Tuesday 12 July 2016

কিছু বাঙালি যা বলেছিলেন------- পুষ্কর দাশগুপ্ত

কিছু (হয়ত অল্পবুদ্ধি ) বাঙালি যা বলেছিলেন:
যে মধুসূদন দত্ত প্রথম যৌবনে ইংরেজি ভাষার কবি হবার স্বপ্ন দেখতেন, যিনি ইংরেজি বাদ দিয়েও সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি ও ইতালিয়ান ভাষা জানতেন, তিনি ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভের্সাই শহর থেকে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন:
তুমি জান, গৌর আমার, গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটা ইয়োরোপীয় ভাষায় জ্ঞান হল বিরাট আর আবাদ করা একটা ভূখণ্ড অধিকার করার মতো — ঐ ভূখণ্ড অবশ্যই বৌদ্ধিক ।… ইয়োরোপ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য প্রশংসনীয় ব্যাপার, … কিন্তু আমরা যখন পৃথিবীকে কিছু বলব তখন তা যেন আমরা আমাদের নিজের ভাষায় বলি। নিজেদের ভেতরে নতুন চিন্তার উত্সার রয়েছে বলে যারা বোধ করে তারা যেন অবিলম্বে নিজেদের মাতৃভাষার দিকে যাত্রা করে।… নিজের ভাষায় দক্ষতা নেই এমন কোনো ব্যক্তির ‘শিক্ষিত’ বলে পরিচিত হতে চাওয়ার আত্মম্ভরিতাকে আমি ঘৃণা করি…
শেষ পর্যন্ত, আমাদের নিজেদের ভাষার চর্চা আর তার সমৃদ্দ্ধি-সাধনের তুলনীয় আর কিছুই হতে পারে না। তুমি কি ভাব যে ইংল্যাণ্ড কি ফ্রান্স অথবা জার্মানি কি ইতালির কবি আর প্রবন্ধকারের দরকার আছে ? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি মিল্টনের নিজের মাতৃভাষা আর জন্মভূমির জন্য কিছু করার মহৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে তাবৎ প্রতিভাধর মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক।
[European scholarship is good…but when we speak to the world, let us speak in our own language. Let those, who feel that they have springs of fresh thought in them, fly to their mother-tongue…I should scorn the pretensions of that man to be called “educated” who is not master of his own language….
After all, there is nothing like cultivating and enriching our own tongue. Do you think England, or France or Germany or Italy wants Poets and Essayists? I pray God, the noble ambition of Milton to do something for his mother-tongue and his native land may animate all men of talent among us.]
যোগীন্দ্রনাথ বসু: মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন-চরিত, পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, চক্রবর্তী চাটার্জ্জি এণ্ড কোং, ১৯২৫, পৃ. ৫৭৪-৫৭৫।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অভিভাষণে বলেন:
I firmly believe that we cannot have any thorough and extentsive culture as a nation, unless the knowledge is disseminated through our own vernaculars. Consider the lesson the past teaches. The darkness of Middle Ages of Europe was not completely dispelled until the light of knowledge shone through the medium of the numerous modern languages. So in India, ― the dark depth of ignorance all round will never be illuminated until the light of knowledge reaches the masses through the medium of their own vernaculars.
― Gurudas Bandyopadhay: Convocation Address , 1891. Hundred Years of the University of Calcutta, 1957,
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের মাতৃভাষাগুলির মাধ্যমে জ্ঞান প্রচারিত না হলে জাতি হিসেবে আমরা কোনো সর্বব্যাপ্ত আর বিস্তৃত কৃষ্টির অধিকারী হতে পারব না।অতীত আমাদের যে শিক্ষা দেয় তার কথা ভেবে দেখুন। অসংখ্য আধুনিক ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো দীপ্তিময় হয়ে ওঠার আগে অব্দি ইয়োরোপে মধ্যযুগের অন্ধকার সম্পূর্ণ বিদূরিত হয় নি। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, ― তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জনসাধারণের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত চারপাশের অজ্ঞানের গভীর অন্ধকার কখনোই আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠবে না ।
গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে উদ্বুদ্ধ তরুণ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে মাতৃভাষা বাংলা, হিন্দি বা উর্দুকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন, বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু ইত্যাদি কয়েকজন সমর্থন করলেও মেকলের জারজ বাঙালিদের দলবদ্ধ বিরোধিতায় সে প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়।
১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকায় লেখেন:
…বঙ্গ বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক। ইংরাজিতে শিক্ষা কখনোই দেশের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না। তোমরা দুটি-চারটি লোক ভয়ে ভয়ে ও কী কথা কহিতেছ, সমস্ত জাতিকে একবার দাবি করিতে শিখাও কিন্তু সে কেবল বিদ্যালয় স্থাপনের দ্বারা হইবে, Political agitation-এর দ্বারা হইবে না।
(ন্যাশনল ফন্ড , ভারতী, কার্তিক, ১২৯০)।
এর পর সারা জীবন তিনি সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন:
আমাদের ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? ভরসা করিয়া এটুকু কোনোদিন বলিতে পারিব না যে, উচ্চশিক্ষাকে আমাদের দেশের ভাষায় দেশের জিনিস করিয়া লইতে হইবে? পশ্চিম হইতে যা কিছু শিখিবার আছে জাপান তা দেখিতে দেখিতে সমস্ত দেশে ছড়াইয়া দিল, তার প্রধান কারণ, এই শিক্ষাকে তারা দেশী ভাষার আধারে বাঁধাই করিতে পারিয়াছে। …আমরা ভরসা করিয়া এ পর্যন্ত বলিতেই পারিলাম না যে, বাংলাভাষাতেই আমরা উচ্চশিক্ষা দিব এবং দেওয়া যায়, এবং দিলে তবেই বিদ্যার ফসল দেশ জুড়িয়া ফলিবে।…আমি জানি তর্ক এই উঠিবে তুমি বাংলা ভাষার যোগে উচ্চশিক্ষা দিতে চাও কিন্তু বাংলাভাষায় উঁচুদরের শিক্ষাগ্রস্থ কই? নাই সে কথা মানি কিন্তু শিক্ষা না চলিলে শিক্ষাগ্রস্থ হয় কী উপায়ে? শিক্ষাগ্রস্থ বাগানের গাছ নয় যে, শৌখিন লোকে শখ করিয়া তার কেয়ারি করিবে,–কিংবা সে আগাছাও নয় যে, মাঠে বাটে নিজের পুলকে নিজেই কণ্টকিত হইয়া উঠিবে!…. বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষাগ্রন্থ বাহির হইতেছে না এটা যদি আক্ষেপের বিষয় হয় তবে তার প্রতিকারের একমাত্র উপায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় উচ্চঅঙ্গের শিক্ষা প্রচলন করা।
(শিক্ষার বাহন, ১৩২২)।
ছিয়াত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেন:
…আজ কোনো ভগীরথ বাংলাভাষায় শিক্ষাস্রোতকে বিশ্ববিদ্যার সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে চলুন, দেশের সহস্র সহস্র মন মূর্খতার অভিশাপে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে, এই সঞ্জীবনী ধারার স্পর্শে বেঁচে উঠুক, পৃথিবীর কাছে আমাদের উপেক্ষিত মাতৃভাষার লজ্জা দূর হোক, বিদ্যাবিতরণের অন্নসত্র স্বদেশের নিত্যসম্পদ হয়ে আমাদের আতিথ্যের গৌরব রক্ষা করুক।
(শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ, ভাষণ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬)।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী:
পাশ্চাত্য জাতির উপার্জিত জ্ঞানরাশি আত্মসাৎ করিবার জন্য আমাদিগকে পাশ্চাত্য ভাষার অনুশীলন করিতে হইবে। কিন্তু ওই বিজাতীয় ভাষা কখন আমাদের আপনার ভাষা হইবে না;... যদি আমাদের স্বজাতিকে... পাশ্চাত্য জাতির উপার্জিত জ্ঞান-সম্পত্তির অধিকারী করিতে চাই , তাহা হইলে আমাদের মাতৃভাষাকে এইরূপে সংস্কৃত মার্জিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে সেই মাতৃভাষা এই জ্ঞানবিস্তার কর্মের ও জ্ঞানপ্রচার কর্মের যোগ্য হয়। এই বঙ্গ ভাষারই অঙ্গে নূতন রক্ত সঞ্চালিত করিয়া, তাহাকে পুষ্ট সমর্থ করিয়া তুলিতে হইবে।
(বৈজ্ঞানিক পরিভাষা,১৮৯৪)।
ইংরাজের প্রদত্ত শিক্ষা হইতে... আমরা শিখিয়াছি অনেক ও পাইয়াছি অনেক; কিন্তু তাহাতে বাহ্য ব্যতীত আভ্যন্তরিক বিশেষ কিছু হয় নাই।...
আমরা জানিয়াছি অনেক ও শিখিয়াছি অনেক; কিন্তু কিরূপে জানিতে হয় ও কিরূপে শিখিতে হয়, তাহা শেখা আবশ্যক বোধ করি নাই। মনুষ্যজাতির জ্ঞানের রাজ্য আমাদের কর্তৃক এক কাঠা, কি এক ছটাক পরিমাণেও বিস্তার লাভ করে নাই।...
ইংরাজের প্রসাদে শিখিয়াছি যথেষ্ট....কিন্তু হায়! আমাদের গড়িবার শক্তি কই, আমাদের উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় কোথায়! আমরা শোনা কথা ও শেখা কথা ভিন্ন জগতে নূতন কথা কি বলিলাম! উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় ত কিছুই দেখি না, এবং আরও কিছু দিনের মধ্যে যে পরিচয় পাওয়া যাইবে, তাহারও কোন শুভ লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি না। ইংরাজী শিক্ষার কি এই পরিণাম?
...সম্প্রতি বাঙ্গালা সাহিত্যে আছে কি ? উপন্যাস ও কাব্য ? তাই বা কয়খানা ? …
ষাট বত্সরের ইংরাজী শিক্ষার ফলে আমরা ভাঙ্গিতে শিখিয়াছি , গড়িতে শিখি নাই,... আমরা পরের কথা আবৃত্তি করিতে পারি, কিন্তু স্বয়ং বাক্য রচনা করিতে জানি না।... (ইংরাজী শিক্ষার পরিণাম, ১৮৯৫)
LikeShow more reactions
Comment

No comments:

Post a Comment