বাংলাভাষী বাঙালিদের কাছে আমার প্রশ্ন
পুষ্কর দাশগুপ্ত
প্রশ্ন ১.
বাঙালি কে বা কারা ? অল্পবিদ্য, স্বল্পবুদ্ধি আমি আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায় যা বুঝি তা হল ভাষা-পরিচয়ে অর্থাৎ মাতৃভাষা বা প্রথম শেখা ভাষার পরিচয়ে বাঙালি বাঙালি, ইংরেজ ইংরেজ। ভৌগোলিক পরিচয়টা গৌণ, যেমন, আসামে অনেক বাঙালি রয়েছেন অথবা কলকাতায় বহু অবাঙালি বাস করেন। প্রশ্ন হল, ইংরেজি জানে না এমন কাউকে কি ইংরেজ বলা যায় ? বাংলা জানে না অথচ বাঙালি হতে পারে কি?
প্রশ্ন ২.
শিক্ষিত বাঙালি কে বা কারা ? ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় দুএকটা পাশ দেওয়া বাঙালি হল শিক্ষিত বাঙালি। অথচ ধ্রুপদী আরবি আর ফারসি অথবা সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অধিকার রয়েছে এরকম দুজন বাঙালিকে শিক্ষিত বলা হয় না। শিক্ষিত বাঙালিরা অবজ্ঞার বাঁকা হাসি মিশিয়ে প্রথম জনকে বলবে মৌলবি সাহেব,দ্বিতীয় জনকে পণ্ডিতমশাই। এর কারণ বা যুক্তিটা কী?
প্রশ্ন ৩.
“ কলকাতা থেকে নিয়মিত বিমানে ভ্রমণকারী প্রতি দু‘জনের একজন, পশ্চিমবঙ্গে নামকরা গাড়ির মালিকদের ৪০%, রাজ্যের ওয়াশিং মেশিন আছে, এমন মানুষদের অর্ধেকেরও বেশি, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক মাইক্রোওয়েভ মালিক, রাজ্যের সমস্ত এয়ার কন্ডিশন মালিকের ৪০%” বুদ্ধিমান, জ্ঞানবান,ধনবান, বলবান, পুণ্যবান, বিনয়,ঔদার্য, শৌর্যক্রৌর্যাদি গুণসম্পন্ন বাঙালিরা যে পত্রিকার পাঠক, যে পত্রিকা“সংবাদপত্র নয়, এক বৃহৎ বাজার‘”, যে “ইংরেজি-খোর” দৈনিকপত্র আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাভাষার পত্রিকা হয়েও বাংলাভাষার ব্যবহারের বিস্তারের চরম বিরোধী আর মাতৃভাষা বাংলার পক্ষপাতীদের “বাংলাবাজ” বলে নির্দেশ করে।
বাংলাভাষার আনন্দবাজার পত্রিকার মতো যে ভাষার পত্রিকা সেই ভাষারই চূড়ান্ত বিরোধী এরকম আর কোনো একটি পত্রিকা পৃথিবীতে আছে কী?
প্রশ্ন ৪.
ঔপনিবেশিত ভারত উপমহাদেশ আর আফ্রিকার কিছু দেশ আর বাজার শহর সিঙ্গাপুর বাদ দিয়ে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য,প্রযুক্তিতে বিদেশি ভাষা ব্যবহার করা হয় এরকম উন্নত দেশ আছে কী?
প্রশ্ন ৫.
ইংরেজি শিক্ষার গত দুশ বছরের ইতিহাসে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, মানবিক-বিজ্ঞান,প্রযুক্তি বা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষিত ভারতীয়দের অবদান কী যদি সেরকম কোনো অবদান না থাকে তার কারণ কী?
প্রশ্ন ৬.
সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থে অনড় এই ঔপনিবেশিক শিক্ষা দেশে ইংরেজি জানা না জানার মাপকাঠিতে পুরনো জাতিভেদের চেয়ে আরো দৃঢ়মূল নতুন জাতিভেদ গড়ে তুলেছে করেছে। ইংরেজি খুব ভালো (কুলীন বামুন), ভালো (বামুন) , মোটামুটি (বৈদ্য,কায়স্থ),চলনসই (জলচল নবশাখ ) জানা না জানার (জলঅচল) এই মাপকাঠিতে আমাদের সমাজে নতুন জাতিভেদ আর বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন ৭.
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নিরক্ষরের এই দেশে দেশের বেশির ভাগ মানুষকে তথ্য জানার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার আর ভাষিক-সাংস্কৃতিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এর পর “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র” দেশের এই অভিধা কি হাস্যকর আর ব্যঙ্গার্থক নয়?
প্রশ্ন ৮.
নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের, জের্মানিক অ্যাংলো-স্যাক্সন, গ্রেকো-রোমান সভ্যতা আর জুডিও-খ্রিস্টান সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণায় পরিপোষিত যে ভাষায় গ্রীষ্ম-মণ্ডলের, অন্য এক ভৌগোলিক পরিবেশ আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয়দের/বাঙালির জীবনকে ঘিরে থাকা বহু উপাদান বা ধ্যানধারণাকে (গাছপালা, শাক-সব্জি,রীতি-নীতি, খাদ্যাভ্যাস, পারিবারিক -সামাজিক সম্পর্ক ) প্রকাশ করা যায় না। সে ভাষায় শিক্ষা শিশুকে/ব্যক্তিকে তার সমাজ তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই শিক্ষাব্যবস্থা কিছু মাঝারি মানের অনুকরণ, অনুসরণ ও পুনরাবৃত্তিক্ষম “শিক্ষিত” উত্পাদনেই শেষ হতে বাধ্য। ইংরেজি শিক্ষার গত দুশ বছরের ইতিহাসে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, মানবিক-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষিত ভারতীয়দের অবদান কী বা কতখানি তা চিন্তা করলেই ব্যপারটা বোঝা যায় (দ্র. প্রশ্ন ৪.)। আমাদের প্রযুক্তিবিদরা ইংরেজি বইয়ে পড়া আর দেখা ছবি অলুসারে শীতের দেশের বাড়ির আদলে এদেশে এমন সব বাড়ি তৈরি করেন যেগুলিতে গ্রীষ্মমণ্ডলের মৌসুমী অঞ্চলে বাস করা যণ্ত্রণাদায়ক, আমাদের সহস্রমারী চিকিত্সকদের বেশির ভাগ ইংরেজি বইপড়া হাতু়ড়ে। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা বেশির ভাগ কারিগর, বিদেশিদের নির্দেশ আর ছক মেনে অর্ডারি সফ্টওয়ার করেই সন্তুষ্ট। আমাদের অধ্যাপকরা অমুক সাহেব আর তমুক সাহেবের মতামত মুখস্ত বলাটাই অধ্যাপনা বলে মনে করেন। এই অস্বাভাবিক অবস্থা কী কখনো কাটবে না?
প্রশ্ন ৯.
আসলে চারদিকের জগৎ ও জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন বিদেশি ভাষায় অধীত বিষয় শিক্ষার্থীর বোঝার স্তর পেরিয়ে বড় জোর মানসিকতার আপাত সংস্থানে আত্তীকৃত হতে পারে , কিন্তু তার পরের স্তরে নিহিত সংস্থানে আত্তীকৃত হয়ে চিন্তাপদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সৃজনশীল বা উদ্ভাবক সঞ্জননী ক্ষমতায় পরিণত হয় না। আমাদের এই উপলব্ধিটা কি আমাদের দেশ তথা ঔপনিবেশিত আরো কিছু দেশের তথাকথিত শিক্ষিতদের সম্পর্কে প্রযোজ্য নয় ?
প্রশ্ন ১০.
বিদেশি ভাষায় এই শিক্ষাব্যবস্থা কি শিক্ষিতদের এক ধরনের দ্বৈত জীবন যাপনে(সিজোফ্রোনিয়ায় ভুগতে) বাধ্য করে না ? বট-অশ্বত্থের সামনে ওক-এল্ম-অ্যাশ-এর ছায়া দেখা ঘর আর বাইরের, বাচন আর কর্মের মধ্যে দ্বিধাবিভক্ত অসুস্থ জীবন কি ব্যক্তি আর সমাজ-জীবনকে পঙ্গু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে না ? এই পক্ষাঘাতের লক্ষণ আর উপসর্গ কি দেশের তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা আর বাচনে স্পষ্ট নয়?
প্রশ্ন ১১.
যে ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ হয় না, যে ভাষা আধুনিক নাগরিক জীবন আর তথ্যপ্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন আর তার ফলে নতুন নতুন শব্দের উদ্ভাবন দ্বারা আধুনিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রেতভাবে যুক্ত হয় না , যে ভাষায় কিছু গল্পকবিতা ছাড়া আর কিছুই লেখা হয় না সেই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী ? আর এই ভাষার সাহিত্যও কি স্রোতহীন গেঁজিয়ে ওঠা বদ্ধ জলায় পরিণত হয়ে উঠছে না ?
প্রশ্ন ১২.
আমরা বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে পড়ি, পড়ে হৈচৈ করি বোদলের,রিলকে, নেরুদা, মার্কেস… কিন্তু ইংরেজিতে অনূদিত হলেও বাংলা ভাষার লেখকদের(রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ,সামসুর রহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়…) লেখা কেউ পড়ে না বা তাঁদের লেখা নিয়ে কেউ আলোচনা করে না। এর কারণ কী ?
প্রশ্ন ১৩.
বাংলা ভাষা আজও যথার্থ অর্থে কম্প্যুটারিয়িত হয় নি । তথ্যপ্রযুক্তির পরিভাষা নিয়ে কখনো মাথা ঘামানো হয়নি। বাংলায় কোনো পরিচালনা তন্ত্র (যেমন উইনডৌজ,ম্যাক ও এস, অ্যান্ড্রইড …) নেই , কোনো পরিপূর্ণ সফটওয়ার সমষ্টি (যেমন মাইক্রোসফট অফিস, ওপেন অফিস…)
নেই , জোড়াতালি দিয়ে টাইপ করতে হয়রান হতে হয়, আরেক পদ্ধতি হল রোমান হরফে বাংলা — অদ্ভুত, অনেক ক্ষেত্রে তার পাঠোদ্ধার প্রায় অসম্ভব। কম্প্যুটারে প্রকাশনার জন্য পেজ মেকার বা ইন ডিজাইনে সরাসরি বাংলা ব্যবহার করা যায় না, কারিগরি পদ্ধতিতে তৈরি নিম্নমানের কিছু সফটওয়ারের সাহায্য নিতে হয়। প্রায় কুটিরশিল্পের উত্পাদন ওই সফটওয়ারগুলির প্রযুক্তি সীমাবদ্ধ, তাতে আলাদা ইউনিকোডে টাইপ করা রচনা ব্যবহার করা যায় না ,আবার এই সফটওয়ারের সাহায্যে টাইপ করা রচনা আলাদাভাবে বাইরে ব্যবহার করাও কঠিন। স্বয়ংক্রিয় বানান আর ব্যকরণ-সংশোধক না থাকায় ছাপার ভুল ছাড়া বাংলা বই দেখা যায় না। এসব নিয়ে সাধারণভাবে বাঙালি আর বিশেষভাবে বাংলাভাষার লেখক-সাংবাদিকরা কেন কখনো কিছু বলেন না , ভাবেন বলেও মনে হয় না। তাঁরা কি অন্যন্য অনেক ব্যাপারের মতো এ ব্যাপারেও অদৃষ্টবাদী?
প্রশ্ন ১৪.
বাংলাভাষায় যথার্থ অর্থে কোনো অভিধান নেই। উপস্থাপিত শব্দগুলির: ক. (আন্তর্জাতিক ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালায় প্রতিবর্ণীকৃত) উচ্চারণ ; খ. পদ-প্রকরণ(বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি) ; গ. ১.ইতিহাস. শব্দটির উত্স ও ব্যুত্পত্তি , ২ ভাষায় কোন সময় থেকে শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে ; ঘ. সংখ্যা (১, ২, ৩ ইত্যাদি) বা অন্য কোনো চিহ্ন দ্বারা নির্দেশিত শব্দটির ক্রমানুসারী (বর্তমান প্রচলিত থেকে অতীত, সাধারণ থেকে বিশেষ পারিভাষিক…) বিভিন্ন অর্থ বা সংজ্ঞার্থ — উক্ত সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী শব্দটির প্রয়োগের (যথাসম্ভব সাহিত্য, সংবাদপত্র ইত্যাদি থেকে) দৃষ্টান্ত; ঙ.সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সাহিত্য বা/এবং প্রবচনে শব্দটির বিশেষ বা রূপকার্থে ব্যবহারের উদাহরণ সহ সংজ্ঞার্থ ; চ. ক্ষেত্র বিশেষে শব্দটির সমার্থক বা/এবং বিপরীতার্থক শব্দের নির্দেশ।
ঢাকার বাংলা একাডেমি কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত গোলাম মুরশিদ-এর বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান এ ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কীভাবে আরো এগিয়ে যাওয়া যায় এই ব্যাপারে (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ,ত্রিপুরা, আসাম ও সারা পৃথিবীর)বাংলাভাষী বাঙালিদের কি কিছুই করার নেই?
প্রশ্ন ১৫.
বাংলাভাষার শব্দের বানানের ক্ষেত্রেও নৈরাজ্য। ঢাকার বাংলা একাডেমি আর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বানান ব্যাপারে একমত নয়, একাডেমি আকাদেমি এই দুই বানানেই বোঝা যায় মতভেদের কারণ খুব গভীর নয়। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকা বা আরও কিছু প্রকাশনা-সংস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের নিজের বানানবিধি মেনে চলে। দুদেশের একাডেমি, ত্রিপুরা, আসাম ও সারা পৃথিবীর বাঙালিদের যোগাযোগ, আলোচনা ও সম্মতির মাধ্যমে বাংলাভাষার শব্দের বানানে একটি অদ্বিতীয় বিধান রচনা করুক এটা কী দাবি করা যায় না ?
প্রশ্ন ১৬.
কিছুদিন আগে প্রদীপ বসু নামে ইতিহাস সমাজতত্ত্বের একজন গবেষক-অধ্যাপকের লেখা কিছুদিন আগে প্রদীপ বসু নামে ইতিহাস সমাজতত্ত্বের গবেষক-অধ্যাপকের লেখা দুটো প্রবন্ধ চোখে পড়ল। তাঁর মতে বাংলাভাষায় জ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তার প্রধান কারণ হল আসলে ভাষায় জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে পরিভাষা তৈরি হয়। তিনটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক Algebra (আরবি আল-জাবর থেকে চতুর্দশ শতকে ল্যাটিনে তারপর ইংরেজি সহ আধুনিক ইয়োরোপীয় ভাষাগুলিতে রূপান্তরিত), television ( গ্রিকমূল তিলে(τῆλεদূরে) ও ল্যাটিনমূল vision (দৃশ্য, ১৯২০-র পর ইংরেজি সহ আধুনিক ইয়োরোপীয় ভাষাগুলিতে রূপান্তরিতভাবে আধুনিক দূরদর্শন ।উল্লিখিত দুটি শব্দই আদিতে নতুন পারিভাষিক শব্দ এবং ব্যবহারের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রাত্যহিক শব্দে পরিণত হয়েছে। বাংলাভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় একই ভাবে গ্রিক ও ল্যাটিনের মতো সংস্কৃত বা/এবং বিদেশি আরবি-ফার্সি থেকে রূপান্তরিত শব্দ প্রথমে পারিভাষিক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় প্রাত্যহিক শব্দে পরিণত হতে পারত। ১৯১২ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রাসায়াণিক পরিভাষা পুস্তিকার ভূমিকায় লিখেছিলেন, “বাঙ্গালা ভাষায় বহুল পরিমাণে বৈজ্ঞানিক পুস্তক লিখিত ও প্রকাশিত না হইলে পরিভাষার দোষগুণ সম্যকরূপে বিচার করা যাইতে পারে না। গ্রন্থকারগণ কতক শব্দ গ্রহণ করিবেন, কতক বাদ দিবেন, কতক বা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া সামঞ্জস্য করিয়া লইবেন। এক কথায়, বাঙ্গালী মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রচার না করিলে কখনই ভাষার ও বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের পুষ্টিসাধন হইবে না।”
খোদ ইংল্যান্ডে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যদি বেশ কিছু প্রদীপ বসুর মতো পণ্ডিতমশাই থাকতেন তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় সাধারণ মানুষের অবোধ্য ল্যাটিন আজও বেঁচে থাকত, জীবনচর্যার সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো সংযোগ স্থাপিত হত না। ইংল্যান্ডে চিন্তার মধ্যযুগ কাটত না।
আমার প্রশ্ন বাংলায় কি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সম্ভব নয়? জাপানিতে, কোরিয়ানে,চিনে ভাষায়, (ইন্দোনেশীয়)ভাষায় , থাই, আরবিতে, রুমানিয়ান, পোলিশ, হাঙ্গেরিয়ান,চেক ইত্যাদি ভাষায় যদি তা সম্ভব হয় তাহলে বাংলায় কেন সম্ভব নয়?
১৮৬৫ সালের ২৬-এ জানুয়ারি ফ্রান্সের ভের্সাই থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বন্ধু গৌরদাস বসাককে একটা চিঠিতে লিখছেন:
…European scholarship is
good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let
those, who feel that they have spring of fresh thought in them, fly to their
mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated”
who is not master of his own language.
ব্রিটিশ যুগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ১৮৯১ আর ১৮৯২ সালের সমাবর্তন অভিভাষণে বলেন:
In
laying stress upon the the importance of the study of our vernaculars, I am not
led by any patriotic sentiment,…but I am influenced by more substancial
reasons. I firmly believe that we cannot any thorough and extensive culture as
a nation, unless knowledge is disseminated through our own vernaculars. Cosider
the lessons of the Past teaches. The darkness of the Middle Ages of Europe was not
completely dispelled until the light of Knowledge shone through the medium of
the numerrous modern languages. So in India, notwithstanding the benign
radiance of knowledge that has shone on the higher levels of our society
through one of the clearest media that exist, the dark depth of ignorance all
round will never be illumined until the light of knowledge reaches the masses
through the medium of their own vernaculars. ( Convocation Address 1891)
One
great reason why our University education fails to awaken much original
thinking, is because it is imparted through the medium of difficult foreign
language , the genius of which is so widely different from that of our own. The
acquisition of such a language must to a great extent be thework of imitation ;
and the habit of imitation gradually becomes so deeprooted as to influence our
intellectual operations generally. ( Convocation Address 1892)
আমি জানি তর্ক এই উঠিবে তুমি বাংলা ভাষার যোগে উচ্চশিক্ষা দিতে চাও কিন্তু বাংলাভাষায় উঁচুদরের শিক্ষাগ্রন্থ কই ? নাই সে কথা মানি কিন্তু শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রন্থ হয় কী উপায়ে ? শিক্ষাগ্রস্থ বাগানের গাছ নয় যে , শৌখিন লোকে শখ করিয়া তার কেয়ারি করিবে ,— কিংবা সে আগাছাও নয় যে , মাঠে বাটে নিজের পুলকে নিজেই কণ্টকিত হইয়া উঠিবে! শিক্ষাকে যদি শিক্ষাগ্রন্থের জন্য বসিয়া থাকিতে হয় তবে পাতার জোগাড় আগে হাওয়া চাই তার পরে গাছের পালা এবং কুলের পথ চাহিয়া নদীকে মাথায় হাত দিয়া পড়িতে হইবে । (রবীন্দ্রনাথ: শিক্ষার বাহন ১৯১৫)।
যাঁরা বলেন বাংলায় বিজ্ঞান চর্চ্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না। ( সত্যেন্দ্রনাথ বসু)।
মধুসূদন, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু- এঁরা কী তাহলে সত্যিকারের শিক্ষাদীক্ষার ঘাটতি থেকে উলটো-পালটা বকেছেন, অথবা পাগলে কী না বলে…! বিলেতে বা ইয়াংকিদের জবরদখল মার্কিন মুল্লুকে নয় খোদ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার ব্যবহারের স্বপক্ষে কেউ যদি এতটুকু রা কাড়ে বাংলাভাষার দৈনিক পত্রিকা আনন্দবাজার তাদের বাংলাবাজ বলে অভিহিত করে, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে জিহাদি,ইংরেজি-আসক্ত আনন্দবাজার পত্রিকাকে ইংরেজিখোর ছাড়া আর কী বলা যায় ? রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রিয় শিক্ষিত বাঙালিরা কী বলেন?
No comments:
Post a Comment