বাঙালীর
নিজের গান / আনিসুল
করিম
বিদেশে
গেলে বাঙালী মাত্রেরই দেশের
জন্য মন উতলা হয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথই বা তার ব্যতিক্রম
হবেন কি করে ? পুত্রকে
চিঠিতে লিখছেন, “ আমাদের
পাড়া গাঁয়ে চাঁদ উঠেছে অথচ কোথাও
গান ওঠে নি , এ
সম্ভব হয় না।” কোন দর্শনীয়
বস্তু দেখতে না পাওয়া বা কোন
রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে
বঞ্চিত হবার মতো , গান
শুনতে না পাওয়ার দুঃখে বাঙালী
হৃদয় কাতর হয়ে পড়েছে। তারপর
অনেকটা খেলার ধারাবর্ণনার
মতো তিনি লিখছেন, “ এখানে
সন্ধ্যার আকাশে নারকেল গাছগুলোর
মাথার উপর শুক্লপক্ষের চাঁদ
দেখা দিচ্ছে। গ্রামে কুঁকড়ো
ডাকছে , কুকুর
ডাকছে , কিন্তু
কোথাও গান নেই “।
অনেকটা
যেন বিপক্ষ দলের সব খেলোয়াড়কে
কাটিয়ে গোল না হওয়ার মতো দুঃখজনক
ঘটনা। বাংলার বাইরে গান না
শুনতে পেয়ে এক বাঙালী কবি
যতখানি হতাশ , ততখানিই
গর্বে উল্লসিত আর এক বাঙালী
কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত
বাংলার বাউল , মাঝি
, চাষির
মুখে গান শুনতে পেয়ে। এক বাউলের
গান--
দিল
দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা,
দেহের
মাঝে বাড়ি আছে,
সেই
বাড়িতে চোর লেগেছে,
ছয়
জনায়ে সিঁদ কাটিছে,
চুরি
করে একজনা।
দেহের
মাঝে বাগান আছে,
নানা
জাতির ফুল ফুটেছে,
ফুলের
সৌরভে জগৎ মেতেছে---
বোঝা
যায় নিছক আবেগতাড়িত উচ্ছ্বাসে
নয়, এমন
গানের জন্য, এমন
গানের ভাষার জন্য গর্ব অনুভব
করা কবির জন্য যথার্থই। অথবা--
মন
তুমি কৃষি কাজ জান না।
এমন
মানব জমিন রইল পতিত,
আবাদ
করলে ফলত সোনা। ( রামপ্রসাদ
সেন )
যে
জমিন থেকে এই গানের উদ্ভব সেই
জমিনে মাথা ঠেকাতে কবিমনের
ব্যকুলতা স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে
মাটির কাছে থাকা মানুষগুলোর
কাছেই জাতির ঐতিহ্য, তার
সংস্কৃতি অক্ষত থাকে। ভিন্ন
সংস্কৃতির আগ্রাসনে যখন শহুরে
সংস্কৃতি বিকৃত হয়,
নিজস্বতা
হারায় , তখন
মাটির কাছে থাকা মানুষগুলো
আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে
রাখার দায়িত্ব পালন করেন।
আধুনিক সভ্যতার পশ্চিমা ঝড়
যখন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও
প্রান্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে
পল্লীর বাঙালী তখন অর্কেস্ট্রা,
হারমোনিয়ামের
মতো আধুনিক বাদ্যের মোহ ছেড়ে
ঘুরে বেড়িয়েছে খঞ্জনী আর
একতারা হাতে। কেন না ওই সব
যন্ত্রেই জড়িয়ে আছে তার পূর্ব
পুরুষের হাতের ছোঁয়া। বাইরের
জগতে যখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ,
রক্তাক্ত
পালাবদল, বাঙালী
তার নিজস্ব সংস্কৃতি কথকতা,
পাঁচালী,
কবিগান,
যাত্রাপালার
বদলে আধুনিক কোন বিনোদনকে
বেছে নিতে চায় নি।
দুঃখ
দুর্দশার শিকার হয়ে,
ক্ষুধা তৃষ্ণা
অভাবকে সঙ্গী করেই বাঙালী
তার পরম্পরাগত সম্পদকে পরম
যত্নে রক্ষা করে এসছে দিনের
পর দিন। এইভাবে সনাতন ঐতিহ্যকে
অনুসরণ করে গানের মধ্য দিয়ে
ঘটল বাঙালীর সাহিত্য-
সংসারে প্রবেশ।
আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসাবে
বাঙালী যে গান গলায় তুলে নিয়েছে
তা হয়ে দাঁড়াল একান্তই তার
নিজের গান।কেন না এই গানের
সাথে প্রথাগত হিন্দুস্তানি
সঙ্গীতের কোন মিল পাওয়া গেল
না।
ঐতিহাসিক
তথ্য অনুসারে বাঙালীর সাহিত্য
সাধনা তথা সংগীত চর্চার সুচনা
চর্যাপদের মধ্য দিয়ে। খ্রিস্টীয়
দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ
শতাব্দী পর্যন্ত চর্যাপদের
সময়কালকে বাংলাগানের ঊষাকাল
বলা চলে। এরপর পদাবলীর যুগ।
পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে পরবর্তী
প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বিদ্যাপতি,
জয়দেব,
চণ্ডীদাস,
জ্ঞানদাস
প্রভৃতি বহু পদকর্তা তাঁদের
সৃষ্ট কীর্তন গানের মধ্য দিয়ে
একই সঙ্গে ঈশ্বর, সাহিত্য
ও সুরের সাধনা করে গেছেন।
কীর্তন গান বাংলার সংগীত জগতে
বিপ্লব ঘটাল। রাজদরবার ও ধনীর
বৈঠকখানা থেকে মুক্ত করে
বাঙালী এই সঙ্গীতকে টেনে আনল
হাটে , মাঠে
, ঘাটে,
পথে প্রান্তরে।
হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতের
বাঁধাগতে আবদ্ধ হয়ে না থাকায়
এই সংগীত বাঙালীর ঘরে ঘরে
সমাদৃত হল। ফলে চৈতন্যদেব
কীর্তনকে অবলম্বন করেই বিপুল
আলোড়ন সৃষ্টি করলেন। কীর্তন
গানের আবহেই চৈতন্যদেব জাতপাতে
দীর্ণ বাঙালীকে এক সুরের
বন্ধনে একাত্ম করলেন। সপ্তদশ
শতকে এল যাত্রাগান। সে যাত্রায়
দোসর হল কবিগান, তরজা
ইত্যাদি লোকসংগীত। বিনোদনের
মোড়কে পরিবেশিত হল লোকশিক্ষা,
সামাজিক
সমস্যার প্রসঙ্গ। কথার চাপান
উতোরে গাইয়েদের লড়াই উঠল জমে।
সে আসর উপভোগ করতে লড়াই লাগল
শ্রোতাদের মধ্যে। নারী পুরুষ
, ধনী
নির্ধন, জাত
বেজাতের একসাথে আসন দখল করার
লড়াই। বিংশ শতাব্দীকে যদি
বাংলা গানের স্বর্ণযুগ বলা
হয় তাহলে এর পূর্ববর্তি সময়ে
ঘটেছে বাংলা সঙ্গীতের মহোৎসব।
উৎসব তো সেটাই যা মানুষকে
মেলায়। গানের টানে মানুষ মিলল
মেলায়, পালা-
পার্বণে,
উৎসবে অনুষ্ঠানে।
জন্ম- মৃত্যু-
বিয়ের মতো
পারিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্র
করে রচিত হল গান। পরিবেশিত
হল। গাইয়ে বাজিয়েরা মহল্লায়
মহল্লায় , পাড়ায়
পাড়ায় আখড়া খুলে বসলেন।
সম্ভ্রান্ত বাড়িতে আসর জমানোর
জন্য মোটা নজরানা। এক জেলার
আঞ্চলিক গান অন্য জেলায় আমন্ত্রণ
পেল। মালদহ জেলার গম্ভীরা
গানে শোনা গেল অভাব অভিযোগ
ক্ষোভের কথা। কৃষির দেবতা
শিবকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া
গম্ভীরা গানে শুনতে পাওয়া
গেল সামাজিক শোষণ বঞ্চনার
বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বাঙালী
কণ্ঠ। গম্ভীরা গানের শিব যেন
হিন্দু দেবতা জটাধারী মহেশ্বর
নন। দীন দরিদ্র বাঙালীরই একজন
প্রতিনিধি। বাংলার মুসলমান
সমাজও ধর্মের বাধা টপকিয়ে
আল্লাহ-রসুলের
জয়গান নিয়ে গানের জগতে সামিল
হল। মোহরমের বেদনাদায়ক ঘটনাকে
স্মরণ করে গাওয়া 'জারি
গান' বা
' ঝাড়নি
গান ' এর
করুণ রস হিন্দু বাঙালীকেও
আকৃষ্ট করেছে। কাসেমের সদ্য
বিবাহিত স্ত্রী সাকিনার বেদনার
মধ্যে কান পাতলে শুনতে পাওয়া
যাবে মনসামঙ্গলের বেহুলার
কান্না। বাংলার মাটিতে প্রোথিত
শিকড়ে, বাংলার
জল হাওয়ায় বিকশিত শাখায় বেড়ে
ওঠা বাঙালী মুসলমান সমাজের
বিয়েতে ধর্মের শাস্ত্রীয়
বিধান প্রায়ই গৌণ হয়ে যায়।
প্রাধান্য লাভ করে গায়ে হলুদ,
ক্ষীর খাওয়ানো,
আইবুড়ো ভাত
খাওয়া ইত্যাদি লোকাচার আর
এইসব লোকাচারকে কেন্দ্র করেই
মুসলমান বইয়ের গান। দলবদ্ধ
নৃত্য সহযোগে এই সব গানে বাঙালী
মুসলমান নারীর ভূমিকাই মুখ্য।
মহিলাদের রচিত, মহিলাগীত
এই গানে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের
বিরুদ্ধে যে কটাক্ষ ও ক্ষোভ
তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে
বাঙালী নারীর আত্মমর্যাদাবোধ
এবং সমাজসচেতনতা।
বাঙালীর
নিজস্ব গান প্রসঙ্গে আর একটি
নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি হলেন ' নিধু
বাবু ' বা
রামনিধি গুপ্ত। বাঙালীর নিজস্ব
জীবনশৈলীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে
তিনি টপ্পা অঙ্গের হিন্দুস্থানি
গানে প্রয়োগ করলেন বিশেষ সংগীত
শৈলী। নিধুবাবু শোরী মিয়াঁর
টপ্পার ক্ষিপ্র গতিকে বাংলার
কোমলতার সঙ্গে সংগতি রেখে ,
বাঙালী মনের
উপযোগী করে গানের গতি কমিয়ে
আনেন। বাংলা গানের প্রধান
বৈশিষ্ট্য কথা ও সুরের সমান
মর্যাদা। নিধুবাবু বাংলা
গানের সেই ধারাকে বজায় রেখে
হিন্দুস্থানি টপ্পা রীতির
কিছু গ্রহণ কিছু বর্জন করে
বাংলায় যে টপ্পা গানের প্রচলন
করলেন তাও চিহ্নিত হল বাঙালীর
নিজের গান বলেই।
সর্বোপরি
যাঁর গানের মধ্য দিয়ে বাঙালী
তার আত্মপ্রকাশের উন্মুক্ত
দরজা খুঁজে পেল তিনি হলেন
কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর
অনবদ্য কাব্যিক ভাষায় বাংলার
মাটি থেকে উদ্ভূত লোকগীতির
সুর সহযোগে যে অপূর্ব সংগীত
সৃজন করলেন তার মধ্যে বাঙালী
খুঁজে পেল তার মনের গহনে তলিয়ে
থাকা অনুভূতিকে। রবীন্দ্রনাথ
সংগীত শাস্ত্রকারদের প্রথাগত
আচার অগ্রাহ্য করে বাংলা গানকে
দিলেন মুক্ত বিহঙ্গের ডানা।
সঙ্গীতকে শৃঙ্খলমুক্ত করার
সপক্ষে তাঁর যুক্তি ছিল--
“ আমি জয়জয়ন্তীর
( রাগ )
কাছে এমন কি
ঘুষ খাইয়াছি যে তাহার গোলামী
করিতে হইবে ?”।
ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে, দিবসের
নানা সময়ে রাগ রাগিণী ব্যবহারের
যে প্রচলিত ধারা রবীন্দ্রনাথ
সংগীতশাস্ত্রের সেই ধরাবাঁধা
পথে চলতে রাজী হন নি। “ গভীর
রজনী নামিল হৃদয়ে আর কোলাহল
নাই” তাঁর এই গানে তিনি '
পরজ' ও
'বসন্ত'
রাগ ব্যবহার
করেছেন। রাত্রির এই গানে
প্রভাতী রাগ 'পরজ'
ব্যবহার
দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে
চেয়েছেন মূলত গানের ভাবগত
আবেদনই নির্ধারণ করবে রাগরাগিণীর
প্রয়োগ। রবীন্দ্রশিষ্য কাজী
নজরুল গজল সহ নানা ইসলামী
সংগীত রচনা করে সংগীতবিমুখ
বাঙালী মুসলমান সমাজকে ্যবাংলা
গানে আগ্রহী করে তোলেন।
রবীন্দ্রপূর্ব যুগে যে বাংলা
গান অনেকটাই হিন্দুত্বের
ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে ছিল। নজরুল
একই সঙ্গে ইসলামী গান আর শ্যামা
সংগীত রচনা করেছেন যার মধ্যে
শাস্ত্রকথার থেকে প্রাধান্য
পেয়েছে মানবিক আবেদন। ধর্মীয়
বেড়াজালমুক্ত উন্নত কাব্যগুণসম্পন্ন
নজরুলের এইসব গানকে সমগ্র
বাঙালী জাতি তাই গ্রহণ করেছে
নিজের গান মনে করে।
এরপর
স্বাধীনতা উত্তরকালে আমরা
দেখেছি বাংলা গান তার নিজের
বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই বাঙালীকে
দিয়েছে অনাবিল বিনোদন। তবে
অতি সম্প্রতি বাংলা গানের
জগতে যে সব কর্মকাণ্ড লক্ষ্য
করা যাচ্ছে ( কানে
শোনা সম্ভব হচ্চে না )
তাতে সংগীতপ্রেমী
মানুষ বাংলা গানের ভবিষ্যৎ
ভেবে উদ্বিগ্ন। বাংলা গানের
বর্তমান গতি প্রকৃতি দেখে
তারা ভাবছেন বাঙালী কি তার
নিজের গান হারাতে বসেছে ?
নানারকম
বাদ্যযন্ত্রের বিকট আওয়াজে
ভরা চিীৎকারমথিত শরীরী উল্লাস
হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের দিনের
কিছু বাংলা গানের নমুনা।
ইদানীং বাংলা গানে এমন কিছু
শব্দসমষ্টি ব্যবহৃত হচ্ছে
যা কাব্য সাহিত্য সমৃদ্ধ বাংলা
গানের অতীত গৌরবকে কালিমালিপ্ত
করছে। বোঝা যায় সাংস্কৃতিক
আগ্রাসনের শিকার হয়েই বাংলা
গানের জগতে এই অনুকরণপ্রিয়তার
প্রবেশ। বাংলা গানকে যারা
ভালবাসেন তাদের বিশ্বাস সাময়িক
উন্মাদনা থেকে মুক্তি পেয়ে
বাংলা গান তার নিজস্বতায় ফিরবে
অচিরেই।
No comments:
Post a Comment