Thursday 3 November 2016

বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার আনুপাতিক অবস্থান ------------------ আজম খান

২০৫১ সনে হিন্দুদের সংখ্যা ১৯৭৪ সনে যা ছিল তাই হতে পারে
 আজম খান
বাংলাদেশে সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় হিন্দু সংখ্যার আনুপাতিক অবস্থান ক্রমাগতই নিম্নমুখী হচ্ছে সেটা এতদিনে আমরা সবাই জানি। সাধারণ ভাবে বলা যায় যে এই অবক্ষয়ের প্রক্রিয়াটি ১৯৪৭ সনের দেশভাগের ও পরবর্তীকালের সরকারদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত না করার পরিণতি। অন্যাদিকে ভারতে বিজেপি ও অন্যান্য চরমপন্থী দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও মুসলিম জনসংখ্যার আনুপাতিক হার ১৯৫১ সনের ১০% থেকে ২০১১ সনে ১৪% এ উঠে এসেছে। ঐ একই পর্যায়কালে (১৯৫১-২০১১) বাংলাদেশে হিন্দুদের শতকরা অংশ ২২ থেকে কমে হয়েছে ৮.৫, আর পাকিস্তানে আরো প্রকটভাবে ১৯৪৭ সনের ২০ থেকে ২৫% হিন্দু-শিখ জনসংখ্যা কমতে কমতে এখন ২%এর নিচে নেমে আসেছে।
এই লেখাটিতে বাংলাদেশের ক্রম-নিম্নগামী হিন্দু জনসংখ্যাকে একটি খুবই সাধারণ গাণিতিক সমীকরণ বা বক্ররেখা দিয়ে দিয়ে মিলিয়ে (বা fit করে) ভবিষ্যতে তার সংখ্যাটা কততে গিয়ে দাঁড়াবে তার একটা হিসাব করা হয়েছে। এই পদ্ধতির পদ্ধতিগত কোন বিশুদ্ধতা দাবি করছি না – সংখ্যাগুলোর যথাযথতায় কিছু বিচ্যুতি থাকতে পারে, তবে মোটা দাগে দেখলে এই লেখার ভাবিকথন বাস্তবতা থেকে খুব দূরে হবে না। আর একটি ব্যাপার – এই গণনায় অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা আদিবাসীদের ভবিষ্যত ধরা হয় নি, তাদের সংখ্যাগুলোও এই অবক্ষয় প্রক্রিয়ার অংশ। এই লেখায় কোন গভীর সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয় নি।
১ নম্বর টেবিলে ১৯৫১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত জরীপের নম্বরগুলো দেখানো হল। চার নম্বর কলাম বা স্তম্ভ থেকে হিন্দু জনসংখ্যার ক্রমান্বয় আনুপাতিক ক্ষয়িষ্ণুতা খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে। সাথে সাথে তিন নম্বর কলাম থেকে ২০১১ নাগাদ এই সমগ্র জনগোষ্ঠী যে সংখ্যাগত ভাবে আর বৃদ্ধি পাচ্ছে না সেটারও একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
টেবিল ১. সমগ্র জনসংখ্যা, হিন্দু জনসংখ্যা ও হিন্দু আনুপাতিক শতকরা জনসংখ্যা (মিলিয়ন এককে)
বছরসমগ্র জনসংখ্যাহিন্দু জনসংখ্যাহিন্দু আনুপাতিক জনসংখ্যা
১৯৫১৪১.৯৩৯.২২২২
১৯৬১৫০.৯৫৯.৪২১৮.৫
১৯৭৪৭০.৮৮৯.৫৭১৩.৫
১৯৮১৮৪.৭৬১০.২৮১২.১
১৯৯১১০৯.৯১২.৭৭১১.৬
২০০১১৩৪.৭১২.৯৩৯.৬
২০১১১৫২.৯১২.৯৯৮.৫
এবার আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বের করব। ১৯৫১ থেজে ২০১১ পর্যন্ত সমগ্র জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হল ৪.৪%, অথচ এই সময়ে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধিহার হচ্ছে মাত্র ০.৭%।
টেবিল ২. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
পর্যায় কালসমগ্র জনগোষ্ঠীহিন্দু জনগোষ্ঠী
১৯৫১ – ২০১১৪.৪%০.৭%
ওপরের সারণীর পর্যায়কালটিকে আরো ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে দেখলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধি হার যে কতখানি মুখ থুবড়ে পড়েছে সেটা আরো স্পষ্ট হয়।
টেবিল ৩. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
পর্যায় কালসমগ্র জনগোষ্ঠীহিন্দু জনগোষ্ঠী
১৯৭৪-১৯৮১২.৮%১.০৬%
১৯৮১-১৯৯১৩.০%২.৪২%
১৯৯১-২০০১২.২৫%০.১২%
২০০১-২০১১১.৩৫%০.০৫%

২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত হিন্দু জনগোষ্ঠী ০.০৫% মত নিতান্তই দুর্বল একটা হার নিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, বলতে গেলে ১৯৯১ থেকেই মনে হয় এই গোষ্ঠীর বৃদ্ধিতে একটা বড় ব্রেক কষা হয়েছে। ১ নং টেবিলের ৪ নং স্তম্ভের ক্রমান্বয় পতনকে যদি একটা গাণিতিক সূচক (power) রেখা দিয়ে মেলানো (fit) যায় তবে আমরা নিচের টেবিলের নিম্নভূমি নম্বরগুলো পাব।
টেবিল ৪. আগামীতে সমগ্র জনসংখ্যার তুলনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক মান
বছরআনুপাতিক শতকরা মান
২০২১৬.৩
২০৩১৫.৩
২০৪১৪.৪
২০৫১৩.৭
২০৬১১.৫
এবার আমরা ভবিষ্যতের দুটি বছরকে লক্ষ করি। একট ২০৩১, অপরটি ২০৫১। ২০১১র বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে ভিত্তি করে ও বর্তমানের আনুমানিক ১.৩৫% বৃদ্ধির হার ধরে নিয়ে হিসাব করলে ২০২১ সালের জনসংখ্যা হবে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি এবং ২০৫১ সনে হবে ২৬১.৪ মিলিয়ন বা ২৬ কোটির কিছু ওপরে। অবশ্য দেশের জনসংখ্যা ২৫০ মিলিয়নে স্থিত হতে পারে এরকমও একটা মতামত আছে, তবে সেই আলোচনাটা আর এক দিনের জন্য তোলা থাকল।
টেবিল ৪’র নম্বরগুলো ব্যবহার করলে ২০৩১য়ে হিন্দু জনসংখ্যা হবে ১০.৬ মিলিয়ন ও ২০৫১তে হবে ৯.৬৭ মিলিয়ন। অর্থাৎ ২০৫১তে সংখ্যাগত ভাবে হিন্দুদের পরিমাণ ১৯৭৪ সনে যা ছিল তাই হবে। এর মানে হল সংখ্যাবৃদ্ধির হার হবে ঋণাত্মক। খুবই মোটা দাগের একটা হিসাবে বলা যেতে পারে ২০১১ থেকে ২০৫১ পর্যন্ত বৃদ্ধির হার হবে -০.৬৪%।
টেবিল ৫. ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা (মিলিয়ন হিসাবে)
বছরসমগ্র জনসংখ্যাহিন্দু জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার
২০১১১৫২.৯১২.৯৯+০.০৫%
২০৩১২০০.০১০.৬০-০.৯২%
২০৫১২৬১.৪৯.৬৭-০.৪৪%

অনেক শিল্পোন্নত দেশের জনসংখ্যার কম প্রবৃদ্ধির কম, অনেক ক্ষেত্রে সেটা ঋণাত্মক। স্কান্ডানেভীয় দেশগুলোতে এই বৃদ্ধির হার ০.৫ থেকে ০.৭%, জাপানে – (নেগাটিভ) ০.২%। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু সমাজ নিঃসন্দেহে এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত নয় ।
কয়েক বছর আগেও আমি বিশ্বাস করতাম যে যদিও হিন্দু জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার কমছে কিন্তু তাদের সংখ্যা কম হার হলেও বাড়ছে। এবং ভবিষ্যতেও বাড়বে। কিন্তূ কার্যতঃ দেখা যাচ্ছে এই বৃদ্ধির হার ক্রমাগতই ঋণাত্মক মানের দিকে যাচ্ছে। আগামী ৪০ বছর হিন্দুদের সংখ্যা ২০১১ সনের সর্বোচ্চ ১৩ মিলিয়ন থেকে ধীরে ধীরে ১০ মিলিয়নে পরিণত হবে। ২০৫১র পরে জনসংখ্যা সাংঘাতিক ভাবে কমে যাবে কিনা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু কার্য্তঃ রাষ্ট্রের সমস্ত কাজে এই সমাজের কোন ভূমিকা থাকবে না। যদি বাংলাদেশ তার জনসংখ্যা ২৫০ মিলিয়ন স্থিতি করতে পারে, একটা সাধারণ হিসাবে ২১০১ সনে হিন্দু জনসংখ্যা ৩.৭৫ মিলিয়নে (৪০ লক্ষের নিচে) নেমে যেতে পারে।
চিন্তকদের মতে হিন্দু জনসংখ্যার এরকম নিম্নমুখী প্রক্রিয়ার কারণ বিবিধ। এর মধ্যে আছে (১) ভারতে ব্যাপক আকারে অভিবাসন, (২) বিভিন্ন কারণে পারিবারিক গঠনের অবক্ষয় এবং (৩) জরীপে হিন্দুদের ইচ্ছাকৃত ভাবে কম দেখানো।
তৃতীয় কারণটিকে নিয়ে আমি আপাততঃ কিছু বলছি না। সরকারি ভাবে যদি আদমশুমারীতে হিন্দুদের কম করে দেখানো হয় তবে এই লেখার সব বিশ্লেষণই বাতিল। আমি আপাততঃ জনগণনার প্রকাশিত সংখ্যাগুলোকে সঠিক বলে ধরে নিচ্ছি।
অনেকে বলেন ভারতে গমন নিতান্তই অর্থনৈতিক একটি পদক্ষেপ, সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি সারা পৃথিবীতেই আছে, তো বাংলাদেশে থাকবে না কেন, এর সঙ্গে ধর্মীয় বৈষম্য টেনে আনা কেন? সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোয় ধর্মীয় ঐক্য যে এক ধরণের দল গঠন করতে পারে সেটা যেন তাঁরা দেখেন না। নরম গরম হুমকি, চাঁদা তোলা, পারিবারিক গঠনের ওপর জুলুম, সম্পত্তি ও জমি দখলে রাখা, আর তারপরে সম্পত্তি ও মন্দিরে আগুন ও লুট, এত কিছুর পরে সেই গোষ্ঠী চলে যাবার কথা তো ভাববেই। ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের কোন ভাগ নেই, বলার জন্য কেউ নেই।
বাংলাদেশের প্রতিটি হিন্দু পরিবার এক ধরণের হুমকির মুখে থাকে। আর এই তিনদিন আগে যশোরে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটল। পরিবারটি ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে গেল। থানা, পুলিশ, কোর্ট সেখানে যেন অসহায়। ওপরে যতই সমন্বয়ের কথা বলা হোক না কেন, কার্যক্ষেত্রে এসে কেউই আসলে সাহায্য করতে পারেন না। অর্পিত সম্পত্তি কেউ কি যথাযথ ভাবে ফেরত পেয়েছেন? কোর্ট ন্যায্য অধিকারীর কাছে সম্পত্তি হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন দখলদারকে কেন যেন ওঠাতে পারেন না।
ভবিষ্যতের এই অবক্ষয় ধারাকে কি সামলানো যাবে? গতি জড়ত্বে যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তার কি আর শেষ আছে? উচ্চ হারে মাদ্রাসা শিক্ষা বোধহয় জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজনকে আরো প্রকট করে তুলছে। বাংলায় ধর্ম সমন্বয়ের একটা syncretist ধারা বজায় ছিল, এর একটা প্রমাণ হল আমাদের বাউল ফকিরদের গানের মধ্যে দিয়ে। এই বাংলার বেশীরভাগ হিন্দু, মুসলমানের পূর্ব পুরুষ একই ছিল। হতে পারে ২০৫১ সনের উন্নত সমাজে যেমন সবার নাগরিক ও সম্পত্তি আধিকার বজায় হবে তেমনই একটা syncretist ধারা সবাইকে এক করবে। তবে ইতিহাসের পরিসংখ্যানের চাকা এই সব ভাল চিন্তার ধার ধারে না। মনে হয় আজ থেকে ৪০ বছর পরে এই ধরনের আলোচনার কোন অর্থ থাকবে না।

No comments:

Post a Comment