Tuesday 12 July 2016

প্রসঙ্গঃ সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িকতা --------------------- বদরুদ্দীন উমর


বদরুদ্দীন উমর।।
৫ জুন যুগান্তরে আমার প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ প্রকাশিত হওয়ার পর তার বক্তব্য নিয়ে ‘ফেসবুকে’ বহু মন্তব্য ও প্রবন্ধ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজে ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করি না। কয়েকজন বন্ধু কতকগুলো লেখার প্রিন্ট কপি আমাকে দেয়ায় আমি তার মধ্যে বাছাই করে কয়েকটি পড়েছি। এত অধিক সংখ্যায় এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হতে দেখে আমি একটু বিস্মিত হয়েছি। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অনেকগুলো আমার বক্তব্যের বিরূপ সমালোচনা, যার মধ্যে গালাগালিও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে মননশীলতা ও সিরিয়াস চিন্তার অভাব খুব প্রকট। যে ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক ব্রিটিশ, এমনকি পাকিস্তানি আমলেও দেখা যেত তার কোনো ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা বাংলাদেশে আর থাকেনি বললেই চলে। রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই প্রকৃত বিতর্কের স্থান দখল করেছে গালাগালি। অবস্থা এমন যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবতারণা কেউ করলেও তার জবাবে বিতর্কের পরিবর্তে পাওয়া যায় গালাগালি, এমনকি ব্যক্তিগত কুৎসা। শুধু তাই নয়, দর্শন, সাহিত্য সমালোচনা বলেও কোনো কিছু বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার মধ্যে নেই। চিন্তা ও মননশীলতার এ হতদরিদ্র অবস্থায় বাংলাদেশকে মনে হয় একটা ডোবার মতো স্থির ও নিস্তরঙ্গ। এ নিস্তরঙ্গ ডোবায় তরঙ্গ সৃষ্টির একটা পথ হল, চিন্তা ক্ষেত্রে যথার্থ বিতর্ক এবং মননশীলতার গুরুতর চর্চা। এ পরিস্থিতিতে গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক ভালো। আমার প্রবন্ধটি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ব্যক্তিই বিতর্কের ব্যাকরণ বিষয়ে নিরীহ। কাজেই তাদের ক্ষেত্রে বিতর্কের নামে এমন বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে যাতে তথ্যের উপস্থিতি ও যুক্তির জোর নেই। এটা বিদ্বেষেরই পরিচায়ক। মূল বিষয়ে আলোচনার আগে এসব কথা কেন বলা প্রয়োজন হল, এটা ফেসবুকে প্রকাশিত লেখাগুলো যারা পড়েছেন তাদের পক্ষে বোঝার অসুবিধা হবে না। কিন্তু যারা সেগুলো পড়েননি, তাদেরও এ বিষয়ে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা এখানে করা হল।

সংখ্যালঘু প্রশ্ন নতুন নয়, যদিও ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে এ প্রশ্ন ছিল না। ভারতে শব্দটির প্রচলন করেছিল ইংরেজরা। তারা ভারতীয়দের শিখিয়েছিল সংখ্যালঘুর অর্থ হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে কোনো দেশে যাদের সংখ্যা কম। সংখ্যাগুরু তারা যাদের সংখ্যা বেশি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকে ভারত ত্যাগের আগ পর্যন্ত তাদের এ তালিম শিরোধার্য করেই ভারতে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলতে সব সময়েই এ বিভাজনের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে ধর্মকে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও হয়েছে এভাবে। রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণও ঘটেছে এরই সূত্র ধরে। ইংরেজের দেয়া শিক্ষা যে ১৯৪৭ সালের এতদিন পরও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষিত লোকদের- বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ইত্যাদির- মস্তিষ্ক শাসন করছে তার প্রমাণ এখনও পর্যন্ত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বলতে তারা বোঝেন, বা প্রধানত বোঝেন, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু। যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মবিযুক্ত (Secular) বলেন, তারাও চিন্তার এই বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খান! ইংরেজের ধর্ম শিক্ষার হাত থেকে তাদেরও নিস্তার নেই!!

এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী নমঃনম করে অন্য ধরনের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর একটা অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তারা ধর্মীয় মানদণ্ডেই জনগণকে বিভক্ত করে অন্যদের বোঝাতে চান, এটাই সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কাজেই এ সমস্যার সমাধান হলেই সমাজে সমতা, ঐক্য, শান্তি সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হবে! এ চিন্তা করতে গিয়ে সমাজের সব থেকে মৌলিক দ্বন্দ্ব, শ্রেণী দ্বন্দ্বের বিশেষ কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। এ বিষয়ে একটু পরেই আরও কিছু আলোচনার প্রয়োজন হবে।

‘ফেসবুকে’ যারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য পৃথকভাবে আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়। তার অন্যতম কারণ এসব লেখালেখির সংখ্যা। কাজেই আমি তাদের বিতর্কের মধ্যে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি সেগুলো নিয়েই কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করব। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বলা দরকার, বেশ কয়েকটি লেখা বা কিছু মন্তব্য একেবারেই আবর্জনাতুল্য। আমার প্রবন্ধটির ওপর যোগ্যতার সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে এসব লেখার মালিকরা আমার সারা জীবনের যা কিছু কাজ সব শিকেয় তুলে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছে যে, আমি ‘দগদগে হিন্দু-বিদ্বেষে পূর্ণ’, ‘মুসলিম জাত্যাভিমানের কারণে আমি মাংসকে গোস্ত বলি’, আমি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অর্থাৎ হিন্দুদের খারিজ করেছি, আমি বলেছি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মূল নিয়ামক, আমি বলেছি বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি, হিন্দুরা বাংলাদেশে মহাসুখে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের মিথ্যা ও উদ্ভট আবোলতাবোল কথার শেষ নেই। এসব যারা লিখেছেন তাদের মন্তব্য ও বক্তব্য আলোচনার সম্পূর্ণ অযোগ্য।

কোনো কোনো বক্তব্য আছে যা অজ্ঞতার ফল। যেমন একজন বলছেন, আমার যুক্তি ‘সাম্প্রদায়িকতাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিচার থেকে দেখার দোষে দুষ্ট’। আমার অবস্থান সম্পর্কে এর থেকে বিভ্রান্তিকর ও অজ্ঞ বক্তব্য আর কী হতে পারে? আমিই এ দেশে প্রথম সাম্প্রদায়িকতার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশ করে তার হাজারো দিক সম্পর্কে আলোচনা করে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান আমলে ষাটের দশক থেকে সংগ্রাম করে আসছি। পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমার প্রথম তিনটি বইয়ের নাম ছিল ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’। সে বইগুলোতে সাম্প্রদায়িকতাকে কি শুধু অর্থনৈতিক বিচারে দেখা হয়েছে? এ দেশের সাম্প্রদায়িকবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে একজন কতখানি অজ্ঞ থাকলে একথা বলা সম্ভব এটা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, আমি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছিলাম এবং তার ভিত্তিতে শুধু সাম্প্রদায়িকতাই নয়, পরবর্তীকালে ধর্মের সব ধরনের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেই যেভাবে সংগ্রাম করেছি তার পরিচয় আমার অজস্র প্রবন্ধের মধ্যে আছে যেগুলো গ্রন্থবদ্ধও হয়েছে। কাজেই আমি সাম্প্রদায়িকতাকে শুধু অর্থনৈতিক বিচারেই দেখি এটা অজ্ঞতাপ্রসূত ফল যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই দুরভিসন্ধিমূলক।

এটা আমি অবশ্যই বলেছি যে, সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তি অর্থনৈতিক এবং সে ভিত্তি অপসারিত হলে সাম্প্রদায়িকতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাম্প্রদায়িকতার অন্য কোনো দিক নেই। শুধু তাই নয়, এ অন্য দিকগুলোর আলোচনাই আমার উপরোক্ত তিনটি বইয়ের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে আছে। বাইরের পরিচয় যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদবিরোধী লোকদের এক পরিচিত অভ্যাস হল এটা বলা যে, মার্কসবাদীরা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে গ্রাহ্য মনে করে না। খোদ মার্কসের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সমালোচকদের এ ধরনের কথাবার্তার অভাব নেই, যাকে মিথ্যা ও কুৎসা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

এ দেশে বামপন্থীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, গ্রামাঞ্চলে এখনও জনগণের সঙ্গে প্রধান দ্বন্দ্ব সামন্তবাদের। এ বক্তব্যের যে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে যাদের যথার্থ পরিচয় আছে এবং এ পরিস্থিতি ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তারা জানেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে অর্থনীতি ক্ষেত্রে সামন্তবাদের অতি সামান্য কিছু অবশেষ থাকলেও সমাজের উপরিকাঠামোতে সামন্তবাদের প্রভাব এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের একটা বিরাট অংশের চিন্তা-চেতনাতেও সামন্তবাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। এ উপস্থিতির মূলে তাদের মধ্যে এক ধরনের ধার্মিকতারও অভাব নেই। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। অর্থনীতিতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি না থাকলেও সমাজের উপরিকাঠামোতে তার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, যা আমি আমার অনেক লেখাতেই বলেছি। ভিত্তিভূমিতে বিপ্লবী পরিবর্তন হলেও উপরিকাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে।

সাম্প্রদায়িকতা হল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের একটি রূপ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মের সব থেকে পরিচিত ও শক্তিশালী রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে যেভাবে ভারত বিভক্ত করেছিল, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত ছিল। সে চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেরই স্বাধীনতা-উত্তর রূপ। এদিক দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির মধ্যে প্রথম থেকেই পার্থক্য সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলায় অধিকাংশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকরা ছিল ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং মুসলমানরা ছিল বিপুল অধিকাংশই প্রজা, ভাগচাষী, খাতক ও দরিদ্র ক্রেতা। ১৯৪৭ সালের পর এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য দ্রুত কমে এসে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলমান জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব যেভাবে ছিল তার অবসান ঘটে। সাম্প্রদায়িকতার অর্থনৈতিক ভিত্তি অপসারিত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির অসাম্প্রদায়িকীকরণ। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের ভিত্তি বিনষ্ট হওয়ার ফলে মুসলিম লীগ পাকিস্তানে শাসক দল হলেও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিলুপ্ত হয়। তারপর এখানে উত্থান হয় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির, যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে অগ্রসর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর না থাকায় তারা নাম পরিবর্তন করে হয় ‘আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িকীকরণ ছাড়াও পূর্ববাংলায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং গণ ও শ্রেণী সংগঠন গড়ে ওঠে। এক কথায়, সাম্প্রদায়িকতার পর এখানে উত্থান ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জনগণ সাম্প্রদায়িকতা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত হয়ে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাঙালিরই রাজনৈতিক বিজয় হয়েছিল। তারা এ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল শাসক শ্রেণীতে। এ কথা কি বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শুধু মুসলমান বাঙালিরাই ক্ষমতাসীন হয়েছিল, আর হিন্দুরা পাকিস্তান আমলের মতোই থেকে গিয়েছিল শাসক শ্রেণীর বাইরে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু হিসেবেই? সেটাই কি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ‘মহান’ বিজয়? আমি হিন্দুদের বাঙালি শাসক শ্রেণীর অংশ বলায় যারা আমার ওপর গালিবর্ষণ করে নিজেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, তারা কি এভাবে হিন্দুদেরকে বাঙালি মুসলমান থেকে পৃথক করে বাঙালি হিন্দুকে হিন্দু হিসেবে শাসক শ্রেণীর বাইরে রেখে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার অপচেষ্টায় লিপ্ত নন?

কেউ কেউ বলেছেন, আমি হিন্দুদের শাসক শ্রেণীর অংশ বলেছি; কিন্তু হিন্দু গরিব ও শোষিত-নির্যাতিতরা কি শাসক শ্রেণীর অংশ? এ ধরনের বালখিল্য কথাবার্তা থেকে মনে হয়, বাংলাদেশে বিতর্কের মানের কোনোই উন্নতি হয়নি। যারা এভাবে প্রগতিশীলতার নামে বিতর্ক করেন, বিতর্কের ব্যাপারে তাদের দক্ষতার নামগন্ধ নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হল ‘শ্রেণী’। আমি শাসক শ্রেণীর কথা বলেছি। বাংলাদেশের হিন্দুদের মতো মুসলমান বাঙালিরা শাসক শ্রেণীর অংশ। তার অর্থ কি এই যে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, এরশাদ এবং তাদের দলের সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিদের মতো গ্রামের গরিব, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ নিু মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগণও শাসক শ্রেণীর লোক? তারা একই শ্রেণীভুক্ত? তাই যদি হয়, তাহলে শাসক শ্রেণী কাকে শাসন করে? এসব খুব মামুলি কথা। এখন যারা এ বিতর্কের নামে আমার ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সমালোচনার নামে গালাগালি করছেন, তাদের চিন্তায় তো এটা নেই যে, শ্রেণী ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের ও বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উপরন্তু হিন্দু ধর্মে বর্ণ প্রথার জন্য উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সঙ্গে নিুবর্ণের হিন্দুর পার্থক্য আরও বেশি। তাদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আরও দুস্তর। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গয়েশ্বর রায় এবং তাদের মতো হিন্দুরা কি বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর লোক নন? তা যদি না হয়, তাহলে যারা এ নিয়ে বিতর্ক করছে, তারা শ্রেণী ও শাসক শ্রেণী বলতে কী বোঝেন?

আমার মূল বক্তব্য এ ক্ষেত্রে হচ্ছে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকের ওপর নির্যাতন হলে সেটা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হবে এমন কোনো কথা নেই! শ্রেণী নির্যাতনই সব থেকে নিষ্ঠুর নির্যাতন, হিন্দু ধর্মে যার একটা পরিচয় পাওয়া যায় নিু বর্ণের হিন্দু বা দলিতদের ওপর উচ্চ বর্ণের নির্যাতনের মধ্যে। এ নির্যাতন কি বাংলাদেশের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা নিু বর্ণের হিন্দুর ওপর করেন না? গরিব হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর যে চরম নির্যাতন হয়, এটা অস্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে না। দীর্ঘদিন ধরে এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি লিখেছি অসংখ্যবার। আমার এসব লেখা আমার অনেক বইয়ের মধ্যে আছে। বেশি আগের কথা বাদ দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির লোকজন ক্ষমতায় এসে যখন হিন্দুদের বাড়িঘরের ওপর আক্রমণ ও তা লুটপাট করেছিল, তখন আমি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লিখেছিলাম। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে পাবনা জেলার সাতক্ষীরায় গরিব হিন্দুদের ওপর আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ও নেতারা যে আক্রমণ করেছিল, তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে তাদের ঘরছাড়া করেছিল, তার বিরুদ্ধেও আমি একইভাবে আমার একাধিক লেখায় প্রতিবাদ করেছিলাম। এসব কথা যে আমাকে এখানে লিখতে হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের জবাবে, এটা এ দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এক মস্ত ট্রাজেডি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিপুলসংখ্যক হিন্দু দেশ ত্যাগ করছেন, এটা এক মহাসত্য। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে গিয়ে এ কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন হিন্দুদের দেশত্যাগের জন্য আমিই দায়ী! হিন্দুরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেন দেশত্যাগ করছেন, এটা জিজ্ঞেস করতে হবে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বকে। স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের শাসনভার তাদের ওপর থাকার সময় এ ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কার? ক্ষমতাসীন বাঙালিদের সরকারের, না যে পাকিস্তানিদের এখান থেকে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের? এটা তো এখন বেশ পরিষ্কার, এমনকি হিন্দুদের কাছেও পরিষ্কার, ১৯৭২ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের লোকজন, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং গুণ্ডাপাণ্ডারা হিন্দুদের সম্পত্তি ব্যাপকভাবে লুটপাট করেছে, তাদের জমিজমা, ভিটেবাড়ি দখল করেছে। এ অপকর্ম যাতে কিছুটা আইনের আওতায় সম্পূর্ণভাবে করা যায় সেজন্য ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানি আমলের ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র বাংলাদেশে উচ্ছেদ না করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে তাকে পুরোপুরিই বহাল রেখেছিল। এভাবে রেখে আওয়ামী লীগের লোকেরা যেভাবে হিন্দু সম্পত্তি লুটপাট ও দখল করেছিল সেটা পাকিস্তানি আমলেও দেখা যায়নি। এছাড়া হিন্দুদের দেশত্যাগের অন্য একটি কারণ হল, ভারতে বর্ণবাদী হিন্দুদের দ্বারা এখানকার হিন্দুদের দেশত্যাগের জন্য উসকানি দেয়া। এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার কারণে হিন্দুদের বসবাস অসম্ভব এ কথা অহরহ প্রচার করা। এ উসকানি ও প্রচারণার স্পষ্ট ও প্রকাশ্য প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে ভারতের বিজেপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের এ মর্মে ঘোষণা থেকে যে, বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা ভারতে যাবে শরণার্থী হিসেবে, তাদের স্বাগত জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে এবং যে মুসলমানরা যাবে, যেমন আসামে, তাদের সেখান থেকে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হবে!! কিন্তু এ প্রসঙ্গে অবশ্য বলা দরকার, হিন্দুদের দেশত্যাগের প্রধান কারণ গরিব হিন্দুদের জমিজমা, ভিটেবাড়ির ওপর আক্রমণ ও তা দখল করা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রত্যেক সরকারের আমলে এটা হলেও আওয়ামী লীগই সব থেকে বড় আকারে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এ অপরাধমূলক কাজ করেছে। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের নিকট সম্পর্কের জন্য এখানকার হিন্দুরা বরাবর আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে এসেছেন। মাত্র কিছুদিন আগে বিজেপির এক নেতা তথাগত রায় (এখন ত্রিপুরার রাজ্যপাল) বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের এক সভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে হিন্দুরা বরাবর ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন তাদের উচিত প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়ানো এবং তাকে ভোট দেয়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ হিন্দুদের ওপর সব থেকে বেশি ও বিপজ্জনক নিপীড়নকারী হলেও ভারত সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এ সম্পর্কের কারণে হিন্দুদের মধ্যে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের চরিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি থেকেছে। এখনও তা আছে, তবে আগের মতো যে আর নেই এটা এখন বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন ও নেতার কিছু বক্তব্য থেকেই দেখা যাচ্ছে।

আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে এখন যারা সব থেকে কুৎসিত ভাষায় বিষোদগার করছে এবং নানা ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা বলছে, তারা আওয়ামী ঘরানার লোক ও প্রধানত সিপিবির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা সবারই জানা, তবু গুরুত্বের জন্য এখানে আবার বলা দরকার, আওয়ামী লীগ ও সিপিবি প্রকৃতপক্ষে আদর্শগতভাবে অভিন্ন। পাকিস্তান আমল থেকেই তাদের এ অবস্থা। বাংলাদেশ হওয়ার পর তারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে আর কোনো রাখঢাক না করে নিজেদের পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদান করেছিল। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাদের নেতা মণি সিং সামরিক বাহিনীর জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, পুলিশের আইজি, উচ্চপর্যায়ের আমলা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বসে সেই ফ্যাসিস্ট দলটির গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। তাদের ‘মার্কসবাদী’ চিন্তাধারায় বাকশালকে আলোকিত করেছিলেন!! ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবের হত্যা এবং বাকশাল উচ্ছেদ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগ ও সিপিবি উভয়েই বাকশালের গর্ভ থেকে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল যমজ ভাই হিসেবে। দল হিসেবে স্বতন্ত্র হলেও তারা উভয়েই ‘মুজিববাদী’ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও তার অনুসারী। এ কারণে বাকশালের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসার পর সিপিবির নামকরণ যথার্থভাবে হয়নি। তার নামকরণ হওয়া দরকার ছিল সিপিবি (মুজিববাদী)। আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদী সিপিবি এখন প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার এক প্রবল আবহ তৈরি হয়েছে, হিন্দুরা এ সাম্প্রদায়িকতার নির্যাতনে অতিষ্ঠ ও আতংকিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে, অনেকে দেশত্যাগ করছে! তারা নিজেরাই যে হিন্দুদের ওপর সব থেকে বড় নির্যাতক এ কথা ধাপাচাপা দেয়ার জন্যই তারা এসব করছে এবং হিন্দুদের ওপর নির্যাতনকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে একে আখ্যায়িত করছে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে। নির্যাতন হলেই যে তা সাম্প্রদায়িক হবে, তার অন্য কোনো চরিত্র থাকবে না বা থাকতে পারে না, এ বক্তব্য হাজির করে তারা নিজেদের লুটতরাজ ও হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক হামলা ও নির্যাতন আখ্যা দিয়ে দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই কুৎসা রটনা করছে।

তাছাড়া সাম্প্রায়িকতার কথা যদি বলা হয়, তাহলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকলে এখানে মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল থাকত? সেরকম কিছুই নেই। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মতো অন্য দলগুলো হল মৌলবাদী টার্গেট হিন্দুরা নয়। টার্গেট হল কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, যে কোনো ধরনের প্রগতিশীল। আওয়ামী লীগ কিসের অসাম্প্রদায়িক? এটা ঠিক, এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। কিন্তু শুধু বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীই নয়, আওয়ামী লীগ তার তিনদফা সরকারের আমলে কি সে আইন বাতিল করেছে, না সেটা বহাল রেখেছে একইভাবে? পঞ্চদশ সংশোধনীতে ভেল্কিবাজি দেখিয়ে একদিকে তারা বাংলাদেশকে বলেছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, আবার অন্যদিকে তারা বহাল রেখেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে!! সিপিবি (মুজিববাদী)ও এদিক দিয়ে একই গর্তের শেয়াল। কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে নির্যাতন এখন হচ্ছে তাকে সাম্প্রদায়িক না বলে শাসক শ্রেণীর লোকদের সম্পত্তি, জমিজমা দখল, দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক তৎপরতা বলে আখ্যায়িত করায় তাদের গায়ে জ্বালা ধরেছে। তাদের লেজে আগুন লেগেছে। আমার বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝার ধারেকাছে না গিয়েই বিতর্কের নামে তারা আমার বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছে। শুধু শব্দ নয়, আমার কোনো কোনো বাক্য পর্যন্ত মোচড় দিয়ে তারা আমার বক্তব্যের যুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং অর্থকে বিকৃত করেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে শিক্ষিত লোকের নিদারুণ অভাবের কারণে সিপিবি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক অঙ্গসংগঠন বা Cultural Wing হিসেবেই কাজ করে এসেছে। আমার বিরুদ্ধে তাদের লোকজনই এখন নানা ধরনের কুৎসা প্রচার করে আওয়ামী লীগের ‘সাম্প্রদায়িক’ চরিত্র আড়ালের চেষ্টা করছে। তাদের এ ‘সাম্প্রদায়িকতার’ সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলাদেশে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ নামে যে সংগঠনটি আছে তার মধ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের উপস্থিতি নামমাত্র। এটা আসলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ বন্ধের জন্য ভারতের পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এবং অন্যরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় রানা দাশগুপ্ত পিটিআইয়ের এ রিপোর্টকে মিথ্যা বলেছেন। কিন্তু পিটিআই এরপর বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছে, রানা দাশগুপ্ত যা বলেছেন তারা সেটাই রিপোর্ট করেছে। তাদের কাছে নিশ্চয়ই সাক্ষাৎকারের রেকর্ডকৃত ভাষ্য আছে। কাজেই পিটিআইয়ের এ দাবিতে তিনি কোনো প্রত্যুত্তর দেননি। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হল, রানা দাশগুপ্ত যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজীকে কোনো এক সূত্র থেকে হুমকি দেয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মিশনের সন্ন্যাসীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। (যুগান্তর, ১৮.০৬.২০১৬)। এসব থেকে বোঝার অসুবিধে নেই যে, ভারতের বিজেপি সরকার ও বাংলাদেশে আরএসএস ও বিজেপি মার্কা উচ্চ বর্ণের কিছু হিন্দু একজোট হয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছে এবং এ সূত্র ধরে বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপের শর্ত তৈরি করছে।

ভারতে যেমন চরম সাম্প্রদায়িকতা আছে, আছে নিুবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের ওপর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের প্রধান অংশের ভয়াবহ নির্যাতন, তেমনি সেখানে আছে এসবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন। সেখানে আছেন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রাম ও প্রতিবাদ করার মতো অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষ- লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনৈতিক ব্যক্তি। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির চরম সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ৪৫ জন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়া লেখক এবং আরও অনেক শিল্পী তাদের পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে ফেরত দিয়েছেন সুদসহ তার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ। বাংলাদেশে যারা নানা ধরনের বড় বড় পুরস্কার পেয়েছেন, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নামে পরিচিত ব্যক্তি, তারা কি আওয়ামী লীগের চরম ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজেদের পুরস্কার ফেরত দিতে পারেন? এ রকম একজনও কি আছেন? শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে তদবির করে পুরস্কার পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে যা ভারতে নেই। ভারতে যারা পুরস্কার পান তারা নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতেই সেটা পেয়ে থাকেন। এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণার পর এক লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কবি পুরস্কার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্লজ্জভাবে শেখ হাসিনার কাছে পুরস্কার দাবি করেছিলেন! হাসিনা সে দাবি মঞ্জুর করে তাকে পুরস্কার দিয়েছেন!! যারা এভাবে পুরস্কার পান তারা কবি সাহিত্যিক হিসেবে যতই গুণী হন, তাদের চরিত্রের খবর কী? যা হোক, এ প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার, ভারতে কোনো গুরুতর বিষয়ে বিতর্ক হলে সে বিতর্কে সাধারণভাবে বিতর্কের ব্যাকরণ ও নিয়ম-কানুন মান্য করেই তা করা হয়। এখানে তার সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। এখানে মননশীলতার চর্চা, সিরিয়াস চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তার কোনো ঐতিহ্য যে এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি, এটা আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে সমালোচনার নামে যে গালাগালি হচ্ছে তার থেকেই বোঝা যায়।

এরপর একটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করব। ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ নামক প্রবন্ধে আমি সংখ্যালঘু সমস্যার ওপর যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম, তার কোনো দেখা এসব বিতর্কের মধ্যে নেই। হিন্দুদের ওপর নির্যাতনকে কেন আমি সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বলছি না, এটাই হল এসব লেখার উত্তেজিত বক্তব্য। যারা এভাবে বিতর্ক করেছেন তারা যে বাংলাদেশে সব থেকে নিপীড়িত জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের বন্ধু নন, এটা তারা এ প্রসঙ্গ তাদের আলোচনায় উহ্য রেখেই প্রমাণ করেছেন। এর মূল কারণ হিন্দুরা জাতিগতভাবে বাঙালি এবং মুসলমানদেরই জাতভাই যা অন্যেরা নয়। বাঙালি উচ্চ ধর্মের হিন্দুরা এখানকার শাসক শ্রেণীর অংশ। কাজেই সাঁওতাল, হাজং, রাখাইন, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরার ওপর নির্যাতন এদের কাছে বিবেচনার বিষয় কীভাবে হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমস্যার প্রকৃত বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ও সব থেকে নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য। এ কর্তব্যবোধের কোনো দেখা আমার বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদের বক্তব্যের মধ্যে পাওয়া গেল না।



বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, বাংলাদেশ মুক্তি কাউন্সিল

No comments:

Post a Comment