Tuesday 30 June 2015

কবীর সুমনের কলাম
"সুমনামি" কথাটা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যর উদ্ভাবন। তিনিই আমায় সঙ্গীত নিয়ে কলাম লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নামটিও তাঁরই দেওয়া। বাঁদরামি, ত্যাঁদড়ামি, বোকামি, ষণ্ডামি, ভণ্ডামি...সুমনামি। চন্দ্রিলই পারেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় আমার লেখাটি অনেকেই পড়তেন। আমাদের পাড়াতেও বেশ বয়স্ক দুই ভদ্রলোক নিয়মিত পড়তেন। রাস্তায় দেখা হলে ঐ লেখাটি নিয়ে কথা বলতেন। একবার বোলপুরে গিয়ে একদল সুমনামি-পাঠককে পেয়েছিলাম। ---- বেশ চলছিল, হঠাৎ আনন্দবাজারের এক লেখক (সাংবাদিক???) আমার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা ছাপলেন। এই কাজটি সব পত্রিকাই মাঝেমাঝে করে থাকেন অল্পবিস্তর। গা-সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। হয়েও গিয়েছিল। তবু, এই ঘটনাটির পর মনে হলো - আমার বয়স হয়ে গিয়েছে, আর নেওয়া যাচ্ছে না। চন্দ্রিলকে ফোন করে বললাম - আর লিখতে পারব না ঐ কাগজের জন্য। চন্দ্রিল বলেছিলেন - "সুমনদা, আপনি না লিখলে আমার ক্ষতি তেমন নয়, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির ক্ষতি।" এমন কথা সচরাচর শুনি না। চন্দ্রিল আলাদা ধরণের মানুষ ও লেখক। ওর সঙ্গে আমার এমনিতে যোগাযোগ হয়নি বিশেষ, হয়ও না। কিন্তু আনন্দবাজারেরই এক লেখক গায়ে পড়ে যা করলেন সেটা হজম করতে পারছিলাম না। বড্ডো খারাপ লেগেছিল। কী করব। চন্দ্রিলের জন্যও খারাপ লাগছিল। ধ্যুৎ।
আনন্দবাজার পত্রিকার চেক বাড়িতে চলে আসে নিজে নিজেই। চাইতে হয় না, তাগাদা দিতে হয় না। সত্যি বলতে, আমার এই অবসরজীবনে ঐ দু'হাজার টাকা (কলাম-পিছু) আমার কাজে লাগছিল। ভোডাফোনের বিল।
সুমনামি-তে গানবাজনা নিয়ে কত কথাই না বলতে পেরেছিলাম। সঙ্গীত নিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা দুষ্কর। কারণ, সঙ্গীত non-verbal medium.
গতকাল এক সম্মানীয় সহনাগরিক "লেখার রেয়াজ" কথাটি লিখেছেন আমারই একটি পোস্টের সূত্রে। রেয়াজ।
রেয়াজ।
শুনেছি কেস্‌রিবাঈ কেরকার পেশাদার সঙ্গীতজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পরেও দিনে ১১/১২ ঘন্টা রেয়াজ করতেন, যার অনেকটা জুড়েই থাকত 'মন্দ্র-সাধনা।' মন্দ্র সপ্তকে লাগাতার গলা চালানো। ধীরেসুস্থে। শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে শোনা - একবার প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি ও মহম্মদ রফি দিল্লি গিয়েছেন, এক বিদেশী অভ্যাগতর সামনে গান শোনানোর জন্য। সারাদিন মহম্মদ রফি বেপাত্তা। একবারও দেখা হয়নি সন্ধ্যাদেবীর সঙ্গে। সন্ধেবেলা তিনি অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন, দেখেন - মহম্মদ রফি, সালাম দিচ্ছেন তাঁকে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টি হাসিটি হেসে। সন্ধ্যাদেবী শুধোলেন, কোথায় ছিলেন সারাদিন ভাইসাহেব? একবারও দেখা হলো না। - আবার মিষ্টি হেসে, মাথা নত করে "ভাইসাহেব" বললেন - "দিদি, রিয়াজ করছিলাম যে।"
শুনেছি মহম্মদ রফি, মান্না দে ও ইয়েসু দাসের রেয়াজ শোনার জন্য তাঁদের বাড়ির সামনে সক্কালবেলা ভীড় করত লোকে।
আকিরা কুরোসাওয়ার সাত সামুরাই ছবির এক জায়গায় দেখেছিলাম - বিপন্ন গরীব গ্রামবাসীদের ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচাতে যে সামুরাইরা এসেছেন তাঁদের একজন অবকাশ পেলেই এক একটা জঙ্গল-গোছের জায়গায় গিয়ে তরোয়াল চালানোর রেয়াজ করে থাকেন। একা। আপনমনে তরোয়াল চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি সমানে। নানানভাবে। তাঁর দক্ষতার মান রক্ষা করা এবং আরও বাড়ানোর জন্য। তরোয়াল-চালানোর রেয়াজ।
১৯৬১ সাল থেকে আমায় খেয়ালে তালিম দিতে শুরু করেছিলেন কালীপদ দাস। অনেক জন্মের সৌভাগ্য থাকলে অমন গুরুর দর্শন ও তালিম মেলে। আমার জীবনে 'মাস্টারমশাই' না এলে জীবনটাই অন্যরকম হতো। তিনি ছিলেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ির প্রথম সারির ছাত্রদের একজন, সেই বিরাট খেয়ালশিল্পীর গায়কীতে নিবেদিতপ্রাণ।
বাবা চেয়েছিলেন চিন্ময় লাহিড়ি আমায় তালিম দিন। তাঁকে অনুরোধ জানান বাবা। আচার্য কিন্তু বলেছিলেন, তাঁর শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে, আগের সেই ফর্ম-ও আর নেই; অতো অল্প বয়সী কোনও শিক্ষার্থীকে তিনি ভালো শেখাতে পারবেন না। তিনি বলেছিলেন, "আমার এক সেরা ছাত্র, কালীপদকে, পাঠাবো। সে একেবারে ঠিকঠাক তালিম দিয়ে ছেলেকে তৈরি করে দিতে পারবে।
এখন ভাবি - কতোটা সৎ ছিলেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ি শিক্ষক ও মানুষ হিসেবে। কতোটা দূরদৃষ্টি তাঁর ছিল। ছাত্র কালীপদ দাসকে তিনি যদি বেছে না নিতেন আমি তৈরি হতাম না।
- আমি কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকে আচার্য আমীর খানের গায়কীতে বাঁধা পড়ে যাই। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সালে খানসাহেবের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে আমি তাঁর পোষা কুকুরের মতো অনুসরণ করে গিয়েছি। খেয়ালের তালিমে একটা সময় আসে যখন গুরু আর ছাত্র একসঙ্গে গান। একজন তবলায় থাকেন। ছাত্রকে গুরু স্বাধীনভাবে গাওয়ার পাঠ দেন, অন্তত সেটাই তাঁর দেওয়ার কথা। মাস্টারমশাই আর আমি এইভাবেই গাইতাম, আমি শিখতাম সমানে, তবলায় ঠেকা ধরে বসে থকতেন সত্য রায়, এক রসিক তবলিয়া।
আমার গায়কীতে, বিশেষ করে স্বরবিস্তার ও সরগমে খানসাহেবের জোরালো প্রভাব থাকত। আমার গুরু তা বুঝতেন এবং তাঁর ছাত্রর ওপর এক মহাশিল্পীর সেই প্রভাবকে সম্মান জানাতেন নীরবে, মিষ্টি হেসে। সেরকম কিছু করলেই তারিফ করতেন আমার গুরু ও সত্য বাবু, আমার আর-এক গুরু। সত্যি বলতে, আচার্য চিন্ময় লাহিড়ি (যাঁর ঘরাণায় আমার থাকার কথা) ও আচার্য আমীর খানের গায়কী ও দর্শনে কোনও মিল নেই। চিন্ময় লাহিড়ির হাতে তৈরি (তাঁরা দুজনেই আদতে পূর্ববঙ্গের মানুষ, সেই ঢাকা থেকেই আচার্য চিন্ময় লাহিড়ির কাছে আমার গুরুর তালিম শুরু) আমার গুরুর মধ্যে আমি কোনওদিন এই ব্যাপারে কোনও অসহিষ্ণুতা দেখিনি। বরং উৎসাহ দিতেন তিনি।
আমীর খান সাহেবের সঙ্গে আমার বাবার আলাপ ছিল। বাবাকে ধরলাম - খান সাহেব যদি একটু তালিম দেন আমায়। --- এক রবিবার আমাদের বাড়ির একতলার ঘরে মাস্টারমশাই-এর তালিম চলছে। সত্য বাবু তবলায়। হঠাৎ আমার গম্ভীর, স্বল্পভাষী পিতৃদেব ঘরে ঢুকলেন। মাস্টারমশাই একটা স্বরমণ্ডল বাজিয়ে তালিম দিতেন, আমি ছাড়তাম তানপুরা। সব থেমে গেল। বাবা সরাসরি আমার মাস্টারমশাইকে বললেন, "কালীপদবাবু, আমীর খান সাহেব সুমনকে তালিম দিতে রাজি হয়েছেন। রেডিয়োতে আপনার ছাত্রর গলা ও গান শুনে তারপর রাজী হয়েছেন। এখন আপনার অনুমতি তো চাইই। আপনি আজ্ঞা করলে তবেই খানসাহেবের কাছে সুমন যাবে। আর-হ্যাঁ, আপনার কাছে তালিম কিন্তু বাদ পড়বে না, পাশাপাশি চলবে।"
বাঙলার সাধারণ এক ঘরের ছেলে কালীপদ দাস। কে চেনে, কজন চিনেছে তাঁকে। পূর্ববাংলার মানুষ। দেশ ভাগ না হলে হয়তো কলকাতায় চলে আসতেনই না। কলকাতায় কত কষ্ট করে একটু জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। চিন্ময়বাবুর কাছে তালিম, নিজের রেয়াজ। আকাশবাণী কলকাতার খেয়াল শিল্পী। ট্রামে বাসে করে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শিখিয়ে সংসার চালাতেন। ছাত্রপিছু ২৫/৩০ টাকা নিতেন। আমি বলছি গত শতকের ছয়-এর দশকের কথা।
বাবার কথা শুনে কালীপদ দাস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে দুই হাত জোড় করে বললেন, "বড়দা, আমার কী ভাগ্য! সুমন যদি খানসাহেবের তালিম পায় তাহলে আমিও সুমনের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারব।" এই বলে কেঁদে ফেললেন আমার গুরু। আমিও কাঁদতে লাগলাম, সত্যবাবুও।
আমি জানিনা, এমন কটি বাঙ্গালি আত্মা আমার এই লেখাটি পড়বেন যাঁরা আদৌ উপলব্ধি করতে পারবেন কী হলো। সেই মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি আর ক'জন আছেন? আমার এই লেখা তো বাঙলার চাষী তাঁতি জেলে কামার কুমোর মুচি পড়বেন না। পড়বেন ইস্কুল-কলেজে পড়া "শিক্ষিত" বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত। - আমার শুধু একটাই অনুরোধ - মন্তব্য করবেন না কোনও। যদি চান পড়তে থাকুন। ভাবতে থাকুন।
সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একটু সময় দিলেন আমাদের। তারপর আমার মাস্টারমশাইকে বললেন - "শুনুন, কালীপদবাবু, আমার ছেলে সুমন তার আসল গুরুকে পেয়ে গিয়েছে। নতুন করে আমীর খানসাহেবকে সুমনের দরকার হবে বলে আমি মনে করি না। তালিম চলতে থাকুক, গান চলতে থাকুক। ব্যাঘাত ঘটালাম, কিছু মনে করবে না।" - প্রস্থান।
আমরা তিন জন কতোক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম আজ আর মনে নেই।
পরে বাবার কাছে শুনেছিলাম আমীর খানসাহেবকে এই ঘটনা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতাচার্য উঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌ পাকের কাছে দোয়া করতে থাকেন। বলেছিলেন, "আল্‌হাম্‌দুলিল্লাহ্‌, চ্যাটার্জিসাব, আপ্‌কা লড়কাকো তো সদ্‌গুরু মিল গয়া! আল্লাহ্‌!" - ইংরিজি-হিন্দুস্তানী মিশিয়ে তিনি বলতে থাকেন, "অনেক ভাগ্য করলে এমন গুরু মেলে কপালে। ইনিই আসল তালিম দিতে পারবেন, সঙ্গীত-জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিতে পারবেন আপনার ছেলের মনে।"
এতোকিছুর পরেও বাবার মনে একটা "কিন্তু" থেকে গিয়েছিল। খানসাহেবের মনেও। কথা হচ্ছিল আকাশবাণী কলকাতার অফিসে, বাবার ঘরে। চা-বিস্কুট খেয়ে দু'জনে ঠিক করেন "সুমনকে" তো একটু 'আমীরখানী' সুযোগও দেওয়া দরকার। - খানসাহেবই একটা উপায় বের করেন। বলেন, একটা কাজ করা যাক, আমি যখন রিয়াজ করব সুমন এসে শুনুক। তাহলেই হবে।
'রিয়াজ', রেয়াজই সব। আমাদের, হিন্দুস্তানী ও কর্ণাটকী সঙ্গিতের গোলামদের ধর্ম হলো রেয়াজ। এই রেয়াজের মধ্য দিয়েই আমরা 'সাত সামুরাই'এর এক সামুরাই-এর মতো অবকাশ পেলেই দূরে গিয়ে একা একা তরোয়ালের কসরৎ করে যাই। দক্ষতায় থাকা, elements-এ থাকা, দক্ষতা বাড়াতে চেষ্টা করে যাওয়া, রাস্তা খোঁজা। খুঁজে যাওয়া। সাত জন্মেও কখনও মৃত্যু ছাড়া আর-কোথাও পৌঁছতে পারব না - এটা জেনেও রাস্তা খুঁজে যাওয়া। রাগের পথ ধরে পথ খোঁজা, পথ খুঁজে যাওয়া, চ'রে বেড়ানো। Essay. In the true sense of the term.
আমার লেখাগুলোও essay. চেষ্টা। শুধু চেষ্টা।
যে সুধী সহনাগরিক আমার ঐ লেখা বা লেখাগুলিকে "লেখার রেয়াজ" বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। গায়ক হবো বলে গান শিখেছি নাকি? তেমনি লেখক হওয়ার জন্য তো লিখি না। সাত সামুরাই-এর ঐ এক সামুরাই আমি। শুধু চেষ্টা। গান যা বানাই, সঙ্গীত যে করি, দিনের পর দিন বসে বসে যন্ত্রাণুষঙ্গ যে বানাই, নির্মাণ করি (যার কথা কেউ বলে না, কোনওদিনই কেউ বলবে না হয়তো, ভালো করে শুনতে শিখলে তো বলবে! শেখার আর দরকার কী- আমরা, মধ্যবিত্ত বাঙালিরা তো সব শিখে গেছি, বুঝে গেছি, জেনে গেছি, বলুন?) সবই 'রেয়াজ', 'রিয়াজ।' চেষ্টা। সন্ধান। যার শেষ হবে আমার মৃত্যুতে।
তারপর কি আবার জন্মাবো?
যেন জন্মাই; শুধু, ১৯৪৯ সালে জন্মে যে বাংলাকে তার সঙ্গীত সমেত পেয়েছি তারপর অনেকগুলো বছর, সেই বাংলাটাই যে আর থাকবে না আমার "পুনরজন্মের" কালে। সেই ভারতও তো আর থাকবে না। সেই ইউরোপ আমেরিকার আধুনিক গানও তো আর থাকবে না ---এখনই তো নেই।
*****
কবীর সুমন
২৫ জুন ২০১৫

No comments:

Post a Comment