Saturday 17 October 2015


শমীন্দ্র ঘোষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙালি স্বপূর্বপুরুষের খুনি-দুর্গাপূজক

১৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ ভোর ৪:২৪

দুর্গাপূজা বাঙালির প্রধান উত্‍সব ও সামাজিক উত্‍সব -- প্রচারটা চলছে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও বহু শিক্ষিত বাঙালির দ্বারা। রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণে এবং পৃষ্ঠপোষক কর্পোরেট ফাণ্ডিং-এর কল্যাণে এখন এটা হুজুকে মাত্রাছাড়া!
আবেগপ্রবণরা, ধান্দাবাজরা হুজুকে মাতুক। আমরা বরং সত্যটা জেনে নেই,
আসুন--
বাঙালির প্রায় অর্ধাংশ অ-হিন্দু। পশ্চিমবঙ্গেও সব বাঙালি হিন্দু নয়। তাই দুর্গাপূজাও সব বাঙালির নয়। বরং হিন্দুদের বা হিন্দুবাঙালির পূজা। তাই নয় কি?
দুর্গাপূজাটাকে সামাজিক বলে প্রচার চালাচ্ছে উগ্রহিন্দুবাদী ও রাজনৈতিক দলও। এখন অনেক মুসলমানও বাধ্য হয়ে এই পূজাতে অংশ নেয়। যেন 'টকের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে তেঁতুলতলায় বাস'! তবু তারা এভাবেই ইসলামবিরোধী।
বঙ্গসমাজে আছে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, উপজাতিধর্ম সরণা, ইহুদি, পার্শী প্রভৃতি ধর্মের মানুষ। এদের সিংহভাগই বাংলাভাষী এবং সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিই। এরাও অংশ নিতে বাধ্য হয়। বাংলার জনসমাজ শুধু হিন্দুদের দ্বারা গঠিত নয়। তাই, এই পূজা সার্বিক সামাজিকও নয়। তাই নয় কি?
এরপরও বাঙালি নাস্তিক-ধর্মহীন-যুক্তিবাদী-মানবতাবাদীরা আছে বঙ্গভূমে। তাই, দুর্গাপূজা বাঙালির এবং সামাজিক পূজা ও উত্‍সব কিছুতেই হতে পারে না। বরং তা শুধুমাত্র হিন্দুদের পূজা।

ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে হয় অনেক সময়। এখন শিবানীর গীত গাইতে হবে দুর্গা ভানতে। তাই, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গবেষণায় প্রাপ্ত নতুন তথ্য জানাচ্ছি।
প্রগ্বৈদিক ধর্ম দেবীপ্রধান। নারীকে সৃজনীশক্তির আধার ভেবে উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাসে পূজা শুরু।
বৈদিকধর্মে নারী পূজিতা নয়। এরা পুরুষ দেবতার সঙ্গীনী। ঋগ্বেদে দুর্গা নেই। দুর্গা পৌরাণিক। বৈদিক ও প্রাগ্বৈদিক ধর্মসংশ্লেষে হিন্দুধর্মের উত্‍পত্তির চরম পর্যায়ে দুর্গার আমদানি করে বৈদিকরা। সংশ্লেষের শুরু প্রাগ্বৈদিক বিষ্ণুকে ঋগ্বেদে অন্তর্ভূক্ত করে বৈদিক ছাপ দিয়ে। নামটা বৃষ্ণি থেকে বিষ্ণু। এরপর শিবকে বৈদিক রুদ্রর সঙ্গে সমীকরণ করে। রুদ্রও ঋগ্বেদে নবীন, শেষের দিকের।
চরম পর্যায়ে প্রাগ্বৈদিক দেবীদের বৈদিকরা স্বীকৃতি দিতে থাকে নাম রূপ কর্ম ইত্যাদি নিজেদের ছক মতো পরিবর্তন সমীকরণ করে করে। ততদিনে ঋগ্বেদের ইন্দ্র, মিত্র, অগ্নি, বরুণ, বায়ু, পর্জন্য প্রভৃতি পুরুষ দেবতারা পিছু হটেছে। এই অভাব পূরণে এল প্রাগ্বৈদিক দেবীরা। কারণ, জয় করতে হবে অজেয় অগম্যভূমি নারীপূজক পূর্বভারতকে। দ্বারবঙ্গ থেকে কিরাতভূমি হলো বঙ্গভূমি। চলছে বৈদিক তথা হিন্দুভক্ত গুপ্তযুগের শাসন। তখন এঅঞ্চলে সমাজের সঙ্গে ধর্ম সম্পৃক্ত, জ্যোতিষে আক্রান্ত। ব্যক্তি সমাজবদ্ধ, ধর্মভীরু। আর্থসমাজ দুর্বল হচ্ছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া প্রবল নাস্তিক্যবাদ। তখনই দুর্গা ও তার সঙ্গে সমীকরণ করে বহুদেবী এল পুরাণে; বাসন্তী, চণ্ডী, পার্বতী, গৌরী, মহালক্ষ্মী, কালী, বিন্ধ্যবাসিনী, পার্বতী ইত্যাদি। আরও পরে মনসা, শীতলা, পর্ণশবরী, চণ্ডিকা, বাশুলী ইত্যাদি এলো মঙ্গলকাব্য যুগে। এই চণ্ডীর সঙ্গে দুর্গাকে সমীকরণ করা হয়েছিল পুরাণে।
মঙ্গলকাব্য যুগ একদিকে বৈদিক ও প্রাগ্বৈদিক সংশ্লেষের শেষ পর্যায়; যেখানে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এবং হিন্দু-মুসলিম সংশ্লেষ শুরুর পর্যায়; যা যুক্তসাধনা। এখানে এল ওলাবিবি, বনবিবি, কালুপীর, ধর্মগাজন, সত্যপীর ইত্যাদি। এই সত্যপীর শেষে হলো সত্যনারায়ণ। এভাবে ধর্মীয় সংশ্লেষের চরম পর্যায়টি হয় বঙ্গভূমেই।
তখনও বঙ্গভূমি প্রাগ্বৈদিক ধর্ম ও নাস্তিক্যে সম্বৃদ্ধ। মূলস্রোত নাস্তিক্যবাদ। বঙ্গের সাংস্কৃতিক মান ও ভাষাজ্ঞান দক্ষিণ এশিয়ায় সুউন্নত ও সম্বৃদ্ধ। হিন্দুকুশ পেরনোর পরে দীর্ঘ প্রায় ১৫০০বছরে বৈদিকরা এই বঙ্গে দাঁত ফোঁটাতে পারেনি। বরং বঙ্গসংস্কৃতিকে একশ্রেণির বৈদিক শ্রদ্ধা করত। তারা তীর্থদর্শনে আসত ও ফিরে গিয়ে পুনোষ্টোম যজ্ঞ করে শুদ্ধ হতো। বাকি বৈদিকরা বঙ্গের শক্তিকে সমীহ করত ও ঘৃণাও করত। বৈদিক সাহিত্যে এর উদাহরণ প্রচুর।
বৈদিক-হিন্দুধর্ম গ্রন্থগুলোতে পরস্পর বিরোধিতা চরম।

অভিধানমতে, দুর্(দুঃখ) গম্(গমন করা, জানা)+অ(কর্মবাচ্যে/কারকে)= দুর্গ+আ= দুর্গা(স্ত্রীলিঙ্গ)। যাঁকে দুঃখে জানা যায়। যিনি দুর্গ অর্থাত্‍ সঙ্কট থেকে ত্রাণ করেন।
তন্ত্রে দ্=দৈত্যনাশ-সূচক, উ=বিঘ্ননাশ-সূচক, র্=রোগনাশ-সূচক,গ্=পাপঘ্নবাচক, আ=ভয়বাচক ও শত্রুনাশ-বাচক।
পুরাণমতে দুর্গ নামক অসুর বিনাশকারী হলেন দুর্গা। মহাশক্তি মহামায়া দুর্গা।

নৃতাত্ত্বিক আলপীয়রাই অসুরজাতি। এরাই বাঙালির অন্যতম পূর্বপুরুষ। অসুর ছাড়াও বঙ্গভূমে এসে এরা শিব-শিবাণী, ষাঁড়-মহিষ পূজাও করত। যদিও দেব-দেবতা অসুর প্রভৃতি ঐশ্বরীক সবই কল্পনা। ঋগ্বেদে এদের অসুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ভাষাও মাগধি-প্রাকৃত-অস্ট্রিকের সঙ্গে সংশ্লেষিত হয়ে বর্তমান বাংলায় আছে। বাঙালির ভাষাকে সেইসময়ে "অসুরজাতির ভাষা" হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বৈদিকরা। বাঙালির বাহন ষাঁড়, মহিষ, বলদ প্রধান। ষাঁড়-মহিষ নিয়ে উপজাতিদের মধ্যে এখনও বহুল প্রচলিত বাঁধনা পরব। বাঙালির আদি দেবতা শিবের বাহন ষাঁড়। অসুরজাতির প্রতীক হিসেবে মহিষাসুরকে, অর্থাত্‍ 'মহিষ পালক অসুরজাতি'কে বধের গল্প দিয়ে বৈদিক বেশ্যা "আনা"কে দুর্গা নামে বাঙালির মধ্যে প্রচার করা হয়। উদ্দেশ্য বৈদিক তথা হিন্দুত্বে বশ্যতা স্বীকার করানো। প্রাগ্বৈদিক-বৈদিক ধর্ম ও সামাজিক আচার সংশ্লেষের চূড়ান্ত পর্যায়। এরপর হিন্দুব্রাহ্মণরা প্রচার শুরু করে। প্রাথমিক সময়ে অসুর হিসেবে উপজাতিদের চিহ্নিত করে ও দুর্গাকে দুর্গতিনাশক হিসেবে বোঝানো হয় বাকি বাঙালিকে। পরে রাজা-জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রমরম করে চলতে থাকে বঙ্গে। দুর্গাদালানেই এপূজা হতো। বাঙালি মুখস্থ করে নেয়, দুর্গতিনাশক মাতৃত্বের প্রতীক দেবী দুর্গা ও অসুর হলো অনুন্নত, কদর্য, ঘৃণ্য জীব; যেমনটা ভাবত বৈদিকরা।
কথিত আছে মৈমনসিংহের জনৈক স্থানীয় জমিদার কংসনারায়ণ রায়চৌধুরী এই পূজার প্রচলন করেন। কিন্তু এটা সঠিক নয়।
এই পূজা বঙ্গে দশ-এগারো শতকে হত, এর প্রাচীন প্রমাণ আছে। চৌদ্দশতকে আন্দুলে ও পনেরো শতকে রংপুরে দুর্গাপূজা হয়। কলকাতায় শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭-তে এপূজার প্রবর্তক। বারোয়ারির শুরু হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় ১৭৬১ বা ১৭৯০-তে।

No comments:

Post a Comment