Monday 4 July 2016

উনি অধ্যাপক আমরা ছাত্রও------ পুষ্কর দাশগুপ্ত

"উনি" অধ্যাপক, অতএব আমরা সবাই ছাত্র
পুষ্কর দাশগুপ্ত
আমি পেশাদারি জ্ঞানচর্চার জগতের বাইরের লোক। স্বভাবতই ওই জগতের কাউকেই প্রায় চিনিনা। আমি থাকি কলকাতা থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার মাইল দূরে। তাই পেশাদারি জ্ঞানচর্চার ওই জগতে আমাকে যে কেউ চেনেনা তা বলাই বাহুল্য। হঠাৎ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে দেখলাম তপোব্রত ঘোষ নামে এক ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখার ব্যাখ্যা করছেন। তাঁর ব্যাখ্যার মন্তব্যকারীদের "স্যার" সম্বোধন আর মন্তব্যের ভাষা থেকে বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক খ্যাতনামা রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক। কৌতূহলী হয়ে তাঁর ৩০-এ এপ্রিলের পোস্টটি পড়লাম। এখানে তপোব্রতবাবুর আলোচ্য হল রবীন্দ্রনাথের একটি গান, যার শুরু, "নাচ শ্যামা তালে তালে..."। তপোব্রতবাবু আলোচনায় জানান যে কয়েক বছর আগে কালিপূজার আগের দিন একটা বেসরকারি টেলিভিশনে শান্তিনিকেতন থেকে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী এক মহিলা আলোচ্য গানটিকে হাস্যকরভাবে রবীন্দ্রনাথের শ্যামাসঙ্গীতের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত করেন। তপোব্রতবাবুর মনে হয়েছে ঘটনাটি প্রসঙ্গ বা রচয়িতার জীবনের পরিপ্রেক্ষিত না জেনে "বাঙালির টেক্সট পড়ার একটা নমুনা ।" বর্তমান রচনায় তপোব্রতবাবু আরো দুবার "টেক্ট" শব্দটি ব্যবহার করেছন "এইবার আমার উদ্দিষ্ট টেক্সটে আসা যাক", "টেক্সটাকে বাঙালি কীভাবে পড়ে তার"... । এছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি আলোচনায় "টেক্ট" শব্দটির ব্যবহার দেখতে পেলাম। বহিরাগত আমি তাঁকে "তাঁর বাংলা ভাষায় লেখা আলোচনায় গল্প, কবিতা, নাটক ইত্যাদি বর্গ-পরিচয়ের বদলে তিনি কেন টেক্সট্ শব্দটি ব্যবহার করেন তা বুঝিয়ে বলতে অনুরোধ করলাম।
অপরিচিতের অনধিকার-চর্চার উত্তরে উষ্মা ও শ্লেষ মিশ্রিত ভঙ্গীতে তপোব্রতবাবু জানালেন, "আমি 'টেক্সট'-এর বদলে 'বাঙ্ময়' লিখতে পারি,শব্দ-গ্রথিত কাব্যশরীর অর্থে, যদি অনুমতি করেন তাই লিখব এখন থেকে,অনেকের চোখ হোঁচট খাবে এই আগাম আশঙ্কায় লিখি না এই আর কি।" তিনি আরো যোগ করলেন , "আমি যে কোনো স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ লিখছি না সেটা তো আমার লেখাগুলোর ধরন থেকেই স্বয়ম্প্রকাশ - কেননা আমি তো 'তন্ময়ীভবন'-কে মানি,একটা 'তত'[দ্বিতীয় 'ত'-টি খণ্ড 'ত'] আছে,'that-ness', যাকে বলি কাব্যের মধ্যে কবির সত্য,ওই সত্যের দিকে অনবরত চলতে থাকাই সহৃদয়-রসিকের কৃত্য,এইরকম কোনো সত্যের অস্তিত্বকে কি স্ট্রাকচারালিস্টরা স্বীকার করবেন? আমি একেবারেই কবির লিখিত বাণীপ্রকাশ অর্থেই 'টেক্সট' শব্দটি লিখছি,যদি এই অর্থে আরো যথাযথ কোনো বিকল্প শব্দের খোঁজ কেউ দেন,আমি তাই লিখব।" আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের একজনের প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ঘোষ জানালেন যে 'টেক্সট' বলতে যদি 'রচনা' ব্যবহার করা হয় তাহলে তা 'প্রবন্ধ' থেকে স্বতন্ত্র বর্গ 'রচনা' বা personal essay-র সঙ্গে আবার অনেকের গুলিয়ে যেতে পারে।
আমি আমার বক্তব্যকে কিছুটা সাজিয়ে তপোব্রতবাবুর সামনে পেশ করলাম:
১.'টেক্সট' শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার রয়েছে। জটিলতার মধ্যে না গিয়ে বলা যায় , 'টেক্সট' হল বাচিক ( বা অবাচিক) সংকেত-শৃঙ্খল যাকে একটি স্বায়ত্ত সংজ্ঞাপক একক হিসেবে গণ্য করা ষায়। বাচিক বা ভাষিক সংজ্ঞাপনের ভিত্তিমূলক একক হল বাক্য, তার পরের ধাপের একক বাচন (discourse), আর বাচনের পরবর্তী ধাপের একক হল 'টেক্সট'।
২, "বাঙ্ময়" শব্দটি কোনো "শব্দ-গ্রথিত" একক নির্দেশ করে না, শুধুমাত্র বাগবয়ব বোঝাতে পারে।
৩. "স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ" এবং "কবির লিখিত বাণীপ্রকাশ অর্থেই 'টেক্সট' শব্দটি" বলতে তপোব্রতবাবু কী বুঝিয়েছেন তা বুদ্ধিদোষে আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
৪. "text বলতে যে অর্থ তাৎপর্য বোঝায়, তার যথার্থ কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। ফর্মালিস্ট বা স্ট্রাকচারালিস্টরা যে অর্থে টেক্সট বলতে চান, তা বাঙ্ময় নয়।" এই মত যিনি প্রকাশ করেছেন সেই ঋতংকরবাবু যদি text শব্দের অর্থ তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ফর্মালিস্ট বা স্ট্রাকচারালিস্টরা যে অর্থে টেক্সট বলতে চান তা কেন বাঙ্ময় হতে পারবে না সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন তা হলে ভালো হয়।
৫.যে 'তন্ময়ীভবন' আর 'সহৃদয়-রসিকের কৃত্যের' কথা তপোব্রতবাবু বলেছেন তা সক্রিয় পঠন-পরিগ্রহণের (পুনর্নির্মাণ) অঙ্গ, একথা তথাকথিত সংস্থানবাদীরা কি অস্বীকার করেছেন?
৬. 'টেক্সট' শব্দের পারিভাষিক প্রতিশব্দ হিসেবে "রচনা" ব্যবহার করা যায়। 'টেক্সট' শব্দের মতো "রচনা" শব্দটিও প্রসঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। যাঁরা 'টেক্সট' শব্দ ব্যবহার সুবিধাজনক বলে মনে করেন তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন : কোনো একটা বিদেশি পারিভাষিক শব্দকে ঘিরে একাধিক নতুন বিদেশি শব্দ গড়ে ওঠে, বাংলায় ওই শব্দগুচ্ছের কেন্দ্রীয় বিদেশি শব্দটি ব্যবহার করলে বাকিগুলির বিদেশি রূপও রাখতে হয়। তখন বাংলা বাচন আর বাংলা থাকে না।text শব্দটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা যে শব্দগুলি এখনি মনে পড়ছে: text রচনা, textual রাচনিক, textualilty রাচনিকতা, তারপর পূর্বোক্ত শব্দগুলিতে meta, trans, inter, intra, para, archi, hyper, hypo, geno, pheno, peri, epi.ইত্যাদি(বাংলায় অধি, পরি, আন্তঃ-, অন্তঃ-, উপ- ইত্যাদি) উপসর্গযোগে বহু শব্দ।
তপোব্রতবাবুর তির্যক উত্তর: আমি যারপরনাই বিনীতভাবে স্বীকার করছি যে,১ -নম্বরের শেষাংশ,২ -নম্বর,৪ -নম্বর এবং অবশই ৫ -নম্বর আমারই বুদ্ধিদোষে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।আর ৬ -নম্বর অনুযায়ী 'রচনা' কিংবা 'পরিরাচনিক' ইত্যাদি লিখতেও মন খুঁতখুঁত করছে।আমার বিনম্র নমস্কার গ্রহণ করুন।...
***
প্রসঙ্গত মনে হল জাতি ও স্তরভেদে বিভক্ত এই বাংলাদেশে (রাজনৈতিক দুই বাংলায়) গুরুবাক্য বিচারহীন ভাবে মেনে নেওয়াটা কর্তব্য বলে বিবেচিত : বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। চৈতন্যের উপাসক এই দেশে রঘুনাথ শিরোমণি বিস্মৃত। তর্কেতে মিলায বস্তু বিশ্বাসে ক্রমশ বহু দূর: এ জাতীয় চিন্তা ধর্মবিরোধী। "উনি" অধ্যাপক অতএব আমাদের ছাত্র না হওয়া অবৈধ, গুরুবাক্য মানতেই হবে — বিশ্বাসে মিলায় বস্তু ।
ছাত্রের ভূমিকা নিতে পারলাম না বলে অধ্যাপক ঘোষের বাচনের বিপ্রতীপ অক্ষের অবস্থান থেকে আমার বা/ এবং আমাদের কিছু প্রশ্নভিত্তিক বক্তব্য থেকে গেল:
১. বাংলা ভাষায় লেখা রচনায় ফরাসির মাধ্যমে ইংরেজিতে আসা ল্যাটিনমূল শব্দ 'টেক্সট' ব্যবহারের কারণ বা প্রয়োজনটা কী তা বোঝা গেলনা। কয়েকজন ছাত্র স্যারের সামনে কিছুটা আমতো আমতো করে "রচনা" শব্দটি প্রস্তাব করল। অধ্যাপক ঘোষ তা বাতিল করে দিলেন, "রচনা" বলতে নাকি personal essay বোঝায় , আমদের প্রশ্ন স্কুলে যে "রচনা" লিখতে বলা হয় তা কি personal essay অথবা "বঙ্কিম রচনাবলী" বা "রবীন্দ্র রচনাবলী" কী যথাক্রমে বঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথের personal essays-এর সংকলন।
যে কোনো ভাষায় প্রশাসন, বিচার-ব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্ঠার্থক বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। সমবেতভাবে এই শব্দগুলিকে শ্রেণী হিসেবে বলা হয় পরিভাষা , আলাদাভাবে বলা হয় পারিভাষিক শব্দ। সংস্কৃত (দর্শন. সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি) আর আরবি-ফার্সি (বিচার, প্রশাসন, ইসলাম ইত্যাদি) থেকে আসা বিভিন্ন পারিভাষিক শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হত এবং হয়। তারপর ঔপনিবেশিক যুগে গত দু শ বছর ধরে ইংরেজি থেকে (সরাসরি ইংরেজি শব্দ, ইংরেজি শব্দের অনুবাদ বা অনুবাদ-অনুকৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে) বাংলা ভাষায় ইংরেজি আর ইয়োরোপীয় জীবনযাপন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রের পারিভাষিক শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে। জীবনের সংঙ্গে যোগহীন বিদেশি ইংরেজি ভাষার মাধ্যম ঔপনিবেশিক ও তার পর নয়া-ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বাংলায় পরিভাষা সৃষ্টির ব্যাপারটা ব্যাপ্তি ও যথোপযুক্ত গুরুত্ব লাভ করে নি। এছাড়া নয়া-ঔপনিবেশিকতার ভিত্তি ভাষিক -সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের (The empires of the future are the empires of the mind. Winston Churchill, speech at Harvard University, Sept. 6, 1943) প্রতিষ্ঠা বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা কি পরিভাষা তৈরির প্রয়াস প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। "'রচনা' কিংবা 'পরিরাচনিক' ইত্যাদি লিখতেও মন খুঁতখুঁত করছে" তপোব্রতবাবুর এই উক্তি বা তাঁর ছাত্র অরুণাভ ঘোষের সমর্থন "বাংলায় নতুন কিছু এবং বাস্তবিকভাবেই উদ্ভট পরিভাষায় ধরা সম্ভব" বা "উদ্ভট বাংলা " মনে হয় ইংরেজি শব্দগুলো রাখার পক্ষাবলম্বী মনোভাবের প্রকাশ । Text , transtextual, transtextuality, metatext , intertext , intratext , paratext , architext , hypertext , hypotext , genotext , phenotext , peritext , epitext ইত্যাদি ইংরেজি শব্দ-কণ্টকিত ওই বাংলাকে কি বাংলা বলা যাবে আর তাতে কি প্রথম থেকেই যারা ইংরেজি জানে না তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে না? পরিভাষা তৈরির সমস্যা সব ভাষাতেই বর্তমান। রোলঁ বার্ত-এর "রচনার সুখ " (Le Plaisir du texte) অনুবাদ করতে গিয়ে ব্রিটিশ অনুবাদের অনুবাদক স্টেফান হিথ আর রিচার্ড মিলার-এর মার্কিন অনুবাদের ভূমিকা-লেখক রিচার্ড হাওয়ার্ড jouissance (রাগমোচন) শব্দের ইংরেজি অনুবাদের অসুবিধা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। তবে ওঁরা অনুবাদ না করে উৎসভাষার শব্দটি ব্যবহার করে দায় সারেন নি। মার্কিন অনুবাদক ব্যবহার করেছেন ধর্মীয় অনুষঙ্গযুক্ত bliss, ব্রিটিশ অনুবাদক প্রস্তাব করেছেন thrill বা প্রসঙ্গ অনুযায়ী অন্য কোনো শব্দ। এছাড়া ব্যবহারের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পারিভাষিক শব্দ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তা আর "উদ্ভট" মনে হয় না, শব্দগুলির অর্থপরিধিও নির্দিষ্ট হয়। Edaphology, nyctalopia, intersubjectivity, simulacrum – এসব পারিভাষিক শব্দ ইংরেজিতে জ্ঞান -বিজ্ঞানের চর্চায় উদ্ভট বলে বোধ হয় না। আবার " বিন্দুর অনুভব এবং নাদের অনুভব একপ্রকার নহে।...নাদভূমি হইতে বিন্দুভূমিতে নামিয়া আসাও তত সহজ নয়।" গোপীনাথ কবিরাজের তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে লেখা রচনা থেকে উদ্ধৃত বাক্য দুটোও পারিভাষিক শব্দের কারণে সবার কাছে বোধ্য নয় কিন্তু সংস্কৃতমূল পারিভাষিক শব্দগুলিকে "উদ্ভট" বলা যাবে কি? স্যারের হয়ে যিনি বাংলা ভাষায় " উদ্ভট" পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারের বিরোধিতা করোছেন সেই অরুণাভ ঘোয কি "নাদভূমি", "বিন্দুভূমি" ইত্যাদি পারিভাষিক শব্দকে " উদ্ভট" মার্কা মেরে বিদায় করবেন।
" টেক্সট " শব্দটির ব্যবহার নিয়ে তপোব্রতবাবু আর তাঁর ছাত্ররা অনেক কথা বললেও বোঝা গেল না গান, রচনা, কবিতা ইত্যাদির বদলে " টেক্সট " বলতে তাঁরা কি বোঝাতে চেয়েছেন, অর্থাৎ তপোব্রতবাবুর আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে " টেক্সট " -এর সংজ্ঞার্থ কী। বাঙালির বিশেষ পরিচিত SOED -এর 'টেক্সট' শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে ভাষাতত্ত্বে ব্যবহারের (কিছুটা মামুলি হলেও) সংজ্ঞার্থ দেখা যায়:
[Old Northern French tixte, (also mod. French) texte from Latin textus tissue, style of literary work, (in medieval Latin) the Gospel, written character, from text- pa. ppl stem of texere weave.]
Linguistics. (A unit of) connected discourse whose function is communicative and which forms the object of analysis and description.
তপোব্রতবাবু বলেছেন : 'টেক্সট' ='বাঙ্ময়', "শব্দ-গ্রথিত কাব্যশরীর" (যা কিছু বলা বা লেখা হয় তাই বাগ্ময়, হরিচরণ অর্থ হিসেবে প্রায় সমার্থক "বাগবয়ব " ব্যবহার করেছেন), কিন্তু তা বিশেষণ, তাকে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করতে "মন খুঁতখুঁত করা" সত্ত্বেও যদি ব্যবহার করা হয় তাহলেও তা ভাষা-ব্যবহারের কোনো স্বায়ত্ত্ব (autonomous) একক (unit) নির্দেশ করে না। "শব্দ-গ্রথিত কাব্যশরীর" শ্রুতিমধুর হলেও অস্পষ্ট বা বলা যায়, অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট। যে কোনো বাক্য বা এবং বাচনই তো "শব্দ-গ্রথিত শরীর"। এছাড়া না neither না nor নেতি নেতি পদ্ধতিতে ("আমি যে কোনো স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ লিখছি না...এইরকম কোনো সত্যের অস্তিত্বকে কি স্ট্রাকচারালিস্টরা স্বীকার করবেন?" এই না না-র (নানাবাদ) পদ্ধতিতেও তপোব্রতবাবু 'টেক্সট' বলতে অন্যদের থেকে আলাদা কী বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়।
তপোব্রতবাবুর বেশির ভাগ বাক্যের তির্যক সংগঠনের উষ্মা-মিশ্রিত শ্লেষ (যদি..করেন, চোখ হোঁচট খাবে, এই আর কি) সব ধরনের জাতিভেদ দ্বারা বিভক্ত আমাদের সমাজের স্তরভেদ নির্দেশ করে, নির্দেশ করে উনি অধ্যাপক অতএব তার উদ্দিষ্ঠ বাকিরা হল শিক্ষার্থী ছাত্র।
"আমি যারপরনাই বিনীতভাবে স্বীকার করছি ...অবশ্যই ৫ -নম্বর আমারই বুদ্ধিদোষে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।আর ৬ -নম্বর অনুযায়ী 'রচনা' কিংবা 'পরিরাচনিক' ইত্যাদি লিখতেও মন খুঁতখুঁত করছে।আমার বিনম্র নমস্কার গ্রহণ করুন।" এই আপাত বিনয়ের মধ্যেও অস্মিতার প্রকাশ স্পষ্ট।
তপোব্রতবাবুর বাচনের ভঙ্গি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এই সংজ্ঞাপনের বার্তার উদ্দেশক "উনি" একজন অধ্যাপক (অতএব বিদ্যায়তনিক ঐতিহ্য অনুসারে) উদ্দিষ্ট পরিগ্রাহকরা ছাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। "কোনো স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে 'টেক্সট' শব্দ লিখছি না ", "... কোনো সত্যের অস্তিত্বকে কি স্ট্রাকচারালিস্টরা স্বীকার করবেন?" অনুপস্থিত (বিদেশি) স্ট্রাকচারালিস্টদের প্রতি এই যুদ্ধং দেহি মনোভাব, "কাব্যের মধ্যে কবির সত্য" এই রোমান্টিক রাবীন্দ্রিক কাব্যচিন্তা (স্মরণীয় ওয়ার্ডসওয়ার্থ- এর উক্তি Aristotle … has said, that Poetry is the most philosophic of all writing: it is so: its object is Truth.) , বা অন্য একটি রচনায় উনিশ শতকীয় biographical criticism-র প্রয়োগের কথা ইত্যদি সব মিলিয়ে রাসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রেইমোঁ পিকার (Raymond Picard) সাহেবের "নতুন সমালোচনা না নতুন ভণ্ডামি" (Nouvelle critique ou nouvelle imposture) বইয়ে নতুন সমালোচনা আর বিশেষ করে তার অন্যতম পথ-প্রদর্শক রোলঁ বার্তকে (Roland Barthes) আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দেয়।
তাছাড়া অধ্যাপক ঘোষের উষ্মা আর শ্লেষ মেশানো ধমক বোধ হয়, একদিকে সংজ্ঞাপন /communication- এর ইয়াকবসন নির্দেশিত অভিযোজক/phatic বৃত্তি যাচাই করার অধ্যাপকীয় পদ্ধতি আর অন্যদিকে যারাই তাঁর আলোচনা পড়তে চাইবে তাদের সবাইকে শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা হবে তার ইঙ্গিত ।
শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গানের বাণীকে রচনা (text) হিসেবে তপোব্রতবাবুর পঠন (reading) অনেকটাই রোমান্টিক, জীবনকাহিনী নির্ভর প্রথাগত পঠন। তন্ময়ীভবন ও সহৃদয় (…যেষাং কাব্যানুশীলনাভ্যাসবশাদ্বিশদীভূতে মনোমুকুরে বর্ণনীয়তন্ময়ীভবনযোগ্যতা তে সহৃদয়সংবাদভাজঃ সহৃদয়াঃ) ভারতীয় কাব্যমীমাংসার ধ্বনি প্রস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও ভারতীয় কাব্যমীমাংসা রচয়িতার জীবনবৃত্তান্ত, কবির সত্যের সন্ধানের ভাববাদী রোমান্টিক পঠনের বদলে, বলা যায়, আধুনিক রচনাকেন্দ্রিক পঠনের পক্ষপাতী। তাছাড়া কালিদাসের "মেঘদূত" পড়তে গেলে যদি কালিদাসের জীবনকাহিনির প্রয়োজন হয় তাহলে তা আর পড়া হবে না।
সব শেষে "স্যারের" পক্ষ নিয়ে অরুণাভ ঘোষের বক্তব্য ছিল: ইংরেজি পরিভাষা যা বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের চর্চায় ব্যবহৃত হয় সেগুলি মুলত ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে থেকে আসায় তার সঙ্গে ইংরেজির একটা নিবিড় মিল আছে ... সেগুলির ব্যঞ্জনা কি সত্যিই বাংলায় নতুন কিছু এবং বাস্তবিকভাবেই উদ্ভট পরিভাষায় ধরা সম্ভব? তাই সেগুলির ব্যবহার করলেই "রবীন্দ্রভক্ত বাঙালি আজ তার বিপরীত পথে এগিয়ে চলেছে" এমন কথা বলাটা একটু অতিসরলীকরণ... আর স্ট্রাকচারালিস্ট বা ফর্মালিস্টরা "টেক্সট" বলতে কোনোকিছু ধ্রুবক বোঝাননি, নানা ব্যঞ্জনায় শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যা মূলত প্রসঙ্গ বা কনটেক্সট-এর উপরে নির্ভরশীল ... অতি সাধারণ কথায়, একটা বই আর একটা টেক্সটের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায় যখন বইটি শুধু একটি 'বস্তু' হিসেবে আলমারীতে পড়ে থাকে ... তখন সেটিকে বই হিসেবেই দেখা যায়, একটা 'কমোডিটি' বা বস্তু হিসেবে দেখা যায়, 'রচনা' হিসেবে না ... কিন্তু সেটার ব্যাখ্যামূলক আলোচনা এবং তার ব্যবহার সেটাকেই 'টেক্সট' করে তোলে ... অর্থাৎ টেক্সট নির্ভর করে তার ব্যাখ্যা ও আলোচনার উপরে ... সেই অর্থে একটা কলমও টেক্সট হতে পারে, একটা বালিশও ... এখন স্যারের এই লেখায় একটি গানের কথা এসেছে যা্র অর্থ জনৈক গায়িকা ভুল বুঝেছেন এবং সেটিই ধরে রেখেছেন ... এখানে "টেক্সট" শব্দের ব্যবহার, মানে স্যারের এই লেখার মধ্যে "টেক্সট" শব্দের ব্যবহার কোনোভাবেই কি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে? বরং আরো অনেক বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়েছে যা ঐ উদ্ভট বাংলা ব্যবহারে হতে পারত ... আরো একবার সকলে ভাবতে পারেন …
এর পর অরুণাভবাবুর বক্তব্য সম্পর্কে আমি যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত করেছিলাম, অবান্তর বা এহো বাহ্য বোধে তার কোনো প্রত্যুত্তর দেওয়া হয়নি। বস্তুত মাননীয় অরুণাভ ঘোষ মহাশয়ের বক্তব্য পড়ে আমার মনে পড়েছিল ছোটবেলায় আমার মাতামহ আমাদের বলতেন , কী সব উদ্ভট শব্দ তোরা শিখছিস : বীজগণিত, ভূগোল, আলজেব্রা, জিওগ্রাফি... কী সুন্দর! তার বহুকাল পরে ভাবতাম দাদু যদি জানতেন আলজেব্রা আরবি আল্-জাব্র্ ওয়াল শব্দ থেকে আসা তাহলে হয়তো শব্দটি তাঁর তালিকা থেকে বাদ দিতেন । ঘোষ মশায় জানিয়েছেন, "ইংরেজি পরিভাষা যা বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের চর্চায় ব্যবহৃত হয় সেগুলি মুলত ফরাসি ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে থেকে আসায় তার সঙ্গে ইংরেজির একটা নিবিড় মিল আছে" ... এখানে প্রথম প্রশ্ন হল কেন, তারপর এই ফরাসি "ভাষাতাত্ত্বিক" কারা আর নিবিড় মিল বলতে কী বোঝানো হয়েছে? "সেগুলির ব্যঞ্জনা কি সত্যিই বাংলায় নতুন কিছু এবং বাস্তবিকভাবেই উদ্ভট পরিভাষায় ধরা সম্ভব?" এই দ্বিতীয় বাক্যে ব্যঞ্জনা বলতে কি শব্দের অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা , এই তিন বৃত্তির অন্যতম ব্যঞ্জনাবৃত্তি বোঝানো হয়েছে না বাচ্যার্থ , লক্ষ্যার্থ বাদ দিয়ে ব্যঙ্গার্থ নির্দেশ করা হয়েছে (সংস্কৃত শব্দার্থতত্ত্বও উদ্ভট ?)। বাংলা ভাষায় ওই ধারণাগুলো নতুন কিছু নয় এটাই কি ঘোষ মশায়ের বক্তব্য? তা যদি হয় সেই বক্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত? এর পর ঘোষ মশায় জানিয়েছেন যে 'কমোডিটি' বা বস্তুর ব্যাখ্যামূলক আলোচনা এবং তার ব্যবহার তাকে 'টেক্সট' করে তোলে, একটা কলমও টেক্সট হতে পারে, একটা বালিশও—ঘোষ মশায় যদি টেক্সট-এর এই ব্যাখ্যার সূত্র জানান তাহলে আমরা উপকৃত হই। তবে "কমোডিটি' বা বস্তু হিসেবে দেখা যায়, 'রচনা' হিসেবে না" এই বাক্যাংশে ঘোষ মশায় নিজেই "রচনা" ব্যবহার করে শব্দটির স্বাভাবিকতা আর যাথার্থ্য প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া "ধ্রুবক" ও "ব্যঞ্জনা", এ দুটি পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারও পরিভাষার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে।
শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার সমস্ত ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পক্ষপাতী রবীন্দ্রনাথের "ভক্ত বাঙালি আজ তার বিপরীত পথে এগিয়ে চলেছে" অমিতাভবাবুর মতে, "এমন কথা বলাটা একটু অতিসরলীকরণ"। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা যে কোনো বিষয়ে জটিল তোমরা কী বুঝবে, তাচ্ছিল্যের স্মিত হাসি সহ "সরলীকরণ", "অতিসরলীকরণ" শব্দে এই মনোভাব প্রকাশ করছেন। আমার প্রশ্ন কেন, কীভাবে "অতিসরলীকরণ"?

No comments:

Post a Comment