Wednesday 4 May 2016

মানচিত্রে রেখা টানাঃ ভারত ভাগ হল---------- আজিজুল জলিল

মানচিত্রে রেখা টানা: ভারত ভাগ হোলপ্রিন্ট কর
আজিজুল জলিল   
শনিবার, ২৯ আগস্ট ২০০৯

      কিন্তু  মাত্র সাত সপ্তাহে হয়ে  গেল সীমান্ত ঠিক করা
      এক  মহাদেশ বিভক্ত করে দেয়া ভাল বা মন্দ
      পরের  দিন সে বিলাতে চলে গেল, যেখানে বিষয়টা ভুলেও গেল
      যেমন  এক যোগ্য উকিলের করার কথা। ফিরবেনা সে আর
      ভীত, যেমন সে তার ক্লাবকে বলে, পাছে আবার গুলি খেতে হয়।
                  ডব্লিউ এইচ  আউডেন – “পার্টিশন” কবিতা থেকে
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়াকে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি সার্বভৌম রাস্ট্রে ভাগ করা। এই পরিকল্পনায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মতি নেওয়া হয়।  ব্রিটিশ সরকার পরিকল্পনায় সম্মত হলে ভারতের বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন সেটা ঘোষনা করেন। পাঞ্জাব আর বাংলা এই দুই প্রদেশের সীমা নির্দেশ করে রেখা টেনে দেওয়া এক বিশেষ সমস্যা হয়ে দেখা দিল। এই গুরুত্বপূর্ন আর জরুরি কাজের জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর বন্ধু ৪৮ বৎসর বয়স্ক স্যার সাইরিল র‌্যাডক্লিফকে বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলেন। তিনি অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করে নামকরা ব্যারিস্টার হন এবং মাউন্টব্যাটেনের সাথে আগেও কাজ করেছিলেন।
র‌্যাডক্লিফ আগে কখনো ভারতের মাটিতে পা রাখেন নাই। আর বাউন্ডারি কমিশনের কাজে যখন এলেন তখন উপমহাদেশকে জানবার সময়ও ছিলনা। ইতিমধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতি ঘটল - পাঞ্জাব আর বাংলায় হিন্দু-মুসলিম দাংগার আগুন জ্বলে উঠল। যদিও এই দুই প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু ছিল, হিন্দুর সংখ্যা একবারে নগন্য ছিলনা – কোন কোন এলাকায় তারা সংখ্যায় বেশি ছিল। র‌্যাডক্লিফ সাহেবের কাজ হয়ে দাড়ালো আট কোটি মানুষকে আলাদা করা আর ১৭৫,০০০ বর্গমাইল জায়গা ভাগ করে দেয়া। জাতিসংঘ এই গুরুতর দ্বায়িত্ব নিতে রাজি হয় নাই। র‌্যাডক্লিফ এই দ্বায়িত্ব নিতে কোনমতে রাজি হয়েছিলেন। তিনি কেন যেন ভেবেছিলেন ছয়মাস সময় পাবেন কয়েকটা বিবাদপূর্ন জেলার সমস্যার সমাধান করে ভারত অথবা পাকিস্তানের অংশভুক্ত করে দেবেন। কিনতু হাজার বৎসরের জোড়া লাগা দেশ আর মানুষকে বিভক্ত করতে তিনি মাত্র ৩৬ দিন সময় পেলেন কারন ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট এই দুই রাস্ট্র স্থাপনের তারিখ আগেই নির্ধারন করা হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের ৮ ই জুলাই। র‌্যাডক্লিফ দিল্লী এসেছেন। পরনে তাঁর ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার উপযুক্ত পোষাক, দিল্লীর অসহ্য গরমের জন্য নয়। কিন্তু সময় ছিলনা সঠিক পোষাক যোগাড় করার। বড়লাট তাঁকে তলব করেছেন কংগ্রেসের নেহরু আর পাটেল  এবং মুসলিম লীগের জিন্নাহ আর লিয়াকাত আলি খানের সাথে দেখা করতে। স্যার সাইরিল বিশেষ ভাবে বললেন তাঁকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি ভারতের বিশালতা, বহুসংখ্যক ও বহুজাতির মানুষের বসবাস, উপমহাদেশের দুই অঞ্চলের জমিজমা ভাগ করে দেয়ার কথা বলেন। আরো উল্লেখ  করেন এ কাজ এমন ভাবে সম্পন্ন করতে হবে যাতে জনপদ অটুট রেখে লোকের স্বস্তি বজায় থাকে, জেলাগুলি ভাগাভাগি থেকে বেঁচে যায়, তাদের মাটির সংগে শহর আর গ্রামের যোগাযোগ থাকে। তিনি জোর দিয়ে বলেন এই কাজ করতে বেশ কয়েক বৎসর লাগবে। কত সময় দেয়া হবে তাঁকে? “পাঁচ সপ্তাহ” বললেন মাউন্টব্যাটেন। স্যার সাইরিল বিস্ময় আর ভয়বিহ্বলতা প্রকাশ করার আগেই নেহরু ব্যাঘাত দিয়ে বলেন “যদি পাঁচ সপ্তাহের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তাহলে আরো ভাল হয়”। জিন্নাহ সুদ্ধ বাকি সবাই রাজি হয়ে মাথা নাড়লেন। মাউন্টব্যাটেন দুই পক্ষ থেকে সই করা প্রতিজ্ঞালিপি নিলেন যে তাঁরা র‌্যাডক্লিফের বিচার আর সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন তা যেমনই হোক না কেন।
বাংলা আর পাঞ্জাবের  জন্য দুই সীমান্ত কতৃপক্ষ  নিয়োগ করা হোল। দুইয়েরই  প্রধান ছিলেন র‌্যাডক্লিফ। প্রত্যেক কতৃপক্ষে চারজন  জজ ছিলেন – দুই জন কংগ্রেস মনোনীত আর দুই জন মুসলিম লীগের। কিন্তু পক্ষভুক্ত হওয়ায় তাঁরা কোন ব্যাপারেই কোন সমঝোতায় পৌছাতে পারেন নাই। ফলে সমস্ত দায়-দায়িত্ব আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ন্যাস্ত হয় র‌্যাডক্লিফের ওপর। তিনি সমস্ত আদমশুমারি আর মানচিত্র যোগাড় করে দিনরাত সেগুলি পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেন। সীমারেখা টানা হবে মুসলিম অথবা হিন্দু সংখ্যাগুরু লাগোয়া এলাকার ভিত্তিতে। অবশ্য “অন্যান্য কারন” বিবেচনায় রাখা হবে। এই অস্পষ্ট সংজ্ঞা চেয়ারম্যানকে অনেক ক্ষমতা দেয়। অনেক বড় শহর বন্দর শিল্পাঞ্চল আর অন্যান্য অবকাঠামো সঠিক ভাগ করা সহজ কাজ নয়। তার উপর ভাগ করতে হবে এমন ভাবে যাতে প্রদেশগুলির অর্থনীতি আর স্বচ্ছলতা অটুট থাকে। এবং ভাগ করা উপমহাদেশে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক আর বানিজ্যিক স্বার্থ বজায় রাখার ব্যাপারও ছিল। সময় ছিলনা বিশাল উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যাবার। কাজেই জনসাধারনকে নিমন্ত্রন করা হোল দিল্লীতে। তাঁরা যেন সেখানে গিয়ে যুক্তি দেখান বিতর্কিত এলাকাগুলি কেন এক দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে, অন্য দেশের নয়।
বাংলার ব্যাপারে র‌্যাডক্লিফ কংগ্রেসের অনেক যুক্তিই মেনে নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার মুসলিম আর অ-মুসলিম জন সংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান সমান হবে আর হুগলি নদী বাঁচিয়ে রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ আর নদিয়া জেলার নদী ব্যাবস্থা আবশ্যক। ফলে মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম সংখ্যাগুরু সত্বেও পশ্চিম বাংলায় চলে যায়। এর উপর চা উৎপাদনকারি জেলা দার্জিলিং আর জলপাইগুড়িও পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশ্য জলপাইগুড়ির পাঁচটি থানা পূর্ব বাংলায় থাকে। খুলনা জেলা আর নদীয়া জেলার কিছু অংশ পূর্ব বাংলাকে দেওয়া হয়। নদীয়া জেলার অংশ দিয়ে নতুন কুষ্টিয়া জেলা গড়া হয়। আসামের মুসলিম সংখ্যাগুরু সিলেট জেলার বেশির ভাগই পূর্ব বাংলায় এসেছে – কারণ গনভোটে পাকিস্তানের সংগে যুক্ত করার দাবি তোলা হয়। কোলকাতা পশ্চিম বাংলায় যাওয়াতে পূর্ব বাংলার বড় রকম ক্ষতি হয়। কোন কোন মহল বলেন র‌্যাডক্লিফ বাংলা ভাগ করেছেন যথার্থ অস্ত্রচিকিৎসকের মত। কিন্তু দ্রুততার সাথে মানচিত্রে সীমানার রেখা টানতে এখনো মাটির উপর সঠিক ভাবে করা সম্ভব হয় নাই। কোন কোন এলাকায় সীমানা গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে – গ্রামের একভাগ গেছে পূর্ব বাংলায় অন্যভাগ পশ্চিম বংগে। আবার কোন কোন জায়গায় বাড়ির মধ্য দিয়ে সীমানা চলে গেছে – কিছু কামরা পড়েছে পূর্ব বাংলায় অন্যঘর পশ্চিম বংগে। পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলা মুসলিম সংখ্যাগুরু সত্বেও মাত্র একটা তহসিল ছাড়া বাকিটা দেওয়া হয় ভারতকে। শোনা যায় এটা করা হয় মাউন্টব্যাটেনের মাধ্যমে নেহরুর বিশেষ চাপ সৃষ্টি করার ফলে। এই কাজটা করানো হয়েছে যাতে মুসলিম সংখ্যাগুরু কাশ্মির রাজ্যে ভারত প্রবেশের সুবিধা পায়। কাশ্মির রাজ্য অমীমাংশিত রয়ে গেল যদিও প্রবেশের সুবিধার ফলে ভারতের রাজ্যপ্রাপ্তি অনেকটা সহজ হয়ে যায়। অ-মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পূর্ব বাংলাকে দেওয়া হয়। নেহরু আপত্তি করেন কিন্তু মাউন্টব্যাটেন বুঝিয়ে বলেন এটা করা হচ্ছে কারন পার্বত্য অঞ্চলের সাথে চট্টগ্রামের বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তা ছাড়া এতে চট্টগ্রামের মত বিশেষ শহর আর নৌবন্দরের কিছুটা নিরাপত্তার ব্যাবস্থাও হবে।
র‌্যাডক্লিফের রায় কাউকেই সন্তষ্ট করে নাই। মুসলিম লীগের ক্ষতি হয়েছিল বেশি। জিন্নাহ সাহেব তাঁর দেশের জনগনকে বুঝালেন “এটা অন্যায়, অবোধগম্য, আর বলা চলে বিকৃত রায়। এটা রাজনৈতিক রায়, বিচারকদের নয়। কিন্তু এই রায় মেনে নিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাজেই মেনে নিচ্ছি”। ভূমি পুংখানুপুংখরুপে ভাগ করার ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেনের গোপন হাত অনেকে সন্দেহ করে। এটা মনে রাখতে হবে তিনি মক্কেল ছিলেন আর র‌্যাডক্লিফ তাঁর উকিল। মাউন্টব্যাটেন নিজেই স্বীকার করেন যে অনেকে তাঁকে সন্দেহ করে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তগুলি তিনি নিজেই নিয়েছিলেন আর তার বেশির ভাগই গেছে ভারতের অনুকূলে। বড়লাট হিসাবে শেষ রিপর্টে তিনি লেখেন “আমার সন্দেহ হয় এই দেশের অনেক লোক ভাবে আমি এখনো বিষয়গুলির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারি”।
র‌্যাডক্লিফের কাজ ১৩ই আগষ্ট শেষ হয়।  কিন্তু মাউন্টব্যাটেন দুই  দিন সময় নিলেন। তিনি চেয়েছিলেন  ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানমালা সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত হবে – ১৪ই আগষ্ট পাকিস্তানের আর ১৫ই আগষ্ট ভারতের। দেশ বিভাগের সবিশেষ বর্ননা তিনি প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেন ১৬ই আগষ্ট আর তা ছাপা হয় পরদিন। সাম্প্রদায়িক দাংগার উত্তেজিত পরিবেশে অনুমান করা হয়েছিল কোন পক্ষই এই রায়ে সন্তুষ্ট হবেনা। এর ফলে প্রচন্ড বিস্ফোরন ঘটবে বিশেষ কয়েক এলাকায়, যেখানে গত এক বৎসর ধরে খুন আর অগ্নি সংযোগ চলছিল। ভূমি বন্টনের খুটিনাটি বর্ননা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল। প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ আর সেনাবাহিনী বিফলে জানায় অগ্রিম খবর পাবার –যাতে তারা দাংগা হাংগামার বিরুদ্ধে সতর্কতার প্রস্তুতি নিতে পারে। পাঞ্জাবের গভর্নর তার পাঠিয়ে অনুরোধ করেন যেন অন্তত কয়েক ঘন্টা আগেও তিনি জানতে পারলে পরিস্থিতি মোকাবিলার কিছুটা প্রস্তুতি নিতে পারবেন। দেশ ভাগের ফলে শেষ পর্যন্ত এক কোটি কুড়ি লক্ষ লোক ঐ সময়ে সীমান্ত পারাপার করে। এই যাযাবরের মত যাতায়াতের পথে ছিল ওনেক ভীতি আর খুন খারাবি। ব্রিটিশের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ থেকে দশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।
কাজ শেষ হতেই র‌্যাডক্লিফ ঝটপট সুটকেশ গুছিয়ে তড়িঘড়ি করে চলে  গেলেন। ১৪ই আগষ্ট তাঁর সৎ ছেলেকে লেখেন “আট কোটি অসন্তষ্ট লোক আমার সন্ধান করবে। চাইনা তারা আমাকে খুঁজে পাক”। খুন হবার তাঁর এতই আশংকা ছিল যে প্লেনটা সম্পূর্ন তল্লাসি করা হয়। ভারত স্বাধীন হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ১৫ই আগষ্ট তাঁর প্লেন আকাশ যাত্রা শুরু করে।
স্যার সাইরিল তাঁর কাজের জন্য কোন পারিশ্রমিক নেন নাই। ভারত উপমহাদেশের মানচিত্রে যে রেখা টেনেছেন তা জনসাধারনকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ফলে যুগ যুগ ধরে সংঘর্ষ হয়েছে। তিনটা যুদ্ধ বেঁধেছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তদের দুঃখ দুর্দশা হয়েছে। স্বাধীনতা এসেছিল বহুমূল্যে।

অনুবাদ - ওয়াজেদা  ও শহীদুর রব
সর্বশেষ আপডেট ( সোমবার, ১৪ জুলাই ২০১৪ )

No comments:

Post a Comment