Saturday 10 December 2016

সুমনের ' গানওলা' ও ডিলানের 'Mr Tambourine Man -------পলাশকান্তি বিশ্বাস

সুমনের ' গানওলা' ও ডিলানের 'Mr Tambourine Man
অনেকেই অনেক সময় জিজ্ঞেস করেছেন কবীর সুমনের ' ও গানওলা, আর একটা গান গাও' গানটা Bob Dylan এর Mr. Tambourine Man গানের অনুসরণ বা অনুকরণ কি না।
সুমনের গানটা সবাই শুনেছেন, এমন ধরে নিয়েই কথাগুলো লিখছি।
সুমনের গানের প্রথম দুলাইনের মধ্যে ডিলানের গানের কথার বেশ কিছুটা ছায়া পাওয়া যায়। কিন্তু তফাতও আছে। দুলাইনের পর থেকে কিন্তু সুমন তার নিজস্ব পথে হেঁটেছেন অন্য মহান স্রষ্টাদের মতই। অন্য কোন সূত্র থেকে ভাব বা ভাবনার কণামাত্র নিয়ে একটা নিজস্ব নবনির্মিতি। সব শিল্পীর ক্ষেত্রেই এমন ঘটা স্বাভাবিক ও স্বীকৃত।
দুটো গান আমি বারবার শুনেছি। দুটো গগানই মহৎ সৃষ্টি তার তার দেশকালের নিরিখে। প্রকৃতপক্ষে দুজনই মহান স্রষ্টা। সুর ও পরিবেশনে দুটোর আমেজ আলাদা।
আমার মনে হহয়েছে এটা বাংলায় অনুবাদ করে দিলে বেশ হয়। যারা ডিলানের গলগানটা শোনেন নি, অথচ সেটা কেমন তা জানতে ইচ্ছে আছে, তাদের ভালো লাগবে। আর সেই ফাঁকে পাঠকদের একটা নতুন বিষয় পাওয়া হয়ে যাবে।
আমেরিকার জীবনাচরণ আমার তেমন জ্ঞাত নয়, কিছুটা অনুমান করে আমার দেশের জীবন-পরিবেশের সঙ্গে যতটা সম্ভব মেলানোর চেষ্টা করেছি। ছন্দটাও এমন রাখার চেষ্টা করেছি যাতে গাইতে চাইলেও তেমন হোঁচট না খেতে হয়।
বন্ধুরা মতামত দিলে খুশি হব। আশা থাকবে, মূল গান বুঝতে বা আমার শব্দপ্রয়োগে অজ্ঞানতা বা অনবধানতাবশত কোন ভুল করে থাকি, তারা আমাকে মন্তব্যে সতর্ক করবেন। হ্যাঁ, অনুবাদকের স্বাধীনতা কিছুটা তো আমায় নিতেই হছে, বিশেষত ছন্দ- অন্ত্যমিল রাখার ক্ষেত্রে।
বন্ধুদের ভালো লাগলে আমার চেষ্টার সার্থকতা।
খঞ্জনি-বৈরাগী**
--- পলাশকান্তি বিশ্বাস
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
আমি জানি এখন সন্ধ্যাবাসর বালি-ধূসরিত
দুহাত নিঃশেষিত
অন্ধ খাড়া অবাঞ্ছিত তবু ঘুমটা অজানা
অবাক-করা ক্লান্তি আমার, পায়ে ক্ষত পোড়ার
কেউ নেই তো দেখা করার।
পুরনো শুনশান রাস্তা মড়ার মত শুয়ে, যেন স্বপ্ন দেখাও মানা।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
তোমার যাদু-দোলের নায়ে একবার নাও আমায় উঠায়ে
আমার হৃত অনুভূতি আমার হাত ভুলেছে মুঠি
পায়ের আঙুল চাইছে ছুটি,
দাঁড়াও, বুট-গোড়ালিই ভরসা এখন হাঁটতে কদম-পথ
যাব যে কোন জায়গায়, মিলিয়ে যাব অজানায়
আমার নিজস্ব যাত্রায়
দেখাও তোমার নাচের চলন-- শিখবই, শপথ।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
হয়তো তুমি মাঝে মধ্যে
দেখেও থাকবে বহাল রৌদ্রে ছুটোছুটি হাসি মজা গান
তাতে নেই তো আমন্ত্রণ ,
সে সব নিছক পলায়ন
লক্ষ্য আকাশ নেই যেখানে বেড়ার অসম্মান।
যদি শোনে তোমার কান অস্পষ্ট ছড়ার গান,
তোমার খঞ্জনিটার কাছে
মিথ্যে কাঙাল জোকার নাচে; আমার নেই যে তাতে মন।
তুমি দেখেছ যা ছায়াবাজির ব্যর্থ অনুসরণ।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।
তারপর, নাও আমায় লুকিয়ে মনের ধোঁয়ার বৃত্ত দিয়ে
কুয়াশা-ধ্বংস-কাল পেরিয়ে চলো সাগরতীরের হাওয়ায়
হিমে-জমাট পাতার কাঁড়ি
ভূতে-পাওয়া গাছের সারি
দুঃখের কামড়-মোচড় ভারি ফেলে যাব চলে দূরের ইশারায়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হীরের আকাশতলায় সাগরপটে, তটরেখায়
সোনা-বালির চবুতরায় হবে হাত দুলিয়ে নাচ
সব ভাগ্য, স্মৃতির রাশি হোক তরঙ্গে বানভাসি
আগামীকাল আসার আগে ভুলতে দাও না আজ।।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
আমি ঘুমে কাতর নই, কোথাও যাবার কথাও নেই।
ও খঞ্জনি-বৈরাগী, আমায় শোনাও একটা গান
এই ‘রাই জাগো রাই’-ভোরে যাব তোমার সঙ্গেই।।

**(বব ডিলানের ‘মিঃ টাম্বুরিন ম্যান’ অনুসরণে)
................................................
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Though I know that evenin's empire has returned into sand,
Vanished from my hand,
Left me blindly here to stand but still not sleeping.
My weariness amazes me, I'm branded on my feet,
I have no one to meet
And the ancient empty street's too dead for dreaming.
Bringing It All Back Home
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Take me on a trip upon your magic swirlin' ship,
My senses have been stripped, my hands can't feel to grip,
My toes too numb to step, wait only for my boot heels
To be wanderin'.
I'm ready to go anywhere, I'm ready for to fade
Into my own parade, cast your dancing spell my way,
I promise to go under it.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Though you might hear laughin', spinnin', swingin' madly across the sun,
It's not aimed at anyone, it's just escapin' on the run
And but for the sky there are no fences facin'.
And if you hear vague traces of skippin' reels of rhyme
To your tambourine in time, it's just a ragged clown behind,
I wouldn't pay it any mind, it's just a shadow you're
Seein' that he's chasing.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.
Then take me disappearin' through the smoke rings of my mind,
Down the foggy ruins of time, far past the frozen leaves,
The haunted, frightened trees, out to the windy beach,
Far from the twisted reach of crazy sorrow.
Yes, to dance beneath the diamond sky with one hand waving free,
Silhouetted by the sea, circled by the circus sands,
With all memory and fate driven deep beneath the waves,
Let me forget about today until tomorrow.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
I'm not sleepy and there is no place I'm going to.
Hey! Mr. Tambourine Man, play a song for me,
In the jingle jangle morning I'll come followin' you.

Sunday 4 December 2016

শুদ্ধ প্রকল্প ---------------------------------------পলাশকান্তি বিশ্বাস

শুদ্ধ প্রকল্প
--- পলাশকান্তি বিশ্বাস
ব্যাংক বলে টাকা নেই, এটিএম বন্ধ।
ফিসফিস, গুঞ্জন, ফিশিফিশি গন্ধ।
কার ঘাড়ে কোপ প’ল, পোয়াবারো কার ?
কেউ বলে ত্রাহি ত্রাহি--- এবারটি ছাড়।
কেউ বলে ঠিক ঠিক, কেউ বলে ধিক !
কারো ক্ষতি কম কিছু, কারো বা অধিক।
কেউ বলে, মেনে নিই কিছু লোকসান
অসাধুর ঘরে যত পাহাড়-প্রমাণ
কালাধন গচ্ছিত, হোক উদ্ধার --
ঘুরপথে জোটে যদি কিছুটা আমার।
অসাধু মুচকি হাসে, কচুপোড়া খা গে,
পোড়া যে কপাল তোর, সামলে নে আগে।
ভাবিস আমার কথা কিছুদিন গেলে--
আমি তো খাচ্ছি মাছ ভেজে মাছ-তেলে।
ছিল বা কতটা তোর ? --- তিন-আনি পাই !
তাই নিয়ে কেঁদে যাস ধানাই পানাই ।
আমি তো কোটির শোক করিনি কখনো,
আসলে তো মাটি সব যেভাবেই গোনো।
ঝটকায় গেল যেটা ঝটকাতে আসবে
তোদের মতন কিছু অকারণে ফাঁসবে।
এটিএম, পেটিএম, প্লাস্টিক মানি
মন্ত্রীর পেটে যা তা সবকিছু জানি।
মগজটা ট্যাড়া তাঁর, ‘সাফা সাফা’ বলে
মাঝরাতে ঝ্যাঁটা হাতে ঘোরে জঙ্গলে।
ময়লা বা ছেঁড়া-ফাটা নকলি বা কালো
হঠাৎ ইচ্ছে, সাইক্লিং বিনে ঢালো
সব শ্বেত-পারাবত শান্তি-আকাশে
যে পারো যতটা ধরো, নয় মরো ত্রাসে।
আমরা দিব্যি আছি বড় বেওসায়ী,
হা-ঘরে জনতা রাতারাতি ধরাশায়ী।
ইন্ডিয়া শাইনিং চিরকাল রবে
ভাবি, ওহে ভারতীয়, তোদের কী হবে।
তোরা থাক তোরা হয়ে, থাক কুঁড়েঘরে
আমরা আমরা থাকি আকাশশহরে।
প্রোমোটার তাল বুঝে খেদাল শ্রমিক,
রেস্তোরাঁ মাড়ায়না প্রেমিকা-প্রেমিক।
টাকা আছে, টাকা নেই মুশকিল ধাঁধা!
একশো’র পায়ে পড়ে দুহাজারি দাদা।
কোথা কালো, কোথা সাদা, কে বেড়ায় মেপে!
বাজারের গলা যেন ধরেছে কে চেপে!
ক্রেতা নেই বলে কাঁদে দোকানি-বাজারি
ক্রেতার কাতরধ্বনিঃ আছে দু-হাজারি!
হাজারপকেটী নেতা ফুলোচ্ছে গাল
আহা কী নেতা রে আমি, তিল থেকে তাল
তাল কেটে বেপরোয়া গমক-ঠমক
দ্যাখো রে দ্যাখো রে চাল, বেতাল-চমক!
ছত্রিশ ইঞ্চির বুক ঠুকে মন্ত্রীঃ
মিথ্যে চেঁচাও বাপু জন-গণতন্ত্রী !
প্রধান করলে যদি, সব সিদ্ধান্ত
আমাকেই নিতে দাও, থাকো চুপ শান্ত।
বিদেশে যা গচ্ছিত আনিব রে দেশে
বলে বলে শেষমেশ গিয়েছি তো ফেঁসে।
বিদেশের পারিনি যা, দেশের তো পারি!
কিরকম ভেবে ভেবে সকলের হাঁড়ি
হাটের মাঝারে এনে ফাটিয়ে দিলাম !
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলো সবে, বলো রাম রাম।
বেওসায়ি বেরাদার--- তাদের যা ঋণ
আগেই মকুব আহা, পথ মসৃণ।
বেকুব জনতা, বাছা, পঞ্চাশ দিন
থাক না সিকিটা খেয়ে প্রতিবাদহীন।
এমনি তো আধপেটা সারাটি বছর;
কটা দিন দেশপ্রেমে--- মরেও অমর।
দেখিস না কিরকম সীমান্তে-মাঠে
শ্রমিক-সেনারা সব বেমালুম খাটে !
দেশপ্রেম খাঁটি কিনা বোঝা যায় কিসে?
নেতার আদেশে যদি মুখ দাও বিষে
তবেই তো খাঁটি তুমি, মিনিমিনি পুষি!
দেশপ্রেমে ভোট বাড়ে, আমরাও খুশি।
সীমান্তে মরে সেনা বিনা প্রতিবাদ
তোমরাও নাও যদি তার কিছু স্বাদ
তবে তো পূর্ণ হয় ষোল-বিশ কলা
না হলে মহান দেশে কমে শৃঙ্খলা ।
শৃঙ্খলা শৃঙ্খল যত বাড়ে, বেশ তো
শাসকের ঘুম জমে, বাড়ে কিছু রেস্তও।
এতকাল মনে মনে যা রেখেছি পুষে
নিন্দুকে বলে কি না সব রাক্ষুসে!
ঘরে ঘরে ফেরি করি দেশপ্রেম-খেলা
অবোধ বোঝে না কিছু, শুধু অবহেলা।
সেনা পাক, পাকসেনা বলি যতবার
দেশজুড়ে হাততালি, ভাবের জোয়ার।
সে জোয়ার-মন্থনে তুললে মাখন
তোদের কি এসে যায়?--- বড় জ্বালাতন!
কিছু জ্বালা সকলের হবে সেটা জানা
তাবলে প্রেমের মালা, ভেট-নজরানা
স্বদেশ ও বিদেশের শিল্পপতিরা
দিচ্ছে যা নেব না কি? সব শিরঃপীড়া
বলে দূরে ছুঁড়ে দেব, নেব না গলায়
শুধু কি গরীব ভজে থাকব তলায়?
ভুবন তো গ্রাম এক। সে গ্রামের যত
ধনী আছে ডাক পাড়ি প্রেমসম্মতঃ
ভাইয়োঁ বহনোঁ, আনো তোমাদের ধন
আমাদের দেশে ঢালো বীজের মতন
কোটি কোটি লোক আছে – সোনাফলা মাঠ
দশগুণ ফিরে পাবে, বিনা বিভ্রাট।
প্রাচীনসভ্য, বড় উদার প্রজাতি
একবার কর যদি ছোট খয়রাতি
আজীবন কৃতজ্ঞ বংশানুক্রমে
তোমারো মুনাফা দ্যাখো কত ওঠে জমে।
বেওসার নামে করো শোষণ-শাসন
পদেপদে নাফা, নেই বিরোধাচরণ।
আমিও মসীহা বেশ, নয়া অবতার
মন-কি-বাত ধর্ম করছি প্রচার
আধুনিক যুগ, হতে হবে আধুনিক,
নোট ছেড়ে দ্রুত ধরো মানি প্লাস্টিক।
এটিএম, পেটিএম, স্মার্টফোন ধরো
ডিজিটাল হয়ে বাঁচো, ডিজিটাল মরো।
স্লোগানে স্লোগানে ভরি দেশের বাতাস
ও আমার ভাই-বোন নাও নয়া শ্বাস
গ্লোবাল ভিলেজ মানে বহু সম্ভাবনা
যুবক যুবতী পাবে হাতে হাতে সোনা
রামরাম নামে করি স্বপ্নের ফেরি
মাঝে মাঝে হুঙ্কার— বাজে রণভেরি
আমার স্বদেশ জেনো স্বভাবে মহান
অতিথিকে দেব ভাবি, দেব সে প্রমাণ।
নাও বাবা লুটে নাও ধন-মান-প্রাণ
গরীব না থাকে দেশে--- ধৌত শ্মশান।
স্বচ্ছতা-অভিযান শুদ্ধ প্রকল্প,
হাজার বছর পরে শোনাবে তা গল্প।
.....................

Thursday 1 December 2016

বাংলাদেশ-----------------------সৈকত ব্যানার্জি

বাংলাদেশ

লিখেছেন সৈকত ব্যানার্জি।
প্রকল্প ১
বাংলাদেশ আমার জাতিপ্রীতির মোক্ষম নমুনা। হলাম না হয় আলাদা দেশ। তবু একই রাণীর দুই রাজপুত্তুর বটে। বাংলাদেশ আমার বাঙালিয়ানার গদগদ প্রতীক।পদ্মা মেঘনার জলে আমার মানস সাঁতার, জারুল হিজল ছুঁয়ে আসা বাতাসে আমার ফিনফিনে ভালো লাগা, বাপ-পিতেমোর আদিবাড়ির অলৌকিক টান রক্তে মিশিয়ে নেওয়া, আর ওই ভাষা দিবসের সাতসকালে সারা বছরে নাক সিঁটকে রাখা ভাষাতেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। রাগ করেন না কত্তা, বাংলাদেশ আমার এক সপাট ন্যাকামো।
প্রকল্প ২
বাংলাদেশ আমার চোখে পাকিস্তানের ছোট ভাই। গিজগিজ করছে মুসলমান। দাড়ি, টুপি, কোরাণ আর হুমায়ুন আহমেদ। উফ!… এই এই এই। নো নো। নো মোর ট্যক। জানো না ওরা সবকটা সন্ত্রাসবাদী! এক্ষুনি চাপাতি কিংবা সুইসাইড বোমে পিণ্ডি চটকে রেখে দেবে।
প্রকল্প ৩
বড় ভাইয়ের প্রতি ঘেন্না ঘেন্না খেলায় ছোট ভাই আবার আমার দোসর। সেই ৭১ এ পাকিস্তানকে যা এক হাত নিয়েছিল না! অবশ্য আমাদের দেশব্রতী, উদার, ভোলেমন সেনা জওয়ানরা নেহাত ছিল তাই! তা সে উপকারের দক্ষিণা নিতেই তো ওই বাংলাদেশ বর্ডারে আমাদের সেনারা, ওই আর কি…নিন্দুকেরা  কি সব বর্ডার রেপ টেপ বলে যেন। যত্তসব বাজে কথা। রাতবিরেতে একটু বাই উঠতে পারে না নাকি মানুষের! বেচারারা ঘরদোর ছেড়ে অত্তদূরে থাকে… কি আর করবে!
হাতের কাছে সুবর্ণ সব সুযোগেরা আছে। তাই আরো খান কতক প্রকল্প চাইলেই বানিয়ে নেওয়া যায়। কোন প্রকল্পে বাংলাদেশ আমাদের অতিরিক্ত কাছে চলে আসে, এতটাই কাছে যে আলাদা করে আর চিহ্নিত করতেই পারি না। ওটা যে আলাদা একটা দেশ, আমার থেকে স্বতন্ত্র তার যে একটা গতি আছে, রক্তাক্ত একটা ওঠাপড়ার ইতিহাস আছে তা আমার আর চোখেই পড়ে না। অথবা,  কোন প্রকল্পে বাংলাদেশ হয়ে যায় ওপারের ‘ওরা’। তখন আমি আশঙ্কিত। আমার নিরাপত্তার বলয়ে  তখন ঘনিয়ে ওঠে সন্দেহ। কাঁটাতারের সীমান্তটা নড়বড়ে লাগে। আগলে রাখতে অক্ষম মনে হয় আমাকে।
বাংলাদেশকে কাঁটাতারের এপার থেকে, এই অশিক্ষিত – অদীক্ষিত চোখ নিয়ে কিভাবে দেখব তবে? মানে নেহাত ওই ভাব-গদগদ আধবোজা চোখ নিয়ে যদি না দেখতে চাই আর কি। তা দেখতেই বা হবে কেন? দিব্যি তো চলছে রসে বসে। বাংলাদেশের ধম্মকম্ম, সাহিত্য, রাজনীতি কিংবা ক্রিকেট এসব কিছুর থেকেও বেশি খোঁজ তো অন্য কিছুর চলতে দেখা যায়। সেটা বাংলাদেশি পর্ণ ভিডিও সার্চিং এর রমরমা দেখলেই দিব্বি ঠাওর হয়। তবু নাছোড় কতকগুলো পরিচয় সেই মোক্ষম মুহুর্তের দৃশ্যেও জুড়ে থাকে যখন, তখন ভয় লাগে। পর্ণ সাইটে মেয়ে শরীর চেখে দেখতে দেখতেও ধর্মের টাকনাটা যখন মুখরোচক হয়ে ওঠে, যখন সায়া ব্লাউজ সালোয়ারের আধা নগ্নতার সঙ্গে সঙ্গে সাপটে থাকে ‘মুসলমান মেয়ে’ কিংবা ‘মালাউন বউ’ এর ধর্মীয় ট্যাগ, তখন খোশমেজাজি তোফা বাংলাদেশকে নিয়ে ন্যাকামো না করে একটু ছরে কেটে ঘা হয়ে থাকা বাংলাদেশটার দিকে তাকানোটা জরুরী হয়ে যায়। এপারের হিন্দু মৌলবাদের কথা বললেই যখন যুক্তি হিসেবে উঠে আসে ওপারের ইসলাম মৌলবাদ, ব্লগার হত্যা, ধর্ষণ, আর লাগাতার হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ তখন যন্ত্রণা হয়। মনে হয় বাংলাদেশ যেন সেই আধ লেখা অসমাপ্ত একটা কবিতা হয়েই রয়ে গেছে, যার প্রতিটি লাইন আমরা যে যার প্রয়োজন মতো ব্যাখা করে নিচ্ছি।
আচ্ছা কোথায় তাকাই তবে বাংলাদেশকে খুঁজতে হলে?  বাঁদরের পিঠে ভাগ হওয়া মানচিত্রের দিকে? একুশের ভাষা আন্দোলন আর তার শহীদ তালিকার দিকে?  শহীদের স্মৃতিতে গড়ে ওঠা মিনারের দিকে?  সে তাকানোয় কোন পূর্ণতার হদিশ আর আজকে মিলবে? সেই হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন না, যে কাফনে মোড়া অশ্রবিন্দুর মতো শহীদ মিনার, সকলকেই আজ যেতে হয় সেখানে, শাসককেও যেতে হয়। ভোটবাক্সের স্বার্থ, জনআবেগের চাপ সকলকেই বাধ্য করে সেখানে যেতে। ‘ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে মনে ঘেন্না করে এ-অশ্রুবিন্দুকে, কিন্তু ফুল নিয়ে না এসে পারে না’।
তবে কি ৬৯ এর আন্দোলন? ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ?  জাতীয়তাবাদের প্রবল ঝলকানি সেখানে ঢেকে রেখেছে যাবতীয় বাঁকাচোরা গলিঘুঁজি।এত আলো,  এত্তো আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু তারপর?  আলোর উৎস থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসে অন্ধকার। ৭১ থেকে ৭৮এর সেনা অভ্যুত্থান, হত্যা,গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে হাত বদল হতে হতে শেষে ক্ষমতা গিয়ে পড়ল এরশাদের হাতে। পাকিস্তান প্রত্যাগত, স্বৈরাচারী এরশাদ। মৌলবাদ পেশী ফুলিয়ে উঠে দাঁড়াল সে আমলে। ৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শাসন কাঠামোকে হাসান আজিজুল হক বলেছেন, রীতিমত রপ্তানি করার যোগ্য ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার’। আর তারপরের অংশ? ৯০ এ না হয় স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে এল গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্রের সেই জয়ে দুহাত তুলে নাচার আগে পায়ে যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকছে হাসান আজিজুল হকেরই আশঙ্কিত প্রশ্ন, গ্যাংগ্রীন ছড়াচ্ছে,
“….. আজ কারো কারো কি মনে হচ্ছে বর্তমান গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনায় স্বৈরাচার আর একটু গণতান্ত্রিক ছিল?”
মাইল মাইল ছড়িয়ে আছে ভিজে মাটি। নরম নদী আঁকিবুঁকি কেটে রেখেছে তাতে। মাঠে মাঠে বোনা হচ্ছে ধান। নৌকাও বুঝি ভাসছে দু এক খানা। এমন পেলব দৃশ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা আবহ সঙ্গীত হিসেবে ভালোই জমত। কিন্তু খটকা যতই লাগুক মিউজিক তো খানিক উলটে পালটে গেছেই। কানে এনতার সুড়সুড়ি দিচ্ছে ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’। পাকিস্তানের দিকে ফিরতি টান আজ কোথাও চোরাগোপ্তা, কোথাও বা বেশ স্পষ্টই। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পরিচয় বানানোর চেষ্টায় আর. এস. এস. আর জামাত এমনিতে ভাই ভাই। ধর্ম দুটোর নাম আলাদা এটুকুই যা ফারাক। আর ইসলামই যদি হবে আমার আসল পরিচয় তবে ইসলামের পুণ্যভূমি ‘পাক-ইস্তান’ই বা আমার থেকে আলাদা থাকে কেন?  মুক্তি যুদ্ধের যে চেতনা মাতিয়ে দিয়েছিল ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল, আজ সে মাতমের ওপর ভণভণ করছে ধর্মের মাছি। আর ধর্মের কলেরা একবার ছড়ালে তা কতদূর কুৎসিত রূপ নিতে পারে তা বাবরি আর গুজরাট দাঙ্গার পর আর বলতে লাগে না বোধহয়। তবু এ রোগ ছড়াচ্ছে। শুধু  সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার নয়, ধর্মীয় মৌলবাদের চিরায়ত লক্ষণ যে কোন যুক্তিবাদী, মুক্ত চিন্তার ওপর আঘাত আনা। সেখানে পাস্কালের যুক্তিকে নাস্তিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করায় অভিজিৎ ও যেমন রেহাই পায়না, তেমনি হুমায়ুন আজাদের হত্যাকারীর ও হদিশ মেলেনা কোনো।
ধর্মও খুঁজে নেয় যোনীদেশ। খুঁজে নেয় বিধর্মীর লিঙ্গ পরিচয়। ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়ের সাথে ‘মেয়ে’পরিচয় যখন মিশে যায় তখন আক্রমণটা যোনীতেই গিয়ে ঠেকে। জেহাদের সে উল্লাস আমরা দেখতে পাই ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসে, দশজন জেহাদি যেখানে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় দশ বছরের শিশুকন্যার ওপর। আর সেই ‘মালাউন’ মেয়ের মা শুধু অসহায় অনুরোধটুকুই করতে পারে তাদের, “হুজুর, আমার মাইয়াডা কচি, আপনেরা একজন একজন কইর‍্যা যান। একলগে মাইরেন না হুজুর।” উদাহরণের ভার বাড়াতে চাই না। ছোবলের পর ছোবল খেতে হবে তাতে। শুধু এটুকুই বলি উদাহরণ চয়নে আমিও কিঞ্চিত পক্ষপাতী হয়ে উঠেছি। নয়ত আমার হাতের কাছেই খোলা ছিল হুমায়ুন আজাদেরই আরেক উপন্যাস ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’। যেখানে ময়নাকে ধর্ষণ করতে করতে সাদ্দাম তার সঙ্গীদের বলে “মালাউন মাইয়াগুনিও এইডার কাছে কিছ না”। আর আলতাপ বলে “আমরা ইসলামিক নাশালিজম কায়েম কইর‍্যা ছারুম।” সে ‘ইসলামিক নাশালিজম’-এর হাত থেকে হিন্দু কিংবা মুসলমান মেয়ে কারুরই রেহাই নেই।
এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের এক বড় অংশের প্রকল্পের গলদ। যে গলদ প্রতিদিন পাল্টে দিচ্ছে আমার বিবেচনার ভঙ্গী। প্রতিবেশীকে দেখার আন্দাজ। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের কথা শুনছি। তাদের যন্ত্রণার ভাষ্য পড়ছি। আর রাগে ঘেন্নায় থুতু ছেটাতে ছেটাতে মেপে নিচ্ছি আমার পাড়ার রহমন চাচাকে, যিনি এই ভারতবর্ষের নিরিখে সংখ্যালঘু। যাঁকে ঘরের ফ্রিজে মাংস রাখার আগে চিন্তা করতে হয় গোমাংস রাখার ‘অপরাধ’ তার ঘরে কোন গুজরাট ডেকে আনবে। আর্টিজান রেস্তরায় হামলার পর আমরা গোটা বাংলাদেশের সমস্ত মুসলমানকে চিনতে শিখছি সন্ত্রাসবাদী বলে। অথচ সেই ছেলেটিকে ভুলে যাচ্ছি, যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বন্ধুদের ছেড়ে রেস্তোরা থেকে পালায়নি। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হয়েছে। ধর্মে সেও মুসলমানই ছিল। আর তারও দেশের নাম বাংলাদেশ। ‘সমস্ত সন্ত্রাসবাদী মুসলমান’। আর সন্ত্রাসবাদের হাতে খুন হওয়া বিপুল পরিমাণ মানুষ? মুসলমান নন তারা?  ক্ষমা করবেন স্যার, আমি একটা গোটা ধর্মের সমস্ত মানুষকে সন্ত্রাসী বলে ট্যাগিয়ে দিতে পারছি না। আমার সামনে ভেসে উঠছে ‘সংসপ্তক’ এর সেকেন্দার মাস্টারের মুখ। ভেসে উঠছে গালিবের কবিতা। মহম্মদ রফির গলা। আর আমার একলা চিলেকোঠার বিপ্রতীপে ক্রমশ হরাইজেন্টালি বাড়তে থাকা হাড্ডি খিজিরের দল।
তবে কোন প্রত্যাশা নিয়ে তাকাবো আমরা বাংলাদেশের দিকে? আস্থা রাখব কোথায়? আবুল ফজল কথিত মানবতন্ত্রে? চিলেকোঠা থেকে কোন উন্মাদ বেরিয়ে আসায়?  হেলাল হাফিজের মিছিলগামী যৌবনের স্পর্ধায়?  জানি না। দিকনির্দেশ করা সমাজবিপ্লবীর কাজ। আমার সাধ্য নয় তা। আমি শুধু অপার যন্ত্রণা নিয়ে সেই বাংলাদেশের ছেলেটার দিকে তাকাতে পারি। আর্টিজানের সন্ত্রাসের পর প্রতিটি মুসলমানকে সন্ত্রাসবাদী জেনে কোতল করার নিদান দিচ্ছি যখন আমরা, সেই ছেলেটি তখন ফেসবুকে একের পর এক লিঙ্ক শেয়ার করে চলেছে, কত কত কত মুসলমান মানুষ খুন হয়েছে এই ইসলাম মৌলবাদীদের হাতে। বাংলাদেশে। গোটা বিশ্বে। যেন চিৎকার করে বলে চলেছে, দেখুন আমি প্রতিদিন মরে মরে প্রমাণ করছি আমি সন্ত্রাসবাদী নই। আমি কোন সংখ্যালঘুকে ঘৃণা করি না। আমার জেহাদ নেই। শুধু বাংলাদেশ আছে।