Tuesday 16 August 2016

ফরিদ কবিরের কলাম

আমার পরে যারা লেখালেখি করতে এসেছেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমি মিশেছি। তারা জানেন, আমি কমবেশি তাদেরকে উৎসাহিতই করি। যারা মেধাবী ও সম্ভাবনাময়, তাদের কবিতা আমি আগ্রহ নিয়েই পড়ি। কাউকে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে তা জানাইও! যাদের কবিতা ভালো লাগে তাদের বেশির ভাগই আমার দলের বা মতের লোক নন।
কারো কারোর সঙ্গে তো আমার আজও অব্দি দেখাও হয়নি! যাদের কবিতা আমার পছন্দ, তারা আমাকে কিংবা আমার কবিতা পছন্দ করেন কিনা- তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নাই।
নতুন যারা লিখছেন তাদের মধ্যে হিজল জোবায়ের-এর সঙ্গে এক-দুবার দেখা হলেও আল ইমরান সিদ্দিকী বা ইমতিয়াজ মাহমুদের সঙ্গে তো আমার কখনো দেখাই হয়নি! হলেও আজ মনে করতে পারছি না। তাদের কবিতা পড়ে তাদের সম্ভাবনাটা যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি কবিতা বিষয়ে তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতিটাও বুঝতে পারা যায়।
তবে, এমন না যে সব কবি তার প্রথম জীবনের লেখাতেই সেই সম্ভাবনার চিহ্ন রাখতে পারেন। জীবনানন্দের কবিতায়ও প্রথম দিকে নজরুলের প্রভাব দেখা যায়! সিকদার আমিনুল হক তো 'সতত ডানার মানুষ বা' 'কাফকার জামা'-র কবিতাগুলি লেখার আগে শামসুর রাহমানকেই অনুসরণ করে আসছিলেন!
প্রসঙ্গক্রমে বলি, সিকদার ভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। তাঁর বাড়িতেও আমি যেতাম প্রায়ই।কিন্তু আশির দশকে অামার সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি সংকলন বেরোলেও তার কোনোটিতেই তাঁর কবিতা আমি নেইনি! এতে হয়তো তিনি দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু আমার প্রতি বিরুপ হননি! আমাদের সম্পর্কে তার কোনো ছাপই কখনো পড়েনি! অবশ্য এর সব কৃতিত্বই তাঁর! যদিও অামার সংকলনে কবিতা না নেয়ায় তখন অনেকের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো! অনেকে আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালও করেছেন!
যাই হোক, কে যে কখন, জীবনের কোন সময়ে এসে নিজের কবিতাটা লিখতে শুরু করবেন তা বলা মুশকিলই। তবে, ততোদিন তাকে ধৈর্য তো রাখতেই হবে!
কবি হয়ে ওঠার কোনো শর্টকাট রাস্তা নাই। অনেক কবি সমকালে জনপ্রিয় হলেও পাঠক পরে তার দিকে ফিরেও তাকায়নি! জনপ্রিয়তা তো কবিতার মাপকাঠি না!
তবে কবিতার মাপকাঠি কোনটা? কবিতার ক্ষেত্রে এটা এক রহস্য বটে! বিশাল প্রশ্নও, যার কোনো জবাব নাই।
তবে, এটুকু বুঝি, কবি তিন প্রকারের।
এক প্রকার, যারা মনের ভাব প্রকাশের জন্যই লেখেন। পাঠক পড়লে তিনি খুশি হন। না পড়লে মন খারাপ করেন না। প্রায় প্রতিদিন তাদের ভাব আসে, তারা তা নিয়েই কবিতা লিখে ফেলেন। বছর বছর বইও বের করেন! কবিতা বিষয়ে কোনো প্রস্তুতি, ভাষা-প্রকরণ নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নাই। ফেসবুকে এদের সংখ্যাই বেশি।
দ্বিতীয় শ্রেণির কবিরা জনপ্রিয় হবার জন্যই লেখেন। তিনি এক সময় বুঝে ফেলেন পাঠক কোনটা খাবে! তিনি সেরকম কবিতাই সরবরাহ করতে ভালবাসেন। তারাও প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে কবিতা লেখেন। সমালোচকরা তাকে কবি স্বীকৃতি না দিলে বিরক্তও হন! কারণ জনপ্রিয়তার কারণে তিনি নিজেকে সেরা ভাবতে শুরু করেন! তারা আসলে পাঠকদের কবি। যদিও কবির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার কবিতাগুলিও মরে যায়!
তৃতীয় শ্রেণির কবিরা সংখ্যায় কম। তারা কবিতার খোল-নলচে পাল্টে দিতে আসেন! কবিতা বিষয়ে তারা আসেন যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই। তারা লেখেন নতুন ধরনের কবিতা, নিজস্ব কবিতা। তারা সমালোচনার ধার ধারেন না! জনপ্রিয় হচ্ছে কিনা তা নিয়েও মাথা ঘামান না!
জীবনানন্দ সম্ভবত তাদের সম্পর্কেই তাঁর এক গদ্যে বলেছেন, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি'।
এই তিন শ্রেণির কবিই আসলে জানেন, তিনি কোন শ্রেণির। ইদানিং চতুর্থ শ্রেণির কিছু কবির দেখাও পাচ্ছি। তারা জানেন না তারা কোন শ্রেণির! তারা কবিতার মতো একটা কিছু লিখেই ভাবেন, ভয়াবহ কিছু একটা লিখে ফেলেছেন! তারা আশেপাশের মেধাবী কবিদের নিয়ে নানা তর্কে লিপ্ত হন, আর দেখাতে চান তারাও মেধাবীদের সমকক্ষ! তারপর তারা একদিন হারিয়ে যান!

Friday 5 August 2016

ব্রাত্য জনের ব্রাত্য কথাকার -------------- বিমল চক্রবর্তী

(এক)


'যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হাতে দীন


সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে


সবার পিছে, সবার নীচে


সবহারাদের মাঝে।'


সবার পিছে সবার নীচে সবহারাদের মাঝ থেকে বেড়ে উঠে যিনি সেই 'সবার অধম দীনের হতে দীন'_ অচ্ছুৎ, প্রান্তজন, মালো, বেদে, জেলে, মেছু, জলদাস ও ভাসমান দলিত মানুষের ভিড়েই চরণ ফেলেছেন এবং গেয়েছেন সেই সর্বহারার গান তিনি ব্রাত্য মানুষের ব্রাত্য কথাকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ। যে ভূমি থেকে তাঁর উত্থান, জলকেন্দ্রিক সেই মালো পাড়া যতই মার্গহীন হোক না কেন তা-ই তাঁর কাছে মহার্ঘ্য বোধ হয়েছে; স্বজাতির ও আপন মৃত্তিকার প্রতি এই প্রীতিবোধ যে কেবল আবেগবশত তা কিন্তু নয়, এ এক জাত শিল্পীর সজ্ঞান ও সচেতনতার পাঠসূত্র কেননা 'আপন অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে কেউ শিল্পী হয় না।' বাংলা সাহিত্যে ধীবর, মাঝি, মালোদের নিয়ে কথা উঠলে প্রথম যে উপন্যাসটির কথা আসে সেটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি'। 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাসের পর মাঝিদের জীবন নিয়ে লেখা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম'। আমাদের সাহিত্যে নদীকেন্দ্রিক পটভূমি ও জীবন ব্যবস্থার প্রতিচিত্র নিয়ে আরো কিছু উপন্যাস রচিত হয়েছে। গঙ্গা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, কর্ণফুলী, গাহিন গাঙ্ এবং জলপুত্র যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর দেশে দেশে সমুদ্র, নদী, নাবিক, মাঝি ও জেলেদের নিয়ে প্রচুর গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে। চীনে, জাপানে, ইতালিতে, আফ্রিকায়, আমেরিকায়, রাশিয়ায় সর্বত্র জেলেদের জীবন নিয়ে প্রচুর সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাহিত্য নোবেল পুরস্কারও অর্জন করেছে। এক্ষেত্রে আমরা উল্লেখ করতে পারি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের 'ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি' কিংবা গার্সিয়া মার্কেজের 'হিস্ট্রি অব এ সিপরেকর্ড সেইলর' উপন্যাসের নাম, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।


'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ কোনো সুপরিকল্পিত প্লট বা কাহিনী প্রতিস্থাপনে প্রয়াসী হননি, শিল্পরীতির প্রতি দৃষ্টিপাত বরং না রেখেই একান্ত প্রণোদনা থেকে চিত্তাকর্ষক এক নির্মম বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে পল্লীর কঠোর বাস্তবতাকেন্দ্রিক গল্প-উপন্যাসের অভাব নেই। আমাদের পূর্বের নামকরা কথা শিল্পীরা মূলত পল্লীজীবনেরই কথক। তবে তাঁদের কথা-বিন্যাসে বাস্তব চিত্রধর্মের চেয়ে প্লট ও কাহিনীর কিংবা চরিত্র-চিত্রণের শৈল্পিক কারুকাজ ছিলো প্রবল। তবে এর ব্যতিক্রম হিসেবে আমরা বলতে পারি বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও আরণ্যক-এর কথা। দীনেন্দ্র কুমার রায়ের পল্লীচিত্রও ছিল নির্জলা গ্রামীণ বাস্তবতার ছবি। উল্লেখ করা যায় কাজী নজরুল ইসলামের 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসের নাম, যেখানে ক্ষুধা, পরাধীনতা, চক্রান্ত ও প্রতিঘাতচিত্র একযোগে রূপলাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি ছোটগল্প ও তারাশংকরের উপন্যাসের ভিত্তিভূমিও গ্রামীণ জীবনচিত্র, কিন্তু সেগুলোতেও তাঁদের সচেতন শিল্পকৃতির ছোঁয়া স্পষ্ট। ড. ক্ষুদিরাম দাস তাঁর এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, "মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' এই তিতাসের মতই নদীকেন্দ্রিক জেলে মালো মাঝিদের জীবন কথা শোনালেও তা চরিত্র নির্মাণের শৈল্পিকতা থেকে মুক্ত নয়। অন্যপক্ষে তিতাসে যেন গল্প লেখার সজ্ঞান প্রয়াসের কোন চিহ্নই নেই। লেখক ঠিক যা দেখেছেন তার হুবহু বিবরণই দিতে চেয়েছেন, এতেই তাঁর পরিতৃপ্তি। অথচ কী নদী, কী গ্রাম দুই মিলে পূর্ণ একটি নিসর্গচিত্র, আর তারই সঙ্গে আগাগোড়া মিলিত অদৃষ্ট নির্ভর এক দলিত ও সংগ্রামী গোষ্ঠীর সুখদুঃখময় জীবনকথা।" বাস্তবতার এমন সুখদুঃখময় প্রতিরূপ বর্ণনাগুণে 'তিতাস একটি নদীর নাম' যেমন চিরায়ত শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে, তেমনি এ কাহিনী আমাদের সামাজিক ইতিহাসের আখ্যান এবং লোকায়ত সংস্কৃতির আবশ্যপাঠ।


(দুই)


'পুব গগণের রক্ত অরুণ আমরা তরুণ শক্তিমান


বিশ্বহিতে রক্তকিরণ করবো মোরা করবো দান


মোদের চরণ স্পর্শে রে


জাগবে ধরা হর্ষে রে


বিশ্বহিতে করবো মোরা তপ্ত বুকের রক্তদান'


এই 'তপ্ত বুকের রক্তদান' করে বিশ্বহিতের কল্যাণ সাধনই ছিলো অদ্বৈত মল্লবর্মণের শিল্পসাধনার অভিলক্ষ্য। 'শিল্পের জন্য শিল্প' ধারণার বাইরে গিয়ে তিনি অচ্ছুৎ উচ্ছন্নসব মানুষকে ঠাঁই দিয়েছেন সাহিত্যের কেন্দ্রে এবং প্রান্ত-মানুষের প্রতি এই প্রীতি তাঁর মানবতা ও কল্যাণকামিতার পরিচায়ক। অনেক কথাশিল্পীর মতোই তাঁর লেখালেখিও শুরু হয়েছে কবিতা দিয়ে। শুরুতে তিনি প্রভাবিত ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা দ্বারা; এছাড়া কবি ও গীতিকার কামিনী ভট্টাচার্য এবং অজয় ভট্টাচার্যের কবিতার প্রভাবও তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।


প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা ছোটগল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে, 'ছোটগল্প' শব্দটিও তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। এ পর্যন্ত অদ্বৈত মল্লবর্মণের লিখা মাত্র ছয়টি ছোটগল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে_১. সন্তানিকা ২. স্পর্শদোষ ৩. কান্না ৪. বিস্ময় ৫. বন্দী বিহঙ্গ ৬. তমোনাশের মন । শেষোক্ত ছোটগল্পটি সম্প্রতি শান্তনু কায়সার সম্পাদিত ছোটকাগজ 'সমতট'-এর জ্যৈষ্ঠ ১৪২২, মে ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু স্বল্পায়ু অদ্বৈত মল্লবর্মণ মাত্র ছয়টি ছোটগল্প রচনা করলেও তাঁর গল্প সম্পর্কে সুমিতা চক্রবর্তীর মন্তব্য হচ্ছে_'অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছিল প্রকৃত ছোটগল্পকারের বিশিষ্ট প্রতিভা।'


কবিতা, প্রবন্ধ এবং ছোটগল্প রচনা করলেও অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রধান পরিচয় ঔপন্যাসিক হিসেবে, সর্বোপরি 'তিতাস একটি নদীর নাম'-এর রচয়িতা হিসেবে তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল প্রতিভা। তিতাস সম্পর্কে অচিন্ত্য বিশ্বাস বলেছেন_'তিতাসের কোন নৌকায় হচ্ছে মুর্শিদী-বাউল গান, কোথাও হচ্ছে পুঁথি পড়া_ হাছন রাজার দেশেরে উত্তরিল শেষেরে...। কোথাও শোনা যাচ্ছে কথার ফাঁকে ফাঁকে গান ভাসিতেছে, শুধু নৌকা নয়, নৌকার ওপারকার মানুষ আর তাঁর গান এমনভাবে আর কোনো উপন্যাসে ধরা পড়েনি।'


লোক সংগীতের জগতে ব্যক্তি মুখ্য থাকেনি, নামহীন-ভণিতাহীন সুরলোকে ভেসে ফিরছে তরঙ্গায়িত নর-নারী। ওয়াই এম শকলব বলেছেন_ 'ÔFolklore has been and continues to be rejection and weapon of class conflict' সামাজিক মগ্ন-চৈতন্যকে গভীর অবলোকনের মাধ্যমে তিনি নদীর মতই এক বহমান ভাষা দিয়েছেন। একদিন শোনা গেলো সেই ভাষা_ 'এখন রাত গভীর হইয়াছে। এখন ভাটিয়ালি গাহিবার সময়, যখন জীবনের ফাঁকে ফাঁকে জীবনাতীত আসিয়া উঁকি দিয়া যায়। এখন কান পাতিলে রাত্রির হৃদস্পন্দন শুনিতে অনেক গভীর ভাবের অজানা স্পর্শ অনুভব করা যায়। অনেক অব্যক্ত রহস্যের বিশ্বাতীত সত্তা এই সময় আপনা থেকে মানুষের মনের ভিতরে নিভৃতে কথা কহিয়া যায়।' প্রকৃত প্রস্তাবে তিতাস একটি নদী-জীবনকেন্দ্রিক পাঁচালী। তিতাসের পাড়ে আখ্যানকে বলা হয় পরস্তাব। তাই তিতাস হল মালো বা গাবরদের নদীকেন্দ্রিক জীবনের পরস্তাব। পদ্মা নদীর মাঝি, ইছামতি, গঙ্গা, চিংড়ি এবং তিস্তাপারের বৃত্তান্ত এমন নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস অথবা কবি, ঢোঁড়াই চরিত মানস এসব আঞ্চলিক সাহিত্যকে কেন্দ্রে রেখে বলা যায় তিতাস একটি মহৎ কথাচিত্র। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত এই আখ্যান যেনো নদীকেন্দ্রিক জীবনচিত্রের চিরায়ত রূপ, যেখানে নদীর বয়ে চলার সাথে সময়ের ধারাপাত একই সূত্রে একাকার_'নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে, কালও বহিয়া চলে। কালের বহার শেষ নাই। নদীরও বহার শেষ নাই।'


বিমল চক্রবর্তীর প্রবন্ধে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও তিনি মূলত একজন কবি। একজন কবির স্বভাব-অস্থিরতাকে দূরে ঠেলে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সংযমের সাথে বাংলা সাহিত্যের ব্রাত্য মানুষের কথাকার অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নতুন আলোয় উপস্থাপন করেছেন 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ ব্রাত্য জীবনের ব্রাত্য কথাকার' গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে। অদ্বৈতের উপন্যাস, গল্প, কবিতা, জীবনচিত্র, শিক্ষা, চিঠিপত্র, তাঁর উপন্যাসের চলচ্চিত্র, সাংবাদিকতা এবং যাপনশৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথক নিবন্ধ ও আলোচনার সমন্বয়ে রচিত এমন গ্রন্থ বোধ করি খুব বিরল। সেই শ্রমসাধ্য কাজটিতে কবি বিমল চক্রবর্তী যে একজন গবেষকের মতোই পরিচ্ছন্নতার সাথে নিয়োজিত ছিলেন গ্রন্থটির পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা উদ্ধৃতি, মন্তব্য, দুর্লভ চিত্র ও প্রতিবেদন দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্য মূল্যায়নের এমন রচনা-সমষ্টি চোখে পড়ে না বললেই চলে। গ্রন্থটিতে সংকলিত রচনাগুলোর দিকে অবলোকন মাত্রই বোধ করা যায় কতটা নিবিড় ও ক্লান্তিকর ছিল এর রচনা ও সম্পাদনা। গ্রন্থভুক্ত রচনাগুলোর মধ্যে জন্ম সময়, পারিবারিক ভিত্তি এবং জীবন, কবি অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ছোট গল্পের অদ্বৈত মল্লবর্মণ, জীবনতৃষার অদ্বৈত মল্লবর্মণ, শাদা হাওয়ার অদ্বৈত মল্লবর্মণ, রাঙামাটির অদ্বৈত মল্লবর্মণ, প্রবন্ধ সাহিত্য ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ, নদীকেন্দ্রিক আখ্যান এবং তিতাস, সাগরময় ঘোষ এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণ, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণ, এছাড়া ত্রিপুরার অদ্বৈত মল্লবর্মণ উৎসব উল্লেখযোগ্য। বিমল চক্রবর্তী রচিত গ্রন্থটিতে মৌলিক রচনার পাশাপাশি সংকলিত হয়েছে বিশিষ্ট লেখকদের অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিয়ে রচিত কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ, যার মধ্যে সুবোধ চৌধুরীর লিখা খাঁটি সোনা তাই ভেঙে গেলো, সাগরময় ঘোষ রচিত_ ভেবেছিলাম একটি মৌলিক উপন্যাস লিখব_হলো না, অচিন্ত্য বিশ্বাস রচিত_ তিতাস একটি নদীর নাম : বর্জিত পাঠ এবং সরোজ মোহন মিত্রের লেখা_ভালোবাসার এক নাম তিতাস। এছাড়া বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে তিতাস নদী ও অদ্বৈত মল্লবর্মণকে নিবেদিত গুরুত্বপূর্ণ কবিদের বেশ কিছু চমৎকার কবিতা। লেখক গ্রন্থটিতে শ্যামল ঘোষের যাত্রারূপকৃত 'তিতাস একটি নদীর নাম'-এর পা-ুলিপিটি সংকলনের মাধ্যমে পুস্তকটিকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি সম্পন্ন পাঠরূপে প্রস্তুত করতে দারুণভাবে সক্ষম হয়েছেন, যা থেকে স্বল্প চেষ্টায় যে কোন পাঠক বাংলা সাহিত্যের এই নিভৃত মানিককে চিনে নিতে পারেন।


(তিন)


'এ আমার শৈশবের নদী, এই জলের প্রহার


সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে


যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে


গতির প্রবাহ হানে।'


কবি আল মাহমুদের কবিতায় তিতাস নদীর যে 'গতির প্রবাহ' পাওয়া যায় তাকেই যেনো আমরা জীবনের উত্থান-পতনের সাথে ছন্দিত হতে দেখি 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিকটবর্তী গোকর্ণঘাট গ্রামে। ১৯১৪ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি তিতাস পাড়ের এই গ্রামটিতে বসবাস করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে অদ্বৈত প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৪ সালে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে, কিন্তু দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত তার সেই পাঠ আর শেষ করতে দেয়নি। 'ব্রাত্য জীবনের ব্রাত্য কথাকার' গ্রন্থটিতে লেখক বিমল চক্রবর্তী অত্যন্ত দক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার সাথে অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্য ও জীবনের বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন, সেই সাথে তুলে এনেছেন নদীকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার জীবনচিত্র; আমরা লেখকের 'নদীকেন্দ্রিক আখ্যান এবং তিতাস' রচনা থেকে সামান্য পাঠ নিচ্ছি_'নদী অনেক হ্রদের জন্ম দেয়, ব-দ্বীপ থেকে শুরু করে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। নদী হল অটনী, অঙ্গিনী, প্রবাহিনী, শৈবালিনী, স্রোতস্মতী, শ্রাবন্তী এবং পয়স্বিনী।' একই রচনায় লেখক ভারত ও বাংলাদেশের নদীগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য প্রদান করেছেন_


'বাংলাদেশও নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের নদীগুলোকে যদি আমরা অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন করি, তাহলে দেখব রংপুর অঞ্চলে ২৫টি নদী আছে, রাজশাহীতে ১০টি, পাবনায় ৮টি, বগুড়ায় ৭টি, ঢাকায় ১৮টি, ময়মনসিংহে ৩৭টি, সিলেটে ৩৬টি, কুমিল্লায় ৪৪টি, নোয়াখালীতে ১৯টি, চট্টগ্রামে ৩০টি, কালিয়ায় ৪টি, যশোরে ২৮টি, ফরিদপুরে ৫টি, খুলনায় ৭টি, বরিশালে ৫৭টি, সুন্দরবন অঞ্চলে ১৭৭টি নদী।' এত বিপুল সংখ্যক নদীর অবস্থান থাকলেও বর্তমানে কিন্তু এই নদীগুলোর অবস্থা ভালো নেই। নাব্যতা সঙ্কট, অবৈধ দখল, অপরিকল্পিত আবাসনশিল্প, দস্যুদের ছোবল আর অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো আজ যৌবন হারাতে বসেছে।


অদ্বৈতের জীবিতকালে একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল 'ভারতের চিঠি_পার্ল বাক্কে'। দেশ পত্রিকায় কাজ করার সময় তাঁর অনূদিত 'জীবনতৃষা' ধারাবাহিকভাবে 'দেশ'-এ প্রকাশিত হয়। অদ্বৈতের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর তাঁর অমর গ্রন্থ 'তিতাস একটি নদীর নাম' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে ঋতি্বক ঘটক উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ন করেন।


কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের সর্বদা চেপে রাখতেই পছন্দ করেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁদেরই দলভুক্ত। এঁরা নিজেরা অনালোকে থেকে আলোর দীপ জ্বেলে যান। অকৃতদার নিঃসঙ্গ অদ্বৈত মল্লবমর্ণের শেষ পর্যন্ত দুজন সহযোদ্ধা ছিলেন, তারা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সাগরময় ঘোষ। আড়ালে পড়ে থাকা অদ্বৈতকে বারবার পর্দার বাইরে আনার চেষ্টা করতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। অদ্বৈত মল্লবর্মণকৃত 'জীবনতৃষা' আরভিং স্টোন-এর বিখ্যাত উপন্যাস 'লাস্ট ফর লাইফ'-এর এক অসাধারণ অনুবাদ। 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত এই অনুবাদ তাঁর সাহিত্য অনুধাবন ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যান গখ। যক্ষ্মা রোগের সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে সারা জীবন যুদ্ধরত সংগ্রামী শিল্পী ভ্যান গখের সঙ্গে অদ্বৈত নিশ্চয়ই প্রাণের একাত্মতা খুঁজে পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রে অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের মন্তব্য ছিল_ 'জীবনের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে সংগ্রামরত শিল্পী ভ্যান গখ-এর সঙ্গে নিজের একান্ত নিবিড় আত্মীয়তা নিশ্চয় অনুভব করেছিলেন। কেননা ওই সময়েই ক্রমশ চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল 'তিতাস'_এর জীবন নিংড়ানো পাঠকৃতি।'


লোকে আজকাল যেখানে পর্যাপ্ত আলো আছে সেখানেই আরো একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে আসে, এই প্রজ্জ্বলন লৌকিকতার বাইরে বোধ করি ভিন্ন কোনো অর্থ বহন করে না; সেখানে কবি বিমল চক্রবর্তী বাংলা সাহিত্যের ব্রাত্য কথাকার অদ্বৈত মল্লবর্মণকে এক মলাটে তুলে ধরতে যে শ্রমনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাকে কেবল দু-পাঁচ বাক্যের প্রশংসা দিয়ে খাটো করতে চাই না। ৫৬টি রচনা, ১৫টি কবিতা এবং বেশ কিছু দুর্লভ স্থিরচিত্রের মাধ্যমে রচিত ও সংকলিত গ্রন্থটি প্রত্যাশা করি অচিরেই অদ্বৈত পাঠকসহ বোদ্ধা লেখক, কবি ও সুধী-সমঝদারজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে এবং আরো হবে। যে প্রেরণা কবি বিমল চক্রবর্তীকে 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ বাত্য জীবনের ব্রাত্য কথাকার' গ্রন্থটি রচনায় প্রাণিত করেছে এবং ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর সাহিত্যকৃতিকে তুলে ধরতে উৎসাহিত করেছে সেই প্রেরণাই নতুন নতুন পাঠক ও লেখককে অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্পর্কে উৎসাহিত করবে_ কেবল এটাই বোধ করি গ্রন্থটি রচনার একক উদ্দেশ্য। যা কিছু সুন্দর ও মানবিক তার সাথে মানুষের গভীর সম্প্রীতি, এই প্রীতিবোধ থেকেই মূলত মানুষ সুন্দরকে অবলম্বন করে থাকে। কবি বিমল চক্রবর্তীর অদ্বৈত অভিযাত্রা যেহেতু চিরায়ত সুন্দর ও খাঁটি বিষয়কে তুলে ধরার লক্ষ্যে, তাই বলতে পারি এ যাত্রায় তিনি দারুণভাবে সফল।


অদ্বৈত মল্লবর্মণ : ব্রাত্য জীবনের ব্রাত্য কথাকার


লেখক : বিমল চক্রবর্তী