Thursday 28 January 2016

আবৃত্তির শক্তিশালী সংগঠন কণ্ঠশীলন

০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১৭:২৮
নমিতা খান
এসেছিলাম ওয়াহিদুল হক নামের এক যোগীর সান্নিধ্য পেতে কণ্ঠশীলন আশ্রমে। আশ্রমই তো। শহরের পাঁচিল ঘেরা হৃদয় মন সংকীর্ণ হয়ে শুকিয়ে যাওয়া কোনো স্থান তো নয়, এ সত্যিই মুক্ত আকাশের নিচে, গাছপালার সবুজ ছায়ায়, সরল সংযত তপোবন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যোগীর প্রিয় রেসকোর্স ময়দান। আর এ যুগের ব্রহ্মাবিদ্যাকে প্রাণের করে নেওয়ার উপাসনালয়। এখানেই যোগী আমাদের ২৩ বছর ধরে বাঙালি-বাঙালিত্বের, জ্ঞান-সত্য-ঐক্য সাধনপদ্ধতি এবং জীবনে জীবন যোগের দীক্ষা দিয়েছেন।
কয়েকজন আলোকবর্তী মানুষ একটি অদৃশ্য ঘর বানালেন দিনপঞ্জীর ১৩৯১ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ ১৯৮৪ খৃস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল এই দিনে। ওয়াহিদুল হক এর নাম দিলেন– কণ্ঠশীলন। এই অদৃশ্য ঘরের অপর দিকপালদের একজন নরেন বিশ্বাস, অপরজন বিপ্লব বালা। পরবর্তী সময়ে তাঁদের স্থির কার্যক্রমকে বেগবান করতে সনজিদা খাতুনও যোগ দিয়েছিলেন। তবে ছায়ানট নামক সংগঠনটিকে নিয়ে ব্যস্ততার জন্য তিনি বেশি দিন যুক্ত থাকতে পারেননি। বিভিন্ন লেখালেখি থেকে জানা যায় নরেন বিশ্বাস ভাষার ব্যাকরণ, বিপ্লব বালা আবৃত্তি শিখন পদ্ধতি, সনজিদা খাতুন ধ্বণি ও ছন্দ আর ওয়াহিদুল হক খাঁটি বাঙালি হওয়ার মন্ত্র নিয়ে কাজ করতেন। কালের নিয়মে আজ তিনজনের দুজন অতীত। কাজের ধারাবহিকতায় তাঁদের শূন্যস্থান পূরণের শতত চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁদের সুযোগ্য ব্রহ্মাচারী মীর বরকত ও গোলাম সারোয়ার।
বর্তমানে কণ্ঠশীলনের বাহ্যিক কাঠামো এক কথায় আবৃত্তি সংগঠন। কাগজে মুদ্রিত, সাহিত্যের বাচিক চর্চা ও প্রসার প্রতিষ্ঠান। ব্যাকরণিকভাব কণ্ঠের অনুশীলন। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে এর তাত্ত্বিক দিক সংস্কৃতি চর্চার শিক্ষায়তন। তত্ত্বের নিগূঢ় বিষয় আরো সুচিহ্নিত করে বলা যায়, বাংলা-বাঙালি-বাঙালিত্ব। আর আবৃত্তি আমাদের উপলক্ষ মাত্র। তাই কণ্ঠশীলনকে সহজ সংজ্ঞাবদ্ধ করা সুকঠিন। কণ্ঠশীলন যারা করেন বা করবেন, বলেন অথবা বলবেন তারা এর তত্ত্ব বা মূল মন্ত্রের সাথে পরিষ্কার বোঝাপড়া করেই করবেন বা করে থাকেন। ইতিমধ্যে কণ্ঠশীলন তার এই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নিজেকে ভিন্ন ধারার বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য মিডিয়ার বিস্তৃতি ও প্রভাবে দেশের অন্যান্য প্রথম শ্রেণীর আবৃত্তি সংগঠনগুলোর মতো সংবাদ পাঠ, উপস্থাপনা, অভিনয় ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্সের নামে অর্থ উপার্জনের সহজ পথে কণ্ঠশীলন পা রাখেনি।
কণ্ঠশীলনের কার্যক্রম অন্য যেকোনো সংগঠনের চেয়ে পদ্ধতিগত ও নিয়মবদ্ধ। এর নিয়মিত কার্যক্রমের একটি বিদ্যায়তন পরিচালনা অপরটি বসা। বিদ্যায়তনের দুটি পর্ব- আবর্তন এবং প্রয়োগের শিক্ষণ পদ্ধতি এতটাই বৈজ্ঞানিক আর আনন্দময় যে শিক্ষার্থীরা চিরচেনা বাংলাকে নতুন করে পেতে থাকে। প্রতিবছর কণ্ঠশীলনের প্রথম দিনটিতে রবীন্দ্রনাথের বাণীবদ্ধ দেয়াল লিখন জানাবো আর জানবো তোমায় ক্ষুদ্র পরিচয়ে অথবা ‘ভেঙ্গেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারই হউক জয়’ কিংবা ‘আজিকে এই সকালবেলাতে, বসে আছি আমার প্রাণের সুরটি মেলাতে’ বা ‘ভুবনজোড়া আসনখানি, আমার হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি’ ইত্যাদি সব বাণী দিয়ে তাদের মননকে স্নাত করা হয়। যখন প্রশ্ন করা হয় এটা তো আমাদের জন্ম ভাষা বিদ্যালয়েও পড়েছো তবে আবার এখানে আসা কেন? সবাই ভাসাভাসা চোখে তাকাতে থাকে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে ভালোমতো শেখা হয়নি, মনোযোগী ছিলাম না। আশ্চর্য যা এত দিনের চর্চায় আয়ত্ত্ব হয়নি- তা কি এই চার মাসের চর্চায় হবে? শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে- তাইতো! ব্রহ্মচারীরা হাল ধরেন। ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতা এমনভাবে তুলে ধরেন যে মনের ভিতর দ্যোতনা জাগায়। মন আটকে যায় কথায়। নাহ্ আর অবহেলা নয়, এবার সঠিকভাবে শেখা চাই। এরপর অনুশীলনের নানা চমক আসতে থাকে। আর প্রতিদিন নতুন নতুন মুখে দেশি-বিদেশি কবিতা আবৃত্তি। ইস্ কবে যে এভাবে বলব। না না এ স্থান ছাড়বার নয়। চলে তাদের নতুন উদ্যমে পথ চলা। এই বিদ্যায়তন পরিচালনায় একটি ক্ষুদ্র দল কাজ করে আর বসা পরিচালনায় বড় দল। ক্ষুদ্র দল স্কুল কমিটি আসলে বড় দল পর্ষদেরই অণুশাখা।
আবর্তন পেরিয়ে প্রয়োগ। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা তার ভেতরের শক্তিকে তুলে ধরবার সুযোগ পায়। জানতে থাকে কবিতা নির্মাণ কৌশল, অনুশীলন, সংগঠন, আচার-ব্যবহার, এক হয়ে চলা ইত্যাদি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবৃত্তির কল্পনা এখানে বাস্তবে রূপ নেয়। নিজের প্রতি আস্থা বাড়তে থাকে। মূলত এ দুটি পর্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিকভাবে কণ্ঠশীলনের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এরপর কয়েক মাস তাকে সাংগঠনিক কাজ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়, এ পরীক্ষায় যোগ্য বিবেচিত হওয়ার পর সাধারণ সদস্য পদ দিয়ে কণ্ঠশীলনের মূল কার্যক্রমে নেওয়া হয়। শুরু হয় আসল পথচলা। এত দিন যা নেওয়ার ছিল এবার  সেগুলো কেবল দেওয়ার পালা।
কণ্ঠশীলনের উল্লেখযোগ্য নিয়মিত কার্যক্রম দলে বসা। সদস্যরা প্রাণের যোগ দিতেই প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টায় লুপ্তপ্রায় তপোবন রেসকোর্সে বসে। বসার অনুষঙ্গ হলো- নতুন নতুন কবিতা শোনা, মৌলিক লেখার শক্তি সঞ্চরণ, বইপড়া ও সে বিষয়ে জানানো, বিশেষ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির অভিজ্ঞতা জানা-চেনা, ছোট ছোট আবৃত্তি প্রযোজনা তৈরি ইত্যাদি। আরো একটি বিশেষ দিকের কথা বলি, এখানে একটি কবিতা একজনই করে থাকে, একই কবিতা দলের অন্য কেউ করে না। উদ্দেশ্য একটায় অজানাকে জানো এবং জানাও। এই ছোট ছোট চেষ্টা দিয়েই এখন মীর বরকত, গোলাম সারোয়ার আর জহিরুল হক খান নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রথম সারির একজন হয়েছেন।এ বড় গর্বের, অহংকারের।
ঊনত্রিশ বছরের কর্মজীবনে কণ্ঠশীলনের সম্পদরাশিও কম নয়। রয়েছে উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি প্রযোজনা- ভাষার লড়াই, মুক্তিযুদ্ধের কথা- অমৃত সমান, রবি ঠাকুর কবি ঠাকুর, চাঁদ বনিকের পালা, নিষ্কৃতি, বর্ষামানব ইত্যাদি। রয়েছে কয়েকটি ধ্রুপদী প্রাযোজনা- অনাম্মী অঙ্গনা, কামনা ও কামনা পেরিয়ে, গান্ধারীর আবেদন প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে উল্লেখযোগ্য নাটক- কারিগর, পুতুল খেলা, রাজা-রানি, উত্তর বংশ ইত্যাদি। এই সম্পদগুলো নিশ্চয় আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার সাক্ষী।
এই আভিজাত্যকে ভর করেই কণ্ঠশীলনের পথচলা হোক আরো বিস্তৃত ও শুভ। আরো অনেক সৃজনশীল মানুষের জন্ম হোক। সৃষ্টিশীল কর্মভাণ্ডারে হোক নুব্জ। আর এভাবেই বাংলাদেশের তাবৎ সংগঠনের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে বেঁচে থাকুক।

No comments:

Post a Comment