Sunday 20 November 2016

প্রসঙ্গ;কালো টাকা,চমকের রাজনীতি ------------------- কল্যাণ সেনগুপ্ত

চমকের রাজনীতির শিকার গোটা দেশ -কল্যাণ সেনগুপ্ত।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটিও বোধকরি অতীতে কখনো নোট বাতিলের ফলে এমন দুর্ভাগ্যের ও উদ্বেগের শিকার হন নি, যেমনটি এবার হচ্ছেন। এমন অবিবেচক, এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রধানমন্ত্রী দেশবাসী এর আগে দেখেনি। প্রথমেই একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। প্রচন্ড ভিড় এড়াতে প্রথম দুদিন ব্যাংকমুখো হবার সাহস পাইনি। তৃতীয় দিনে গিয়েও ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরতে হলো। চতুর্থ দিনে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অনেক কষ্টে সাকুল্যে দশ হাজার পাওয়া গেল, কিন্তু তার মধ্যে চারটি 2000এর নোট, বাকিটা 100 । এবার বলুন, কোন বাজারে দু-চারশো টাকার মাল কিনলে 2000এর নোট ভাঙিয়ে দেবে? এখন আমাকে বাধ্য হয়ে সবার দয়া ভিক্ষা চাইতে হবে। এই পরিস্থিতি যে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত অসহনীয়। আমার মতো অনেককেই অসৎ না হয়েও এমন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এভাবে আরো কতদিন চলবে বোঝা যাচ্ছে না আদৌ। প্রথম দিকে অরুনhim জেটলি বলেছিলেন- এইসা ঘাবরানেকা কুছ নেহি, দো-চার দিনমে সব কুছ সামান্য হো জায়েগা। এখন আবার শুনছি 15/20 দিন। মোদীজি মাঝে বললেন- মুঝে পাচাস দিনকা সময় দিজিয়ে, ম্যায় এক নয়া ভারত সবকো দেঙ্গে। কতদিনে এই সমস্যা শেষ পর্যন্ত মিটবে কেও নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা। উল্টে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, পরিস্থিতি ক্রমশঃ আরো খারাপ হবে। সবাই একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে বাজারে পাঁচশর নোট নেই আর একশোর জোগানও সামান্য। নোট বাতিলের আগে এর প্রয়োজনীয় যোগানের কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। এর ফলে ব্যবসা বাণিজ্য ও দৈনিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে সেই বিষয়টিকেও কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কোনো দায়িত্বশীল সরকার যে এমনটা করতে পারে, তা প্রায় অকল্পনীয়। এই অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা ঢাকতে এখন দেশপ্রেমের দোহাই দেওয়া হচ্ছে এবং যারাই এবিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে, তারা নাকি সব দেশদ্রোহী। এই জবরদস্তি উচ্চকিত দেশভক্তি কি ফ্যাসিজমের পদধ্বনি নয়! ইতিহাস কিন্তু সেই আশঙ্কার কথাই বলে।
একবার এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত বলেছিলেন- এটা গণতন্ত্রের যুগ। কিন্তু বিভিন্ন রকম আক্রমণ থেকে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখাও এক বড় সংগ্রাম। আমাদের আশেপাশে বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বেশ নড়বড়ে। যদিও আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ভিত বেশ সুদৃঢ়। এখানে বহু ধর্মের মানুষ, বহু ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে একত্রে শান্তিতে বাস করছে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে অবলম্বন করে। এখানে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের ঠাঁই নেই। রাজনীতি বা সেনাবাহিনীর যে কেউ হোক, স্বৈরতন্ত্রঈ হয়ে উঠতে চাইলে মুশকিল হচ্ছে, তিনি যদি উত্তর ভারতের মানুষ হন তবে অচিরেই দক্ষিণের প্রায় সবাই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, আবার দক্ষিণের হলে বিদ্রোহ করবে উত্তরের মানুষ। ফলে এখানে স্বৈরতন্ত্রের সফল হবার আশা নেই। কিন্তু কখনো কারো মাথায় যদি ভুত চাপে তখন আর অগ্রপশ্চাদ বিবেচনা থাকেনা। যেমনটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মাথায় চেপেছে, আশঙ্কা হচ্ছে। নইলে কোনো দায়িত্বশীল সুস্থমস্তিস্কের মানুষের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব নয়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করেও যদি তিনি কোনো বাধা না পান বা পার পেয়ে যান, তাহলে কিন্তু আগামী দিনে দেশকে আরো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা ছেড়ে দিলেও শুধুমাত্র দৈনিক ব্যবসা বাণিজ্যের লেনদেনে ইতিমধ্যেই কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে, তা আন্দাজ করলে শিউরে উঠতে হয়। আগামীদিনে কিন্তু সব হিসেব নিকেশ করতেই হবে। এই পদক্ষেপের ফলে কতটা লাভ হলো আর কতটা ক্ষতি, তারও হিসেব। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পঞ্চাশ দিন পরে অর্থাৎ 2017তে তিনি নতুন ভারত উপহার দেবেন। নতুন ভারত বলতে কি কালোটাকা, নকল টাকা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত ভারত? তাহলে বলতে হয়, এটিও তবে ওই '১৫ লক্ষ প্রত্যেককে' এর মতোই আর একটি ধাপ্পা। বর্তমান অবস্থায় দেশকে সম্পূর্ন কালো টাকা মুক্ত করা অসম্ভব। কারণ ধনীদের থেকে 100% কর আদায় প্রায় অসম্ভব। কর বহির্ভুত অঘোষিত টাকাই হচ্ছে কালো টাকা। সবাই যে সে টাকা ঘরের মধ্যে থরেথরে সাজিয়ে রাখে, এমনটা নয়। বিদেশে পাচার করে, সোনা কিনে মজুত করে, রিয়েল স্টেটের ব্যবসা ইত্যাদিতে লগ্নি করে। নোট বাতিলের ফলে কালোটাকার একটা ক্ষুদ্র অংশ হয়তো নষ্ট হবে বা ধরা পরবে। তবে হ্যাঁ, নকল টাকার ক্ষেত্রে সাময়িক সুফল পাওয়া যাবে। তবে সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বড় চালু নোটের নকল আবার চালু হবে। চালু হবে সন্ত্রাসও। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি কোনো পদক্ষেপই নয়। সম্প্রতি গুজরাটেও দুলক্ষ টাকার অধিক ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং সেই ঘুষে সবই ছিল নতুন দুহাজার টাকার নোট। কোথা থেকে এল এত দুহাজারের নোট, সেও এক রহস্য! অর্থাৎ সর্ষে ভুতের সক্রিয়তা এতটুকু কমেনি, আর দুর্নীতিতো দূরস্থান।
আজ একথা প্রমাণিত যে, যথেষ্ট প্রস্তুতি না নিয়েই এই নোট বাতিলের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাকে বলা যায়, রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি। এমনটি আমাদের দেশে অতীতে কখনও হয়নি। এর মধ্যেও সারাদিন লাইন দিয়ে যারা টাকা পাচ্ছেন, তাদেরকেও 80% ₹2000 নোটেই দেওয়া হচ্ছে জবরদস্তি। মনে হচ্ছে যেন, ₹2000 নোট চালু করতেই এই ₹500 ও 1000 নোট বাতিল করা হলো। বর্তমানে এই ₹2000 নোট সাধারণ মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে বলা হচ্ছে, সিদ্ধান্তটি নাকি ঐতিহাসিক, এর ফলে নাকি ধনী ও দারিদ্রের ব্যবধান কমবে! এসব অবান্তর দাবি করা হলেও অর্থনীতির কোনো পন্ডিত কিন্তু এর সপেক্ষে মুখ খোলেননি। অপরদিকে অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, স্বামীনাথন আইয়ার বা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতির বিশিষ্ট মানুষেরা বরং আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন। মনমোহন সিং শুধুমাত্র কংগ্রেস নেতা নন, তিনি একজন অর্থনীতির পণ্ডিতও বটেন। তিনি নিজের অতীত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেছেন, আমি যখন নরসীমা রাও মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হয়ে আসি, তখন আমার মনে হয়েছিল অতিশীঘ্রই কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। কিন্তু নরসীমাজি আমাকে বলেন, এটা ভারতবর্ষ। এখানে কিছু করতে হলে প্রথমেই ভাবতে হবে দেশের সুদূর প্রান্তে উঃ পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্রতম মানুষটির কথা, তার যেন কোন ক্ষতি না হয়। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সেসব ভাবার প্রয়োজন মনে করেন নি। তিনি বিশ্বাস রাখেন সাফল্যের বাজিতে, চমকের রাজনীতিতে।

No comments:

Post a Comment