Thursday 17 November 2016

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে-১------------------------------ মাসুদ রানা

অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে (১)
মাসুদ রানা
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সম্মেলন
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ১৫ নাগরিক - বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী - উদ্যোগী হয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলন' অনুষ্ঠিত করেছেন আজ ঢাকায়। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বিডিনিউজ টুয়ান্টিফৌর জানাচ্ছে, এই সম্মেলন থেকে বুদ্ধিজীবীরা ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক' দিয়েছেন। ডাক দেয়া হয়েছে দেশবাসীর প্রতি।
ডাক-দেয়া এই পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী হলেনঃ (১) সালাহউদ্দিন আহমেদ, (২) সরদার ফজলুল করিম, (৩) মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, (৪) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, (৫) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, (৬) সৈয়দ শামসুল হক, (৭) বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, (৮) কাইয়ুম চৌধুরী, (৯) হামিদা হোসেন, (১০) আনিসুজ্জামান, (১১) কামাল লোহানী, (১২) রামেন্দু মজুমদার, (১৩) সেলিনা হোসেন, (১৪) সুলতানা কামাল ও (১৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' আর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' বহু-উচ্চারিত দু'টি শব্দবন্ধ। এ-দু'টি শব্দবন্ধের ‘এ্যাফেক্টিভ' বা আবেগিক আবেদন বিশাল হলেও এদের ‘কগনিটিভ' বা বোধিক অবয়ব অস্পষ্ট। ফলে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে না। কারণ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' ও ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' হচ্ছে অনির্দিষ্ট ও বিমূর্ত ধারণা, যা বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে বিকশিত আকাঙ্খাসমূহের নিতান্ত বায়বীয় উপস্থাপন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ সন্ধান
যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী?' তাহলে, এর স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছেঃ ‘যে চেতনা সাম্প্রদায়িক নয়'। স্পষ্টতঃ ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' কোনো স্ব-ব্যাখ্যাত ধারণা নয়। যেহেতু ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থ ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের অর্থের উপর নির্ভরশীল, তাই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ‘সাম্প্রদায়িক চেতনা'র ব্যাখ্যা ছাড়া সম্ভব নয়।
শব্দ হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক' স্বনির্ভর নয়। এটি ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের আগে তৎসম উপসর্গ ‘অ' যোগে গঠিত। এই শব্দের অর্থ এর ভিতরে নিহিত নয়। ফলে, ‘অসাম্প্রদায়িক' শব্দটি বলে না এটি কী; বরং বলে এটি কী নয়।
নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন পঞ্চদশ বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ, বুদ্ধিজীবীরা চাইছেন, শিশুদের চেতনা যেনো ‘সাম্প্রদায়িক' না হয়। উত্তম প্রস্তাব! ‘সাম্প্রদায়িক' নাই-বা হলো। কী হবে তাহলে? এর উত্তর আছে? অন্যত্র না হাতড়িয়ে প্রস্তাবিত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা'র ভিতর কি এর উত্তর আছে?
‘সাম্প্রদায়িক' হিসেবে যে-সকল চেতনা চিহ্নিত করা যায়, তা বাদ দিয়ে যা থাকে, তার সবকিছুকেই ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' রূপে নির্দেশ করা সম্ভব। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। নেতিবাচক সংজ্ঞায়ণের এই হচ্ছে সমস্যা। সে-কারণে, বিজ্ঞানে ইতিবাচক বস্তুনিষ্ঠ সংজ্ঞা ছাড়া অন্য কোনো রকম সংজ্ঞা গ্রহণীয় নয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ‘বাঙালী' বলতে একটি বিশেষ জাতির মানুষ বুঝায়। কিন্তু ‘অবাঙালী' দ্বারা হাজার-হাজার জাতির মানুষ বুঝাতে পারে। সুতরাং, ‘তিনি অবাঙালী' কিংবা ‘ইনি অমুসলিম' বলে কোনো পরিচয় হতে পারে না। একইভাবে ‘আমি অসাম্প্রদায়িক' বললে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নির্দেশ করে না। স্পষ্টতঃ ‘নিগেটিভ কনস্ট্র্যাক্ট' বা নেতিবাচক ধারণা হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' অতি সহজেই নিঃশেষিত হয়ে যায়। সুতরাং, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্ত নয়, একটি অকার্যকর ধারণাও বটে।
‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উৎস সন্ধান
এবার আলোকপাত করা যাক ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দের উপর। ‘সাম্প্রদায়িক' শব্দটি বাংলার রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্সে' বা ভাষ্যে সরাসরি ইংরজি ‘কম্যুনাল' শব্দ থেকে এসেছে, যা শতাধিক বছর আগে খোদ ইংল্যাণ্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্রিটিশ ঔনিবেশিক কালে ভারতে প্রবর্তিত হয়েছিলো।
ইংরেজি ভাষায় ‘কম্যুনাল' শব্দের উৎপত্তি কাল ‘অক্সফৌর্ড ডিকশনারী'তে দেখানো হয়েছে ঊনিশ শতক। ‘কম্যুনাল' শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ‘কমিউন' থেকে। বলা হয়েছে, এই ‘কমিউন' হচ্ছে সেই ‘কমিউন' যা ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্যারি কমিউন' নামে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, প্যারি কমিউন ছিলো ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত বেঁচে থাকা পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, ‘কমিউন' শব্দের মধ্যে সাম্যবাদী উপাদান আছে।
তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ১নং অর্থ হচ্ছে ‘shared by all members of a community; for common use' অর্থাৎ, ‘কমিউনিটির সকল সদস্যের অংশীদারিত্বে, সাধারণ ব্যবহারের জন্য'। সেই কারণেই, ইংল্যাণ্ডে ‘কম্যুনাল' একটি ইতিবাচক ধারণা।
বিশ্বজুড়ে নানা দেশে ‘কম্যুনাল চাইল্ড রীয়ারিং' (শিশুপালন), ‘কম্যুনাল এডুকেশন' (শিক্ষা), ‘কম্যুনাল হাউজিং (আবাসান)' ‘কম্যুনাল লিভিং' (বসবাস), ‘কম্যুনাল কুকিং (রান্না)' ‘কম্যুনাল ঈটিং' (ভোজন) ‘কম্যুনাল স্লীপিং' (নিদ্রা), ‘কম্যুনাল পার্কিং' (গাড়ী রাখা), ‘কম্যুনাল সেইফটি' (নিরাপত্তা), ইত্যাদি ‘প্র্যাক্টিস' বা চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়।
‘কম্যুনাল' শব্দের এতো ইতিবাচক ব্যবহার দেখে হয়তো ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার' বাঙালীরা হতাশ হবেন। কিন্তু তাঁদের নিরাশ হবার কারণ নেই - অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় একটি অর্থ আছে, যেটির ব্যবহার ইংল্যাণ্ডে হয় না বললেই চলে। ‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থটির উদ্ভব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ‘ডিসকৌর্স' বা ভাষ্য থেকে।
অভিন্ন ভারতীয় জাতীয় পরিচয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন ধর্মীয় পরিচয়ে, প্রাদেশিক পরিচয়ে কিংবা ভাষিক পরিচয়ে বিভক্তিমূলক ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন, কর্মসূচি ও তৎপরতার ‘নিগেটিভ ব্র্যাণ্ডিং' বা নেতিবাচক চিহ্নায়ণে ‘কম্যুনাল' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, অক্সফৌর্ড ডিকশনারীতে ‘কম্যুনাল' শব্দের ২ নং অর্থ নির্দেশ করে বলা হয়েছে ‘ (of conflict) between different communities, especially those having different religions or ethnic origins' - অর্থাৎ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্য সংঘাত বিষয়ক - বিশেষ করে যাদের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ও জনজাতিক ভিন্নতা। এই ঐতিহাসিক কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক শব্দ।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, দ্বিতীয় অর্থে ‘কম্যুনাল' বা ‘সাম্প্রদায়িক' হতে হলে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রয়োজন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের বাস অনেক দিনের। কিন্তু ‘কম্যুনাল' শব্দ তখনই রাজনৈতিক ভাষ্যে এসেছে, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে সংখ্যাগুরু হিন্দুর সাথে সংখ্যালঘু মুসলমান ক্ষমতার প্রশ্নে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে।
যেহেতু ‘কম্যুনাল' একটি নেতিবাচক বিশেষণ, তাই কেউই নিজেকে ‘কম্যুনাল' হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। এটি হচ্ছে বিপরীত সম্প্রদায়ের দ্বারা আরোপিত ‘স্টিগমা' বা কালিমা, যা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পারস্পরিক ‘ন্যারেশন' বা বর্ণনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও তাদের আপেক্ষিক শক্তির উপর নির্ভর করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দূর্বলের চেয়ে প্রবলের বর্ণনই বেশি প্রতিষ্ঠা পায়।
সুতরাং, এই কালিমা যেভাবে সংখ্যালঘুর গায়ে সেঁটে বসে, সংখ্যাগুরুর গায়ে ততো নয়। ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী রাজনীতির অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকাতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। আর এ-দুটি ধারার শাব্দিক প্রতীকায়ণ ঘটেছিলো যথাক্রমে ‘বন্দে মাতরম' ও ‘আল্লাহু আকবার' ধ্বনি দ্বারা। তা সত্ত্বেও মুসলিম লীগের গায়ে কালিমা লেগেছে বেশি, কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে তেমন লাগেইনি।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা
‘কম্যুনাল' শব্দের দ্বিতীয় অর্থে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দল নির্দেশ করতে গেলে, সংজ্ঞানুসারে প্রথমেই নির্দেশ করতে হবে কোন্‌ সম্প্রদায়ের সাথে কোন্‌ সম্প্রাদায়ের রাজনৈতিক সংঘাত হচ্ছে। জাতীয় পরিধিতে এদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ ব্রিটিশ ঔপনেবিশিক আমলে। এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ভিত্তি ছিলো ধর্ম।
পাকিস্তান সৃষ্টির কালে এদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হয়েছে, তাতে হিন্দুরা পরাস্ত হয়ে ব্যাপক সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েও তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আর কখনও ১৯৪৭-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা দিন-দিন আরও প্রান্তিক হচ্ছে। সম্প্রদায়গত ভাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রবৃত্ত হবার মতো জনের ও মনের শক্তি এঁদের নেই।
পাকিস্তানী অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক আমলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে প্রধানতঃ বাঙালীর সাথে বিহারীর। এর ভিত্তি ধর্ম নয়, কারণ বিহারী সম্প্রদায়ও ছিলো মুসলমান। বাঙালী-বিহারী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভিত্তি ছিলো তাঁদের জনজাতিক ভিন্নতা। বিহারী সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও এঁদের পেছনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষপাত ছিলো। তাই, বিহারী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে বাঙালী নিধনে ভূমিকা রেখেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিহারী সম্প্রদায় সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই সম্প্রদায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিধন করা হয়েছে, একটি অংশ পাকিস্তানে চলে গিয়েছে, আর অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশ প্রান্তিক হয়ে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হচ্ছে প্রধানতঃ পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্র-সমর্থিত বাঙালীর সাথে পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলোর। এর মধ্যে জনজাতিক ও ধর্মীয়, এই দুটো উপাদনই বর্তমান, যদিও প্রথমটিই প্রধান। তবে এই সংঘাত ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ। জাতীয় পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত নয়। কারণ, পাহাড়ী সম্প্রদায়গুলো জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে বাঙালীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত নয়।
পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঘিরে বাঙালীর সাথে পাহাড়ীদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে, যার স্রষ্টা হচ্ছে রহমানবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাহাড়ীদের নায্য দাবি অগ্রাহ্য করে তাঁদেরকে ‘বাঙালী হয়ে' যেতে বললেন এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে বাঙালী অভিবাসনের সূচনা করলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। পরবর্তী সরকারগুলো সেই নীতিই অনুসরণ করে আসছে, যদিও মাঝখানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার একটি অকার্যকর পার্ব্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলনের যে বিবরণ সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা পাঠের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে এই মুহূর্তের জনজাতিক সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ব্যাপারে বোধ ও বুদ্ধি গড়ে তোলার পরিবর্তে অতীতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্মৃতি রোমন্থন করে একটি বিমূর্ত ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন।
বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' সঞ্চারণের কথা বললেন, এর মধ্য পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী মানুষের উপর চালিত রহমানবাদী সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ‘এথনিক ক্লিনসিং' বা জনজাতিক নিশ্চিহ্নায়ণের বিরুদ্ধে কোনো বোধ কি প্রতিফলিত হয়েছে? পাঠ থেকে বলছিঃ না, হয়নি। সুতরাং বুদ্ধিজীবীদের ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' শুধু বিমূর্তই নয় কপটও বটে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী অসাম্প্রদায়িক?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘অসাম্প্রদায়িক' ছিলো বলে বিষয়টিকে ছোটো করা হয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সম্পর্কে সঠিক বোধ থেকে এ-কথা বলা সম্ভব নয়। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্যে ‘প্রিন্সিপল অফ ইনভেলিডেশন এ্যাণ্ড জাস্টিফিকেশন' - অর্থাৎ বাতিলায়ণ ও ন্যায্যায়ণ নীতির দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া বুঝা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘আণ্ডারপিনিং' বা টিকিয়ে রাখার সমর্থনে ক্রিয়াশীল থাকে একটি আদর্শবাদ। প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় তার পক্ষের আদর্শবাদটির ‘ইনভেলিডেশন' বা বাতিলায়ণ। কিন্তু এই বাতিলায়ণ সম্ভব হয় না, যদি-না একটি বিকল্প প্রস্তাবিত ব্যবস্থার ‘জাস্টিফিকেশন' বা ন্যায্যায়ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা অভিন্ন ভারতীয় জাতি তত্ত্বের বাতিলায়ণের মাধ্যমে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতি তত্ত্ব অভিন্ন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৈধতাকে বাতিল করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা এনে দিয়েছিলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ ছাড়া ভারত বিভাগ সম্ভব ছিলো না।
আমরা পরবর্তীতে দেখি, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পূর্ব-বাংলার প্রয়োজন ছিলো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিকৃত তথাকথিত মুসলিম সাম্যের বৈধতার বাতিলায়ণ। বাঙালীকে তাই পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তিমূলে - অর্থাৎ, ধর্মবাদের উপর -আঘাত করতে হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে। সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিলো কি-না সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমাদের বুঝার জন্য প্রয়োজন যে, পূর্ব-বাংলার মানুষ তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়কে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে বাতিল করে জনজাতিক পরিচয়ের ন্যায্যতাদায়ী যে-আদর্শবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, তা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ। যেহেতু ২৪ বছর আগে ধর্মীয় পক্ষপাতের ভিত্তিতে বাঙালী পাকিস্তান গড়েছিলো, তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার জন্ম ছিলো অনিবার্য। ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ছাড়া পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব ছিলো না।
আজ যাঁরা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ‘অসাম্প্রদায়িক' বলে চিহ্নিত করছেন, তাঁরা বুঝে কিংবা না বুঝে ইতিহাস বিকৃত করছেন। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো বলেই যুদ্ধ-বিজয়ের অব্যবহিত পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূল-নীতির দ্বিতীয়টি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা'।
কিন্তু পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করলাম, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রথম আঘাত হানেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যেখানে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিযুক্তিকরণ বুঝায়, সেখানে তিনি বললেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়'। এই কথা বলে তিনি রাষ্ট্রীয় আচারে-অনুষ্ঠানে ও রেডিও-টেলিভিশনে প্রবর্তন করলেন কুরআন-পাঠ, গীতি-পাঠ, ত্রিপিটক-পাঠ, বাইবেল-পাঠ ইত্যাদির বহু-ধর্মবাদী চর্চা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়ে ও ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির চরম লঙ্ঘন করলেন। কোথায়? সে-ও আবার পাকিস্তানের লাহোরে গিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের এই কর্মটি বাঙালী জাতির জন্য গৌরবের ছিলো না।
শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ১৯৭১ সালের ধর্মবাদী দালালদের ‘সাধারণ ক্ষমা'ই করেননি, তিনি অনুমোদন দেন ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠার, যার মধ্য দিয়েই সদ্য স্বাধীন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ বাংলাদেশে পরাজিত রাজনৈতিক ইসলামবাদীরা নিজেদেরকে সংগঠিত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে।
একনায়ক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর পূর্বসূরী একনায়ক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সৃষ্ট ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আরও এক কদম এগিয়ে গেলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি হত্যা করলেন সংবিধান থেকে শব্দটিকে প্রত্যাহার করে এবং কুরআনের পংক্তি যুক্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তৃতীয় একনায়ক হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এসে রহমানবাদের হাতে আহত ও নিহত ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দিলেন ইসলামকে ‘রাষ্ট্র-ধর্ম' ঘোষণার মাধ্যমে।
এরশাদ-পরবর্তী শাসক খালেদা জিয়া এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সেই উত্তরাধিকারের সংরক্ষা করলেন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'র দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় আসার ও থাকার তাগিদে শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সেখান থেকে কু্রআনের পংক্তি ও ইসলামকে রাষ্ট্র-ধর্ম করার ঘোষণা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করতে পারলেন না। তিনি বরং এখন শারিয়া আইন প্রবর্তনের অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দ নেই। তার বদলে এসেছে ‘অসাম্প্রদায়িক' ধারণা। আওয়ামী লীগের অনুসারী বাম ও অভিসারী বামেরা পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি তেমন আর ব্যবহার করছেন না। তাঁরা বলছেন ‘অসাম্প্রদায়িকতা'র কথা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা' গড়ে তোলার কথা বলছেন, তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূর্ত-নির্দিষ্ট রূপে ধারণ করেন না। তাহলে কেনো তারা এই চেতনার কথা বলছেন, তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পরবর্তী পর্বে দেখানো হবে।
রোববার, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com
 

No comments:

Post a Comment