Tuesday 16 August 2016

ফরিদ কবিরের কলাম

আমার পরে যারা লেখালেখি করতে এসেছেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমি মিশেছি। তারা জানেন, আমি কমবেশি তাদেরকে উৎসাহিতই করি। যারা মেধাবী ও সম্ভাবনাময়, তাদের কবিতা আমি আগ্রহ নিয়েই পড়ি। কাউকে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে তা জানাইও! যাদের কবিতা ভালো লাগে তাদের বেশির ভাগই আমার দলের বা মতের লোক নন।
কারো কারোর সঙ্গে তো আমার আজও অব্দি দেখাও হয়নি! যাদের কবিতা আমার পছন্দ, তারা আমাকে কিংবা আমার কবিতা পছন্দ করেন কিনা- তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নাই।
নতুন যারা লিখছেন তাদের মধ্যে হিজল জোবায়ের-এর সঙ্গে এক-দুবার দেখা হলেও আল ইমরান সিদ্দিকী বা ইমতিয়াজ মাহমুদের সঙ্গে তো আমার কখনো দেখাই হয়নি! হলেও আজ মনে করতে পারছি না। তাদের কবিতা পড়ে তাদের সম্ভাবনাটা যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি কবিতা বিষয়ে তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতিটাও বুঝতে পারা যায়।
তবে, এমন না যে সব কবি তার প্রথম জীবনের লেখাতেই সেই সম্ভাবনার চিহ্ন রাখতে পারেন। জীবনানন্দের কবিতায়ও প্রথম দিকে নজরুলের প্রভাব দেখা যায়! সিকদার আমিনুল হক তো 'সতত ডানার মানুষ বা' 'কাফকার জামা'-র কবিতাগুলি লেখার আগে শামসুর রাহমানকেই অনুসরণ করে আসছিলেন!
প্রসঙ্গক্রমে বলি, সিকদার ভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। তাঁর বাড়িতেও আমি যেতাম প্রায়ই।কিন্তু আশির দশকে অামার সম্পাদনায় বেশ কয়েকটি সংকলন বেরোলেও তার কোনোটিতেই তাঁর কবিতা আমি নেইনি! এতে হয়তো তিনি দুঃখ পেয়েছেন, কিন্তু আমার প্রতি বিরুপ হননি! আমাদের সম্পর্কে তার কোনো ছাপই কখনো পড়েনি! অবশ্য এর সব কৃতিত্বই তাঁর! যদিও অামার সংকলনে কবিতা না নেয়ায় তখন অনেকের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো! অনেকে আমাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালও করেছেন!
যাই হোক, কে যে কখন, জীবনের কোন সময়ে এসে নিজের কবিতাটা লিখতে শুরু করবেন তা বলা মুশকিলই। তবে, ততোদিন তাকে ধৈর্য তো রাখতেই হবে!
কবি হয়ে ওঠার কোনো শর্টকাট রাস্তা নাই। অনেক কবি সমকালে জনপ্রিয় হলেও পাঠক পরে তার দিকে ফিরেও তাকায়নি! জনপ্রিয়তা তো কবিতার মাপকাঠি না!
তবে কবিতার মাপকাঠি কোনটা? কবিতার ক্ষেত্রে এটা এক রহস্য বটে! বিশাল প্রশ্নও, যার কোনো জবাব নাই।
তবে, এটুকু বুঝি, কবি তিন প্রকারের।
এক প্রকার, যারা মনের ভাব প্রকাশের জন্যই লেখেন। পাঠক পড়লে তিনি খুশি হন। না পড়লে মন খারাপ করেন না। প্রায় প্রতিদিন তাদের ভাব আসে, তারা তা নিয়েই কবিতা লিখে ফেলেন। বছর বছর বইও বের করেন! কবিতা বিষয়ে কোনো প্রস্তুতি, ভাষা-প্রকরণ নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নাই। ফেসবুকে এদের সংখ্যাই বেশি।
দ্বিতীয় শ্রেণির কবিরা জনপ্রিয় হবার জন্যই লেখেন। তিনি এক সময় বুঝে ফেলেন পাঠক কোনটা খাবে! তিনি সেরকম কবিতাই সরবরাহ করতে ভালবাসেন। তারাও প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে কবিতা লেখেন। সমালোচকরা তাকে কবি স্বীকৃতি না দিলে বিরক্তও হন! কারণ জনপ্রিয়তার কারণে তিনি নিজেকে সেরা ভাবতে শুরু করেন! তারা আসলে পাঠকদের কবি। যদিও কবির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার কবিতাগুলিও মরে যায়!
তৃতীয় শ্রেণির কবিরা সংখ্যায় কম। তারা কবিতার খোল-নলচে পাল্টে দিতে আসেন! কবিতা বিষয়ে তারা আসেন যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই। তারা লেখেন নতুন ধরনের কবিতা, নিজস্ব কবিতা। তারা সমালোচনার ধার ধারেন না! জনপ্রিয় হচ্ছে কিনা তা নিয়েও মাথা ঘামান না!
জীবনানন্দ সম্ভবত তাদের সম্পর্কেই তাঁর এক গদ্যে বলেছেন, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি'।
এই তিন শ্রেণির কবিই আসলে জানেন, তিনি কোন শ্রেণির। ইদানিং চতুর্থ শ্রেণির কিছু কবির দেখাও পাচ্ছি। তারা জানেন না তারা কোন শ্রেণির! তারা কবিতার মতো একটা কিছু লিখেই ভাবেন, ভয়াবহ কিছু একটা লিখে ফেলেছেন! তারা আশেপাশের মেধাবী কবিদের নিয়ে নানা তর্কে লিপ্ত হন, আর দেখাতে চান তারাও মেধাবীদের সমকক্ষ! তারপর তারা একদিন হারিয়ে যান!

No comments:

Post a Comment