Saturday 31 October 2015

বাংলা ছড়া ছড়িয়ে আছে / পার্থ বসু
নৌকায় পাবনা থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে ঘনায়মান সন্ধ্যা আর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে একটি বেয়ে আসা ডিঙির গানে রবি ঠাকুর উৎকর্ণ হয়েছিলেন---
যুবতী ক্যান বা কর মন ভারী
পাবনা থেহা আন্যে দিব টেহা দামের মোটরি।
কবির গ্রাম্য সাহিত্য নিবন্ধে ছড়াটির উল্লেখ আছে শুরুতেই। লোকসাহিত্যের চর্চা , সংগ্রহ, আর সংরক্ষণে তিনিই পথিকৃৎ। দেশভাগের পর , বিশেষ করে বাংলাভাগের পর, বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলায় ছড়িয়ে থাকা লৌকিক ছড়া নিয়ে যে সব অমুল্য কাজ হয়ে চলেছে এখানে সাধারন্যে তার প্রচার নেই।
ঘটিগরমের পাঠকদের তার কিছু পরিবেশন করব ভাবছি।
প্রথমে নেত্রকোনার কথায় আসি। আমাদের এপার বাংলায় ঘুমের মাসী পিসী ওপারে নেত্রকোনায় নিন্দাউলি মাইয়া। নিন্দা মানে নিদ বা নিদ্রা কিন্তু। নিন্দা ভেবে বসবেন না। তাঁকে খাতির যত্নের বহরটি দেখুন
নিন্দাউলির মাইয়া গো আমার বাড়িত যাইও
খাট নাই পিড়ি নাই আবুর চউখ্যে বইও।
নিন্দাউলি মাইয়া রে আমার বাড়িত যাইও
হাইল ধানের চিড়া দিয়াম পেট ভইরা খাইও।
হাইল ধানের চিড়া দিয়াম বিন্নি ধানের খই
পাতে মজা শবরী কলা গামছা বান্দা দই।।
তাহলে শালি ধানের চিঁড়া , বিন্নি ধানের খই, শবরী কলা এবং গামছায় বাঁধলেও ভাঙবে না এমন দই খাওয়া গেল। এবার নেত্রকোনার একটি বিখ্যাত মিষ্টির কথা।বালিশ।
না , এ বালিশ মাথায় দেওয়ার বালিশ না। কোল বালিশ ? তাও না। দেখতে কোল বালিশের মত। তাই লোকমুখে নাম জারি হল-- বালিশ। রসগোল্লার আবিষ্কর্তা নবীন ময়রার থেকে এই বালিশের আবিস্কারক নেত্রকোনায় কম খ্যাত না। গয়া নাথ ঘোষ এই সে দিনও ও বাংলাতেই ছিলেন। ১৯৬৯ এ সপরিবারে দেশ ছেড়ে এপারে আসেন। পাক প্রণালী , মন্ত্রগুপ্তি দিয়ে এসেছেন এক সময়ের কর্মচারী নিতাই মোদককে। মিষ্টিটি এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়। নিতায়ের ছেলেরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে।
বালিশ নিয়ে আর একটু বিশদ বলি। মিষ্টির উদ্ভাবন প্রায় একশ বছর আগে। নেত্রকোনার বারহাট্টা রোডে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার এখনও স্বনামে টিকে আছে। ঘ্রাণে না হোক কানে নিন।
মিষ্টিটি তৈরির উপকরণ দুধ-ছানা, চিনি ও ময়দা। প্রথমে ছানার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে মণ্ড , মণ্ড দিয়ে বালিশ , তাপর গরম চিনির রসে ভাজা। গা জুড়োলে চিনির রসে আবার ডুব। যখন রসে টইটম্বুর বিক্রি হবে ক্ষীরের প্রলেপ , দুধের মালাই গায়ে মাখিয়ে। তিন সাইজে তৈরি হয়। বড় বালিশ তেরো থেকে চোদ্দ ইঞ্চি। আরও বড় চাই ? অর্ডার করুন।
জিভে জল আসছে তো ?
শ্বশুরবাড়ি বালিশ না নিয়ে গিয়ে নতুন জামাই কি ফাঁপরে পড়েছিল সেই ছড়াটি শুনুন তবে। জামাই জাম নিয়েছিল, কোলকাতার রসগোল্লাও নিয়েছিল। কিন্তু
জাম, রসগোল্লা পেয়ে শ্বশুর করলেন চটে নালিশ
আশা ছিল আনবে জামাই গয়ানাথের বালিশ।
মিষ্টি তো স্বপ্নে খেলেন। গলা শুকোল ? পানি খান।
ওহহো। জল নাকি পানি এই ধন্দে বিষম খাচ্ছেন ? গোবলয়ে কিন্তু পানি নিয়ে বিবাদ নাই। এখানে এখনও বর্ধমান। তো ছড়ায় ছড়ায় বর্ধমান যাই চলুন
ও বাবা! এটা কে ? / আমি। আমি ভোম্বল।
তোমার পেট এত মোটা কেন ? / আমি যে অনেক খাই।
গায়ে কেন জামা নাই ? / জামা নাই, আঁটে না।
কাঁধে কি ? কম্বল।
--ভোম্বল দাসের কম্বল খান। কম্বল ধইরা মারল টান।
কম্বল গেল বর্ধমান।
বর্ধমানের পোলাপান। বাপে কইল হুঁকা আন।
হুঁকার মধ্যে ছিল পানি
টান দিল যেই জানাজানি এবং হইল কানাকানি----
আমরা হুঁকা টানি না হুঁকার কথা জানি না
হুঁকার কথা জানি না ---
একটি খেলার ছড়ায়, একটি ঘুমপাড়ানি গানেও কান পাতুন। এগুলিও নেত্রকোনার।
খেলার গান
ঝুম ঝুম পশ্চিমে বিয়া খাব নারিকেল চিনি দিয়া।
কলাগাছের গলা পানি, ছাগলের আড়ুপানি।
ঘুমপাড়ানির গান
লালি লালি লালি রে ঘুইঙ্গা মাছের তেল।
আমার আবু ছান করে গায়ে মাইখ্যা তেল।।
গাঙে থাইক্যা আইন্যা পানি ঢাইলা দিছি গায়।
আপদ বিপদ লইয়া পানি গাঙে চইল্যা যায়।।
কোন গাঙে ? গঙ্গায় ? পদ্মায় ? নাকি তিস্তায় ? না। কোন গুরু গম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় যাব না। বরং ছড়ায় ছড়ায় ছড়িয়ে যাব। আবহমান বাংলাদেশে।
যে পরিমান কৃষিজমি ফেলে ও বাংলায় গেছিলেন মুসলিম চাষিরা তার তিন ভাগের একভাগ এখনও অকর্ষিত। একটি শুকনো পরিসংখ্যান। এই যে ভোম্বল দাসের ছড়া আর বর্ধমানের স্মৃতিকাতর ওপারের মানুষ, কিংবা যশোর , খুলনা, বরিশালের স্মৃতিকাতর এপার এই ফেলে যাওয়া আর ফেলে আসার কোন পরিসংখ্যান নেই। ঢাকা , নোয়াখালি, সিলেট সমগ্রের কথা বললে ক্ষতির খতিয়ান লিখে শেষ হবে না। আজকের মত একটি তাঁতির বাড়ির ছড়া শুনিয়ে সমাপ্তি টানব।
সেই যে তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা। বাসাটি কোথায় ? ঢাকা না টাঙ্গাইল ? ধনেখালি না রাজবলহাট। অখণ্ড বাংলায় এই ছড়াটি যতটা আকাশ পেয়েছে , আজ তা পাচ্ছে কি ? ভাবনা শেখানেই। ছড়াটির প্রথম দুলাইন সুপ্রসিদ্ধ। বনশ্রী সেনগুপ্তের কণ্ঠে আরও কিছু শুনেছি। কি রকম ?
তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা কোলা ব্যাঙের ছা।
খায় দায় গান গায় তাই রে নাইরে না।।
এরপর গানটির ঠিকানা পাচ্ছি ধনেখালির আশপাশ। জিলা হুগলী।
সুবুদ্ধি তাঁতির ছেলের কুবুদ্ধি ঘনাল।
আখড়াবাড়ি দিয়া তাঁতি ব্যাঙের ছা মারিল।।
এরপর ব্যাঙেদের পাল্টা প্রতিশোধের কাহিনী। আগে ডাঙা, পাছে ডাঙা মধ্যে ধনেখালি। সেখান থেকে এল ব্যাঙ চোদ্দ হাজার ঢালি। হুগলী শহর থেকে সনাতন সেপাই আসছে। গোঁসাই ব্যাঙের কাছে বিলাপ আর তাঁতির প্রাণভিক্ষা।
লিরিক কার জানা নেই। পাই নি। কিন্তু মনে হয় ওপার বাংলার কেউ। দীনবন্ধু মিত্রের রচনায় পেয়েছিলাম এক সুবুদ্ধি গোয়ালার মেয়ের কথা যে পীরকে দুধে জল মিশিয়ে ঠকিয়েছিল।
এই যে এপার বাংলা ওপার বাংলা করে পরস্পরকে জানার কথা বলছি এতো বিসমিল্লায় গলদ। এতো আসলে আপনাকে এই জানা আমার না ফুরানোর গান। বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্রীয় প্রপঞ্চ মাত্র। বাংলা জাতীয়তা আর সংস্কৃতি অবিভাজ্য।
এই অনুভবেই
ঝিম ঝিম লতাপাতা কালকে যাব কলিকাতা।
কলিকাতা ঢম ঢম,
টম্যাটো বাইগন গাড়ি আমার বড় ভাই
টাকা দিলে ঢাকা যাই।
এই ছড়াও নেত্রকোনার। ঠিক ততটাই আপনারও। আমারও। যে যেখানেই থাকি।

No comments:

Post a Comment