী?

Thursday 17 November 2016

ইরম শর্মিলার রাজনৈতিক দল --------------পোর্টাল ইউকেবেঙ্গলি

রাজনৈতিক দল গঠন করলেন 'মণিপুরের লৌহমানবী' ইরম শর্মিলা
irom_shormila.jpg
ইউকেবেঙ্গলি, লণ্ডন - ১৮ অক্টোবর ২০১৬, মঙ্গলবারঃ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন 'মণিপুরের লৌহমানবী' ইরম শর্মিলা চানু। ভারত সরকারের 'নিগ্রহমূলক' বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তিনি দীর্ঘ ষোল বছর অনশন করেন। গত অগাষ্টে অনশন ভেঙ্গে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন রাজনীতিতে প্রবেশের।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে সেনাবাহিনীর সন্দেহিত নিগ্রহমূল আচরণ বন্ধ ও বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করার দাবীতে ইরম শর্মিলা ষোল বছর ধরে অনশন পালন করেন। এই সময়কালে দেশটির সরকার তাঁর নাকে নল ঢুকিয়ে জোর করে খাবার প্রবেশ করিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
আরও কয়েকটি রাজ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অনুরূপ নিগ্রহের অভিযোগ থাকলেও, ইরমের আন্দোলনের কল্যাণে মণিপুরে পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচার ও সহানুভূতি পেয়েছে। দু'মাস আগে অনশন ভঙ্গ করার সময় তিনি বলেছিলেন, এবার রাজনীতির মাঠে লড়বেন।
আজ ইম্ফলের প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে পিপল্‌স রিসার্জেন্স এ্যাণ্ড জাষ্টিস এ্যালায়েন্স সংক্ষেপে 'প্রজা' নামের রাজনৈতিক দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ৪৪ বছর বয়ষ্ক ইরম। তিনি জানান, আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য মণিপুর রাজ্য নির্বাচনে তাঁর দল ৬০টি আসনের মধ্যে অন্ততঃ ২০টিতে প্রার্থী দেবে। তিনি নিজে দাঁড়াবেন দু'টি আসনে, যার একটির বর্তমান এমপি হচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইববি সিং।
রাজনীতির মাঠেও ইরমের মূল লক্ষ্য - অর্থাৎ বিশেষ ক্ষমতা আইন রদ করা - অবিচ্যুত থাকবে। তিনি জানান, তাঁর দলের ভিত্তি হবে ন্যায়বিচারের নীতি, ভালোবাসা ও শান্তি।
সরাসরি দলভিত্তিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা না থাকার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ইতিমধ্যেই ইরম বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। দ্য হিন্দু পত্রিকা জানিয়েছে, অনশন ভাঙার পর তিনি দিল্লীর আম আদমী পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিবালের সাথে দেখা করে জানতে চেয়েছেন বড়ো দলকে পরাজিত করার কৌশল সম্পর্কে।
অনশনের ষোল বছর মণিপুরের জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থন পেয়েছেন ইরম শর্মিলা। তাদের সেই সমর্থন রাজনীতিক শর্মিলার প্রতি অটুট থাকে তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের নির্বাচ পর্যন্ত।

আত্মপরিচয়ের দুই শিবিরঃ বাঙালির রাজনৈতিক মেরুকরণ ______________ মাসুদ রানা

আত্মপরিচয়ের দুই শিবিরঃ বাঙালীর রাজনৈতিক মেরুকরণ
মাসুদ রানা
বাঙালীর আত্মপরিচয় সঙ্কটযেখানেই বাঙালীর রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন বা চর্চার প্রশ্ন আসে, সেখানেই দু’টি আত্মপরিচয় পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব প্রবৃত্ত হয়ে সঙ্কট সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে। এদের একটি হচ্ছে তার ধর্মীয় আত্মপরিচয়, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি। আর, অন্যটি তার জাতিসত্তাগত আত্মপরিচয়, অর্থাৎ বাঙালী। এটি শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্র সত্য, তা নয়। এটি ব্রিটেইনের বাঙালীর ক্ষেত্রেও সত্য।
সমাজমনোবিজ্ঞানে এটি একটি আইডেণ্টিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয় সঙ্কট। আমি আমার এ্যাকাডেমিক গবেষণায় এর তত্ত্বায়ন করেছি ‘এ্যাম্বিভ্যালেণ্ট আইডেণ্টিটি’ বা ‘দোদুল্যমান আত্মপরিচয়’ নামে। আমি দেখিয়েছি, এর উদ্ভব হয়েছে ধর্মীয় ক্যাটেগোরাইজেশন ও এথনিক ক্যাটেগোরাইজেশনের মিশ্রণ বা ক্রস-ক্যাটেগোরাইজেশনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত বিরোধ থেকে।
দ্বন্দ্বে লিপ্ত ও দোদুল্যমান দুই আত্মপরিচয় গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে (১) দু’টি ঐতিহাসিক বঞ্চনাবোধ, (২) দু’টি ঐতিহাসিক আন্দোলন ও (৩) দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এই তিনটির (৪) ‘ভিভিড মেমোরি’ বা ‘বিশাল স্মৃতি’, যা 'সৌশ্যাল রিপ্রেজেণ্টেশন' বা সামাজিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে বাঙালীর সামাজিক সংবোধ পরস্পর বিরোধী দু’টি আত্মপরিচয় গঠন ও আবেগ সঞ্চারের মাধ্যমে তীব্র প্রেষণা তৈরি করে দু'টি ক্যাম্পে বা শিবিরে মেরুকৃত করে চলছে। আমি এক্ষণে দুই ক্যাম্প বা শিবিরকে ১৯৪৭-শিবির ও ১৯৭১-শিবির বলে চিহ্নিত করছি।
বাঙালী একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে যে সঙ্কটে নিপতিত হয়, একই বাঙালী ব্রিটেইনে একটি সম্প্রদায় হিসেবে বাস করেও একই সঙ্কটের সম্মুখিন হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসকে বাঙালীর রাজধানী বলা হয় তার জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতাজাত রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে। আমার তত্ত্বানুসারে, এখানেও বাঙালীর মধ্যে আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বপ্রসূত সঙ্কট রয়েছে। আর, এর এর ফলে এখানেও বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্তর-শিবির বনাম সাতচল্লিশ-শিবিরে বিভক্তি রয়েছে।
এখানে সাতচল্লিশ-শিবির সংগঠিত রয়েছে সদ্য মেয়র-পদচ্যুত ও লেবার দলের বহিষ্কৃত নেতা লুতফুর রহমানকে ঘিরে। এই শিবিরের বিপরীতে একাত্তর-শিবির জড়ো হচ্ছে লেবার দলের এমপি রুশনারা আলিকে ঘিরে।
আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিকতা
ব্রিটিশ ভারতে বাঙালী মুসলমানের মধ্যে বঞ্চনাবোধ ছিলো বাঙালী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। কারণ, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ বাঙালী মুসলমানকে অস্পৃশ্য ‘যবন’ মনে করে বাঙালীত্বের পরিচয় থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছিলো, যা তৎকালীন সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।
হিন্দু সন্ত বিকেনান্দ স্পষ্ট বলেছেন, বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেছেনে আছে হিন্দু বর্ণবাদ। শতোশতো বছর ধরে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে হিন্দু বর্ণাশ্রমের অধীনে নিম্নবর্ণভূক্ত রেখে নিপীড়ন করার কারণে বাইরে থেকে আসা মুসলিম বিজয়ীদের দেওয়া ইসলামিক সাম্যের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা লাখে লাখে মুসলমান হয়েছিলেন। 
বস্তুতঃ হিন্দুত্ব ছেড়ে মুসলমান হলেও বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ বাস্তবে সেই মর্য্যাদা পাননি। তাই রূপান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে আদি হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ কাজ করে। কারণ, হিন্দুত্ব ছেড়ে গেলেও বর্ণহিন্দুর কাছে রূপান্তরিত মুসলিম অস্পৃশ্যই রয়ে গিয়েছিলো বা আছে।
সামন্ত স্থবির সমাজে মুষ্ঠিমেয় সম্পদশালী ও ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠের বিক্ষোভ নানা সময়ে নানাভাবে স্বল্পমাত্রায় প্রকাশিত হলেও, পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে-সাথে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রবর্তন ও বিকাশ হতে শুরু করলে, সেই নিম্নবর্গের শক্তি ও ক্ষোভের প্রকাশ পেতে শুরু করে। বাংলায় ব্রিটিশ শাসকদের প্রস্তাবিত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সেই সুযোগের সূচনা করে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কোলকাতায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম তরঙ্গ হিন্দুত্বাবাদী ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে শুরু হলে, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠন করে মুসলমানত্ববাদী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয়।
দীর্ঘ চার দশক ধরে বাঙালীর মধ্যে হিন্দু-পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলন ও মেরুকরণের ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙালী জাতি ও বাংলার স্থল-জল-অন্তরীক্ষ বিভক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয় বিভক্ত বাংলা ও বিভক্ত বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ড এবং পশ্চিম খণ্ড থাকে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হয়ে।
বিভক্তির প্রায় সাথে-সাথেই উভয় খণ্ডে শুরু হয় নতুন বঞ্চনাবোধ - এবং পূর্বখণ্ডে দ্রুত কিন্তু পশ্চিম খণ্ডে ধীরে (১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এবং পরে উত্তরাপথ তথা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে)। পূর্ববাংলায় বঞ্চনাবোধের সূচনা হলো বাংলাভাষা নিয়ে ১৯৪৮ সালে। সে-বছর পাকিস্তানের পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বললেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। আর এর প্রতিবাদে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপরই ‘না, না’ বলে প্রতিবাদের মুখর হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ।
পূর্ববাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালীর বঞ্চনাবোধ শতোরূপে প্রকাশ পেতে পেতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এলো তখন, যখন বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানের সাধারণ ও সাংবিধানিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা থেকে তাঁকে - তথা বাঙালীকে - বঞ্চিত করে গণহত্যা শুরু করলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে। এই পর্যায়ে বাঙালী মুসলমান উপলদ্ধি করলো, মুসলমানত্ব তার মৌলিক পরিচয় নয়। তার মৌলিক পরিচয় বাঙালীত্ব। আর এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই সে যুদ্ধ করে স্বাধীন করলো মাতৃভূমি এবং হয়ে উঠলো একটি স্বীকৃত জাতি।
কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিকশিত বাঙালী জাতিয়তাবদের  ঐতিহাসিক দ্বিতীয় তরঙ্গ বাঙালী জাতিকে মুসলিম পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত করলেও পাকিস্তান-পূর্ব অখণ্ড বাংলা ও বাঙালীত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পারলো না। ফলে, পূর্বখণ্ডের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশ’ রূপতঃ ইতিহাস ও ভূগোলের আয়নায় যখন পশ্চিমখণ্ডের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশ’ দেখে, তখন আত্মপরিচয়ের আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি হতে বাধ্য।
১৯৭১ সালের বাঙালী জাতীয়তবাদী আন্দোলনে যেহেতু এই প্রশ্নের উত্তর ছিলো না, কিংবা থাকলেও স্পষ্ট ছিলো না, তাই বাংলার ও বাঙালী জাতির খণ্ডতার জাষ্টিফিকেশনের জন্যে যুদ্ধে পরাজিত দ্বিজাতি তত্ত্বের নীরব পুনরুত্থান ঘটলো। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে পূর্বখণ্ডের বাঙালীর মুসলিম পরিচয়কে আন্তর্জাতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। পরিবর্তীতে জিয়াউর রহমান জাতির আত্মপরিচয়ের সঙ্কট মোচনের চেষ্টায় ‘বাঙালী’র বদলে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন।
কিন্তু দুই রহমানের প্রচেষ্টা বাঙালী জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে যায় বলে, সঙ্কট কাটেনি। তাই একাত্তরের সীমাবদ্ধতা কাটাতে সাতচল্লিশ, আর সাতচল্লিশের সীমাবদ্ধতা কাটাতে একাত্তরে শরণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের দোদুল্যতা অব্যাহত রয়েছে।
নির্বাচনে বাঙালী আত্মপরিচয়
ব্রিটেইন যখন পার্লামেণ্টারি নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে, তখন টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালী আত্মপরিচিতি ক্রিয়া করতে শুরু করেছে রুশনারা আলির সমর্থনে। কিন্তু এর মধ্যে বাঙালী বংশোদ্ভূত লুতফুর রহমানকে ইসলামবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে কারচুপি এবং ধর্ম ও বর্ণের খেলা খেলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার অভিযোগের পক্ষে রায় দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তাঁকে আগামী পাঁচ বছরের জন্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এষ্টাব্লিশমেণ্টের এই রায়ের পেছনে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে লুতফুর রহমানের দুই দু'বার বিজয়। লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ নিয়মে লুতফুর রহমান মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পরও তাঁর ইসলামবাদী-সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে তাঁর প্রার্থিতা তুলে নিলে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গণরায়ে বিজয়ী হন। দ্বিতীয়বারও তিনি বিজয়ী হন ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্ষ্ট’ নামে সংগঠন গঠন করে ব্রিটেইনের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসমূহের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ বাঙালী সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে।
লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এষ্টাবলিশমেণ্টের আঘাত ব্রিটেইনের বাঙালীর মধ্যে দ্বিধার তৈরি করেছে। সাতচল্লিশ-শিবির এটিকে মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসবে প্রচার করছে। আর, সে-কারণে একাত্তর শিবির স্বস্তিবোধ করছে।
একাত্তর শিবির রুশনারা আলিকে ঘিরেই তাঁদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন চায়। রুশনারা আলিও বাঙালীত্বের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। তিনি গতবারের নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে অধিক মাত্রায় বাঙালী।
রুশনারা আলি তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই ইসলামিক আইডেণ্টিক নিতে পারবেন না, যা লুৎফুর রহমান নিয়েছিলেন। কিন্তু লুতফুর রহমান যেহেতু বাঙালী আইডেণ্টিটিও ব্যবহার করেছিলেন, তাই লুতফুর রহমানকে রুশনারা আলির বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করার অনুরোধে রুশনারা আলির বাঙালী আইডেণ্টিটি কাজ করেছে। বাঙালী হয়ে বাঙালী এমপির প্রার্থিতার বিরোধিতা করলে লুৎফুর রহমানের বাঙালী আইডেণ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
কিন্তু ব্রিটিশ এষ্টাব্ললিশমেণ্টের হাতে লুতফুর রহমান ‘ভিক্টিম’ হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষিত হওয়ার কারণে, সাধারণভাবে বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তা রুশনারা আলির বিরুদ্ধে যেতে পারে ধারণা করে একাত্তর-শিবির। তাই, একাত্তর-শিবিরের পক্ষ থেকে লুতফুর রহামানকে সাতচল্লিশ-শিবিরের লোক হিসেবে দেখানো চেষ্টা চলছে। সহজ বাংলায় তাঁকে ‘রাজাকার’ও বলা হচ্ছে।
বাঙালী আত্মপরিচয়ের প্রায়োগিক প্রশ্ন
মে মাসের নির্বাচনকে সামনে রেখে এই যে বাঙালী আইডেণ্টির আবেদন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বাস্তব তাৎপর্য কী, তা নিয়েই কেউ প্রশ্ন করছেন না। একজন প্রার্থী বাঙালী বলেই বাঙালী সম্প্রদায়কে সম্প্রদায়গতভাবে ভৌট দিতে হবে, এমন আবেদন যৌক্তিক নয়। যাঁরা এই আবেদন নিয়ে ভৌটারদের কাছে যান, তাঁদের এই যাওয়াও নৈতিক নয়।
আমি মনে করি, ব্রিটেইনের বহুসাংস্কৃতিক সমাজে প্রতিটি এথনিক বা জনজাতিক গোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির চাওয়া শুধু ন্যায্য নয়, আবশ্যকও বটে। ডাইভার্সিটি বা বিভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়ে ও বিকাশ ঘটিয়ে সমন্বিত হওয়াই সভ্যতা ও মানবিকতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঈর্ষণীয় হলেও বাঙালীর ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সমাজের মূলস্রোত ধারায় স্থান করে নেওয়ার প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না।
লুতফুর রহমান থেকে শুরু করে রুশনারা আলি সকলেই বাঙালী আইডেণ্টিটি 'কার্ড' ব্যবহার করলেও বাস্তবে তাঁরা তেমন কোনো কাজই করেননি। কারণ, বাঙালী সম্প্রদায়ের লোকেরা নির্বাচনের প্রার্থীদের বাঙালী চেহারা দেখেই তৃপ্ত। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাঙালী নাম দেখেই তাঁরা সন্তুষ্ট। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রশাসনে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিফলন ঘটছে কিনা, না ঘটলে কীভাবে তা আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে ঘটানো যায়, সেদিকে তাদের কোনো আগ্রহ কিংবা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
২০১৭ সাল থেকে স্কুল-কলেইজে এ্যা-লেভেলের কারিক্যুলাম থেকে বাংলাভাষা প্রত্যাহার করা হবে বলে ফেব্রুয়ারীতে ঘোষণা এসেছে। বাংলার শিক্ষকগণ এনিয়ে তাঁদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে হলেও বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু বাঙালী রাজনীতিকদের কাছ থেকে কোন বজ্রকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না বাংলা পক্ষে।
এটি বলা অন্যায্য হবে না যে, প্রাক্তন মেয়র লুতফর রহমান ও তাঁর অনুসারীগণ যতোটুকু না বাঙালী, তার চেয়েও অধিক মুসলমান। তাঁদের সাতচল্লিশ-শিবিরভূক্তির কারণে, বাংলার প্রতি তাঁদের আগ্রহ কম। এটি স্পষ্ট।
কয়েক বছর আগে যখন ব্রিটেইনের নতুন ভাষানীতি প্রকাশিত হলো এবং প্রাইমারী পর্যায়ে একটি ইংরেজির অতিরিক্তি একটি দ্বিতীয় ভাষা শেখা আইন করা হলো, তখন কিছু শিক্ষক ও সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে সেমিনার করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন নিবেদন ও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন (সেই সেমিনার পেপারটি আমি পরবর্তীতে প্রকাশ করবো)।
কিন্তু আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোনো শিবিরই এতে ন্যুনতম আন্তরিকতা দেখাননি। একদল মনে করেন বাংলার চেয়ে ইউরোপীয় ভাষা শেখা উত্তম। আরেক দল বাংলার চেয়ে আরবি ভাষা শেখা কর্তব্য বলে মনে করেন। এদের উভয়ের কাছে বাংলা একটি অপাংক্তেয় ভাষা।
কিন্তু নির্বাচন এলে উভয় দলই বাঙালী আত্মপরিচয়ে বাঙালী সম্প্রদায়ের কাছে ভৌট চাইতে যান। বাংলা গণমাধ্যমগুলোও তারস্বরে ‘তিনি আমাদের বাঙালী’ বলে উচ্ছাস প্রকাশ করে। নির্বাচন শেষে বাংলাভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতি যে তিমির থাকে, সে তিমিরেই হারিয়ে যায় - অনেকটা একুশে ফেব্রুয়ারীতে তিন সপ্তাহ ব্যাপী রূপতঃ প্রাদুর্ভাবিত বাংলাপ্রীতি রোগের মতো।
আমি মনে করি, প্রার্থী বাঙালী কি না, তা ততো গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাঙালী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন। বাঙালী ভৌটারদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে অন্ততঃ ৫টি প্রশ্নঃ
(১) বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে আপনি কী করেছেন?
(২) বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে কী কর্মসূচি আছে আপনার?
(৩) প্রাইমারী স্কুলের শিশুরা যেনো বাংলা শিখতে পারে তা নিশ্চিত করতে আপনি কী করবেন?
(৪) ২০১৭ সালে যে এ্যা-লেভেল থেকে বাংলা তুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে, তার রোখার জন্য আপনি কী করবেন?
(৫) বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য নিয়ে চর্চা ও গবেষণার জন্যে একটি এ্যাকাডেমি বা ইনষ্টিটিউশন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কিনা, করলে এই প্রয়োজন মেটাতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
উপরের প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক জবাব ছাড়া কোনো প্রার্থীকেই শুধু বাঙালী হওয়ার কারণে ভৌট দেওয়া হবে জাতিসত্তায় জাগ্রত বাঙালীর জন্যে অর্থহীন। আমি মনে করি, উপরের প্রশ্নমালার ইতিবাচক উত্তর নিয়ে যদি কোনো অবাঙালীও নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আসেন, সকল বাঙালীর উচিত হবে সেই অবাঙালীকেই ভৌট দেওয়া। যে-রাজনীতিক চর্মে বাঙালী কর্মে নন, রাজনৈতিকভাবে তিনি বাঙালী নন।

শনিবার ২৫ এ্যাপ্রিল ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড

অসাম্প্রদায়িক চেতনাপ্রসগে-২______________________________মাসুদ রানা

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে (১)
মাসুদ রানা
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্মেলন
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ১৫ নাগরিক - বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী - উদ্যোগী হয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলন' অনুষ্ঠিত করেছেন আজ ঢাকায়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিডিনিউজ টুয়ান্টিফৌর জানাচ্ছে, এই সম্মেলন থেকে বুদ্ধিজীবীরা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক' দিয়েছেন। ডাক দেয়া হয়েছে দেশবাসীর প্রতি।
ডাক-দেয়া এই পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী হলেনঃ (১) সালাহউদ্দিন আহমেদ, (২) সরদার ফজলুল করিম, (৩) মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, (৪) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, (৫) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, (৬) সৈয়দ শামসুল হক, (৭) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, (৮) কাইয়ুম চৌধুরী, (৯) হামিদা হোসেন, (১০) আনিসুজ্জামান, (১১) কামাল লোহানী, (১২) রামেন্দু মজুমদার, (১৩) সেলিনা হোসেন, (১৪) সুলতানা কামাল ও (১৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' বহু-উচ্চারিত দু'টি শব্দবন্ধ। এ-দু'টি শব্দবন্ধের ‘এ্যাফেক্টিভ' বা আবেগিক আবেদন বিশাল হলেও এদের ‘কগনিটিভ' বা বোধিক অবয়ব অস্পষ্ট। ফলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ও ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' হচ্ছে অনির্দিষ্ট ও বিমূর্ত ধারণা, যা বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে বিকশিত আকাঙ্খাসমূহের নিতান্ত বায়বীয় উপস্থাপন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ সন্ধান
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী?' তাহলে, এর স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছেঃ ‘যে চেতনা সাম্প্রদায়িক নয়'। স্পষ্টতঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' কোনো স্ব-ব্যাখ্যাত ধারণা নয়। যেহেতু ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থ ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থের উপর নির্ভরশীল, তাই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ‘সাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ছাড়া সম্ভব নয়।
শব্দ হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক' স্বনির্ভর নয়। এটি ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের আগে তৎসম উপসর্গ ‘অ' যোগে গঠিত। এই শব্দের অর্থ এর ভিতরে নিহিত নয়। ফলে, ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দটি বলে না এটি কী; বরং বলে এটি কী নয়।
নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ, বুদ্ধিজীবীরা চাইছেন, শিশুদের চেতনা যেনো ‘সাম্প্রদায়িক' না হয়। উত্তম প্রস্তাব! ‘সাম্প্রদায়িক' নাই-বা হলো। কী হবে তাহলে? এর উত্তর আছে? অন্যত্র না হাতড়িয়ে প্রস্তাবিত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ভিতর কি এর উত্তর আছে?
‘সাম্প্রদায়িক' হিসেবে যে-সকল চেতনা চিহ্নিত করা যায়, তা বাদ দিয়ে যা থাকে, তার সবকিছুকেই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' রূপে নির্দেশ করা সম্ভব। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নেতিবাচক সংজ্ঞায়ণের এই হচ্ছে সমস্যা। সে-কারণে, বিজ্ঞানে ইতিবাচক বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞা ছাড়া অন্য কোনো রকম সংজ্ঞা গ্রহণীয় নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ‘বাঙালী' বলতে একটি বিশেষ জাতির মানুষ বুঝায়। কিন্তু ‘অবাঙালী' দ্বারা হাজার-হাজার জাতির মানুষ বুঝাতে পারে। সুতরাং, ‘তিনি অবাঙালী' কিংবা ‘ইনি অমুসলিম' বলে কোনো পরিচয় হতে পারে না। একইভাবে ‘আমি অসাম্প্রদায়িক' বললে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্দেশ করে না। স্পষ্টতঃ ‘নিগেটিভ কনস্ট্র্যাক্ট' বা নেতিবাচক ধারণা হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' অতি সহজেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। সুতরাং, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্ত নয়, একটি অকার্যকর ধারণাও বটে।
‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উৎস সন্ধান
এবার আলোকপাত করা যাক ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উপর। ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দটি বাংলার রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্সে' বা ভাষ্যে সরাসরি ইংরজি ‘কম্যুনাল' শব্দ থেকে এসেছে, যা শতাধিক বছর আগে খোদ ইংল্যাণ্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্রিটিশ ঔনিবেশিক কালে ভারতে প্রবর্তিত হয়েছিলো।
ইংরেজি ভাষায় ‘কম্যুনাল' শব্দের উৎপত্তি কাল ‘অক্সফৌর্ড ডিকশনারী'তে দেখানো হয়েছে ঊনিশ শতক। ‘কম্যুনাল' শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ‘কমিউন' থেকে। বলা হয়েছে, এই ‘কমিউন' হচ্ছে সেই ‘কমিউন' যা ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্যারি কমিউন' নামে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, প্যারি কমিউন ছিলো ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত বেঁচে থাকা পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, ‘কমিউন' শব্দের মধ্যে সাম্যবাদী উপাদান আছে।
তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ১নং অর্থ হচ্ছে ‘shared by all members of a community; for common use' অর্থাৎ, ‘কমিউনিটির সকল সদস্যের অংশীদারিত্বে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য'। সেই কারণেই, ইংল্যাণ্ডে ‘কম্যুনাল' একটি ইতিবাচক ধারণা।
বিশ্বজুড়ে নানা দেশে ‘কম্যুনাল চাইল্ড রীয়ারিং' (শিশুপালন), ‘কম্যুনাল এডুকেশন' (শিক্ষা), ‘কম্যুনাল হাউজিং (আবাসান)' ‘কম্যুনাল লিভিং' (বসবাস), ‘কম্যুনাল কুকিং (রান্না)' ‘কম্যুনাল ঈটিং' (ভোজন) ‘কম্যুনাল স্লীপিং' (নিদ্রা), ‘কম্যুনাল পার্কিং' (গাড়ী রাখা), ‘কম্যুনাল সেইফটি' (নিরাপত্তা), ইত্যাদি ‘প্র্যাক্টিস' বা চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
‘কম্যুনাল' শব্দের এতো ইতিবাচক ব্যবহার দেখে হয়তো ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার' বাঙালীরা হতাশ হবেন। কিন্তু তাঁদের নিরাশ হবার কারণ নেই - অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় একটি অর্থ আছে, যেটির ব্যবহার ইংল্যাণ্ডে হয় না বললেই চলে। ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থটির উদ্ভব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্স' বা ভাষ্য থেকে।
অভিন্ন ভারতীয় জাতীয় পরিচয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে, প্রাদেশিক পরিচয়ে কিংবা ভাষিক পরিচয়ে বিভক্তিমূলক ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন, কর্মসূচি ও তৎপরতার ‘নিগেটিভ ব্র্যাণ্ডিং' বা নেতিবাচক চিহ্নায়ণে ‘কম্যুনাল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ২ নং অর্থ নির্দেশ করে বলা হয়েছে ‘ (of conflict) between different communities, especially those having different religions or ethnic origins' - অর্থাৎ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সংঘাত বিষয়ক - বিশেষ করে যাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ও জনজাতিক ভিন্নতা। এই ঐতিহাসিক কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক শব্দ।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় অর্থে ‘কম্যুনাল' বা ‘সাম্প্রদায়িক' হতে হলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রয়োজন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বাস অনেক দিনের। কিন্তু ‘কম্যুনাল' শব্দ তখনই রাজনৈতিক ভাষ্যে এসেছে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর সাথে সংখ্যালঘু মুসলমান ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে।
যেহেতু ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক বিশেষণ, তাই কেউই নিজেকে ‘কম্যুনাল' হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এটি হচ্ছে বিপরীত সম্প্রদায়ের দ্বারা আরোপিত ‘স্টিগমা' বা কালিমা, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পারস্পরিক ‘ন্যারেশন' বা বর্ণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও তাদের আপেক্ষিক শক্তির উপর নির্ভর করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দূর্বলের চেয়ে প্রবলের বর্ণনই বেশি প্রতিষ্ঠা পায়।
সুতরাং, এই কালিমা যেভাবে সংখ্যালঘুর গায়ে সেঁটে বসে, সংখ্যাগুরুর গায়ে ততো নয়। ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রাজনীতির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকাতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। আর এ-দুটি ধারার শাব্দিক প্রতীকায়ণ ঘটেছিলো যথাক্রমে ‘বন্দে মাতরম' ও ‘আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দ্বারা। তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের গায়ে কালিমা লেগেছে বেশি, কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে তেমন লাগেইনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা
‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দল নির্দেশ করতে গেলে, সংজ্ঞানুসারে প্রথমেই নির্দেশ করতে হবে কোন্‌ সম্প্রদায়ের সাথে কোন্‌ সম্প্রাদায়ের রাজনৈতিক সংঘাত হচ্ছে। জাতীয় পরিধিতে এদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ ব্রিটিশ ঔপনেবিশিক আমলে। এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ভিত্তি ছিলো ধর্ম।
পাকিস্তান সৃষ্টির কালে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হয়েছে, তাতে হিন্দুরা পরাস্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আর কখনও ১৯৪৭-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা দিন-দিন আরও প্রান্তিক হচ্ছে। সম্প্রদায়গত ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবৃত্ত হবার মতো জনের ও মনের শক্তি এঁদের নেই।
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ বাঙালীর সাথে বিহারীর। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, কারণ বিহারী সম্প্রদায়ও ছিলো মুসলমান। বাঙালী-বিহারী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভিত্তি ছিলো তাঁদের জনজাতিক ভিন্নতা। বিহারী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও এঁদের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষপাত ছিলো। তাই, বিহারী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালী নিধনে ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিহারী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিধন করা হয়েছে, একটি অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছে, আর অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশ প্রান্তিক হয়ে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে প্রধানতঃ পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র-সমর্থিত বাঙালীর সাথে পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলোর। এর মধ্যে জনজাতিক ও ধর্মীয়, এই দুটো উপাদনই বর্তমান, যদিও প্রথমটিই প্রধান। তবে এই সংঘাত ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত নয়। কারণ, পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলো জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে বাঙালীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নয়।
পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঘিরে বাঙালীর সাথে পাহাড়ীদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, যার স্রষ্টা হচ্ছে রহমানবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাহাড়ীদের নায্য দাবি অগ্রাহ্য করে তাঁদেরকে ‘বাঙালী হয়ে' যেতে বললেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে বাঙালী অভিবাসনের সূচনা করলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। পরবর্তী সরকারগুলো সেই নীতিই অনুসরণ করে আসছে, যদিও মাঝখানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি অকার্যকর পার্ব্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলনের যে বিবরণ সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা পাঠের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে এই মুহূর্তের জনজাতিক সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ব্যাপারে বোধ ও বুদ্ধি গড়ে তোলার পরিবর্তে অতীতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্মৃতি রোমন্থন করে একটি বিমূর্ত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কথা বললেন, এর মধ্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী মানুষের উপর চালিত রহমানবাদী সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ‘এথনিক ক্লিনসিং' বা জনজাতিক নিশ্চিহ্নায়ণের বিরুদ্ধে কোনো বোধ কি প্রতিফলিত হয়েছে? পাঠ থেকে বলছিঃ না, হয়নি। সুতরাং বুদ্ধিজীবীদের ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্তই নয় কপটও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী অসাম্প্রদায়িক?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘অসাম্প্রদায়িক' ছিলো বলে বিষয়টিকে ছোটো করা হয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে সঠিক বোধ থেকে এ-কথা বলা সম্ভব নয়। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে ‘প্রিন্সিপল অফ ইনভেলিডেশন এ্যাণ্ড জাস্টিফিকেশন' - অর্থাৎ বাতিলায়ণ ও ন্যায্যায়ণ নীতির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া বুঝা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘আণ্ডারপিনিং' বা টিকিয়ে রাখার সমর্থনে ক্রিয়াশীল থাকে একটি আদর্শবাদ। প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় তার পক্ষের আদর্শবাদটির ‘ইনভেলিডেশন' বা বাতিলায়ণ। কিন্তু এই বাতিলায়ণ সম্ভব হয় না, যদি-না একটি বিকল্প প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ‘জাস্টিফিকেশন' বা ন্যায্যায়ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলায়ণের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিলো না।
আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতার বাতিলায়ণ। বাঙালীকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে - অর্থাৎ, ধর্মবাদের উপর -আঘাত করতে হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিলো কি-না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জনজাতিক পরিচয়ের ন্যায্যতাদায়ী যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালী পাকিস্তান গড়েছিলো, তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিলো অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব ছিলো না।
আজ যাঁরা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‘অসাম্প্রদায়িক' বলে চিহ্নিত করছেন, তাঁরা বুঝে কিংবা না বুঝে ইতিহাস বিকৃত করছেন। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো বলেই যুদ্ধ-বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূল-নীতির দ্বিতীয়টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রথম আঘাত হানেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যেখানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্তিকরণ বুঝায়, সেখানে তিনি বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়'। এই কথা বলে তিনি রাষ্ট্রীয় আচারে-অনুষ্ঠানে ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রবর্তন করলেন কুরআন-পাঠ, গীতি-পাঠ, ত্রিপিটক-পাঠ, বাইবেল-পাঠ ইত্যাদির বহু-ধর্মবাদী চর্চা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে ও ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির চরম লঙ্ঘন করলেন। কোথায়? সে-ও আবার পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই কর্মটি বাঙালী জাতির জন্য গৌরবের ছিলো না।
শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ১৯৭১ সালের ধর্মবাদী দালালদের ‘সাধারণ ক্ষমা'ই করেননি, তিনি অনুমোদন দেন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠার, যার মধ্য দিয়েই সদ্য স্বাধীন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলামবাদীরা নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে।
একনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর পূর্বসূরী একনায়ক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আরও এক কদম এগিয়ে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি হত্যা করলেন সংবিধান থেকে শব্দটিকে প্রত্যাহার করে এবং কুরআনের পংক্তি যুক্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় একনায়ক হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এসে রহমানবাদের হাতে আহত ও নিহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দিলেন ইসলামকে ‘রাষ্ট্র-ধর্ম' ঘোষণার মাধ্যমে।
এরশাদ-পরবর্তী শাসক খালেদা জিয়া এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সেই উত্তরাধিকারের সংরক্ষা করলেন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসার ও থাকার তাগিদে শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সেখান থেকে কু্রআনের পংক্তি ও ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম করার ঘোষণা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করতে পারলেন না। তিনি বরং এখন শারিয়া আইন প্রবর্তনের অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দ নেই। তার বদলে এসেছে ‘অসাম্প্রদায়িক' ধারণা। আওয়ামী লীগের অনুসারী বাম ও অভিসারী বামেরা পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি তেমন আর ব্যবহার করছেন না। তাঁরা বলছেন ‘অসাম্প্রদায়িকতা'র কথা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তোলার কথা বলছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূর্ত-নির্দিষ্ট রূপে ধারণ করেন না। তাহলে কেনো তারা এই চেতনার কথা বলছেন, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পরবর্তী পর্বে দেখানো হবে।
রোববার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com
 

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে-১------------------------------ মাসুদ রানা

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে (১)
মাসুদ রানা
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্মেলন
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ১৫ নাগরিক - বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী - উদ্যোগী হয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলন' অনুষ্ঠিত করেছেন আজ ঢাকায়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিডিনিউজ টুয়ান্টিফৌর জানাচ্ছে, এই সম্মেলন থেকে বুদ্ধিজীবীরা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক' দিয়েছেন। ডাক দেয়া হয়েছে দেশবাসীর প্রতি।
ডাক-দেয়া এই পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী হলেনঃ (১) সালাহউদ্দিন আহমেদ, (২) সরদার ফজলুল করিম, (৩) মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, (৪) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, (৫) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, (৬) সৈয়দ শামসুল হক, (৭) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, (৮) কাইয়ুম চৌধুরী, (৯) হামিদা হোসেন, (১০) আনিসুজ্জামান, (১১) কামাল লোহানী, (১২) রামেন্দু মজুমদার, (১৩) সেলিনা হোসেন, (১৪) সুলতানা কামাল ও (১৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' বহু-উচ্চারিত দু'টি শব্দবন্ধ। এ-দু'টি শব্দবন্ধের ‘এ্যাফেক্টিভ' বা আবেগিক আবেদন বিশাল হলেও এদের ‘কগনিটিভ' বা বোধিক অবয়ব অস্পষ্ট। ফলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ও ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' হচ্ছে অনির্দিষ্ট ও বিমূর্ত ধারণা, যা বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে বিকশিত আকাঙ্খাসমূহের নিতান্ত বায়বীয় উপস্থাপন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ সন্ধান
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী?' তাহলে, এর স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছেঃ ‘যে চেতনা সাম্প্রদায়িক নয়'। স্পষ্টতঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' কোনো স্ব-ব্যাখ্যাত ধারণা নয়। যেহেতু ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থ ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থের উপর নির্ভরশীল, তাই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ‘সাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ছাড়া সম্ভব নয়।
শব্দ হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক' স্বনির্ভর নয়। এটি ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের আগে তৎসম উপসর্গ ‘অ' যোগে গঠিত। এই শব্দের অর্থ এর ভিতরে নিহিত নয়। ফলে, ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দটি বলে না এটি কী; বরং বলে এটি কী নয়।
নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ, বুদ্ধিজীবীরা চাইছেন, শিশুদের চেতনা যেনো ‘সাম্প্রদায়িক' না হয়। উত্তম প্রস্তাব! ‘সাম্প্রদায়িক' নাই-বা হলো। কী হবে তাহলে? এর উত্তর আছে? অন্যত্র না হাতড়িয়ে প্রস্তাবিত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ভিতর কি এর উত্তর আছে?
‘সাম্প্রদায়িক' হিসেবে যে-সকল চেতনা চিহ্নিত করা যায়, তা বাদ দিয়ে যা থাকে, তার সবকিছুকেই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' রূপে নির্দেশ করা সম্ভব। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নেতিবাচক সংজ্ঞায়ণের এই হচ্ছে সমস্যা। সে-কারণে, বিজ্ঞানে ইতিবাচক বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞা ছাড়া অন্য কোনো রকম সংজ্ঞা গ্রহণীয় নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ‘বাঙালী' বলতে একটি বিশেষ জাতির মানুষ বুঝায়। কিন্তু ‘অবাঙালী' দ্বারা হাজার-হাজার জাতির মানুষ বুঝাতে পারে। সুতরাং, ‘তিনি অবাঙালী' কিংবা ‘ইনি অমুসলিম' বলে কোনো পরিচয় হতে পারে না। একইভাবে ‘আমি অসাম্প্রদায়িক' বললে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্দেশ করে না। স্পষ্টতঃ ‘নিগেটিভ কনস্ট্র্যাক্ট' বা নেতিবাচক ধারণা হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' অতি সহজেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। সুতরাং, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্ত নয়, একটি অকার্যকর ধারণাও বটে।
‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উৎস সন্ধান
এবার আলোকপাত করা যাক ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উপর। ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দটি বাংলার রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্সে' বা ভাষ্যে সরাসরি ইংরজি ‘কম্যুনাল' শব্দ থেকে এসেছে, যা শতাধিক বছর আগে খোদ ইংল্যাণ্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্রিটিশ ঔনিবেশিক কালে ভারতে প্রবর্তিত হয়েছিলো।
ইংরেজি ভাষায় ‘কম্যুনাল' শব্দের উৎপত্তি কাল ‘অক্সফৌর্ড ডিকশনারী'তে দেখানো হয়েছে ঊনিশ শতক। ‘কম্যুনাল' শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ‘কমিউন' থেকে। বলা হয়েছে, এই ‘কমিউন' হচ্ছে সেই ‘কমিউন' যা ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্যারি কমিউন' নামে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, প্যারি কমিউন ছিলো ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত বেঁচে থাকা পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, ‘কমিউন' শব্দের মধ্যে সাম্যবাদী উপাদান আছে।
তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ১নং অর্থ হচ্ছে ‘shared by all members of a community; for common use' অর্থাৎ, ‘কমিউনিটির সকল সদস্যের অংশীদারিত্বে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য'। সেই কারণেই, ইংল্যাণ্ডে ‘কম্যুনাল' একটি ইতিবাচক ধারণা।
বিশ্বজুড়ে নানা দেশে ‘কম্যুনাল চাইল্ড রীয়ারিং' (শিশুপালন), ‘কম্যুনাল এডুকেশন' (শিক্ষা), ‘কম্যুনাল হাউজিং (আবাসান)' ‘কম্যুনাল লিভিং' (বসবাস), ‘কম্যুনাল কুকিং (রান্না)' ‘কম্যুনাল ঈটিং' (ভোজন) ‘কম্যুনাল স্লীপিং' (নিদ্রা), ‘কম্যুনাল পার্কিং' (গাড়ী রাখা), ‘কম্যুনাল সেইফটি' (নিরাপত্তা), ইত্যাদি ‘প্র্যাক্টিস' বা চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
‘কম্যুনাল' শব্দের এতো ইতিবাচক ব্যবহার দেখে হয়তো ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার' বাঙালীরা হতাশ হবেন। কিন্তু তাঁদের নিরাশ হবার কারণ নেই - অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় একটি অর্থ আছে, যেটির ব্যবহার ইংল্যাণ্ডে হয় না বললেই চলে। ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থটির উদ্ভব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্স' বা ভাষ্য থেকে।
অভিন্ন ভারতীয় জাতীয় পরিচয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে, প্রাদেশিক পরিচয়ে কিংবা ভাষিক পরিচয়ে বিভক্তিমূলক ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন, কর্মসূচি ও তৎপরতার ‘নিগেটিভ ব্র্যাণ্ডিং' বা নেতিবাচক চিহ্নায়ণে ‘কম্যুনাল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ২ নং অর্থ নির্দেশ করে বলা হয়েছে ‘ (of conflict) between different communities, especially those having different religions or ethnic origins' - অর্থাৎ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সংঘাত বিষয়ক - বিশেষ করে যাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ও জনজাতিক ভিন্নতা। এই ঐতিহাসিক কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক শব্দ।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় অর্থে ‘কম্যুনাল' বা ‘সাম্প্রদায়িক' হতে হলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রয়োজন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বাস অনেক দিনের। কিন্তু ‘কম্যুনাল' শব্দ তখনই রাজনৈতিক ভাষ্যে এসেছে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর সাথে সংখ্যালঘু মুসলমান ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে।
যেহেতু ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক বিশেষণ, তাই কেউই নিজেকে ‘কম্যুনাল' হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এটি হচ্ছে বিপরীত সম্প্রদায়ের দ্বারা আরোপিত ‘স্টিগমা' বা কালিমা, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পারস্পরিক ‘ন্যারেশন' বা বর্ণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও তাদের আপেক্ষিক শক্তির উপর নির্ভর করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দূর্বলের চেয়ে প্রবলের বর্ণনই বেশি প্রতিষ্ঠা পায়।
সুতরাং, এই কালিমা যেভাবে সংখ্যালঘুর গায়ে সেঁটে বসে, সংখ্যাগুরুর গায়ে ততো নয়। ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রাজনীতির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকাতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। আর এ-দুটি ধারার শাব্দিক প্রতীকায়ণ ঘটেছিলো যথাক্রমে ‘বন্দে মাতরম' ও ‘আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দ্বারা। তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের গায়ে কালিমা লেগেছে বেশি, কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে তেমন লাগেইনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা
‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দল নির্দেশ করতে গেলে, সংজ্ঞানুসারে প্রথমেই নির্দেশ করতে হবে কোন্‌ সম্প্রদায়ের সাথে কোন্‌ সম্প্রাদায়ের রাজনৈতিক সংঘাত হচ্ছে। জাতীয় পরিধিতে এদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ ব্রিটিশ ঔপনেবিশিক আমলে। এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ভিত্তি ছিলো ধর্ম।
পাকিস্তান সৃষ্টির কালে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হয়েছে, তাতে হিন্দুরা পরাস্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আর কখনও ১৯৪৭-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা দিন-দিন আরও প্রান্তিক হচ্ছে। সম্প্রদায়গত ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবৃত্ত হবার মতো জনের ও মনের শক্তি এঁদের নেই।
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ বাঙালীর সাথে বিহারীর। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, কারণ বিহারী সম্প্রদায়ও ছিলো মুসলমান। বাঙালী-বিহারী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভিত্তি ছিলো তাঁদের জনজাতিক ভিন্নতা। বিহারী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও এঁদের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষপাত ছিলো। তাই, বিহারী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালী নিধনে ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিহারী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিধন করা হয়েছে, একটি অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছে, আর অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশ প্রান্তিক হয়ে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে প্রধানতঃ পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র-সমর্থিত বাঙালীর সাথে পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলোর। এর মধ্যে জনজাতিক ও ধর্মীয়, এই দুটো উপাদনই বর্তমান, যদিও প্রথমটিই প্রধান। তবে এই সংঘাত ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত নয়। কারণ, পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলো জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে বাঙালীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নয়।
পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঘিরে বাঙালীর সাথে পাহাড়ীদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, যার স্রষ্টা হচ্ছে রহমানবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাহাড়ীদের নায্য দাবি অগ্রাহ্য করে তাঁদেরকে ‘বাঙালী হয়ে' যেতে বললেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে বাঙালী অভিবাসনের সূচনা করলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। পরবর্তী সরকারগুলো সেই নীতিই অনুসরণ করে আসছে, যদিও মাঝখানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি অকার্যকর পার্ব্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলনের যে বিবরণ সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা পাঠের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে এই মুহূর্তের জনজাতিক সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ব্যাপারে বোধ ও বুদ্ধি গড়ে তোলার পরিবর্তে অতীতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্মৃতি রোমন্থন করে একটি বিমূর্ত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কথা বললেন, এর মধ্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী মানুষের উপর চালিত রহমানবাদী সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ‘এথনিক ক্লিনসিং' বা জনজাতিক নিশ্চিহ্নায়ণের বিরুদ্ধে কোনো বোধ কি প্রতিফলিত হয়েছে? পাঠ থেকে বলছিঃ না, হয়নি। সুতরাং বুদ্ধিজীবীদের ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্তই নয় কপটও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী অসাম্প্রদায়িক?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘অসাম্প্রদায়িক' ছিলো বলে বিষয়টিকে ছোটো করা হয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে সঠিক বোধ থেকে এ-কথা বলা সম্ভব নয়। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে ‘প্রিন্সিপল অফ ইনভেলিডেশন এ্যাণ্ড জাস্টিফিকেশন' - অর্থাৎ বাতিলায়ণ ও ন্যায্যায়ণ নীতির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া বুঝা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘আণ্ডারপিনিং' বা টিকিয়ে রাখার সমর্থনে ক্রিয়াশীল থাকে একটি আদর্শবাদ। প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় তার পক্ষের আদর্শবাদটির ‘ইনভেলিডেশন' বা বাতিলায়ণ। কিন্তু এই বাতিলায়ণ সম্ভব হয় না, যদি-না একটি বিকল্প প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ‘জাস্টিফিকেশন' বা ন্যায্যায়ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলায়ণের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিলো না।
আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতার বাতিলায়ণ। বাঙালীকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে - অর্থাৎ, ধর্মবাদের উপর -আঘাত করতে হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিলো কি-না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জনজাতিক পরিচয়ের ন্যায্যতাদায়ী যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালী পাকিস্তান গড়েছিলো, তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিলো অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব ছিলো না।
আজ যাঁরা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‘অসাম্প্রদায়িক' বলে চিহ্নিত করছেন, তাঁরা বুঝে কিংবা না বুঝে ইতিহাস বিকৃত করছেন। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো বলেই যুদ্ধ-বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূল-নীতির দ্বিতীয়টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রথম আঘাত হানেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যেখানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্তিকরণ বুঝায়, সেখানে তিনি বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়'। এই কথা বলে তিনি রাষ্ট্রীয় আচারে-অনুষ্ঠানে ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রবর্তন করলেন কুরআন-পাঠ, গীতি-পাঠ, ত্রিপিটক-পাঠ, বাইবেল-পাঠ ইত্যাদির বহু-ধর্মবাদী চর্চা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে ও ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির চরম লঙ্ঘন করলেন। কোথায়? সে-ও আবার পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই কর্মটি বাঙালী জাতির জন্য গৌরবের ছিলো না।
শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ১৯৭১ সালের ধর্মবাদী দালালদের ‘সাধারণ ক্ষমা'ই করেননি, তিনি অনুমোদন দেন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠার, যার মধ্য দিয়েই সদ্য স্বাধীন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলামবাদীরা নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে।
একনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর পূর্বসূরী একনায়ক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আরও এক কদম এগিয়ে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি হত্যা করলেন সংবিধান থেকে শব্দটিকে প্রত্যাহার করে এবং কুরআনের পংক্তি যুক্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় একনায়ক হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এসে রহমানবাদের হাতে আহত ও নিহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দিলেন ইসলামকে ‘রাষ্ট্র-ধর্ম' ঘোষণার মাধ্যমে।
এরশাদ-পরবর্তী শাসক খালেদা জিয়া এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সেই উত্তরাধিকারের সংরক্ষা করলেন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসার ও থাকার তাগিদে শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সেখান থেকে কু্রআনের পংক্তি ও ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম করার ঘোষণা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করতে পারলেন না। তিনি বরং এখন শারিয়া আইন প্রবর্তনের অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দ নেই। তার বদলে এসেছে ‘অসাম্প্রদায়িক' ধারণা। আওয়ামী লীগের অনুসারী বাম ও অভিসারী বামেরা পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি তেমন আর ব্যবহার করছেন না। তাঁরা বলছেন ‘অসাম্প্রদায়িকতা'র কথা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তোলার কথা বলছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূর্ত-নির্দিষ্ট রূপে ধারণ করেন না। তাহলে কেনো তারা এই চেতনার কথা বলছেন, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পরবর্তী পর্বে দেখানো হবে।
রোববার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com
 

Friday 11 November 2016

হামলার প্রতিক্রিয়া - নির্মলেন্দু গুণ,জাকির তালুকদার,সাখাওয়ত টিপু ও স্বকৃত নোমান

হামলার প্রতিক্রিয়া : সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক

০৬ নভেম্বর ২০১৬, ২৩:৪২
ফিচার ডেস্ক
গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ১৫টি মন্দির ও সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি আপলোডকে কেন্দ্র করে এই হামলা চালানো হয়। এর কদিনের মাথায় নতুন করে ১১টি বাড়িতে গভীর রাতে দেওয়া হয় আগুন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন দেশের প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও তরুণ লেখকরা। তাঁদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া নিচে দেওয়া হলো।
নির্মলেন্দু গুণ
কবি
পাকবাহিনীও তাদের স্থানীয় দোসরদের অত্যাচারে জন্মভূমিতে টিকতে না পেরে, ১৯৭১ সালে তো আমরা মালাউনরা ভারতেই চলে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম- কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, কিছুটা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য।
ভারত আমাদের খুব বেশিদিন থাকতে দিল না। নয় মাসের মাথায়, ১৬ ডিসম্বরে পাকি মুচুয়ার দল মিত্রবাহিনীর কাছে ( মতান্তরে ভারতের কাছে) রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে বসল।
আর সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থী শিবিরগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভারত ভদ্রভাবে আমাদের সদ্যোজাত বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিল। মানে push back করল।
সবাই যে ধাক্কা খাইয়া দেশত ফিইরা আইল, তা কিন্তু না। অনেকেই আমার মতো, আপনের মতো মহানন্দে নাচতে নাচতে ফিইরা আইল তার সাত পুরুষ ( মতান্তরে সাতশ' পুরুষ)-এর জন্মভিটায়।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগও অন্তত মুখে মানা করল না। বলল- ‘আয়, আয়। ভোটের সুময় তোরারে কামে লাগব। তয় দেহিস আবার ইলেকশনে দাঁড়াইচ না কুনু। তোরা দরকার পড়লে ভোট দিবি, আর মাঝেমইধ্যে আমলীগের পক্ষে মিছিল করবি, কবিতা, গান, নাটক এসব লেখবি। আয়। আইয়া পড়।’
আমরা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’তে হাসতে হাসতে, লাফাইতে লাফাইতে ফিইরা আইলাম।
এর পরের কাহিনী, যে কাহিনীর শেষ নাই, তা আপনে বলেন। আমারে একটু লুকায়া-লুকায়া কাঁদতে দেন।
আমি চাই না কবির চোখের জল সাধারণ মানুষে দেখুক।
আমাকে স্মরণ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জাকির তালুকদার
কথা সাহিত্যিক
নাসিরনগরের ঘটনা এই দেশে প্রথম নয়। আবার এটাই যে শেষ ঘটনা হবে, এমনটি মনে করা সবচাইতে নির্বোধ আশাবাদীর পক্ষেও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই রকম অপঘটনা ঘটে চলেছে বহুদিন ধরে।
কিন্তু এসব বন্ধ হয় না কেন?
বন্ধ হয় না, কারণ আমাদের অপরাজনীতি এবং লুটপাটের অর্থনীতি এসব ঘটনার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। আর ‘এই দেশের সাধারণ মানুষ পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক’- এই দাবি নিয়ে আমরা যতই গলা ফাটিয়ে চেঁচাই না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রক্রিয়ার দীর্ঘ সক্রিয়তা আমাদের সাধারণ মানুষের মননকেও বিষাক্ত করে তুলেছে।
গণতন্ত্র বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা না জেনেই আমরা গণতন্ত্রের নামে দেশের সবকিছুকে তুলে দিয়েছি কিছু রাজনীতিবিদের হাতে। আর চোখের সামনে তো দেখতেই পাচ্ছি যে, ক্ষমতা-সংশ্লিষ্ট শাসক দলগুলোর রাজনীতিতে ন্যূনতম রুচিশীলতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, মানবিকতার বিন্দুমাত্র জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। যে মানুষগুলো রাজনীতিকে মানবকল্যাণের সাথে এক করে দেখতে অভ্যস্ত, তারা হয় এসব দল থেকে অপসারিত, অথবা কোণঠাসা।
সাহিত্য-সংস্কৃতি যে মানুষের মনে শুভবোধ সৃষ্টি করবে, তারও কোনো অবকাশ নেই। কারণ সত্যিকারের সাহিত্য এবং সংস্কৃতি যাতে মানুষের কাছে পৌঁছুতে না পারে, তার সার্বিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র সম্পন্ন করেছে।
তাই আমাদের পক্ষ থেকে শুধু ঘৃণা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। বরং জনপ্রতিরোধের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার কাজটি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সাখাওয়াত টিপু                
কবি
সম্প্রতি নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নিন্দনীয়। আগেও রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম হামলা হয়েছে। বাংলাদেশ বহু জাতিগোষ্ঠী আর বহুভাষিক জনগণের রাষ্ট্র। সর্ব ধর্মের মানুষের রাষ্ট্র বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্ব ধর্মের মানুষের অধিকারের কথা বলা আছে। তারপরও কেন সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো ঘটছে? নানাবিধ কারণ থাকলে কিছু সংকটকে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকা। দলীয় লুটপাততন্ত্র আর ক্ষমতাকেন্দ্রীক সুবিধাবাদীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, দেশে সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রায়ণ নেই। অন্তত বুর্জোয়া গণতন্ত্র ব্যক্তি-মানুষের বিকাশের মূল্যবোধকে আমলে নেয়। সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে তার সামাজিক পরাগায়ন ঘটে। এই পরাগায়নে মানুষের প্রতি মানুষের দায়বোধ প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে এই সাংস্কৃতিক সংকট জায়মান।
তৃতীয়ত, নাগরিক অধিকার ভুলণ্ঠিত করে অন্যের সম্পদ আর জমি জবরদস্তি করে ভোগ-দখলের লালসা। ফলে নির্বাচনী ক্ষমতা বদলের রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িক চেহারা প্রকাশ্য হয়। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা, বিচার আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা তো গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। সব বর্ণ, সম্প্রদায় আর ভাষিক জনগোষ্ঠীর অধিকারও তাই। দুর্বলের ওপর হামলা-নির্যাতন-লুটপাট করে সবলেরাও সুখে থাকতে পারে না। তাই প্রয়োজন সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সবার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
স্বকৃত নোমান
কথাসাহিত্যিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এই বাণীটি কি শুধুই যুদ্ধকালের জন্য প্রযোজ্য ছিল? নাকি চিরকালের জন্য? মনে তো হয় না বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে তাঁর এই বাণীর কোনো গুরুত্ব আছে। ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের যে ঘটনাটি ঘটল তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যে ছেলেটি ইসলামের ‘অবমাননা’ করেছে তাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি অপরাধী হলে আইন মোতাবেক তাঁর বিচার হবে। কিন্তু তাঁর একার ‘অপরাধের’ জন্য এতগুলো বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা কেন? ঘটনার বিচার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে এই হামলা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ক্ষমতাসীন দলের অনেকে এর সঙ্গে জড়িত। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধগোষ্ঠী।
আমাদের মনে রাখা দরকার, এই দেশ শুধু মুসলমানের না। কখনো ছিল না। এই দেশ বহু জাতিগোষ্ঠীর। কতিপয় ধর্মোন্মাদ এই সত্যটি স্বীকার করতে চায় না। আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে এদের। স্বীকার করতে যাতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তারা কাণ্ডজ্ঞানহীন। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়, সরকারকে সেই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই বহু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কীভাবে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা যায়, অবশ্যই সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

সময়ের গভীর অসুখ---------- সাক্ষাৎকার স্বকৃত নোমানের

সাম্প্রদায়িকতার গভীর অসুখ নিয়ে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের সঙ্গে আলাপ : যে লেখক বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ, আমি তাকে লেখক মনে করি না।

সাম্প্রদায়িকতা আমাদের এই ভূখণ্ডের গভীর অসুখ। এ অসুখ একই সঙ্গে মর্মঘাতী ও প্রাণঘাতী। এর কোনো নিরাময় এখনো পর্যন্ত মেলেনি। অদূরভবিষ্যতে মিলতে পারে বলেও কোনো আশা দেখা যায় না।
এই অসুখের কবলে পড়ে ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন। দেশ ছেড়েছেন। নিঃশ্ব হয়েছেন। সমষ্টিগত বিষাদ বহন করতে হচ্ছে বংশ পরম্পরায়।

এর নিদান হিসেবে ধর্ম-সম্পদায় অনুসারে দেশভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অসুখ সারার লক্ষ্মণ দেখা যায়নি। ১৯৫০, ১৯৫৪ , ১৯৬৪ সালে রক্তক্ষয়ী হামলা ঘটেছে ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে।

অসাম্প্রদায়িক দেশ  নির্মাণ করার আকাঙ্ক্ষায় বাংলার পূর্ব ভূখণ্ডে ৩০ লক্ষ মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ১৯৯২, ২০০১, ২০১৪, ২০১৬ সালে পুরনো কৌশলে সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল হেনেছে।
এই মর্মভেদী বিষয়গুলো নিয়ে গল্পপাঠের প্রকাশক মৌসুমী কাদের কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। আলাপে অংশ নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান।  নিচে সেই আলাপগুলো পত্রস্থ হলো--

প্রশ্ন  ১. মৌসুমী কাদের : 
ইদানীং ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ বিষয়টি নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে । সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ‘মানুষ’ আদৌ আছে কি? একজন লেখক কতটা অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন?



১. স্বকৃত নোমান : 
সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষ নিশ্চয়ই আছে। আমি তো প্রায়ই ঘুরে বেড়াই। সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক মানুষের সন্ধান করে বেড়াই। হাটে মাঠে ঘাটে এমন অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, যারা প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক। তারা আমাদের মতো পুঁতিগত বিদ্যায় বিদ্বান নন। তারা সহজিয়া মানুষ। তারা অসম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করেন, লালন করেন, চর্চা করেন। তাদের নিয়ে আমি লিখেছিও বিস্তর।

নবী ও কবির মধ্যে ফারাক আছে। কবি মানে লেখক বোঝাচ্ছি। নবীর কাজ ধর্ম প্রচার। লেখকের তা নয়। লেখক তার পাঠকের বুদ্ধির মুক্তি ঘটান। বুদ্ধির মুক্তি ঘটলে যে কোনো মানুষ সাম্প্রদায়িক থাকতে পারে না। লেখককে প্রচলিত সকল ধর্মমতের উর্ধ্বে উঠতে হয়। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে আমি নাস্তিকতা বোঝাচ্ছি না। নাস্তিকতা মানে অসাম্প্রদায়িকতা নয়। অসাম্প্রদায়িকতা মানে সব ধর্মমতকে অস্বীকার করাও নয়। পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে কিংবা নিত্য পুজা করেও একজন মানুষ অসাম্প্রদায়িক হতে পারেন। এমন বহু অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমি দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিজয়া-সম্মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যে চাষী চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণে ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।’ তাঁর এই কথাতেই অসাম্প্রদায়িকতা নিহিত। লেখক হবেন ঠিক এমনই। সবাইকে তিনি সম্ভাষণ করবেন। মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবে দেখবেন। যে লেখক বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ, আমি তাকে লেখক মনে করি না। তিনি লেখক হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতে পারবেন না। তার সকল নিবেদনই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।



প্রশ্ন ২. মৌসুমী কাদের
একজন মহৎ লেখকের দায়বদ্ধতার জায়গাটি থেকে অসাম্প্রদায়িকতার গুরুত্ব কতটুকু?


২. স্বকৃত নোমান : 
লেখক তো তার লেখার কাছেই দায়বদ্ধ। লেখক তার লেখার কাছে দায়বদ্ধ থাকলে আপনাতেই অসাম্প্রদায়িকতা এসে যাবে তার লেখায়। আর যদি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলি, তাহলে বলতে হবে, লেখক তো আর ইউটোপিয়ার অধিবাসী নন। যে কোনো একটা সমাজেই তার বসবাস। সেই সমাজের ভালো-মন্দের সঙ্গে তাকে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যে দেশের মানুষ এখনো রাস্তায় থুতু ফেলে, বাসের জানালা নিয়ে ঠেলাঠেলি করে, ধর্মের মোহে আরেকজনের মাথায় বাড়ি মারে, ধর্মের জন্য চাপাতি নিয়ে অন্যের ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ে, সেই দেশের কোনো লেখক সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন থাকতে পারেন না। থাকা উচিত নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাকে অসাম্প্রদায়িক হতেই হবে। হতে না পারলে, ঐ যে আগেই বলেছি, তার সকল নিবেদনই ব্যর্থ। তার মধ্যে আর একটি সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। বেহুদাই তিনি কাগজ-কালি নষ্ট করতে থাকবেন।


প্রশ্ন ৩. মৌসুমী কাদের : 
 ব্যক্তি জীবনের ‘সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞতা’ লেখক হিসেবে প্রকাশ করবার সময় কতটা ‘নৈর্ব্যক্তিক’ হওয়া সম্ভব?

৩. স্বকৃত নোমান : 
নৈর্ব্যক্তিক হওয়াটাই তো লেখকের সাধনা। এই সাধনায় তাকে জয়ী হতে হয়। অবশ্যই। নইলে তিনি লেখক কিসের?



প্রশ্ন ৪. মৌসুমী কাদের
সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে লেখক যখন কোন একটি সম্প্রদায়কে সমর্থন করতে বাধ্য হয় (যেমন সংখ্যালঘু) এবং তিনি যদি সেই একই গোষ্ঠিরই লোক হন তখন কি উপায়ে লিখলে ‘পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে’ বলে মনে হবে না।

৪. স্বকৃত নোমান : 
 লেখক কোনো কিছুতে বাধ্য নন। হতে পারেন না। বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ বা খৃষ্টান সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি যেমন সোচ্চার থাকবেন, বাংলাদেশে শিয়া বা আরাকানে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থাকবেন। নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়কে তিনি সমর্থন করবেন কেন? হ্যাঁ, ক্ষেত্রবিশেষ যদি তিনি সমর্থন করতে বাধ্য হনও, সেটা তার ব্যক্তিসত্তার বাধ্যতা। সামাজিক সত্তার বাধ্যতা। লেখকসত্তার নয়। লেখার সময় তার এই বাধ্যবাধকতা থাকবে না। লেখায় তা প্রতিফলিত হবে না। লেখায় তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন। এই নিরপেক্ষতা নির্যাতিত গোষ্ঠীর পক্ষে চলে গেলে তাতে লেখকের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হবে না। কারণ তিনি তো সমাজিক বাস্তবতাকে লেখায় এনেছেন। যেমন বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে। লেখক যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের হন এবং এই নির্যাতনের কথা লেখেন, তাতে তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হবে না। কারণ তিনি তো সমাজিক বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছেন।


প্রশ্ন ৫. মৌসুমী কাদের :
 লেখক যখন স্বার্থপর হয়, আত্মপ্রচারণায় মগ্ন থাকে, ‘মানুষ এবং মাধ্যম’ উভয়কে ব্যবহার করে, নির্লজ্জ আত্মপ্রচার এবং স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় লিপ্ত হয় এবং একসময় সুনাম এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়, এমনকি মহৎ লেখকের খেতাবও অর্জন করে; নব্য লেখকরা কী ভাবে তাকে গ্রহণ এবং অনুসরণ করবে?

৫. স্বকৃত নোমান : 
 এগুলো লেখকের ব্যক্তিগত সমস্যা। অনেক লেখক এসব সমস্যায় আক্রান্ত। এসব সমস্যার কারণে তিনি একা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তার জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন না। দেখতে হবে, তার এসব সমস্যা তার লেখায় চলে এলো কিনা। লেখায় যদি চলে আসে তিনি নবীনদের কাছে পরিত্যাজ্য হবেন। কিন্তু লেখায় যদি তিনি সৎ থাকেন, আপোস না করেন, তাহলে অবশ্যই তিনি নমস্য। বাল্মিকী তো এক কালে ডাকাত ছিলেন। তাতের রামায়ণের কী ক্ষতি হলো? ‘কবিকে খুঁজো না তার জীবনচরিতে’। রবীন্দ্রনাথের কথা। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে আল মাহমুদ ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক হলে অসুবিধা কোথায়? উত্তরটা হচ্ছে, আল মাহমুদ ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক নন। জামায়াত। জামায়াত আর ধর্ম এক জিনিস না। ধরে নিলাম এক জিনিস। কিন্তু আল মাহমুদ ব্যক্তিজীবনের সীমাবদ্ধতাকে লেখায় প্রকাশ করেছেন। বখতিয়ারের ঘোড়া তার প্রমাণ। এ কারণে তিনি পরিত্যাজ্য। তাকে গ্রহণ বা অনুসরণের কিছু নাই।


প্রশ্ন ৬. মৌসুমী কাদের :  
সরকার, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লেখার সময় একজন সংখ্যালঘু লেখকের ভয় কাটিয়ে ওঠার উপায় কি?

৬. স্বকৃত নোমান : 
ভয় থাকলে তো তিনি লেখক হতে পারবেন না। লেখকের পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ হয় না। প্রয়োজনে তাকে মস্তক বন্ধক দিতে হয়। চলে যাক কল্লা, তবু তিনি লিখবেন। এই সাহস না থাকলে লেখালেখি বাদ দিয়ে বরং তিনি হাল চাষ করুন, তাই ভালো।

Thursday 10 November 2016

অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা--------------- দেবব্রত চক্রবর্তী

অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা
নরেন্দ্র মোদী ৯ই নভেম্বর মধ্যরাত্তি থেকে প্রকৃত অর্থে নামিয়ে এনেছেন অঘোষিত "অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা "। এক কলমের খোঁচায় ১৫লক্ষ কোটি টাকা ক্যাশ, সিস্টেম থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে । হটাৎ কি এমন ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হোল যে এই ধরনের অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজন পড়ল ? ১৫ লক্ষ কোটি টাকা ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে মুছে দেওয়ার মাত্র চার ঘণ্টা পুর্বে জাতির প্রতি ভাষণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন …।
করাপশন ,ব্ল্যাক মানি ,সন্ত্রাসবাদ এবং জাল নোট আমাদের উন্নতির রাস্তায় বড় বাধা এবং এই বাধা দূর করে উন্নতির রাস্তায় এগিয়ে চলতে অদ্য মধ্যরাত্রি হইতে “ five hundred rupee and thousand rupee currency notes presently in use will no longer be legal tender”
সুতরাং সরকারীভাষ্য এবং যুক্তি অনুসার ৫০০-১০০০ এর নোট বেআইনি করে দেওয়ার কারন দুর্নীতি বন্ধ করা , কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই , সন্ত্রাসবাদের অর্থের স্রোত বন্ধ করে দেওয়া এবং জাল নোটের কারবারিদের অসহায় করে দেওয়ার মত প্রগতিশীল এবং মহৎ উদ্দেশ্য। অতি উত্তম । কিন্তু তাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে আবার নূতন করে ৫০০/- এবং ২০০০/-টাকার নোট ছাপা কেন ? উল্টে তো সন্ত্রাসবাদী ,ঘুষখোর এবং কালো টাকার কারবারিদের সুবিধা , ২০০০ টাকার বান্ডিল ১০০০ টাকার তুলনায় হ্যান্ডেল করা সহজ । তাহলে মধ্যরাত্তিরের এই নাটক কেন ?
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন আগতপ্রায় , মোদী নির্বাচনে জিতেছিলেন বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফিরিয়ে আনবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে , এমনকি প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমাও পড়ে যাবে এইরকম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন । এদিকে ওনার ক্ষমতায় আসার ২-১/২ বছর অতিক্রান্ত ,কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক টাকাও আসেনি । মোদীকে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচক মণ্ডলীর কাছে দেখাতেই হোত যে দেখুন কালো টাকা’র সমস্যা মোকাবিলা করবার জন্য সত্যই আমি কিছু করছি । যদিও দেশের ৫০০-১০০০ এর নোট বাতিল করে উনি সুইস ব্যাংকের কালো টাকা কিভাবে ফেরত আনবেন সেই প্রশ্নর উত্তর নেই । বৃহৎ কালো অর্থের কারবারিরা কেউই বালিশের খোলের মধ্যে ৫০০-১০০০ এর নোট পুরে পাহারা দেননা তাঁদের সমস্ত অর্থ বিদেশে এবং বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেন দেশগুলিতে জমা থাকে এবং সেইখান থেকে ভারতে এসে আবার কালো অর্থ হিসাবে বিদেশে পালায় - কালো টাকা বালিশের তলায় অলস বশে থাকেনা ,থাকে মার্কেটে , বিদেশে । মোদী কাকে উল্লু বানাচ্ছেন ? ভারতের সেই সমস্ত জনতাকে যারা মাত্র ৩২/- দিন গুজরান করে ।
এইবার আসা যাক দুর্নীতির প্রশ্নে । ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে “twenty-nine state-owned banks wrote off a total of Rs 1.14 lakh crore of bad debts between financial years 2013 and 2015, much more than they had done in the preceding nine years.”অর্থাৎ বিগত ৯ বছরে দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেস সরকার যা করতে পারেনি মোদী একাই মাত্র দু বছরের মধ্যে তা করে ফেলেছেন । 1.14লাখ কোটি টাকা অনাদায়ী হিসাবে ঘোষণা , কারা এই মহামান্য প্রভু সকল যাহারা গরীব মানুষের সঞ্চিত অর্থ মেরে দিয়েও পার পেয়ে যান? রিসার্ভ ব্যাংক তাঁদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে । এটা যদি দুর্নীতি না হয় তাহলে কোনটা দুর্নীতি ?
যে সমস্ত কালো টাকা সোনা ,জমি ,রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ হয়ে গেছে তার কি হবে ? গতকাল রাত্তির বারোটা পর্যন্ত সমস্ত সোনার দোকান খোলা ছিল , সেই সমস্ত ক্রেতা’র কি হবে ? সুতরাং কালো টাকা , দুর্নীতিদমন ,সন্ত্রাসবাদ সমস্ত যুক্তি falls flat on its face. তাহলে এই হটকারি স্বিধান্তের আসল কারন কি ?
মোদী বলছেন “…..The five hundred and thousand rupee notes hoarded by anti-national and anti-social elements will become just worthless pieces of paper.” ভারতের যে সমস্ত নাগরিক ৫০০-১০০০ টাকার নোট পকেটে রেখেছেন সবাই অ্যান্টি সোশ্যাল এবং অ্যান্টি ন্যাশনাল!!! মোদী পুনরায় বলছেন “ ….in this movement for purifying our country, will our people not put up with difficulties for some days? I have full confidence that every citizen will stand up and participate in this ‘mahayagna’.” রাষ্ট্রের পিউরিফিকেশন ? বিশুদ্ধিকরণ ? মনে আছে আজ থেকে ৬০-৭০ বছর পুর্বে ইউরোপে আমরা একই রেটরিক শুনেছি ,ফাইনাল সলিউসন ?
সুতরাং গল্পটা ঠিক কি ?
ভারতের পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলির মার্কেট ক্যাপিটালাইজেসন জানুয়ারি ২০১৫ তে ছিল 4.5লাখ কোটি টাকা আর সেই মার্কেট ক্যাপিটালাইজেসন ২০১৬’র জানুয়ারিতে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে 2.7 লাখ কোটি টাকা ।
ভারতের পাবলিক সেক্টর ব্যাংক গুলি ৭ লাখ কোটি টাকার নন পার্ফমিং অ্যাসেট ,রিস্ট্রাকচার্ড লোন এবং সন্দেহ জনক সম্পদের পাহাড়ের ওপর বসে আছে ।
হিন্দু বিজনেস লাইন জানাচ্ছে গত কয়েক বছরে পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলির অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রম অবনতি ইনভেস্টর এবং বিদেশী পুঁজির কনফিডেন্স কমিয়ে দিচ্ছে ।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে রিসার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে 2.1 লক্ষ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যাতে পাবলিক সেক্টর ব্যাংক গুলির হাতে ঋণ দেওয়ার মত অর্থ থাকে ( neutral liquidity zone )
এখন ব্যাংক যদি লিকিউডিটীর অভাবে ঋণ দিতে না পারে, তাহলে টাকার বৃদ্ধি হবেনা , যেহেতু লিকিউডিটির অভাবে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার হার ঢিমেগতি করতে বাধ্য হচ্ছে সেহেতু যথেষ্ট পরিমান অর্থ ব্যাংকের হাতে থাকছেনা এবং টাকা বৃদ্ধির এই গ্যাপ লিকিউডিটি’র অভাব সৃষ্টি করছে আর এই অভাব মেটাতেই রিসার্ভ ব্যাংক বাধ্য হয়ে সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে 2.1 লক্ষ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যাতে লিকিউডিটি’র অভাব পূরণ করা সম্ভব হয় ।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী ,দুর্বল মানি মাল্টিপ্লায়ার এর প্রশ্ন ছাড়াও ,মানুষের হাতে টাকার সার্কুলেশন হঠাৎ বেড়ে গেছে , লম্বা ছুটির এবং উৎসবের মরশুমে মানুষ হাতে বেশী টাকা রাখছে অর্থাৎ ব্যাংক থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে পুনরায় লিকিউডিটি’র অভাব । ক্রেডিট সুইসে’র হিসাব অনুযায়ী গত বারো মাসে currency in circulation increased by Rs 2.6 lakh crore ।
এই সমস্ত রিপোর্টের সারাংশ - ভারতীয় ব্যাংক রক্তের অভাব - লিকিউডিটি ক্রাইসিসে ভুগছে । অথচ মোদী শাসনক্ষমতায় আসবার পর থেকে বিভিন্ন নৈতিক /অনৈতিক উপায়ে অর্থনিতিতে গতি ফেরানোর চেষ্টা করছেন ,ইন্ডিয়া কে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব বানানোর স্বপ্ন ফেরী করছেন অথচ চাকরীর বাজারে মন্দ্যা ,ম্যানুফ্যাকচারিং আউটপুট বৃদ্ধি পাওয়া দূরের কথা উল্টে নিন্মগামী। আর বি আই অসহায় , লিকিউডিটি বাড়াতে গেলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে । সুতরাং শেষ এবং মরীয়া অস্ত্র ‘শালা সব টাকা ,যা কিছু সার্কুলেশনে আছে ফেরত নিয়ে এসো ব্যাংকে ‘ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা ব্যাংককে মানুষের রক্ত যোগাও এই সমস্ত বাতেলা বাজির অবশেষে ব্যাংকের লিকিউডিটি তো বাড়বে ।
ভারতের বাজারে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা ফিজিক্যাল সার্কুলেশনে আছে ,তার ৮৮% ৫০০- ১০০০ /- এর নোট , রিসার্ভ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী “ there are 16.5 billion ‘500-rupee’ notes and 6.7 billion ‘1000-rupee’ notes in circulation right now. “ আনুমানিক ১৫ লক্ষ কোটি টাকা সিস্টেম থেকে ছেঁচে তুলে নাও , এই ১৫ লক্ষ কোটি টাকা বাধ্যতামূলক ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে প্রবেশ করবে এবং তার পরে দৈনিক মাত্র ২০০০ টাকা-৪০০০ টাকা আপনি এ টি এমের মাধ্যমে তুলতে পারবেন এবং সপ্তাহে মাত্র ২০০০০/- । আপনার টাকা বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ,আজকের ব্যাংঙ্কিং এর ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ব্যবহার করতে দিয়ে কৃত্তিম উপায়ে লিকুউডিটি বাড়ানো হবে । লাভবান হবে কে ? নিশ্চয় সেই সমস্ত হতদরিদ্র চাষা ,বা ক্ষুদ্রশিল্পের মালিক নয় যারা অর্থের অভাবে আত্মহত্যা করতে বা ফ্যাক্টারি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন । লাভবান হবেন সেই সমস্ত ক্রোনি পুঁজিপতি যারা মোদীর আমলে ফুলে ফেঁপে উঠছেন আর আমরা মুর্খের দল - কালো টাকা উদ্ধারের বিপুল বাতেলায় পেটে গামছা বেঁধে উদবাহু নৃত্য করব।
“ This demonetization is the biggest crony capitalist neo-liberalist coup that has ever taken place in India. Never doubt it, India will have to pay a heavy price for it.”
প্রায় ৮০% ভারত বাসীর কি হবে ? এনাদের তো ব্যাংক একাউন্টই নেই ? সামান্য কয়েকটা ৫০০-১০০০ এর নোট পরিবর্তনের জন্য তাঁদের কি ধরনের কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ? আর যদি ব্যাংক একাউন্ট থাকেও তাঁদের বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্কিং এর মাধ্যমে যে লিকিউডিটি বৃদ্ধি তার ফল লাভ করবে কতিপয় ক্রোনি পুঁজিবাদী শক্তি আর আগামী বছর ব্যাংকের ব্যাড ডেটস ২লক্ষ কোটি টাকা ছাড়াবে । গরীব এবং মধ্যবিত্ত ভারতবাসী কি নীরব দর্শকের মত চেয়ে চেয়ে দেখবে যে তাঁদের সম্পদ “ being sucked up by the banks and eventually the crony capitalists? “
বিদ্রোহ করুন অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা প্রতিরোধ করুন । আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদ করেছেন সমর্থন করুন ।
(সাথে পড়তে থাকুন -প্রভাত পট্টনায়েক এর লেখা )

Tuesday 8 November 2016

  শোনার সন্ধি
           ---পলাশকান্তি বিশ্বাস
  
আমার কথা শুনছ না তুমি,
আমি শুনছি না তোমার!
দুজনেই শুধু বলতে চাইছি,
অভ্যেস নেই শোনার।

তোমার কথা শুনছি না আমি,
তুমি শুনছ না আমার!
আমাদের কথা আমাদের নয়,
কথাটা আসলে জামার।

জামার রঙটা লাল না নীল
পাড়ায় কিংবা রাজপথে
সত্য শুধু সেই পরিচয়
রক্তে লেখা দাসখতে!
মাঠে ময়দানে চায়ের দোকানে
অফিস কাছারি ক্যান্টিনে
আমরা উঠছি, আমরা বসছি,
ছোট ছোট দলে রঙ চিনে।

ওই তো দিদি মঞ্চে রোখা,
ওই যে দাদা টিভি-র শোয়
গনগনে কথা চনমনে লাগে
তর্ক মেলাই সে দৃশ্যয়।

কারোর কথা শুনছে না কেউ
সবাই বলে তার মতো।
জামার হয়েই যা বলে যায়
তাই মনে হয় শাশ্বত। 

আসর ভাঙলে ওরাই করে 
একসঙ্গে স্বাস্থ্যপান!
আমজনতা দেশ ও গাঁয়ে
লড়ছে, মরছে— ছত্রখান!

প্রতিবেশি বা আত্মীয় হও
বন্ধু বা সহকর্মী
জামার বিরোধ সবো না, সবো না,
ফুঁৎকারে যা বিধর্মী!

ফুঁৎকারে আর চিৎকারে যদি
ফল না মেলে, সর্বশেষ
অতর্কিত হানায় করি
বিরোধীদের সব নিকেশ!

ভয় নিয়ে ঘর, সভয় বাঁচি,
হয় না, হয় না সন্ধি!
কে আর বলবে, চলো সবাই
শোনাতেই আগে মন দি’।।
........................