অনৈতিক দেশভাগ ঃসৌজন্য- ইশতিয়াক জামি
=======================
=======================
"... স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ দিল্লীতে বসেই সীমানা চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শুধু কলকাতা সফর করে যান। কমিশনের সদস্যগন কলকাতা ও লাহোর থেকে প্রত্যহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁর নিকট দিল্লীতে প্রেরণ করবেন বলে তিনি নিয়ম করেন। সেখানে দলকে সীমানা সংক্রান্ত দাবীনামা পেশ করার আহবান জানান। জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বাংলা কমিশন ১৬ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই আগ্রহীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। কংগ্রেস, বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবিনামা পেশ করা হয়।
১৯৪৭ সালের ৬ থেকে ৭ জুলাই সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোট অনুযায়ী সিলেট জেলা পূর্ববাংলার সঙ্গে একীভূত হবার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার সীমানা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ৪ থেকে ৬ আগষ্ট কলকাতায় এক বৈঠক আহবান করেন। বৈঠকে আসাম সরকার ও পূর্ব বাংলা সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ, আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ও আসাম প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিবর্গ এবং পূর্ববাংলা মুসলিম লীগ ও সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিনিধিগণ যোগদান করেন।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যে দাবিনামা পেশ করা হয় তাতে বাংলার মোট ৭৭,৪৪২ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ৪০,১৩৭ বর্গমাইল দাবী করা হয়। দাবিকৃত এলাকার জনসংখ্যা ছিল অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার ৪৫%, তন্মধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা ৩২% এবং বাকীরা অমুসলমান। কংগ্রেস যে সমস্ত এলাকা দাবী করে সেগুলো হচ্ছে গোটা বর্ধমান বিভাগ, নদীয়া, যশোর ও খুলনা জেলাসমূহের সামান্য অংশ বাদে গোটা প্রেসিডেন্সী বিভাগ, রাজশাহী বিভাগের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, রংপূর জেলা থেকে ডিমলা ও হাতিবান্ধা থানা, দিনাজপূর জেলার পশ্চিমাংশ এবং নবাবগঞ্জ মহকুমা বাদে মালদহ জেলা, ঢাকা বিভাগের বরিশাল জেলা থেকে গৌরনদী, নজীপূর, স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠি থানাসমূহ, ফরিদপূর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমা ও রাজৈর থানা। ভারত ভূখন্ডের সাথে আসামের রেল যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস রংপূর জেলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভুরুঙ্গামারীও দাবি করে বসে। কংগ্রেস কলকাতা শহর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি পেশ করে।
তাদের দাবির স্বপক্ষে তারা যুক্তি দেখায় যে, ১৯৪১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী কলকাতা শহরে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ২৩.৫৯% (মোট ২,১০৮,৮৯১ এর মধ্যে ৪,৯৭,৫৩৫), কর প্রদানকারী মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ১৪.৮% (৬৮,৫৬৭ এর মধ্যে ১০,১৪৯) এবং কলকাতা শহরের ৮১,১৫৯ বাড়ির মধ্যে মুসলমান বাড়ির সংখ্যা মাত্র ৬,৮৬৩ (৮.৪৫%)। কংগ্রেস আরো উল্লেখ করে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ত বেসরকারী সাহায্যের মধ্যে মুসলমানদের দান মাত্র ১%। কংগ্রেস আরো যুক্তি দেখায় যে কলকাতার আশে পাশে যে ১১৪ টি পাটকল আছে তার সবগুলি মালিক অমুসলমান ব্যাক্তিবর্গ। সুতরাং সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলা বিভক্ত হলে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গেরই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অপরপক্ষে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিভাগের বেশির ভাগ অংশ এবং বর্ধমান জেলাসমূহ, হুগলী ও ভাগীরথীর পূর্বাংশ পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করা হয়। মুসলিম লীগের দাবীতে বলা হয় দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা হওয়া সত্ত্বেও ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে এবং পূর্ববাংলার অর্থনীতির প্রয়োজনে এই জেলাগুলি পূর্ববাংলাভুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। সপক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে, উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিতে নদী ও এর শাখানদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ নদীগুলি জলপাইগুড়ির তিস্তা দিয়ে প্রবাহিত। তাছাড়া পূর্ববাংলার রেলপথ সংরক্ষনের একমাত্র উৎস হচ্ছে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং এ অবস্থিত পাহাড়ের পাথর। পুর্ববাংলার কাঠের চাহিদা মেটানো হত জলপাইগুড়ি জেলার বন জংগল থেকে সংগৃহীত কাঠ থেকে। সুতরাং মূসলিম লীগ দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলাদ্বয় পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি পেশ করে। পূর্ববাংলায় ভবিষ্যতে হাইড্রো-ইলেকট্রিক শক্তি উৎপাদনের জন্য কর্নফুলী নদীর অধিকার আবশ্যক। এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ববাংলায় অন্তর্ভুক্তির দাবি করা হয়। মুসলিম লীগ কলকাতা শহর পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর দাবি পেশ করে। মুসলিম লীগ যুক্তি পেশ করে যে, কলকাতা শহরটি গড়ে উঠেছে মূলত পূর্ববাংলার সম্পদ দিয়ে। পৃথিবীর ৮০% পাট পূর্ববাংলায় উৎপাদিত হয় এবং ঐ পাট দিয়েই কলকাতার আশেপাশের পাটকল চলে। তাছাড়া কলকাতা ছিল বাংলার একমাত্র সমুদ্র বন্দর। উক্ত বন্দরে কর্মরত শ্রমিক,কর্মচারী নাবিকরা মূলত পূর্ববাংলারই লোক। অতএব কলকাতা পূর্ববাংলারই প্রাপ্য।
এইভাবে কংগ্রেস ও লীগের দাবিদাওয়ার মীমাংসা করা কমিশনের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। স্যর সিরিল র্যডক্লিফ ব্যক্তিগত ভাবে এসব দাবিদাওয়া সম্পর্কে কোন পক্ষকে সাক্ষাৎকার দেননি। তিনি বুঝতে পারেন যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সীমানা চিহ্নিত করা সম্ভব হবেনা। তাই তিনি নিজের ইচ্ছামত সীমানা নির্ধারনের সিদ্ধান্ত নেন। সীমানা চিহ্নিত সংক্রান্ত কতকগুলি মৌলিক প্রশ্নের উদ্ভাবন করেন, যেমনঃ
ক, বাংলার কোন অংশকে কলকাতা শহর প্রদান করা উচিত? এই শহরকে দ্বিখন্ডিত করে উভয় অংশকে খুশি করা কি সম্ভব?
খ, সমগ্র কলকাতার সঙ্গে কোন একটি অংশকে প্রদান করার পেছনে নদীয়া কিংবা কুলট নদীকে গুরুত্ব দেয়া উচিত কি না।
গ, টার্মস অব রেফারেন্সে উল্লেখিত ‘সম্প্রদায়গত সংলগ্ন এলাকার’ নীতিকে উপেক্ষা করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা যশোর ও নদীয়া পশ্চিমবংগের অন্তর্ভুক্ত করা যথার্থ হবে কি না।
ঘ, মালদহ ও দিনাজপুর জেলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কিছু অংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা কি পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হবে?
ঙ, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্চনীয় কিন্তু জেলাদ্বয়ের মুসলিম জনসংখ্যা অত্যন্ত কম (১৯৪১ এর আদমশুমারী অনুযায়ী দার্জিলিং এ মাত্র ২.৪২% ও জলপাইগুড়িতে ২৩.০৮%।) সুতরাং এই জেলাদ্বয় কোন অংশে অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ?
চ, পার্বত্য চট্টগ্রামের মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৩% হলেও জেলাটি চট্টগ্রাম জেলার অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং এই জেলাটি কোন ভূখন্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে?
মাউন্টব্যাটেনের ৩ জুন পরিকল্পনায় যদিও ‘সম্প্রদায়গত সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং এলাকার সংলগ্নতা’ (Majority and Contiguity Principles)- এর ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিত করার কথা ছিল কিন্তু র্যাডক্লিফ উক্ত নীতি এবং লীগ, কংগ্রেসের সমঝোতা নীতিকে উপেক্ষা করে নিজের বিচারবুদ্ধিমতো সীমানা চিহ্নিত করেন। জনসংখ্যা, ভৌগলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সীমানা নির্ধারণ করলে অন্তত কয়েকমাস সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু র্যাডক্লিফ তার দিল্লী অফিসে বসে টেবিলের উপর ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মাইলের সীমানা চূড়ান্ত করেন। এই কাজ করতে তিনি মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। সরদার বল্লভ ভাই প্যটেল ১৫ জানুয়ারী ১৯৫০ সালে কলকাতার এক জনসভায় উল্লেখ করেন যে, ‘আমরা ভারত বিভাগে রাজি হওয়ার পূর্বশর্তস্বরূপ কলকাতা শহর যেন ভারতভুক্ত থাকে তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম। আমাদেরকে সেই নিশ্চয়তা দেয়া হলে আমরা ভারত বিভক্তিতে সম্মত হই’। মাউন্টব্যটেন যেভাবেই হোক কলকাতা ভারতকে দেবেন বলে অংগীকার করেছিলেন। সম্ভবত সেজন্যই তিনি বাউন্ডারি কমিশনে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য কিংবা জাতিসংঘের মনোনীত প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা সমর্থন করেননি। যাহোক, র্যাডক্লিফের ঘোষণায় কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ ভুক্ত করা হয়।
র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে নিম্নে উল্লেখিত জেলাগুলো পূর্ববাংলার ভাগে পড়েঃ
১। ঢাকা ২। ময়মনসিংহ ৩। ফরিদপুর ৪। বাখরগঞ্জ (বরিশাল) ৫। চট্টগ্রাম ৬। ত্রিপুরা ৭। নোয়াখালী ৮। পাবনা ৯। বগুড়া ১০। রংপুর ১১। রাজশাহী। নদীয়া, দিনাজপুর এবং মালদহ জেলা পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হল। নদীয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬১%) হওয়া সত্ত্বেও এর দুই তৃতীয়াংশ এলাকা পশ্চিমবঙ্গকে দেয়া হয়। বাকি অংশ চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়া মহকুমা পূর্ববাংলার ভাগে পড়ে। অবিভক্ত দিনাজপুরের ৩০ টি থানার মধ্যে সম্পূর্ণ এলাকাসহ ৯টি থানা ও একটি থানার অংশবিশেষ পশ্চিমবংগের ভাগে দেয়া হয়। অপরপক্ষে ২০টি থানা সম্পূর্ণভাবে, একটি থানা আংশিকভাবে (হিলি) পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। মালদহ জেলার (৫৭% মুসলমান) চাপাইনবাবগঞ্জ পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। বাকী অংশ (মালদহের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ) পশ্চিমবংগভুক্ত করা হয়। জলপাইগুড়ি জেলা থেকে ৪টি থানা –যথা দেবীগঞ্জ, বোদা, তেতুলিয়া ও পঞ্চগড় পূর্ববাংলার ভাগে পড়ে। সম্পূর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলা (৫৬% মুসলমান) পশ্চিমবঙ্গভুক্ত করা হয়। যশোর জেলার বনগাও (৫৩% মুসলমান) ও গাইঘাটা থানা বাদে গোটা যশোর জেলা পূর্ববাংলাকে দেয়া হলো। খুলনা (৪৯.৩৬% মুসলমান) জেলাকে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গকে দেয়া হয়েছিল। এ কারণে খুলনা জেলায় তিনদিন ভারতের পতাকা উড্ডীন ছিল। কলকাতার বেলভেডিয়ার হাউজে সীমান্ত নির্ধারণী মামলায় এ. কে. ফজলুল হক স্যার র্যাডক্লিফের নিকট ওকালতি করে খুলনা জেলাকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে জানা গেল মুর্শিদাবাদ জেলার বদলে খুলনাকে পূর্ববাংলার ভাগে দেয়া হয়েছে। মুসলমান অধ্যূষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকা ভারতকে প্রদানের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম গ্রহণের ব্যপারে কংগ্রেসের ততটা আগ্রহ ছিলনা।
আসামের সীমানা চিহ্নিতকরণ সম্পর্কিত টার্মস অব রেফারেন্সের বিষয়ে সীমানা কমিশনের হিন্দু ও মুসলমান সদস্যবর্গ ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। মুসলমান সদস্যরা দাবি করেন যে, পূর্ববাংলা সংলগ্ন আসামের সকল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ববাংলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে হিন্দু সদস্যগণ মত প্রকাশ করেন যে, কমিশনের ক্ষমতা কেবল সিলেট জেলা সংলগ্ন আসামের সীমানা নির্ধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কমিশনের চেয়ারম্যন হিন্দু-সদস্যদের মত সমর্থন করেন।
সিলেট জেলার ৩৫ টি থানার মধ্যে মাত্র ৮ টি থানায় অমুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; তার মধ্যে দুটি থানা সুল্লা ও আজমিরীগঞ্জ চারিদিকে মুসলমান থানা দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। বাকি ৬ টি থানা সিলেটের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে একটানা অবস্থিত ছিল। তবে মূল সিলেটের সাথে থানাগুলির কোন সংযোগ ছিলনা। অপরদিকে কাচার জেলার হাইলাকান্দি মহকুমা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তা সিলেটের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বদরপুর ও করিমগঞ্জের সংলগ্ন ছিল। কিন্তু এই এলাকা পূর্ববংগের অন্তর্ভুক্ত করলে সিলেটের দক্ষিণের ৬ টি অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানার সাথে আসামের কোন সংযোগ থাকেনা, আবার ৬টি থানাই আসামের অন্তর্ভুক্ত করলে সিলেটের সাথে পূর্ববাংলার রেল-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় কমিশনের চেয়ারম্যন মনে করেন যে, কিছু মুসলমান এলাকা এবং হাইলাকান্দি মহকুমা অবশ্যই আসামের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সুতরাং দক্ষিণ সিলেটের ও করিমগঞ্জ মহকুমার ৬ অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করে তার বিনিময়ে পাথরকান্দি,বাতাবাড়ি, করিমগঞ্জ এবং বদরপুর এই চারটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ৪ টি থানাকে পূর্ববাংলায় রাখার জন্য আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বাউন্ডারি কমিশনের নিকট স্মারকলিপি পেশ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে তার সেক্রেটারী নির্বাচিত করা হয়। কলকাতায় তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। স্মারকলিপি পেশ করার জন্য তারা যে গাড়ীতে উঠেন তার শিখ ড্রাইভার তাদেরকে নিয়ে বলি দেবার জন্য কালিঘাট অভিমুখে রওনা দেয়। শারীরিক শক্তি প্রয়োগে ড্রাইভারকে তারা সে চেষ্টা নিবৃত্ত করেন এবং বেলভেডিয়ারে গিয়ে তারা কমিশনের নিকট স্মারকলিপি পেশ করেন।
যদিও ১৫ই আগষ্টের পূর্বেই সীমানা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ ও বাস্তবায়নের কথা ছিল কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের কোন কর্মসূচী যাতে সীমানা সংক্রান্ত ক্ষোভের কারণে ব্যহত না হয় সেজন্য মাউন্টব্যটেন তা ১৬ই আগষ্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। যথারীতি ১৬ আগষ্ট বিকেল ৫টায় ভাইসরয়ের বাড়িতে পার্টিশন কাউন্সিলের সভা আহবান করা হয়। উক্ত সভায় পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় যথাক্রমে লিয়াকত আলী খান ও পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, সরদার বলদেব সিং, আব্দুর রব নিশতার, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও ভি পি মেনন উপস্থিত হন। সভা শুরুর তিন ঘন্টা পূর্বে সীমানা কমিশনের রিপোর্ট প্রতিনিধিবর্গের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই রিপোর্ট কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং শিখ প্রতিনিধিদের কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। দুই ঘণ্টা ধরে সভায় হট্টগোল এবং বাদ-প্রতিবাদ চলে। তবে শেষ পর্যন্ত সকলেই স্বীকার করেন যে, যেহেতু সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্তে কেউই খুশী হতে পারেননি, তার অর্থ প্রত্যেক পক্ষ কোথাও না কোথাও কিছু সুবিধা লাভ করেছে যা অন্য পক্ষকে অসন্তুষ্ট করেছে। শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষ সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহনে সম্মত হয় এবং তা শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করার ঐকমত্য ঘোষণা করে। বাংলা বাউন্ডারি কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবগঠিত পূর্ববাংলা অবিভক্ত বাংলার মোট আয়তনের ৬৩.৮০% এবং মোট জনসংখ্যার ৬৪.৮৬% লাভ করে। বৃহত্তর বাঙ্গলার মুসলমান জনসংখ্যার ৮৩.৯৪% এবং অমুসলমান জনসংখ্যার ৪১.৭৮% পূর্ববাংলাভুক্ত হয়। নবগঠিত পূর্ববাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ৭০.৮৩ : ২৯.১৭ । নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ২৫.০১% : ৭৪.৯৯%.
বাংলার বাউন্ডারি কমিশনের সিদ্ধান্ত অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকার মুসলমানদেরকে অবাক ও বিস্মিত করে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকার মুসলমানগণ ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করে, অথচ পরবর্তীতে তারা জানতে পারে যে, তারা ভারতভুক্ত হয়েছে। সরেজমিনে তদন্ত না করে দিল্লীর অফিস কক্ষে বসে মানচিত্রের উপর সীমানা চিহ্নিত করায় সীমানা কোন কোন ক্ষেত্রে একটি গ্রামকে দ্বিখন্ডিত করে, কোথাও তা বাড়ীর আঙ্গিনার মাঝখান দিয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় কারো ঘরের দরজা পড়েছে পাকিস্তানে জানালা পড়েছে ভারতে।
সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাময়িক ক্ষোভ সৃষ্টি করলেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ চাপা পড়ে যায় দেশত্যাগ, দাঙ্গা ও লুটপাটের ঘটনার যাঁতাকলে।
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে সমগ্র বাংলা বিভক্ত হলো। একটি পূর্ববাংলা অপরটি পশ্চিমবঙ্গ। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হলো। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ হলো ভারতের একটি প্রদেশ। পাকিস্তান হলো মুসলমানদের দেশ॥"
- মুহাম্মদ আসাদ / বাংলা যেভাবে ভাগ হলো ॥ [ কৃষ্ণচূড়া প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ । পৃ: ৮৬-৯১ ]