Monday 21 March 2016

টিপ্পনি- রাজনীতির তৃতীয় পরিসর



টিপ্পনি : রাজনীতির তৃতীয় পরিসর

Standard

শস, ন-ডি২০১৪, মসা
সাধারণভাবে রাজনীতিকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক হিসেবে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। তবে একটু ভাবলেই আমরা বুঝতে পারি, ক্ষমতার অনেক প্রকারভেদ আছে। রাজনীতি যে ক্ষমতাটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়, তা রাজনৈতিক ক্ষমতা। তবে এই ক্ষমতাটি খুবই পরাক্রমী, তার সামনে অন্যান্য ক্ষমতা অনেক ম্লান।
রাজনৈতিক ক্ষমতা কী? সামাজিক মানুষের বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার ফারাকের ভারসাম্য রক্ষার পরাক্রম। সামাজিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ফারাক অনেকটাই তৈরি হয় তার অবস্থান দিয়ে। লিঙ্গগত, জাতিগত, জাতগত, শ্রেণীগত, গোষ্ঠীগত, ধর্মগত অবস্থান, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি অবস্থান খুব সুনির্দিষ্ট এবং তা অন্যটি থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা। এই অবস্থানজনিত আশা আকাঙ্ক্ষাগুলির দরকষাকষি এবং তার সমাধানের মাধ্যমে মূলত ওই অবস্থানগুলিকেই আরও দৃঢ় করা এক ধরনের রাজনীতি। এক্ষেত্রে ক্ষমতার আরেকটি অতিরিক্ত ভূমিকা আছে। তা এই ভারসাম্যের দেখভাল করে। ভারসাম্যটি রক্ষার জন্য রয়েছে যে হাতিয়ারগুলি, সেগুলির দেখভাল করে। এটাকেই আমরা বলি রাষ্ট্র। আর ভারসাম্য রক্ষার হাতিয়ারটি কখনও আপাতদৃষ্টিতে খুব উদার হয়, আবার কখনও তা খড়্গহস্ত। যখন যেমন প্রয়োজন তখন তেমন আর কি। এই রাজনীতির পরিসরটি প্রথম পরিসর। এই রাজনীতি সামাজিক বিভাজনগুলিকে দুর্বল করে না, বরং বিভাজনগুলি ঠিকঠাক থাকার মধ্যেই এই রাজনীতির সার্থকতা, কারণ কেবল তাহলেই ‘ভারসাম্য রক্ষা করা’র কাজটি প্রাসঙ্গিকতা পায়।
তবে রাজনীতির এই প্রথম পরিসর স্থিতিমূলক। কিন্তু সমাজ তো প্রাণবন্ত, কম্পনশীল। তাই তা সদাসর্বদা নতুন নতুন অবস্থানের জন্ম দেয়। আবার হয়তো মিলিয়েও যায়। অনেক সময়ই তা চিরাচরিত অবস্থানগুলিকেও এমনকী আড়াআড়ি ভেঙে দিতে পারে। আবার কখনো তা চিরাচরিত অবস্থানগুলির মধ্যেই কোনোটির অনুরূপ কিছু, কিন্তু চিরাচরিত নয়, গজিয়ে ওঠা (যেমন শ্রেণীগত বিভাজনের মধ্যে বিত্তগত বিভাজন বা উপার্জনগত বিভাজন)। নয়া অবস্থান নয়া আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসে। তা প্রথম পরিসরের দরকষাকষিকে প্রশ্ন করে। ফলে ভারসাম্যের চালু রূপটিকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে নয়া রূপ দাবি করতে থাকে। এ এক বিরোধিতার পরিসর। সমাজের প্রাণবন্ততা, কম্পনশীলতার সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগ। চিরাচরিত বিভাজনগুলিকে অস্বীকার করে নয়া বিভাজিকা নির্মাণে এর ঝোঁক। আমরা একে বলছি রাজনীতির দ্বিতীয় পরিসর।
উপরোক্ত দুটি পরিসরই সামাজিক বিভাজন এবং তাদের মধ্যেকার ভারসাম্যের রাজনীতির পরিসর। যেন দুইয়ে মিলিয়ে এক বৃহত্তর পরিসর — বিভাজনের বাস্তবতা বা আবশ্যকতা এবং তাদের মধ্যেকার ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা — এটাই নির্মাণ করে এই রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরটি। তাই এই দুটি পরিসরই বাস্তব পরিসর।
সমাজে রাজনীতি বলতে মূলত এই দুটি পরিসরকেই বোঝায়।
তবে রাজনীতির আরেকটি পরিসরও রয়েছে। আমরা তাকে তৃতীয় পরিসর বলছি। মানুষ তার সৃষ্টিশীলতার কারণেই নতুন নতুন অবস্থান তৈরি করে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেই নতুন অবস্থানগুলি তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনা নিয়ে হাজির হয়। এই অবস্থানগুলি বিভাজনগুলিকে গুরুত্ব দেয় না। সমস্ত রকম সামাজিক বিভাজনের মধ্যে মধ্যে উজিয়ে ওঠা এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, কিন্তু অসীম সংখ্যক অবস্থান সামাজিক বিভাজনগুলিকে আবছা করে। তার ফলশ্রুতিতে ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তাকেও লঘু করে। কিন্তু এগুলি নিজেরা এতই ক্ষুদ্র যে কিছুতেই সেগুলি নিজে কোনো বিভাজিকা হয়ে ওঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একক ক্ষুদ্র অবস্থান ক্ষণস্থায়ী এবং তা মিলিয়ে যায়। কখনো কখনো প্রথম পরিসরের মধ্যে এসে যায় তার কুশীলবরা। কখনো কখনো কোনো কোনো ক্ষুদ্র অবস্থান কম্পনশীল সমাজের বদান্যতায় দ্বিতীয় পরিসরের অবস্থানে সরে যেতে পারে। তখন আর তাকে পৃথক অবস্থান হিসেবে দেখা যায় না। আবার অন্য কোথাও গজিয়ে ওঠে আরেকটি একক অবস্থান। কিন্তু দুনিয়া জুড়ে এইরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য অবস্থানই তৈরি করে রাজনীতির তৃতীয় পরিসরটি — যার একক অবস্থানগুলি সতত জন্মাচ্ছে আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিসরটি এতই বিচিত্র এবং এর একক অবস্থানগুলি এতই দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী, যে এর কোনো প্রতিনিধিত্ব হয় না (কিন্তু অন্য দুটি পরিসরে হয়, কারণ তা বিভাজনমূলক অবস্থানের পরিসর)।
বিভাজন না থাকা, ভারসাম্য না থাকা, প্রতিনিধি না থাকার কারণে প্রায়শই এই পরিসরটিকে রাজনীতির পরিসর বলে মনে হয় না। সমাজও একে রাজনীতির পরিসর হিসেবে বুঝতে পারে না। রাজনীতির সামাজিক ধারণার প্রকোপে এই পরিসরের অবস্থানগুলিও নিজেদের রাজনীতির পরিসর বলে বুঝতে পারে না। কিন্তু যেহেতু এই পরিসরটি সামাজিক বিভাজনকে ঝাপসা করে দেয় বা হালকা করে দেয়, ভারসাম্যর প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, প্রতিনিধিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় — তাই এই পরিসরটি অবশ্যই একটি রাজনীতির পরিসর।
তবে এই পরিসরটি সম্পূর্ণভাবে কল্পিত বা বানিয়ে তোলা পরিসর নয়। মানুষের সৃষ্টিশীলতা এই অবস্থানগুলির উৎস হলেও সমাজের স্থিতি এবং কম্পনশীলতা নিরপেক্ষ নয় এ পরিসর। যত দিন যাচ্ছে, তত বোঝা যাচ্ছে, এই পরিসর একটি ঘোরতর বাস্তবতা। এই পরিসরটির আত্মোপলদ্ধির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ অন্য পরিসরগুলোতে বা অন্য কোনো কিছুতে উপনীত হওয়ার নয়, বরং বিভাজনগুলি থেকে মুক্তির।
মানুষের সৃষ্টিশীলতা এই পরিসরের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, যেন বা সমাজের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত, অবাস্তব পরিসর। কিন্তু আদপে এই পরিসর সমাজের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত নয়, বরং সমাজের বৈচিত্র্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এটি কোনো শিল্পকলা (আর্ট) নয়। তবে অনেকসময়ই এই পরিসরের একক অবস্থানগুলির ক্ষণস্থায়িত্ব, দুর্বল অবস্থা এবং যে কোনো
জায়গায় গজিয়ে ওঠা, অর্থাৎ সমাজের বৈচিত্র্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশকে, ভুল করে শিল্পকলা (আর্ট) অথবা সমাজবিচ্ছিন্নতা বলে মনে হয়।
এই তৃতীয় পরিসর মাইক্রোফ্যাসিজম এবং আত্মঘাতী প্রবণতা মুক্ত নয়। মাইক্রোফ্যাসিজম অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিসরেও যে ফ্যাসিবাদ কাজ করে, ক্যানসারের মতো, দ্রুত ধ্বংস ডেকে আনে। আত্মঘাতী প্রবণতা মাইক্রোফ্যাসিজমের মতোই, আত্মধ্বংসকারী।
সমাজজীবনে অন্তর্লীন রাজনীতির তৃতীয় পরিসর। উল্লেখ্য, পুঁজিবাদও সমাজে অন্তর্লীন একটি ব্যবস্থা।

No comments:

Post a Comment