Thursday 25 June 2015

সৌজন্য নববার্তাডটকম
(ক)বীরগাথা / পার্থ দাশগুপ্ত
--------------
কাগজে কলমে কবীর সুমন আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী। তারা নিউজে ২০০৬-৭ সালে উনি 'মতামত' নামে একটি টক-শো সঞ্চালনা করতেন। যা ওই একই চ্যানেলে তুমুল জনপ্রিয় শো 'লাইভ দশটায়'-র উত্তরসূরি। যাকে টক-শো না বলে বলা ভালো 'সুমন একাই এক শো' smile ইমোটিকন আমি একরকম প্রায় জোরজার করেই সেই অনুষ্ঠানে ওঁর গবেষণার অবৈতনিক সাহায্যকারী হিসেবে একটা জায়গা পেয়েছিলাম। মাসখানেকের মধ্যে, সম্ভবত আমার কাজে খুশি হয়ে, উনি তারা নিউজ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেন যাতে আমাকে অনুষ্ঠানটির প্রযোজকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওঁর অনুরোধ বা সুপারিশ সেই সময়ে তারা নিউজ কর্তৃপক্ষের কাছে একরকম আদেশই ছিল বলা চলে। ওঁরা রাজি হন এবং তারপর থেকে আমার একটা যৎসামান্য মাসিক সাম্মানিকও ধার্য হয়। তখন সেই টাকাটাও আমার কাছে অনেক টাকা ছিল, কারণ আমি তখন স্বেচ্ছায় বেকারত্ব গ্রহণ করেছি। সোজা বাংলায়, কবীরদা আমাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দেন।
কবীর সুমন আমার মত একজন অর্বাচীনকে কবীরদা বলে ডাকার অনুমতি দিয়েছিলেন প্রথম দিনই। এবং আমি ওঁর বাড়ি থেকে খান দশেক বাড়ির পরেই থাকি অথচ আমাদের আগে আলাপ হয়নি জেনে অবাক হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন জানি না। কারণ বাঘে গোরুতে আলাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক না। সাংবাদিকতায় সম্পূর্ণ অশিক্ষিত এবং অনভিজ্ঞ একজন অনতিতরুণকে ( তখন আমার বয়স আটত্রিশ) আক্ষরিক অর্থে হাতে করে কাজ শিখিয়েছিলেন। Anirban Sadhu Sukanta Mitra এবং শুভেন্দু কয়াল - আমার অন্যান্য সহকর্মী এবং বন্ধুরাও একইরকম যত্ন, নিষ্ঠা এবং ভালোবাসার সঙ্গে আমাকে কাজ শিখিয়েছিলেন।
আমরা যে সময়টায় এবং যতদিন একসঙ্গে 'মতামত' করতে পেরেছিলাম, ঘটনাচক্রে স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গে সে বড় সুখের সময় নয়। এবং অভূতপূর্বও বটে। আমাদের সবার জীবন বরাবরের জন্য পালটে দিয়েছিল সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম - লালগড়। আমরা সবাই একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করতাম, যাকে সাংবাদিকতা না বলে মানবজন্মের দায় মেটানোর একটা প্রাণপণ চেষ্টা বলা বোধ হয় সত্যির বেশি কাছাকাছি হবে। তার বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না, কারণ সেটা যে ক'জন জানেন, ( যেমন আমাদের পরিবারের লোকেরা ), তাঁরা জানেন। আর যারা জানেন না, তাঁরা আন্দাজও করতে পারবেন না। তারা নিউজের নিউজ এডিটর Debjyoti Chakraborty আমাদের পিছনে সর্বশক্তি এবং যাকে বলে nose for journalism - নিয়ে না দাঁড়ালে কাজটা আমরা করতে পারতাম না। এ বঙ্গের 'পরিবর্তন'কামী ও তার ধ্বজাধারী ক'জন মানুষ তাঁর নাম জানেন ও অবদানের খবর রাখেন?
সিপিএম পরিচালিত তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার আমাদের এই উদ্যোগে বিচলিত হয়ে তারা নিউজ কর্তৃপক্ষর উপর এমন কিছু একটা চাপ তৈরি করেন, যার ফলে কবীরদা কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আমাকে অবশ্য প্রস্তাব দেওয়া হয় 'মতামত' অনুষ্ঠানের প্রযোজক হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে এবং বলা হয় সপ্তাহে তিনদিন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আর দু দিন অশোক বিশ্বনাথন কবীরদার জায়গায় অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করবেন। আমি সবিনয়ে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করি ও তারা নিউজের কর্তা ডঃ অমিত চক্রবর্তী মহাশয়কে জানাই যে, বাঘের খাঁচায় খাবার দিয়ে আমার এমন বদভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, এরপর বাঁদর নাচানো আমার পক্ষে অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবেই আমার কাজটি ও সেই মাসোহারাটি চলে যায়। কবীরদা চলে যাওয়ার পরের দিনই।
আমি শিক্ষকতা করে জীবিকানির্বাহ করতে থাকি। কবীরদা সক্রিয় রাজনীতিতে চলে যান। আমাদের যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন না হলেও ক্ষীণ হয়ে আসে। ২০০৯ সালে আমি সুকুমার রায়ের 'আবোল তাবোল'-এর সবকটি কবিতার পুনর্লিখন করি মূলত সিপিএমের দানবীয় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার একটা ফর্ম হিসাবে। কবীরদাকে পাণ্ডুলিপিটি দেখাই। উনি চমৎকৃত হন এবং সেটা ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেন। উনিই বইটির নামকরণ করেন 'হ্যাঁ বোল না বোল', যা আজ আপনাদের অনেকেরই পড়া। ২০০৯ সালের ১৬ মার্চ ওঁর জন্মদিনে কলামন্দিরের অনুষ্ঠানে কবীরদা বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সে বছর উনি লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হওয়ার পর আমি 'বিজল্প'র প্রসূন ভৌমিকের প্রযোজনায় ওঁর উপরে একটি প্রচার ভিডিও বানাই। সেটা খুব খারাপ হয়নি এবং বেশ কিছু জায়গায় প্রচারিতও হয়েছিল। কেউ চাইলে আমি কপি করে দিতে পারি। সাংসদ হওয়ার পর দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার জন্য আমি ওঁর একটা লম্বা সাক্ষাৎকার নিই যাতে একটা প্রধান প্রশ্ন ছিল সাংসদ হিসেবে উনি কী কী কাজ করতে পারবেন। উনি যা উত্তর দিয়েছিলেন এবং বাস্তবে যা করতে পেরেছেন, যে কোনও উৎসাহী তা সরেজমিনে যাচাই করে আসতে পারেন। জয়াতলা, হিমচি, খেয়াদা - এই গ্রামগুলো কলকাতার মানুষের থেকে অনেক দূরে হলেও শহর কলকাতা থেকে আসলে খুব দূরে নয়।
২০০৯ সালের শেষ দিকে আমি আবার বেকার হয়ে পড়ি এবং কবীরদার সুপারিশে 'যুগ পরিবর্তন' নামের একটি সদ্যোজাত দৈনিক পত্রিকায় কাজ পাই। সেটি অবশ্য অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। তবে কপালজোরে আমি কাগজটির চিতারোহণ পর্বের পূর্বেই সর্বভারতীয় ইংরেজি সাপ্তাহিক 'তহেলকা'য় কাজ পেয়ে গিয়েছিলাম।
২০০৯ সালের ১৮ জুন রাত দশটায় আমার বাবা মারা যান। পরের দিন বাবাকে দাহ করার আগে কবীরদা আমার অনুরোধে বোড়াল শ্মশানে শায়িত বাবার মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের 'পথে চলে যেতে যেতে' গানটি গেয়েছিলেন। ওঁর অনুষ্ঠান কিন্তু এখনও হাউসফুল হয় এবং টিকিটের দাম নেহাত কম নয়।
আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, এত কথা লিখলাম কেন? আমার কেরিয়ারগ্রাফের গল্প শোনাতে? নাকি কবীর সুমনের সঙ্গে আমার হৃদ্যতার কাহিনি শোনাতে? উত্তরগুলো একে একে দিচ্ছি।
এক, কবীর সুমন ইদানীং নিয়মিত ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর নানা মতামত দিচ্ছেন এবং আজকালকার সংবাদমাধ্যমের ভাষায় 'বিতর্ক বাঁধাচ্ছেন' ( চন্দ্রবিন্দুটা খেয়াল করুন)। এতে অনেকে উল্লসিত হচ্ছেন, অনেকে মজা পাচ্ছেন এবং অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছে। এবার বোঝাই, 'মতামত'-এর প্রসঙ্গ কেন টানলাম। আজ যদি 'মতামত'-এর মত একটা মঞ্চ ওঁর থাকত, তাহলে কবীর সুমন এই লেখাগুলো ওঁর অশক্ত কাঁপা আঙুলে ল্যাপটপে লিখতেন না। এটা কেন বলতে হল? কারণ, যাঁদের স্মৃতিতে 'মতামত' রয়ে গিয়েছে, তারা যদি আজকের 'টক শো' গুলো দেখেন, তাহলেই বুঝবেন, আজ অন্তত এ বাংলার কোনও চ্যানেলের মাথাতেই আসবে না ওরকম একটা অনুষ্ঠান করার বা কবীর সুমনকে দিয়ে তা সঞ্চালনা করানোর। আধুনিক বাংলার ( এবং সম্ভবত এ দেশের) সেরা মস্তিষ্কের যদি কমিউনিকেশনের তাগিদ থাকে, তাহলে তাঁকে তাঁর যোগ্য জায়গা কেউ দিতে পারছে কি? ফলে, উনি ফেসবুকে লিখে বেশ করছেন। যারা ওঁর ফেসবুকে আশ্রয়প্রাপ্তি নিয়ে বিচলিত বা আমোদিত, তারা চুপ করে থাকলেই দেশের ও দশের মঙ্গল।
দুই, আমি আমার কথা এত বেশি করে এইজন্য লিখলাম কারণ আমার মত নিশ্চয়ই এমন আরও অনেকে আছেন যারা কবীর সুমনের দ্বারা নানাভাবে উপকৃত। শুধু আমার পিতৃসম শিক্ষক হিসেবে নয়, আমার ক্ষেত্রে ওঁর অবদান কিন্তু কোনও শুকনো উপকার নয়, উনি চাকরি জুটিয়ে দিয়ে আমার ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করেছেন - দু বার। এবং ওঁর উদ্যোগে 'হ্যাঁ বোল না বোল' প্রকাশিত হওয়ার ফলেই আমি সাংবাদিক হিসেবে কল্কে পেয়েছি। আমি অনেকদিন ধরে ওঁর ফেসবুকের সব লেখা খেয়াল করছি। কিন্তু কখনও দেখছি না কেউ তাঁদের জীবনে ওঁর অবদানের কথা খোলাখুলি বলছেন। ওঁর গান কার কেমনভাবে জীবনদর্শন পালটে দিয়েছে সেরকম অনেক গল্প আমরা জানি। এবং নিয়ত সে আহ্লাদ শুনতেও পাই। কিন্তু ওঁর কারণে আমার মত বাস্তব জীবন পালটে যাওয়ার গল্প আরও মানুষের আছে আমি নিশ্চিত। তাঁদের কোথাও দেখি না। তাই আমি অন্তত আমার কথাটা প্রকাশ্যে বললাম।
তিন, অনেকদিন কবীরদার সঙ্গে দেখা হয় না। উনি যা লেখেন এবং বলেন ইদানীং, সব কিছুর সঙ্গে আমার মতেও মেলে না। কিন্তু খারাপ লাগে যখন দেখি যে কেউ, আবার বলছি, যে কোনও রাম শ্যাম যদু মধু, ওঁর যে কোনও লেখায় মতামত দেওয়ার স্পর্ধা দেখান। 'অওকাদ' বলে একটা শব্দ আছে, যার বাংলা হয় না। ফলে বাঙালিরা তার অর্থও জানে না, অনুশীলনও জানে না। কবীর সুমন যা খুশি লিখুন, আপনাদের পক্ষে চুপ করে থাকাটা কি খুব কঠিন? কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দার্জিলিং গিয়েছেন। একদিন রোদ ঝলমল করে সে আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দিল, আর তার পরের সাতদিন হয়তো মেঘে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকল। তা বলে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা উইঢিপি হয়ে গেল? না কি, কেন সে প্রতিদিন রোদ ঝলমলে হয়ে নেই - তাই নিয়ে তার বিরুদ্ধে পিটিশন দেন?
এবার যে ধান ভানতে বসেছিলাম সেটা লিখে শেষ করি।
কবীরদা জার্মান ভাষাটা তাঁর মাতৃভাষা বাংলার মত করেই জানেন। একটা খটমট উচ্চারণের ভাষায় কথা বলে বলেই যে জার্মানরা একটা রসকষহীন জাতি নয়, সেটা উনিই আমাকে গল্প করেছিলেন। তার মধ্যে দুটো গল্প এরকম।
কোনও জার্মান যখন কোনও স্বজাতিকে অপমান করতে চায়, ইংরেজিতে যাকে belittle করা বলে, তখন সে রাগারাগি, চেঁচামেচি করে না। খুব বিনীত ও নিরীহভাবে দুটি বাক্য বলে -
এক - যা দেখলাম মশাই, শিক্ষা জিনিসটা আপনার বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি।
আর
দুই - আপনি আসলে 'আপনি' নন, আপনি একটা 'তুই'।
কবীরদা ইদানীং যখন ফেসবুকে নানা সুখদুঃখের কথা লেখেন বা এই সমাজ বা এখনকার মানুষজনকে নিয়ে লেখেন, বা নানা কমেন্টের প্রতিক্রিয়া দেন, তখন নিজে যে কেন এই দুটি বাক্য খেয়াল রাখেন না, কে জানে। রাখলে, এই লেখালেখি ভুলে আরেকটু বেশি সময় রিয়াজ করতে পারতেন। আমরাও সমৃদ্ধ হতাম আরেকটু বেশি।
কবীরদা, ভুল বললাম কিছু?
প্রণাম নেবেন।

No comments:

Post a Comment