Thursday 1 December 2016

বাংলাদেশ-----------------------সৈকত ব্যানার্জি

বাংলাদেশ

লিখেছেন সৈকত ব্যানার্জি।
প্রকল্প ১
বাংলাদেশ আমার জাতিপ্রীতির মোক্ষম নমুনা। হলাম না হয় আলাদা দেশ। তবু একই রাণীর দুই রাজপুত্তুর বটে। বাংলাদেশ আমার বাঙালিয়ানার গদগদ প্রতীক।পদ্মা মেঘনার জলে আমার মানস সাঁতার, জারুল হিজল ছুঁয়ে আসা বাতাসে আমার ফিনফিনে ভালো লাগা, বাপ-পিতেমোর আদিবাড়ির অলৌকিক টান রক্তে মিশিয়ে নেওয়া, আর ওই ভাষা দিবসের সাতসকালে সারা বছরে নাক সিঁটকে রাখা ভাষাতেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। রাগ করেন না কত্তা, বাংলাদেশ আমার এক সপাট ন্যাকামো।
প্রকল্প ২
বাংলাদেশ আমার চোখে পাকিস্তানের ছোট ভাই। গিজগিজ করছে মুসলমান। দাড়ি, টুপি, কোরাণ আর হুমায়ুন আহমেদ। উফ!… এই এই এই। নো নো। নো মোর ট্যক। জানো না ওরা সবকটা সন্ত্রাসবাদী! এক্ষুনি চাপাতি কিংবা সুইসাইড বোমে পিণ্ডি চটকে রেখে দেবে।
প্রকল্প ৩
বড় ভাইয়ের প্রতি ঘেন্না ঘেন্না খেলায় ছোট ভাই আবার আমার দোসর। সেই ৭১ এ পাকিস্তানকে যা এক হাত নিয়েছিল না! অবশ্য আমাদের দেশব্রতী, উদার, ভোলেমন সেনা জওয়ানরা নেহাত ছিল তাই! তা সে উপকারের দক্ষিণা নিতেই তো ওই বাংলাদেশ বর্ডারে আমাদের সেনারা, ওই আর কি…নিন্দুকেরা  কি সব বর্ডার রেপ টেপ বলে যেন। যত্তসব বাজে কথা। রাতবিরেতে একটু বাই উঠতে পারে না নাকি মানুষের! বেচারারা ঘরদোর ছেড়ে অত্তদূরে থাকে… কি আর করবে!
হাতের কাছে সুবর্ণ সব সুযোগেরা আছে। তাই আরো খান কতক প্রকল্প চাইলেই বানিয়ে নেওয়া যায়। কোন প্রকল্পে বাংলাদেশ আমাদের অতিরিক্ত কাছে চলে আসে, এতটাই কাছে যে আলাদা করে আর চিহ্নিত করতেই পারি না। ওটা যে আলাদা একটা দেশ, আমার থেকে স্বতন্ত্র তার যে একটা গতি আছে, রক্তাক্ত একটা ওঠাপড়ার ইতিহাস আছে তা আমার আর চোখেই পড়ে না। অথবা,  কোন প্রকল্পে বাংলাদেশ হয়ে যায় ওপারের ‘ওরা’। তখন আমি আশঙ্কিত। আমার নিরাপত্তার বলয়ে  তখন ঘনিয়ে ওঠে সন্দেহ। কাঁটাতারের সীমান্তটা নড়বড়ে লাগে। আগলে রাখতে অক্ষম মনে হয় আমাকে।
বাংলাদেশকে কাঁটাতারের এপার থেকে, এই অশিক্ষিত – অদীক্ষিত চোখ নিয়ে কিভাবে দেখব তবে? মানে নেহাত ওই ভাব-গদগদ আধবোজা চোখ নিয়ে যদি না দেখতে চাই আর কি। তা দেখতেই বা হবে কেন? দিব্যি তো চলছে রসে বসে। বাংলাদেশের ধম্মকম্ম, সাহিত্য, রাজনীতি কিংবা ক্রিকেট এসব কিছুর থেকেও বেশি খোঁজ তো অন্য কিছুর চলতে দেখা যায়। সেটা বাংলাদেশি পর্ণ ভিডিও সার্চিং এর রমরমা দেখলেই দিব্বি ঠাওর হয়। তবু নাছোড় কতকগুলো পরিচয় সেই মোক্ষম মুহুর্তের দৃশ্যেও জুড়ে থাকে যখন, তখন ভয় লাগে। পর্ণ সাইটে মেয়ে শরীর চেখে দেখতে দেখতেও ধর্মের টাকনাটা যখন মুখরোচক হয়ে ওঠে, যখন সায়া ব্লাউজ সালোয়ারের আধা নগ্নতার সঙ্গে সঙ্গে সাপটে থাকে ‘মুসলমান মেয়ে’ কিংবা ‘মালাউন বউ’ এর ধর্মীয় ট্যাগ, তখন খোশমেজাজি তোফা বাংলাদেশকে নিয়ে ন্যাকামো না করে একটু ছরে কেটে ঘা হয়ে থাকা বাংলাদেশটার দিকে তাকানোটা জরুরী হয়ে যায়। এপারের হিন্দু মৌলবাদের কথা বললেই যখন যুক্তি হিসেবে উঠে আসে ওপারের ইসলাম মৌলবাদ, ব্লগার হত্যা, ধর্ষণ, আর লাগাতার হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ তখন যন্ত্রণা হয়। মনে হয় বাংলাদেশ যেন সেই আধ লেখা অসমাপ্ত একটা কবিতা হয়েই রয়ে গেছে, যার প্রতিটি লাইন আমরা যে যার প্রয়োজন মতো ব্যাখা করে নিচ্ছি।
আচ্ছা কোথায় তাকাই তবে বাংলাদেশকে খুঁজতে হলে?  বাঁদরের পিঠে ভাগ হওয়া মানচিত্রের দিকে? একুশের ভাষা আন্দোলন আর তার শহীদ তালিকার দিকে?  শহীদের স্মৃতিতে গড়ে ওঠা মিনারের দিকে?  সে তাকানোয় কোন পূর্ণতার হদিশ আর আজকে মিলবে? সেই হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন না, যে কাফনে মোড়া অশ্রবিন্দুর মতো শহীদ মিনার, সকলকেই আজ যেতে হয় সেখানে, শাসককেও যেতে হয়। ভোটবাক্সের স্বার্থ, জনআবেগের চাপ সকলকেই বাধ্য করে সেখানে যেতে। ‘ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে মনে ঘেন্না করে এ-অশ্রুবিন্দুকে, কিন্তু ফুল নিয়ে না এসে পারে না’।
তবে কি ৬৯ এর আন্দোলন? ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ?  জাতীয়তাবাদের প্রবল ঝলকানি সেখানে ঢেকে রেখেছে যাবতীয় বাঁকাচোরা গলিঘুঁজি।এত আলো,  এত্তো আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু তারপর?  আলোর উৎস থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসে অন্ধকার। ৭১ থেকে ৭৮এর সেনা অভ্যুত্থান, হত্যা,গুপ্তহত্যার মধ্য দিয়ে হাত বদল হতে হতে শেষে ক্ষমতা গিয়ে পড়ল এরশাদের হাতে। পাকিস্তান প্রত্যাগত, স্বৈরাচারী এরশাদ। মৌলবাদ পেশী ফুলিয়ে উঠে দাঁড়াল সে আমলে। ৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের শাসন কাঠামোকে হাসান আজিজুল হক বলেছেন, রীতিমত রপ্তানি করার যোগ্য ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার’। আর তারপরের অংশ? ৯০ এ না হয় স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে এল গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্রের সেই জয়ে দুহাত তুলে নাচার আগে পায়ে যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকছে হাসান আজিজুল হকেরই আশঙ্কিত প্রশ্ন, গ্যাংগ্রীন ছড়াচ্ছে,
“….. আজ কারো কারো কি মনে হচ্ছে বর্তমান গণতন্ত্রের সঙ্গে তুলনায় স্বৈরাচার আর একটু গণতান্ত্রিক ছিল?”
মাইল মাইল ছড়িয়ে আছে ভিজে মাটি। নরম নদী আঁকিবুঁকি কেটে রেখেছে তাতে। মাঠে মাঠে বোনা হচ্ছে ধান। নৌকাও বুঝি ভাসছে দু এক খানা। এমন পেলব দৃশ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা আবহ সঙ্গীত হিসেবে ভালোই জমত। কিন্তু খটকা যতই লাগুক মিউজিক তো খানিক উলটে পালটে গেছেই। কানে এনতার সুড়সুড়ি দিচ্ছে ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’। পাকিস্তানের দিকে ফিরতি টান আজ কোথাও চোরাগোপ্তা, কোথাও বা বেশ স্পষ্টই। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পরিচয় বানানোর চেষ্টায় আর. এস. এস. আর জামাত এমনিতে ভাই ভাই। ধর্ম দুটোর নাম আলাদা এটুকুই যা ফারাক। আর ইসলামই যদি হবে আমার আসল পরিচয় তবে ইসলামের পুণ্যভূমি ‘পাক-ইস্তান’ই বা আমার থেকে আলাদা থাকে কেন?  মুক্তি যুদ্ধের যে চেতনা মাতিয়ে দিয়েছিল ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল, আজ সে মাতমের ওপর ভণভণ করছে ধর্মের মাছি। আর ধর্মের কলেরা একবার ছড়ালে তা কতদূর কুৎসিত রূপ নিতে পারে তা বাবরি আর গুজরাট দাঙ্গার পর আর বলতে লাগে না বোধহয়। তবু এ রোগ ছড়াচ্ছে। শুধু  সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার নয়, ধর্মীয় মৌলবাদের চিরায়ত লক্ষণ যে কোন যুক্তিবাদী, মুক্ত চিন্তার ওপর আঘাত আনা। সেখানে পাস্কালের যুক্তিকে নাস্তিকতার পক্ষে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ করায় অভিজিৎ ও যেমন রেহাই পায়না, তেমনি হুমায়ুন আজাদের হত্যাকারীর ও হদিশ মেলেনা কোনো।
ধর্মও খুঁজে নেয় যোনীদেশ। খুঁজে নেয় বিধর্মীর লিঙ্গ পরিচয়। ‘সংখ্যালঘু’ পরিচয়ের সাথে ‘মেয়ে’পরিচয় যখন মিশে যায় তখন আক্রমণটা যোনীতেই গিয়ে ঠেকে। জেহাদের সে উল্লাস আমরা দেখতে পাই ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসে, দশজন জেহাদি যেখানে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় দশ বছরের শিশুকন্যার ওপর। আর সেই ‘মালাউন’ মেয়ের মা শুধু অসহায় অনুরোধটুকুই করতে পারে তাদের, “হুজুর, আমার মাইয়াডা কচি, আপনেরা একজন একজন কইর‍্যা যান। একলগে মাইরেন না হুজুর।” উদাহরণের ভার বাড়াতে চাই না। ছোবলের পর ছোবল খেতে হবে তাতে। শুধু এটুকুই বলি উদাহরণ চয়নে আমিও কিঞ্চিত পক্ষপাতী হয়ে উঠেছি। নয়ত আমার হাতের কাছেই খোলা ছিল হুমায়ুন আজাদেরই আরেক উপন্যাস ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’। যেখানে ময়নাকে ধর্ষণ করতে করতে সাদ্দাম তার সঙ্গীদের বলে “মালাউন মাইয়াগুনিও এইডার কাছে কিছ না”। আর আলতাপ বলে “আমরা ইসলামিক নাশালিজম কায়েম কইর‍্যা ছারুম।” সে ‘ইসলামিক নাশালিজম’-এর হাত থেকে হিন্দু কিংবা মুসলমান মেয়ে কারুরই রেহাই নেই।
এখানেই বোধহয় লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের এক বড় অংশের প্রকল্পের গলদ। যে গলদ প্রতিদিন পাল্টে দিচ্ছে আমার বিবেচনার ভঙ্গী। প্রতিবেশীকে দেখার আন্দাজ। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের কথা শুনছি। তাদের যন্ত্রণার ভাষ্য পড়ছি। আর রাগে ঘেন্নায় থুতু ছেটাতে ছেটাতে মেপে নিচ্ছি আমার পাড়ার রহমন চাচাকে, যিনি এই ভারতবর্ষের নিরিখে সংখ্যালঘু। যাঁকে ঘরের ফ্রিজে মাংস রাখার আগে চিন্তা করতে হয় গোমাংস রাখার ‘অপরাধ’ তার ঘরে কোন গুজরাট ডেকে আনবে। আর্টিজান রেস্তরায় হামলার পর আমরা গোটা বাংলাদেশের সমস্ত মুসলমানকে চিনতে শিখছি সন্ত্রাসবাদী বলে। অথচ সেই ছেলেটিকে ভুলে যাচ্ছি, যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বন্ধুদের ছেড়ে রেস্তোরা থেকে পালায়নি। সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হয়েছে। ধর্মে সেও মুসলমানই ছিল। আর তারও দেশের নাম বাংলাদেশ। ‘সমস্ত সন্ত্রাসবাদী মুসলমান’। আর সন্ত্রাসবাদের হাতে খুন হওয়া বিপুল পরিমাণ মানুষ? মুসলমান নন তারা?  ক্ষমা করবেন স্যার, আমি একটা গোটা ধর্মের সমস্ত মানুষকে সন্ত্রাসী বলে ট্যাগিয়ে দিতে পারছি না। আমার সামনে ভেসে উঠছে ‘সংসপ্তক’ এর সেকেন্দার মাস্টারের মুখ। ভেসে উঠছে গালিবের কবিতা। মহম্মদ রফির গলা। আর আমার একলা চিলেকোঠার বিপ্রতীপে ক্রমশ হরাইজেন্টালি বাড়তে থাকা হাড্ডি খিজিরের দল।
তবে কোন প্রত্যাশা নিয়ে তাকাবো আমরা বাংলাদেশের দিকে? আস্থা রাখব কোথায়? আবুল ফজল কথিত মানবতন্ত্রে? চিলেকোঠা থেকে কোন উন্মাদ বেরিয়ে আসায়?  হেলাল হাফিজের মিছিলগামী যৌবনের স্পর্ধায়?  জানি না। দিকনির্দেশ করা সমাজবিপ্লবীর কাজ। আমার সাধ্য নয় তা। আমি শুধু অপার যন্ত্রণা নিয়ে সেই বাংলাদেশের ছেলেটার দিকে তাকাতে পারি। আর্টিজানের সন্ত্রাসের পর প্রতিটি মুসলমানকে সন্ত্রাসবাদী জেনে কোতল করার নিদান দিচ্ছি যখন আমরা, সেই ছেলেটি তখন ফেসবুকে একের পর এক লিঙ্ক শেয়ার করে চলেছে, কত কত কত মুসলমান মানুষ খুন হয়েছে এই ইসলাম মৌলবাদীদের হাতে। বাংলাদেশে। গোটা বিশ্বে। যেন চিৎকার করে বলে চলেছে, দেখুন আমি প্রতিদিন মরে মরে প্রমাণ করছি আমি সন্ত্রাসবাদী নই। আমি কোন সংখ্যালঘুকে ঘৃণা করি না। আমার জেহাদ নেই। শুধু বাংলাদেশ আছে।

No comments:

Post a Comment