Sunday 17 July 2016

পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে ------------ মুহম্মদ তকিউয়াল্লাহ

পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে
মুহম্মদ তকীয়ূলাহ
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে আমাকে বহিস্কার করা হয়
১৯৪৮ সালে। এর কয়েক মাস পরেই আমার নামে হুলিয়া জারি হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ
থেকে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হলো ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যাবার।
এরপর কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে আমি যখন বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেই তখন আমাকে জীবিত বা মৃত
ধরিয়ে দেবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সেসময় পাঁচহাজার টাকায় ঢাকা শহরে একটি মাঝারি
আকারের বাড়ি কেনা যেত।
১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হলো আমার পলাতক জীবন। সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে পথচলা সেই
জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে আতংক, বিপদের হাতছানি আর পাশাপাশি কত না ঘটনা, কত আনন্দ বেদনার গল্প।
বিশ্ববিদ্যালয়েরহল থেকে বের করে দেওয়ার পরও আমি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে হলে যেতাম। অবশ্য সে সময় ছাত্ররা
প্রায়ই আমাকে সাবধান করে দিতেন যে ‘আপনাকে পুলিশের লোক খোঁজে’। সেসময় আমি মাঝে মাঝে
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বাসস্থানে থাকতাম। কখনও সুইপার কলোনিতে লুকিয়ে থাকতাম। আমরা
শ্রমিক কর্মচারীদের দাবীদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সহায়তা দিতাম। এটাই ছিল কমিউনিস্ট
পার্টির কর্মকাÐ। সেসময় দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা জড়িত ছিলেন। পার্টি নিষিদ্ধ
ছিল। কিন্তু আন্দোলনগুলোতে পার্টি কর্মীদের অংশগ্রহণ তা সে ছদ্ম পরিচয়েই হোক আর প্রকৃত নামেই হোক ছিল
আনন্দপাঠ ২০১৬ ঈদ সংখ্যা ২৬
স্মৃতিকথা
পুরো মাত্রায়। এইভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে একদিন বৃহত্তর বিপব হবে আমরা সেই স্বপ্নই
দেখতাম।ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের যোগ ছিল। কলকাতার নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে অনেক সময়
নির্দেশ আসতো। মস্কো এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। আগেই বলেছি আমার সরাসরি
নেতা ছিলেন নেপাল নাগ।মণিসিংহ ছিলেন আরও উচ্চ পর্যায়ের নেতা। নেপাল নাগের ছদ্মনাম ছিল রহমান ভাই।
আমার ছদ্মনাম ছিল ইউসুফ আনোয়ার খান বা ওয়াই এ খান। বিহারী বা অবাঙালী সাজতাম মাঝে মধ্যে। আবার
কখনও কখনও অমরবাবু নামেও পরিচয় দিতাম। কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ম অনুসারে এসব ছদ্মনাম এবং প্রকৃত পরিচয়
কঠোরভাবে গোপন রাখা হতো। ফলে আমার অধিকাংশ কমরেড জানতেন না আমার প্রকৃত নাম কী বা কী আমার
পরিচয়। সেসময় পরিচয় গোপন রাখার জন্য আমি কখনও গোঁফ দাঁড়ি রাখতাম, কখনও বা ক্লিনড শেভ। আমি
সিগারেট খাই না। কিন্তু ছদ্মবেশ ধরার জন্য কখনও কখনও সিগারেট বা চুরুট খেতে হতো। ভীষণ বাজে লাগতো
বিষয়টা। কখনও ধুতি চাদর পরে হিন্দু ভদ্রলোক সাজতাম। অভিনয় শিখেছিলাম বন্ধু খান আতার কাছ থেকে। ঢাকা
কলেজে পড়ার সময় সে আমার সহপাঠী ছিল। আমরা দুজনে একসাথে নাটক করেছি। নাটকে আমি মেয়ে সাজতাম।
যাই হোক। চেহারার গড়ন বদলানোর জন্য কপালের সামনের দিকের চুল পাক করে তুলে চওড়া কপাল
বানালাম। এ কাজে আমাকে সাহায্য করলেন বন্ধু শহীদুল্লাহ কায়সার। আমি এবং শহীদুল্লাহ কায়সার অনেকদিন
একসঙ্গে পলাতক জীবন যাপন করেছি। আমাদের আরেক কমরেড ছিলেন নাদেরা বেগম। এই সাহসী নারী
কমরেডের গল্প সেসময় ছিল আরও অনেক কর্মীর অনুপ্রেরণার উৎস। একবার একটি বাড়িতে নাদেরা বেগম পলাতক
ছিলেন। সে বাড়িতে পুলিশ হানা দিলে তিনি দেয়াল টপকে পালাতে যান। তখন পুলিশ তার শাড়ি চেপে ধরলে তিনি
শাড়ি ফেলে বাউজ পেটিকোট পরেই পালিয়ে ছিলেন।
আমি এবং নাদেরা অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী সেজেও থেকেছি। তিনি খুব দৃঢ় চরিত্রের সাহসী কমিউনিস্ট
ছিলেন।
শহীদুল্লাহ কায়সার ও আমি ছিলাম ঘনিষ্ট বন্ধু। সে কথা আগেই বলেছি। আমাদের কাজ ছিল শ্রমিক
ইউনিয়ন সংগঠনের কাজ করা। সেসময় জেল পুলিশ ইউনিয়ন ও রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন হয় আমাদের দুজনের
উদ্যোগে। আমরা দুজন সচিবালয়ের কর্মচারীদের মধ্যেও সংগঠন গড়ে তুলি।সেসময় ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির
নেতৃত্বে ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। তিনি ছিলেন পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির সেক্রেটারি। সেক্রেটারিয়েটে
আরও ছিলেন জ্ঞান চক্রবর্তি, অনিল মুখার্জি আমি ও শহীদুল্লাহ কায়সার। আরও অনেকে ছিলেন কিন্তু তাদের নাম
এখন ভুলে গেছি।
সেটা সম্ভবত ১৯৫০ সাল। ইসলামপুরের এক বাড়িতে আমাদের পার্টির গোপন মিটিং হয়। নিয়ম ছিল
মিটিং শেষ করে কয়েকজন সে বাড়িতে থেকে যাবে। আবার কয়েকজন ধীরে ধীরে মানে একজন একজন করে সে
বাড়ি থেকে গোপনে বের হবে। একসঙ্গে একবাড়িতে অনেক লোক ঢুকলে বা বের হলে তো পুলিশের সন্দেহ হবে।
তাই এই ব্যবস্থা। সে রাতে আমার সেই বাড়িতেই থেকে যাবার কথা। কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সার বললো, ‘তকি চলো।
আজ অন্য কোথাও থাকবো। রাতে কাবাব খাবো’। আমি আর কায়সার বেরিয়ে গেলাম। সেই রাতেই বাড়িতে পুলিশ
হানা দিল। সরদার অ্যারেস্ট হলো। আমি শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে ছিলাম বলে বেঁচে গেলাম। পলাতক জীবনে
আমিও অনেক বার কায়সারকে পালাতে সাহায্য করেছি। দুজনে একসঙ্গে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি গ্রামের পথে,
শ্রমিক বস্তিতে থেকেছি ছদ্মপরিচয়ে। তখন ভেবেছিলাম কমরেডবন্ধুকে সবসময় এইভাবেই রক্ষা করতে পারব। কিন্তু
১৯৭১ সালে আলবদর ঘাতকরা যখন তাঁকে নিয়ে যায় তখন তো আমি তাকে রক্ষা করতে পারিনি। এমনকি ১৬ই
ডিসেম্বর রায়ের বাজারের সেই বধ্যভূমিতে আমি প্রিয় বন্ধুর মৃতদেহটিও খুঁজে পাইনি। কিন্তু প্রিয় বন্ধু, সাম্যবাদী
সমাজের স্বপ্নের ভিতর আজও তুমি বেঁচে আছ।
ইসলামপুরের সেই বাড়ি থেকে পুলিশ সরদার ফজলুল করিমকে অ্যারেস্ট করার পর পার্টির পক্ষ থেকে
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং আমাকে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি করা হয়।
সেসময় আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে আমার বড়বোনের বাসায় যেতাম। তার বাড়ি ছিল আলি নেকির দেউড়িতে।আমার
মাথার দাম তখন পাঁচ হাজার টাকা। ছোটবু ও বড়বু ঠাট্টা করে বলতেন ‘বেলাতকে ধরিয়ে দিয়ে আমরাই টাকাটা
নিয়ে নেই।’ তারা ঠাট্টা করলেও আমার অনেক আত্মীয় কিন্তু সত্যিই একথা ভাবতেন। বিশেষ করে একজন আত্মীয়
ছিল পুলিশের ইনফরমার। সেকথা অবশ্য তখন আমার মা এবং ভাইবোনরা জানতেন না। এই আত্মীয়ই আমাকে
পুলিশের কাছে ধরিযে দিয়েছিল। শুনেছি পাঁচ হাজার টাকায় সে ঢাকা শহরে একটা বাড়িও কিনেছিল।
আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকার সময় বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিতাম। কখনও ইউসুফ আনোয়ার খান কখনও অমরবাবু নামে।
আনন্দপাঠ ২০১৬ ঈদ সংখ্যা ২৭
স্মৃতিকথা
এসব বাড়িতে যারা আশ্রয় দিতেন তারা ছিলেন ‘সিমপ্যাথাইজার’। তার মানে তারা হয়তো পার্টির কমরেড নন কিন্তু
পার্টির প্রতি বা আমাদের আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল। হয়তো বাড়ির কোনো ছেলে পার্টির প্রতি সিমপ্যাথাইজার
বা কোনোভাবে ছাত্র সংগঠন বা শ্রমিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। কিন্তু বাড়ির অন্য সদস্যরা কোনোভাবে পার্টির সঙ্গে
যুক্ত নয়। কিংবা হয়তো কোনো কমরেডের আত্মীয় বাড়ি। সেখানে তারা আমার প্রকৃত পরিচয় জানতেন না। যে
কমরেড আমাকে সেখানে নিয়ে গেছেন তিনি তার আত্মীয় বা বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছেন। তিনিও জানতেন না আমার
প্রকৃত নাম কী। হিন্দু ধর্মের কারও বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার সময় হিন্দু পরিচয় দিয়েই থাকতাম। খেতে বসে খুব
সতর্ক থাকতে হতো পাছে বাম হাত দিয়ে পানির গাস বা চামচ ধরে ফেলি। অধিকাংশ বাড়িতেই বাড়ির মেয়েরা
আমাকে খুব আদর যতœ করতেন।
একবার এমনি একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলাম। সে বাড়ির তরুণী মেয়েটি আমার প্রেমে পড়লেন। তার
বাবা-মা আমার সঙ্গে তাদের আদরের মেয়ের বিয়ে দিতেও প্রস্তুত। কারণ তারা মনে করেছিলেন আমি কোনো সম্ভ্রান্ত
হিন্দু পরিবারের সন্তান। এদিকে তখন আমি বিয়ে করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। আমার এই অনিশ্চিত জীবনের
সঙ্গে কি কাউকে জড়ানো চলে? হাই কমান্ডের কাছে আমার করণীয় জানতে চাইলাম। পার্টির জরুরি নির্দেশে আমি
সেই বাড়ি ত্যাগ করে চলে আসি। পরে শুনেছি তারা সপরিবারে কলকাতায় চলে যায়। ভুল সময়ে, ভুল মানুষের
প্রেমে পড়া সেই তরুণীর সঙ্গে জীবনে আর কখনও দেখা হয়নি। তার জন্য এখানে রইল একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস।
পলাতক জীবনের প্রসঙ্গে শহীদুল্লাহ কায়সারের একটি কথা মনে পড়ছে। তার হাতের রান্না বিশেষ করে
ডাল রান্না ছিল অপূর্ব। চুলায় রান্না বসিয়ে আমাকে বলতো ‘তকি একটু খেয়াল রাখো’। তারপর ঝটপট লিখতে বসে
যেত এবং কি দ্রæত যে লেখা শেষ করতো সেটা এখনও অবাক বিস্ময়ে মনে পড়ে।
১৯৫১ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পলাশী ব্যারাক ও নীলক্ষেত ব্যারাকে সরকারী সচিবালয়ের
কর্মচারীদের বাসস্থান ছিল। সেখানে কর্মচারী ইউনিয়নের গঠনমূলক কাজ এবং কর্মচারীদের দাবীদাওয়া নিয়ে
আন্দোলনের পরিকল্পনা বিষয়ে একটা মিটিং ছিল। গোপন মিটিং। মিটিংয়ের নিয়ম হলো যারা কর্মী তারা ধীরে ধীরে
একজন দুজন করে আগে আসবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা সবাই উপস্থিত হবে। আমি যাবো পরে। তারপর
মিটিং শেষ হলে আমি আগে বেরিয়ে যাবো। অন্যরা ধীরে ধীরে একজন দুজন করে বের হবে এবং বিভিন্ন গন্তব্যে চলে
যাবে।
আমার ওই দিন রাতে মিটিং শেষ করে ভোরে ভাইয়ার (মুহম্মদ সফীয়ূল্লাহ) বাড়িতে যাবার কথা। ভাইয়া
তখন থাকতেন লালবাগে। আবার পরদিন যেতে হবে জয়নুল আবেদীনের (শিল্পাচার্য) শ্বশুর বাড়িতে। তার শ্যালিকা
রওশন আরা বাচ্চু আমাদের পার্টির সমর্থক। বাচ্চু এবং তার আরেক বোন ওদের বাড়িতে আমাকে দাওয়াত
করেছিল।তারা প্রায়ই আমাকে দাওয়াত করতো এবং চমৎকার রান্না করে খাওয়াতো। এই রওশন আরা বাচ্চু বায়ান্নর
ভাষা আন্দোলনের একজন সাহসী সৈনিক।
দিনটা ছিল শনিবার। মিটিং শেষ হলো বেশ রাতে। নীলক্ষেত ব্যারাক থেকে বেরিয়ে উপাচার্যের বাড়ির
সামনে দিয়ে ঘুরে এস এম হলের পিছন দিয়ে লালবাগের দিকে যাচ্ছি। পলাশী ব্যারাকের ভিতর দিয়ে লালবাগ
যাবো। নির্জন রাস্তায় হাঁটছি আর বারে বারে পিছু ফিরে দেখছি কেউ ফলো করে কিনা। এসএম হলের গেট পার
হলাম তখনও কাউকে দেখিনি। ইকবাল হলের সামনে দিয়ে তখন রেল লাইন ছিল। রেল লাইন পার হলাম। ভোরের
আলো ফুটছে একটু একটু করে। পলাশী ব্যারাকে উনুনের ধোঁয়া।রান্নার কাজ চলছে কোনো বাড়িতে।হঠাৎ একটা
লোক এসে আমাকে জাপটে ধরলো। সাদা পোশাকে পুলিশের লোক। আমি প্রবল ধস্তাধস্তি করছি তার সঙ্গে। পলাশী
ব্যারাকের সামনে চায়ের দোকানের লোকরা ছুটে এলো। ওরা আমাকে চেনে। বাঁচাতে এসেছে। বেগতিক দেখে
লোকটি রিভালবার বের করলো। রিভালবার দেখে আমাকে বাঁচাতে আসা লোকরা থমকে গেল। পুলিশ আমাকে
একটা রিকশায় উঠালো। আমার চিন্তা হচ্ছে। কারণ পকেটে একটা কাগজে মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত এবং কয়েকজন
কমরেডের নাম রয়েছে। পুলিশের লোকটির অগোচরে খুব সাবধানে পকেটে থাকা কাগজপত্র চুপিসারে রাস্তায় ফেলে
দিলাম। আজাদ পত্রিকার অফিসের সামনে দিয়ে যখন রিকশা যাচ্ছে, আমি চিৎকার করে উঠলাম। বললাম ‘ভাই
আমি ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে। আমি সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি এবং মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছি
এই জন্য পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’ বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিৎকার করে অনেক কথা বললাম। আমার উদ্দেশ্য
ছিল যদি পত্রিকা অফিসে কোনো সাংবাদিক থাকেন তাহলে তিনি যেন খবরটি পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
ততোক্ষণে বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাকে লালবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। থানার ওসি কাকে যেন
ফোন করে বললেন ‘আমরা তকিয়ূল্লাহকে অ্যারেস্ট করেছি’। এদিকে থানার সামনে বেশ জটলা বেঁধে গেছে তখন।
আনন্দপাঠ ২০১৬ ঈদ সংখ্যা ২৮
স্মৃতিকথা
আমি চিৎকার করে বক্তৃতা দিতে দিতে থানায় ঢুকেছি। আমার চিৎকারে পথচলতি বেশ কিছু লোক জমা হয়েছে।
সেই ভিড়ের ভিতর ঘটনাক্রমে আমার এক আত্মীয় ছিলেন। তিনি বাজার করতে যাচ্ছিলেন। তিনি ভাইয়াকে গিয়ে
আমার গ্রেপ্তারের খবরটা দিলেন। লালবাগ থানায় দুপুর পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখা হলো। এদিকে আমাকে উদ্ধারের
জন্য শ্রমিকরা জড়ো হচ্ছিলেন। পাছে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় সেজন্য বিকালে তোপখানা রোডের পুলিশঅফিসে
নিয়ে যাওয়া হলো। সেটা ছিল ডিবির অফিস।সেখানে আনোয়ারুল আজিম নামে এক ডিবি অফিসার খুব জেরা শুরু
করলো।বিকেল থেকে সারা রাত।
কমরেডদের নাম কি? তোমাদের নেতা কে? কে কে আছে তোমার সাথে, আপনি দেশের শত্রু, আপনার
ফাঁসি হবে। কখনও আপনি, কখনও তুমি। আমি সব কথাতেই শুধু বলি ‘আমি জানি না’। এইভাবে সেখানে সারা
রাত জেরা চললো।
আমাকে বলে তুমি শুধু একটা বিবৃতি দাও, বলো যে ভুল করেছ। বলো কমিউনিস্ট পার্টির লোকরা
ভারতের গুপ্তচর। তোমরা নাস্তিক। বলো যে, সমাজতন্ত্র একটা ভুল পথ। এই বিবৃতি দিলে তোমাকে ছেড়ে দিব।
তোমার কোনো শাস্তি হবে না। না হলে কিন্তু তোমাকে দেশদ্রোহী বলে ফাঁসি দেওয়া হবে।
আমি বললাম, ‘সমাজতন্ত্রকে আমি ভুল বললেই তো আর সেটা ভুল হয়ে যাবে না। আমি যদি বলি কাল
ভোরে সূর্য উঠবে না তাহলে কি সূর্যের উদয় বন্ধ থাকবে? সমাজতন্ত্র কোনো ভুল আদর্শ না। এটাই একমাত্র সঠিক
পথ। আর আমি এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছি। আমি দেশদ্রোহী না। আমি দেশপ্রেমিক।’
আনোয়ারুল আজিম বললো ‘তুমি পাগল। তোমাকে পাগলাগারদে পাঠাবো।’
এর পরদিন দুপুরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডিবির হেডঅফিসে। ডিবির হেড অফিস তখন ছিল সদরঘাটের
ওয়াইজঘাটে। পরে যেখানে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি হয়।
ওয়াইজঘাটের ডিবির অফিসে নিয়ে আমাকে আবার রিমান্ডে নেওয়া হলো। একটা কড়া ইলেকট্রিক আলো সোজা
চোখের উপর জ্বালিয়ে রেখেছে। একটা চেয়ারে বসিয়ে আমার হাত পা বেঁধে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে। অনিল মুখার্জি
কোথায়? মণি সিংহ কে?, ফণী গুহ কোথায়? সরদার ফজলুল করিম কি তোমার আত্মীয়? শহীদল্লাহ কায়সার
কোথায়? তোমাদের নতুন পরিকল্পনা কি? ভারতে কবে যাবে?ভারত থেকে কত টাকা পেয়েছ? এই সব প্রশ্ন। ঘুরে
ঘুরে একই কথা বারে বারে বলে। চোখের উপর কড়া আলো। বললাম, জানি না। পুলিশটি আমাকে প্রচন্ড জোরে
চড় কষালো। ঘাড়ের রগ চেপে ধরে যন্ত্রনা দিতে লাগলো। হাতের নোখের নিচে সুই ফোটানো হলো। আরও নানা
কায়দায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলতে লাগলো। এইভাবে সারা রাত রিমান্ড চললো। ভোরে ফজরের আজান
পড়ছে। আমি বললাম ‘আমি নামাজ পড়বো’। তারা বলে, ‘তুমি তো নাস্তিক, তোমার আবার নামাজ কিসের?’
আমি বললাম ‘আমি নাস্তিক নই, আমি কমিউনিস্ট।’
আমার হাত খুলে দেওয়া হলো।আমি নামাজ পড়লাম। নামাজের পর আবার টর্চার ও জেরা শুরু হলো।
এদিকে আমাকে নামাজ পড়তে দেখে সাধারণ কয়েকজন সেপাইয়ের মধ্যে মৃদু প্রতিবাদ ও গুঞ্জন শুরু হলো। একজন
তো বলেই ফেললো, ‘কেমন কমিউনিস্ট যে নামাজ পড়ে? এই নিরীহ ভদ্রলোকের ছেলের উপর অযথা জুলুম করা
হচ্ছে।’
সকাল দশটার দিকে আমাকে ঢাকা জেল হাজতে নিয়ে আসা হলো। ৪০ নম্বর সেল। এরপর নিয়ে গেল
যেখানে অপরাধী পাগলদের আটকে রাখা হয় সেই ওয়ার্ডে। বলা হলো আমি পাগল। সেখানে পাগলা গারদে আটকে
রাখা হলো আমার চারিদিকে পাগলের মেলা। সুস্থ মানুষ সেখানে দিনের পর দিন থাকলে সত্যিই পাগল হয়ে যাবে।
কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আসলে এটাও নির্যাতনের একটা কৌশল।
সেখানে একজন কয়েদি যে কিছুটা সুস্থ। সে আমাকে বললো, আপনাকে এখানে রেখেছে কেন? আপনি তো পাগল
না। আপনি তো রাজবন্দী।
সে আমাকে বুদ্ধি দিল। তার পরামর্শমতো আমি রাজবন্দীর মর্যাদা দাবী করলাম।বললাম,‘আমার দাবী না
মানলে অনশন করবো।’
কেউ কোনো কথা শোনে না। তখন আমি সত্যিই অনশন শুরু করলাম। তিনদিন অনশন পালন করার পর
কারা কতৃপক্ষ ভয় পেয়ে গেল যে অনশনে হয়তো আমার মৃত্যু হবে। সন্ধ্যায় আমাকে রাজবন্দীর মর্যাদা দিয়ে ‘নিউ
২০ ওয়ার্ডে’ নেওয়া হলো। এখানে সব রাজবন্দীরা ছিলেন। শুরু হলো আমার টানা পাঁচ বছরের জেলজীবন।
অনুলিখন: শান্তা মারিয়া

No comments:

Post a Comment