Tuesday, 30 June 2015

অনৈতিক দেশভাগ  ঃসৌজন্য- ইশতিয়াক জামি
=======================
"... স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ দিল্লীতে বসেই সীমানা চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শুধু কলকাতা সফর করে যান। কমিশনের সদস্যগন কলকাতা ও লাহোর থেকে প্রত্যহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁর নিকট দিল্লীতে প্রেরণ করবেন বলে তিনি নিয়ম করেন। সেখানে দলকে সীমানা সংক্রান্ত দাবীনামা পেশ করার আহবান জানান। জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বাংলা কমিশন ১৬ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই আগ্রহীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। কংগ্রেস, বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবিনামা পেশ করা হয়।
১৯৪৭ সালের ৬ থেকে ৭ জুলাই সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোট অনুযায়ী সিলেট জেলা পূর্ববাংলার সঙ্গে একীভূত হবার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার সীমানা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ৪ থেকে ৬ আগষ্ট কলকাতায় এক বৈঠক আহবান করেন। বৈঠকে আসাম সরকার ও পূর্ব বাংলা সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ, আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ও আসাম প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিবর্গ এবং পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ ও সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিনিধিগণ যোগদান করেন।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে দাবিনামা পেশ করা হয় তাতে বাংলার মোট ৭৭,৪৪২ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ৪০,১৩৭ বর্গমাইল দাবী করা হয়। দাবিকৃত এলাকার জনসংখ্যা ছিল অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার ৪৫%, তন্মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ৩২% এবং বাকীরা অমুসলমান। কংগ্রেস যে সমস্ত এলাকা দাবী করে সেগুলো হচ্ছে গোটা বর্ধমান বিভাগ, নদীয়া, যশোর ও খুলনা জেলাসমূহের সামান্য অংশ বাদে গোটা প্রেসিডেন্সী বিভাগ, রাজশাহী বিভাগের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, রংপূর জেলা থেকে ডিমলা ও হাতিবান্ধা থানা, দিনাজপূর জেলার পশ্চিমাংশ এবং নবাবগঞ্জ মহকুমা বাদে মালদহ জেলা, ঢাকা বিভাগের বরিশাল জেলা থেকে গৌরনদী, নজীপূর, স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠি থানাসমূহ, ফরিদপূর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমা ও রাজৈর থানা। ভারত ভূখন্ডের সাথে আসামের রেল যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস রংপূর জেলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভুরুঙ্গামারীও দাবি করে বসে। কংগ্রেস কলকাতা শহর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি পেশ করে।
তাদের দাবির স্বপক্ষে তারা যুক্তি দেখায় যে, ১৯৪১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী কলকাতা শহরে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ২৩.৫৯% (মোট ২,১০৮,৮৯১ এর মধ্যে ৪,৯৭,৫৩৫), কর প্রদানকারী মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১৪.৮% (৬৮,৫৬৭ এর মধ্যে ১০,১৪৯) এবং কলকাতা শহরের ৮১,১৫৯ বাড়ির মধ্যে মুসলমান বাড়ির সংখ্যা মাত্র ৬,৮৬৩ (৮.৪৫%)। কংগ্রেস আরো উল্লেখ করে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত বেসরকারী সাহায্যের মধ্যে মুসলমানদের দান মাত্র ১%। কংগ্রেস আরো যুক্তি দেখায় যে কলকাতার আশে পাশে যে ১১৪ টি পাটকল আছে তার সবগুলি মালিক অমুসলমান ব্যাক্তিবর্গ। সুতরাং সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা বিভক্ত হলে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গেরই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অপরপক্ষে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিভাগের বেশির ভাগ অংশ এবং বর্ধমান জেলাসমূহ, হুগলী ও ভাগীরথীর পূর্বাংশ পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করা হয়। মুসলিম লীগের দাবীতে বলা হয় দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা হওয়া সত্ত্বেও ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে এবং পূর্ববাংলার অর্থনীতির প্রয়োজনে এই জেলাগুলি পূর্ববাংলাভুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। সপক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে, উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতে নদী ও এর শাখানদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ নদীগুলি জলপাইগুড়ির তিস্তা দিয়ে প্রবাহিত। তাছাড়া পূর্ববাংলার রেলপথ সংরক্ষনের একমাত্র উৎস হচ্ছে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং এ অবস্থিত পাহাড়ের পাথর। পুর্ববাংলার কাঠের চাহিদা মেটানো হত জলপাইগুড়ি জেলার বন জংগল থেকে সংগৃহীত কাঠ থেকে। সুতরাং মূসলিম লীগ দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলাদ্বয় পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি পেশ করে। পূর্ববাংলায় ভবিষ্যতে হাইড্রো-ইলেকট্রিক শক্তি উৎপাদনের জন্য কর্নফুলী নদীর অধিকার আবশ্যক। এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ববাংলায় অন্তর্ভুক্তির দাবি করা হয়। মুসলিম লীগ কলকাতা শহর পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর দাবি পেশ করে। মুসলিম লীগ যুক্তি পেশ করে যে, কলকাতা শহরটি গড়ে উঠেছে মূলত পূর্ববাংলার সম্পদ দিয়ে। পৃথিবীর ৮০% পাট পূর্ববাংলায় উৎপাদিত হয় এবং ঐ পাট দিয়েই কলকাতার আশেপাশের পাটকল চলে। তাছাড়া কলকাতা ছিল বাংলার একমাত্র সমুদ্র বন্দর। উক্ত বন্দরে কর্মরত শ্রমিক,কর্মচারী নাবিকরা মূলত পূর্ববাংলারই লোক। অতএব কলকাতা পূর্ববাংলারই প্রাপ্য।
এইভাবে কংগ্রেস ও লীগের দাবিদাওয়ার মীমাংসা করা কমিশনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। স্যর সিরিল র‍্যডক্লিফ ব্যক্তিগত ভাবে এসব দাবিদাওয়া সম্পর্কে কোন পক্ষকে সাক্ষাৎকার দেননি। তিনি বুঝতে পারেন যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সীমানা চিহ্নিত করা সম্ভব হবেনা। তাই তিনি নিজের ইচ্ছামত সীমানা নির্ধারনের সিদ্ধান্ত নেন। সীমানা চিহ্নিত সংক্রান্ত কতকগুলি মৌলিক প্রশ্নের উদ্ভাবন করেন, যেমনঃ
ক, বাংলার কোন অংশকে কলকাতা শহর প্রদান করা উচিত? এই শহরকে দ্বিখন্ডিত করে উভয় অংশকে খুশি করা কি সম্ভব?
খ, সমগ্র কলকাতার সঙ্গে কোন একটি অংশকে প্রদান করার পেছনে নদীয়া কিংবা কুলট নদীকে গুরুত্ব দেয়া উচিত কি না।
গ, টার্মস অব রেফারেন্সে উল্লেখিত ‘সম্প্রদায়গত সংলগ্ন এলাকার’ নীতিকে উপেক্ষা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা যশোর ও নদীয়া পশ্চিমবংগের অন্তর্ভুক্ত করা যথার্থ হবে কি না।
ঘ, মালদহ ও দিনাজপুর জেলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কিছু অংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা কি পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে?
ঙ, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্চনীয় কিন্তু জেলাদ্বয়ের মুসলিম জনসংখ্যা অত্যন্ত কম (১৯৪১ এর আদমশুমারী অনুযায়ী দার্জিলিং এ মাত্র ২.৪২% ও জলপাইগুড়িতে ২৩.০৮%।) সুতরাং এই জেলাদ্বয় কোন অংশে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ?
চ, পার্বত্য চট্টগ্রামের মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৩% হলেও জেলাটি চট্টগ্রাম জেলার অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং এই জেলাটি কোন ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে?
মাউন্টব্যাটেনের ৩ জুন পরিকল্পনায় যদিও ‘সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং এলাকার সংলগ্নতা’ (Majority and Contiguity Principles)- এর ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিত করার কথা ছিল কিন্তু র‍্যাডক্লিফ উক্ত নীতি এবং লীগ, কংগ্রেসের সমঝোতা নীতিকে উপেক্ষা করে নিজের বিচারবুদ্ধিমতো সীমানা চিহ্নিত করেন। জনসংখ্যা, ভৌগলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সীমানা নির্ধারণ করলে অন্তত কয়েকমাস সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু র‍্যাডক্লিফ তার দিল্লী অফিসে বসে টেবিলের উপর ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মাইলের সীমানা চূড়ান্ত করেন। এই কাজ করতে তিনি মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। সরদার বল্লভ ভাই প্যটেল ১৫ জানুয়ারী ১৯৫০ সালে কলকাতার এক জনসভায় উল্লেখ করেন যে, ‘আমরা ভারত বিভাগে রাজি হওয়ার পূর্বশর্তস্বরূপ কলকাতা শহর যেন ভারতভুক্ত থাকে তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম। আমাদেরকে সেই নিশ্চয়তা দেয়া হলে আমরা ভারত বিভক্তিতে সম্মত হই’। মাউন্টব্যটেন যেভাবেই হোক কলকাতা ভারতকে দেবেন বলে অংগীকার করেছিলেন। সম্ভবত সেজন্যই তিনি বাউন্ডারি কমিশনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য কিংবা জাতিসংঘের মনোনীত প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা সমর্থন করেননি। যাহোক, র‍্যাডক্লিফের ঘোষণায় কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ ভুক্ত করা হয়।
র‍্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে নিম্নে উল্লেখিত জেলাগুলো পূর্ববাংলার ভাগে পড়েঃ
১। ঢাকা ২। ময়মনসিংহ ৩। ফরিদপুর ৪। বাখরগঞ্জ (বরিশাল) ৫। চট্টগ্রাম ৬। ত্রিপুরা ৭। নোয়াখালী ৮। পাবনা ৯। বগুড়া ১০। রংপুর ১১। রাজশাহী। নদীয়া, দিনাজপুর এবং মালদহ জেলা পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হল। নদীয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬১%) হওয়া সত্ত্বেও এর দুই তৃতীয়াংশ এলাকা পশ্চিমবঙ্গকে দেয়া হয়। বাকি অংশ চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া মহকুমা পূর্ববাংলার ভাগে পড়ে। অবিভক্ত দিনাজপুরের ৩০ টি থানার মধ্যে সম্পূর্ণ এলাকাসহ ৯টি থানা ও একটি থানার অংশবিশেষ পশ্চিমবংগের ভাগে দেয়া হয়। অপরপক্ষে ২০টি থানা সম্পূর্ণভাবে, একটি থানা আংশিকভাবে (হিলি) পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। মালদহ জেলার (৫৭% মুসলমান) চাপাইনবাবগঞ্জ পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। বাকী অংশ (মালদহের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ) পশ্চিমবংগভুক্ত করা হয়। জলপাইগুড়ি জেলা থেকে ৪টি থানা –যথা দেবীগঞ্জ, বোদা, তেতুলিয়া ও পঞ্চগড় পূর্ববাংলার ভাগে পড়ে। সম্পূর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলা (৫৬% মুসলমান) পশ্চিমবঙ্গভুক্ত করা হয়। যশোর জেলার বনগাও (৫৩% মুসলমান) ও গাইঘাটা থানা বাদে গোটা যশোর জেলা পূর্ববাংলাকে দেয়া হলো। খুলনা (৪৯.৩৬% মুসলমান) জেলাকে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গকে দেয়া হয়েছিল। এ কারণে খুলনা জেলায় তিনদিন ভারতের পতাকা উড্ডীন ছিল। কলকাতার বেলভেডিয়ার হাউজে সীমান্ত নির্ধারণী মামলায় এ. কে. ফজলুল হক স্যার র‍্যাডক্লিফের নিকট ওকালতি করে খুলনা জেলাকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে জানা গেল মুর্শিদাবাদ জেলার বদলে খুলনাকে পূর্ববাংলার ভাগে দেয়া হয়েছে। মুসলমান অধ্যূষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকা ভারতকে প্রদানের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম গ্রহণের ব্যপারে কংগ্রেসের ততটা আগ্রহ ছিলনা।
আসামের সীমানা চিহ্নিতকরণ সম্পর্কিত টার্মস অব রেফারেন্সের বিষয়ে সীমানা কমিশনের হিন্দু ও মুসলমান সদস্যবর্গ ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। মুসলমান সদস্যরা দাবি করেন যে, পূর্ববাংলা সংলগ্ন আসামের সকল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ববাংলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে হিন্দু সদস্যগণ মত প্রকাশ করেন যে, কমিশনের ক্ষমতা কেবল সিলেট জেলা সংলগ্ন আসামের সীমানা নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কমিশনের চেয়ারম্যন হিন্দু-সদস্যদের মত সমর্থন করেন।
সিলেট জেলার ৩৫ টি থানার মধ্যে মাত্র ৮ টি থানায় অমুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; তার মধ্যে দুটি থানা সুল্লা ও আজমিরীগঞ্জ চারিদিকে মুসলমান থানা দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। বাকি ৬ টি থানা সিলেটের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে একটানা অবস্থিত ছিল। তবে মূল সিলেটের সাথে থানাগুলির কোন সংযোগ ছিলনা। অপরদিকে কাচার জেলার হাইলাকান্দি মহকুমা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তা সিলেটের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বদরপুর ও করিমগঞ্জের সংলগ্ন ছিল। কিন্তু এই এলাকা পূর্ববংগের অন্তর্ভুক্ত করলে সিলেটের দক্ষিণের ৬ টি অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানার সাথে আসামের কোন সংযোগ থাকেনা, আবার ৬টি থানাই আসামের অন্তর্ভুক্ত করলে সিলেটের সাথে পূর্ববাংলার রেল-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় কমিশনের চেয়ারম্যন মনে করেন যে, কিছু মুসলমান এলাকা এবং হাইলাকান্দি মহকুমা অবশ্যই আসামের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সুতরাং দক্ষিণ সিলেটের ও করিমগঞ্জ মহকুমার ৬ অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করে তার বিনিময়ে পাথরকান্দি,বাতাবাড়ি, করিমগঞ্জ এবং বদরপুর এই চারটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ৪ টি থানাকে পূর্ববাংলায় রাখার জন্য আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বাউন্ডারি কমিশনের নিকট স্মারকলিপি পেশ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে তার সেক্রেটারী নির্বাচিত করা হয়। কলকাতায় তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। স্মারকলিপি পেশ করার জন্য তারা যে গাড়ীতে উঠেন তার শিখ ড্রাইভার তাদেরকে নিয়ে বলি দেবার জন্য কালিঘাট অভিমুখে রওনা দেয়। শারীরিক শক্তি প্রয়োগে ড্রাইভারকে তারা সে চেষ্টা নিবৃত্ত করেন এবং বেলভেডিয়ারে গিয়ে তারা কমিশনের নিকট স্মারকলিপি পেশ করেন।
যদিও ১৫ই আগষ্টের পূর্বেই সীমানা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ ও বাস্তবায়নের কথা ছিল কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের কোন কর্মসূচী যাতে সীমানা সংক্রান্ত ক্ষোভের কারণে ব্যহত না হয় সেজন্য মাউন্টব্যটেন তা ১৬ই আগষ্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। যথারীতি ১৬ আগষ্ট বিকেল ৫টায় ভাইসরয়ের বাড়িতে পার্টিশন কাউন্সিলের সভা আহবান করা হয়। উক্ত সভায় পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় যথাক্রমে লিয়াকত আলী খান ও পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, সরদার বলদেব সিং, আব্দুর রব নিশতার, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও ভি পি মেনন উপস্থিত হন। সভা শুরুর তিন ঘন্টা পূর্বে সীমানা কমিশনের রিপোর্ট প্রতিনিধিবর্গের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই রিপোর্ট কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং শিখ প্রতিনিধিদের কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দুই ঘণ্টা ধরে সভায় হট্টগোল এবং বাদ-প্রতিবাদ চলে। তবে শেষ পর্যন্ত সকলেই স্বীকার করেন যে, যেহেতু সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্তে কেউই খুশী হতে পারেননি, তার অর্থ প্রত্যেক পক্ষ কোথাও না কোথাও কিছু সুবিধা লাভ করেছে যা অন্য পক্ষকে অসন্তুষ্ট করেছে। শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষ সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহনে সম্মত হয় এবং তা শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করার ঐকমত্য ঘোষণা করে। বাংলা বাউন্ডারি কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবগঠিত পূর্ববাংলা অবিভক্ত বাংলার মোট আয়তনের ৬৩.৮০% এবং মোট জনসংখ্যার ৬৪.৮৬% লাভ করে। বৃহত্তর বাঙ্গলার মুসলমান জনসংখ্যার ৮৩.৯৪% এবং অমুসলমান জনসংখ্যার ৪১.৭৮% পূর্ববাংলাভুক্ত হয়। নবগঠিত পূর্ববাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ৭০.৮৩ : ২৯.১৭ । নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ২৫.০১% : ৭৪.৯৯%.
বাংলার বাউন্ডারি কমিশনের সিদ্ধান্ত অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকার মুসলমানদেরকে অবাক ও বিস্মিত করে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকার মুসলমানগণ ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করে, অথচ পরবর্তীতে তারা জানতে পারে যে, তারা ভারতভুক্ত হয়েছে। সরেজমিনে তদন্ত না করে দিল্লীর অফিস কক্ষে বসে মানচিত্রের উপর সীমানা চিহ্নিত করায় সীমানা কোন কোন ক্ষেত্রে একটি গ্রামকে দ্বিখন্ডিত করে, কোথাও তা বাড়ীর আঙ্গিনার মাঝখান দিয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় কারো ঘরের দরজা পড়েছে পাকিস্তানে জানালা পড়েছে ভারতে।
সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাময়িক ক্ষোভ সৃষ্টি করলেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ চাপা পড়ে যায় দেশত্যাগ, দাঙ্গা ও লুটপাটের ঘটনার যাঁতাকলে।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে সমগ্র বাংলা বিভক্ত হলো। একটি পূর্ববাংলা অপরটি পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হলো। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ হলো ভারতের একটি প্রদেশ। পাকিস্তান হলো মুসলমানদের দেশ॥"
- মুহাম্মদ আসাদ / বাংলা যেভাবে ভাগ হলো ॥ [ কৃষ্ণচূড়া প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ । পৃ: ৮৬-৯১ ]
কবীর সুমনের কলাম
"সুমনামি" কথাটা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যর উদ্ভাবন। তিনিই আমায় সঙ্গীত নিয়ে কলাম লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নামটিও তাঁরই দেওয়া। বাঁদরামি, ত্যাঁদড়ামি, বোকামি, ষণ্ডামি, ভণ্ডামি...সুমনামি। চন্দ্রিলই পারেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার লেখাটি অনেকেই পড়তেন। আমাদের পাড়াতেও বেশ বয়স্ক দুই ভদ্রলোক নিয়মিত পড়তেন। রাস্তায় দেখা হলে ঐ লেখাটি নিয়ে কথা বলতেন। একবার বোলপুরে গিয়ে একদল সুমনামি-পাঠককে পেয়েছিলাম। ---- বেশ চলছিল, হঠাৎ আনন্দবাজারের এক লেখক (সাংবাদিক???) আমার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা ছাপলেন। এই কাজটি সব পত্রিকাই মাঝেমাঝে করে থাকেন অল্পবিস্তর। গা-সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। হয়েও গিয়েছিল। তবু, এই ঘটনাটির পর মনে হলো - আমার বয়স হয়ে গিয়েছে, আর নেওয়া যাচ্ছে না। চন্দ্রিলকে ফোন করে বললাম - আর লিখতে পারব না ঐ কাগজের জন্য। চন্দ্রিল বলেছিলেন - "সুমনদা, আপনি না লিখলে আমার ক্ষতি তেমন নয়, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির ক্ষতি।" এমন কথা সচরাচর শুনি না। চন্দ্রিল আলাদা ধরণের মানুষ ও লেখক। ওর সঙ্গে আমার এমনিতে যোগাযোগ হয়নি বিশেষ, হয়ও না। কিন্তু আনন্দবাজারেরই এক লেখক গায়ে পড়ে যা করলেন সেটা হজম করতে পারছিলাম না। বড্ডো খারাপ লেগেছিল। কী করব। চন্দ্রিলের জন্যও খারাপ লাগছিল। ধ্যুৎ।
আনন্দবাজার পত্রিকার চেক বাড়িতে চলে আসে নিজে নিজেই। চাইতে হয় না, তাগাদা দিতে হয় না। সত্যি বলতে, আমার এই অবসরজীবনে ঐ দু'হাজার টাকা (কলাম-পিছু) আমার কাজে লাগছিল। ভোডাফোনের বিল।
সুমনামি-তে গানবাজনা নিয়ে কত কথাই না বলতে পেরেছিলাম। সঙ্গীত নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা দুষ্কর। কারণ, সঙ্গীত non-verbal medium.
গতকাল এক সম্মানীয় সহনাগরিক "লেখার রেয়াজ" কথাটি লিখেছেন আমারই একটি পোস্টের সূত্রে। রেয়াজ।
রেয়াজ।
শুনেছি কেস্‌রিবাঈ কেরকার পেশাদার সঙ্গীতজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরেও দিনে ১১/১২ ঘন্টা রেয়াজ করতেন, যার অনেকটা জুড়েই থাকত 'মন্দ্র-সাধনা।' মন্দ্র সপ্তকে লাগাতার গলা চালানো। ধীরেসুস্থে। শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে শোনা - একবার প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি ও মহম্মদ রফি দিল্লি গিয়েছেন, এক বিদেশী অভ্যাগতর সামনে গান শোনানোর জন্য। সারাদিন মহম্মদ রফি বেপাত্তা। একবারও দেখা হয়নি সন্ধ্যাদেবীর সঙ্গে। সন্ধেবেলা তিনি অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন, দেখেন - মহম্মদ রফি, সালাম দিচ্ছেন তাঁকে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসিটি হেসে। সন্ধ্যাদেবী শুধোলেন, কোথায় ছিলেন সারাদিন ভাইসাহেব? একবারও দেখা হলো না। - আবার মিষ্টি হেসে, মাথা নত করে "ভাইসাহেব" বললেন - "দিদি, রিয়াজ করছিলাম যে।"
শুনেছি মহম্মদ রফি, মান্না দে ও ইয়েসু দাসের রেয়াজ শোনার জন্য তাঁদের বাড়ির সামনে সক্কালবেলা ভীড় করত লোকে।
আকিরা কুরোসাওয়ার সাত সামুরাই ছবির এক জায়গায় দেখেছিলাম - বিপন্ন গরীব গ্রামবাসীদের ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচাতে যে সামুরাইরা এসেছেন তাঁদের একজন অবকাশ পেলেই এক একটা জঙ্গল-গোছের জায়গায় গিয়ে তরোয়াল চালানোর রেয়াজ করে থাকেন। একা। আপনমনে তরোয়াল চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি সমানে। নানানভাবে। তাঁর দক্ষতার মান রক্ষা করা এবং আরও বাড়ানোর জন্য। তরোয়াল-চালানোর রেয়াজ।
১৯৬১ সাল থেকে আমায় খেয়ালে তালিম দিতে শুরু করেছিলেন কালীপদ দাস। অনেক জন্মের সৌভাগ্য থাকলে অমন গুরুর দর্শন ও তালিম মেলে। আমার জীবনে 'মাস্টারমশাই' না এলে জীবনটাই অন্যরকম হতো। তিনি ছিলেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ির প্রথম সারির ছাত্রদের একজন, সেই বিরাট খেয়ালশিল্পীর গায়কীতে নিবেদিতপ্রাণ।
বাবা চেয়েছিলেন চিন্ময় লাহিড়ি আমায় তালিম দিন। তাঁকে অনুরোধ জানান বাবা। আচার্য কিন্তু বলেছিলেন, তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে, আগের সেই ফর্ম-ও আর নেই; অতো অল্প বয়সী কোনও শিক্ষার্থীকে তিনি ভালো শেখাতে পারবেন না। তিনি বলেছিলেন, "আমার এক সেরা ছাত্র, কালীপদকে, পাঠাবো। সে একেবারে ঠিকঠাক তালিম দিয়ে ছেলেকে তৈরি করে দিতে পারবে।
এখন ভাবি - কতোটা সৎ ছিলেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ি শিক্ষক ও মানুষ হিসেবে। কতোটা দূরদৃষ্টি তাঁর ছিল। ছাত্র কালীপদ দাসকে তিনি যদি বেছে না নিতেন আমি তৈরি হতাম না।
- আমি কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকে আচার্য আমীর খানের গায়কীতে বাঁধা পড়ে যাই। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সালে খানসাহেবের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে আমি তাঁর পোষা কুকুরের মতো অনুসরণ করে গিয়েছি। খেয়ালের তালিমে একটা সময় আসে যখন গুরু আর ছাত্র একসঙ্গে গান। একজন তবলায় থাকেন। ছাত্রকে গুরু স্বাধীনভাবে গাওয়ার পাঠ দেন, অন্তত সেটাই তাঁর দেওয়ার কথা। মাস্টারমশাই আর আমি এইভাবেই গাইতাম, আমি শিখতাম সমানে, তবলায় ঠেকা ধরে বসে থকতেন সত্য রায়, এক রসিক তবলিয়া।
আমার গায়কীতে, বিশেষ করে স্বরবিস্তার ও সরগমে খানসাহেবের জোরালো প্রভাব থাকত। আমার গুরু তা বুঝতেন এবং তাঁর ছাত্রর ওপর এক মহাশিল্পীর সেই প্রভাবকে সম্মান জানাতেন নীরবে, মিষ্টি হেসে। সেরকম কিছু করলেই তারিফ করতেন আমার গুরু ও সত্য বাবু, আমার আর-এক গুরু। সত্যি বলতে, আচার্য চিন্ময় লাহিড়ি (যাঁর ঘরাণায় আমার থাকার কথা) ও আচার্য আমীর খানের গায়কী ও দর্শনে কোনও মিল নেই। চিন্ময় লাহিড়ির হাতে তৈরি (তাঁরা দুজনেই আদতে পূর্ববঙ্গের মানুষ, সেই ঢাকা থেকেই আচার্য চিন্ময় লাহিড়ির কাছে আমার গুরুর তালিম শুরু) আমার গুরুর মধ্যে আমি কোনওদিন এই ব্যাপারে কোনও অসহিষ্ণুতা দেখিনি। বরং উৎসাহ দিতেন তিনি।
আমীর খান সাহেবের সঙ্গে আমার বাবার আলাপ ছিল। বাবাকে ধরলাম - খান সাহেব যদি একটু তালিম দেন আমায়। --- এক রবিবার আমাদের বাড়ির একতলার ঘরে মাস্টারমশাই-এর তালিম চলছে। সত্য বাবু তবলায়। হঠাৎ আমার গম্ভীর, স্বল্পভাষী পিতৃদেব ঘরে ঢুকলেন। মাস্টারমশাই একটা স্বরমণ্ডল বাজিয়ে তালিম দিতেন, আমি ছাড়তাম তানপুরা। সব থেমে গেল। বাবা সরাসরি আমার মাস্টারমশাইকে বললেন, "কালীপদবাবু, আমীর খান সাহেব সুমনকে তালিম দিতে রাজি হয়েছেন। রেডিয়োতে আপনার ছাত্রর গলা ও গান শুনে তারপর রাজী হয়েছেন। এখন আপনার অনুমতি তো চাইই। আপনি আজ্ঞা করলে তবেই খানসাহেবের কাছে সুমন যাবে। আর-হ্যাঁ, আপনার কাছে তালিম কিন্তু বাদ পড়বে না, পাশাপাশি চলবে।"
বাঙলার সাধারণ এক ঘরের ছেলে কালীপদ দাস। কে চেনে, কজন চিনেছে তাঁকে। পূর্ববাংলার মানুষ। দেশ ভাগ না হলে হয়তো কলকাতায় চলে আসতেনই না। কলকাতায় কত কষ্ট করে একটু জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। চিন্ময়বাবুর কাছে তালিম, নিজের রেয়াজ। আকাশবাণী কলকাতার খেয়াল শিল্পী। ট্রামে বাসে করে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শিখিয়ে সংসার চালাতেন। ছাত্রপিছু ২৫/৩০ টাকা নিতেন। আমি বলছি গত শতকের ছয়-এর দশকের কথা।
বাবার কথা শুনে কালীপদ দাস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোড় করে বললেন, "বড়দা, আমার কী ভাগ্য! সুমন যদি খানসাহেবের তালিম পায় তাহলে আমিও সুমনের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারব।" এই বলে কেঁদে ফেললেন আমার গুরু। আমিও কাঁদতে লাগলাম, সত্যবাবুও।
আমি জানিনা, এমন কটি বাঙ্গালি আত্মা আমার এই লেখাটি পড়বেন যাঁরা আদৌ উপলব্ধি করতে পারবেন কী হলো। সেই মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি আর ক'জন আছেন? আমার এই লেখা তো বাঙলার চাষী তাঁতি জেলে কামার কুমোর মুচি পড়বেন না। পড়বেন ইস্কুল-কলেজে পড়া "শিক্ষিত" বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত। - আমার শুধু একটাই অনুরোধ - মন্তব্য করবেন না কোনও। যদি চান পড়তে থাকুন। ভাবতে থাকুন।
সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একটু সময় দিলেন আমাদের। তারপর আমার মাস্টারমশাইকে বললেন - "শুনুন, কালীপদবাবু, আমার ছেলে সুমন তার আসল গুরুকে পেয়ে গিয়েছে। নতুন করে আমীর খানসাহেবকে সুমনের দরকার হবে বলে আমি মনে করি না। তালিম চলতে থাকুক, গান চলতে থাকুক। ব্যাঘাত ঘটালাম, কিছু মনে করবে না।" - প্রস্থান।
আমরা তিন জন কতোক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম আজ আর মনে নেই।
পরে বাবার কাছে শুনেছিলাম আমীর খানসাহেবকে এই ঘটনা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতাচার্য উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌ পাকের কাছে দোয়া করতে থাকেন। বলেছিলেন, "আল্‌হাম্‌দুলিল্লাহ্‌, চ্যাটার্জিসাব, আপ্‌কা লড়কাকো তো সদ্‌গুরু মিল গয়া! আল্লাহ্‌!" - ইংরিজি-হিন্দুস্তানী মিশিয়ে তিনি বলতে থাকেন, "অনেক ভাগ্য করলে এমন গুরু মেলে কপালে। ইনিই আসল তালিম দিতে পারবেন, সঙ্গীত-জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিতে পারবেন আপনার ছেলের মনে।"
এতোকিছুর পরেও বাবার মনে একটা "কিন্তু" থেকে গিয়েছিল। খানসাহেবের মনেও। কথা হচ্ছিল আকাশবাণী কলকাতার অফিসে, বাবার ঘরে। চা-বিস্কুট খেয়ে দু'জনে ঠিক করেন "সুমনকে" তো একটু 'আমীরখানী' সুযোগও দেওয়া দরকার। - খানসাহেবই একটা উপায় বের করেন। বলেন, একটা কাজ করা যাক, আমি যখন রিয়াজ করব সুমন এসে শুনুক। তাহলেই হবে।
'রিয়াজ', রেয়াজই সব। আমাদের, হিন্দুস্তানী ও কর্ণাটকী সঙ্গিতের গোলামদের ধর্ম হলো রেয়াজ। এই রেয়াজের মধ্য দিয়েই আমরা 'সাত সামুরাই'এর এক সামুরাই-এর মতো অবকাশ পেলেই দূরে গিয়ে একা একা তরোয়ালের কসরৎ করে যাই। দক্ষতায় থাকা, elements-এ থাকা, দক্ষতা বাড়াতে চেষ্টা করে যাওয়া, রাস্তা খোঁজা। খুঁজে যাওয়া। সাত জন্মেও কখনও মৃত্যু ছাড়া আর-কোথাও পৌঁছতে পারব না - এটা জেনেও রাস্তা খুঁজে যাওয়া। রাগের পথ ধরে পথ খোঁজা, পথ খুঁজে যাওয়া, চ'রে বেড়ানো। Essay. In the true sense of the term.
আমার লেখাগুলোও essay. চেষ্টা। শুধু চেষ্টা।
যে সুধী সহনাগরিক আমার ঐ লেখা বা লেখাগুলিকে "লেখার রেয়াজ" বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। গায়ক হবো বলে গান শিখেছি নাকি? তেমনি লেখক হওয়ার জন্য তো লিখি না। সাত সামুরাই-এর ঐ এক সামুরাই আমি। শুধু চেষ্টা। গান যা বানাই, সঙ্গীত যে করি, দিনের পর দিন বসে বসে যন্ত্রাণুষঙ্গ যে বানাই, নির্মাণ করি (যার কথা কেউ বলে না, কোনওদিনই কেউ বলবে না হয়তো, ভালো করে শুনতে শিখলে তো বলবে! শেখার আর দরকার কী- আমরা, মধ্যবিত্ত বাঙালিরা তো সব শিখে গেছি, বুঝে গেছি, জেনে গেছি, বলুন?) সবই 'রেয়াজ', 'রিয়াজ।' চেষ্টা। সন্ধান। যার শেষ হবে আমার মৃত্যুতে।
তারপর কি আবার জন্মাবো?
যেন জন্মাই; শুধু, ১৯৪৯ সালে জন্মে যে বাংলাকে তার সঙ্গীত সমেত পেয়েছি তারপর অনেকগুলো বছর, সেই বাংলাটাই যে আর থাকবে না আমার "পুনরজন্মের" কালে। সেই ভারতও তো আর থাকবে না। সেই ইউরোপ আমেরিকার আধুনিক গানও তো আর থাকবে না ---এখনই তো নেই।
*****
কবীর সুমন
২৫ জুন ২০১৫

বাঙালীর নিজের গান / আনিসুল করিম

বাঙালীর নিজের গান / আনিসুল করিম
বিদেশে গেলে বাঙালী মাত্রেরই দেশের জন্য মন উতলা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথই বা তার ব্যতিক্রম হবেন কি করে ? পুত্রকে চিঠিতে লিখছেন, “ আমাদের পাড়া গাঁয়ে চাঁদ উঠেছে অথচ কোথাও গান ওঠে নি , এ সম্ভব হয় না।” কোন দর্শনীয় বস্তু দেখতে না পাওয়া বা কোন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হবার মতো , গান শুনতে না পাওয়ার দুঃখে বাঙালী হৃদয় কাতর হয়ে পড়েছে। তারপর অনেকটা খেলার ধারাবর্ণনার মতো তিনি লিখছেন, “ এখানে সন্ধ্যার আকাশে নারকেল গাছগুলোর মাথার উপর শুক্লপক্ষের চাঁদ দেখা দিচ্ছে। গ্রামে কুঁকড়ো ডাকছে , কুকুর ডাকছে , কিন্তু কোথাও গান নেই “। 
অনেকটা যেন বিপক্ষ দলের সব খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল না হওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা। বাংলার বাইরে গান না শুনতে পেয়ে এক বাঙালী কবি যতখানি হতাশ , ততখানিই গর্বে উল্লসিত আর এক বাঙালী কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলার বাউল , মাঝি , চাষির মুখে গান শুনতে পেয়ে। এক বাউলের গান--
দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা,
দেহের মাঝে বাড়ি আছে,
সেই বাড়িতে চোর লেগেছে,
ছয় জনায়ে সিঁদ কাটিছে,
চুরি করে একজনা।
দেহের মাঝে বাগান আছে,
নানা জাতির ফুল ফুটেছে,
ফুলের সৌরভে জগৎ মেতেছে---
বোঝা যায় নিছক আবেগতাড়িত উচ্ছ্বাসে নয়, এমন গানের জন্য, এমন গানের ভাষার জন্য গর্ব অনুভব করা কবির জন্য যথার্থই। অথবা--
মন তুমি কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা। ( রামপ্রসাদ সেন )
যে জমিন থেকে এই গানের উদ্ভব সেই জমিনে মাথা ঠেকাতে কবিমনের ব্যকুলতা স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে মাটির কাছে থাকা মানুষগুলোর কাছেই জাতির ঐতিহ্য, তার সংস্কৃতি অক্ষত থাকে। ভিন্ন সংস্কৃতির আগ্রাসনে যখন শহুরে সংস্কৃতি বিকৃত হয়, নিজস্বতা হারায় , তখন মাটির কাছে থাকা মানুষগুলো আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে রাখার দায়িত্ব পালন করেন। আধুনিক সভ্যতার পশ্চিমা ঝড় যখন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে পল্লীর বাঙালী তখন অর্কেস্ট্রা, হারমোনিয়ামের মতো আধুনিক বাদ্যের মোহ ছেড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে খঞ্জনী আর একতারা হাতে। কেন না ওই সব যন্ত্রেই জড়িয়ে আছে তার পূর্ব পুরুষের হাতের ছোঁয়া। বাইরের জগতে যখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ, রক্তাক্ত পালাবদল, বাঙালী তার নিজস্ব সংস্কৃতি কথকতা, পাঁচালী, কবিগান, যাত্রাপালার বদলে আধুনিক কোন বিনোদনকে বেছে নিতে চায় নি।
দুঃখ দুর্দশার শিকার হয়ে, ক্ষুধা তৃষ্ণা অভাবকে সঙ্গী করেই বাঙালী তার পরম্পরাগত সম্পদকে পরম যত্নে রক্ষা করে এসছে দিনের পর দিন। এইভাবে সনাতন ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে গানের মধ্য দিয়ে ঘটল বাঙালীর সাহিত্য- সংসারে প্রবেশ। আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসাবে বাঙালী যে গান গলায় তুলে নিয়েছে তা হয়ে দাঁড়াল একান্তই তার নিজের গান।কেন না এই গানের সাথে প্রথাগত হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের কোন মিল পাওয়া গেল না।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে বাঙালীর সাহিত্য সাধনা তথা সংগীত চর্চার সুচনা চর্যাপদের মধ্য দিয়ে। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চর্যাপদের সময়কালকে বাংলাগানের ঊষাকাল বলা চলে। এরপর পদাবলীর যুগ। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে পরবর্তী প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বিদ্যাপতি, জয়দেব, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস প্রভৃতি বহু পদকর্তা তাঁদের সৃষ্ট কীর্তন গানের মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে ঈশ্বর, সাহিত্য ও সুরের সাধনা করে গেছেন। কীর্তন গান বাংলার সংগীত জগতে বিপ্লব ঘটাল। রাজদরবার ও ধনীর বৈঠকখানা থেকে মুক্ত করে বাঙালী এই সঙ্গীতকে টেনে আনল হাটে , মাঠে , ঘাটে, পথে প্রান্তরে। হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের বাঁধাগতে আবদ্ধ হয়ে না থাকায় এই সংগীত বাঙালীর ঘরে ঘরে সমাদৃত হল। ফলে চৈতন্যদেব কীর্তনকে অবলম্বন করেই বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। কীর্তন গানের আবহেই চৈতন্যদেব জাতপাতে দীর্ণ বাঙালীকে এক সুরের বন্ধনে একাত্ম করলেন। সপ্তদশ শতকে এল যাত্রাগান। সে যাত্রায় দোসর হল কবিগান, তরজা ইত্যাদি লোকসংগীত। বিনোদনের মোড়কে পরিবেশিত হল লোকশিক্ষা, সামাজিক সমস্যার প্রসঙ্গ। কথার চাপান উতোরে গাইয়েদের লড়াই উঠল জমে। সে আসর উপভোগ করতে লড়াই লাগল শ্রোতাদের মধ্যে। নারী পুরুষ , ধনী নির্ধন, জাত বেজাতের একসাথে আসন দখল করার লড়াই। বিংশ শতাব্দীকে যদি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলা হয় তাহলে এর পূর্ববর্তি সময়ে ঘটেছে বাংলা সঙ্গীতের মহোৎসব। উৎসব তো সেটাই যা মানুষকে মেলায়। গানের টানে মানুষ মিলল মেলায়, পালা- পার্বণে, উৎসবে অনুষ্ঠানে। জন্ম- মৃত্যু- বিয়ের মতো পারিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হল গান। পরিবেশিত হল। গাইয়ে বাজিয়েরা মহল্লায় মহল্লায় , পাড়ায় পাড়ায় আখড়া খুলে বসলেন। সম্ভ্রান্ত বাড়িতে আসর জমানোর জন্য মোটা নজরানা। এক জেলার আঞ্চলিক গান অন্য জেলায় আমন্ত্রণ পেল। মালদহ জেলার গম্ভীরা গানে শোনা গেল অভাব অভিযোগ ক্ষোভের কথা। কৃষির দেবতা শিবকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া গম্ভীরা গানে শুনতে পাওয়া গেল সামাজিক শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বাঙালী কণ্ঠ। গম্ভীরা গানের শিব যেন হিন্দু দেবতা জটাধারী মহেশ্বর নন। দীন দরিদ্র বাঙালীরই একজন প্রতিনিধি। বাংলার মুসলমান সমাজও ধর্মের বাধা টপকিয়ে আল্লাহ-রসুলের জয়গান নিয়ে গানের জগতে সামিল হল। মোহরমের বেদনাদায়ক ঘটনাকে স্মরণ করে গাওয়া 'জারি গান' বা ' ঝাড়নি গান ' এর করুণ রস হিন্দু বাঙালীকেও আকৃষ্ট করেছে। কাসেমের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী সাকিনার বেদনার মধ্যে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যাবে মনসামঙ্গলের বেহুলার কান্না। বাংলার মাটিতে প্রোথিত শিকড়ে, বাংলার জল হাওয়ায় বিকশিত শাখায় বেড়ে ওঠা বাঙালী মুসলমান সমাজের বিয়েতে ধর্মের শাস্ত্রীয় বিধান প্রায়ই গৌণ হয়ে যায়। প্রাধান্য লাভ করে গায়ে হলুদ, ক্ষীর খাওয়ানো, আইবুড়ো ভাত খাওয়া ইত্যাদি লোকাচার আর এইসব লোকাচারকে কেন্দ্র করেই মুসলমান বইয়ের গান। দলবদ্ধ নৃত্য সহযোগে এই সব গানে বাঙালী মুসলমান নারীর ভূমিকাই মুখ্য। মহিলাদের রচিত, মহিলাগীত এই গানে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কটাক্ষ ও ক্ষোভ তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে বাঙালী নারীর আত্মমর্যাদাবোধ এবং সমাজসচেতনতা।
বাঙালীর নিজস্ব গান প্রসঙ্গে আর একটি নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হলেন ' নিধু বাবু ' বা রামনিধি গুপ্ত। বাঙালীর নিজস্ব জীবনশৈলীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি টপ্পা অঙ্গের হিন্দুস্থানি গানে প্রয়োগ করলেন বিশেষ সংগীত শৈলী। নিধুবাবু শোরী মিয়াঁর টপ্পার ক্ষিপ্র গতিকে বাংলার কোমলতার সঙ্গে সংগতি রেখে , বাঙালী মনের উপযোগী করে গানের গতি কমিয়ে আনেন। বাংলা গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য কথা ও সুরের সমান মর্যাদা। নিধুবাবু বাংলা গানের সেই ধারাকে বজায় রেখে হিন্দুস্থানি টপ্পা রীতির কিছু গ্রহণ কিছু বর্জন করে বাংলায় যে টপ্পা গানের প্রচলন করলেন তাও চিহ্নিত হল বাঙালীর নিজের গান বলেই।
সর্বোপরি যাঁর গানের মধ্য দিয়ে বাঙালী তার আত্মপ্রকাশের উন্মুক্ত দরজা খুঁজে পেল তিনি হলেন কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনবদ্য কাব্যিক ভাষায় বাংলার মাটি থেকে উদ্ভূত লোকগীতির সুর সহযোগে যে অপূর্ব সংগীত সৃজন করলেন তার মধ্যে বাঙালী খুঁজে পেল তার মনের গহনে তলিয়ে থাকা অনুভূতিকে। রবীন্দ্রনাথ সংগীত শাস্ত্রকারদের প্রথাগত আচার অগ্রাহ্য করে বাংলা গানকে দিলেন মুক্ত বিহঙ্গের ডানা। সঙ্গীতকে শৃঙ্খলমুক্ত করার সপক্ষে তাঁর যুক্তি ছিল-- “ আমি জয়জয়ন্তীর ( রাগ ) কাছে এমন কি ঘুষ খাইয়াছি যে তাহার গোলামী করিতে হইবে ?”। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে, দিবসের নানা সময়ে রাগ রাগিণী ব্যবহারের যে প্রচলিত ধারা রবীন্দ্রনাথ সংগীতশাস্ত্রের সেই ধরাবাঁধা পথে চলতে রাজী হন নি। “ গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে আর কোলাহল নাই” তাঁর এই গানে তিনি ' পরজ' 'বসন্ত' রাগ ব্যবহার করেছেন। রাত্রির এই গানে প্রভাতী রাগ 'পরজ' ব্যবহার দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন মূলত গানের ভাবগত আবেদনই নির্ধারণ করবে রাগরাগিণীর প্রয়োগ। রবীন্দ্রশিষ্য কাজী নজরুল গজল সহ নানা ইসলামী সংগীত রচনা করে সংগীতবিমুখ বাঙালী মুসলমান সমাজকে ্যবাংলা গানে আগ্রহী করে তোলেন। রবীন্দ্রপূর্ব যুগে যে বাংলা গান অনেকটাই হিন্দুত্বের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে ছিল। নজরুল একই সঙ্গে ইসলামী গান আর শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন যার মধ্যে শাস্ত্রকথার থেকে প্রাধান্য পেয়েছে মানবিক আবেদন। ধর্মীয় বেড়াজালমুক্ত উন্নত কাব্যগুণসম্পন্ন নজরুলের এইসব গানকে সমগ্র বাঙালী জাতি তাই গ্রহণ করেছে নিজের গান মনে করে।

এরপর স্বাধীনতা উত্তরকালে আমরা দেখেছি বাংলা গান তার নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই বাঙালীকে দিয়েছে অনাবিল বিনোদন। তবে অতি সম্প্রতি বাংলা গানের জগতে যে সব কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে ( কানে শোনা সম্ভব হচ্চে না ) তাতে সংগীতপ্রেমী মানুষ বাংলা গানের ভবিষ্যৎ ভেবে উদ্বিগ্ন। বাংলা গানের বর্তমান গতি প্রকৃতি দেখে তারা ভাবছেন বাঙালী কি তার নিজের গান হারাতে বসেছে ? নানারকম বাদ্যযন্ত্রের বিকট আওয়াজে ভরা চিীৎকারমথিত শরীরী উল্লাস হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের দিনের কিছু বাংলা গানের নমুনা। ইদানীং বাংলা গানে এমন কিছু শব্দসমষ্টি ব্যবহৃত হচ্ছে যা কাব্য সাহিত্য সমৃদ্ধ বাংলা গানের অতীত গৌরবকে কালিমালিপ্ত করছে। বোঝা যায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়েই বাংলা গানের জগতে এই অনুকরণপ্রিয়তার প্রবেশ। বাংলা গানকে যারা ভালবাসেন তাদের বিশ্বাস সাময়িক উন্মাদনা থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলা গান তার নিজস্বতায় ফিরবে অচিরেই।   

Thursday, 25 June 2015

সৌজন্য নববার্তাডটকম
(ক)বীরগাথা / পার্থ দাশগুপ্ত
--------------
কাগজে কলমে কবীর সুমন আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী। তারা নিউজে ২০০৬-৭ সালে উনি 'মতামত' নামে একটি টক-শো সঞ্চালনা করতেন। যা ওই একই চ্যানেলে তুমুল জনপ্রিয় শো 'লাইভ দশটায়'-র উত্তরসূরি। যাকে টক-শো না বলে বলা ভালো 'সুমন একাই এক শো' smile ইমোটিকন আমি একরকম প্রায় জোরজার করেই সেই অনুষ্ঠানে ওঁর গবেষণার অবৈতনিক সাহায্যকারী হিসেবে একটা জায়গা পেয়েছিলাম। মাসখানেকের মধ্যে, সম্ভবত আমার কাজে খুশি হয়ে, উনি তারা নিউজ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেন যাতে আমাকে অনুষ্ঠানটির প্রযোজকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওঁর অনুরোধ বা সুপারিশ সেই সময়ে তারা নিউজ কর্তৃপক্ষের কাছে একরকম আদেশই ছিল বলা চলে। ওঁরা রাজি হন এবং তারপর থেকে আমার একটা যৎসামান্য মাসিক সাম্মানিকও ধার্য হয়। তখন সেই টাকাটাও আমার কাছে অনেক টাকা ছিল, কারণ আমি তখন স্বেচ্ছায় বেকারত্ব গ্রহণ করেছি। সোজা বাংলায়, কবীরদা আমাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দেন।
কবীর সুমন আমার মত একজন অর্বাচীনকে কবীরদা বলে ডাকার অনুমতি দিয়েছিলেন প্রথম দিনই। এবং আমি ওঁর বাড়ি থেকে খান দশেক বাড়ির পরেই থাকি অথচ আমাদের আগে আলাপ হয়নি জেনে অবাক হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন জানি না। কারণ বাঘে গোরুতে আলাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক না। সাংবাদিকতায় সম্পূর্ণ অশিক্ষিত এবং অনভিজ্ঞ একজন অনতিতরুণকে ( তখন আমার বয়স আটত্রিশ) আক্ষরিক অর্থে হাতে করে কাজ শিখিয়েছিলেন। Anirban Sadhu Sukanta Mitra এবং শুভেন্দু কয়াল - আমার অন্যান্য সহকর্মী এবং বন্ধুরাও একইরকম যত্ন, নিষ্ঠা এবং ভালোবাসার সঙ্গে আমাকে কাজ শিখিয়েছিলেন।
আমরা যে সময়টায় এবং যতদিন একসঙ্গে 'মতামত' করতে পেরেছিলাম, ঘটনাচক্রে স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গে সে বড় সুখের সময় নয়। এবং অভূতপূর্বও বটে। আমাদের সবার জীবন বরাবরের জন্য পালটে দিয়েছিল সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম - লালগড়। আমরা সবাই একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করতাম, যাকে সাংবাদিকতা না বলে মানবজন্মের দায় মেটানোর একটা প্রাণপণ চেষ্টা বলা বোধ হয় সত্যির বেশি কাছাকাছি হবে। তার বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না, কারণ সেটা যে ক'জন জানেন, ( যেমন আমাদের পরিবারের লোকেরা ), তাঁরা জানেন। আর যারা জানেন না, তাঁরা আন্দাজও করতে পারবেন না। তারা নিউজের নিউজ এডিটর Debjyoti Chakraborty আমাদের পিছনে সর্বশক্তি এবং যাকে বলে nose for journalism - নিয়ে না দাঁড়ালে কাজটা আমরা করতে পারতাম না। এ বঙ্গের 'পরিবর্তন'কামী ও তার ধ্বজাধারী ক'জন মানুষ তাঁর নাম জানেন ও অবদানের খবর রাখেন?
সিপিএম পরিচালিত তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার আমাদের এই উদ্যোগে বিচলিত হয়ে তারা নিউজ কর্তৃপক্ষর উপর এমন কিছু একটা চাপ তৈরি করেন, যার ফলে কবীরদা কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আমাকে অবশ্য প্রস্তাব দেওয়া হয় 'মতামত' অনুষ্ঠানের প্রযোজক হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে এবং বলা হয় সপ্তাহে তিনদিন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আর দু দিন অশোক বিশ্বনাথন কবীরদার জায়গায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করবেন। আমি সবিনয়ে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করি ও তারা নিউজের কর্তা ডঃ অমিত চক্রবর্তী মহাশয়কে জানাই যে, বাঘের খাঁচায় খাবার দিয়ে আমার এমন বদভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, এরপর বাঁদর নাচানো আমার পক্ষে অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই আমার কাজটি ও সেই মাসোহারাটি চলে যায়। কবীরদা চলে যাওয়ার পরের দিনই।
আমি শিক্ষকতা করে জীবিকানির্বাহ করতে থাকি। কবীরদা সক্রিয় রাজনীতিতে চলে যান। আমাদের যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন না হলেও ক্ষীণ হয়ে আসে। ২০০৯ সালে আমি সুকুমার রায়ের 'আবোল তাবোল'-এর সবকটি কবিতার পুনর্লিখন করি মূলত সিপিএমের দানবীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার একটা ফর্ম হিসাবে। কবীরদাকে পাণ্ডুলিপিটি দেখাই। উনি চমৎকৃত হন এবং সেটা ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন। উনিই বইটির নামকরণ করেন 'হ্যাঁ বোল না বোল', যা আজ আপনাদের অনেকেরই পড়া। ২০০৯ সালের ১৬ মার্চ ওঁর জন্মদিনে কলামন্দিরের অনুষ্ঠানে কবীরদা বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সে বছর উনি লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হওয়ার পর আমি 'বিজল্প'র প্রসূন ভৌমিকের প্রযোজনায় ওঁর উপরে একটি প্রচার ভিডিও বানাই। সেটা খুব খারাপ হয়নি এবং বেশ কিছু জায়গায় প্রচারিতও হয়েছিল। কেউ চাইলে আমি কপি করে দিতে পারি। সাংসদ হওয়ার পর দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার জন্য আমি ওঁর একটা লম্বা সাক্ষাৎকার নিই যাতে একটা প্রধান প্রশ্ন ছিল সাংসদ হিসেবে উনি কী কী কাজ করতে পারবেন। উনি যা উত্তর দিয়েছিলেন এবং বাস্তবে যা করতে পেরেছেন, যে কোনও উৎসাহী তা সরেজমিনে যাচাই করে আসতে পারেন। জয়াতলা, হিমচি, খেয়াদা - এই গ্রামগুলো কলকাতার মানুষের থেকে অনেক দূরে হলেও শহর কলকাতা থেকে আসলে খুব দূরে নয়।
২০০৯ সালের শেষ দিকে আমি আবার বেকার হয়ে পড়ি এবং কবীরদার সুপারিশে 'যুগ পরিবর্তন' নামের একটি সদ্যোজাত দৈনিক পত্রিকায় কাজ পাই। সেটি অবশ্য অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তবে কপালজোরে আমি কাগজটির চিতারোহণ পর্বের পূর্বেই সর্বভারতীয় ইংরেজি সাপ্তাহিক 'তহেলকা'য় কাজ পেয়ে গিয়েছিলাম।
২০০৯ সালের ১৮ জুন রাত দশটায় আমার বাবা মারা যান। পরের দিন বাবাকে দাহ করার আগে কবীরদা আমার অনুরোধে বোড়াল শ্মশানে শায়িত বাবার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের 'পথে চলে যেতে যেতে' গানটি গেয়েছিলেন। ওঁর অনুষ্ঠান কিন্তু এখনও হাউসফুল হয় এবং টিকিটের দাম নেহাত কম নয়।
আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, এত কথা লিখলাম কেন? আমার কেরিয়ারগ্রাফের গল্প শোনাতে? নাকি কবীর সুমনের সঙ্গে আমার হৃদ্যতার কাহিনি শোনাতে? উত্তরগুলো একে একে দিচ্ছি।
এক, কবীর সুমন ইদানীং নিয়মিত ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর নানা মতামত দিচ্ছেন এবং আজকালকার সংবাদমাধ্যমের ভাষায় 'বিতর্ক বাঁধাচ্ছেন' ( চন্দ্রবিন্দুটা খেয়াল করুন)। এতে অনেকে উল্লসিত হচ্ছেন, অনেকে মজা পাচ্ছেন এবং অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছে। এবার বোঝাই, 'মতামত'-এর প্রসঙ্গ কেন টানলাম। আজ যদি 'মতামত'-এর মত একটা মঞ্চ ওঁর থাকত, তাহলে কবীর সুমন এই লেখাগুলো ওঁর অশক্ত কাঁপা আঙুলে ল্যাপটপে লিখতেন না। এটা কেন বলতে হল? কারণ, যাঁদের স্মৃতিতে 'মতামত' রয়ে গিয়েছে, তারা যদি আজকের 'টক শো' গুলো দেখেন, তাহলেই বুঝবেন, আজ অন্তত এ বাংলার কোনও চ্যানেলের মাথাতেই আসবে না ওরকম একটা অনুষ্ঠান করার বা কবীর সুমনকে দিয়ে তা সঞ্চালনা করানোর। আধুনিক বাংলার ( এবং সম্ভবত এ দেশের) সেরা মস্তিষ্কের যদি কমিউনিকেশনের তাগিদ থাকে, তাহলে তাঁকে তাঁর যোগ্য জায়গা কেউ দিতে পারছে কি? ফলে, উনি ফেসবুকে লিখে বেশ করছেন। যারা ওঁর ফেসবুকে আশ্রয়প্রাপ্তি নিয়ে বিচলিত বা আমোদিত, তারা চুপ করে থাকলেই দেশের ও দশের মঙ্গল।
দুই, আমি আমার কথা এত বেশি করে এইজন্য লিখলাম কারণ আমার মত নিশ্চয়ই এমন আরও অনেকে আছেন যারা কবীর সুমনের দ্বারা নানাভাবে উপকৃত। শুধু আমার পিতৃসম শিক্ষক হিসেবে নয়, আমার ক্ষেত্রে ওঁর অবদান কিন্তু কোনও শুকনো উপকার নয়, উনি চাকরি জুটিয়ে দিয়ে আমার ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করেছেন - দু বার। এবং ওঁর উদ্যোগে 'হ্যাঁ বোল না বোল' প্রকাশিত হওয়ার ফলেই আমি সাংবাদিক হিসেবে কল্কে পেয়েছি। আমি অনেকদিন ধরে ওঁর ফেসবুকের সব লেখা খেয়াল করছি। কিন্তু কখনও দেখছি না কেউ তাঁদের জীবনে ওঁর অবদানের কথা খোলাখুলি বলছেন। ওঁর গান কার কেমনভাবে জীবনদর্শন পালটে দিয়েছে সেরকম অনেক গল্প আমরা জানি। এবং নিয়ত সে আহ্লাদ শুনতেও পাই। কিন্তু ওঁর কারণে আমার মত বাস্তব জীবন পালটে যাওয়ার গল্প আরও মানুষের আছে আমি নিশ্চিত। তাঁদের কোথাও দেখি না। তাই আমি অন্তত আমার কথাটা প্রকাশ্যে বললাম।
তিন, অনেকদিন কবীরদার সঙ্গে দেখা হয় না। উনি যা লেখেন এবং বলেন ইদানীং, সব কিছুর সঙ্গে আমার মতেও মেলে না। কিন্তু খারাপ লাগে যখন দেখি যে কেউ, আবার বলছি, যে কোনও রাম শ্যাম যদু মধু, ওঁর যে কোনও লেখায় মতামত দেওয়ার স্পর্ধা দেখান। 'অওকাদ' বলে একটা শব্দ আছে, যার বাংলা হয় না। ফলে বাঙালিরা তার অর্থও জানে না, অনুশীলনও জানে না। কবীর সুমন যা খুশি লিখুন, আপনাদের পক্ষে চুপ করে থাকাটা কি খুব কঠিন? কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দার্জিলিং গিয়েছেন। একদিন রোদ ঝলমল করে সে আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দিল, আর তার পরের সাতদিন হয়তো মেঘে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকল। তা বলে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা উইঢিপি হয়ে গেল? না কি, কেন সে প্রতিদিন রোদ ঝলমলে হয়ে নেই - তাই নিয়ে তার বিরুদ্ধে পিটিশন দেন?
এবার যে ধান ভানতে বসেছিলাম সেটা লিখে শেষ করি।
কবীরদা জার্মান ভাষাটা তাঁর মাতৃভাষা বাংলার মত করেই জানেন। একটা খটমট উচ্চারণের ভাষায় কথা বলে বলেই যে জার্মানরা একটা রসকষহীন জাতি নয়, সেটা উনিই আমাকে গল্প করেছিলেন। তার মধ্যে দুটো গল্প এরকম।
কোনও জার্মান যখন কোনও স্বজাতিকে অপমান করতে চায়, ইংরেজিতে যাকে belittle করা বলে, তখন সে রাগারাগি, চেঁচামেচি করে না। খুব বিনীত ও নিরীহভাবে দুটি বাক্য বলে -
এক - যা দেখলাম মশাই, শিক্ষা জিনিসটা আপনার বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি।
আর
দুই - আপনি আসলে 'আপনি' নন, আপনি একটা 'তুই'।
কবীরদা ইদানীং যখন ফেসবুকে নানা সুখদুঃখের কথা লেখেন বা এই সমাজ বা এখনকার মানুষজনকে নিয়ে লেখেন, বা নানা কমেন্টের প্রতিক্রিয়া দেন, তখন নিজে যে কেন এই দুটি বাক্য খেয়াল রাখেন না, কে জানে। রাখলে, এই লেখালেখি ভুলে আরেকটু বেশি সময় রিয়াজ করতে পারতেন। আমরাও সমৃদ্ধ হতাম আরেকটু বেশি।
কবীরদা, ভুল বললাম কিছু?
প্রণাম নেবেন।

Tuesday, 23 June 2015

ভারত মানেই হিন্দি নয় , হিন্দি ভারতের একমাত্র মুখ নয় / গর্গ চ্যাটার্জী



দিল্লীর হিন্দিবাদিরা সরকারী ভাবেই যেখানে ছলে বলে কৌশলে ভারতের বাকি সব ভাষাকে কোণঠাসা করতে মরীয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ম্বরে হিন্দি ভাষা শিক্ষার বিভাগ উদ্বোধন করে এলেন। এর সব খর্চা যোগাবে ভারত। ভারতবাসীর করের টাকায়। আমরা যারাই কিনা যে যার মা ও মাতৃভাষার মর্যাদায় বিশ্বাস করি নিশ্চয় বুঝতে পারছি আমাদের শত্রু কে , মিত্রই বা কে ? আসুন শপথ নিই হিন্দি , যা আমাদের রাষ্ট্র ভাষা নয়, রাজ ভাষাও নয়, আর সব ভারতীয় ভাষার মতই একটি আঞ্চলিক ভাষাই, আমাদের যতটুকু সম্মান দেবে আমার ভাষাও তাকে ততটুকুই পাল্টা সম্মান দেবে। এক ফোঁটা বেশিও না , কমও না।

আফনি বইছন জলর তলত / পার্থ বসু

আফনি বইছন জলের তলত / পার্থ বসু
অখণ্ড বাংলার রাজধানী কোলকাতায় আসতো চাটগাঁ থেকে দার্জিলিং, সুরমা ভ্যালি থেকে সুন্দরবন সব জেলার মানুষ। কোলকাতায় তাঁরা যে যার মাটির ভাষায় কথা বলতেন নিশ্চয়। বাজার তার নিজের প্রয়োজনেই বুঝে নিত। কোলকাতার বাতাস সেই নানা শব্দে ম ম করত। জারিত হত। বেচাকেনায় দু পক্ষই পরস্পরকে যে যার গরজে বুঝে নিতেন। বাংলা ভাষার আঞ্চলিক শব্দের আর উচ্চারণের যে বিপুল বৈচিত্র আর বিশিষ্টতা কোলকাতার কান তাতে অভ্যস্ত ছিল। হয়তো জিহ্বা সড়গড় ছিল না।
ব্যাপারটা এভাবেও ভাবা যায় বাংলাভাষা জেলায় জেলায় নানা স্রোতে প্রবাহিত। একসময় সেই নানা স্রোত নানা ঢেউয়ে আছড়ে পড়ত কোলকাতায়। দেশভাগের পর দিন বদলেছে।
কোলকাতা নিজেই তার লব্জ হারিয়েছে কবেই। শান্তিপুর কেস্টনগরের বুলি কপচে তবু তার নাক উঁচামির সীমা নেই। শুধু পূব বাংলার বুলি নয় সে মেদিনীপুর বাঁকুড়া পুরুলিয়ার বুলিতেও হাসে। অবশ্য আঞ্চলিক ভাষার কবতে আবৃত্তিকারের গলায় শুনে হাততালিও দেয়। কারণ ? কোলকাতা কি প্রমিত বাংলার মনসবদার ?
পায়ের তলার মাটি কবেই সরে গেছে। বাংলা তাড়ানোর পৃষ্ঠপোষক সরকার নিজেই। সরকারী কাজ বাংলায় করার উদ্যোগ নেই। বাংলা ভাষার কোন ভবিষ্যৎ নেই। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য যেখানে স্কুলে বাংলা শেখা অবাঙ্গালী দূর কথা বাঙালীর জন্যই আবশ্যিক নয়। বাংলা না শিখলেও কারও কিছু যায় আসে না। আগে অন্তত বেচুদার চাকরিতে গ্রাম গঞ্জের বাজার ধরতে বাংলা জানা লোকের কদর ছিল। এখন হিন্দি জানলেই হল। মোবাইল সেট বানান আর বিক্রি করেন যে মাইক্রোমাক্স কোম্পানি তারা বাজারে নতুন সেট এনেছে। মেসেজ করে যে কোন দশটি ভাষায় তা ঝটপট অনুবাদ করে দিচ্ছে। এই দশ ভাষার মধ্যে হিন্দি আছে, তামিল আছে, মালায়লম আছে, গুজরাতি আছে – নেই শুধু বাংলা। সেটটি বিক্রি হবে বাংলায় , পশ্চিমবঙ্গেই !
তোমার খড়্গ ধুলায় পড়ে-- এখানে খড়্গ কি ভাবে উচ্চারণ করি ? খড়গো এভাবেই তো ? অথচ খড়গপুর খড়গোপুর এভাবে বলার জন্য এক কালে কোলকাতার মেয়েটির কাছে খুব ঠ্যাটা হতে হয়েছিল। মেয়েটি যুবতী ছিল এবং সুন্দরী। সে বয়সে আত্মসম্মানে লাগলেও আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারি নি। শহর কোলকাতাই এক বিপুল আকর্ষণ। দূরের গ্রামটিও আজ তাকেই নকল করে।
ওপার বাংলা কবেই আঞ্চলিক শব্দের অভিধান সংকলন করেছে। এমন কি বরাক করেছে। শিলচরের আবিদ রাজা মজুমদার আর হাইলাকান্দির জগন্নাথ চক্রবর্তী বিশাল দুটি বই লিখেছেন। আমরা এপারে পারি নি। কোলকাতায়।

একটা গল্প বলি। গল্প নয় সত্য।
ফাঁসীর মঞ্চে প্রাণ দিলেন উনিশের ক্ষুদিরাম। জন্ম আমি যে জেলায় থাকি তার পাশের জেলায়। মেদিনীপুরে। পীতাম্বর দাস তাই নিয়ে গান বাঁধলেন --- একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। তখন না ছিল টেলিভিশন , না ছিল কি রেডিও। শুধু মুখে মুখে গানটি ছড়িয়ে পড়ে অখণ্ড বাংলার কোণে কোণে , এমন কি ভারতের অন্য রাজ্যেও। ফলত গানটি জেলা থেকে জেলায় আঞ্চলিক শব্দে জারিত হয়। ভাব ঠিক থাকলেও ভাষায় প্রকারভেদ আসে। ক্ষুদিরামকে নিয়ে যে কাজ হয়তো আমাদের করার ছিল, ক্ষুদিরাম ঘরের ছেলে, বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে। বাংলা একাডেমী ঢাকা 'একবার বিদায় দে মা' র রূপান্তর সমগ্র প্রকাশ করেছেন।
কোলকাতা ভাষাগত ভাবেই ছুঁতমার্গী। কোলকাতা সেই কুয়ো যার বাসিন্দা ভেকসমূহ সবজান্তার ভেক ধরেন। কিন্তু ভিতর ফাঁপা। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসা মানে তার সমগ্রতাকেই ভালোবাসা। তার আঞ্চলিক প্রকারভেদকেও সম্মান করা।
ফেসবুকের কল্যাণে এই বয়সে আমি বাংলা ভাষার নানা স্রোতে অবগাহনের সুযোগ পাচ্ছি। আমার বন্ধু তালিকায় সিলেট থেকে সুন্দরবন, রংপুর থেকে খুলনা, পঞ্চগড় থেকে পাবনা , রাজশাহী থেকে যশোর-- নানা এলাকার মানুষ। তাঁদের টাইমলাইনে আনন্দে সফর করি। সমৃদ্ধ হই। কান সম্পন্ন হয়। প্রাণ তৃপ্ত।
গতকাল আমার যৌবন কালের বন্ধু গৌরীশঙ্কর দত্তের বাড়ি গেছিলাম। ভালো কবিতা লিখতেন। ভালো প্রাবন্ধিক। নানা বিষয়ে পড়াশুনা আছে। বয়স এখন একাশি। এখনও আড্ডা ভালবাসেন। শরীর সঙ্গ দেয় না। প্রাণ উচ্ছল মানুষটিকে দু এক আঁচড়ে পেশ করি আগে।

ঢাকা বিক্রমপুরের মানুষ। চেহারায় আপাত রুক্ষ। কিন্তু মিশতেন শিং ভেঙে আমাদের মত বাছুরের সাথে। খালাসীটোলায় নয় কোলাঘাটে নদীর ধারে আমরা কজন গৌরীদার সঙ্গে মহীনের ঘোড়া। গৌরীদা মস্তিতে ছিলেন। শখ হল সিনেমা দেখবেন। সিনেমা দেখতে গৌরীদা শলা করতেন রিক্সাচালকদের সাথে। আঁতেল সমালোচনায় কান দিতেন না। কিন্তু বেলা প্রায় দুটো। খটখটে রোদ। হাতের নাগালে রিক্সাওয়ালা কেউ পাওয়া গেল না। ফিরতি ট্রেনে যাওয়া হল বাউড়িয়া। ওখানে মুঘলে আজম চলছে। কাগজে রিভিউ পড়েছি। ধ্রুপদী।
গৌরীদা নিমরাজি হয়ে টিকিট কাটলেন। আমরা দোতলার ব্যালকনিতে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি। হাফ টাইম। হল ফাটিয়ে গৌরীদা হাঁক দিলেন-- চল। এ বই দেখা যায় না। হাফ টাইম হইয়া গেল একটাও সিটি পড়ে নাই। এটা হিন্দি বই !
সাহিত্য সভায় নতুন ছেলেটি স্বরচিত কবিতা পড়ছে। গৌরীদা এসব আসরে আসতেন নিয়মিত। শুনতেন মন দিয়ে। আলোচনাও করতেন। একদিন ক্ষেপে গেলেন। সদয় পড়া শেষ করেছে নবীন কবি গৌরীদা অগ্নিশর্মা-- এটা কি হইছে ?
কবিতা ? বয়স কত হে ? সুকান্তর নাম শুনছ ? আঠারো বছরে সুকান্ত যা ল্যাখছে আগে সেই মান স্পর্শ কর। তারপর আগাবার কথা, ল্যাখার কথা ভাববে। বাংলা সাহিত্য বর কঠিন ঠাই। অযোগ্যের জায়গা নাই। যাও , বারাইয়া যাও।
ছেলেটি কাঁদো কাঁদো। গৌরীদাকে চাপা স্বরে বললাম-- কি হচ্ছে গৌরীদা? ছেলেটি ভয় পাচ্ছে তো !
অমনি খ্যাঁক খ্যাঁক করে সরবে হেসে ফেললেন-- ভয় না পাইলেই টিকব।

গৌরীদার কথা বিশদে আবার লিখব। কালকের আড্ডা থেকে দুটি গল্প শেয়ার করছি। গৌরীদার বলা।
একটি গল্প নোয়াখালীর। নোয়াখালী প বলতে ফ কয়। এটুকু মনে রাখুন। চাষি চলেছে আলপথে। গ্রামে ঢুকে সে তখন ক্ষুধায় তেষ্টায় কাতর। সাথে চিঁড়া আছে। সামনে টলটলে পুকুর। চিঁড়া ভিজাতে জলে নামতে গিয়ে বিষম খেল। জলে ওগুলি কি ? কুমীরের বাচ্চার মত। চাষি বাণ জাতীয় মাছ দেখেছিল। কিন্তু ভয়ে তার মাথা তখন কাজ করছে না। অদৃশ্য কুমীরকে শুনিয়ে বলল
আফনি বইছন জলর তলত
সন্তানগণ ফাটিয়ে দিছু
মুইঠ্যা চিঁড়া ভিজাইবাম
তবু জলত না নামবাম।
কিছু বুঝছ কোলকাতা?
এ গল্পটা চট্টগ্রামের। গৌরীদা শুনেছিলেন তাঁর কাকার মুখে। কাকা শৈলেন ঘোষ ছিলেন নাটক পাগল। গ্রামে নাটক হবে। রামায়নের গল্প। মুসলমান প্রধান গ্রাম। নাটকের বেশীর ভাগ কুশীলব তারাই। রাবনের চরিত্রে অভিনয় করছে দশাসই ইয়াসিন। শৈলেন পরিচালক। শেষ দৃশ্যে রাবনের বাণ খাওয়া , পতন ও মৃত্যু। কিন্তু ইয়াসিন বাণ খেয়েও পড়ছে না। রাম ফিসফিস করে বলল – ফরি যাও। কে শোনে কার কথা ! ইয়াসিন ওরফে রাবণ সদম্ভে বলল-- ইয়াসিন এমন বেটা ন দুই চাইরটা না মারি ফরি যাইত !
শুরু হল ধুন্ধুমার। দর্শক সমর্থন ইয়াসিনের দিকেই। ঠিকই তো কইছে। মারপিট হউক। দেখি কে জিতে !
শৈলেন চেঁচালেন-- ইয়াসিন শুইয়া ফর। ফরি যাও।
বটে ! গ্রামবাসী তা মানবে কেন। একযোগে চড়াও হল তাঁর উপর। ওই শালাই নষ্টের মূল।


শৈলেন পিঠ বাঁচাতে দৌড় দিলেন। সে আর এক রামায়ণ।  

দিওয়ানা জিকির / জুয়েল মাজহার

   দিওয়ানা জিকির
।। জুয়েল মাজহার ।।
আমারে পড়বো মনে, জানি তুমি, ডাকবা আমায়
খাড়া-সোজা-উপ্তা হয়া দিওয়ানা জিকিরে অবিরাম;
বাঁশের ঝিংলা দিয়া, জালিবেত-সুন্ধিবেত দিয়া
কানমলা দিয়া মোরে কতো আর করবা প্রহার।
আমি এর প্রতিশোধ নিব ঠিক। খাল-বিল-নদীনালা বাইদ
পার হয়া চলে যাব একশো ক্রোশ দূরে একদিন।
যেন, কনফুসিয়াসের স্বপ্নে বিভোর কোনো চীনা
সারাদিন একা একা খালেবিলে কিস্তি ভাসায়

ডাকবা আমারে তুমি লুকায়া লুকায়া একদিন!
যেন এক ভেকশিশু, হাইঞ্জাকালে কচুর বাগানে
ডর পায়া, চিল্লায়া, মায়েরে একলা তার ডাকে।
যেমতি বাদলা দিনে পাইতা মোরে হাকালুকি হাওরে হাওরে
সাড়া তবু পাইবা না। যেনো বোবা কালেঙ্গাপাহাড়
চুপ মাইরা বইসা রবো; আর দেখব তোমার জিল্লতি
যতো জোরে ডাক পাড়ো কোনোদিন পাবা না আমায়।
লক্ষ ক্রোশ দূরে গিয়া তোমা হতে থাকব স্বাধীন!
খেলব, খেলার ছলে একা বসে তাস সারাদিন।

আমারে খুঁজবা তুমি হবিগঞ্জে, তেকোনা পুকুরপাড়ে,
মিরাশির মাঠে আর উমেদনগরে,
করবা তালাস চুপে পুরান মুন্সেফি আর বগলা বাজারে।
দুই হাত উঁচা কইরা হাঁক দিবা যেন ক্যানভাসার:
চিফ রেইট,
দুই টেকা,
হলুদি ব্যাটাটা!

বেফিকির উড়াধুড়া আমি এক ফকিন্নির পোলা
আন্ধা-কানা ঘুইরা মরি লালনীল স্মৃতির বাগানে;
চান্নি-পশর রাইতে জারুলের নিচে বেশুমার,
আবালের সর্দি যেন সাদা-নীল ফুল ঝরে পড়ে

মগরা নদীতে আর লাফুনিয়া-কইজুরি বিলে
তোমার নাকের মতো বেঁকা-ঘোলা জলে নাও লয়া,
মনভরা গোস্বা লয়া, পেটভরা ভুক লয়া আমি
অলম্ভূত কালা বাইদে ভাইসা রবো একলা স্বাধীন।
যেন আমি বাচ্চা এক উদ
খিদা লাগলে উপ্তা ডুবে আচানক কালবাউস ধরে
কুশার-খেতের ভিত্রে বইসা খাব ফুর্তি লয়া মনে;

আসমানে লেঞ্জাহাঁস উইড়া চলে হাজারে-বিজারে
চিতলের পেটি য্যান কলকলাবে সামনে ধনুগাঙ;
তার বুকে ঝাঁপ দিব, করবো আমি সেখানে সিনান

আমারে না পায়া যদি নিজের জাগ্না চউখে মাখো তুমি নিদ্রাকুসুম,
আমি তবে পুটকিছিলা বান্দরের মতো
বসে রবো চুপচাপ
বদ্দিরাজ গাছের
আগায় !!

অনিকেত প্রান্তর / গর্গ চ্যাটার্জী

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সাথে ভারতীয় সংঘ-রাষ্ট্রের নরেন্দ্র মোদীর চুক্তির ফলে নিরসন হলো ছিটমহল অধ্যায়, যদিও এর মধ্যেই অন্য রাষ্ট্র  বেছে নেওয়ায়ে সংখ্যালঘু ঘর ইতিমধ্যেই ঘর জ্বলেছে এক রাষ্ট্রে  অদ্ভূত জিনিস এই ধর্ম, রাষ্ট্র নাগরিকত্বের টানাপড়েন-গুলি  আর এসব  এলোমেলো করে দেওয়া সেই অদ্ভূত শব্দটি - ‘জন্মভূমি বাংলাদেশের অন্তর্গতভারতীয়ছিটমহলেভারতীয়নাগরিক শিশু পাশের গ্রামে (অর্থাৎ বাংলাদেশে) গিয়ে শিখেছে যে তার প্রধানমন্ত্রী হলো শেখ হাসিনা সর্বার্থেই ছিট-মহল গুলি প্রান্তিক, এমনকি রাষ্ট্রও তাদের থেকে আনুগত্য দাবি করে না ভারতের নাগরিক নিজেকে ভারতীয় মনে করে কিনা, তেরঙ্গা দেখে সটান হয় কিনা, গান্ধী দেখে শ্রদ্ধা দেখানোর ভাব করে কিনা, ক্রিকেটে পাকিস্থান-ঘেন্না করে কিনা, ছিটমহলবাসীদের ক্ষেত্রে ভারতের তাও এসে যেত না আজকালকার রাষ্ট্র-ভিত্তিক বিশ্ব-চরাচর-কল্পনার দিনে  দিনে এর চেয়ে হতোছেদা আর কি করে করা যেতে পারে যাই হোক, আশা করা যায় যে এখান থেকে দুই দেশের বাচ্চারা ঠিক ঠিক পতাকা দেখে ঠিক ঠিক সটান হতে শিখবে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ঘুণাক্ষরেও সোসিয়াল মিডিয়া-তে হিন্দি ছাড়া কোন দেশী ভাষায় তার প্রজাদের বার্তা পাঠান না, হেন পাক্কা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী পূর্ব্ববাংলা সফরকালে সস্তা চমক দিয়ে সেখানকার বাঙ্গালীর মন জয় করার জন্য টুইট করলেন বাংলায় একজন পশ্চিম-বঙ্গবাসী হিসেবে এটা  কতটা অপমানজনক যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের সেটুকু স্বীকৃতিও দেয় না, যতটা কিনা পূর্ব্ব-বঙ্গবাসীদের দেয় আকাশ খুব অন্ধকার  আমরা একটু নিজেদের ভাঙ্গা সিঁড়দারাটার দিকে চেয়ে দেখি, একটু লজ্জা পাই, একটু ক্ষুব্ধ হই, একটু আত্মসম্মান সঞ্চয় করি স্বীকৃতি দিক না দিক, দিল্লি বাংলা অন্যান্য রাজ্যের থেকে করের টাকা নিয়ে খয়রাতি করে আসবে বিদেশে একটি বিশেষ ভাষা-কেভারতের  মুখহিসেবে ফোকাস দেওয়ার জন্য এবার- নরেন্দ্রভাই-এর ঢাকা সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে নতুন দিল্লির সরকার বাহাদুরের কল্যানে বাঙালি, তামিল, অহমিয়া, তেলুগু, কন্নড়-ভাষী মানুষেরা এটা জেনে প্রীত হবেন যে তাদের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব-টা হিন্দী আপনাদের না জানিয়েই নিয়ে নিয়েছেন আর সাথে নিয়েছে আপনাদের করের টাকা  বলাই-বাহূল্য, নতুন দিল্লীর খয়রাতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগটির নাম হিন্দী আর এই সব খয়রাতি করে অনেকে ভেবেছেন ওরা হেব্বি খুশি  ওরা কিন্তু অনেকেই বেশ রেগে আছেন
কলকাতার হো চি মিন সরনীর নাম অনেকেই শুনে থাকবেন  কেউ কেউ হয়তো জানবেন যে এই রাস্তার আগের নাম ছিল হ্যারিংটন স্ট্রীট কে এই হ্যারিংটন? ইনি ফিরিঙ্গি কোম্পানির আমলে নিজামত বা সদর আদালত-এর প্রধান বিচারক ছিলেন  ১৮২৩ সালের  ২৮ জুন তিনি লিখিত মন্তব্য করেন যে সতীদাহ প্রথা যদি তখুনি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলেও এই নিষিদ্ধকরণের বিরুধ্যে তেমন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন তিনি আশা করেন না অর্থাৎ জনগণ সে অর্থে সতিদাহর পক্ষে ছিল না সতী-দাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয় এর ছয় বছর পরে, ১৮২৯ - নানা বিরুদ্ধতা উপেক্ষা সত্তেও সতিদাহ নিষিদ্ধকরণের যে প্রকাশ্য নায়কদের কথা আমাদের চিরকাল জেনে এসেছি, কিন্তু নেপথ্য নায়ক যে জনগণ, তাদেরকে স্বীকার করে নেন হ্যারিংটন ফলে নায়কদের উচ্চতা একটু কমে, তাদের সংগ্রাম একটু ফ্যাকাশে হয় তবুও সেটাই বাস্তব  হ্যারিংটন-এর নামের জায়গায় হো চি মিন  দিয়ে সেটা ভোলা যায় না  তবে হো চি মিন নামকরণের ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য, এবং সেটি কিন্তু গর্ব করার মতো এই রাস্তাতেই মার্কিন কনসুলেট ভিয়েতনাম- মহিলা-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষকে হত্যা করার যে নৃশংস খেলায় মেতেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এটা ছিল তার- বিরুধ্যে কলকাতার নিজের মত করে প্রতিবাদ একটু লজ্জা দেওয়া, একটু বিড়ম্বনায় ফেলা কলকাতার মার্কিন দূতাবাসকে আজ- হো চি মিন-এর নাম স্মরণ করতে হয়, না চাইলেও নৃশংসতার প্রতিবাদ হিসেবে লজ্জা দেওয়ার মতো নাম পরিবর্তনের দাবি কিন্তু বেশ ছোয়াঁচে  নিষ্পাপ শিশু ফেলানি-কে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বি-এস-এফ বাহিনী গুলি করে হত্যা করে দুই বাংলার সীমান্তে গরীবের মেয়ে ফেলানির দেহ লটকে সীমান্তের কাঁটাতারে লটকে থাকে বেশ কিছু সময় আর বিঁধে থাকেঅনুভূতিগুলো এই কাঁটা-তার- ঝুলে থাকা শিশুর ছবিটি ভারতের 'স্বাধীন' 'মুক্ত' সংবাদ-মাধ্যম খুব বেশি প্রচার না করলেও, সারা বিশ্ব জেনে গেছিল ফেলানিকে এবং তাকে খুন করা উর্ধি-ধারী বাহিনীকে, যাদের মাইনে  আমি আপনি দিই বাঙ্গালীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ঢাকায় উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়, দাবি উঠেছিল সেখানকার ভারতীয় দুতাবাসের সামনের রাস্তার নাম বদলে  ফেলানির নামে করে দেবার জন্য তারপর যা হবার, তাই হয়েছে  গরিব মানুষের মেয়ের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ বেশিদিন টিকে থাকে না - ঘটনা হয়ে যায় সংখ্যা ফেলানি ঝুলে ছিল যে কাঁটা-তারে, দুই বাংলার মধ্যে সে কাঁটা-তার বানিয়েছে দিল্লী এতে ওপার থেকে অনুপ্রবেশ কমেছে কিনা, তার কোন খবর নেই , তবে এই কাঁটা-তার লাগানোর বরাত পেয়ে যে ঠিকাদার-রা কাজ করেছেন, তারা যাদের ঠিকাদার হবার নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের যে পকেট ভালই ভরেছে, সেটা বলাই বাহুল্য সেটাও আমার আপনার টাকা তবে এটা যেহেতু 'জাতীয় সুরক্ষা' প্রশ্ন, বেশি হিসেব চাইবেন না বেশি হিসেব চাইলে আপনাকে সিধা করার মত নানা কালা কানুন ভারতে মজুত আছে - অশোক-স্তম্ভের সিংহ-গুলি শুধু দাঁড়িয়ে থাকে না, কামড়ে রক্ত- বার করে
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি পূর্ব্ব বাংলা ঘুরে এসে বললেন যে ছিট-মহল বিনিময়ের ঘটনা হলো বার্লিনের প্রাচীরের পতনের মতই 'ঐতিহাসিক' এই 'ঐতিহাসিক' ধারণাটা আমি কখুনই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কোনটা ঐতিহাসিক, কোনটা নয়, কেই বা সেসব ঠিক করে দেয়  তবে এটুকু জানি, যে দুই গরীব বাস্তুহারা টইটুম্বুর  বাংলার মধ্যে যে 'অনিকেত প্রান্তর', তার মাঝে কাঁটা-তার বসিয়ে আর যাই হোক, বার্লিনের প্রাচীর পতন হয় না সীমান্ত-বাসী মানুষের ভাষা যারা বোঝে না, তাদের গায়ে উর্দি পরিয়ে, হাতে বন্দুক ধরিয়ে ধর্ষণ করানোকে, মন-মর্জি মতো মারামারি জিনিস-পত্র হাতানোকে, হতদরিদ্র মানুষ খুন করানোকে 'সুরক্ষা' নাম দেওয়া পাপ এই পাপ কিন্তু আমাদের পয়সায় মাইনে পাওয়া-রা কিন্তু করে এপার বাংলার মানুষজনের সঙ্গেও  এমন পাপ মা দূর্গা কখুনো মাফ করবেন কিনা জানিনা
যখন এই দিল্লী-ঢাকা শীর্ষ দেওয়া-নেওয়া হচ্ছিল, পাশে থাকা থেকে সাথে থাকার সুললিত বাণী দেওয়া হচ্ছিল, ঠিক তখুনই হাসিনা সরকারের প্রবাস কল্যাণমন্ত্রী মোশারফ হোসেন ফরিদপুরে তার বহুদিনকার চেনা একটি প্রথিত্জসা সংখ্যালঘু পরিবারের বসতবাড়ি জোর করে হাতিয়ে নেবার সব রকম ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন একদিন হয়তো সেই নিপীড়িত পরিবারের একজনএপারেচলে আসবে পশ্চিম-বঙ্গের বাঙ্গালীদের সংস্কৃতিক নিজস্বতাকে যারা স্বীকৃতি দেয় না, তাদের কোলেই খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয় পরিচয় তারপর তার এই নতুন প্রভু তার নিজের রাজনীতির খেলার অংশ হিসেবে দেখাবেননাগরিকত্বেরলোভ তাই দেখে পূর্ব্ব বাংলার কেউ কেউ বলবেন যে এমন ঘোষণা হলো অনধিকার-চর্চা ঘর-পালানো মানুষটা কি আজ-ওপারের’?  পূর্ব্ব বাংলার ভিটে ছেড়ে পালিয়ে আসা বাঙ্গালী হিন্দু ঠিক কোন মুহুর্তে 'ইন্ডিয়ান' হয়ে যায় এবং দেশ নিয়ে কিছু বলার অধিকার হারায়? পালানোর দিন ? বর্ডার পেরোলে ? ‘ইন্ডিয়াননাগরিকত্ব পেলে? দুই পুরুষ পরে? নাকি এসবের অনেক আগে, ‘ভুলধর্মে জন্মমুহুর্তে? আমি জানি না