Thursday 17 November 2016

আত্মপরিচয়ের দুই শিবিরঃ বাঙালির রাজনৈতিক মেরুকরণ ______________ মাসুদ রানা

আত্মপরিচয়ের দুই শিবিরঃ বাঙালীর রাজনৈতিক মেরুকরণ
মাসুদ রানা
বাঙালীর আত্মপরিচয় সঙ্কটযেখানেই বাঙালীর রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন বা চর্চার প্রশ্ন আসে, সেখানেই দু’টি আত্মপরিচয় পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব প্রবৃত্ত হয়ে সঙ্কট সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে। এদের একটি হচ্ছে তার ধর্মীয় আত্মপরিচয়, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি। আর, অন্যটি তার জাতিসত্তাগত আত্মপরিচয়, অর্থাৎ বাঙালী। এটি শুধু যে বাংলাদেশের ক্ষেত্র সত্য, তা নয়। এটি ব্রিটেইনের বাঙালীর ক্ষেত্রেও সত্য।
সমাজমনোবিজ্ঞানে এটি একটি আইডেণ্টিটি ক্রাইসিস বা আত্মপরিচয় সঙ্কট। আমি আমার এ্যাকাডেমিক গবেষণায় এর তত্ত্বায়ন করেছি ‘এ্যাম্বিভ্যালেণ্ট আইডেণ্টিটি’ বা ‘দোদুল্যমান আত্মপরিচয়’ নামে। আমি দেখিয়েছি, এর উদ্ভব হয়েছে ধর্মীয় ক্যাটেগোরাইজেশন ও এথনিক ক্যাটেগোরাইজেশনের মিশ্রণ বা ক্রস-ক্যাটেগোরাইজেশনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত বিরোধ থেকে।
দ্বন্দ্বে লিপ্ত ও দোদুল্যমান দুই আত্মপরিচয় গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে (১) দু’টি ঐতিহাসিক বঞ্চনাবোধ, (২) দু’টি ঐতিহাসিক আন্দোলন ও (৩) দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এই তিনটির (৪) ‘ভিভিড মেমোরি’ বা ‘বিশাল স্মৃতি’, যা 'সৌশ্যাল রিপ্রেজেণ্টেশন' বা সামাজিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে বাঙালীর সামাজিক সংবোধ পরস্পর বিরোধী দু’টি আত্মপরিচয় গঠন ও আবেগ সঞ্চারের মাধ্যমে তীব্র প্রেষণা তৈরি করে দু'টি ক্যাম্পে বা শিবিরে মেরুকৃত করে চলছে। আমি এক্ষণে দুই ক্যাম্প বা শিবিরকে ১৯৪৭-শিবির ও ১৯৭১-শিবির বলে চিহ্নিত করছি।
বাঙালী একটি জাতি হিসেবে বাংলাদেশে বাস করে যে সঙ্কটে নিপতিত হয়, একই বাঙালী ব্রিটেইনে একটি সম্প্রদায় হিসেবে বাস করেও একই সঙ্কটের সম্মুখিন হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসকে বাঙালীর রাজধানী বলা হয় তার জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতাজাত রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে। আমার তত্ত্বানুসারে, এখানেও বাঙালীর মধ্যে আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বপ্রসূত সঙ্কট রয়েছে। আর, এর এর ফলে এখানেও বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একাত্তর-শিবির বনাম সাতচল্লিশ-শিবিরে বিভক্তি রয়েছে।
এখানে সাতচল্লিশ-শিবির সংগঠিত রয়েছে সদ্য মেয়র-পদচ্যুত ও লেবার দলের বহিষ্কৃত নেতা লুতফুর রহমানকে ঘিরে। এই শিবিরের বিপরীতে একাত্তর-শিবির জড়ো হচ্ছে লেবার দলের এমপি রুশনারা আলিকে ঘিরে।
আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিকতা
ব্রিটিশ ভারতে বাঙালী মুসলমানের মধ্যে বঞ্চনাবোধ ছিলো বাঙালী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। কারণ, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ বাঙালী মুসলমানকে অস্পৃশ্য ‘যবন’ মনে করে বাঙালীত্বের পরিচয় থেকেও বঞ্চিত করে রেখেছিলো, যা তৎকালীন সাহিত্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।
হিন্দু সন্ত বিকেনান্দ স্পষ্ট বলেছেন, বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেছেনে আছে হিন্দু বর্ণবাদ। শতোশতো বছর ধরে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে হিন্দু বর্ণাশ্রমের অধীনে নিম্নবর্ণভূক্ত রেখে নিপীড়ন করার কারণে বাইরে থেকে আসা মুসলিম বিজয়ীদের দেওয়া ইসলামিক সাম্যের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা লাখে লাখে মুসলমান হয়েছিলেন। 
বস্তুতঃ হিন্দুত্ব ছেড়ে মুসলমান হলেও বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ বাস্তবে সেই মর্য্যাদা পাননি। তাই রূপান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে আদি হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ কাজ করে। কারণ, হিন্দুত্ব ছেড়ে গেলেও বর্ণহিন্দুর কাছে রূপান্তরিত মুসলিম অস্পৃশ্যই রয়ে গিয়েছিলো বা আছে।
সামন্ত স্থবির সমাজে মুষ্ঠিমেয় সম্পদশালী ও ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠের বিক্ষোভ নানা সময়ে নানাভাবে স্বল্পমাত্রায় প্রকাশিত হলেও, পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে-সাথে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রবর্তন ও বিকাশ হতে শুরু করলে, সেই নিম্নবর্গের শক্তি ও ক্ষোভের প্রকাশ পেতে শুরু করে। বাংলায় ব্রিটিশ শাসকদের প্রস্তাবিত ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সেই সুযোগের সূচনা করে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কোলকাতায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম তরঙ্গ হিন্দুত্বাবাদী ‘বন্দে মাতরম’ নিয়ে শুরু হলে, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠন করে মুসলমানত্ববাদী ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে প্রতিক্রিয়ার সূচনা হয়।
দীর্ঘ চার দশক ধরে বাঙালীর মধ্যে হিন্দু-পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী জাতীয়তাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলন ও মেরুকরণের ফলে ১৯৪৭ সালে বাঙালী জাতি ও বাংলার স্থল-জল-অন্তরীক্ষ বিভক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয় বিভক্ত বাংলা ও বিভক্ত বাঙালী জাতির পূর্বখণ্ড এবং পশ্চিম খণ্ড থাকে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হয়ে।
বিভক্তির প্রায় সাথে-সাথেই উভয় খণ্ডে শুরু হয় নতুন বঞ্চনাবোধ - এবং পূর্বখণ্ডে দ্রুত কিন্তু পশ্চিম খণ্ডে ধীরে (১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এবং পরে উত্তরাপথ তথা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে)। পূর্ববাংলায় বঞ্চনাবোধের সূচনা হলো বাংলাভাষা নিয়ে ১৯৪৮ সালে। সে-বছর পাকিস্তানের পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বললেন “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। আর এর প্রতিবাদে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপরই ‘না, না’ বলে প্রতিবাদের মুখর হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ।
পূর্ববাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালীর বঞ্চনাবোধ শতোরূপে প্রকাশ পেতে পেতে চূড়ান্ত পর্যায়ে এলো তখন, যখন বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র পাকিস্তানের সাধারণ ও সাংবিধানিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা থেকে তাঁকে - তথা বাঙালীকে - বঞ্চিত করে গণহত্যা শুরু করলো ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে। এই পর্যায়ে বাঙালী মুসলমান উপলদ্ধি করলো, মুসলমানত্ব তার মৌলিক পরিচয় নয়। তার মৌলিক পরিচয় বাঙালীত্ব। আর এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই সে যুদ্ধ করে স্বাধীন করলো মাতৃভূমি এবং হয়ে উঠলো একটি স্বীকৃত জাতি।
কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিকশিত বাঙালী জাতিয়তাবদের  ঐতিহাসিক দ্বিতীয় তরঙ্গ বাঙালী জাতিকে মুসলিম পাকিস্তান থেকে বিযুক্ত করলেও পাকিস্তান-পূর্ব অখণ্ড বাংলা ও বাঙালীত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে পারলো না। ফলে, পূর্বখণ্ডের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশ’ রূপতঃ ইতিহাস ও ভূগোলের আয়নায় যখন পশ্চিমখণ্ডের ‘বাঙালী’ ও ‘বাংলাদেশ’ দেখে, তখন আত্মপরিচয়ের আত্মজিজ্ঞাসা তৈরি হতে বাধ্য।
১৯৭১ সালের বাঙালী জাতীয়তবাদী আন্দোলনে যেহেতু এই প্রশ্নের উত্তর ছিলো না, কিংবা থাকলেও স্পষ্ট ছিলো না, তাই বাংলার ও বাঙালী জাতির খণ্ডতার জাষ্টিফিকেশনের জন্যে যুদ্ধে পরাজিত দ্বিজাতি তত্ত্বের নীরব পুনরুত্থান ঘটলো। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে পূর্বখণ্ডের বাঙালীর মুসলিম পরিচয়কে আন্তর্জাতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। পরিবর্তীতে জিয়াউর রহমান জাতির আত্মপরিচয়ের সঙ্কট মোচনের চেষ্টায় ‘বাঙালী’র বদলে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদের সূচনা করেন।
কিন্তু দুই রহমানের প্রচেষ্টা বাঙালী জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে যায় বলে, সঙ্কট কাটেনি। তাই একাত্তরের সীমাবদ্ধতা কাটাতে সাতচল্লিশ, আর সাতচল্লিশের সীমাবদ্ধতা কাটাতে একাত্তরে শরণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের দোদুল্যতা অব্যাহত রয়েছে।
নির্বাচনে বাঙালী আত্মপরিচয়
ব্রিটেইন যখন পার্লামেণ্টারি নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে, তখন টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালী আত্মপরিচিতি ক্রিয়া করতে শুরু করেছে রুশনারা আলির সমর্থনে। কিন্তু এর মধ্যে বাঙালী বংশোদ্ভূত লুতফুর রহমানকে ইসলামবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে কারচুপি এবং ধর্ম ও বর্ণের খেলা খেলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার অভিযোগের পক্ষে রায় দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তাঁকে আগামী পাঁচ বছরের জন্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এষ্টাব্লিশমেণ্টের এই রায়ের পেছনে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে লুতফুর রহমানের দুই দু'বার বিজয়। লেবার পার্টির অভ্যন্তরীণ নিয়মে লুতফুর রহমান মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পরও তাঁর ইসলামবাদী-সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে তাঁর প্রার্থিতা তুলে নিলে, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গণরায়ে বিজয়ী হন। দ্বিতীয়বারও তিনি বিজয়ী হন ‘টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্ষ্ট’ নামে সংগঠন গঠন করে ব্রিটেইনের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসমূহের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ বাঙালী সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে।
লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ এষ্টাবলিশমেণ্টের আঘাত ব্রিটেইনের বাঙালীর মধ্যে দ্বিধার তৈরি করেছে। সাতচল্লিশ-শিবির এটিকে মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসবে প্রচার করছে। আর, সে-কারণে একাত্তর শিবির স্বস্তিবোধ করছে।
একাত্তর শিবির রুশনারা আলিকে ঘিরেই তাঁদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়ন চায়। রুশনারা আলিও বাঙালীত্বের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। তিনি গতবারের নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে অধিক মাত্রায় বাঙালী।
রুশনারা আলি তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই ইসলামিক আইডেণ্টিক নিতে পারবেন না, যা লুৎফুর রহমান নিয়েছিলেন। কিন্তু লুতফুর রহমান যেহেতু বাঙালী আইডেণ্টিটিও ব্যবহার করেছিলেন, তাই লুতফুর রহমানকে রুশনারা আলির বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করার অনুরোধে রুশনারা আলির বাঙালী আইডেণ্টিটি কাজ করেছে। বাঙালী হয়ে বাঙালী এমপির প্রার্থিতার বিরোধিতা করলে লুৎফুর রহমানের বাঙালী আইডেণ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
কিন্তু ব্রিটিশ এষ্টাব্ললিশমেণ্টের হাতে লুতফুর রহমান ‘ভিক্টিম’ হয়েছেন বলে প্রত্যক্ষিত হওয়ার কারণে, সাধারণভাবে বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তা রুশনারা আলির বিরুদ্ধে যেতে পারে ধারণা করে একাত্তর-শিবির। তাই, একাত্তর-শিবিরের পক্ষ থেকে লুতফুর রহামানকে সাতচল্লিশ-শিবিরের লোক হিসেবে দেখানো চেষ্টা চলছে। সহজ বাংলায় তাঁকে ‘রাজাকার’ও বলা হচ্ছে।
বাঙালী আত্মপরিচয়ের প্রায়োগিক প্রশ্ন
মে মাসের নির্বাচনকে সামনে রেখে এই যে বাঙালী আইডেণ্টির আবেদন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বাস্তব তাৎপর্য কী, তা নিয়েই কেউ প্রশ্ন করছেন না। একজন প্রার্থী বাঙালী বলেই বাঙালী সম্প্রদায়কে সম্প্রদায়গতভাবে ভৌট দিতে হবে, এমন আবেদন যৌক্তিক নয়। যাঁরা এই আবেদন নিয়ে ভৌটারদের কাছে যান, তাঁদের এই যাওয়াও নৈতিক নয়।
আমি মনে করি, ব্রিটেইনের বহুসাংস্কৃতিক সমাজে প্রতিটি এথনিক বা জনজাতিক গোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিকাশের অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির চাওয়া শুধু ন্যায্য নয়, আবশ্যকও বটে। ডাইভার্সিটি বা বিভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়ে ও বিকাশ ঘটিয়ে সমন্বিত হওয়াই সভ্যতা ও মানবিকতা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, টাওয়ার হ্যামলেটসে বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঈর্ষণীয় হলেও বাঙালীর ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সমাজের মূলস্রোত ধারায় স্থান করে নেওয়ার প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না।
লুতফুর রহমান থেকে শুরু করে রুশনারা আলি সকলেই বাঙালী আইডেণ্টিটি 'কার্ড' ব্যবহার করলেও বাস্তবে তাঁরা তেমন কোনো কাজই করেননি। কারণ, বাঙালী সম্প্রদায়ের লোকেরা নির্বাচনের প্রার্থীদের বাঙালী চেহারা দেখেই তৃপ্ত। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক নেতৃত্বে বাঙালী নাম দেখেই তাঁরা সন্তুষ্ট। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রশাসনে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিফলন ঘটছে কিনা, না ঘটলে কীভাবে তা আইনসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে ঘটানো যায়, সেদিকে তাদের কোনো আগ্রহ কিংবা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।
২০১৭ সাল থেকে স্কুল-কলেইজে এ্যা-লেভেলের কারিক্যুলাম থেকে বাংলাভাষা প্রত্যাহার করা হবে বলে ফেব্রুয়ারীতে ঘোষণা এসেছে। বাংলার শিক্ষকগণ এনিয়ে তাঁদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে হলেও বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু বাঙালী রাজনীতিকদের কাছ থেকে কোন বজ্রকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না বাংলা পক্ষে।
এটি বলা অন্যায্য হবে না যে, প্রাক্তন মেয়র লুতফর রহমান ও তাঁর অনুসারীগণ যতোটুকু না বাঙালী, তার চেয়েও অধিক মুসলমান। তাঁদের সাতচল্লিশ-শিবিরভূক্তির কারণে, বাংলার প্রতি তাঁদের আগ্রহ কম। এটি স্পষ্ট।
কয়েক বছর আগে যখন ব্রিটেইনের নতুন ভাষানীতি প্রকাশিত হলো এবং প্রাইমারী পর্যায়ে একটি ইংরেজির অতিরিক্তি একটি দ্বিতীয় ভাষা শেখা আইন করা হলো, তখন কিছু শিক্ষক ও সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে সেমিনার করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন নিবেদন ও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন (সেই সেমিনার পেপারটি আমি পরবর্তীতে প্রকাশ করবো)।
কিন্তু আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোনো শিবিরই এতে ন্যুনতম আন্তরিকতা দেখাননি। একদল মনে করেন বাংলার চেয়ে ইউরোপীয় ভাষা শেখা উত্তম। আরেক দল বাংলার চেয়ে আরবি ভাষা শেখা কর্তব্য বলে মনে করেন। এদের উভয়ের কাছে বাংলা একটি অপাংক্তেয় ভাষা।
কিন্তু নির্বাচন এলে উভয় দলই বাঙালী আত্মপরিচয়ে বাঙালী সম্প্রদায়ের কাছে ভৌট চাইতে যান। বাংলা গণমাধ্যমগুলোও তারস্বরে ‘তিনি আমাদের বাঙালী’ বলে উচ্ছাস প্রকাশ করে। নির্বাচন শেষে বাংলাভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতি যে তিমির থাকে, সে তিমিরেই হারিয়ে যায় - অনেকটা একুশে ফেব্রুয়ারীতে তিন সপ্তাহ ব্যাপী রূপতঃ প্রাদুর্ভাবিত বাংলাপ্রীতি রোগের মতো।
আমি মনে করি, প্রার্থী বাঙালী কি না, তা ততো গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাঙালী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন। বাঙালী ভৌটারদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে অন্ততঃ ৫টি প্রশ্নঃ
(১) বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে আপনি কী করেছেন?
(২) বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যে কী কর্মসূচি আছে আপনার?
(৩) প্রাইমারী স্কুলের শিশুরা যেনো বাংলা শিখতে পারে তা নিশ্চিত করতে আপনি কী করবেন?
(৪) ২০১৭ সালে যে এ্যা-লেভেল থেকে বাংলা তুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে, তার রোখার জন্য আপনি কী করবেন?
(৫) বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য নিয়ে চর্চা ও গবেষণার জন্যে একটি এ্যাকাডেমি বা ইনষ্টিটিউশন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কিনা, করলে এই প্রয়োজন মেটাতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
উপরের প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক জবাব ছাড়া কোনো প্রার্থীকেই শুধু বাঙালী হওয়ার কারণে ভৌট দেওয়া হবে জাতিসত্তায় জাগ্রত বাঙালীর জন্যে অর্থহীন। আমি মনে করি, উপরের প্রশ্নমালার ইতিবাচক উত্তর নিয়ে যদি কোনো অবাঙালীও নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আসেন, সকল বাঙালীর উচিত হবে সেই অবাঙালীকেই ভৌট দেওয়া। যে-রাজনীতিক চর্মে বাঙালী কর্মে নন, রাজনৈতিকভাবে তিনি বাঙালী নন।

শনিবার ২৫ এ্যাপ্রিল ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড

No comments:

Post a Comment