Wednesday 27 July 2016

চারু মজুমদার- মৃত্যুহীন ২৮ জুলাই------------- দেবব্রত চক্রবর্তী

মৃত্যুহীন ঃ- ২৮শে জুলাই
আজ থেকে ৪৪ বছর পূর্বে প্রায় ১২ দিন ধরে লকআপে অকথ্য অত্যাচারের অবশেষে ভোর ৪টের সময় কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে রাস্তা ব্যারিকেড করে সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তার নশ্বর দেহ । মাত্র ৯৬ পাউন্ড ওজনের ,অত্যন্ত দুর্বল শারীরিক কাঠামোর অধিকারী এই হাঁপানি আক্রান্ত মানুষটি তাঁর মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে আজকেও রাষ্ট্রের কাছে এক আতঙ্কের স্বরূপ । আজকেও তাঁর নাম নেওয়া এই দেশে নিষিদ্ধ। তাকে স্মরণ করা এই দেশের আইন মোতাবিক বিপদজনক। তাঁর নীতিতে বিশ্বাস করার অর্থ এই দেশের শাসকশ্রেনীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া । তাঁর লেখাপত্তর আপনার হেফাজতে পাওয়া গেলে আজকেও আপনি যে কোন মুহূর্তে গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন ,রাষ্ট্র দুয়ে দুয়ে চারের সরল অঙ্কে আপনাকে ৭-৮ বছর অনায়াসে জেলে আটকে রাখতে পারে । বাঙলার বুদ্ধিজীবী কুল পৃথিবীর সমস্ত ব্যক্তির বিষয়ে গম্ভীর আলোচনায় যুক্ত থাকলেও ,স্যাটানিক ভার্সেস থেকে তসলিমা নাসরিন নিষিদ্ধ কেন এই নিয়ে পাতার পর পাতা ভরালেও সযত্নে এড়িয়ে চলেন এই ব্যক্তিত্বকে অথবা নস্যাৎ করবার প্রতিযোগিতায় নাম লেখান দলে দলে । অথচ স্বাধীন ভারতবর্ষের এই সাত দশকের ইতিহাসে যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় ব্যক্তি ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন ইনি তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব -এক এবং অদ্বিতীয় - ‘ চারু মজুমদার ‘ । আজকে তার হত্যার ৪৪ বছর পূর্ণ হোল ।
কলকাতা এবং দেশজুড়ে আজকের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সূচিতে -অমুক শোভাযাত্রা , তমুক শিল্প প্রদর্শনী , হাবিজাবি প্রতিবাদ , মাথা ধরানো সেমিনার ,বস্তাপচা নাটক ,দলিত নির্যাতন, এইডস বিষয়ক সচেতনতা সমেত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি খুঁজে পেলেও কোথাও চারু মজুমদারের স্মৃতিতে পথসভা , আলোচনা , সেমিনার , ধর্না , চিত্র প্রদর্শনী কিছুই আপনি খুঁজে পাবেননা । ধুপকাঠি গুচ্ছ জ্বালিয়ে নেত্রীর শ্রদ্ধা অবনতা মাল্যদানের যে প্রাত্যহিকতার ফটো সেশন তাতে উনি স্বযত্নে প্রত্যাখ্যাত । কোন খবরের কাগজে তাঁর বিষয়ে কোন নিবন্ধ , ছবি বা ইতিহাস আলোচনার প্রশ্নই ওঠেনা আর উঠবেই বা কেন ? চারু মজুমদার তো এই শাসক শ্রেনীর করুণা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তাদের উৎখাত করতে । চারু মজুমদার তো আর মধ্যবিত্তের নায়ক হতে চাননি তিনি চেয়েছিলেন নিপীড়িত মানুষ কে নায়ক বানাতে । সংসদীয় গণতন্ত্রের অসারতা চারু মজুমদার ছিঁড়ে ফালাফালা করেছিলেন আর তাই ভারতের সমস্ত সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল চারু মজুমদারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ । এই হাড় জিরজিরে লোকটির আত্মা এখনো তাদের তাড়া করে বেড়ায় । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে চারু মজুমদার একমাত্র ব্যক্তি মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও এদেশে যার নাম ফিস ফিস করে উচ্চারণ করতে হয় ।
১৯৭০ এর দশকের নক্সালবাড়ি আন্দোলন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম ভদ্রলোক নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ,বুদ্ধিবৃত্তি এবং স্থবির সামাজিক জগতের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল । ১৮-২৫ বছরের যুবাদের উৎসাহ , উচ্ছ্বাস এবং বিদ্রোহের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল এতদিনের সযত্ন লালিত মিথ । বিদ্যাসাগর থেকে রামমোহন ,সাহিত্য থেকে সিনেমা , শিক্ষা থেকে রাজনীতি ,সমাজনীতি থেকে অর্থনীতি সমস্ত কিছু আর প্রশ্নের উর্ধে নয় । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম সমস্ত কিছু কে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবার মানসিক ক্ষমতা , বিদ্রোহের ন্যায় সঙ্গত জন্মসিদ্ধ অধিকারের উল্লেখ এবং নূতন মানুষে উত্তরণের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন চারু মজুমদার । চারু মজুমদার এবং নক্সাল আন্দোলনের প্রায় সমস্ত প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্ব তাদের অসংখ্য লেখায় এতদিনের স্থবিরতা , স্ট্যাটাস কো কে অগ্রাহ্য করবার , চ্যালেঞ্জ করবার বারুদ যোগাচ্ছিলেন অবিরত । বিপ্লবী কারা ? কারা কাঁধ মিলিয়ে লড়বেন নিপীড়িত কৃষক শ্রমিক এবং দেশ ব্যাপী অত্যচারের বিরুদ্ধে ? কারা স্বার্থ ত্যাগ করে নূতন সমাজের বীজ বুনবেন ? চারু মজুমদারের "New Man” তারাই যারা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাধারন মানুষের স্বার্থে চরম আত্ম্ত্যাগ করবার মত ক্ষমতা অর্জন করে । ছাত্র এবং যুবা -যাদের কাঁধে প্রতিক্রিয়াশীল অতীতের বোঝা নেই । ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের প্রবণতা নেই । শিক্ষার দক্ষতায় বিভিন্ন তত্ব এবং অবস্থান বিশ্লেষণে সক্ষম সেই যুবক -ছাত্র -তরুণ সম্প্রদায় কৃষকের সাথে শ্রমিকের সাথে দীর্ঘ আত্মত্যাগের মাধ্যমে , বিপ্লবের আগুনে পুড়ে নিজেদের নতুন মানুষে , বিপ্লবী চরিত্রে পরিবর্তিত করবেন । আর এই সমস্ত বিপ্লবী চরিত্র , ছাত্র -যুবা সেই অগ্রণী শ্রেণী যারা বিদ্রোহের প্রথম আগুন জ্বালাবেন ,রাষ্ট্রের কাগুজে বাঘের চরিত্র উন্মলিত করবেন এবং সাধারন জনতাকে নিজেদের স্থাপিত দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হতে উৎসাহিত করবেন ।
ইতিহাস স্বাক্ষী চারু মজুমদার এবং তার বিপ্লবী আগুনে ব্যক্তিত্ব , স্বার্থ ত্যাগ করে ‘নূতন ‘ মানুষে পরিবর্তিত হওয়ার আহ্বান কত অসংখ্য ছাত্র -যুবককে ক্যারিয়ার তুচ্ছ করে স্থবির সমাজের ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দেওয়ার ভাবনায় অনুপ্রাণিত করেছিল । স্বছল ,সুখী নিশ্চিন্ত জীবনের মায়া ত্যাগ করে দুর্গম গ্রামে কৃষকের দাওয়ায় নিজেদের শ্রেণী চরিত্র পরিবর্তন করবার সেই প্রয়াসে কোন ছল বা ধান্দাবাজি ছিলোনা। কিছু পাওয়ার আশায় কেউ শখ করে গ্রামে যাননি । গিয়েছিলেন নূতন মানুষে পরিবর্তিত হওয়ার অন্তরের তাড়নায় । চারু মজুমদার সেই আগুনের মত ব্যক্তিত্ব যিনি একটা গোটা প্রজন্মকে শ্রমিক ,কৃষক ,দলিত ,নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন । নক্সাল আন্দোলনে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা বা স্ট্রেটেজিক দুর্বলতা ছিল নিশ্চয়ই ,পরিকল্পনা বা সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রমাণিত সত্য কিন্তু বিপ্লব তো কেবল যেন তেন পথে ক্ষমতা দখল নয় “ The struggle of ours is not only [for] a seizure of power. Comrade Charu Mazumdar has said that we must become new men. This is a struggle for the birth of new men” ।
নক্সাল আন্দোলনের ব্যর্থতা , রাষ্ট্রীয় নির্মম সন্ত্রাস , রাজনৈতিক হটকারিতা ,সাংগঠনিক দুর্বলতা সমস্ত বাস্তব সত্য এবং তথ্য সমেত বর্তমান । চারু মজুমদারের হত্যার ইতিমধ্যে ৪৪ বছর অতিক্রান্ত । তার নির্দেশিত পথের অধিকাংশ আজকে পরিত্যক্ত ,পার্টি শতধা বিভক্ত , কিন্তু তবুও কেন এখনো “ চারু মজুমদার’ নাম উচ্চারণের পূর্বে আসে পাশের শ্রোতাকে দেখে নিতে হয় ? কেননা সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সমবেত বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেওয়ার সচেতন প্রয়াসকর্তারা জানেন চারু মজুমদার কেবল মাত্র একটি সত্যের জন্য বেঁচে থাকবেন - তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন বিদ্রোহ আমাদের ন্যায় সঙ্গত জন্মসিদ্ধ অধিকার এবং কেবল ক্ষমতা দখল নয় “ We must become new men .This is a Struggle for the birth of new men” ।
তবে কি এখানে ওখানে ইতিউতি কিছু পোস্টার , সস্তার কাগজে ছাপা কিছু লিফলেট , লোক চক্ষুর অন্তরালে কোন জঙ্গলে তার স্মৃতিচারণ আর প্রায় বৃদ্ধ কিছু মানুষের স্মৃতিতেই কি কেবল বেঁচে আছেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা ? নাকি আমাদের জ্ঞাত জগতের বাইরে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ চারু মজুমদারের নাম, লেখা ,দর্শনের সাথে পরিচিত হন ? নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে তাঁর জীবন উৎসর্গ কে স্মরণ করেন। নতুন নতুন মানুষ চারু মজুমদারের নীতিকে সঠিক মেনে ক্ষেতে খামারে খেটে খাওয়া মানুষদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত হন ? রাষ্ট্রর আধিপত্য একই ঔদ্ধত্যে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য দল বাঁধেন এবং শুরু করেন “ Struggle for the birth of new men “?
চারু মজুমদার সেই ধরনের বিরল বিস্ফোরক যাকে নিষ্ক্রিয় করবার ক্ষমতা রাষ্ট্র তাঁর মৃত্যুর ৪৪ বছর পরেও আয়ত্ত্বে আনতে অক্ষম ।

No comments:

Post a Comment