আফনি
বইছন জলের তলত /
পার্থ বসু
অখণ্ড
বাংলার রাজধানী কোলকাতায়
আসতো চাটগাঁ থেকে দার্জিলিং,
সুরমা
ভ্যালি থেকে সুন্দরবন সব জেলার
মানুষ। কোলকাতায় তাঁরা যে
যার মাটির ভাষায় কথা বলতেন
নিশ্চয়। বাজার তার নিজের
প্রয়োজনেই বুঝে নিত। কোলকাতার
বাতাস সেই নানা শব্দে ম ম করত।
জারিত হত। বেচাকেনায় দু পক্ষই
পরস্পরকে যে যার গরজে বুঝে
নিতেন। বাংলা ভাষার আঞ্চলিক
শব্দের আর উচ্চারণের যে বিপুল
বৈচিত্র আর বিশিষ্টতা কোলকাতার
কান তাতে অভ্যস্ত ছিল। হয়তো
জিহ্বা সড়গড় ছিল না।
ব্যাপারটা
এভাবেও ভাবা যায় বাংলাভাষা
জেলায় জেলায় নানা স্রোতে
প্রবাহিত। একসময় সেই নানা
স্রোত নানা ঢেউয়ে আছড়ে পড়ত
কোলকাতায়। দেশভাগের পর দিন
বদলেছে।
কোলকাতা
নিজেই তার লব্জ হারিয়েছে কবেই।
শান্তিপুর কেস্টনগরের বুলি
কপচে তবু তার নাক উঁচামির সীমা
নেই। শুধু পূব বাংলার বুলি
নয় সে মেদিনীপুর বাঁকুড়া
পুরুলিয়ার বুলিতেও হাসে।
অবশ্য আঞ্চলিক ভাষার কবতে
আবৃত্তিকারের গলায় শুনে
হাততালিও দেয়। কারণ ?
কোলকাতা
কি প্রমিত বাংলার মনসবদার ?
পায়ের
তলার মাটি কবেই সরে গেছে।
বাংলা তাড়ানোর পৃষ্ঠপোষক
সরকার নিজেই। সরকারী কাজ
বাংলায় করার উদ্যোগ নেই। বাংলা
ভাষার কোন ভবিষ্যৎ নেই। ভারতে
পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য
যেখানে স্কুলে বাংলা শেখা
অবাঙ্গালী দূর কথা বাঙালীর
জন্যই আবশ্যিক নয়। বাংলা না
শিখলেও কারও কিছু যায় আসে না।
আগে অন্তত বেচুদার চাকরিতে
গ্রাম গঞ্জের বাজার ধরতে বাংলা
জানা লোকের কদর ছিল। এখন হিন্দি
জানলেই হল। মোবাইল সেট বানান
আর বিক্রি করেন যে মাইক্রোমাক্স
কোম্পানি তারা বাজারে নতুন
সেট এনেছে। মেসেজ করে যে কোন
দশটি ভাষায় তা ঝটপট অনুবাদ
করে দিচ্ছে। এই দশ ভাষার মধ্যে
হিন্দি আছে,
তামিল আছে,
মালায়লম
আছে, গুজরাতি
আছে – নেই শুধু বাংলা। সেটটি
বিক্রি হবে বাংলায় ,
পশ্চিমবঙ্গেই
!
তোমার
খড়্গ ধুলায় পড়ে--
এখানে খড়্গ
কি ভাবে উচ্চারণ করি ?
খড়গো এভাবেই
তো ? অথচ
খড়গপুর খড়গোপুর এভাবে বলার
জন্য এক কালে কোলকাতার মেয়েটির
কাছে খুব ঠ্যাটা হতে হয়েছিল।
মেয়েটি যুবতী ছিল এবং সুন্দরী।
সে বয়সে আত্মসম্মানে লাগলেও
আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারি
নি। শহর কোলকাতাই এক বিপুল
আকর্ষণ। দূরের গ্রামটিও আজ
তাকেই নকল করে।
ওপার
বাংলা কবেই আঞ্চলিক শব্দের
অভিধান সংকলন করেছে। এমন কি
বরাক করেছে। শিলচরের আবিদ
রাজা মজুমদার আর হাইলাকান্দির
জগন্নাথ চক্রবর্তী বিশাল
দুটি বই লিখেছেন। আমরা এপারে
পারি নি। কোলকাতায়।
একটা
গল্প বলি। গল্প নয় সত্য।
ফাঁসীর
মঞ্চে প্রাণ দিলেন উনিশের
ক্ষুদিরাম। জন্ম আমি যে জেলায়
থাকি তার পাশের জেলায়। মেদিনীপুরে।
পীতাম্বর দাস তাই নিয়ে গান
বাঁধলেন --- একবার
বিদায় দে মা ঘুরে আসি। তখন না
ছিল টেলিভিশন ,
না ছিল কি
রেডিও। শুধু মুখে মুখে গানটি
ছড়িয়ে পড়ে অখণ্ড বাংলার কোণে
কোণে , এমন
কি ভারতের অন্য রাজ্যেও। ফলত
গানটি জেলা থেকে জেলায় আঞ্চলিক
শব্দে জারিত হয়। ভাব ঠিক থাকলেও
ভাষায় প্রকারভেদ আসে। ক্ষুদিরামকে
নিয়ে যে কাজ হয়তো আমাদের করার
ছিল, ক্ষুদিরাম
ঘরের ছেলে,
বাংলাদেশ
তা করে দেখিয়েছে। বাংলা একাডেমী
ঢাকা 'একবার
বিদায় দে মা' র
রূপান্তর সমগ্র প্রকাশ করেছেন।
কোলকাতা
ভাষাগত ভাবেই ছুঁতমার্গী।
কোলকাতা সেই কুয়ো যার বাসিন্দা
ভেকসমূহ সবজান্তার ভেক ধরেন।
কিন্তু ভিতর ফাঁপা। বাংলা
ভাষাকে ভালোবাসা মানে তার
সমগ্রতাকেই ভালোবাসা। তার
আঞ্চলিক প্রকারভেদকেও সম্মান
করা।
ফেসবুকের
কল্যাণে এই বয়সে আমি বাংলা
ভাষার নানা স্রোতে অবগাহনের
সুযোগ পাচ্ছি। আমার বন্ধু
তালিকায় সিলেট থেকে সুন্দরবন,
রংপুর থেকে
খুলনা, পঞ্চগড়
থেকে পাবনা ,
রাজশাহী
থেকে যশোর-- নানা
এলাকার মানুষ। তাঁদের টাইমলাইনে
আনন্দে সফর করি। সমৃদ্ধ হই।
কান সম্পন্ন হয়। প্রাণ তৃপ্ত।
গতকাল
আমার যৌবন কালের বন্ধু গৌরীশঙ্কর
দত্তের বাড়ি গেছিলাম। ভালো
কবিতা লিখতেন। ভালো প্রাবন্ধিক।
নানা বিষয়ে পড়াশুনা আছে। বয়স
এখন একাশি। এখনও আড্ডা ভালবাসেন।
শরীর সঙ্গ দেয় না। প্রাণ উচ্ছল
মানুষটিকে দু এক আঁচড়ে পেশ
করি আগে।
ঢাকা
বিক্রমপুরের মানুষ। চেহারায়
আপাত রুক্ষ। কিন্তু মিশতেন
শিং ভেঙে আমাদের মত বাছুরের
সাথে। খালাসীটোলায় নয় কোলাঘাটে
নদীর ধারে আমরা কজন গৌরীদার
সঙ্গে মহীনের ঘোড়া। গৌরীদা
মস্তিতে ছিলেন। শখ হল সিনেমা
দেখবেন। সিনেমা দেখতে গৌরীদা
শলা করতেন রিক্সাচালকদের
সাথে। আঁতেল সমালোচনায় কান
দিতেন না। কিন্তু বেলা প্রায়
দুটো। খটখটে রোদ। হাতের নাগালে
রিক্সাওয়ালা কেউ পাওয়া গেল
না। ফিরতি ট্রেনে যাওয়া হল
বাউড়িয়া। ওখানে মুঘলে আজম
চলছে। কাগজে রিভিউ পড়েছি।
ধ্রুপদী।
গৌরীদা
নিমরাজি হয়ে টিকিট কাটলেন।
আমরা দোতলার ব্যালকনিতে।
মুগ্ধ হয়ে দেখছি। হাফ টাইম।
হল ফাটিয়ে গৌরীদা হাঁক দিলেন--
চল। এ বই
দেখা যায় না। হাফ টাইম হইয়া
গেল একটাও সিটি পড়ে নাই। এটা
হিন্দি বই !
সাহিত্য
সভায় নতুন ছেলেটি স্বরচিত
কবিতা পড়ছে। গৌরীদা এসব আসরে
আসতেন নিয়মিত। শুনতেন মন দিয়ে।
আলোচনাও করতেন। একদিন ক্ষেপে
গেলেন। সদয় পড়া শেষ করেছে নবীন
কবি গৌরীদা অগ্নিশর্মা--
এটা কি
হইছে ?
কবিতা
? বয়স
কত হে ? সুকান্তর
নাম শুনছ ? আঠারো
বছরে সুকান্ত যা ল্যাখছে আগে
সেই মান স্পর্শ কর। তারপর
আগাবার কথা,
ল্যাখার
কথা ভাববে। বাংলা সাহিত্য বর
কঠিন ঠাই। অযোগ্যের জায়গা
নাই। যাও , বারাইয়া
যাও।
ছেলেটি
কাঁদো কাঁদো। গৌরীদাকে চাপা
স্বরে বললাম--
কি হচ্ছে
গৌরীদা? ছেলেটি
ভয় পাচ্ছে তো !
অমনি
খ্যাঁক খ্যাঁক করে সরবে হেসে
ফেললেন-- ভয়
না পাইলেই টিকব।
গৌরীদার
কথা বিশদে আবার লিখব। কালকের
আড্ডা থেকে দুটি গল্প শেয়ার
করছি। গৌরীদার বলা।
একটি
গল্প নোয়াখালীর। নোয়াখালী
প বলতে ফ কয়। এটুকু মনে রাখুন।
চাষি চলেছে আলপথে। গ্রামে
ঢুকে সে তখন ক্ষুধায় তেষ্টায়
কাতর। সাথে চিঁড়া আছে। সামনে
টলটলে পুকুর। চিঁড়া ভিজাতে
জলে নামতে গিয়ে বিষম খেল। জলে
ওগুলি কি ? কুমীরের
বাচ্চার মত। চাষি বাণ জাতীয়
মাছ দেখেছিল। কিন্তু ভয়ে তার
মাথা তখন কাজ করছে না। অদৃশ্য
কুমীরকে শুনিয়ে বলল
আফনি
বইছন জলর তলত
সন্তানগণ
ফাটিয়ে দিছু
মুইঠ্যা
চিঁড়া ভিজাইবাম
তবু
জলত না নামবাম।
কিছু
বুঝছ কোলকাতা?
এ
গল্পটা চট্টগ্রামের। গৌরীদা
শুনেছিলেন তাঁর কাকার মুখে।
কাকা শৈলেন ঘোষ ছিলেন নাটক
পাগল। গ্রামে নাটক হবে। রামায়নের
গল্প। মুসলমান প্রধান গ্রাম।
নাটকের বেশীর ভাগ কুশীলব
তারাই। রাবনের চরিত্রে অভিনয়
করছে দশাসই ইয়াসিন। শৈলেন
পরিচালক। শেষ দৃশ্যে রাবনের
বাণ খাওয়া , পতন
ও মৃত্যু। কিন্তু ইয়াসিন বাণ
খেয়েও পড়ছে না। রাম ফিসফিস
করে বলল – ফরি যাও। কে শোনে
কার কথা ! ইয়াসিন
ওরফে রাবণ সদম্ভে বলল--
ইয়াসিন
এমন বেটা ন দুই চাইরটা না মারি
ফরি যাইত !
শুরু
হল ধুন্ধুমার। দর্শক সমর্থন
ইয়াসিনের দিকেই। ঠিকই তো কইছে।
মারপিট হউক। দেখি কে জিতে !
শৈলেন
চেঁচালেন--
ইয়াসিন
শুইয়া ফর। ফরি যাও।
বটে
! গ্রামবাসী
তা মানবে কেন। একযোগে চড়াও
হল তাঁর উপর। ওই শালাই নষ্টের
মূল।
শৈলেন
পিঠ বাঁচাতে দৌড় দিলেন। সে
আর এক রামায়ণ।
No comments:
Post a Comment