Monday 4 July 2016

রোহিঙ্গার নারীরা - আশু মালিক

জীবন বাঁচাতে বিক্রি হচ্ছেন রোহিঙ্গা নারীরা.....!!....
রোহিঙ্গা নারীরা দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারায় এমনকি প্রাণটাও। এর মধ্যে মেয়েদের অনেকে বিক্রি হয়ে যায়, কেউ রক্ষা পায় বিয়ে করার শর্তে। এই দেশহীন মানুষদের করুণ কাহিনী নিয়েই একটি হৃদয়স্পর্শী প্রতিবেদন ছেপেছে মার্কিন দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। Rohingya Women Flee Violence Only to Be Sold Into Marriage এই শিরোনামে তারা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে গত ২ আগস্ট। সেটিরই সংক্ষেপিত অনুবাদ তুলে ধরা হলো:
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠী উৎখাতের প্রক্রিয়া চলছে বহু দিন থেকেই। এমনকি দেশটির সামরিক সরকার সরাসরি এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও মেয়েরা ধর্ষণেরও শিকার হচ্ছে। এই অমানবিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলারে করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে পাড়ি দেয়।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ২২ বছরের শাহিদাহ ইউনুসের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা। সহিংসতা থেকে বাঁচাতে মেয়েকে নিরাপদে মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে মানবপাচারকারী দালালদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাবা-মা। তাকে নিয়ে রাখা হয়েছিল মানবপাচারকারীদের শিবিরে। পাচারকারীরা তাকে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দিতে এক হাজার ২৬০ ডলার দাবি করে। কিন্তু এতো টাকা দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশেষে একদিন এক অপরিচিত লোক এসে তাকে বললো, মুক্তি পেতে চাইলে হয় তাকে ওই টাকা দিতে হবে নতুবা তাকে কাউকে বিয়ে করতে হবে। পাচারকারীরা শাহিদাহকে তার বাবা-মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ করে দেয়।
শাহিদাহ বলেন, ‘আমাকে বাবা-মার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। তারা আমাকে জানান, বিয়েতে যদি আমার মত থাকে তাহলে পুরো পরিবারের জন্য সেটা ভালো হয়। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে কী করতে হবে।’
শেষ পর্যন্ত শাহিদাহকে ওই সব রোহিঙ্গা নারীদের কাতারে শামিল হতে হলো, যাদেরকে টাকার বিনিময়ে মালেয়শিয়ায় রোহিঙ্গা পুরুষদের কাছে বিয়ে দেয়া হয়। পাচারকারীদের কারাগার থেকে মুক্তি অথবা তাদের হাতে আরও বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে এটা মেনে নেয়াই ভালো। আর এটা হচ্ছে মাতৃভূমিতে চলমান সহিংসতা ও দারিদ্রতা থেকে বাঁচার মূল্য।
এ ধরণের ঘটনার শিকার নারীদের প্রকৃত সংখ্যা নিরুপন মুশকিল। তবে কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীদের অনুমান সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শতাধিক ( হাজার নাও হতে পারে) রোহিঙ্গা নারীকে এ ধরনের বিয়ে করতে হচ্ছে। আর এ সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছেই।
জাতিসংঘের শরণার্থি বিষয়ক কমিশন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অপহরণ ও অসম্মতিতে যে সব নারীদের বিয়ে হয় তাদের মূল্য শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যৎ স্বামীরা দেয়।
ব্যাংকেকে রোহিঙ্গা শরণার্থিদের পর্যবেক্ষণকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফোরটিফাই রাইটস নামে একটি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, ‘শতাধিক, সহস্রাধিক নাও হতে পারে নারী ও কিশোরীকে ২০১২ সাল থেকে এই পাচার পথে জোর করে ও বিক্রির মাধ্যমে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। টিকে থাকার প্রক্রিয়া হিসেবে একে অনেক পরিবার ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। পাচারকারী চক্র একে লাভজনক ব্যবসা হিসেবেই দেখছে।
শাহিদাহ এখন মালয়েশিয়ার পেনাংয়ে ৩৮ বছরের রোহিঙ্গা পুরুষের সঙ্গে সংসার করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ আমাকে মুক্তির জন্য পাচারকারীদের অর্থের প্রয়োজন ছিল। আমাদের ধর্ষণের ভয় ছিল। একজন রোহিঙ্গা পুরুষকেই বিয়ে করা উত্তম যে আমাদের দেখভাল করতে পারবে।’
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থি শরীফা শাকিরাহ জানান, পাচারকারীদের হাতে আটক অনেক নারীই মনে করেন, যদি তারা দ্রুত স্বামী খুঁজে না পায় তাহলে তাদেরকে থাইল্যান্ড অথবা ভারতে পাচারকারীরা যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দিবে।
তবে অনেকে আবার কোন কিছুরই পরোয়া করে না। পাচারের শিকার ১৫ বছরের এক কিশোরীর কথা উল্লেখ করে ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, ওই কিশোরী তার পাচারকারীদের বলেছিল, সে কোন কিছুরই পরোয়া করে না। সে বিয়ে করবে না।
শরীফা শাকিরাহ জানান, অল্প বয়স্ক কন্যাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন বাবা-মা নিরাপত্তার জন্য এবং বাড়ির বোঝা কমাতে অথবা পাচারকারীদের কাছে শোনা মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের লোভনীয় গল্পে প্রভাবিত হয়ে তরুণীদের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, পাচারকারীদের জাহাজে টাকা ছাড়া কোন নারী উঠলেই সে বিক্রিযোগ্য পণ্য হয়ে গেল। মুক্তির জন্য কেউ টাকা দেয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ক্যাম্পে অথবা নৌকায় আটকে রাখা হয়। পাচারকারী যখন জানতে পারে ওই নারীর জন্য টাকা দেয়ার কেউ নেই তখন সে লোকদের জানায় তাদের কাছে এই নারীটি রয়েছে।
ভবিষ্যতের সেই স্বামী বয়স্কও হতে পারে আবার দরিদ্রও হতে পারে। অনেক নারীকেই শেষ পর্যন্ত অসুখী জীবন ও নীপিড়নমুলক সম্পর্কের ফাঁদে পড়তে হয়।
দুই বছর আগে ২১ বছরের আম্বিকা খাতু মালেয়শিয়ায় এক লোককে বিয়ে করেছিলেন যে তার মুক্তির জন্য ১ হাজার ৫০ ডলার দিয়েছিল পাচারকারীদের।
তিনি তার স্বামী সম্পর্কে বলেন, ‘আমার তুলনায় তার বয়স অনেক বেশি। তারপরও আমার মা বিয়েতে সম্মত ছিল। আমাদের কোন উদ্ধারকারী ছিল না। তাই আমি রাজী হয়েছি।’
আম্বিকা মিয়ানমারে নার্সিং নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল হাসপাতালে কাজ করতে। বর্তমানে তাকে অসুস্থ মা, বোন ও তার শিশুর সঙ্গে একটি ঘরে জুবুথুবু হয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।
আম্বিকা বলেন, ‘পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধারের পর আমার স্বামী জানতে চেয়েছিল তাকে আমি বিয়ে করতে চাই কিনা।
তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখে স্বামী বলেছিল, যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে না চাও, তাহলে তোমার পেছনে যা খরচ করেছি তা ফেরত দাও, ব্যাস তাতেই চলবে।’
আম্বিকা বলেন, ‘আমি এখানকার ভাষা জানি না। তাই তাকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চাকরি করবো কিভাবে? তাছাড়া আমাদের এখানে কোন আত্মীয়-স্বজন নেই এবং আমার কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। তাই তাকে বিয়ে করা ছাড়া আমার কোন উপায় নেই।’
আম্বিয়ার মা মাবিয়া খাতু বলেন ‘ আমি যদি তার হাতে আমার মেয়েকে তুলে না দেই তাহলে পাচারকারীরা তাকে কোন বাজে হাতের কাছে বিক্রি করে দিতে পারতো। পাচারকারীরা আমার দুই মেয়েকেই বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। তাই আমি তাদের বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। এখন সে নিরাপদ হাতে রয়েছে এবং অন্তত খাবারতো খেতে পারবে।’
LikeShow more reactions
Comment

No comments:

Post a Comment