Thursday 10 November 2016

অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা--------------- দেবব্রত চক্রবর্তী

অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা
নরেন্দ্র মোদী ৯ই নভেম্বর মধ্যরাত্তি থেকে প্রকৃত অর্থে নামিয়ে এনেছেন অঘোষিত "অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা "। এক কলমের খোঁচায় ১৫লক্ষ কোটি টাকা ক্যাশ, সিস্টেম থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে । হটাৎ কি এমন ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হোল যে এই ধরনের অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজন পড়ল ? ১৫ লক্ষ কোটি টাকা ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে মুছে দেওয়ার মাত্র চার ঘণ্টা পুর্বে জাতির প্রতি ভাষণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন …।
করাপশন ,ব্ল্যাক মানি ,সন্ত্রাসবাদ এবং জাল নোট আমাদের উন্নতির রাস্তায় বড় বাধা এবং এই বাধা দূর করে উন্নতির রাস্তায় এগিয়ে চলতে অদ্য মধ্যরাত্রি হইতে “ five hundred rupee and thousand rupee currency notes presently in use will no longer be legal tender”
সুতরাং সরকারীভাষ্য এবং যুক্তি অনুসার ৫০০-১০০০ এর নোট বেআইনি করে দেওয়ার কারন দুর্নীতি বন্ধ করা , কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই , সন্ত্রাসবাদের অর্থের স্রোত বন্ধ করে দেওয়া এবং জাল নোটের কারবারিদের অসহায় করে দেওয়ার মত প্রগতিশীল এবং মহৎ উদ্দেশ্য। অতি উত্তম । কিন্তু তাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে আবার নূতন করে ৫০০/- এবং ২০০০/-টাকার নোট ছাপা কেন ? উল্টে তো সন্ত্রাসবাদী ,ঘুষখোর এবং কালো টাকার কারবারিদের সুবিধা , ২০০০ টাকার বান্ডিল ১০০০ টাকার তুলনায় হ্যান্ডেল করা সহজ । তাহলে মধ্যরাত্তিরের এই নাটক কেন ?
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন আগতপ্রায় , মোদী নির্বাচনে জিতেছিলেন বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফিরিয়ে আনবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে , এমনকি প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমাও পড়ে যাবে এইরকম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন । এদিকে ওনার ক্ষমতায় আসার ২-১/২ বছর অতিক্রান্ত ,কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক টাকাও আসেনি । মোদীকে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচক মণ্ডলীর কাছে দেখাতেই হোত যে দেখুন কালো টাকা’র সমস্যা মোকাবিলা করবার জন্য সত্যই আমি কিছু করছি । যদিও দেশের ৫০০-১০০০ এর নোট বাতিল করে উনি সুইস ব্যাংকের কালো টাকা কিভাবে ফেরত আনবেন সেই প্রশ্নর উত্তর নেই । বৃহৎ কালো অর্থের কারবারিরা কেউই বালিশের খোলের মধ্যে ৫০০-১০০০ এর নোট পুরে পাহারা দেননা তাঁদের সমস্ত অর্থ বিদেশে এবং বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেন দেশগুলিতে জমা থাকে এবং সেইখান থেকে ভারতে এসে আবার কালো অর্থ হিসাবে বিদেশে পালায় - কালো টাকা বালিশের তলায় অলস বশে থাকেনা ,থাকে মার্কেটে , বিদেশে । মোদী কাকে উল্লু বানাচ্ছেন ? ভারতের সেই সমস্ত জনতাকে যারা মাত্র ৩২/- দিন গুজরান করে ।
এইবার আসা যাক দুর্নীতির প্রশ্নে । ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে “twenty-nine state-owned banks wrote off a total of Rs 1.14 lakh crore of bad debts between financial years 2013 and 2015, much more than they had done in the preceding nine years.”অর্থাৎ বিগত ৯ বছরে দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেস সরকার যা করতে পারেনি মোদী একাই মাত্র দু বছরের মধ্যে তা করে ফেলেছেন । 1.14লাখ কোটি টাকা অনাদায়ী হিসাবে ঘোষণা , কারা এই মহামান্য প্রভু সকল যাহারা গরীব মানুষের সঞ্চিত অর্থ মেরে দিয়েও পার পেয়ে যান? রিসার্ভ ব্যাংক তাঁদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছে । এটা যদি দুর্নীতি না হয় তাহলে কোনটা দুর্নীতি ?
যে সমস্ত কালো টাকা সোনা ,জমি ,রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ হয়ে গেছে তার কি হবে ? গতকাল রাত্তির বারোটা পর্যন্ত সমস্ত সোনার দোকান খোলা ছিল , সেই সমস্ত ক্রেতা’র কি হবে ? সুতরাং কালো টাকা , দুর্নীতিদমন ,সন্ত্রাসবাদ সমস্ত যুক্তি falls flat on its face. তাহলে এই হটকারি স্বিধান্তের আসল কারন কি ?
মোদী বলছেন “…..The five hundred and thousand rupee notes hoarded by anti-national and anti-social elements will become just worthless pieces of paper.” ভারতের যে সমস্ত নাগরিক ৫০০-১০০০ টাকার নোট পকেটে রেখেছেন সবাই অ্যান্টি সোশ্যাল এবং অ্যান্টি ন্যাশনাল!!! মোদী পুনরায় বলছেন “ ….in this movement for purifying our country, will our people not put up with difficulties for some days? I have full confidence that every citizen will stand up and participate in this ‘mahayagna’.” রাষ্ট্রের পিউরিফিকেশন ? বিশুদ্ধিকরণ ? মনে আছে আজ থেকে ৬০-৭০ বছর পুর্বে ইউরোপে আমরা একই রেটরিক শুনেছি ,ফাইনাল সলিউসন ?
সুতরাং গল্পটা ঠিক কি ?
ভারতের পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলির মার্কেট ক্যাপিটালাইজেসন জানুয়ারি ২০১৫ তে ছিল 4.5লাখ কোটি টাকা আর সেই মার্কেট ক্যাপিটালাইজেসন ২০১৬’র জানুয়ারিতে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে 2.7 লাখ কোটি টাকা ।
ভারতের পাবলিক সেক্টর ব্যাংক গুলি ৭ লাখ কোটি টাকার নন পার্ফমিং অ্যাসেট ,রিস্ট্রাকচার্ড লোন এবং সন্দেহ জনক সম্পদের পাহাড়ের ওপর বসে আছে ।
হিন্দু বিজনেস লাইন জানাচ্ছে গত কয়েক বছরে পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলির অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রম অবনতি ইনভেস্টর এবং বিদেশী পুঁজির কনফিডেন্স কমিয়ে দিচ্ছে ।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে রিসার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে 2.1 লক্ষ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যাতে পাবলিক সেক্টর ব্যাংক গুলির হাতে ঋণ দেওয়ার মত অর্থ থাকে ( neutral liquidity zone )
এখন ব্যাংক যদি লিকিউডিটীর অভাবে ঋণ দিতে না পারে, তাহলে টাকার বৃদ্ধি হবেনা , যেহেতু লিকিউডিটির অভাবে ব্যাংক ঋণ দেওয়ার হার ঢিমেগতি করতে বাধ্য হচ্ছে সেহেতু যথেষ্ট পরিমান অর্থ ব্যাংকের হাতে থাকছেনা এবং টাকা বৃদ্ধির এই গ্যাপ লিকিউডিটি’র অভাব সৃষ্টি করছে আর এই অভাব মেটাতেই রিসার্ভ ব্যাংক বাধ্য হয়ে সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে 2.1 লক্ষ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যাতে লিকিউডিটি’র অভাব পূরণ করা সম্ভব হয় ।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর আরেকটি রিপোর্ট অনুযায়ী ,দুর্বল মানি মাল্টিপ্লায়ার এর প্রশ্ন ছাড়াও ,মানুষের হাতে টাকার সার্কুলেশন হঠাৎ বেড়ে গেছে , লম্বা ছুটির এবং উৎসবের মরশুমে মানুষ হাতে বেশী টাকা রাখছে অর্থাৎ ব্যাংক থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে পুনরায় লিকিউডিটি’র অভাব । ক্রেডিট সুইসে’র হিসাব অনুযায়ী গত বারো মাসে currency in circulation increased by Rs 2.6 lakh crore ।
এই সমস্ত রিপোর্টের সারাংশ - ভারতীয় ব্যাংক রক্তের অভাব - লিকিউডিটি ক্রাইসিসে ভুগছে । অথচ মোদী শাসনক্ষমতায় আসবার পর থেকে বিভিন্ন নৈতিক /অনৈতিক উপায়ে অর্থনিতিতে গতি ফেরানোর চেষ্টা করছেন ,ইন্ডিয়া কে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব বানানোর স্বপ্ন ফেরী করছেন অথচ চাকরীর বাজারে মন্দ্যা ,ম্যানুফ্যাকচারিং আউটপুট বৃদ্ধি পাওয়া দূরের কথা উল্টে নিন্মগামী। আর বি আই অসহায় , লিকিউডিটি বাড়াতে গেলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে । সুতরাং শেষ এবং মরীয়া অস্ত্র ‘শালা সব টাকা ,যা কিছু সার্কুলেশনে আছে ফেরত নিয়ে এসো ব্যাংকে ‘ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা ব্যাংককে মানুষের রক্ত যোগাও এই সমস্ত বাতেলা বাজির অবশেষে ব্যাংকের লিকিউডিটি তো বাড়বে ।
ভারতের বাজারে ১৭ লক্ষ কোটি টাকা ফিজিক্যাল সার্কুলেশনে আছে ,তার ৮৮% ৫০০- ১০০০ /- এর নোট , রিসার্ভ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী “ there are 16.5 billion ‘500-rupee’ notes and 6.7 billion ‘1000-rupee’ notes in circulation right now. “ আনুমানিক ১৫ লক্ষ কোটি টাকা সিস্টেম থেকে ছেঁচে তুলে নাও , এই ১৫ লক্ষ কোটি টাকা বাধ্যতামূলক ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে প্রবেশ করবে এবং তার পরে দৈনিক মাত্র ২০০০ টাকা-৪০০০ টাকা আপনি এ টি এমের মাধ্যমে তুলতে পারবেন এবং সপ্তাহে মাত্র ২০০০০/- । আপনার টাকা বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ,আজকের ব্যাংঙ্কিং এর ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ব্যবহার করতে দিয়ে কৃত্তিম উপায়ে লিকুউডিটি বাড়ানো হবে । লাভবান হবে কে ? নিশ্চয় সেই সমস্ত হতদরিদ্র চাষা ,বা ক্ষুদ্রশিল্পের মালিক নয় যারা অর্থের অভাবে আত্মহত্যা করতে বা ফ্যাক্টারি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন । লাভবান হবেন সেই সমস্ত ক্রোনি পুঁজিপতি যারা মোদীর আমলে ফুলে ফেঁপে উঠছেন আর আমরা মুর্খের দল - কালো টাকা উদ্ধারের বিপুল বাতেলায় পেটে গামছা বেঁধে উদবাহু নৃত্য করব।
“ This demonetization is the biggest crony capitalist neo-liberalist coup that has ever taken place in India. Never doubt it, India will have to pay a heavy price for it.”
প্রায় ৮০% ভারত বাসীর কি হবে ? এনাদের তো ব্যাংক একাউন্টই নেই ? সামান্য কয়েকটা ৫০০-১০০০ এর নোট পরিবর্তনের জন্য তাঁদের কি ধরনের কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ? আর যদি ব্যাংক একাউন্ট থাকেও তাঁদের বাধ্যতামূলক নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্কিং এর মাধ্যমে যে লিকিউডিটি বৃদ্ধি তার ফল লাভ করবে কতিপয় ক্রোনি পুঁজিবাদী শক্তি আর আগামী বছর ব্যাংকের ব্যাড ডেটস ২লক্ষ কোটি টাকা ছাড়াবে । গরীব এবং মধ্যবিত্ত ভারতবাসী কি নীরব দর্শকের মত চেয়ে চেয়ে দেখবে যে তাঁদের সম্পদ “ being sucked up by the banks and eventually the crony capitalists? “
বিদ্রোহ করুন অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা প্রতিরোধ করুন । আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবাদ করেছেন সমর্থন করুন ।
(সাথে পড়তে থাকুন -প্রভাত পট্টনায়েক এর লেখা )

No comments:

Post a Comment