ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বাতিল করা সত্ত্বেও, কোনো পক্ষই বাংলার অখণ্ডতা পুনরুদ্ধারের জন্য তেমন তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা নেই। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় অনেক সময় অত্যন্ত আকস্মিক ও স্বল্পকালীন উদ্যোগ দ্বারা উদ্ভূত ঘটনা পরবর্তীতে সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক কল্পনার পরিগঠনের স্থায়ী সুরত তৈরি করে দিতে পারে। আমি ইতিমধ্যে দেখিয়েছি পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশ উভয়স্থানের ঐতিহাসিক স্মৃতি দ্বিতীয়বারের বাংলাভাগের বাস্তবতাকে কঠোরভাবে অস্বীকার করে; তথাপি ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকে নতুন জাতীয়তাবাদী কল্পনার সম্ভাবনা দেশভাগের পরিণাম দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তার বাইরে যেতে পারেনি।
স্বদেশি সময়কার জাতি
১৯০৫ সালের প্রথম বাংলা ভাগের সাথে ১৯৪৭-এর দ্বিতীয়বারের বাংলা ভাগের তুলনার জরুরত আছে।
প্রথমবারের বাংলা ভাগ (পশ্চিমে বাংলা এবং পূর্ব দিকে পূর্ব বাংলা ও আসাম) একান্তই উপর মহলের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফসল। সে সময়ে বঙ্গভঙ্গের জন্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন হয়নি, যেরকম আমরা এখনকার সাংস্কৃতিক জনমিতির নিরিখে প্রদেশভাগের দাবিকারী জাতীয়তাবাদী তৎপরতায় দেখে থাকি। উল্টা, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের উছিলায় ভারতে সম্ভবত প্রথম গণভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (স্বদেশি আন্দোলন) সংঘটিত হয়। বাংলার মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে এক ও অবিচ্ছেদ্য এর বরাতে তারা বঙ্গভঙ্গ রদের দাবি জানায় এবং ১৯১১ সাল নাগাদ সফলও হয়। বঙ্গভঙ্গের কারণ হিশেবে প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলা হয়: ১৮৯০০০ বর্গমাইল এলাকা ও ৭৯ মিলিয়ন জনসংখ্যাবিশিষ্ট অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অসাধ্য। কিন্তু সুমিত সরকার তার ক্ল্যাসিক গবেষণায় দেখিয়েছেন প্রশাসনিক বিবেচনার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনাও এক্ষেত্রে সমান ভূমিকা রাখে।১ এর মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত কারণ হচ্ছে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সঞ্চারণশীল জাতীয়তাবাদী অনুভূতির বিকাশকে দমানো। ঔপনিবেশিক গভর্নর উপলব্ধি করেছিলেন প্রদেশের বিভক্তি পুরো বাংলা প্রশাসনের ওপর এদের আন্দোলনের আছর কমাবে, এই আন্দোলনের চারিত্র সেসময়ে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক না হলেও অবন্ধুসুলভ ছিল।
এথনোগ্রাফার এবং প্রশাসক এইচ.এইচ. রিসলি তার বহুল উদ্ধৃত দুটি বাক্যে বলেছিলেন: ‘অবিভক্ত বাংলা এক ধরনের শক্তি বা হুমকিস্বরূপ। বিভক্ত বাংলা অনেক দিক থেকেই চাপে থাকবে… আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিভক্ত করা এবং আমাদের শাসনকাজের বিরোধী প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা।২
অন্যভাবে বললে, ঔপনিবেশিক প্রশাসনের রাজনৈতিক মতলব ছিল দমনমূলক : হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী প্রতিপক্ষকে বাধাগ্রস্ত করা। ভাইসরয় কার্জন তাদের মতলব সোজা-সাপটা ভাবেই উল্লেখ করেছিলেন :
‘যারা নিজেদেরকে বাঙালি জাতি মনে করে এবং স্বপ্ন দেখে যখন ইংরেজরা চলে যাবে আর বাঙালি বাবুরা কলকাতার গভর্মেন্ট হাউসে অধিষ্ঠিত হবে, তখন তারা বাংলাভাগের যেকোনো উদ্যোগকে সেই স্বপ্ন পূরণের প্রধান অন্তরায় মনে করবে। আমরা যদি দুর্বল হয়ে তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিই তাহলে কোনোদিনই বাংলাকে ভাগ করা যাবে না এবং ভারতের পূর্বদিকের শক্তি আরো দৃঢ় ও মজবুত হবে এবং আমাদের সমস্যার নিরন্তর উৎস হবে।’৩
ঔপনিবেশিক কৌশলের অন্যদিকের কথা উল্লেখ করতেও তিনি ভোলেননি : বঙ্গভঙ্গ ‘পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রদান করবে যার স্বাদ তারা বিগত মুসলমান শাসনামলের পর থেকে পায়নি।’৪
সুতরাং ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ যদি প্রাথমিকভাবে ঔপনিবেশিক ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ কৌশলে সহায়তা করে, তাহলে আমরা দেখব সেই কৌশল এলাকা এবং সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে এরই মধ্যে হাজির ছিল। সেসময়ে আসলেই একটি জাতি ছিল নাকি দুইটি এটা ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। বরং এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল একক জাতির কল্পনা রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। আর এই রাজনৈতিক বাস্তবতার ভিতর ভাষাভিত্তিক ও ধর্মভিত্তিক দুটি জাতি তৈরির চেতনাকে উসকে দেয়ার পর্যাপ্ত রসদ ছিল।
মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই প্রথম বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গ কর্তৃক সৃষ্ট স্থিত অবস্থাকে অস্থির করে তোলার ক্ষেত্রে, স্বদেশি আন্দোলনের যে সাফল্য (এ আন্দোলনের প্রধান নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির ভাষায়) বাংলায় সেটিই জাতীয়তাবাদী কল্পনার ক্ষেত্রে প্রধান স্ফূরণ ঘটায় এবং পরবর্তী দশকগুলোর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মতাদর্শিক ও সাংগঠনিক রূপরেখা প্রদান করে। এটিই প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যখন ভারতের জাতীয়তাবাদী কল্পনা এলাকাভিত্তিক বিভাজনের রাষ্ট্রীয় এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। নানান ধর্মীয় জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও বাংলা এক ও অবিচ্ছেদ্য এই চেতনা একটি জাতির ‘স্বাভাবিক ইতিহাসের’ (natural history) ধারণাকে মজবুত ভিত্তি প্রদান করে যেখানে এক জাতির ভিতরেই বিভিন্ন এলাকা ও সংস্কৃতির সহাবস্থান সম্ভব। এই স্বাভাবিক-ঐতিহাসিক থিম ভারত রাষ্ট্রকাঠামোর ভিতর বাংলার অন্তর্ভুক্তিকে সহজ করে দেয়। কারণ বাংলার সংস্কৃতিকে ভারতীয় জাতির বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ঐক্যের ‘স্বাভাবিক’ অংশ হিশেবেই গণ্য করা হয়।
তবে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সাফল্য কদাচিৎই এই একক ও সর্বব্যাপ্ত জাতির ধারণায় যে ফাটল আছে তা লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। এ সময়ে বাংলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নেতৃত্ব পুরোপুরিভাবে উচ্চবর্ণ হিন্দুর হাতে ছিল। আরো তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, এই জাতি ছিল সুস্পষ্টভাবেই ‘হিন্দু’, কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে তারা এই জাতীয়তাবাদী কল্পনাকে বা জাতির এই ধারণাকে জনমানসে স্বাভাবিক হিশেবে চাপিয়ে দিতে কামিয়াব হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, হিন্দুকেন্দ্রিক জাতির এই ধারণা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল বা জাতির চৌহদ্দি থেকে মুসলমানদের বাদ দিয়েছিল। এটাও উল্লেখ করবার মতো যে, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে সামান্য রাজনৈতিক প্রচারণা দেখা গেলেও স্বদেশি আন্দোলনকারীরা জাতীয়তাবোধ জাগরণের জন্য ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে’র মাহাত্ম্য প্রচার করে বেড়ায়। যেমন: বিপিনচন্দ্র পাল একটি ‘মিশ্র দেশাত্মবোধ’ ও ফেডারেল ইন্ডিয়ার ধারণা প্রদান করেন যেটি গঠিত হবে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, আদিবাসী নিয়ে।৫ এই ধারণা গণ জাতীয়তাবাদী পর্যায় জারি থাকে এবং ১৯২০ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের ‘হিন্দু-মুসলমান চুক্তি’তে চমৎকারভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে হিন্দুয়ানি ভাবধারায় গঠিত জাতির ‘স্বাভাবিক ইতিহাসের’ ধারণার পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ ‘ঐক্যের ধারণা’ও তখন বিকশিত হচ্ছিল। এই দুটি ধারণা সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ পায় একেবারে প্রথমদিককার জাতীয়তাবাদী এক রচনায়, যেখানে আমরা স্বাভাবিক সম্পর্কের উপমার চূড়ান্ত প্রয়োগ দেখতে পাই ‘ভারতভূমি যদিও হিন্দু জাতীয়দিগেরই যথার্থ মাতৃভূমি, যদিও হিন্দুরাই ইহার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তথাপি মুসলমানেরাও আর ইহার পর নহেন, ইনি উহাদিগকেও আপন বক্ষে ধারণ করিয়া বহুকাল প্রতিপালন করিয়া আসিতেছেন। অতএব মুসলমানেরাও ইহার পালিত সন্তান।
‘এক মাতারই একটি গর্ভজাত ও অপরটি স্তন্যপালিত দুইটি সন্তানে কি ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ হয় না? অবশ্যই হয়Ñসকল শাস্ত্র মতেই হয়। অতএব ভারতবর্ষ নিবাসী হিন্দু এবং মুসলমানদিগের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ জন্মিয়াছে…’৬
সংক্ষেপে, স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাংলায় যে কল্পিত জাতির প্রভাবশালী সুরত তৈরি হয় তার একদিকে ছিল আর্য-হিন্দু ধারার স্বাভাবিক ইতিহাসআশ্রিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং পাশাপাশি ছিল ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক একাত্মতা ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের গীত। তখন এই সমন্বয় সম্ভবপর হয়েছিল কারণ ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাংলা অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বাংলায় সংখ্যালঘু হিন্দুরা তখনও পর্যন্ত কোনো মসিবত আকারে হাজির হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী এলিটরা (মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দু, ভূস্বামী এবং শহুরে পেশাজীবী শ্রেণির সমষ্টি) নিজেদেরকে অবস্থান তখনও পর্যন্ত অনায়াসেই কল্পিত জাতির নেতৃত্বস্থানেই দেখেছেন।
দুটি পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে ওলট-পালট করে দেয়। পয়লা, বিশের দশক থেকে ভারত জুড়ে উত্থানের ফলে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সম্পূর্ণ নতুন সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয় যেখানে বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতাদের অবস্থান প্রান্তিক অথবা কখনো কখনো সর্বভারতীয় কংগ্রেসের বিপরীতমুখী হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়, বাংলায় মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের রাজনীতি কৃষিভিত্তিক পাটাতন খুঁজে পায়। ফলে কৃষিভিত্তিক শ্রেণিসম্পর্কের প্রশ্নকে মোকাবেলা করতে না পারায় হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্ববোধের পুরানো গীত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় পরিবর্তনটা দিয়েই আগে শুরু করা যাক, যেহেতু দ্বিতীয়বারের বাংলা ভাগের ‘কাঠামোগত’ ব্যাখ্যার এটি একটি জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।
দেশভাগের ইতিহাস
পূর্ববাংলার কৃষকশ্রেণি প্রধানত মুসলমান এবং অধিকাংশ জমিদারই ছিল হিন্দু এই বাস্তবতা অনেক ঐতিহাসিক বিশেষত মার্কসীয় ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত শর্ত হিশেবে বিবেচিত হয়েছে কারণ এর ফলে শ্রেণি সংঘাতকে ধর্মীয় সংঘাত হিশেবে আখ্যায়িত করা সম্ভব হয়েছে এবং ইংরেজরা একে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনকে ব্যবহার করে। বাংলাদেশি র‌্যাডিকাল ঐতিহাসিক বদরুদ্দীন উমর যেমন বলেছেন এখানে ইংরেজ শাসকরা কিছু সংঘাতহীন দ্বন্দ্বকে সংঘাতপূর্ণ দ্বন্দ্বে পরিণত করে আর সে কারণেই দেশভাগ সম্ভব হয়েছিল।৭ সুগত বসু এই যুক্তির সবচাইতে সতর্ক গবেষণালব্ধ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।৮ তিনি লক্ষ করেছেন পূর্ব বাংলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোতে প্রায় সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কৃষকশ্রেণি বিরাজমান ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত এই কৃষকশ্রেণির সাথে হিন্দু জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের ‘পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক’ ছিল, যারা এখানকার মুদ্রানির্ভর কৃষি অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করতো। তবে ত্রিশের দশকের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে গ্রাম্যঋণের এই জাল ধ্বংস হয়ে ‘শ্রেণিক্ষমতার ভারসাম্য কৃষকদের পক্ষে ঝুঁকে যায়’। উপস্বত্বজীবী এবং ব্যবসায়ী শ্রেণিÑ ‘তাদের কার্যকারিতা হারায়। যখন এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটি সম্ভাবনার বিস্তৃত ময়দানে চলে আসে তখন সুবিধাপ্রাপ্ত ধর্মপন্থীরা ধর্মীয় পরিচয়ের শক্তিকে নিরাপদ মতাদর্শরূপে ব্যবহার করে। পূর্ববাংলার বিশাল ক্ষুদ্র কৃষক সম্প্রদায় যারা একই অর্থনৈতিক শর্তের নিচে বসবাস করতো, ধর্ম তাদেরকে ‘সম্প্রদায়’-এর ধারণা প্রদান করে; ফলে বাংলার ইতিহাসের এক জটিল সন্ধিক্ষণে ধর্ম ‘জাতীয় বন্ধনের’ বুনিয়াদরূপে আবির্ভূত হয়, পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিকভাবে আরো মজবুত হয় এবং শেষতক মুসলমানদের স্বতন্ত্র মাতৃভূমির দাবি জানায়। কিছু হিন্দু ও মুসলমান নেতারা মুসলমান কৃষকশ্রেণিকে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও সমাজবাদী ব্যানারে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। মুসলমান কৃষকশ্রেণি তাদেরকে দমিয়ে রাখা দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক ব্যবস্থাকে বহু আগেই নীরবে প্রত্যাখ্যান করে; তারা ধর্মীয় আবেদনে সাড়া দেয় এবং ইতিমধ্যেই ঘটে যাওয়া সামাজিক সম্পর্কের ভাঙনকে একটি শক্তিশালী মতাদর্শিক বৈধতা দেয় যা এতদিন পরে এখন এসে কাগজে কলমে কবুল করে নেয়া হচ্ছে।’৯
ত্রিশের দশকে পূর্ববাংলায় যে শ্রেণিদ্বন্দ্বের উম্মেষ ঘটে, তা ছিল কৃষিভিত্তিক। ‘এই দ্বন্দ্বকে রাজনীতিকরা তাদের নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের মতো ব্যাখ্যা ও ব্যবহার করে। এই রাজনীতিকরা উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কাজ করার পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকাতেও তৎপরতা চালায়। সরকারের পুনঃপুন সাংবিধানিক সংস্কারকে ব্যবহার করে এবং একটি অবশ্যম্ভাবী অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বকে ধর্মের মুখোশে আড়াল করে।’১০
ধর্ম শ্রেণিদ্বন্দ্বকে আড়াল করে এরকম বাহাস না করলেও সুরঞ্জন দাশ দেখিয়েছেন দুইবার বাংলা ভাগের মধ্যবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমান বৈরিতার ধরন বিস্তর পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে গেছে।১১ হিন্দু-মুসলমানরা প্রথমদিকে অপেক্ষাকৃত কম সংগঠিত ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি ও আইনপ্রণেতাদের সাথেও খুব একটা যুক্ত ছিল না। তবে শ্রেণিসচেতনতা সৃষ্টির পর সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের পরবর্তী পর্বে দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। একদিকে শ্রেণি ও সম্প্রদায়গত পরিচয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, অপরদিকে, এলিট ও গণমানুষের সাম্প্রদায়িকতাও একবিন্দুতে এসে মিশে। ফলে, পুরো জনগোষ্ঠী দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়, প্রত্যেক পক্ষই তাদের নিজেদের এলিট দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও সেই সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা ছড়িয়ে দিতে সফল হয়।
হিন্দু জনগোষ্ঠীর অবস্থা কী ছিল? জয়া চ্যাটার্জি সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন কৃষিভিত্তিক দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব বাংলার কৃষকসম্প্রদায়গত সচেতনতার ওপর জোর দেয়ার কারণে মনে হতে পারে ‘বাংলার সাম্প্রদায়িকতা হল স্রেফ মুসলমানদের মামলা। মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার সমান্তরালে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটেনি বা ঘটলেও তা এমন সীমিত ও ছোট গণ্ডির মধ্যে ছিল যে, পাকিস্তান হাসিলে এটি কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি।’১২ এরপর তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন কিভাবে ত্রিশের দশক থেকে হিন্দু সম্প্রদায়গত পরিচয় গড়ে ওঠে, প্রথমদিকে শিক্ষিত ও স্বচ্ছল জমিদার এবং পেশাজীবী শ্রেণির সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সখ্যতার মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে নিম্নবর্ণ হিন্দুদেরকে একই সম্প্রদায়ের ছাতার নিচে এনে ‘সংস্কৃতায়িত’ আকাঙক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়; আর এদের প্রধান রাজনৈতিক মতলব ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের শাসনকে প্রত্যাখান করা।১৩
‘তথ্য-সাবুত থেকে বলা যায় যে, বাঙালিরা তাদের প্রাদেশিক রাজনীতিতে নীরব দর্শক ছিল না অথবা পুরোপুরি পরিস্থিতির শিকারও হয়নি যে জোরজবরদস্তি করে তাদের ‘মাতৃভূমি’কে ভাগ করা হয়েছে। বরঞ্চ বাংলার বিপুলসংখ্যক হিন্দু কংগ্রেসের প্রাদেশিক শাখা ও হিন্দু মহাসভার সাহায্যে বাংলাভাগ ও ভারতের অভ্যন্তরে একটি পৃথক হিন্দু প্রদেশ গঠনের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালায়।’১৪
এই দুটো অবস্থানকে পাশাপাশি রাখলে, বাংলায় মুসলমান ও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস এ কথাই মনে করিয়ে দেয়Ñএকটি জনগোষ্ঠী শ্রেণি ও সামাজিক স্তরবিন্যাসকে ভেদ করে সম্পূর্ণ দুইভাগে বিভক্ত ছিল; একভাগ সমগ্র প্রদেশ শাসনের রাজনৈতিক হকের ওপর জোরারোপ করে যেহেতু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়, অন্যভাগ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য একটি পৃথক ‘মাতৃভূমি’ সৃষ্টির (অথবা ধরে রাখা) উদ্দেশ্যে প্রদেশের রাজনৈতিক বিভক্তির ওপর জোর দেয়। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’ ব্যাখ্যা করতে যেয়ে খোদ ইতিহাসবিদ্যাও মনে হয় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
আমার কাছে একটা জিনিস বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় : যখন আমরা ইতিহাসের কোনো একটা ‘ঘটনা’ নিয়ে ভাবি, যেমন ধরা যাক বাংলার ভাগ (অথবা ভারতের), তখন আমরা সেই ঘটনার পেছনে জড়িয়ে থাকা নানা উৎসমুখকে খোলাসা করার কোশেশ করি। এর প্রত্যেকটি উৎস থেকে আবার নানা কিসিমের আখ্যান তৈরি করা যেতে পারে। যেমন: একটি জাতির দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক নির্মাণের গাল-গল্প থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক মাসের তৎপরতার ফলে বিভক্ত প্রদেশের গল্প। গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নানামুখি ইতিহাসের ভিতর একটি আখ্যান মূল ও প্রভাবশালী পরিচয়ে পরিণত হয়, যেমন সাতচল্লিশের ঘটনা জটিল ভঙ্গিম ইতিহাসকে ‘দেশভাগের কাহিনি’ হিশেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু এগুলো প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ইতিহাস যার ভিতর নানা কিসিমের উপাদান, যেমন ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ আছে। এদের তাৎপর্য একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এখানে আমি ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ এই দুটি বিষয়ের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে দ্বিতীয়বারের বাংলা ভাগের বেশ কিছু আখ্যানকে বিশ্লেষণ করব। জনপ্রিয় বিশ্বাস এবং চর্চার অবস্থান থেকে দেখলে, বাংলায় ইসলামের প্রসার, মুসলিম কৃষকসম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে বিভিন্ন ইসলামিক-অনৈসলামিক চর্চার সহাবস্থান এবং ইসলামকে ‘বিশুদ্ধ’ করার পুনঃপুন প্রচেষ্টার এক লম্বা কাহিনির কথা আমরা বলতে পারি।১৫ অন্য আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা ১৯ শতকের শেষ দিকে একটি নয়া এলিট মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উন্মেষের কথা বলতে পারি যার এক অংশ উত্তর ভারতের উর্দুভাষী আশরাফ সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, আরেক অংশ একটি স্বতন্ত্র বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতি তৈরির কোশেশ করে।১৬ অন্য আরেক অবস্থান থেকে দেখলে, যেটা আমি ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি ১৯ শতকের শেষদিকের ইতিহাসআশ্রিত দেশকেন্দ্রিক ধারণার প্রাণভোমরা ছিল আর্য/হিন্দু সভ্যতা। এই জাতীয়তাবাদী নির্মাণ উচ্চবর্ণ হিন্দুদের আধুনিকায়িত আধিপত্যের দ্বারা পুরো বাংলা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে, স্বদেশি আন্দোলনের নাটকীয়তায় তার হদিশ মেলে। এ কারণে ভারতীয় ও বাঙালি এই দুই পরিচয়ের মধ্যে অথবা প্রকৃত হিন্দু এবং হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের যে গীত তার ভিতর সে সময়ে খুব সামান্যই গরমিল লক্ষ করা যায়। খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে চিত্তরঞ্জন দাশের কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত জাতীয়তাবাদী এই প্রচেষ্টা সবচেয়ে বড় সাফল্য পায়। শহর ও গ্রাম উভয়স্থানেই মানুষের ক্ষোভ যখন তুঙ্গে, ২০ দশকের প্রথম দিকে বাংলার জাতীয়তাবাদ গর্বের সাথে হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বের উপনিবেশবিরোধী ব্যানার প্রদর্শন করে।
২০ দশকের শেষ দিকে ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’ যখন ভেঙে যায় এবং উচ্চবর্ণ হিন্দুদের জমি-জমা সংক্রান্ত স্বার্থ হেফাজত করতে গিয়ে কংগ্রেস যখন নিজের অবস্থানকে সংকীর্ণ করে ফেলে, তখন দীর্ঘদিনের যে মতাদর্শিক নির্মাণ তা ‘জাতীয়তাবাদ’ থেকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’য় রূপান্তরিত হয়Ñএরকম ভাবলে বিষয়টি অতিরিক্ত সরলীকরণ হয়ে যায়।১৭ এই পরিবর্তনের কেচ্ছা বুঝতে হলে আমাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিতে আবদ্ধ অল্পসংখ্যক মানুষের স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণের দিকে নজর ফেরাতে হবে। নির্দিষ্ট আলাপ ও আলোচনা, বক্তব্য ও ঘোষণা এবং কিছু বিশেষ মানুষ ও তাদের আলাপচারিতা ছাড়া এই ইতিহাস বয়ান করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র এধরনের রাজনৈতিক তৎপরতার প্রাসঙ্গিকতার ফলেই দেশবিভাগের মতো ঘটনায় সবসময়ই ‘গোপন ইতিহাস’ এবং ‘না বলা কাহিনী’র সম্ভাবনা থেকে যায়।
আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ১৯৩৫ সালের সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলায় সরকারি ক্ষমতা বণ্টন নির্ধারণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয় সম্ভবত একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে আইনসভা থেকে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করা হতো তাতে ৪৮ ভাগ আসন মুসলমানদের জন্য (মোট জনগোষ্ঠীর ৫৪ ভাগ ছিল তারা), ১২ ভাগ ছিল ‘দলিত শ্রেণির’ জন্য (তপশিলি শ্রেণি যারা পুরো জনগোষ্ঠীর ১৮ ভাগ) এবং ২০ ভাগ সংরক্ষিত ছিল হিন্দু প্রার্থীদের জন্য (দলিত শ্রেণি বাদে হিন্দুরা ছিল ২৬ ভাগ)। বিস্ময়করভাবে, ১০ ভাগ আসন বরাদ্দ ছিল ইয়োরোপীয়দের জন্য অথচ তারা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ০.০৪ ভাগ; তা সত্ত্বেও তারা সম্প্রদায়গতভাবে গঠিত হাউসে গুরুত্ববহ ভারসাম্য তৈরির ক্ষমতা রাখতো। বাংলায় ‘প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের’ এই বিন্যাস ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ সম্বন্ধে জাতীয়তাবাদীদের অভিযোগের একটি জ্বলজ্যান্ত নজির।
ত্রিশ এবং চল্লিশ দশকে বাংলার প্রাদেশিক রাজনীতিতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে জনমত ব্রিটিশবিরোধী চেতনা থেকে ক্রমশ সরে আসছিল এ কথা সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদেরকে বাতিল করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং স্থানীয় ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র মুসলমানদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছিল এই অভিযোগ তাদের ব্রিটিশবিরোধী অনুভূতিকে আরো মজবুতই করেছিল। আবার হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের নতুন পরিস্থিতিতে ১৯ শতকের শেষ থেকে নির্মিত জাতীয়তাবাদী মানসের অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অদলবদলের জরুরত ছিল একথাও সত্য নয়। পূর্বে (স্বদেশি সময়ে) যদি এটা হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান থেকেই জন্ম নিত তবে এখন এটা মুসলমান-স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও সহজেই করতে পারত। ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নকে ঘিরে যে বিশাল কৌশলগত রাজনৈতিক সম্ভাবনার জন্ম হতে পারে তাকে যদি আমরা আমলে না নেই তাহলে আমরা ভারতে জাতীয়তাবাদী কল্পনা যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিল তার আধিপত্যবাদী শক্তিকে অনুধাবনে ব্যর্থ হবÑএই সম্ভাবনা বিস্তারের এক দিকে রয়েছে হিন্দু আধিপত্যের চূড়ান্ত পর্যায়, মাঝখানে আন্তঃসম্প্রদায়গত ভ্রাতৃত্বকরণ এবং অন্যদিকে ধর্ম ও রাজনীতিকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা।
বাংলার মুসলমান রাজনীতির ক্ষেত্রে এমনটা ছিল না, অন্তত আমরা যে দুই দশক নিয়ে কথা বলছি। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বাংলার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো একটা দিক হচ্ছে হিন্দু সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের আধিপত্যহীন উচ্চাভিলাষ। বাংলার মুসলমান রাজনীতিকে পুরো ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘুর রাজনীতির সাথে মিলিয়ে দেখা ছাড়া এ ঘটনার অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। একটা ন্যূনতম সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক তৎপরতাও দেখা যাবে না যাকে বাঙালি সমাজে মুসলমান নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যালঘু হিন্দুদের সম্মতি আদায়ের আধিপত্যকামী প্রচেষ্টা হিশেবে পাঠ করা যায়। সম্ভবত এই অনুপস্থিতি ছিল ওই আন্দোলনের নিম্নবর্গীয়তার অপরিহার্য লক্ষণ। হয়ত এটাও বলা যেতে পারে তখন আধিপত্যকামী প্রচেষ্টা বেড়ে ওঠার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় ছিল না। অথবা আরো সতর্কভাবে আমরা বলতে পারি, সে ধরনের কোনো প্রচেষ্টার সবচাইতে সম্ভাবনাময় সময়ে অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে যখন ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় সবচেয়ে সক্রিয় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তি হিশেবে আবির্ভূত হয় সেসময় কংগ্রেস এবং কৃষক-প্রজা পার্টির মধ্যকার রাজনৈতিক ঐক্য ভেস্তে যায়। মূলত দুটি কারণে এটি ভেস্তে যায়। পয়লা, কংগ্রেসের কোয়ালিশনে না যাওয়ার অনমনীয় সর্বভারতীয় নীতির কারণে; এবং পরবর্তীতে যুদ্ধের সময় কংগ্রেস নেতারা যেন মন্ত্রী পর্যায়ের ক্ষমতায় যেতে না পারে সেজন্য গভর্নর এবং ব্রিটিশ আমলারা আন্তঃসম্প্রদায়গত রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি জারি করে।১৮ অপরিণত হলেও ১৯৩৭ সালে খুব অল্প সময়ের জন্য একমাত্র উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এই প্রচেষ্টা প্রজা আন্দোলনকে শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং গোটা বাঙালি সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতিশ্রুতিশীল একটি আন্দোলন হিশেবে তুলে ধরার কোশেশ চালায়।১৯ যাই হোক, প্রাদেশিক পর্যায়ে আন্তঃধর্মীয় গণতান্ত্রিক মৈত্রীর অনুপস্থিতিতে কৃষকদের সংগঠিত করার মত বামপন্থীদের স্থানীয় প্রচেষ্টা হয় নির্দিষ্ট চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ থাকে অথবা সরকারি আমলাতন্ত্রের মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক শক্তির দ্বারা বানচাল হয়ে যায়।২০ পূর্ববাংলায় কৃষক-জনতার বিদ্রোহ কৃষিভিত্তিক ভ্রাতৃত্ব ও ইনসাফের ধর্ম হিশেবে ইসলামকে জোড়ালোভাবে ব্যবহার করেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি তৈরি করতে পারে না। ফলে এটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়।
কৌশলসমূহ ও ফলাফল
ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ভিত্তিতে বাংলাভাগের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, একথা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক নয়। বাংলার ভেতরকার জনমতের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বেঙ্গল এসেম্বলির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতেন আর তারা সীমিত ভোটাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগকে কেন্দ্র করে পক্ষে বিপক্ষে বেশকিছু প্রচারণা হয়েছে। এগুলোকে জনরোষের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে, সে সময়ের তথ্য-সাবুত থেকে এ কথাই জানা যায়, দেশভাগকে কেন্দ্র করে সকল আলাপ-আলোচনা ১৯৪৬ সালের অগাস্টে কলকাতার এবং তার কয়েক সপ্তাহ পরে নোয়াখালির সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ঘেরাটোপে আবদ্ধ ছিল। হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ কর্তৃক সংগঠিত এই ঘটনাগুলোই সম্ভবত দেশভাগের পেছনে সবচাইতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। ১৯৪৬-এর নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে কিছু লোক ক্ষমতার সাধারণ পরিবর্তনের সর্বনাশা পূর্বাভাস হিশেবে দেখেছেন। অন্যদের চোখে আইনগত বা সাংবিধানিক কাঠামো যাই হোক না কেন পাকিস্তানের জন্ম ছিল অবধারিত।
অগাস্ট ১৯৪৬ থেকে অগাস্ট ১৯৪৭ সময়কালে বাংলায় যেসব রাজনৈতিক বাহাস হয় সেগুলো পাঠ করলে যে কেউ সহজেই বুঝতে করতে পারবেন পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাচ্ছে, এই পরিণতি ঠেকাবার আর কোনো পথ খোলা নেই এই ধারণার বুনিয়াদেই তখন তারা নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করছিলেন। ফলে প্রত্যেক সম্প্রদায় (সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অথবা দলিত শ্রেণি) নিজেদের স্বার্থ হেফাজত করে কিভাবে সর্বোচ্চ ফায়দা আদায় করবে তার হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত ছিল। এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না, দল বা গোষ্ঠী এবং সংগঠনের মর্যাদা অথবা নেতা নির্বিশেষে বাংলার মধ্যে সে সময়কার প্রতিটি বক্তব্য হোক সেটা কোনো দাবি কিংবা বা আবেদন, কোনো আশ্বাস অথবা হুংকার বাংলার বাইরের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে; বাংলার কেউই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি যার দ্বারা এই প্রদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। তাই দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে এই অনুভূতি পোক্ত হয় যে, ১৯৪৭ সালে বাংলা সর্বভারতীয় রাজনীতিকদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল।
অগাস্ট ১৯৪৭-এর পূর্ববর্তী মাসগুলোয় ধর্মীয় ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিদের দ্বারা গৃহীত অবস্থানের অনিশ্চিত ও কৌশলগত প্রকৃতি তুলে ধরা বেশ সহজ। ফজলুল হক (যিনি তখন ক্ষমতার বাইরে এবং মুসলিম লিগেরও বাইরে) নির্দ্বিধায় বলেনÑমন্ত্রিরা আইনসভা নয় বরং মুসলিম লীগের প্রধান জিন্নাহর কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছে। সুতরাং সাংবিধানিকভাবে, বাংলায় কোনো সরকার নেই।২১ আরো তাৎপর্যপূর্ণভাবে, মে ১৯৪৭-এ শরৎ বোস-সোহরাওয়ার্দি সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব করলে আবুল হাশিম এ প্রস্তাবের পক্ষে প্রাদেশিক মুসলিম লিগের মধ্যে প্রচারণা চালান এবং এই প্রস্তাবকে মূল লাহোর প্রস্তাব যেখানে ‘স্বাধীন মুসলিম স্টেটগুলো’ নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি করা হয়েছিল তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখিয়ে ন্যায্যতা দেবার কোশেশ করেন। এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আকরাম খান বলেন, প্রাদেশিক লিগের কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারে না। কারণ সর্বভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ হেফাজতের জন্য জিন্নাহ এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগ আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।২২
হিন্দু সমাজে যখন এই বিভক্তির প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় তখন, অন্তত সংগঠিত হিন্দু মতের ক্ষেত্রে অর্থাৎ চরম ডানপন্থী হিন্দু মহাসভা থেকে শুরু করে মধ্যমপন্থী কংগ্রেস, এমনকি বামপন্থীদের মধ্যে প্রায় মতৈক্য গড়ে ওঠেÑবাংলা ভাগের দাবিতে সবাই গলা মেলায়।২৩ যখন পাকিস্তান জন্মের অনিবার্যতা স্পষ্ট হল, বিশেষত মার্চ ১৯৪৭-এ কংগ্রেসের উচ্চমহল যখন পাঞ্জাব ভাগের ধারণাকে কবুল করে তখন হিন্দুরা বাংলা ভাগের পক্ষে অবিরত বাহাস করে গেছে যাতে বাংলা প্রদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা পাকিস্তানের বাইরে হিন্দুরাষ্ট্রে জায়গা পায়। উগ্র সাম্প্রদায়িক যুক্তি ছাড়াও এই অবস্থানকে আরো চমৎকার যুক্তি দ্বারা জায়েজ করা হয় যার একটি এরকম ১৯ ও ২০ শতকে সৃষ্ট আধুনিক গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে ভারত সমুন্নত করবে এবং কাজে কাজেই সকল গোষ্ঠীর অধিকারও সেখানে সুরক্ষিত হবে। অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব অল্প লোকই কবুল করেছিলেন এবং বেশিরভাগই শ্যামপ্রসাদ মুখার্জির যুক্তি দ্বারা উৎসাহিত হয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল সার্বভৌম বাংলা যদি ধর্মের ভিত্তিতে পরে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চায় সে অবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আর কিছু করার থাকবে না।
‘দলিত শ্রেণির’ নেতাদের ভিতরকার বাহাসগুলো ছিল আরো কৌতূহলউদ্দীপক। শেডিউল্ড কাস্টস ফেডারেশনের নেতা এবং রাজনৈতিকভাবে মুসলিম লিগের সহযোগী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল দেশভাগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন
‘যদি এরকম হয় তাহলে দেখা যাবে যে পূর্ব বাংলার হিন্দুদেরকে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। যেসব নেতারা বাংলাভাগের প্রস্তাব করেছেন তারা নিশ্চয়ই জনগোষ্ঠী বদলা-বদলির অভিপ্রায়ও রাখেন। সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই। শুধু একটা কথাই স্মরণ করিয়ে দিব যে, বর্ণহিন্দু নেতারা এতদিন ড. আমবেদকারের ‘Thoughts on Pakistan’ বইয়ের জন্য এবং জিন্নাহর জনগোষ্ঠী অদল-বদলের পরামর্শকে তীব্রভাবে নিন্দা করেছিলেন।… বাংলা ভাগ হলে তপশিলি শ্রেণিই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে। পূর্ববাংলার বর্ণহিন্দুরা ধনী এবং বেশির ভাগেরই ভালো ভালো চাকরি আছে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিমবাংলায় যেতে তাদের তেমন কষ্ট করতে হবে না। দরিদ্র তপশিলি কৃষক সম্প্রদায়, জেলে এবং কারুশিল্প গোষ্ঠীকে পূর্ববাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দয়ায় বেঁচে থাকতে হবে।’
এর প্রত্যুত্তরে রাধানাথ দাস, কন্সটিটুয়েন্ট এসেম্বলির তপশিলি সম্প্রদায়ের একজন সদস্য, বলেন :
‘আজকে যদি আমরা নোয়াখালির নমঃশুদ্রদের বলি তোমরা পশ্চিমবাংলায় চলে আসো, পশ্চিম এবং উত্তর বাংলার সরকার তোমাদেরকে আশ্রয় দিবে এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করবে, তাহলে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, যোগেন বাবু তার স্বজাতির একজনকেও সেখানে (নোয়াখালি) ধরে রাখতে পারবেন না। অন্যভাবে বললে, মুসলিম লিগের শাসক বা মুসলিম লিগের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতর তারা নিরাপদ বোধ করবে না… আমি বলব, নিম্নবর্ণ হিন্দুরা বরং সবচেয়ে সহজে পূর্ববাংলা ছাড়তে পারবে কারণ তাদের সহায় সম্পত্তি বলতে তেমন কিছুই নেই।২৪
অবশেষে যখন বেঙ্গল এসেম্বলিতে ভোটাভুটি হল, ত্রিশজন তপশিলি সম্প্রদায় সদস্যের মাত্র পাঁচ জন দেশভাগের বিপক্ষে ভোট দেন। স্পষ্টতই, যখন সংখ্যালঘুদের সংখ্যালঘু হিশেবে সংগঠিত একটি গোষ্ঠীর কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসলো, তপশিলি শ্রেণির প্রতি মুসলিম লিগের দাদাগিরিসুলভ প্রবণতা অপর্যাপ্ততা প্রমাণিত হল।
দেশভাগের প্রশ্ন রাজনৈতিক বলয়ের বাইরের লেখালেখিতেও আলোচিত ছিলÑএর থেকেও আমরা সে সময়কার গভীর অনিশ্চয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারি। ইংরেজি Delirium শিরোনামে এপ্রিল ১৯৪৭-এ পূর্ববর্তী বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলো নিয়ে একটি ছোট বই বের হয়।২৫ বইটির লেখক বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় পেশায় ডাক্তার, স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের সাথেও তিনি যুক্ত, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি তার এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি, নিজের মর্যাদা সম্পর্কেও সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। দক্ষিণ কলকাতার আলমবাজার উপশহরের কলকারখানার বস্তির শ্রমজীবী শ্রেণি, হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অগাস্ট ১৯৪৬-এ তার এলাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোকে তিনি বহিরাগতদের আক্রমণ হিশেবে বর্ণনা করছেন। এই অজ্ঞাত শক্তিশালী গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিবেশিদের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পেরে ওঠেনি। তিনি আরো বলেন, কলকাতায় দাঙ্গার খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের নেতারা যৌথভাবে শান্তি কমিটি গঠন করে। তিনি নিজেও প্রতিবেশি এলাকায় যান, বহিরাগতদের খুঁজে বের করার জন্য সেখানকার অধিবাসীদের কাছে আবেদন জানান ‘বাইরের উৎপাত কোনোভাবেই আমাদের এলাকায় ঢুকতে দেয়া যাবে না।’ কিন্তু, রাত শেষ না হতেই বস্তিগুলোয় আগুন জ্বালানো হয় এবং নির্মম নিষ্ঠুরতায় খুনোখুনি চলতে থাকে।
বইটির বাকি অংশে আছে কেন এমন ঘটনা ঘটলো আর এর পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। এই লেখার মধ্যে তখনকার হিন্দু মধ্যবিত্ত পুরুষরা যে ধরনের আলোচনা করতো তার পরিচয় মেলে। ব্রিটিশদেরকে দোষ দেয়া, কংগ্রেসকে দোষ দেয়া, মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম লিগকে দোষ দেয়া ইত্যাদি সকল রাজনৈতিক যুক্তিই এখানে হাজির ছিল। আধুনিক ভারতের ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের কাছেও এসব যুক্তি খুবই পরিচিত। তবে যে পদ্ধতিতে বিভ্রান্তিকর এবং নিন্দনীয় ঘটনাগুলোকে ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’ বলে চালিয়ে দেয়া হয় তা ছিল অবাক করার মতো।
‘লিগ, কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের ভিতরকার মতপার্থক্য এবং দ্বন্দ্ব আমার কাছে রাজনৈতিক মঞ্চে থিয়েটার নাটকের মতো মনে হয়। যে নাটকের নাট্যকার ও পরিচালক মহাত্মাজি আর বাকিরা অভিজ্ঞ অভিনেতা। বেশিরভাগ ভারতীয়রাই বুঝতে পারে না কোন রহস্যময় পথে মহাত্মাজি এবং জিন্নাহ সাহেব তাদের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলেন। … তারা দুজনে মিলে ধর্মসংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ধর্মবেত্তাদের পাশ কাটিয়ে ধর্মপ্রচারণার সঙ্গে স্বাধীনতার বার্তাও যুক্ত করেছেন। এভাবেই তারা তাদের পার্টি এবং জাতি তৈরি করেছেন। … একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা নিশ্চল মানসিকতা ও জরাজীর্ণ সমাজকে ধ্বংস করতে এবং সাধারণ মানুষের ভিতর রেনেসাঁর জন্ম দিতে চেয়েছেন। … এই আলোড়নকে আমি সাম্প্রদায়িক বলে মনে করি না। একে আমি ভারতের শেষ আন্দোলন হিশেবেই দেখতে চাই।… যে সংঘাত এখন এই দেশে সংঘটিত হচ্ছে খুব শীঘ্রই তা এমন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে যখন দুই সম্প্রদায়ের লোকেরাই অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং ধর্মীয় ভণ্ডামিতে ভরে উঠবে। সম্ভবত তখনই ভারতে একটি নতুন জাতির উদ্ভব হবে’।২৬
বইটিতে একের পর এক ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে অবাস্তব হিশেবেই দেখানো হয় যেগুলো ‘প্রকৃত’ ইতিহাসের পথ আটকাতে পারবে না।
‘এই ডিসেম্বরে [১৯৪৬] কংগ্রেস, ব্রিটিশদের অবস্থানকে মেনে নিয়েছে যা বহুদিন থেকেই মুসলিম লিগের উদ্দেশ্য হাছিলের পক্ষে যায়। এখন কংগ্রেস বাংলার ভাগ, পাঞ্জাবের ভাগ, এমনকি ভারত ভাগও মেনে নিবে। লিগের পাকিস্তান দাবিকে হজম করতে গিয়ে একসময় সম্ভবত ভারতের সব প্রদেশকেই ভাগ করতে হবে। এই ঘটনা হয় দুই জাতির শক্তি বৃদ্ধি করবে নয়তো হিন্দু-মুসলমানের প্রাত্যহিক জীবন এমনই দুর্বিষহ হয়ে উঠবে যে তারা নিজেরা মারামারি কাটাকাটি করবে, দেশের মধ্যেই কাঁটাতারের দেয়াল তুলবে এবং কোনো সম্প্রদায়ই সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে না।…দেশভাগ যদি আজকে অপরিহার্যও হয়ে থাকে, চিরকাল এরকম খণ্ডিত অবস্থায় থাকতে পারে না’।২৭
স্বাধীনতা এবং দেশভাগের সমসাময়িক সময়ে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত আরেকটি ছোট্ট বইয়ের মূল থিমও ছিল এই ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’।২৮ মুসলিম লিগের যে মতাদর্শ অর্থাৎ ‘মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার আড়ালে আধুনিক একদলীয় শাসন’ সেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস মোকাবিলা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ফলে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।২৯
‘সত্যি বলতে, কংগ্রেসের ব্যর্থতা প্রকারান্তরে মুসলিম লিগেরই সাফল্য। বাস্তবতা হল, দেশভাগ ঠেকানোর জন্য শেষ দুই বছরে কংগ্রেসের প্রচেষ্টা একদমই একটা কার্যকর ছিল না… অনিবার্য কাজটাই তিনি [মাউন্টব্যাটেন] করেছেন, কারণ এই পরিণতি ঠেকানোর সবরকমের প্রচেষ্টাই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে; তিনি শুধুমাত্র সার্জনের ছুরি দিয়ে সমস্যার সুরাহা করেছে।৩০
উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়া সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে নিন্দা করার পর লেখক অন্য আরেকটি বিফল সম্ভাবনার (ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের) জন্য আফসোস করেন‘যে বাংলা একসময় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাহসিকতার সঙ্গে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়, ১৯৪৭ এসে সেই একই ধরনের আরেকটা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হল। হায়রে ইতিহাসের নির্মম পরিহাস! ১৯০৫ সালে নেতৃত্ব এসেছিল প্রধানত পূর্ববাংলা থেকে এসেছিল, এখন আসছে পশ্চিমবাংলা থেকে। ১৯০৫ সালে এর সংগঠক ছিল ভারতের তদানীন্তন সরকার আর এখন বাঙালিরা নিজেরাই। ১৯০৫ সালে সমস্যার ধরন ছিল রাজনৈতিক, এখন সম্প্রদায়গত। ১৯০৫-এর আন্দোলন সারা ভারতে অবিভক্ত জাতীয়তার সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল; এখন বাংলা তার সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে বলি দিতে আগ্রহী, তাদের ত্রাণকর্তা হিশেবে অন্যের পানে চেয়ে আছে।৩১
চুনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের পোর্ট্রেট গ্যালারিতে মূলত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের করুণ পরিণতির সুরই বেজে উঠেছে।৩২ ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সালের ভিতরকার সময়ে লেখা অনেকগুলো চিঠির মধ্যে একটি ছিল খাদিম ইসলামের যে সারাজীবন মুসলিম লিগের সমর্থন করেছে। সে এখন বলছেÑ‘আমার ভুলের কারণেই আমার জন্মভূমি আজ বিভক্ত ও পরাজিত হচ্ছে… হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবাংলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলা থেকে আলাদা হয়ে যাবে আর উত্তর ভারতের কলোনিতে পরিণত হবে।’ জয়নুল কবির বলছেন ‘লিগ ও ইংরেজদের ষড়যন্ত্র পূর্ববাংলাকে আলিগড়ের এবং পশ্চিমবাংলাকে বানারসের কলোনিতে পরিণত করবে… রাজা গণেশ থেকে সুভাষ [চন্দ্র বসুর] এবং সুলতান ইলিয়াস থেকে তিতুমীরের বাংলা আবার কবে সময়ের অতল গহ্বর থেকে জেগে উঠবে?’ পুরুলিয়ার সুনীল সেন এপ্রিল ১৯৪৯-এ এসে উপলব্ধি করেন ‘পাটনার শাসকরা বিহারের বাঙালিদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে… সারাজীবন লালন করা তার ভারতবাদ’ হঠাৎ করেই ধূলিসাৎ হল… জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি উপলব্ধি করলেন ‘পাঞ্জাবের হিন্দু অথবা পেশোয়ারের মুসলমানের সাথে তার কোনো কাল্পনিক বা প্রয়োজনীয় বন্ধন নেই। বরং আদর্শ ও স্বার্থের দিক থেকে তিনি বাঁকুড়ার হিন্দু ও বরিশালের মুসলমানদের সাথে যুক্ত।’
ঐতিহাসিকভাবে পাঠ করলে এগুলো আমাদের কাছে নতুন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর গুরুত্বারোপের চাইতে দেশভাগের বাস্তবতাকে অস্বীকারের কাল্পনিক স্মৃতি-জাগানিয়া চিহ্ন হিশেবেই বেশি ধরা পড়ে। এমনকি পশ্চিমবাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসবিদ্যাও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ্যার অন্তর্গত দানবীয়তাকে সচেতনভাবে ধামাচাপা দিতে চায়। ফলশ্রুতিতে দেশভাগকে গ্রিক ট্র্যাজেডির সাথে তুলনা করা হয় : ‘পতঙ্গ যেমন আগুনের দিকে ছুটে আমাদের নিয়তিও কোনো এক অদৃশ্য হাত দ্বারা পরিচালিত হয়ে অনিবার্য ট্র্যাজেডির দিকে ছুটে চলে… তা না হলে ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা যারা সকলেই (জিন্নাহসহ) একসময় দেশভাগের ধারণাকে প্রতিহত করেছিলেন, কেন তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিকে এসে এমন আচরণ করলেন যে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল’?৩৩
আশ্চর্যজনকভাবে, দেশভাগের ক্ষত যখন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল এবং বিপুল সংখ্যক উন্মুল জনগোষ্ঠী নতুন করে তাদের জীবন আরম্ভ করছিল (কংগ্রেস তথা বাম শাসনামলেও) সেসময় পশ্চিমবাংলায় যে ধাঁচের জাতীয়তাবাদ আধিপত্য বিস্তার করে, তার আদল ছিল ঠিক স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার জাতীয়তাবাদের মতো অর্থাৎ হিন্দু সভ্যতার অতীতে প্রোথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ (বাঙালির পরিচয়গত বোধও দৃঢ়ভাবে এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধে। কেন্দ্রের রাজনীতির সাথে এর কৌশলগত সম্পর্ক কতটা কৃত্রিম তা যেন কোনো বিষয়ই না) এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রণোদনা (যাকে এখন ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি হিশেবে উল্লেখ করা হয়)। এ ধরনের ইতিহাসবিদ্যার কাছে দেশভাগে এক ধরনের গলদ, ক্ষতি ও ব্যর্থতার চিহ্নস্বরূপ এবং এর দায় সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের অক্ষমতার ওপর বর্তায়। কল্পিত জাতির দীর্ঘস্থায়ী মতাদর্শ তার আধিপত্য জারি রাখে, দাবি করে এধরনের ‘জাতির’ ভিতরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও নিরাপদে থাকবে অথচ বাস্তবে দেখা যায় জনজীবনে এটি ব্যাপক পরিমাণে সম্প্রদায়গত বৈষম্য, বিরোধ ও কৌশলগত সংঘাতকে অনুমোদন দেয়।
অন্যদিকে, ওপার বাংলায় পরবর্তী ২৫ বছরে, একটি নতুন ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়, ১৯৪৭ সালের অগাস্ট নয় বরং ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর জন্ম ঘটে। ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক ভেদাভেদকে ছিন্ন করে ভাষার ভিত্তিতে মিলিত একটি জাতীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আধিপত্যশীল হয়। সেখানেও ১৯৪৭-এর বাংলাভাগ একটি গলদ, ক্ষতি ও ব্যর্থতার চিহ্ন হিশেবেই বিবেচিত হয় আর এ পরিস্থিতি হিন্দু নেতাদের গোয়ার্তুমি এবং ব্রিটিশদের ম্যানিপুলেশনের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল।৩৪ দেশভাগের আগের দশকে যে আধিপত্যশীল প্রণোদনার অভাব ছিল, ১৯৭০-এ সেটাই সফলতার সাথে তৈরি হল, তবে এর পরিধি ছিল শুধুমাত্র পূর্ববাংলা। কারণ সাতচল্লিশেই ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ হয়ে গেছে।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বাতিল করা সত্ত্বেও, কোনো পক্ষই বাংলার অখণ্ডতা পুনরুদ্ধারের জন্য তেমন তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা নেই। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় অনেক সময় অত্যন্ত আকস্মিক ও স্বল্পকালীন উদ্যোগ দ্বারা উদ্ভূত ঘটনা পরবর্তীতে সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক কল্পনার পরিগঠনের স্থায়ী সুরত তৈরি করে দিতে পারে। আমি ইতিমধ্যে দেখিয়েছি পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশ উভয়স্থানের ঐতিহাসিক স্মৃতি দ্বিতীয়বারের বাংলাভাগের বাস্তবতাকে কঠোরভাবে অস্বীকার করে; তথাপি ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকে নতুন জাতীয়তাবাদী কল্পনার সম্ভাবনা দেশভাগের পরিণাম দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তার বাইরে যেতে পারেনি।
বাংলার এই পরিস্থিতি আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের একটা বিশেষ দিক বুঝতে সাহায্য করে আর তা হল আধিপত্যশীল জাতীয় মতাদর্শগুলোর পরিগঠনে সাংস্কৃতিক জনমিতির উপাদান হিশেবে প্রায়শই ধর্মের অদৃশ্য উপস্থিতি। জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত লেখালেখিতে একে অবশ্য একদমই স্বীকৃতি দেয়া হয় না। এনলাইটেনমেন্ট-উত্তর রাষ্ট্রের বৈধতা পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ‘জনগোষ্ঠী’র যে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করে তার ভিতর ধর্ম খুব একটা খাপ খায় না। যত যাই হোক না কেন, সাম্প্রতিক সকল জাতিরাষ্ট্রের ভিতর শুধুমাত্র ইজরায়েল ও পাকিস্তান প্রকাশ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার দাবি করে। তারপরও জাতীয়তাবাদের এন্তার নজির দেখানো সম্ভব যেখানে জাতীয় পরিচয়ের সাংস্কৃতিক নির্মাণের উপাদান হিশেবে ধর্মীয় পরিচয় প্রধান ভূমিকা রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে, জাতীয়তাবাদ নিয়ে কাজ করা সাম্প্রতিক পণ্ডিতরা দেখিয়েছেনÑপশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর তথাকথিত সেকুলার জাতীয়তাবাদ গঠনেও ধর্ম অন্যতম উপাদানরূপে কাজ করেছে।৩৫ সম্ভবত, জাতীয়তাবাদী মতাদর্শগুলো আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে তখনই সবচেয়ে কার্যকর হয় যখন তারা এর জন্মের গোপন ইতিহাস থেকে ধর্মকে বাদ দিতে কামিয়াব হয়, যখন তারা ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতো মোটাদাগের বাস্তবতাকে জনজীবনের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক কাণ্ডজ্ঞানে রূপান্তর করতে পারে। এটা সম্ভবত সেই শর্ত যেখানে জাতিরাষ্ট্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সর্বজনীন বুর্জোয়া নাগরিকত্ব প্রদানের মহানুভবতা দেখায়। সেরকম পরিস্থিতি তৈরি করতে হলে জনসাধারণের স্মৃতি থেকে নির্দিষ্ট কিছু বয়ানকে মুছে দেয়াই জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ্যার প্রধান কর্তব্য হয়ে ওঠে।
লেখার উৎস : পার্থ চট্টোপাধ্যায় ‘দি প্রেজেন্ট হিস্ট্রি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ১৯৯৮।
ভাষাবদল করেছেন : সাব্বির আজম
ফুটনোট
১. সুমিত সরকার, The Swadeshi Movement in Bengal ১৯০৩-১৯০৮ (নয়া দিল্লি : পিপলস পাবলিশিং হোম, ১৯৭৩)।
২. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭-১৮।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯-২০।
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮।
৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২০-৪।
৬. ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (১৮৭৬), ভূদেব রচনা সম্ভার। সম্পাদনা : প্রমথনাথ বীশি (কলকাতা : মিত্র এন্ড ঘোষ ১৯৬৯), পৃ. ৩৪১-৭৪।
৭. বদরুদ্দীন উমর, বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি (কলকাতা : চিরায়ত, ১৯৮৭), মুখবন্ধ।
৮. সুগত বসু, Agrarian Bengal Social Structure & Politics : ১৯১৯-১৯৪৭ (কেমব্রিজ : কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৬) বিশেষত, পৃ. ১৮১-২৩২।
৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩১-২।
১০. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৭।
১১. সুরঞ্জন দাশ, Communal Riots in Bengal : ১৯০৫-১৯৪৭ (দিল্লি : অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১)
১২. জয়া চ্যাটার্জী, Bengal Divided : Hindu Communalism & Partition : ১৯৩২-১৯৪৭ (কেমব্রিজ : কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫), পৃ. ১৫২।
১৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৮।
১৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৭।
১৫. রিচার্ড এম ইটন, The Rise of Islam & The Bengal Frontier : ১২০৪-১৭৬০ (দিল্লি : অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৪)।
১৬. রফিউদ্দিন আহমেদ, Bengal Muslims : The Quest for Identity : ১৮৭৬-১৯০৬ (দিল্লি : অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২); তাজিন এম. মুরশিদ, The Sacred & the Secular : Bengal Muslim Discourses : ১৮৭১-১৯৭৭ (কলকাতা : অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৫)।
১৭. জয়া চ্যাটার্জী, জাতীয়তাবাদ থেকে সাম্প্রদায়িকতায় রূপান্তরের যুক্তি হাজির করেছেন : ‘জাতীয়তাবাদ ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিত। ভদ্রলোকদের সাম্প্রদায়িকতা তাদের এই সতীর্থ বাঙালিদের প্রতি ঐ ছিল। একপক্ষের ইতিহাস হল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের; অন্য পক্ষের কাছে এটা ছিল ব্রিটিশ শাসনের আনন্দোৎসব কারণ মুসলমান স্বৈরতন্ত্র থেকে তারা স্বাধীনতা পেয়েছে। এর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যাবে এই ‘স্বৈরতন্ত্র’কে প্রতিহত করা এবং অস্বীকার করা যে মুসলমানরাও বাঙালি বা ভারতীয়।’ Bengal Divided, পৃ. ২৬৮। তার মতে এই ‘রূপান্তর’ ত্রিশের দশকে হয়েছিল এবং জোরারোপ করে বলেনÑসাম্রাজ্যের হাতের অসহায় পুতুলে পরিণত হওয়ার কারণে নয়, বরং বিশাল এক শক্তিশালী হিন্দু জনগোষ্ঠীর (শহর এবং গ্রাম উভয় স্থানেই) প্রদেশ বিভক্তির সক্রিয় সংগ্রামের ফলেই দেশভাগ ঘটেছে। তার যুক্তি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সরল দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত বলে মনে হয়েছে আমার কাছে।
১৮. এ দুটো ঘটনাই এখন শক্তিশালী তথ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত : শীলা সেন, Muslim Politics in Bengal: ১৯৩৭-১৯৪৭ (নয়া দিল্লি : ইমপেক্স ইন্ডিয়া, ১৯৭৬); কমলা সরকার, , Bengal Politics: ১৯৩৭-১৯৪৭. (কলকাতা : এ. মুখার্জি, ১৯৯০); লিওনার্দ এ. গর্ডন, Brothers Against the Raj : A Biography of Sarat & Subhas Chandra Bose (নয়া দিল্লি : পেঙ্গুইন বুকস ইন্ডিয়া, ১৯৯০)।
১৯. দেখুন, বিশেষত, হুমায়ুন কবির, Muslim Politics ১৯০৯-১৯৪২ (কলকাতা : গুপ্ত, রহমান এবং গুপ্ত, ১৯৪৩) এবং নরীশচন্দ্র সেনগুপ্ত, যুগ পরিক্রম, খ–২ (কলকাতা : ফির্মা কে. এল. মুখোপাধ্যায়, ১৯৬১), বিশেষত পৃ. ১৭৮-২৫৩।
২০. ত্রিপুরা এবং নোয়াখালি জেলার জন্য সুগত বসুর Agrarian Bengal-এ এর তথ্যউপাত্ত হাজির করা হয়েছে, পৃ. ১৮১-২৩২।
২১. কালিপদ বিশ্বাসের যুক্ত বাংলার শেষ অধ্যায় (কলকাতা : অরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৬৬), পৃ. ৩৮৬-৯০।
২২. বদরুদ্দীন উমরের বঙ্গ-ভঙ্গ বইয়ে এই তর্কে বিস্তৃতভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। পৃ. ৪৬-৬৮।
২৩. অধিকাংশ কমিউনিস্টই পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন যে, ১৯৪৬-৪৭-এর সেই পরিস্থিতিতে, সাম্প্রদায়িক বিভক্তির অপরিহার্যতাকে শনাক্ত করার চাপ ছিল অপ্রতিরোধ্য। দেখুন : কমিউনিস্ট লেখালেখির ওপর সার্ভে এবং স্মৃতিকথা, অমলেন্দু সেনগুপ্ত, উত্তাল কাল : অসমাপ্ত বিপ্লব (কলকাতা : পার্ল পাবলিশার্স, ১৯৮৯)।
২৪. এই বিতর্ক আবার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, জগদীশচন্দ্র ম-ল, বঙ্গ-ভঙ্গ (কলকাতা : মহাপ্রাণ পাবলিশিং সোসাইটি, ১৯৭৭)।
২৫. ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, Dilirium (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) (আলমবাজার : দাতব্য বিভাগ, ১৯৪৭)।
২৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮।
২৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭-৮।
২৮. সত্যেন সেন, পনেরোই আগস্ট (কলকাতা : সিটি বুক কোম্পানি, ১৯৪০)।
২৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩।
৩০. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫।
৩১. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭-৮।
৩২. চুনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, ভাঙ্গন দিনের কথামালা (প্রকাশকাল নেই সম্ভবত ১৯৫২)।
৩৩. শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, জিন্নাহ, পাকিস্তান : নতুন ভাবনা (কলকাতা : মিত্র এবং ঘোষ, ১৯৮৮), পৃ. ৩০২-৩
৩৪. বাংলাদেশি ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ বিষয়ে প্রায় ঐক্যমত্য দেখা যাচ্ছে। যেমন, সরকারি অর্থানুকুল্যে লিখিত একটি ইতিহাস সোহরাওয়ার্দি ও আবুল হাশিমের সার্বভৌম যুক্ত বাংলার মহৎ পরিকল্পনাকে নসাৎ করে দেয়ার জন্যে একগুঁয়ে বাঙালি হিন্দুদের’ নিন্দা করছে। বাংলা ভাগের অনুমতির ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘুদের সমান গুরুত্ব দেয়ার কারণে ব্রিটিশদেরকেও সমালোচনা করেছে। মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, আমাদের মুক্তি সংগ্রাম (ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ১৯৭৮), পৃ. ৪১১-১২। র‌্যাডিকাল ঐতিহাসিক বদরুদ্দীন উমর লেনিনীয় যুক্তিতে বলেনÑভারতের মতো বহুজাতির দেশে একমাত্র প্রকৃত গণতান্ত্রিক যুক্তরাজ্যীয় ব্যবস্থা সম্প্রদায় ও আঞ্চলিক স্বার্থের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য ভারসাম্য নিয়ে আসতে পারে। তিনি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশদেরকে দেশভাগের জন্য দায়ী করেন। বঙ্গ-ভঙ্গ, পৃ. ১০৪-৫।
৩৫. যেমন, লিন্ডা কোলি, Britons : Forging the Nation :১৭০৭-১৮৩৭ (নিউ হাভেন : ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯২)।