Saturday 30 April 2016

ক্যাপিটালিস্ট পার্টি অফ ইনডিয়া(মুনাফাবাজ)------বিশ্বেন্দু নন্দ

 ক্যাপিটালিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া(মুনাফাবাজ)
রাজনৈতিক ভাবে যে দলটাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি সেটা হল সিপিএম।কেননা আপনারা মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।যে শতক একসময় দেশের জনগণকে নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখিয়েছিল, আপনাদের সচেতন সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির সুখের রাজনীতি সেই স্বপ্নের বুকে ছুরি চালিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী খাদ্য-আন্দোলনের পর যে জনসমর্থন পেয়ে আপনারা ক্ষমতার মসনদে পৌঁছলেন, আশু-রিলিফের নামে যুক্তফ্রন্ট তৈরি করে গ্রাম-বাংলার খেটে-খাওয়া মানুষের আশা-আকাঙ্খাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন আপনারা। "লালসেলাম" 'কমরেড' এই কথা গুলো একসময় মানুষকে সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাতো, বিশ্বাস যোগাতো তা আজ বাংলা সিনেমার বিখ্যাত চুটকি তে পরিনত হয়েছে।মরিচঝাঁপি, নকশালবাড়ি, নন্দিগ্রাম,SEZ একের পর এক উদাহরণ দিলে ৫০০ পাতা ফুরিয়ে যাবে।তাপসী মালিক থেকে চুনি কোটাল আপনাদের বামপন্থায় জেন্ডার মুভমেন্ট নতুন মাত্রা পেয়েছিল!!রাষ্ট্রের সুবিধার্থে কিভাবে নিও-লিবেরাল ইকোনমি খুব সহজ উপায়ে লাগু করা যায় তা আপনাদের বামপন্থা শিখিয়ে দিয়েছে, দক্ষ শাসকের মতো । মার্কেট ইকোনমি আপনারা ঢেলে সাজিয়েছেন পুজির স্বার্থে। ছাত্র-ইউনিয়ন-গুলি নির্লজ্জ ভাবে আপনাদের অরাজনইতিক চর্চা,অপসংস্কৃতি এর জন্যে লুম্পেনকারী দের ঠেকে পরিনত হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় বাড়িভাড়া থেকে রাস্তার ড্রেন তৈরি প্রতিটি জায়গায় আপনাদের নির্লজ্জ দলতন্ত্র,মস্তানি, ক্ষমতার আস্ফালন দেখেছে সাধারণ মানুষ। আপনাদেরই যাবতীয় ধারাবাহিকতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তৃণমূল সরকার। আর একটা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিক্রিয়াশীল হলে কতটা ভয়ংকর জন-বিরোধী হয়ে উঠতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সিপিএম।আপনারা টাটা- বিড়লা-অম্বানী দের সাথে হাতে হাত রেখে কমিউনিস্ট সুলভ মিটিং করেছেন(থুড়ি ব্যারিকেড গড়েছেন) শ্রমিকশ্রেণীর সুবিধার্থে!!!!আপনারা নয়া-উদারনীতির আকাশ-কুসুম মেকি উন্নয়নের বাজনা বাজিয়েছেন টাটাদের ন্যানো গাড়িতে চড়ে।আজ সিপিএম মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দল, যার সাথে শ্রমিকশ্রেণীর তথা প্রলেতারিয়েত নিজস্ব রাজনৈতিক মুক্তির বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই... নন্দিগ্রামের গনহত্যার সমর্থনে যারা ডকুমেন্টারি বানিয়ে প্রচার চালান , বক্তব্য রাখেন তাদের কম্যুনিস্ট তো দুরের কথা বামপন্থী বলতেও ঘৃণা হয়।এই সিপিএম এর প্রচারে প্রেসিডেন্সির ছাত্র-পেটানো নেতা 'ঋদ্ধি'র আন্দবাজারিও মুখ সামনের সারিতে থাকে।ভোট শেষ হওয়ার আগেই আপনারা তাই থ্রেট দেন স্বাধীন ছাত্র-ছাত্রীদের। কারণ আপনারাও ভয় পান আসলে স্বাধীন ভাবনাকে, স্বাধীন চিন্তনকে।
হ্যাঁ আমি স্বাধীন।আমি স্বাধীন ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনে বিশ্বাসী। সমাজের প্রচলিত শাসকশ্রেণীর আচার-ব্যাবহার,নিয়ম-রীতির ভাবনার থেকে আমি স্বাধীন। মালিকশ্রেণীর দলের যাবতীয় সুবিধাবাদ থেকে স্বাধীন। 'গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার' নামে গণতন্ত্রকে খুন করে ফেলা পার্টির স্বৈরাচারী, একনায়কতন্ত্র ভূমিকা থেকে আমি স্বাধীন।আন্দোলনের নিত্য-নতুন ফর্মে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এটা। স্বাধীনভাবে( শাসকশ্রেণীর যাবতীয় দল ও চেতনা সংস্কৃতির বাইরে) ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত হওয়ার সময় এটা। বিকল্প-শক্তির খোঁজে নতুন আইডিয়ার জন্ম এভাবেই হয়। আমার কাছে পার্টি এমনই একটি আইডিয়া।সেই আইডিয়া কে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ ঐক্যবদ্ধ সংঘবদ্ধ হওয়া, শাসকের উল্টোদিকে নতুনরূপে পরিবর্তনকামী শক্তির জন্ম দেওয়া।সেই শক্তি শোষিতের প্রতিরোধের শক্তি, পাল্টা লড়াই এর শক্তি।আমি মনে করি না সংগঠিত হওয়ার সমস্ত কাঠামোর মধ্যেই hierarchy এর জন্ম হয়, এই সিম্পল গোদা লজিকে।
আজকের এই সিপিএম ক্ষমতায় এলে আরও বেশি দম্ভ নিয়ে নামাবে রাষ্ট্রের সমস্ত দমনমূলক নীতি। এই সিপিএম হবে উগ্র শোষণের পক্ষে, আরও বেশি নয়া-উদারনীতির পক্ষে, আরও বেশি পুজির পক্ষে, আরও বেশি হয়ে উঠবে রাষ্ট্রযন্ত্রের পার্ট। সিপিএম বা তৃণমূল বা কংগ্রেস বা বিজেপি প্রতিটি রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে, শাসকশ্রেণীর দলের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা খেটে-খাওয়া মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হোক সংঘবদ্ধ হোক, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে, ব্যাবস্থাটাকে পাল্টানোর স্বপ্ন নিয়ে।

কেন আমি সিপিএমকে তৃণমূলের চেয়ে বেশি আক্রমণ করি? ----------- মনোরঞ্জন ব্যাপারী

সেই বহু বছর ধরে একটা নিয়ম বা ভাবনা সর্বত্র চালু আছে -'' যে আমাদের দলে নয় সে ওদের দলে '' । অর্থাৎ আমরা ওঁরা বিভাজন । সেই নিয়মে যেহেতু আমি সিপিএম য়ের মরিচ ঝাঁপি গন হত্যা বা নকশাল বাড়ী থেকে নেতাই নিয়ে কোন কথা বলি '' তেনারা '' আমাকে দেগে দেন তৃণমূল বলে । ভাবনাটা এই রকম - যে তৃণমূল তাঁর সব কথা অসত্য। এটা করতে পারলে সব জবাব দিহির দায় থেকে পিঠ বাচাবার একটা ছুতো পাওয়া যায় ।
তবে যারা আমার নিকট জন সবাই জানেন আমি তৃণমূল নই ।আর আমি তৃণমূল হলে সেটা এত গোপনে হবোনা । সবার সামনে প্রকাশ্যে ওই দলের সদস্যতা নেব । কে আমাকে বাধা দেবে?
অনেকে বলছেন আমি কেন তৃণ মুলের বিরুদ্ধে কিছু বলি না - মানে যে ভাষায় সিপিএম কে বলি সেই ভাষায় কেন ওদের আক্রমন করি না । আমি স্বীকার করছি তা করি না । কারন আমার বলা বা লেখায় [ যদিও তা হবে না ] যদি তৃণমুলের একটাও ভোট কমে যায় - যদি সেই এক ভোটের কারনে সে ক্ষমতায় না আসতে পারে যারা ক্ষমতায় আসবে তাঁরা যে পৃথিবীর সব চেয়ে জঘন্য অত্যাচারী নিকৃষ্ট একটা দল । তাঁরা যে দুঃশাসন ইতিপুর্বে চালিয়ে বিদায় নিয়েছে আমার দেহ মনে - সমাজ জীবনে তাঁর দগদগে স্মৃতি যে আজো বর্তমান । কে তাদের দায়িত্ব নেবে যে তাঁরা ক্ষমতায় এলে আর এমন ঘটনা ঘটাবে না ? আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা সেই মানুষ গুলোকে যাদের দন্ডকারন্য থেকে এরাই ডেকে এনে চল্লিশ খানা লঞ্চ দিয়ে চার দিক থেকে ঘিরে নির্মম ভাবে হত্যা করে নৌকা করে নিয়ে গিয়ে সাগরের জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল । ফেলে এসেছিল গভীর অরন্যে বাঘের খাদ্য হিসাবে । তাঁরা যে আমার আপন জন - আত্মীয় । - স্বজাতি দলিত দরিদ্র অসহায় ।
তৃণমূল নিয়ে আমারও অভিযোগ কম নেই ,১, সে তাঁর প্রতিশ্রতি পালন করেনি- রাজবন্দীদের আজও মুক্তি দেয়নি । আমাদের অতি প্রিয় আদিবাসী নেতা ছত্রধর মাহাত আজও জেলে পচছে । উচিৎ ছিল তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া ২ উচিৎ ছিল যারা দীর্ঘ ৩৪ বছর মানুষের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালিয়ে ছিল মরিচঝাপি থেকে নেতাই পর্যন্ত- আর পাড়ায় পাড়ায় যে ছোট ছোট মাস্তান গুন্ডা - তাদের ধরে জেলে ঢোকানো - বিচার করে সাজা দেওয়া । তা না করে সেই হার্মাদদের তাদের নিজের দলে ঢুকিয়েছে । আজ তাঁরা আগের মতই মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করছে । দলের পুরাতন তৃনমূলদেরই মারছে । ৩ দরকার ছিল ব্যাপক অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো । তাহলে অন্তত মানুষ নির্ভয়ে পথে চলতে পারত । অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালালে সিপিএম সহ সব দলের দাগীরা বাংলা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হত । তাহলে অন্তত মমতা শান্তি ভাবে আরও কিছু উন্নয়নের কাজ করতে পারত । সে ক্ষমতায় বসা মাত্র মনিহারা ফনীরা পদে পদে যে বিরুদ্ধতা শুরু করে ছিল - তা পারত না । তাহলে আর আজ রাজপথে মমতার বিরুদ্ধে মিছিলে লোক পাওয়া যেত না । না আমি সারদা নিয়ে কিছু বলছি না । আমি সারদার আগে সঞ্চয়িতা দেখেছি কারা সেই চিট ফান্ডের মাধ্যমে লক্ষলক্ষ মানুষকে ঠকিয়ে কোন কৌশলে সঞ্চয়িতা কর্তাকে হাপিশ করেছিল তা আমাদের জানা । অপরাধ সেটাও- অপরাধ এটাও । এখানে কোন আমরা ওঁরা চলে না । কোন মানে নেই যে সিঙ্গুরের তাপসী মালিকের হত্যা ধর্ষণ ন্যায় আর কামদুনি অন্যায় বলার । তবে আজ সেটাই হচ্ছে । সব অপরাধীর বিচার সাজা আর মানুষের ক্ষতি পুরন হওয়া দরকার ।
আর নারদা ? হাসতে হচ্ছে -। মাত্র ৯৫ লক্ষ টাকা ঘুস? এতেই ৯ জন কে ফাসানো গেল ! হ্যা ঘুষ নিলে সেটা অপরাধ । আর গোপন ক্যামেরায় ছবি থাকলে তো বলারই দরকার নেই । কিন্ত দাদা আমি যে সিপিএম দের সেই সব নেতা দের চিনি যারা ৪০/৪২ বছর আগে আমাদের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খেত । আজ তাদের বিত্ত বৈভব কত হাজার কোটি টাকার ভাবলে মাথা ঘুরে যায় । কোথা থেকে এল এত টাকা ? সৎ পথের কামাইয়ে ? সত্যি হচ্ছে ভোটবাজ সব দলকেই এই ভাবে টাকা নিতে হয় । মনে নেই সুভাস চক্রবর্তীর সেই সদম্ভ সাহসিক উক্তি? দল চালাতে মিটিং মিছিল করতে ক্যাডার পুষতে এমন ঘুষ সবাই খায় । তবে ওই - গু খায় সব মাছ নাম হয় পাঙাশের । তবে এটা বলা যায় যে তৃণমূল নেতারা নির্বোধ । এত নির্বোধ যে চুরি করাটাও ঠিক মত শিখে ঊঠতে পারেনি । ছিচকে কর্মেই ধরা পড়ে যায় । আমাদের এটাই ভরসা- ওঁরা লাখ থেকে লাখ লাখে যাবার আগে ধরা পড়ে যাবে । অন্যরা - মানে ওদের সরিয়ে যাদের আনা হবে ,হাজার হজার কোটি গিলে ফেললেও কেঊ টেরটি পাবেনা । তাই আমার মনে হয় খুনি ডাকাত ধর্ষক দের চেয়ে ছিচকে চোর পকেট্মার কিছুটা ভাল । ডাকাত তো প্রান ধন সম্মান সব নেবে । ছিচকে চোর নেবে ছেড়া পুটুলি । যতদিন না মানুষের সত্যিকারের দরদী কোন দল গড়ে না ওঠে আমি চাই -যা চলছে তাই চলুক । আপাততঃ সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর আমাদের কি করবার আছে?

Thursday 28 April 2016

সিপিএম ফিরে এলে কার লাভ?---------------- সম্রাট সেনগুপ্ত

এই বাজারে সিপিএমের বিরোধীতা করলেই তৃনমূল ভাবছে লোকে। অথচ অতিবাম বুদ্ধিজীবিরা সেই আলথুজারের স্ট্রাকচারাল মার্ক্সিজমের ইকনমি ইন দা লাস্ট ইনস্টান্সের মতো বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাম বুদ্ধিজীবিদের যতই সিপিএম সমালোচনা থাক তাদের সমর্থনে সিপিএম ইন দা লাস্ট ইনস্টান্স। তৃনমূল সরকারে আছে তাই প্রবল সিপিএম বিরোধীতা তাদের সুবিধা করে দেবে এই ছুতোয় যারা সিপিএমের সমালোচনা করছেন তাদের বলা হচ্ছে সুবিধাবাদী আর যে হেতু তৃনমূল সরকারে আছে তাই তার বিরোধীতা করলেই সে বীর বিপ্লবী! তবে সেই সব বিপ্লবীদের স্মৃতি শক্তি বড়ই দূর্বল - পাঁচের আগের চৌঁত্রিশ বছর এতো সহজে ভুলে গেলেন - ভুলে গেলেন মরিচঝাঁপি থেকে নন্দীগ্রামের হত্যার জিনিওলজি! কেমন সরিশার মধ্যে প্রেত মনে হইতেছে না? সিপিএম ফিরে এলে কার লাভ? কেন বাঙালি স্বভাবতই বামপন্থি হওয়া স্বত্বেও - তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবির সংখ্যা এতো বেশি হওয়া স্বত্বেও কেন সিপিমের গণহত্যাগুলোর নন্দীগ্রাম পূর্ববর্তি পর্যায়ে কোন গুরুত্বপূর্ন সমালোচনা হয়নি? কেন? এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবিদের সাথে তবে কি সিপিএমের কোন আইডিওলজিকাল আন্তঃসম্পর্ক আছে? কেউ কেউ ভাবছেন নাকি তৃণমূল ক্ষমতায় এলে এবিভিপির মিছিল বুঝিবা আর যাদবপুরের গেট অবধি এসে ফিরে যাবে না - সরাসরি ভিতরে ঢুকবে। বাস্তব কি তাই বলে? এই রাজ্যের পুলিশ কর্তৃক এবিভিপিকে ফেরত পাঠানো হয় যাদবপুরের দোরগোড়া থেকে। সুগত বসু জেএনইউ কান্ডে ছাত্রদের কাজের কিছু সমালোচনা করেও (কেউ তা সমর্থন করবেন কি না অন্য কথা তবে গণতন্ত্রে সমালোচনা স্বাস্থ্যকর) প্রকারন্তরে ছাত্রদের উপর বিজেপির আক্রমনের নিন্দাই করেন। হোক কলরবে শেষ অবধি বিরোধীতা স্বত্বেও মূখ্যমন্ত্রি ছাত্রদের দাবী মেনে নেন। আচ্ছা দিল্লিতে এবিভিপির থেকে কি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলি যুব সংগঠন দূর্বল? যাদবপুরের আন্দোলন ভাঙতে যদি আশেপাশের কলেজের সব তৃণমূলি ছাত্রদের একত্রিত করা হতো পরিস্থিতিটা কি দাঁড়াতো। এবিভিপির আর অভিযানের দরকার পরত না, অনেক আগেই আক্রান্ত হতো যাদবপুর। তা হয় নি। তাহলে কেন এই বিপন্নতা? কেন র‍্যাডিকাল বামেরা ভুলে গেলেন যে কোন বিরুদ্ধ মতকে কি করে ম্যানেজ করত সিপিএম। সমাজতত্বের ছাত্র হিসেবে জেনেছি যখন মেটেরিয়াল বাস্তবের সাথে বোধের ফারাক থাকে তার ব্যাখ্যা দিতে পারে মতাদর্শ বা আইডিওলজি। পশ্চিমবঙ্গের বাম আইডিয়ালিজমের সাথে মধ্যবিত্ত আইডিওলজির একটা সংঘাত রয়েছে। তার রূপ আমরা দেখেছি নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় - সে ছিল মধ্যবিত্ত আইডিওলজির সাথে বাম আইডিয়ালিজমের সংঘাতের কাল। যার কারনে দু দুবার ভাঙে কমিউনিস্ট পার্টি। আর নকশাল দমনের পর বাম আদর্শবাদ ক্রমশঃ অন্তঃসার শূন্য একটি নাম সংকীর্তনে পরিণত হয় - কতগুলো স্লোগান, কতগুলো বার্তালাপ, কতগুলো নাম, কিছু গান আর কিছু অতীতের ঐতিহাসিক গল্প - এই আধারগুলি টিকিয়ে রাখে সিপিএম। নিওলিবারেল যুগে একটি যায়মান সময়ের ইতিবৃত্ত আঁকড়ে বাঁচে বাঙালি মধ্যবিত্ত বাম বুদ্ধিজীবি। তার কলোনিয়াল সুবিধাবাদী জারজ লেগাসি স্থিতাবস্থা টিকিয়ে রাখে বাম নাম সংকির্তনে। সর্বহারা, শ্রেণিবৈষম্য, সমাজতন্ত্র, লেনিন-স্ট্যালিন-মাও-হো লাল সেলাম, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশেনাল, সর্বহারার রাজনীতি সব এক ভাঙা রেকর্ডের মতো চালিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে বাঙালি মধ্যবিত্ত। এদিকে ভাবের ঘরে চুরি হয়ে যায় - ঘটে যায় স্বজনপোষন, রাজনীতির দূর্বৃত্তায়ন, একাধিক গণহত্যা। নন্দীগ্রাম অবধি অপেক্ষা করতে হয় সুশিল সমাজকে বুঝতে যে কমরেডরা আর সর্বহারার পক্ষে নেই। তবে এই ফাটল ক্ষণস্থায়ী। মধ্যশ্রেণির স্মৃতিমেদুরতার মধ্যে হয়ত সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকেই যাবে - বুদ্ধিজীবিরা গল্প করবে কি করে তারা এনেছিলেন ১৩ই মে, ২০১১-র বিপ্লব, আনন্দবাজারও নিশ্চয়ই কিছু কৃতিত্ব দাবী করবে। থাকবে না নামপরিচয়হীন ভদ্রলোক শ্রেণীর বাইরের সেইসব নাম যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যারা এনেছিলেন এই বৈপ্লবিক মূহুর্ত যেখানে হয়ত বিশ্বের সেই দূর্লভ ঘটনা ঘটল - নিওলিবারেল এই অর্থব্যবস্থায় যেখানে জমিদখলকারী হেরে গেল। কারন ১৯৬৮-র ফরাসী ছাত্র বিপ্লবের স্লোগান অনুযায়ী সর্বহারাদের কিছু হারানোর থাকে না শিকল ছাড়া। সরকারী শিকল ভাঙল তারা, জিতল না যদিও, সাত ফসলি জমি নিস্ফসলি হয়ে গেলো কমরেডদের ঐতিহাসিক ভুলে। না না আমি এক নতুন শব্দ ব্যবহার করছি আজকাল। ঐতিহাসিক ঠিক। এটাই সিপিএমের প্রকৃত শ্রেণি চরিত্র - অতএব ঐতিহাসিক ঠিক - তা কিছু কিছু বিশেষ মূহুর্তে প্রকাশিত হয়। যারা এই জনগণতান্ত্রিক ঐতিহাসিক ঠিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তাদের ভোটবাক্স ছাড়া অস্তীত্ব নেই। তারা বাঙালি ভদ্রলোকের ডিসকোর্সে অনুপস্থিত - অদৃশ্য। অপরদিকে রইল সাংস্কৃতিক পেশি সর্বস্ব বাম বুদ্ধিজীবি। সিপিএম কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশেনাল চালালে, লাল পতাকা দেখলে যাদের বুক হা হা করে। এরা কেউই নন্দীগ্রাম পূর্বে জমি অধিগ্রহনের বিরুদ্ধে কোন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি, কেবল নন্দীগ্রামের স্বতঃসফুর্ত প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়ে নাম কিনেছেন। তাই এরা সব কিছু খুব তারাতারি ভুলে যেতে বাধ্য। আইডিওলজি তো অনেকটাই নিশ্চেতনে থাকে। সব সময় তা সচেতন নয়। সিপিএম সংস্কৃতির নিশ্চেতনে আছে বাঙালি মধ্যবিত্ত মতাদর্শ যা নিজেদের শ্রেনীস্বার্থ রক্ষাকারী এবং সেই স্বার্থের সাথে সর্বহারা শ্রেণীর উত্থানের বুদ্ধিজৈবিক সমর্থনের যে সংঘাত আছে তাকে ভুলিয়ে রাখার আফিম। নিরপেক্ষ থাকাটা এই শ্রেণীর একটা ভান। সরকারে থাকা দলকে অন্ধ সমর্থন না করেও তাদের নির্বাচনে জয়ি হওয়ার আশা করাটা এদের কাছে লজ্জার। অথচ সিপিএম এবং কংগ্রেসের অশুভ জোটের আকাংখা করাটা এদের কাছে নিরপেক্ষতা। হবে নাই বা কেন? পাড়ার মোড়ে মোড়ে ফাটা রেকর্ডে রবীন্দ্রসংগীতের বদলে জাগো জাগো সর্বহারা বাজালে শুনতে আরেকটু ভালো লাগতো বৈকি! এই পাঁচ বছরে তৃণমূলের সব থেকে বড় ব্যর্থতা তাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল হেজিমনি তৈরি করতে পারে নি। যাদবপুরের হোক কলরবের একাংশের স্লোগান শুনলেই সেটা বুঝবেন - "কালিঘাটের ময়না, এখানে এসব হয় না।" এদের কেউ কেউ আবার হোককলরবের বিরোধী মিছিলটাকে ঝি ক্লাসের মিছিল বলেছিল। শ্রেণি চরিত্রটা কি খুব অস্পস্ট? এবার যদি হোক কলরবের পক্ষে এতো কিছু লেখার পড়েও কোন কোন ভদ্রসন্তান আজকের এই পোস্টটা পড়ে মনে করেন আমি ঐ বিরোধী মিছিলটায় ছিলাম, তাহলে কি আমার 'বাবু' হয়ে বসতে পারি না বলে লজ্জিত হওয়া উচিত? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।

Wednesday 27 April 2016

হত্যার সারিতে রেজাউলের পর কে--- রাহমান নাসিরুদ্দিন

এখন পশ্চিমবাংলা- বুধসন্ধ্যার আড্ডা - অসিত রায়

উল্টোডাঙ্গায় বাপির চায়ের দোকানে বুধসন্ধ্যার আড্ডা। কঠিন দুর্বোধ্য বই পড়া অরুণ লাল চায়ে চুমুক দিয়ে সূচনা করল, তাত্বিক কথা আজ থাকঃ তোমরা বল এতদিন যাবত যত মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবাংলায় এসেছেন তাদের মধ্যে যাঁদের কথা বলা যায় তাঁরা কারা? সমবেত উত্তর-কেন? বিধান রায়, জ্যোতি বসু, মমতা? প্রফুল্ল ঘোষ,সেন, সিদ্ধার্থ,অজয় ,বুদ্ধকে বাদ দিলে?
স্বরাজ- কেনও?বিধানের আমলে দুর্গাপুর,চিত্তরঞ্জন,কল্যানী,হরিনঘাটা,সল্ট লেক?
অসিত- সেই বিধানই আবার ১৯৫৭ তে পশ্চিমবাংলাকে বিহারের সঙ্গে জুড়ে দেবার বাংলা বিরোধী চক্রান্ত করেছিশে।বিপুল প্রতিবাদে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। কাজটা তিনি করেছিলেন নেহরুর পরামর্শে। তবে জহরকে ধরে তিনি মানভুম কে দু টুকরো করে পশ্চিমবাংলার সঙ্গে জুড়েছিলেন । কিষানগঞ্জ থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে এখানে লাগিয়েছিলেন উত্তরের সাথে দক্ষিণকে যোগ করতে।
অরুণ- না এগুলি বিষয় নয়। বেশ, জ্যোতিবাবুর মুকুটের পালক কি কি?
বাপি- রক্ত দিয়ে গড়া বক্রেশ্বর? হলদিয়া পেট্রো? বর্গা রেকর্ডিং ? আর কি? কেন , চূড়ান্ত দলতন্ত্র দিয়ে সমস্ত পার্টি কর্মীদের বেকারত্ব ঘোচানো? এবং লোকাল কমিটির একচ্ছত্র আধিপত্য ? অজস্র গণসঙ্ঘঠন দিয়ে এখানকার সমাজ-রাজনীতিকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলা?
অরূপ- বুদ্ধকে তোমরা আলোচনার বাইরে রাখলে কেন ? তিনি তো চেষ্টা করেছিলেন সামান্য টাকায় কৃষকের জমি নিয়ে টাটাকে দিয়ে ন্যানো কারখানা খুলতে? তা তোমাদের দয়ায় তা হল কই?
অসিত- মমতার কাছে প্রত্যাশার বহরটা তো বেশ বড়ই ছিল? তিনি কি দিলেন?
অরুণ- একটা কথা দিয়ে শুরু করি । কর্পোরেট ওষুধ কম্পানী ও লোভী ডাক্তাররা মিলে স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাকে এবং গরিব মানুষকে ছিবড়ে করে দিচ্ছিল।মমতা সরকারি হাসপাতাল গুলিতে জেনেরিক নামে ওষুধ দেওয়ার ফরমান দিয়ে ওষুধের দাম বিপুল কমে রেখে দিয়ে নতুন পথ দেখালেন ।এটা কি কম অ্যাচিভমেন্ট ?আর কাদের জন্য? গরিব মানুষদের জন্য নয় কি?
বাপি- দেখুন, জনকল্যাণমূলক প্রকল্প দিয়ে সামান্য হলেও মমতা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি তো পৌঁছোতে পারছেন! কন্যাশ্রীর মত আর অনেক প্রকল্পর মাধ্যমে অল্প আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েরা উপকৃত হয়েছে!কিন্তু খবরের কাগজ কি এক লাইনও এর জন্য খরচ করেছে? আর দু টাকার চাল?
ভোলা- জেলায়,জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়,মেডিকাল কলেজ,হাসপাতাল, পলিটেকনিক কে করল ?শুধু গালি দিলেই হবে?
অরূপ- ওগুলো কিছুদিন বাদেই মুখ থুবড়ে পড়বে। 
অরুণ -এখন পশ্চিমবাংলায় ৯৭ শতাংশ মুসলিম ওবিসি সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারে, এটা কম কথা হল?
লেলো- তাই ত ওদের এত বাড় বেড়েছে।
ভোলা- কেন খাগড়াগড়,কালিয়াচকে দেখলেন না?
বাপি- ওদিকে দেখুন, বিমল গুরুং কে টাইট দিতে কি রকম লেপচা,তামাং,ভুটিয়া এই সব জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা উন্নয়ন বোর্ড করে দিলেন! কর আদায়ও অনেকটা বেড়েছে।
অসিত - এবার কিছু নিমতেতো কথা বলুন! সারদা,নারদ স্টিং এগুলিতে মানুষ কি বিচলিত ? সব পারটি অবশ্য টাকা নেয়। কিন্তু জনগণ জানতে পারে না। ওদের ক্ষে্রে কেন এটা হোল?
অরুণ- আমি একটু অন্য কথা বলতে চাই । কাজ নেই, চাকরি নেই,নতুন কর্মসংস্থানের নামগন্ধ নেই। তাই রাজনৈতিক দাদাগিরির উপর নির্ভরশীল জীবিকার প্রসার এই আমলে হুহু করে বেড়েছে ।
অরূপ- সিপিএমের আমলেও দালালি,ঠিকেদারি, সিন্ডিকেট ব্যাবসা সবই ছিল।কিন্তু পার্টির একটা নিয়ন্ত্রণ ও ছিল। বাইরের কেউ খুব একটা জানতে পারত না।
অসিত- তাই দেখা যাচ্ছে জঙ্গল রাজের লাগামহীন দৌরাত্ম । তাই যতদিন বাংলার স্বার্থবাহী নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ দিল্লির চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারার সম্ভাবনা তৈরি করছে ততদিন রুপোলী রেখা দেখা অসম্ভব , স্বৈরাচারী পদ্ধতি তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এমনকি নির্বাচনে তিনি জিতলেও । আজ চতুর্থ লাল চায়ে আড্ডার অবসান হোক।

Thursday 21 April 2016

আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত ----------------- শর্মিষ্ঠা নাথ

আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত

‘আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি’। কোনও ক্ষত, কত

গভীর ও দুরারোগ্য হলে তাকে ‘অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনা’র মত শব্দবন্ধ দিয়ে ধরা যায়

গেইল তুরিনের ‘আতঙ্কের দেওয়ালঃ বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত’ (অনুবাদ- অসিত রায়,

প্রথম প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ, জানু ২০১৬) বইটি দেখতে দেখতে সেই অনুভূতি

হচ্ছিল। হ্যাঁ পড়া নয়, দেখা শব্দটাই ব্যবহার করলাম। কারণ বইটিতে রয়েছে মূলতঃ

তুরিনের তোলা ১৯৯২ সাল থেকে তৈরি ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর ৩,২০০

কি.মি. ব্যাপী দেওয়াল ও কাঁটাতারের বেড়ার দু’পাশের মানুষের রোজকার জীবন

সংগ্রামের বেশ কিছু ফটোগ্রাফ। ফটোগুলি রঙীন নয়, সাদা-কালো কারণ যাদের

জীবনচর্যার ছবি তিনি ধরেছেন তাদের জীবনে অন্য কোনও রঙ নেই।তাদের

জীবনযুদ্ধ  কোনও মহত্তর উত্তরণের স্বপ্ন দেখায় না, বরং তা প্রতিপদে সন্তর্পণে

মৃত্যুকে এড়িয়ে চলে।কাঁটাতারের বেড়ার জিরো পয়েন্ট থেকে ৮কিমি অর্থাৎ ১৮,০০০

ব্যাপী গ্রাম ও কৃষিজমিতে অবস্থানকারী দুইকোটি মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক

বি.এস.এফ যারা সীমান্তে নজর রাখে ও দেশান্তরী মানুষের চলাচলকে প্রতিহত করে।

তাদের আইন, স্বেচ্ছাচার, জুলুম, আত্যাচার ও সর্বোপরি ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে তাদের

মানসিক সংযোগহীনতা রোজকার ঘটনা। মানবাধিকার সংগঠন Human Rights

Watch- এর মতে বি এস এফের হাতে ১০ বছরে হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু

হয়েছে। তুরিনের তোলা ফটোগ্রাফ গুলির নীচে পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু তা প্রায় প্রতেই

হয় না কারণ ফটোগুলি ‘speak for themselves’।এদের চরিত্রগুলির চোখে, মুখে ও

সমস্ত শরীরী বিভঙ্গে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক, অসহায়তা, মূঢ়তা, বিস্ময়, প্রশ্ন ও

বোবাকান্না। কোনও ছবিতে কোনও মুখরতা বা উচ্ছ্বাস নেই। এক ব্যাপক

ভাষাহীনতায় তারা আক্রান্ত। কোন পাপের উত্তরাধিকার বহন করছে জীবন মৃত্যুর

কাঁটাতারের উপর ঝুলতে থাকা এই মানুষগুলো? কোন দুঃসহ অতীত এই বিপন্ন

বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্ম দিয়েছে? তাকে বারবার ফিরে দেখা কি আমাদের

ঔচিত্যবোধের অন্তর্গত নয়? নাকি সেই ইতিহাস নঞর্থকতাকে, বীভৎসতাকে ও

হিংস্রতাকে তুলে ধরে বলে তাকে লালন করবার কোনও দায় আমাদের থাকবে না।

অনেকেই এ প্রসঙ্গ তুলেছেন যে দেশভাগের সময় ’৪৭-এ সমস্ত মানুষকে যেহেতু

সাম্প্রদায়িক ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাই সেই সময়ের ঘটনা দেখতে গিয়ে

একজন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় হিসাবে খানিকটা সতর্ক হওয়াটাই কি কাম্য নয়?

নৈতিকতার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন উর্বশী বুটালিয়া তাঁর ‘The Other Side of

Silence’ লিখতে গিয়ে। তাঁর প্রশ্ন, যা আমি জেনেছি তার সব প্রকাশ করলে

দক্ষিনপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের হাতে কি বিপজ্জনক মালমশলা তুলে দেওয়া হবে না? ‘ I

am torn between the desire to be honest and to be careful’, ‘Seminar’

পত্রিকার ৪৬১ নং সংখ্যায় জাবিদ আলম বলেছিলেন যে, নতুন প্রজন্মের কাছে

দেশভাগ এক দূরের ঐতিহাসিক ঘটনা, সে অভিজ্ঞতার বীভৎসতাকে ভুলে গেলেই

আমাদের নিত্যকার জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এই বক্তব্যের প্রতিবাদ

করেছেন জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে তাঁর ‘Remembering Partition’ গ্রন্থে। তাঁর মতে, আমাদের

নীরবতাই বরং দক্ষিনপন্থী ঐতিহাসিকদের হাত শক্ত করবে। আর পাণ্ডে যেটা

বলেননি তা  হল, ভুলে গেলেই যদি নিত্যদিনের জীবনযাপন স্বাভাবিক হত,

তাহলে গুজরাটের নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটতোনা। তাই আমাদের রাজনীতির

অতীত, ভবিষ্যতকে বুঝতে গেলে, বর্তমানকে চিনতে গেলে, বারবার আমাদের

দেশভাগের দিনগুলি পুনরালোচনা করতে হবে।

       ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়কর ঘটনা দেশভাগ।

যুদ্ধ নেই, আপাতত সব শান্তিকল্যান হয়ে আছে এমন পরিস্থিতিতে মানব

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণপ্রব্রজন ঘটেছে ভারতভাগের ফলে। Reflections

on Exile প্রবন্ধ সঙ্কলনে Edward Said বর্তমান যুগকে ‘the age of

refugees, of displaced persons, mass immigration’ বলেছেন। তার

মধ্যে বঙ্গবিভাগ বৃহত্তম ‘never before or since, in human history,

there has been such a mass exodus of people ’।ছিন্নমূল মানুষ

ভিটেমাটি, দেশ, চিরাভ্যস্ত জীবন ছেড়ে অনির্দেশ্যের পথে পাড়ি দিয়েছিল।

গণনাতীত মৃত্যু, অগণিত ধর্ষণ, চূড়ান্ত নির্মমতা তাদের জন্য রাস্তায় ওত

পেতে বসেছিল। অনেক জীবন পথে বিপথে, শিবিরে, দেশান্তরে চিরকালের মত

হারিয়ে যায় আর যারা থেকে যায় তারা বেশিরভাগই ‘রুগ্ন, অভুক্ত, অস্নাত,

হাজার লোকের পুতিগন্ধ জনতা’। শিকড়ের সঙ্গে যে চিরকালীন বিচ্ছেদ সূচীত

হল তাদের ‘ the unhealable rift forced between a human being and

a native place, between the self and the true home’ তার বেদনা

কোনোদিন তারা অতিক্রম করতে পারেনি।এবং এটাতো আজ তর্কাতীত ভাবে

প্রমাণিত যে পূর্বপাকিস্তান/ পূর্ববঙ্গ/বাংলাদেশ থেকেই মূলত হিন্দু

জনগোষ্ঠী যূথবদ্ধভাবে ও ধারাবাহিক ভাবে ভারতে চলে এসেছে বা আসছেন।

একথা বিধান রায়ের মন্ত্রিসভাতেই পুনর্বাসনমন্ত্রী রেণুকা রায়

বলেছিলেন ‘the exodus was an one-way affair’. ১৯৪৬-৪৭ সালে

নোয়াখালির ত্রিপুরার দাঙ্গায়, ইস্লামিক রাষ্ট্রে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির

নাগরিকে পর্যবসিত হওয়ায়, হায়দ্রাবাদের মত পূর্ববঙ্গেও ভারত

আক্রমণ করতে পারে এই অনুমানে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ফলে তাদের

দেশত্যাগ ঘটে। অথচ নেহরু-লিয়াকত চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের

নিরাপত্তা দেওয়ার ফলে বহু চলে যাওয়া মুসলমান বাঙালি এখানে ফিরে

এসেছে। কিন্তু পূর্বপাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দুরা চলে এসেছে তাদের

সম্পত্তি সম্পর্কে কঠোর আইন প্রবর্তিত হয়েছে। ১৯৫২-৬০ কালপর্বে

বাঙালি হিন্দুর দেশত্যাগ ঘটে পাসপোর্ট প্রবর্তনের ফলে, দাঙ্গার ফলে ও

সম্পত্তি বিক্রয় সংক্রান্ত আইনের ফলে।বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের দরুন ২০ লাখ একরের বেশি

জমি হারিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এই নির্গমন অব্যাহত।

খালেদা জিয়ার নির্বাচন জয়ের পরই চলে আসা হিন্দুর পরিমাণ আরও বেড়ে

গেছে। ১৯৯৪ সালে Holiday প্রত্রিকায় প্রকাশিত The Missing

Population প্রবন্ধে মহীউদ্দিন আহমেদ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে,

১৯৭৪ সাল থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৭৫ জন হিন্দু বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে

হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রেম হুগো তাঁর ‘Illegal International Migration in Asia”

প্রবন্ধে বাংলাদেশের ১ কোটি হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা বলেছেন। এরা শুধু

হিন্দু না, মুসলমানও যাদের বেশির ভাগ ভারতে এসেছে।

     একথা ঠিকই যে পূর্ববঙ্গে বর্ণহিন্দুদের দ্বারা উপেক্ষিত ও শোষিত নিম্নবর্ণের

হিন্দুরা, মূলত নমঃশূদ্র কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী ইত্যাদিরা প্রথমে পূর্বপাকিস্তান ছাড়ার

কথা ভাবেনি। মুসলিম কৃষিজীবী ও নমঃশূদ্র দুই social underdog হাত মেলানোয়

বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধি কংগ্রেস অখণ্ড বাংলায়

ক্ষমতাচ্যুত ছিল।পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সময়ে মুসলিম লীগ তাদের প্রতি নিপীড়ন

অবসানের যে ওয়াদা দিয়েছিল তা পূরণ করেনি। প্রথম দিকে দেশ না ছাড়লেও

মধ্যবিত্ত হিন্দুভদ্রলোকেরা চলে গেলে তারা নিরাশ্রয় বোধ করতে থাকে। সবচেয়ে

মর্মান্তিক আঘাত এরা পেয়েছিল ‘ধর্মান্তরিত করায় ও মেয়েদের সম্ভ্রমহানিতে’।

ফরিদপুর, ঢাকা, মৈমনসিং, বরিশাল, যশোর ও খুলনা জেলায় বসবাসকারী শ্রমমাত্র

সম্বল এই মানুষগুলি ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেন।

   বর্ণহিন্দু মানুষজন , যারা পূর্বপাকিস্তানে থাকাকালীনই ভারতে সম্পত্তি বিনিময়

করতে বা কিনতে পেরেছিলেন তাঁরা মুলতঃ কলকাতা ও তার আশেপাশে উত্তর চব্বিশ

পরগণায় বসতি গড়েছিলেন। দক্ষিণদিকে ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, বিজয়গড় থেকে উত্তরে

দমদম, বরানগর, নিউব্যারাকপুর ইত্যাদি অঞ্চলে জবরদখল কলোনি গড়ে ওঠার যে

ইতিহাস উদ্বাস্তু জনগণ তৈরি করেছিলেন, তাতেও মুলতঃ বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ই অগ্রণী।

আর তপশিলী জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় বাঙালি হিন্দু শেয়ালদা রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম হয়ে

রাণাঘাট, ধুবুলিয়ার ভয়াবহ ক্যাম্প থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন আন্দামান, নৈনিতাল

বা দণ্ডকারণ্যে। এই ‘lesser mortals, situated at the periphery’- র কী হল?

আন্দামানে পাঠানো বাঙালিরা যেন অন্তর্ধান করে গেল বাঙালির চৈতন্য থেকে। আর

মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, অন্ধ্রের বনাঞ্চল দণ্ডকারণ্যে পাথুরে রুক্ষ জমি, বৃষ্টিপাত বিরল

অঞ্চলে  যেসব নদীর দেশের মানুষ গুলিকে পাঠানো হল তাদের মর্মান্তিক পরিণতি তো

আজ সকলেরই জানা। বিরোধী পক্ষে থাকাকালীন বামফ্রন্ট তাদের পশ্চিমবাংলায়

ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, যা শাসক হওয়ার পরে তারা অচিরে ভুলে যায়। তবু

তাদেরই কিছু মন্ত্রীর প্ররোচনায় দণ্ডকারণ্য থেকে ১৯৭৮-এ ফিরে আসা সুন্দরবনের

মরিচঝাঁপিতে উপনিবেশ গড়ে তোলা মানুষগুলি বামফ্রন্টের পরিকল্পিত দমননীতির

শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে ১৯৭৯-এ। তথাপি আগেই বলেছি বাংলাদেশ থেকে

নির্গমনের স্রোত অব্যাহত রয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগণা ও নদীয়ার প্রান্তবর্তী

অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত হাবড়া, গাইঘাটা, বনগাঁ, বাগদা, অথবা উত্তরদিকে মালদা,

বালুরঘাট ইত্যাদি অঞ্চলে অভিবাসী মানুষদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। ভোটব্যাঙ্ক

বাড়ানোর তাগিদে বহুসময় শাসকদল তাদের তোষণ করে, যদিও যথাযোগ্য সুবিধা বা

অধিকার কিছুই তারা পায়না।

                    গেইল তুরিনের বইটি দেখতে গিয়ে অনিবার্য ভাবে যে

প্রশ্নটি মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছিল তা হল এই ছিন্নমূল মানুষ তো সেভাবে স্থান

পেলনা বাংলার সামাজিক ইতিহাসে বা শিল্পসাহিত্যে? এই নির্যাতিত মানবতাকে

চিত্রায়িত করে কেন কালজয়ী বাংলা সাহিত্য রচিত হলনা বা কেন সাহিত্য নীরবতার

দ্বারা নিজেকে দরিদ্র করলো তার উত্তরে অনেক কবি সাহিত্যিক জানিয়েছেন যে

কোনও কোনও বীভৎসতা মানুসের কল্পনা শক্তিকে অসার করে দেয় তা এতই

“uniquely unique’ এবং ‘non narratable’। ঋতু মেনন ও কমলা ভাসিন তাদের

Borders & Boundaries গ্রন্থে বলেছেন,দেশভাগের কাহিনী ‘reverberate with things

unsaid’।আসলে পার্টিশন ভোলা যেমন শক্ত,মনে করা ততই বিপজ্জনক। আবার এ ও

দেখান হয়েছে যে একটি জন গোষ্ঠী যেখানে ‘ যৌথ দুর্ভাগ্যের’ কথা ভুলে থাকতে

চায়, সেখানে শিল্পী কিই বা করতে পারেন।দেশ ভাগের অনেক পরে ১৯৬৪ সালের

দাঙ্গা নিয়ে ‘The shadow Lines’লিখতে গিয়ে অমিতাভ ঘোষ জানাছেন যে এর

প্রতিটি ঘটনা নীরবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখা। এই নিরবতা স্মৃতির অসমৃদ্ধতাজনিত

নয়, দমনকারী রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া না, ‘it lies outside the reach of

my intelligence, beyond words –that is why silence must win, must

inevitably defeat me.’তাহলে যে ঘটনা প্রবাহের কোনও অর্থ হয় না, তা নিয়ে

কিছু বলাও যায় না। প্রশ্ন উঠেছে, জীবনধর্মী শিল্পী অবক্ষয়ের রূপকল্প কি রচনা

করতে পারেন? কারন “ এ যে স্বদেহ কণ্ডূয়ন করে স্বদেহ ভক্ষনের চিত্র”।

            তথাপি, নীরবতার কাছে আত্মসম্মান তো ‘surrender to cynicism’

তাই বরশার্ট, এলি হ্বিজেল, প্রাইমো লেভি, পল সেলানের মতো কবি ও লেখকরা

নৃশংসতার একটি ভাষা আবিষ্কারে উদ্যোগী হয়েছেন। বাস্তব দুঃস্বপ্নের ভয়ংকর

দিনযাপনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন এক নতুন ‘art of

atrocity’। তুরিনের ফটোগ্রাফ গুলি তাই সামাজিক ইতিহাসের একটা বড় ফাঁককে

পূরণ  করেছে। ভারতীয় সীমানার জিরো পয়েন্ট থেকে দেড়শ মিটার ভিতরে যে

স্থলভূমি, অতীতে কিন্তু তা ছিল বাংলার মানুষের দৈনন্দিন আদানপ্রদান ও চলাচলের

স্থান। এই দেয়ালের অথনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক প্রতিক্রিয়া তাই খুবই

মারাত্মক। শুধু দেশান্তরি মানুষের জন্যই নয়, বরং উভয় দেশের মানুষের

জন্যও।পুরো সীমান্তবর্তী অঞ্চলে - তা বাংলাদেশে হোক বা ভারতে, এই দেয়াল

মানুষের সামাজিক চলাচল ও স্বাধীনঅর্থনৈতিক কাজকর্মের অধিকার লঙ্ঘন করছে।

তুরিনের ক্যামেরায় উঠে এসেছে বি এস এফের হাতে নিগৃহীত এইসব জীবন মৃত্যুর

তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের বৃত্তান্ত। সেই বৃত্তান্তে  আছে ১৪ বছরের ফেলানি, যে

এক নতুন জীবনের আশায় কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে বি এস এফের গুলিতে প্রাণ

হারায়,আছেন মইজুদ্দীন, যিনি  নিগ্রহের পর আর ভালোভাবে হাঁটতে পারেননা, আছে

৩০ বছরের বাবুন যে ২০১২-তে গরু পাচার করতে গিয়ে বি এস এফ –এর ছোঁড়া

পাথরে থেতলে যায়, আছেন উত্তরবঙ্গের (লালমণিরহাট) থেকে ঢাকায় রাস্তা সারাইয়ে

কর্মরত এক সর্বস্বান্ত নারী যিনি বি এস এফ ও বি এস জি-র সংঘর্ষে আজ গৃহহারা।

শুধু নিগ্রহ বা অত্যাচার নয়, এই ছবিগুলো সামাজিক মনস্তাত্বিক অবক্ষয়ের এক

জীবন্ত দলিল হওয়া উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাচার হওয়া কাসির সিরাপ ফেনসিডিল

কিভাবে নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছে বাংলাদেশীদের, কিভাবে ধর্মীয় শিক্ষার মোড়কে ঢাকার

মাদ্রাসাগুলো শিশুদের নরম হৃদয়কে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করছে বা কিভাবে বাংলাদেশের

ভিতরেই সীমান্ত অঞ্চল থেকে উন্নত জীবনের আশায় ঢাকায় চলে গিয়ে হাজার হাজার

মানুষ মনুষ্যেতর জীবনযাপন করছে তার ছবি গেইল ক্যামেরাবন্দি করেছেন

অকুতোভয়ে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে।

         বইটি অনুবাদ করে অসিত রায় আমাদের কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন।

এই খণ্ড খণ্ড চিত্রের কোলাজ করে ঘটমান বর্তমান ও অদূর অতীতের  যে ভাষ্য

তিনি  আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন তাতে আবার মাথা নিচু করে উচ্চারণ করতে

হয়-‘ এ আমার , এ তোমার পাপ’।

                                       ...............শর্মিষ্ঠা নাথ

Tuesday 19 April 2016

ধর্মনিরপেক্ষতা------- মজিদ মাহমুদ ঃ সৌজন্য ;ঢাকা রিভিউ

ধর্মনিরপেক্ষতা : একটি অজ্ঞানকাণ্ডীয় আলোচনা

 সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৫ধর্মনিরপেক্ষতা : একটি অজ্ঞানকাণ্ডীয় আলোচনা২০১৫-১০-০১T১৬:২১:১৩+০০:০০
এমনকি কার্জনের বাংলাভাগকে উচ্চমধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিরা যেভাবে রুখে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, অথচ যখন চূড়ান্তভাবে দেশ বিভাগ হলো তখন সেই শ্রেণীর হিন্দুরাই বাংলামায়ের পক্ষচ্ছেদনের পক্ষে দাঁড়ালেন; এর মধ্যে যে তাৎক্ষণাৎ একটি শ্রেণী স্বার্থই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল। অথচ ইতিহাসে এই বাংলা একটি স্বাধীন ও বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে ছিল; শশাঙ্ক, সেন ও পাল আমলে তার যেমন গুরুত্ব ছিল, তেমনি স্বাধীন সুলতানি আমল ও বারভূইয়াদের আমলেও বাংলার নিজস্বতা খর্ব হয়নি; বাংলা একই সঙ্গে স্বর্গ ও নরক বলে বিবেচিত হয়েছে; যে সব বিদেশী পর্যটক এদেশে বেড়াতে এসেছেন তারা দেখেছেন, একটি দেশ অফুরন্ত খাদ্যের ভান্ডার, মাছ-মাংস ফল মূল সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, এসব সংগ্রহের জন্য অর্থের দরকার হয় না; আবার দিল্লি থেকে যারা শাসন করতে এসেছেন, গরম ও আদ্রভাবাপন্ন একটি দেশ, যাতায়াত ব্যবস্থা সর্বত্র নদীনালা দ্বারা বিভক্ত, ঘোড়া ছুটিয়ে খুব একটা যাওয়ার সুবিধা পাওয়া যায় না; তবু যারা একবার এসে পড়েছেন, তারা এই দেশটিকে ভালোবেসে ফেলেছেন, এই কুহুকিনিকে ছেড়ে তারা আর কোথাও যেতে চাননি, সুলতানি আমলের তুঘরিল-বোগরা খা, মোগল আমলের শাহসুজা থেকে অনেকেই এই তালিকায় রয়েছেন।
মজিদ মাহমুদ
এমন একটা গ্রামে আমার শৈশব কেটেছিল, সেটিই আমার জন্মস্থান; যেখানে একটি মাত্র পরিবার ছিল হিন্দু, যারা পুরো গ্রামের বয়স্ক ও শিশুদের চুলকেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন; অবশ্য জীবিকা শব্দটি তাদের জন্য মানানসই ছিল না, তারাই আসলে ছিলেন এই গ্রামের মানুষের মাথা ও চুলের শৈলি-নির্মাতা। স্বভাবত তারা আমাদের শিশুদের মাথাটা তাদের দুই হাঁটুর মাঝখানে চিমটার মতো শক্ত করে ধরে রেখে চুলকাটার কাজটি সেরে নিতেন; যদিও পদ্ধতিটি কষ্টকর তবু এর উপকারি দিক ছিলÑ মাথাটা হাঁটুর মধ্যে শক্ত করে ধরে থাকায়, ধারালো কাঁচি বা ক্ষুরের আঘাত থেকে রক্ষা পায়। একটি বৃহত্তর গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার লোকের চুল-দাড়ি তারা দক্ষতার সঙ্গে বংশপরম্পরায় কেটে আসছিলেন; এই সুবাদে তাদের যাতায়াত ছিল আমাদের পরিবারগুলোর উঠোন থেকে পাকঘর পর্যন্ত। যেহেতু শিশুদের চুলও তারাই কাটতেন, এমনকি মেয়ে-শিশুদের চুলও আট-দশ বছর পর্যন্ত তাদের সাইজ করে রাখতে হতো; আর এই সুবাধে বাড়ির মহিলাদের কাছেও তারা ছিলেন সমান প্রিয়; মাঝে-মাঝে তারাও তাদের চুলের আগা কেটে নিতেন, আড়ালে-আবডালে। দুই ঈদ বা শবে-বরাতে তাদের ব্যস্ততা যেমন বেড়ে যেতো, তেমনি বিয়ে বা খাতনার অনুষ্ঠানগুলোতে তাদের কাঁচির ঝনঝনানির সঙ্গে আনন্দ ঝরে পড়ত; সবচেয়ে মজা হতো, যখন তারা বিয়ের বর কিংবা খাতনার পাত্রের গোঁফে কিংবা মাথার চুলে একটি পোচ দিয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকতেন; অর্থাৎ এবার ছেলের মা-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে থেকে আনা-আধুলি-কড়ি না পড়া পর্যন্ত তার চুলকাটা শেষ হতো না। দুই ঈদ বা কোনো অনুষ্ঠানাদি ছাড়া তাদের চুল কামানোর সঙ্গে নগদার্থের কোনো সম্পর্ক ছিল না; বর্ষার শুরুতে আউশ কাটার মৌসুমে, আর শীতের শেষের রবিশস্য মাড়াইয়ের সময়ে তারা বস্তা নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে প্রতিটি বাড়ি থেকে তাদের মজুরি আদায় করে নিতেন; অবশ্য এটি হতো একটি পারষ্পারিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে; কাউকে কখনো বলে দিতে হতো না, তাদের কি পরিমাণ শস্য দিতে হবে, কিংবা তারা নিজেরাও কখনো অতিরিক্ত দাবি করেছেন বলে শোনা যায়নি। এই ব্যবস্থা কেবল তাদের জন্যই চালু ছিল না, যারা নদী পারাপার করতো, লাঙল বাধত, কামার বা কুমোরের কাজ করতো, চিকিৎসা দিতো সবার জন্যই ছিল একই ব্যবস্থা; তবে আমাদের গ্রামে চুল-মেরামত ছাড়া আর সকল কাজের সঙ্গে মুসলমানরাই জড়িত ছিলেন; পেশার ধরনের কারণে কাউকে গ্রামের মধ্যে বড় বা ছোট শ্রেণীভুক্তির বিষয়টি তখনো আমাদের গোচরে আসেনি।
যদিও এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে, পেশাগত শ্রেণী আদিকাল থেকে মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করে দিয়েছে। অবশ্য আমাদের গ্রাম থেকে একক্রোশ উত্তরে গেলে, সেখানে হিন্দু বসতির ঘনত্ব ছিল কিছুটা বেশি; যেখানে শিক্ষকতা ও উচ্চতর পেশাবৃত্তির সঙ্গে তারা জড়িত ছিলেন; অনেককেই আমি দেখেছি, শাদা পাঞ্জাবি ও শাদা ধূতি পরিহিত পরিপাটি মানুষ, গ্রামের লোক যাদের বাবু বলে ডাকতেন, এবং বেশ সমিহ করে কথা বলতেন; এই ঘটনাগুলো দেশ-স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল; আশির দশকের শুরুতে এটি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়; তার অর্থ কি এমন; পাকিস্তান শাসনের সময়কাল পর্যন্ত এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে বসবাস করেছিলেন! দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান কি তাদেরর সামাজিক কাঠামো ক্ষুণœ করতে পারেনি, কিংবা করতে চায়নি! ধর্মে বিভক্ত পাকিস্তানের এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম সামাজিক কাঠামোর কিরূপ পবির্তন হয়েছিল, তার কোনো গবেষণা আমার কাছে নেই। তবে ভারত বিভাগের ফলে দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পূর্বের সামাজিক কাঠামোর মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়েছিল বলে বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই। তার হয়তো একটি কারণ হতে পারে, কেন্দ্রিয়ভাবে মুসলিম জাতীয়তাবাদি রাষ্ট্র গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা থাকলেও বাঙালির দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও সমাজ কাঠামো তাকে পরিবর্তন করতে বাধা দিয়েছে; পাশাপাশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের পর থেকে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিজেদের আলাদা জাতি বলে প্রবলভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে; তার প্রধান উপাদান ছিল ভাষা; এবং বাংলা ভাষার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উপাদান হিন্দু উপাদান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো উপায় ছিল না; তারচেয়ে বড়, দীর্ঘদিনের একত্রে বসবাসের অভিজ্ঞতা তাদের অপর বলে চিনতে সহায়তা করেনি। দুটি ধর্মের মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের ছিন্ন রক্তের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ খোলা না থাকলেও প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকে একটি ভাষিক সম্পর্ক দ্বারা যুক্ত ছিল; কাকা, জ্যাঠা, ফুপু, মা, মাসি খালাÑ এ ধরনের সম্পর্কগুলো রক্তের সম্পর্কের বাইরেও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল; এবং পাশাপাশি বসবাসের ফলে এই সম্পর্কগুলো এতই সুদৃঢ়ভাবে হাজির থাকতো যে, আখেরে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না; এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা বংশ পরম্পরায় একই সম্পর্কের ঐতিহ্য নিয়ে বেড়ে উঠতো। আর এই সম্পর্কের উপযোগিতার স্থায়িত্বের অন্তরালে ছিল পেশাভিত্তিক শ্রম-বিভাজন; প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক দ্বারা যুক্ত ছিল; যতদিন না পেশার বন্ধনগুলো শিথিল এবং পরিবর্তিত হয়েছে; কিংবা অন্যকোনো কৌশলের কাছে পরাভূত হয়েছেÑ ততদিন পর্যন্ত ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক সমস্যাগুলো রক্তপাত কিংবা ঘৃণার বস্তু হিসাবে বিবেচিত হয়নি। যদিও সামজিক এই বন্ধনগুলোর মধ্যেই ছিল একটি হীন ও বশ্যতা আদায়ের প্রক্রিয়া, তবু সম্প্রতি উদ্ভূত নবীন সমস্যাসমূহের অনেকখানি ততকালে মোকাবেলা করতে হয়নি।
একটা সময়ে ভারতবর্ষে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ধারণার যুগ; গ্রামীণ সমাজের বাইরে মানুষকে জীবিকার জন্য তেমন কোথাও যেতে হতো না; জীবন ধারণের প্রায় সকলবস্তু সেখানেই উৎপাদিত হতো; যে বস্তুসমূহ তারা উৎপাদন করতে পারতো না, তার অধিকাংশ আশেপাশের গ্রামের সমবায়ী হাটের মাধ্যমে অনেকটা বিনিময় প্রথার মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন; রাজা বা জমিদারের খাজনা মিটিয়ে দিলে তাদের আর কোনো ঝামেলা থাকতো না; সমস্ত গ্রামও প্রায় একটি পারিবারিক ব্যবস্থার মতো ছিল; সেই সঙ্গে ছিল তাদের সামাজিক শ্রমের অভিজ্ঞতা; এবং ছিল একটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ; যারা বিবাদ মীমাংসায় মধ্যস্থতা করতে পারতেন। আসলে এই গ্রাম ব্যবস্থাই ছিল একটি ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র। এমনকি এসব গ্রামগুলোতে ছিল একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রত্যেকে পারিবারিকভাবে ছিল আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, মেয়েরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকতেন না; বাইরে থেকে আসা ছোটখাটো আক্রমণ তারা ঠেকিয়ে দিতে পারতেন। এ ধরনের রাষ্ট্রের একটা সুবিধা থাকে, নিচ থেকেই তা টেকসই রূপ নিয়ে বেড়ে ওঠে; রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রিয় ব্যবস্থা থেকে তাকে খুব বেশি সহায়তা দিতে হয় না; এর পরবর্তী পদক্ষেপগুলো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে; যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকে; কিন্তু এই পদ্ধতির সঙ্গে কেন্দ্রিয় ব্যবস্থা ও রাজনীতি জড়িত থাকার ফলে স্থানীয় লোকজন সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন না; যারা এই সব কাজে দক্ষ ছিলেন তারা কেন্দ্রিয় ইচ্ছের কাছে পরাস্ত হয়ে পড়েন। সম্পূর্ণ গ্রামধারণার যুগে ধর্ম ও বর্ণের নামে সংঘাত হওয়ার সুযোগ কম ছিল, কারণ প্রত্যেকেই পেশা দ্বারা পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল; রাত পোহালেই মাছের জন্য জেলের কাছে, তৈজসপত্রের জন্য কুমারের কাছে, অস্ত্রের জন্য কামারের কাছে ছুটতে হতো; তবে এর দ্বারা এই সব পেশার প্রান্তিক অবস্থার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না।
সে যাই হোক, আমি যে নাপিত পরিবারের কথা বলতে ছিলাম, তারা আশির দশকের শুরুর দিকে তাদের বংশপরম্পরায় বাস্তুভিটা ত্যাগ করে গোপালগঞ্জ জেলার কোনো একটা উপজেলা সদরে নতুন করে আবাস গড়ে তোলেন। বর্তমান সময়ে এসে এই প্রশ্নটি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, কেন তারা তাদের পূর্বপুরুষের আবাস ছেড়ে একটি অচেনা আজানা পরিবেশে নিজেদের নিয়ে গেলেন। অবিভাসন মানুষের একটি সাধারণ প্রক্রিয়া, মানুষ আদিকাল থেকে অবিভাসনের মাধ্যমে নিজের জীবন যাপনকে অধিকতর নিরাপদ ও সহজ করতে চেয়েছেন; তবু মানুষ পরিণামে একটি শিকড়বিহীন বৃক্ষÑ যেখানেই সে যাক না কেন, ঘুরে ঘুরে সে তার জন্মস্থানের কাছে, তার ডাইলেক্টেসের কাছে, তার শৈশবে বেড়ে ওঠা মানুষজনের কাছে ফিরে আসতে চেয়েছেন। আমি এই লেখাটা শুরু করেছিলাম এই জন্য যে, সেই অবিভাসি হিন্দু পরিবারটির বর্তমানের প্রবীণ সদস্য, যার বয়স এখন আশি বছর অতিক্রম করছে, সেই গিরেন্দ্রনাথ, তিরিশ বছরের ব্যবধানে জীবনের শেষপর্বে এসে প্রায়ই তার ফেলে যাওয়া গ্রামে বেড়াতে আসেন; এবং তার পরিত্যক্ত ভিটের কাছে বসে থাকেন; এবং পরিচিতদের সঙ্গে বসে দুটি কথা বলতে খুবই আকুলতা পোষণ করেন; এ ধরনের মনস্তত্ব কোনো নতুন নয়; এটা রবীন্দ্রনাথে দুই বিঘা জমির উপেন হোক, আর ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভূমি হোক সকল কিছুর জন্য প্রায় একই ধরনের চেতনা কাজ করে থাকে। কিন্তু গিরেন কি জন্য তার ভিটে ছেড়ে গিয়েছিলেন, তার উত্তরে যা জানা যায়, তাহলো নিরাপত্তহীনতা, অপরিচয়ের ভয় এবং পেশা হারানো একই সঙ্গে তার জন্য ঘটে গিয়েছিল।
সাতচল্লিশের বিভাজনের পরে পাকিস্তান হয়েছিল বা হয়নি তারা বুঝতে পারেননি; যদিও অনেকেই তখন এলাকা ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু যারা ছিলেন তারা প্রতিবেশিদের সঙ্গে আত্মীয়তা ও কর্মের বন্ধনে থেকে গিয়েছিলেন; এবং নিজের আঙিনাতে একটি শীলগ্রাম প্রতিষ্ঠা করে পূজামণ্ডপেরও ব্যবস্থা করেছিলেন; ঘরের বৌ-ঝিরা পূজাম-প ও তুলসি তলায় জল ছিটিয়ে নিজেদের প্রেতলোকের কাজটি সমাধা করতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই একটি বড় পরিবর্তন তারা লক্ষ করলেন; প্রথমত যে পাকিস্তান হিন্দু-সম্পত্তিকে শত্রুতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তারা যাওয়ার পরে যেন এই চেতনা স্বাধীন দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে দেখা দিল; তারা যে হিন্দু তারা যে আলাদা তা গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন; আর এটি প্রবল হয়ে উঠলো তখন, যখন ওই গ্রামের হাটের ওপর একটি আধুনিক মানের সেলুন ঘর গড়ে উঠলো; তখন অনেকেই বলতে শুরু করলো হিন্দুর কাছে চুল-দাড়ি কাটলে নাপাকি যায় না, অনেকেই এককাঠি এগিয়ে গিয়ে বলল, পবিত্র দাড়িমোবারকে হিন্দুর ছোঁয়া লাগলে নামাজ হবে না; আর এই সব প্রচারণার সঙ্গে নব-প্রতিষ্ঠিত সেলুনের খরিদ্দারের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল; এমনকি এতদিন যারা এবং যাদের বাপদাদারা গিরেনের বাপ তুষ্টনাপিতের কাছে বংশপরম্পরায় চুলদাড়ি কেটে আসছিলেন তারাও প্রকাশ্যে আসতে সাহস হারিয়ে ফেললেন; এবং অজানা কারণেই দেখা গেল গ্রামের বয়স্কদের সঙ্গে যে সম্পর্কে তারা আবদ্ধ ছিলেন নতুন প্রজন্ম কেন যেন তাদের কাছে এবং তাদের সন্তানদের কাছে অপরিচয়ের হয়ে উঠলেন। যদিও এ গ্রামে আগে থেকে মুসলমানদের মধ্যেও, বিশেষ করে নানা মাজহাব এবং আমিন জোরে বলা, কিংবা দোয়াললিন অথবা জোয়াললিন বলাকে কেন্দ্র করে দু একবার খুনাখুনি পর্যন্ত গড়িয়েছে; কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানÑ এ ধরনের ধর্মীয় বিভাজনে তাদের মধ্যে কোনো কোন্দল কখনো হয়নি। তাছাড়া এই পরিবারটির পাশের বাড়ি, যারা ছিল সুখ-দুঃখের সাথী, তাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কেমন যেন একটি অসহিষ্ণুভাব এবং যখন-তখন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে মেয়ে-বৌদের অপ্রস্তুত করে তোলার প্রবণতাও বেড়ে গেল; তখন আর এ গ্রামে থাকা তারা নিরাপদ মনে করেননি; আসলে প্রতিবেশির ছেলেদের জন্য যখন নতুন করে ঘর ও বাড়ি তৈরির প্রশ্ন দেখা দিল, তখনই এই হিন্দু পরিবারের জমিটি তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল; এ ক্ষেত্রে ধর্ম তাদের কিছুটা সহায়তা করল বই কি? কিন্তু এই পরবারটির এমন কোনো অবস্থা ছিল না, চাইলেই পাশ্ববর্তী হিন্দু রাষ্ট্রে গমণ করে ধর্মের দ্বারা আত্মীকৃত হতে পারেন; যাদের এ ধরনের সুবিধা ছিল না আশির দশকের শেষাবধি তারা শহরে, কিংবা যে সব এলাকায় হিন্দু-বসতি অপেক্ষাকৃত ঘনবদ্ধ সেই সব স্থানে অবিভাসন করেছেন। তবে সাতচল্লিশের পর থেকে যে একটি বড় অংশ ভারত গমণ করেছেন তাতে সন্দেহ নাই; আর এটি এই জন্যই সম্ভব হয়েছে যে তিনদিকে ভারতবেষ্টিত একটি বৃহত্তর দেশ যেখানে ধর্মের বাহ্যিক সহানুভূতির সঙ্গে স্থানের সুপ্রতুলতাও রয়েছে; শতকোটি নাগরিকের দেশে এক বা দুকোটি লোককে আত্মীকরণ করা খুব একটা শক্ত কিছু নয় বলেই আপাতভাবে মনে করা যায়, যদিও বাস্তবতা হয়তো তা নয়।
সম্প্রতি মদিজি এই সব হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নিজেদের মূলধারায় মিশে যেতে অনুমতি দিয়েছেন; বাঙালি মুসলমান সেই সুবিধা পাবে না; যদিও তাদের পিতা না হলেও পিতামহদের একই দেশ ছিল ইংরেজ বাহাদুরের অধীনে, কিংবা পরাক্রান্ত মোগলের সাম্রাজ্যে। এই যে বিভাজনটা যে হয়ে গেল গত শতকের সাতচল্লিশে তার দায়-দায়িত্ব এখন কাদের ওপর বর্তাবে? দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যদিও দেশ বিভাজন হয়েছিল, তবু এই বিভাজন তো কেবল বাড়ির পুবদুয়ার বরাবর বেড়া তুলে দিলেই সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল না; এর জন্য এমন কি তাড়া ছিল যে যেদিকে শতকরা একান্ন জন মুসলমান সেদিকে মুসলমানরাষ্ট্র আর যেদিকে একান্নজন হিন্দু সেদিকে হিন্দু রাষ্ট্র; তাহলে উন-পঞ্চাশজন মুসলামনকে কি বলির উপযুক্ত হয়ে তৈরি হতে হয়েছে; এই ধর্মীয় গণতন্ত্রায়নের নির্মম উদাহরণ আর ইতিহাসে হতে পারে না। মুসলমান নেতাদের পক্ষে দেশ বিভজান যে একটি জাতীয় আত্মহত্যার শামিল, তা কেবল অর্বাচিনদের পক্ষেই ভাবা সম্ভব ছিল; এক ভারতের পক্ষেই মুসলমানদের আর্গুমেন্ট যথাযথ ন্যায়সম্মত ও আদর্শিক হতে পারতো; কিছু বিবেচনা কিছু উপবিবেচনা সামনে রাখলেই তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হওয়ার কথা ছিল; যে মুসলমানরা একটানা প্রায় আটশত বছর ভারত উপমহাদেশ শাসন করলেন; এবং তাদের হাত থেকেই ইংরেজ ক্ষমতা নিলেন; অথচ ইংরেজ চলে যাওয়ার প্রাক্কালে কিভাবে তারা একটি খণ্ডিত ভারতের ক্ষুদ্রাংশ নিয়ে তার জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, তারা যা পেয়েছে তা যথেষ্ট এবং এতটুকু না পেলে পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যেতো। কিন্তু মুসলমানরা তো সবকালেই এ দেশে সংখালঘুই ছিল, কিন্তু শাসনতন্ত্রের ক্ষেত্রে তো তাদের ধারাবাহিকতার ইতর বিশেষ হয়নি; এবং ইতিহাস তো এটিই বলে সংখ্যালঘুরাই মূলত দুনিয়াটাকে শাসন করে থাকেন; সুতরাং সংখ্যার ওপরে শাসনতন্ত্র নির্ভর করে না। তাছাড়া যে বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগণ তাদের দৃষ্টিতে যারা ছিল শত্রু সেই হিন্দুদের জিম্মাদারিতে রেখে গেলেন, তারা কিভাবে মুসলিম হিতৈষী হতে পারেন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে এসবের কিছুই হয়নি, হিন্দু রাষ্ট্র বলে যেটি হিন্দুস্থান হলো আর মুসলিম রাষ্ট্র বলে যেটি পাকিস্তান হলো, তাদের উপরিতলের প্রচারণা ভিন্ন রাষ্ট্রীয় চরিত্রের কোনো পার্থক্য থাকলো না; হিন্দু বা মুসলিম হওয়ার জন্য তাদের পূর্বের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হলো না; দুটি রাষ্ট্রই মূলত তাদের ধর্ম-নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় বা সমুন্নত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করলো, সেটি নেহেরু কিংবা জিন্নাহ দুজনের কর্ম এবং বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে যথাযথভাবে ধরা পড়বে; সুতরাং এই যে বিভাজন তা মূলত একটি জনহিতকর চেতনা থেকে সাধিত না হয়ে, নেতৃত্বের খায়েস থেকে সংগঠিত হয়েছিল বলে মনে করা যায়। কিন্তু ক্ষতি যা হলো তা হলো এই হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য অন্তত নৈতিকভাবে দুটি দেশ আলাদা হয়ে গেল; এবং সর্বদাই তাদের জনগণের কাছে একটি নতুন প্রকল্প তুলে ধরতে হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে সেটি কসরত করতে হলো, আর তার নাম দেয়া হলো ধর্মনিরপেক্ষতা; এই ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে যথেষ্ট মূল্যবান এবং ধারালো অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হলো; অথচ এই পরিভাষার বাইরেই এই অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ও গোত্রের সঙ্গে একত্রে বসবাসের এক গভীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন; তার জন্য আলাদাভাবে তাদের ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার হওয়ার দরকার হয়নি। তারা তাদের নিজেরদের মানুষের সঙ্গে বসবাসের দ্বারা এই অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন, যেভাবে মানুষ বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত হয়ে, একই সমাজে বসবাস করে, অথচ তাদের মধ্যে কতই না পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই প্রশ্নটি আমাকে গভীরভাবে ভাবিত করে, সত্যিই কি বিভাজন-প্রকল্প মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য চালিত ছিল; নাকি নেতৃত্বের বলি খেলার অংশ হিসাবে, আর ইংরেজ প্রভুদের দূরদৃষ্টিতায় সম্পন্ন হয়েছিল; ধরে নেয়া গেল, সাতচল্লিশে অবিভক্ত ভারত স্বাধীন হয়েছে আওরঙ্গজেবের বিজিত সা¤্রাজ্যসহ তাহলে ভারতরাজ্য হিসাবে আর মুসলমানরা জাতি হিসাবে কোথায় দাঁড়াতো; পৃথিবীর প্রায় অর্থেক মুসলমান তখন এই একটি মাত্র দেশে বাস করতেন; এবং শক্তিশালী ভারতের অবস্থানের কারণে আজ সারাবিশ্বো মুসলমান যে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছে, তা নাও হতে পারতেন; কিংবা সর্বদা একটি দরকসাকসির অবস্থানে থাকতেন। আর যে কল্পিত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কথা বলা হয়, তা ঐতিহাসিকভাবে ধোপে টেকে না; কারণ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা বলা হয়, তা কেবল বিভাগোত্তর বিভাজনের দাবির কারণে সংগঠিত হয়েছে; আর বিভাজনের ফলে ভারত পকিস্তানের মধ্যে প্রায় গোটা তিনেক বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, অসংখ্য লোকক্ষয় হয়েছে, সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে; প্রচুর সেনামোতায়েত রাখা হচ্ছে; প্রতি বছর দেশগুলোর বাজাটে বিশাল অংকের সামরিক ব্যয় রাখা হচ্ছে; এবং সাধারণ মানুষের নিরুদ্বিগ্ন উন্নয়নের পরিবর্তনে অনিশ্চিত শঙ্কায় জীবনপাত হচ্ছে। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সংঘাত এড়ানোর জন্য এই বিভাজনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বলে মনে করা হয়, তার লাভের আশায় গুড়েবালি। তবে এটি ভাবার কারণ নাই যে, ঔপনিবেশিক আমলে দুটি জাতি বিভাজিত হওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ ছিল না; এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য, মুসলিম ও ইংরেজ শাসনামলে হিন্দু মুৎসুদ্দি শ্রেণীকে ঠিক একই কাজ করতে হয়েছিল, যার একটি হলো শাসন সহযোগী করণিকতা; যার জন্য অফিস আদালতে কাজ করার উপযোগী একাডেমিক শিক্ষায় তারা এগিয়ে ছিলেন, সে ফারসি হোক বা ইংরেজি হোক তাদের জন্য কোনো ইতর বিশেষ হয়নি; কিন্তু ইংরেজের শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে মুসলমানদেরও ঠিক একই প্রতিযোগিতায় নেমে আসতে হলো, কিন্তু শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবে প্রতিযোগিতায় এটে ওঠা সহজ ছিল না; আর এরই ফলাফল বাংলাভাগে কার্জনের যৌক্তিক অবস্থান; বঞ্চিত মুসলমানদের এই সাময়িক প্রাপ্তিকে ছোট করে দেখার সঙ্গেও ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করা হয়; কিন্তু একটি দেশের অধীনে প্রশাসনিক বিভাজন আর চূড়ান্ত পর্বে দেশ হিসাবে আলাদা অস্তিত্বে আসা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ইংরেজের বিভাজনের শাসননীতি কেবল তাৎক্ষণাত উদ্ভূত পরিস্থিতি শামাল দেয়ার জন্যই প্রবর্তিত ছিল না; আখেরে তাদের গতায়নের পরেও যাতে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রসত্তার জন্ম দ্বারা বৃহত্তর জাতীয়তাবাদের শক্তি খর্ব হয়, এ পরিকল্পনাও অমূলক নয়। বাংলা বিভাজনের সেই শুরুতেই, প্রায় একশ বছর আগে এর পক্ষচ্ছেদনের কর্মটি সম্পন্ন হয়েছিল; যে সুবে বাংলা মুসলমানরা শাসন করতো, সেই মুসলমানরাই কিছু অংশের সংখ্যাধিক্যের দাবিতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দাবি ছেড়ে দিয়ে কেবল কর্তিত বাংলার অধিকার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন; পরিণামে বাংলামায়ের যে পক্ষচ্ছেদন হয়, তাতে চিরদিনের জন্য দুপায়ের হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে; এবং মূলবাংলা থেকে উপবাংলার উড়িষ্যা, বিহার, আসাম, ছত্রিশগড়, চ-িগড়, ছোটনাগপুর ও ত্রিপুরা চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; বাংলার এই সবগুলো অঞ্চল একত্রে থাকলে চিনের মান্দারিন ছাড়া আর কোনো বৃহত্তর জাতি বাঙালিদের সমান হতো না; সুতরাং শুরু থেকেই বাঙালিদের যৌক্তিকতা এটিই হতে পারত যে, দেশ যদি স্বাধীন হতেই হয়, তাহলে এই বিশাল বাংলা নিয়েই তার আয়োজন হতে হবে।
হয়তো বিভাজনের এই সময়কালে বাঙালিরা এই জাতের কোনো নেতা পয়দা করতে ব্যর্থ হয়েছিল, যে তাদের জন্য দীর্ঘকালের ফলদবৃক্ষ রোপন করতে পারবেন। সেটি হিন্দু ও মুলমান উভয় বাঙালির জন্যই সত্য; এমনকি কার্জনের বাংলাভাগকে উচ্চমধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিরা যেভাবে রুখে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন, অথচ যখন চূড়ান্তভাবে দেশ বিভাগ হলো তখন সেই শ্রেণীর হিন্দুরাই বাংলামায়ের পক্ষচ্ছেদনের পক্ষে দাঁড়ালেন; এর মধ্যে যে তাৎক্ষণাৎ একটি শ্রেণী স্বার্থই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল। অথচ ইতিহাসে এই বাংলা একটি স্বাধীন ও বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে ছিল; শশাঙ্ক, সেন ও পাল আমলে তার যেমন গুরুত্ব ছিল, তেমনি স্বাধীন সুলতানি আমল ও বারভূইয়াদের আমলেও বাংলার নিজস্বতা খর্ব হয়নি; বাংলা একই সঙ্গে স্বর্গ ও নরক বলে বিবেচিত হয়েছে; যে সব বিদেশী পর্যটক এদেশে বেড়াতে এসেছেন তারা দেখেছেন, একটি দেশ অফুরন্ত খাদ্যের ভান্ডার, মাছ-মাংস ফল মূল সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, এসব সংগ্রহের জন্য অর্থের দরকার হয় না; আবার দিল্লি থেকে যারা শাসন করতে এসেছেন, গরম ও আদ্রভাবাপন্ন একটি দেশ, যাতায়াত ব্যবস্থা সর্বত্র নদীনালা দ্বারা বিভক্ত, ঘোড়া ছুটিয়ে খুব একটা যাওয়ার সুবিধা পাওয়া যায় না; তবু যারা একবার এসে পড়েছেন, তারা এই দেশটিকে ভালোবেসে ফেলেছেন, এই কুহুকিনিকে ছেড়ে তারা আর কোথাও যেতে চাননি, সুলতানি আমলের তুঘরিল-বোগরা খা, মোগল আমলের শাহসুজা থেকে অনেকেই এই তালিকায় রয়েছেন। এর ফলে বাংলা একটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির জনগোষ্ঠী উপহার দিতে পেরেছিল, যা অন্য কোনো অঞ্চলের মুসলমান কিংবা হিন্দু কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় জাতপাত সম্প্রদায়ের বাইরে একটা নতুন ধরনের দর্শন ও ধর্ম চেতনার অংশ হিসাবেই তার বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু ইংরেজ শাসনের অভিঘাতে বাঙালির হয়ে ওঠার চেতনপ্রক্রিয়া প্রথম বাধাগ্রস্ততা তৈরি হয়; প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের চিন্তার বিনিময় তাকে ধর্মীয় আত্মীকরণের জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে শুরু করলো; ব্যক্তিগত ধর্মবোধের চেতনার বাইরে রাজনৈতিক ধর্মচেতনার উদ্ভব হলো; রাজার মানুষদের মধ্যেও এর একটি সযতœ প্রয়োগ দেখা যেতে শুরু করল। অবশ্য ভারতীয় রাষ্ট্রচেতনার মধ্যেও ধর্ম অনুপস্থিত ছিল না; অশোক থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত সকলেই তা ব্যবহার করেছেন; আকবর ধর্মের একটা সেকুলার রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন; যদিও তার প্রয়োগের মধ্যে নতুন একটি ধর্মীয় আবহ তৈরি করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল রাজার ধর্ম দীনইলাহি, যে সব বিষয় মুসলমান বা হিন্দুর কাছে পরষ্পর বিরোধী তিনি তার একটা সমন্বয় দ্বারা হিন্দু প্রজাগণকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন, ধর্মের কারণে অন্তত কেউ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে না; হিন্দু বেগমদের জন্য ঠিকঠাক মতো পূজাগৃহগুলো সংরক্ষিত হয়েছিল; এমনকি তাদের গর্ভে ভবিষ্যতের মোগল রাজাদের জন্মও হয়েছিল। যদিও আকবরের ভারত শাসননীতিতে ধর্মের ব্যবহার ঘটেছিল; তবু বলা চলে এটিই হয়তো ইউরোপীয় চেতনার আগের সেকুলার রাষ্ট্রভাবনার প্রকাশ। কিন্তু এই চেতনা স্থায়ী না হওয়ার কারণ, জনগণের সঙ্গে এই চিন্তার কোনো বোঝাপড়া সম্পন্ন হয়নি; যেটি ইউরোপের আলোকায়ন কিংবা ফরাসি বিপ্লবের ফলে জনসম্পৃক্তির মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। ইউরোপে ব্লাসফেমির মতো আইন অব্যাহত থাকার পরেও তারা রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করতে পেরেছিল। ধর্ম প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়েছিল; রাষ্ট্র নাগরিকদের ভালোমন্দের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো ব্যবস্থাপত্র সামনে আনবে না। অবশ্য এর আগে এমন সব বিষয়ের তারা ফয়সলা করতে পেরেছিল, তাহলো এমনÑ বাইবেলের বাইরেও অভ্যন্তরীণ এবং দেশের বাইরে রফতানিযোগ্য বুদ্ধি ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তাশীল উপাদান; যেমন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, কিংবা মানুষ বিবর্তনের ফল;Ñ সাধারণ মানুষের কাছে যদিও এই সত্য প্রায় ধর্মের মেটাফরের মতো, কারণ কোনো বিজ্ঞানিক প্রমাণাদি ছাড়াই সেগুলো তাদের মেনে নিতে হয়; এবং এমন সব বিষয় যা এখনো মীমাংসিত হয়নি, সত্যিই মানুষ বানর জাতীয় প্রাণী থেকে উদ্ভূত; নাকি স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক পুরুষ ও নারীর গর্ভ থেকে তারা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়; এর সঙ্গে যদিও দুনিয়ায় বেঁচে থাকা জীবনের কিছু এসে যায় না, তবু যখন পৃথিবীর জীবনের কর্মের ওপর মৃত্যু-উত্তর অনন্ত জীবনের ভালো থাকা নির্ভর করে, তখন তো আর অনেকেই অল্প-দামে মরজীবনকে বিক্রি করতে চাইবে না; যেহেতু ধর্মে নির্দেশ আছে, কি ধরনের কর্ম-সম্পাদন করলে তারা কি ধরনের একটি অনন্ত আনন্দময় জীবন যাপন করতে পারবেন। যদিও ধর্মের অনেকগুলো অনুশীলন ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদন করা যায়, আবার অনেকগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে; বিশেষ করে বর্তমান সময়ে এসে কেবল মুসলিম দুনিয়ায় নয়, খৃষ্টান দুনিয়াতেও গর্ভপাত, সমলিঙ্গের বিয়েসহ নানা ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে; এর বাইরে মুসলিম দুনিয়ায় আছে ব্যাংকিং ও সুদব্যবস্থা, মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও মেয়েদের ড্রেসকোড নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্কÑ এসবও রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে হয়। সুতরাং ধর্ম নিরপেক্ষকতা ও রাষ্ট্র একটি জটিল সম্পর্কের দ্বারা আবদ্ধ।
ভারত মহাদেশ যদিও ধর্মের দ্বারা বিভাজিত হয়েছিল; কিন্তু অচিরেই ধর্মনিরপেক্ষ একটি চরিত্র ধারণের চেষ্টা করে আসছিল; ভরতের ক্ষেত্রে তো ছিলই, নেহেরুর অব্যাহত প্রচেষ্টার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সারবস্তু অন্তত চিন্তা ও প্রচারে ছিল; পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে না হলেও পাকিস্তানের প্রথম আইন বিষয়ক মন্ত্রী যোগেন ম-লসহ দলিত নেতাদের পাকিস্তান সমর্থনের মধ্যে এই সত্য প্রমাণ করে, বাইরে ধর্ম-নিরপেক্ষ মোড়ক না থাকলেও রাষ্ট্রের মূলচরিত্র ধর্ম-নিরপেক্ষ। কিন্তু পরিণামে এই যুক্তি দেয়া খুব কঠিন যে, পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ছিল; আর এ প্রমাণ করতে চাওয়া উদ্ভটও বটে। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষতার বাইরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই দাবি জোরেসোরে ছিল যে, এতে নি¤œশ্রেণীর হিন্দুরাও সুবিধা পাবে; কিন্তু পরিণামে কেবল হিন্দু নয়, বাঙালি মুসলমানরাও বঞ্চনার শিকার হন। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক চেতনার সীমাবদ্ধতাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। নবগঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যে চারটি মূলনীতির ওপর নির্মিত হয়েছিল তার অন্যতম ছিল ধর্ম-নিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রীয় ধর্ম -নিরপেক্ষ নীতি আর প্রকৃতপক্ষে ধর্ম-নিরপেক্ষতার চর্চা এক নয়, কিংবা সম্ভব নয়, তা কিছুদিনের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে; প্রথমত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মমতের প্রতি প্রশ্রয় প্রদর্শন ছাড়া ভোট কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; ফলে অপর একটি আদর্শ দ্বারা নিগৃহীত না হওয়া পর্যন্ত চলমাল মূল্যবোধের সবটার সঙ্গেই কৌশলগত সম্পর্ক শাসককুলকে রেখে চলতে হয়। সুতরাং সংবিধান ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও, এই মতের দাবিদার দলটিকেও এই ভেবে জনগণের সমিহ আদায় করতে হয় যে, তারা ইসলামের জন্য কতখানি করেছেন, কিংবা ইসলামি দেশগুলোর সঙ্গে কতখানি সম্পর্ক রক্ষা করে চলছেন, এসবই জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অকুণ্ঠ সম্মানবোধ, যদিও এসবই বহিঃসম্পর্কের ব্যাপার। রোমান কনসটান্টিপোল ধর্ম না মেনেও রাষ্ট্রীয়ভাবে খৃষ্টানধর্মের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে মূলত জনগণের ইচ্ছের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছের দ্বারা রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার সম্মতি আদায় করে থাকেন।
ফলে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতি জোর দেয়া হলেও পাকিস্তান আমলের অধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে আলাদাভাবে ক্রিয়া করেনি; বরং ধর্ম-নিরপেক্ষতা ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে প্রতিপক্ষ হিসাবে হাজির হয়েছে, কেবল আলাদাভাবে স্বীকৃতি থাকার কারণে। এতদিন হিন্দু-মুসলমান দুটি আলাদা জাতি হিসাবে স্বীকৃত থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় পক্ষ বলে আলাদা কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল না; অথচ সেই অস্তিত্বই বড় হয়ে বিশাল ধর্মীয় পক্ষ হিসাবে রূপ লাভ করে; এবং স্বাধীনতার স্থপতি সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অকার্যকর তবু শোভন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিরও অবসান ঘটানো হয়; এবং এটি করে জাতীয় সিম্বলের মতো ইসলামকে জাতীয় ধর্মের স্বীকৃত দেয়া হয়; এটি যদিও এমন কিছু নয়, একটি দোয়েল পাখিকে জাতীয় পাখি করার অর্থ এই নয় যে আর কোনো পাখির অস্তিত্ব দেশে নাই, কিংবা তাদের গুরুত্ব কম রয়েছে। তারপর শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি, যা ইসলামি পাকিস্তানে দরকার হয়নি; ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর অবাধ রাজনীতি করবার সুযোগ, এসবই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু একটি প্রশ্ন তলিয়ে দেখা হয়নি যে, আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির কোনো সুযোগ আছে কিনা? এ দেশে সেকুলার হওয়ার পেছনে প্রধানত হিন্দু ও মুসলিম দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অবৈরিপূর্ণ বসবাসের রাষ্ট্রীয় মনেবৃত্তি বোঝানো হলেও সংবিধানের আওতায় কোনো হিন্দু ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না, যেমনটি জামায়াতে ইসলামি কিংবা অপরাপর মুসলিম দলের অস্তিত্ব রয়েছে; তাহলে এই প্রণোদনার পেছনে যে একটি ভোটের রাজনীতি রয়েছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, এদেশে হিন্দুধর্মের কোনো রাজনৈতিক দল রাস্তায় নামলে যে ভোটের রাজনীতিতে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে, সেই বুদ্ধিটুকু তাদের ঘটে আছে; কিন্তু মুসলিম নামে দল গঠন করলে প্রাথমিকভাবে যেমন সকল মুসলমানকে দলভুক্ত ভেবে আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি আখেরে সম্ভবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। অথচ ভারতে ঠিকই হিন্দু মৌলবাদি দলগুলো ক্ষমতার স্বাদ নিতে শুরু করেছে। এমনকি ভারতে কোনো হিন্দুধর্মীয় গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকলে এ দেশের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন; এবং ইদানীং প্রায়ই লক্ষ করা যায়, দুটি ধর্মের বিশ্বাসগত চরমবৈরিতা সত্ত্বেও তারা ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মহীন রাজনীতির চেয়ে শ্রেয় মনে করেন। এমনকি কেউ কারো অখ-তাকে আঘাত করতে চায় না; অথচ নিয়ম অনুসারে ইসলামি দলগুলোর প্রধানত কাজ করার কথা ছিল অমুসলিমদের মাঝে, তাদের হেদায়েত করার মাধ্যমে খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের পথ প্রশস্ত হওয়ার কথা; কিন্তু মুসলিম দলগুলো কেবল মুসলমানদের মধ্যে কিংবা দলগুলোর মধ্যে নিজেদের সঙ্গে ফারাক তৈরির মাধ্যমে একটি আদর্শগত বৈরিতা তৈরি করছে। তাহলে দুটি দেশেই ধর্মীয় রাজনীতির সমান্তরালে যে বস্তুটি আসছে তাহলো, গণতন্ত্র ও সংখ্যাগুরুর সমর্থন লাভ। ধর্মীয় দল কিংবা ধর্ম আখেরে কোনো কাজে আসছে না, হয়তো তা বাইরে বা চেতনায় থেকে যাচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত একটি ভিন্ন ধর্ম-সহিষ্ণু রাষ্ট্র হলেও আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র ধারণার আমলে তা রীতিমত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; এমনকি ধর্মীয় উগ্রপন্থার জন্ম হচ্ছে, এটি যে ভালো তার পক্ষে মতামত গঠন হচ্ছে, এবং জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশিদার হচ্ছে। অথচ এই ভারতের রয়েছে হিন্দু ও মুসলিম দুটি বিপরীত মেরুর বাসিন্দাদের অন্তত এক হাজার বছরের বসবাসের অভিজ্ঞতা। দুটি ধর্মের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে তীব্র বিরোধ থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা এতদিন ভালোভাবে বসবাস করে আসলেও, সাম্প্রতিক ধর্ম নিরপেক্ষতার যুগে এমন সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে; যা আগে কখনো হতে হয়নি। যদিও তাদের জানা থাকা উচিতÑ এই দুটি সম্প্রদায় চূড়ান্তভাবে কেউ কাউকে ধ্বংস করতে পারবে না; এমনকি তাদের বৈশিষ্টেরও মৌলিক কোনো পরিবর্তন হবে না; বরং তারা এই সত্যটি উপলব্ধির মাধ্যমে ভারতীয় সমাজকে আরো এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে একদা ভারতীয় সমাজ লাভবান হয়েছে, তার চিন্তা, জ্ঞান ও সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে; এবং দুটি ধর্মই তার কৌলিন্য হারিয়ে একটি নতুন ধরনের চিন্তামতের জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় বহুশ্বরবাদ মোকাবেলায় মুসলমানরা যেমন তাদের নির্ভেজাল একেশ্বরবাদ ছেড়ে পীর সুফি সাধু সন্তুসহ নানা মধ্যসত্বভোগীর প্রতি নির্ভরশীল হয়েছে, তেমনি হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানদের বিশ্বাসের অনুরূপ শিখ বৈষ্ণব ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তন হয়েছে। সুফি বাউল চিন্তার পাশাপাশি কবীর, নানক, দাদু, রামানন্দ বহু সমন্বয়বাদি সাধকের জন্ম হয়েছে; যাদের চিন্তা মূলত মধ্যযুগে ভারতীয় সমাজের সেকুলার ধর্মমত হিসাবে কাজ করেছিল। শুরুতে শিখ ধর্মের গুরুগৃহ সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল, এখনো আছে, কিন্তু শিখ আলাদা একটি পরিশুদ্ধ ধর্মে পরিণত হয়েছে; ঈশ্বর সেবক হওয়ার জন্য কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের দরকার হয় না। অবশ্য সকল ধর্মের শুরুতে একটি উদার সর্বধর্মীয় বিষয় কাজ করে; ইসলামের আদিযুগে তা লক্ষ করা যায়, ইসলাম শুরুতে তার পূর্ববর্তী সকল ধর্মের স্বীকৃতি যেমন রয়েছে, তেমন মসজিদেও খৃষ্টান পাদ্রিদের উপাসনায় আপত্তি ছিল না। সকল নবীন ধর্ম হয়তো তার অস্তিত্বের সংকটে কিংবা অস্তিত্বশীল ধর্মগুলোর গোড়ামির বিরুদ্ধে একটি উদার চেতনা থেকে কাজ করেছিল; কিন্তু কালক্রমে সেই সব ধর্মের অনুসারিরা সেই চেতনা থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে ধর্মীয় পরিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করেন; যদিও নিত্য-নতুন চিন্তা ও গোষ্ঠী তাদের নিজেদের ধর্মমতের মধ্যেই ঘটতে থাকে; এবং তারা তাদের নিজেদের উপদলের সঙ্গে একটি আপসরফা করলেও অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সেটা করতে আগ্রহী থাকে না। যদিও মুসলমানরা আজ অনেক দেশে আন্তঃধর্মীয় সংঘাতেও লিপ্ত রয়েছে। মুসলমানদের এই সংঘাতের পেছনে যদিও পশ্চিমা সেকুলার কান্ট্রিগুলোর অনেককে দায়ি করা হয়; তবু এটি তো সত্য মুসলমানদের দ্বারাই তাদের দুষ্কর্ম সাধিত হচ্ছে; কিছু পরিবার বা সামরিকপক্ষ নিজেদের ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য অন্যদের ক্রিড়ানক হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে; এর অনেকটাই ধর্মীয় মোড়কে সাধিত হচ্ছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার চ্যালেঞ্জগুলো আজ প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে; খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবারের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমেরিকায় কোনো মুসলমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারবে না; এটি তাদের সংবিধানের জন্যও সাংঘর্ষিক; তাদের আক্রমণের তীর ওবামার দিকে; যদিও ওবামা মুসলমান নন; তবে তার বাবা অফ্রিকান-মুসলমান ছিলেন, ওবামা তার মায়ের ধর্ম ক্রিশ্চানিটিকেই গ্রহণ করেছেন; এবং অদূর ভবিষ্যতেও আমেরিকায় কোনো মুসলমানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না; তবু কেন রিপাবলিকানরা এই স্লোগান নিয়ে আসছেন? হয়তো আমেরিকান জনগণের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক মানসিকতা রয়ে গেছে, বিশেষ করে মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতা; আর এটিই হয়তো রিপাবলিকানরা ক্যাশ করতে চাচ্ছেন, সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের চেয়ে সংখ্যাগুরু খৃষ্টানভোট তাদের জন্য বেশি জরুরি; এখন আর রাজনৈতিক উপাদান হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা কাজে আসছে না। ইউরোপের দেশগুলোও এটি কমবেশি মোকাবেলা করছে। যদিও আমরা অনেকদিন ধরে ইউরোপীয় বস্তুচিন্তা ব্যবহার করে আসছি; তবু সঠিকভাবে তা ব্যবহার করার সুযোগ ঘটেনি। স্বাধীনতা-উত্তর একবারই সেই সুযোগ এসেছিল, কিন্তু এর বাস্তবতা রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুকূলে নয় বলে প্রবর্তকগণই এর একটি জগাখিচুড়ি ব্যবহার করেছেন। একুশ শতকের সূচনাপর্বে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত মুসলিম জঙ্গিবাদের প্রচার সর্বস্বতায় আরেকটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল; কিন্তু ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকে তা গ্রহণ করা হয়নি; সংবিধান সংশোধন হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে আসছে, সঙ্গে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসাবেও থাকছে; উলামাদের নিয়ে অঙ্গসংগঠনও করা হচ্ছে; ব্লগারদের উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, আবার হত্যাকারীদের যুক্তি আছে বলেও মনে করা হচ্ছে; আজ পক্ষ-বিপক্ষ নির্ণয় করা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মের সম্পৃক্ততার এমন একটা গ্যারাকল রচিত হয়েছে, যা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের যে সংস্কারগুলোর প্রয়োজন ছিল, তার একটি হতে পারতো মুসলিম পারিবারিক আইন; মেয়েদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কার্যত কিছু করার ঝুকি সরকার নিতে রাজি নয়; অথচ আইউবের ইসলামি পাকিস্তানি রাষ্ট্রেও এ আইনের যুগান্তকারি সংশোধন হয়েছিল, যা এখনো এ দেশের আইনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে, তার একটি মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ ও দাদার আগে পিতার মৃত্যু হলে নাতিদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়া। ইসলামের আইনের যদিও সারবস্তু ছিল, পিতার সম্পত্তিরই কেবল উত্তরাধিকার হওয়া যাবে, দাদার সম্পত্তির নয়; কিন্তু কোরানের উত্তরাধিকার আইন মোটেও কট্টর ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, মানবিক চেতনাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে; এবং এই আইনের মধ্যে এর সংস্কারের সূত্র নিহিত আছে; মেয়েদের সম্পত্তির ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা কোরআনে রয়ে গেছে; কিন্তু ইসলামি আইন যে ইনসাফের ওপর ওপর প্রতিষ্ঠিত সেটি সঠিকভাবে দেখার জন্য কোনো যুগোপযোগী ব্যাখাকারি উলামা বা নেতা ঝুকি নিচ্ছে না; অথচ দেড়হাজার বছর আগে যে আইনটি হয়েছিল মেয়েদের সম্পত্তি পাইয়ে দেয়ার জন্য, সেই ধর্ম আজ মেয়েদের বঞ্চিত করার দোষারোপ নিয়েও কানে পানি দিচ্ছে না; এতে রাষ্ট্রেরও কিছু এসে যায় না, যেমন আছ তেমন নাচ নীতিতে সবাই বিশ্বাসী। তবু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ বস্তু এখনো দামি হিসাবে প্রতিপন্ন; বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোট টানার জন্য এর রয়েছে ধন্বন্তরিগুণ, যেমন বড় দুটি দলের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে একই রকম আচরণ ও মনোভাব পোষণ করেন, অন্তত সম্পত্তি বা স্বার্থের ব্যাপারে, তবু বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ হিন্দুভোট আকষর্ণে এগিয়ে থাকে, কারণ অন্তত আইন ও চেতনাগতভাবে সংখ্যালঘুরা নিজেদের হীন ভাবেন না; অপরদিকে বিএনপি এটি বোঝাতে সক্ষম হয়নি যে নাগরিক হিসাবে এদেশে তাদের গুরুত্ব কম নয়। আপাতভাবে জামায়াতে ইসলামি দুর্নামের ভয়ে সংখ্যালঘু নিপীড়ন না করলেও তাদের অনেককেই বলতে শুনছি, তারা চলে গেলেই ভালো কারণ তারা তো তাদের ভোটার হবে না। আবার তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায়, কোন ইসলামি দল ক্ষতায় আসলো তাহলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক মর্যাদা কি হবে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাটি এখানে কেবল সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে; সংখ্যাগুরুদের নিয়ে যেন কিছুই ভাবার নেই।
আসলে ধর্ম নিরপেক্ষতা একটি গোলমেলে বস্তু হিসাবে রয়ে গেছে; আদতে যাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা হয়েছে, তার আসলে ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র কখনো ছিল না; ধর্ম নিরপেক্ষতার উপাদান মূলত নিজেই একটি ধর্মবস্তুতে রূপ নিয়েছে; বিশেষ করে মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের যুগে কবীর, লালন, অশোক আকবর, দারাশিকো, গান্ধী তাদের জীবন দর্শনের মূল্যবোধ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে গ্রহণ করা হয়নি; বরং ধর্ম তাদের জীবনের অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল; নিজের ধর্মীয় লেবাসকে তারা সমালোচনা না করলেও অন্যের ধর্মাচরণে তারা উপহাস করেছেন। বর্তমানেও ধর্মনিরপেক্ষতা সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত না হয়ে ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিচালিত হচ্ছে। সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয়-সম্প্রীতি রক্ষা করে কিনা, তা নিয়েও আজ প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে; সবাই প্রত্যক্ষ করেছে যে, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার যে উন্মাদনা তার জন্ম সর্বোচ্চ ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সংবিধানের আওতায় হয়েছে; সাম্প্রদায়িক গুজরাট হত্যা আর তারই ওপরে ভর করে ক্ষমতায় আসীনÑ সংবিধান সে সব রক্ষা করতে পারেনি; কারণ একটি মাত্র দল যখন এই ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার ও সুবিধাভোগী হয়ে পড়ে, তখন ক্ষমতার অন্যান্য অংশিদাররা অন্য পথে ক্ষমতায় আসতে চেষ্টা করে। সুতরাং একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চা, এবং ভালোত্বের সাংস্কৃতি যখন একটি দেশে বিনিময়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় তখন বক্রপথই পথ ওয়ে ওঠে। ফলে চরিত্রের দিক দিয়ে ভারতের কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে বস্তুত কোনো তফাত নাই; বলা হয়ে থাকে বিজেপির প্রতিষ্ঠাদের কেউ বিশ্বাসী হিন্দু নন, এবং তাদের দলেও মুসলমান নেতার সংখ্যা কম নন। পাশাপাশি নেপাল সংবিধানে এতকাল হিন্দুরাষ্ট্র বলে স্বীকৃত হলেও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরাষ্ট্রের মতো সেখানে ধর্মীয় সংঘাত বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দেখা যায়নি; বরং তাদের জনগণের মধ্যে ভারতীয়দের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে, কারণ সে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের শীর্ষভাগ তাদের দখলে। আবার অতিসম্প্রতি তাদের হিন্দুরাষ্ট্রের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের জন্ম দেবে না তা বলা মুস্কিল; ইতোমধ্যেই তাদের তরাই এলাকার জনগণের মধ্যে একটি উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যদিও আপাতভাবে ধর্মীয় উগ্রপন্থা মানুষের জন্য ক্ষতিকর মনে হয়েছে, তবু ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিকর্মকা- দ্বারা গত শতকে যত লোক নিহত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ও রাষ্ট্রের দ্বারা সেই হত্যাকা- কয়েকগুণ বেশি হয়েছে। সুতরাং, রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় বা ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক সংযোজনের আসলেই কোনো প্রয়োজন আছে কিনা; সেটি ভেবে দেখার দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমান রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় এগুলো রাজনৈতিক জিকির ব্যতিত আর কোনো কাজে আসছে বলে মনে হয় না। আসলে এই মীমাংসাটাই জরুরি, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের ধরন কেমন হবে। সংবিধানে এমন সব প্রতীকী মেটাফর যার বহুবিধ ব্যাখ্যা হতে পারে, তা আসলে নাগরিকের প্রয়োজনে আসে না। নাগরিকের মৌলিক অধিকারসহ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, ব্যবসায়-বাণিজ্যর নিরাপত্তা, গমনাগমের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সরকার নির্বাচনের স্বাধীনতা এবং ফৌজদারি ও দেওয়ানি অপরাধসমূহের নিস্পত্তির সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকাই যথেষ্ট; আর সব অবশিষ্ট হতে পারে রাষ্ট্রের এখতিয়ার মুক্ত। যদিও আমার এই মত রাষ্ট্রের কাঠামোর সুচিন্তিত প্রকাশ নয়, তবু বলা যায়, এমন কিছু পরিবর্তন কেবল সংখাগরিষ্টতার ভিত্তিতে নেয়া কোনো ন্যায়সংগত নয়, তার অন্যতম হলো, যা দেশের একজন ব্যক্তিরও চিন্তা বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে ক্ষুণœ করে। রাষ্ট্রের এমন সব বিষয়ে হাত দেয়ার প্রয়োজন হয় না, যেখানে রাষ্ট্র বা ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়; তবে আমাদের এখানে সরকার ও রাষ্ট্রকে অধিকাংশ সময়ে সমান্তরাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের গ্রামের উন্মূল নাপিত পরিবারকে দিয়ে এ আলোচনা শুরু করেছিলাম; কারণ আমার কাছে এ আলোচনা সম্পাদনের জন্য কোনো গবেষণা-প্রণালি ছিল না; অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে এগুতে চেয়েছি। যেমন নাপিত পরিবারটির আজ যে উন্মূলিত হওয়ার ঘটনা, তা কেবল একটি গ্রাম-সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; ইউরোপের শরনার্থী ব্যবস্থার সঙ্গেও তার যোগ রয়েছে; কারণ বিশ্বায়নের ধাক্কায় আমাদের পরিচিত সকল কিছু আজ অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে, আর যা অপরিচিত তা-ই আমাদের অচেনা ও অপর মনে হচ্ছে। যেমন মধ্যযুগে ধর্মের বিভেদ থাকলেও তার রূপ ছিল দেশজ, যেমন শত শত বছর মুসলমানরা ভারতীয় সমাজে বাস করলেও ধর্মের প্যাটেন্ট পরিশুদ্ধতার দরকার হয়নি; বা কেউ তার প্যাটেন্ট দাবি করেনি; যেমন এই শতাব্দিতে এসে আমাদের বলতে হচ্ছে, এই নিমগাছ, এই পাটগাছ আমাদের, আমরা যদি সময় মতো বাণিজ্যের খাতায় তালিকাভুক্ত না করতে পারি তাহলে অন্যরা এটি নিয়ে নেবে, এবং এর ব্যবহারের জন্য আমাদের অতিরিক্ত টাকা গুণতে হবে। তেমনি আজ নানা রকম যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, অনুবাদ ও বর্ণশিক্ষার ফলে ধর্মের মূল গ্রন্থের বাণী ও উপগ্রন্থের সঙ্গে যেমন যে কারো সহজে পরিচয় ঘটছে, সেহেতু তার ব্যাখ্যাও নানা রকম হয়ে যাচ্ছে; এবং এতকাল যা দেশজ ও প্রায়োগিক ছিল তা-ই আজ হয়ে যাচ্ছে কেতাবি ও বাণিজ্যিক; হিন্দু ধর্মের জন্যও এটা সত্য, কারণ হিন্দুরা প্রকৃতগতভাবে ধর্মের কোনো পরিশুদ্ধতা ছাড়াই পুরোপুরি স্থানিক নিয়মে ধর্মপালন করে এসেছেন এতকাল; কে রাম আর কে লক্ষণ তার বাস্তব রূপ নিয়ে তার মাথাব্যাথা ছিল না; অথচ আজ দশমুন্ডের রাবন আর দশভূজা দূর্গা হিন্দুর মানসলোকে ক্ষমতালক্ষী হিসাবে দেখা দিয়েছে; ফলে এই নাপিত পরিবারকে পুরনো মালের নতুন মোড়কের যুগে টিকতে হলে বেশি মূল্য গুণতে হবে; ধর্মনিরপেক্ষতা হুদাই একটি বোল।

Sunday 17 April 2016

ছোটলোক আর ভদ্রলোক -------- অনিরুদ্ধ ঘোষ

ছোটলোক এবং ভদ্রলোক এই concept টা ভারতের বেশ একটা unique concept. পশ্চিমবঙ্গও ব্যাতিক্রম নয়। রবিন্দ্রনাথ, নজরুল, রামমোহন্‌ , বিদ্যাসাগর - এক কথায় Bengal Rennaisance জারিত বঙ্গ সন্তানদের বেশ একটা নাক উঁচু ভাব আছে। তার মধ্যেও আবার বাম, ডান , মাঝামাঝি , কত কি ? কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই এককাট্টা – ছোটলোকদের বড় বাড় বেড়েছে । যাদের আমরা চিরকাল তুই তকারি করে এসেছি তাদের সহ্য করতে হবে ? সেটা তারা ভালো কাজ করুক কি নাই করুক। তাই আজ খুব ভদ্রলোক, মাঝামাঝি ভদ্রলোক আর একটু ভদ্রলোক রা জোট বেধেছে । আর হবেই বা না কেন ? ছোটলোকদের কি মুখের ভাষা ? আমাদের বড় বড় মনিষীদের সম্বন্ধে এরা কিছুই জানেনা। তাও মাঝে মাঝে এদের quote করে হাসির খোরাক হওয়া চাই । এই ছোটলোকদের হাতে পড়ে বাঙ্গালীর প্রিয় সংস্কৃতি একেবারে রসাতলে যেতে বসেছে। তার ওপর ছোটলোকরা আবার ঘুষ খেতেও শিখেছে ( ভদ্রলোকদের ঘুষ খাওয়াটা দেখতে অতটা খারাপ লাগেনা । ভদ্রলোকদের ঘুষ খাওয়াটা সবসময় দেখাও যায়না। বেশিরভাগ নিজের হাতে ঘুষ নিতে ঘেন্না করে । তাদের সব কিছুই হাই ফাই । বোতামের এক খোঁচায় পানামা আর Switzerland এ টাকা চলে যায়। তারপর তারা মন্দির মসজিদে যায় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে । মনের মধ্যে কেমন একটা খচ খচ করে যে । )
আর ভদ্রলোকদের দেখুন । ধব ধবে সাদা প্যান্ট শার্ট পরা , দারুন শিক্ষিত ( MIT/HARVARD ) । অথচ দিনের পর দিন পশ্চিমবঙ্গের কোনও উন্নতি হলনা ...।। থুড়ি ... জলা জমি ভরাট করে Real Estate হল তো ? খেলার মাঠ লোপাট করে Mall হল তো ? কারো কারো পকেট ভারী হল তো ? আবার থুড়ি ...।।বিপ্লবী পার্টির fund collection হল । আবার জাতীয় স্তরে একজন ( এও MIT/HARVARD ) ধব ধবে সাদা শার্ট /লুঙ্গি পরে আর চোস্ত ইংরাজি তে কথা বলে । তার আমলেই হল হাজার হাজার কোটি টাকার চুরি । তাদের পার্টি এখন আবার পশিম্বঙ্গে বামপন্থীদের বন্ধু। ( তাতে কি হল ? ভদ্রলোক রা ঘুষ খেতেই পারে কিন্তু ছোটলোকরা কেন খাবে ? ) আবার এখনকার যিনি, তিনিও চোস্ত ইংরাজি বলেন । ধব ধপে সাদা জামা কাপড় পড়ে্ন ( সাদা রঙটা পবিত্রতার প্রতীক কিনা )। মল্য সাহেব নামে জনৈক ভদ্রলোককে বললেন, শিগগিরি পালান , আমি আর সামলাতে পারছিনা । পালিয়ে যাবার পর তার সে কি হম্বিতম্বি । দেখে নেবার হুমকি । একেই বলে True ভদ্রলোক Patriot. আরও আছে । ধব ধবে সাদা জামা কাপড় পরে হাজার হাজার মানুষ খুন । না না, নিজের হাতে এমন নোংরা কাজ ভদ্রলোকরা করেনা । পুলিশ আছে, ছোটলোকরা আছে । আরও একধরনের ভদ্রলোক রাজ্যস্তরে আছে। যেমন আমাদের বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী। সত্যি ভালো মানুষ । Simple জীবন যাপন ( নিন্দুকেরা যদিও বলে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই )। তিনি নাকি recently ছোটলোকদের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গ কে উদ্ধার করে তার glory days ফিরিয়ে দেবার ডাক দিয়েছেন । তা ৩৫ বছরে কিছু করা গেলনা ? থুড়ি ...।। এ প্রশ্ন করা যাবেনা । উনি যে সত্যিকারের ভদ্রলোক । এসব প্রশ্ন ছোটলোকদের করতে হয়। আরেক ধরণের নতুন ভদ্রলকের উদ্ভব হয়েছে । তার ( sorry , তাঁর ) পোশাক যাকে বলে whitest of all. তাঁর আবার চূল দাড়িও ধব ধপে সাদা । ভদ্রলোক চূড়ামণি যাকে বলে আর কি । পবিত্রতা ঝরে পরছে । সাহিত্য তাহিত্য ছেড়ে তিনি এখন আবার political party গুলির জোটের দালালী করছেন । থুড়ি ...। ভদ্রলোক রা কখনা দালালী করে ? এর নাম Liaison Agency . শুনতে কত ভালো বলুন ?
ওহে ছোটলোকগণ !! তোমাদের এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে । ভদ্দর লোক হওয়া সহজ নয় । জয় ভদ্দর লোকের জয়।

একটি রাজনৈতিক সুইসাইড নোট -------শমীক সরকার


একটি রাজনৈতিক সুইসাইড নোট

হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহিত ভেমুলা ১৭ জানুয়ারি রবিবার রাত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যেই একটি ঘরে আত্মহত্যা করেছেন গলায় ফাঁস দিয়ে। আম্বেদকর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (ASA) সদস্য এই তরুণ গবেষক দলিত ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। মুজফফরনগর দাঙ্গার ওপর বানানো একটি তথ্যচিত্র দেখানো নিয়ে হিন্দুত্ববাদী আর এস এস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপির সদস্যদের সঙ্গে বিরোধ হয় তাদের। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বারো দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রহিত সহ পাঁচ গবেষক, প্রত্যেকেই ASA সংগঠনটির সদস্য, তাদের হোস্টেল, ক্যান্টিন প্রভৃতি থেকে তাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তাঁবু খাটিয়ে থাকছিল রহিতরা।
আত্মহত্যার আগে রহিত ভেমুলা কিন্তু একটা সুইসাইড নোট লিখে রেখে গেছে। গোটা নোটটিতে কোথাও বলা নেই যে সে দলিত। দলিত আন্দোলন নিয়ে, উচ্চবর্ণের অত্যাচার নিয়ে, নিজেদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবিচার নিয়ে একটিও কথা বলা নেই। শুধু একবার ASA ‘পরিবার’-এর উল্লেখ আছে। আর একবার আছে — “আর শেষবারের জন্য, জয় ভীম।” বরং অসম্ভব নির্লিপ্ততাতে বলা আছে, “আমি চলে গেলে তার জন্য আমার বন্ধু বা শত্রুদের বিব্রত কোরো না।”
কিন্তু এই সুইসাইড নোটটিতে আরও অনেক কথা বলা আছে।
“আমি বিজ্ঞান ভালোবাসতাম। নক্ষত্র, প্রকৃতি ভালোবাসতাম। কিন্তু তারপরেও আমি মানুষ ভালোবাসতাম এটা না জেনেই যে মানুষ দীর্ঘকাল হলো প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাদের অনুভবগুলি হাত-ফেরতা। আমাদের ভালোবাসা নির্মিত। আমাদের বিশ্বাসগুলি রাঙানো। আমাদের নিজস্বতার প্রমাণ হলো কৃত্রিম শিল্পকলা। ঘা না খেয়ে ভালোবেসে যাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে।
মানুষের মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপাত সত্ত্বায় এবং আশু সম্ভবনায়। একটা ভোটে। একটা সংখ্যায়। একটা জিনিসে। কখনোই তাকে একটা মন হিসেবে নেওয়া হয় না। নক্ষত্রের কণা দিয়ে গড়া এক মহান সৃষ্টি বলে নেওয়া হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে, কি পড়াশুনা, কি রাস্তাঘাট, কি রাজনীতি, কি বাঁচা-মরায়।”
সভ্য মানুষের অনুভব থেকে বিশ্বাস, রাজনীতি থেকে বাঁচামরা, এমনকি নিজস্বতা — সবকিছুতে কৃত্রিমতার সমালোচনা করেছে রহিত — হাত-ফেরতা, নির্মিত, রাঙানো — এইসব শব্দের ব্যবহারে। ‘এই ঘটনায় আমার প্রেমিকা দুঃখ পেয়েছে তাই আমিও দুঃখ পেয়েছি’ — হাত-ফেরতা অনুভব; ‘কুসুমকলি রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী স্বভাবে নম্র ভদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি মানে যা যা কেউ হলে তাকে ভালোবাসা যায় তাই কুসুমকলিকে ভালোবাসি’ — নির্মিত ভালোবাসা; ‘আমি (বা তুমি) বামপন্থী/মমতাপন্থী/ভেগানপন্থী/মোদীবাদী/আমোদবাদী’ — রাঙানো বিশ্বাস।
রহিতের চিঠিতে তার নিপীড়িত সত্ত্বা নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা নেই। নিদারুণ ক্ষোভ আছে। সে ‘দলিত’ হিসেবে পরিচিত হতে চায়নি — “মানুষের মূল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তার আপাত সত্ত্বায় এবং আশু সম্ভবনায়। একটা ভোটে। একটা সংখ্যায়।” যে কোনো নিপীড়িত সত্ত্বার আন্দোলনে একজন নিপীড়িত সত্ত্বার মানুষ অংশ নিতে পারে দুটো জায়গা থেকে — ১) সেই সত্ত্বাকে গৌরবান্বিত করার মাধ্যমে একটা পালটা শভিনিজম তৈরির জায়গা থেকে (কাশ্মীরিয়ত, দলিত ভারত নির্মাণ, মুসলিম জাহান, গোর্খাল্যান্ড, তামিল ইলম প্রভৃতি …) ২) সেই আরোপিত সত্ত্বাকে সামাজিকভাবে অস্বীকার করার জায়গা থেকে। চিঠি পড়ে মনে হয় রহিত এই দ্বিতীয়টায় পড়ে। তার এই চিঠিটিতে কোথাও বাঙ্ময় নেই তাই নিপীড়িত সত্ত্বার কথা, কিন্তু ছেয়ে আছে গোটাটা জুড়ে, শব্দগুলির ফাঁকে ফাঁকে অদৃশ্য শব্দে, পংক্তিগুলির ফাঁকে ফাঁকে অদৃশ্য পংক্তিতে। সত্ত্বার আন্দোলনের মধ্যে থেকে আরোপিত সত্ত্বাগুলির বিলোপের অন্তর্লীন আকুতিই এই সুইসাইড নোটটিকে করে তুলেছে এক অসামান্য রাজনৈতিক নোট।
— শমীক সরকার