Saturday, 30 May 2015
Friday, 22 May 2015
একটি তুচ্ছ মৃত্যু / ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ
ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার কবি। বাংলা ভাষারও প্রধান কবিদের অন্যতম। ঈশান বাংলা মানে বরাকের এই শ্রদ্ধেয় কবির এই কবিতাটি বারবার পড়ার মত। আগে পড়িয়েছি। আবার পড়াই
একটি তুচ্ছ মৃত্যু/ ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ
ওসমান চাচার কাফন দাফন হচ্ছে।
নাজুক রোদে চারজন লোক পড়ছে নামাজ-এ-জানাজা।
পৃথিবীর মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গা খর্চা হবে।
কিছু দূরে রিফুজিলতার ছেঁড়া বোরখা পরা একটা খেজুর গাছ
পাশে অপুষ্ট শিশুর মতো দু-একটা কচুঝোপ।
ওসমান চাচা তেমন কেউকেটা নয়--- মুরুব্বি নয়।
তার এন্তেকাল খুবই সাধারণ একটা ঘটনা।
খোদার দরবার পর্যন্ত পৌঁছোবার মতো খবরই নয়!
ফিরিস্তারাও এসেছেন কি আসেন নি।
ওসমান চাচার দুই ছেলে---
রোজগার করে। পেলে খায়, না পেলে রোজা---
বছরের যে কোন দিন।
এ হেন লোকের মৃত্যুতে কি আর শোকপালন হবে।
তবু গণকঠাকুরের বিধবা আঁচলের খুঁটে
দু ফোঁটা চোখের জল মুছে মনে মনে বলল---
“ভগবান, লোকটাকে পায়ে ঠাঁই দিয়ো”
বিপদে আপদে কেঁদে পড়লে দিত এক আধ কাঠি চাল,
গণকের বাৎসরিক শ্রাদ্ধে—দু একটা বাঁশ ,
ছেলের পৈতের দিনে এক কাঁদি কলা, আধসের দুধ।
মানুষ যখন মানুষের রক্তের জন্য
চিৎকার করে ঈশ্বরের আসন কাঁপিয়ে দিল
সেদিন বলেছিল—এখন ফিরিস্তারা ঘুমিয়ে আছে।
আমল করছে শয়তান, তবে শেষ পর্যন্ত জেতেন আল্লা পাক।
ভয় নেই। আমার জোয়ান ছেলেরা তোর বাড়ি পাহারা দেবে।
আল্লা আছেন বেটি।
যাও চাচা। তুমি মানুষের জান নিতে পারো নি।
রক্তে তোমার অরুচি।ছি! তুমি কাপুরুষ।
আমাদের মতো বীরের দুনিয়ায় তোমায় মানায় না।
ওসমান চাচার কাফন দাফন হচ্ছে।
নাজুক রোদে চারজন লোক পড়ছে নামাজ-এ-জানাজা।
পৃথিবীর মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গা খর্চা হবে।
কিছু দূরে রিফুজিলতার ছেঁড়া বোরখা পরা একটা খেজুর গাছ
পাশে অপুষ্ট শিশুর মতো দু-একটা কচুঝোপ।
ওসমান চাচা তেমন কেউকেটা নয়--- মুরুব্বি নয়।
তার এন্তেকাল খুবই সাধারণ একটা ঘটনা।
খোদার দরবার পর্যন্ত পৌঁছোবার মতো খবরই নয়!
ফিরিস্তারাও এসেছেন কি আসেন নি।
ওসমান চাচার দুই ছেলে---
রোজগার করে। পেলে খায়, না পেলে রোজা---
বছরের যে কোন দিন।
এ হেন লোকের মৃত্যুতে কি আর শোকপালন হবে।
তবু গণকঠাকুরের বিধবা আঁচলের খুঁটে
দু ফোঁটা চোখের জল মুছে মনে মনে বলল---
“ভগবান, লোকটাকে পায়ে ঠাঁই দিয়ো”
বিপদে আপদে কেঁদে পড়লে দিত এক আধ কাঠি চাল,
গণকের বাৎসরিক শ্রাদ্ধে—দু একটা বাঁশ ,
ছেলের পৈতের দিনে এক কাঁদি কলা, আধসের দুধ।
মানুষ যখন মানুষের রক্তের জন্য
চিৎকার করে ঈশ্বরের আসন কাঁপিয়ে দিল
সেদিন বলেছিল—এখন ফিরিস্তারা ঘুমিয়ে আছে।
আমল করছে শয়তান, তবে শেষ পর্যন্ত জেতেন আল্লা পাক।
ভয় নেই। আমার জোয়ান ছেলেরা তোর বাড়ি পাহারা দেবে।
আল্লা আছেন বেটি।
যাও চাচা। তুমি মানুষের জান নিতে পারো নি।
রক্তে তোমার অরুচি।ছি! তুমি কাপুরুষ।
আমাদের মতো বীরের দুনিয়ায় তোমায় মানায় না।
Friday, 15 May 2015
মাতৃভাষার
অধিকার ,
১৯
শে মে-র
শিক্ষা/
পার্থ
বসু
স্বীকার
করতে দ্বিধা নেই,
চাকরি
জীবনে রাজ্যের বাইরে যখন
দ্বিতীয় দফায় বদলী হয়ে শিলচরে
যেতে হয়েছিল ,
ক্ষুব্ধ
হয়েছিলাম। এটি দ্বিতীয় দফা
উত্তর পূর্বাঞ্চলের বদলী।
আগে বিহার রাজ্যেও প্রায় পাঁচ
বছর ছিলাম। আশা করেছিলাম অন্তত
গৌহাটি পোস্টিং পাব। কলকাতা
থেকে যাতায়াত সহজ হত। শিলচরে
এসে অবাক হয়েছিলাম--
এ
তো আরেক বাংলা। আমার পশ্চিম
বাংলার থেকেও অনেক বেশী বাংলা।
বাংলাই।
ভাগ্যিস
শিলচরে এসেছিলাম। তাই না ভাষা
শহীদের স্মৃতিবাহী তীর্থ
দর্শন হল। ভাগ্যিস !
স্বীকার
করতে দ্বিধা নেই,
বাংলায়
এতো সাইন বোর্ড কোলকাতাতেই
দেখা যায় না। আর আমার অফিসের
যে অধস্তন কর্মী ক্যাশ পিওনের
কাজ করত প্রায় ছ'মাস
পরে জেনেছিলাম ছেলেটি আদিতে
ছাপরার। এতো নিখুঁত সিলেটী
বুলিতে কথা বলতো !
কোলকাতার
মাড়োয়ারি ব্যবসার স্বার্থে
যেটুকু বা বাংলা বলতেন আগে,
এখন
তারও প্রয়োজন হচ্ছে না,
তার
নমুনা--
কি
বাসুবাবু ,কেমোন
আছেন ?
জবানে
হিন্দি টান। এখানে তা নয়।
এখানে মাটির ভাষা তারা আত্মস্থ
করেছেন। উচ্চারনেও বিকৃতি
নেই। অসমীয়া সাহিত্যের অন্যতম
পুরোধা পুরুষ তো একজন মাড়োয়ারিই।
জ্যোতি প্রকাশ আগরওয়াল।
কথাগুলি
এ জন্যেই বলা,
কোলকাতা
না হয় একটি কসমোপলিটান শহর।
এককালে ভারতের রাজধানী। অখণ্ড
ভারতের।
কোলকাতার
বাইরে বাংলার গ্রামে গঞ্জে
মফস্বল শহরে ,
নানা
জেলা শহরে ,
তাঁরা
বাংলা ভাষা নিজের বলেই গ্রহণ
করেছিলেন। আমার স্কুলের বেশ
কিছু সহপাঠী ছিল মাড়োয়ারি।
তারা বাংলা স্কুলে বাংলা
মাধ্যমেই পড়াশুনা করেছে।
এখন
পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি ঠিক
বিপরীত। ইংরেজি আর হিন্দি
মাধ্যমের স্কুল দ্রুত বিস্তার
পেয়েছে। গ্রামেও। সেখানে এমন
কি বাঙালীর ছেলেও বাংলা পড়ছে
না। পড়ছে ইংরেজি আর হিন্দি।
আমি
মাড়োয়ারির ছেলেটি তার মাতৃভাষায়
পড়ার সুযোগ পাচ্ছে এতে আনন্দিত।
কিন্তু এই মাটির ভাষা যে
বাংলাভাষা তা অবহেলিত হবে
কেন ?।
ভারতের যে কোন রাজ্যে '
সন
অব দি সয়েল '
এই
তকমাটি পেতে হলে ,
সরকারী
চাকরি পেতে হলে অন্তত স্কুলস্তরে
রাজ্যের ভাষাটি শেখা বা শেখানো
হয়েছে মার্কশীট সহ তার প্রমান
দাখিল করতে হয়। আগ্রহী জন
ওয়েবসাইট থেকে ভারতের বিভিন্ন
রাজ্যের সরকারী চাকরি পাওয়ার
শর্তগুলি দেখে নিন। পশ্চিমবাংলা
ব্যতিক্রম। এখানে বাংলা জানি
এই বিবৃতি যথেষ্ট। আমারা কেন
চাইব না বাংলাভাষা শিক্ষা
বাংলায় বসবাসকারী যে কোন
প্রদেশের মানুষের জন্য আবশ্যিক
হোক ?
সরকারী
কাজকর্মে বাংলার ব্যবহার
আবশ্যিক হোক ?
আমাদের
দুর্ভাগ্য বা দুর্বলতা ভগ্ন
দেশে ভগ্ন দশায় ভাষার অধিকারের
মৌলিক প্রশ্নটিকে আমাদের
নেতারা এড়িয়ে গেছিলেন। যে
নেতৃত্ব সমূহ বাঙালী ,
তামাম
ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
বাঙালী ,
কোলকাতার
কাছে প্রত্যাশা করেছিল আমরা
সেখানে নিদারুণ ব্যর্থ। এখানে
বাম বা ডানে তফাৎ নেই। এখানে
বিধান রায়ের মত শ্রদ্ধেয় এবং
জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রীও ভাষার
প্রশ্নে বাঙালী জাতীয়তার
প্রশ্নে কোন দিশা দেখানো দূরের
কথা ,
তিনি
বাংলা বিহার সংযুক্তিপ্রস্তাবে
সায় দিয়েছিলেন। আন্দোলন করে
যা রুখতে হয়েছিল।
দুদিন
আগে সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন
তৃণমূল কাউন্সিলর ফরজানা
আলমের দাদা এ বি পি আনন্দকে
সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন।
খিদিরপুরের লোক। একবারের
জন্য বাংলা বলতে শুনলাম না।
কেউ বলতেই পারেন উর্দু বাংলার
দ্বিতীয় রাজভাষা। উনি অন্যায়
কিছু করেন নি। উর্দু কেন আমাদের
দ্বিতীয় রাজভাষা আমার আপত্তি
সেখানেই। উর্দু একটি ভারতীয়
ভাষা। উন্নত ভাষা। সন্দেহ
নেই। আমার প্রশ্ন উর্দুকে
রাজভাষার সম্মান দিয়ে নেতারা
সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছেন।
বাংলায় উর্দুভাষী মুসলমান
সমগ্র বাঙালী মুসলমানের
প্রতিনিধি নন। কয়েক লক্ষ
উর্দুভাষী আছেন বড় জোর। কয়েক
কোটি বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা
বাংলা। এই পদক্ষেপে নেতারা
উর্দুভাষী আর বাঙালী মুসলমানকে
এক ব্র্যাকেটে আনলেন। বাংলার
মুসলমানের বৃহত্তর সংখ্যাই
বাঙালী ,
এবং
উর্দুর রাজকীয় সম্মানে তাদের
কিছু যায় আসে না এটা বোঝার
চেষ্টাই করলেন না। সংখ্যার
বিচারে বরং দ্বিতীয় রাজভাষার
মুকুট প্রাপ্য ছিল সাঁওতালীর।
যে ভাষার কাছে বাংলা ভাষা তার
পুষ্টি পেয়েছে।
তার
ব্যকরণ ,
ছন্দ,
শব্দভাণ্ডার
অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর থেকেই
বিপুল বিপুল ভাবে আহরিত।
নির্মিত। খণ্ডিত বৃহত্তর
বাংলা যেখানে জোর করে উর্দু
চাপানোর বিরোধিতায় ভাষা
আন্দোলনের পথে নেমে প্রাণ
দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা
প্রতিষ্ঠাই শুধু নয় ,
একটি
নতুন জাতিসত্তা ,
নতুন
বাংলাদেশের জন্ম দিলেন ;
অবশিষ্ট
বাংলায় এপারে উর্দুর হাত ধরেই
হিন্দি আধিপত্য বাদ কায়েম
করছে । আমরা দেখেও দেখছি না।
উদাসীন। এপারেও আমাদের মাতৃভাষা
বাংলা একইভাবে বিপন্ন। কোণঠাসা।
ভাষা জাতীয়তার একটি বলিষ্ঠ
অসাম্প্রদায়িক একক। এখানেও
জরুরী একটি ভাষা আন্দোলন। যা
ভাষার টানেই হিন্দু বৌদ্ধ
ক্রিশ্চান মুসলমানকে এক তারে
বাঁধবে।
সুখের
কথা ১৯ শে মে নিয়ে সচেতনা ক্রমে
বাড়ছে। গত কয়েক বছর ধরেই শুধু
একুশের অনুষ্ঠান নয় উনিশে মে
পালিত হচ্ছে পশ্চিম বাংলার
নানা শহরে। জেলা শহরে। গ্রামেও।
আজ ১৭ মে কোলকাতায় আগামী ১৯
শে মে-র
স্মরনে সভা রয়েছে। এঁরা কাজ
করছেন ভাষার স্বাতন্ত্র ,
জনগোষ্ঠীর
স্বাধীনতা নিয়ে। এঁদের শ্লোগান--
“ আমি
চাই সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে
রাষ্ট্রপুঞ্জে ”। ১৯ শে মে-র
ভাষা আন্দোলনের যে শিক্ষাটি
এখানে অনুশীলন ও চর্চার দাবি
রাখছে একটু বিস্তারে বলি।
আমি যা অনুভব করেছি।
একুশের
প্রেরণাতেই উনিশ। একুশের
আন্দোলনে অর্জনের মহিমা।
উনিশ সেখানে বাঙালীর একটি
স্বতন্ত্র রাজ্য বা স্বশাসিত
ভূখণ্ডও পায় নি। যেটুকু অধিকার
বরাকে বাংলাভাষার জন্য এগারো
শহীদের প্রাণের মূল্যে আদায়
করেছিল তা এখনও অসমীয়া
সম্প্রসারণবাদের আগ্রাসন
মুক্ত নয়। অথচ গণভিত্তির
প্রশ্নে ১৯শে মে-র
ভাষা আন্দোলনে শুধু ছাত্র
নয়,
সমাজের
সব স্তরের নানা বয়সের নানা
পেশার মানুষ সম্পৃক্ত ছিলেন।
যখন শিলচরে ছিলাম দেখেছি রেল
স্টেশনে শিলচর নামটি বাংলায়
উৎকীর্ণ আছে। জানি না এখনও
তাই ?
সংশয়ের
কারণ ,
রেল
তো কেন্দ্রীয় সরকারের। টেলিফোনও
তাই। শিলচরে দিলীপ বা তমোজিত
চেনা কাউকে ফোন করলে ,
ধরা
যাক লাইন পাচ্ছি না ,
যান্ত্রিক
কণ্ঠে জানানো হয় – লাইনটু
ব্যস্ত আছে। ঘন্টেক পিছতে--
ব্যস্ত
হ্যয়। থোড়া টাইম বাদ---।
অসমীয়া আর হিন্দিতে। বাংলা
! অসমীয়া
তো বরাকের রাজভাষা নয়।
পাঠ্যপুস্তকে অসমীয়া সিনট্যাক্সে
বাংলা শেখানো হচ্ছে। শ্রদ্ধেয়
বিজিত ভট্টাচার্য এ বিষয়ে
বিস্তৃত লিখেছেন। তা বিদ্বদজনের
দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে।
ভাষাভিত্তিক
রাজ্য পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়াটি
দেশভাগের পর সম্পন্ন হয়েছে
তার আওতায় না এসে,
পড়ে
পাওয়া ব্রিটিশ উত্তরাধিকারের
আসাম নামটির সুবাদে,
অসমীয়ারা
বহুবারের মতই সম্প্রতি আবার
সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর
বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাচ্ছে।
১৯ শে মে-র
চেতনা বাঙালীকে এই আত্মপরিচয়ের
সংকট থেকে উত্তীর্ণ করুক।
বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন বিশেষ
করে সংখ্যালঘু বাঙালীরা।
ধর্ম পরিচয়ে যাদের অনেকেই
মুসলমান। উন্মত্ত জনরোষ থেকে
কাছাড়ের যে হতভাগ্য যুবক
কিছুদিন আগেই ডিমাপুরে অক্ষম
প্রশাসনের চোখের সামনে নিহত
হলেন ,
প্রাথমিক
খবরে তাকেও বাংলাদেশ থেকে এ
দেশে অনুপ্রবেশকারী বলা
হয়েছিল। পরে দেখা যায় ওই
পরিবারের সদস্য ভারতীয়
সেনাবাহিনীকেও সেবা দিয়েছেন।
কোচবিহার সন্নিহিত গোয়ালপাড়া
থেকে বাংলাভাষা সংস্কৃতি
কিভাবে হিংস্র ভাবে মুছে দেওয়া
হয়েছিল তা আজ ইতিহাস। ওই অঞ্চলের
তরুণ প্রজন্মের জন্যই সদর্থে
'ঘর-ওয়াপসী'
প্রয়োজন।
বাংলাভাষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
প্রয়োজন।
১৯
শে মে ভাষা শহীদ দিবসে যে যার
মাতৃভাষার রক্ষা ও বিকাশ
আমাদের ব্রত হোক। ব্রত কথাটির
যে লোকায়ত পরিসর তাতে স্থান
সংকুলান না হওয়ায় ব্রতের জন্য
যা করনীয় অর্থাৎ যাহাই ব্রাত্য
তা অপাংক্তেয় বিধান দিয়েছিলেন
পুরোহিতরা। ১৯ শে মে-র
শপথ হোক ব্রাত্যজনের সুমহান
উত্থান।
বাংলাভাষার
অধিকার রক্ষার সংগ্রাম যে
সারা বিশ্বে মাতৃভাষার অধিকার
রক্ষার প্রতীক ও প্রেরণা হয়ে
দাঁড়াল তারই স্বীকৃতি দিয়েছে
ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে
মাতৃভাষা দিবস ঘোষণায়। ১৯ শে
মে-র
ভাষা আন্দোলনে এই বৃহৎ পরিসর
ছিল। বাংলা ভাষা বরাকের বাকি
সব ভাষাগোষ্ঠীর সমর্থন পেয়েছিল।
নেপালি ,
হিন্দি
, ডিমাসা
,
বিষ্ণুপ্রিয়া
মনিপুরী--
তখনও
মেঘালয় ,
অরুণাচল
হয় নি--
শিলং
, ইম্ফল,
খাসি
জয়ন্তিয়া পাহাড় বাঙালীর সাথে
পায়ে পা মিলিয়ে প্রতিরোধে
সামিল হয়েছিল। ভারত আজ কার্যত
বিভিন্ন জাতিসত্তার একটি
কারাগারে পরিণত। এই ক্রান্তিকালের
রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটি বুঝতে
সুপ্রাবন্ধিক অসিত রায়ের শরণ
নিচ্ছি। তাঁর কথায়--
'ভারত
একটি সাম্রাজ্যরাষ্ট্র ও
সমস্ত জাতিসত্তার একট কারাগার।
জাতিগুলিও সুগঠিত নয়। কারণ,
দীর্ঘলালিত
বর্ণব্যবস্থায়
জাতিসত্তার মধ্যে ঐক্য গড়ে
ওঠে নি ব্রাহ্মণ্যবাদের
প্রভূত্বে। তার সঙ্গে যুক্ত
হয়েছে ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা।
যার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে
মিথ্যে হিন্দু-মুসলমানের
দেশভাগ এবং এখন কর্পোরেটদের
বিশ্বায়ন। এর স্রষটা কিন্তু
জিন্না নন।এই বিকলাঙ্গ পাকিস্তান
তিনি চান নি। তাকে ঘাড় ধাক্কা
দিয়ে পোকায় খাওয়া পাকিস্তান
নিয়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেন
নেহরু-প্যাটেল,
অবশ্যই
গান্ধীর আশীর্বাদসহ। তবে
তাঁকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের
হাতে প্রাণ দিতে হয়। কিন্তু
জাতির জনক হিসেবে কারেন্সি
নোট,
আদালত,প্রশাসন
দফ্তর
আলো করে থাকেন। তাই সুভাষ
থাকেন ব্রাত্য। তাঁর পরিবারের
পেছন দু দশক ধরে গোয়েন্দা
লাগানো থাকলেও বাঙালি থাকে
মৌন। দুই ক্ষমতালোলুপ
সাম্রাজ্যরাষ্ট্রের
দুই প্রহরী। প্রথমজন,
নেহরু
পরিবার ৬৭ বছর কংগ্রেস পার্টি
চালিয়ে সাময়িক শাসনক্ষমতা
থেকে অপসারিত। তাদের
সাম্রাজ্যরাষ্ট্র
রক্ষণের নির্মমতার প্রয়োজন
কাশ্মিরি,
নাগা,
মিজো
ও অল্পবিস্তর সব রাজ্যই
মিটিয়েছে। অন্যজন প্যাটেল
ও তার মানসপুত্র নরেন্দ্র
মোদি যিনি গরীব দেশের কয়েক
হাজার কোটি টাকা খরচ করে
প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েছেন।
এ নিয়ে লোকসভায় বাম-ডান
কাউকে কথা বলতে বা আঙ্গুল
তুলতে দেখি নি। এই সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের
দুই প্রহরী পার্টির সাধারণ
অবস্থান এক। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান।
কংগ্রেস নরম সুরে বলে আর বিজেপি
বলে সোচ্চারে। অরুন্ধতি রায়ের
ভাষায় বলি,
কংগ্রেস
হল রাতের বিজেপি আর বিজেপি
হল দিনের কংগ্রেস। দুদলেরই
সমর্থনভূমি কর্পোরেট। তবে
কংগ্রেসের বেলায় তারা বিভক্ত।
আর বিজেপির কিছু ক্যাডারভিত্তিক
লেজুড় আছে। তারা আপোষহীন
হিন্দু জঙ্গী সংগঠন,
আর
এস এস ও বিশ্বহিন্দু পরিষদ।
এরা কর্পোরেটদের পক্ষে কিছুটা
অসুবিধাজনক। '
বাংলার
প্রথম ভুবন রাজনৈতিক ভাবে
ঢাকা। বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধতর
উত্তরাধিকার পশ্চিমবাংলার
এ কথা তবু বাংলাদেশের অনেক
বন্ধুই বিশ্বাস করেন। এ
বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে হলে
আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া
গতি নেই। ১৯ শে মে আমাদের পথ
দেখাক।
১৯
শে মে মাতৃভাষা আন্দোলনে বিশ্ব
ইতিহাসের প্রথম মহিলা শহীদ
কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট এগারো
বলিদান ,
পরে
আরও দুই ,
এই
ধারাতেই বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী
ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ
করেছেন যে বোনটি – সুদেষ্ণা
সিংহ তাদের পুণ্য স্মৃতিতে
,
আসুন
,
শপথ
নিই--
জান
দেব ,
জবান
দেব না।
Friday, 8 May 2015
সন্ত্রাস বনাম / রোহণ কুদ্দুস
সন্ত্রাস বনাম , রোহণ কুদ্দুস
টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে নানা মাদ্রাসায় জঙ্গিদের আস্তানার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে দেখছি। সেই সঙ্গেই দেখছি চারদিকে নানা পরিচিত-অপরিচিত মানুষ নড়েচড়ে বসেছেন 'মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী নয়' এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। ধর্ম নির্বিশেষে সবাই মোটামুটি একমত যে, এই কাজটা করতে মুসলমানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। খুবই হাস্যকর লাগছে এইসব কথাবার্তা। লাদেনের সূত্রে মুসলমান মানেই যদি সন্ত্রাসবাদী হত, তাহলে হিন্দু মানেই পরমহংসদেব হয়ে যেত। আমরা গড়পড়তা 'দিন আনি দিন খাই' বাঙালি। নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে বড়জোর কয়েক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে থাকি। এসব ছেড়ে ঠিক যে নিয়মে একজন ছাপোষা বাঙালি দেশের কল্যাণে জান লড়িয়ে দেন না, সেই একই সূত্র ধরে সাধারণ বাঙালির মতোই দেশ টুকরো করার বা নিরীহ মানুষ মেরে জিহাদ করার সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের নেই। এই সহজ সত্যিটাও যদি বুঝিয়ে বলার দরকার হয়, তাহলে বৃথাই আমরা ছটা দশকের বেশি সময় পাশাপাশি কাটালাম।
বিজ্ঞানীরা বলেন, আমরা যা শুনি তা ছবির মাধ্যমে মগজে চালনা করি। যখনই বারবার কানের গোড়ায় গাওয়া হবে 'মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী নয়'; তখন মগজ এভাবে বুঝবে। 'মুসলমান' শব্দে টুপিওয়ালা দাড়িধারী পাজামা পাঞ্জাবী পরা মানুষের ছবি মাথায় আসবে (দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ছবিটা সত্যি। অনেকেই প্রশ্ন করেন "তোমায় দেখে তো মুসলমান বলে মনে হয় না।" যাই হোক, যা বলছিলাম।) 'মানেই' শব্দে মগজের কোনো হেলদোল হবে না, কারণ এর কোনো ছবি নেই। 'সন্ত্রাসবাদী' শব্দে রকেটলঞ্চার, মেসিনগান, গ্রেনেড শুদ্ধু একজন লোকের ছবি মাথায় আসবে। কিন্তু তারপর 'নয়' শব্দেরও কোনো ছবি মাথায় আসবে না। বারংবার এই বাক্য কানে ঢুকতে থাকার ফলে দেখা যাবে টুপি দাড়িওয়ালা মুসলমানের অঙ্গে রকেটলঞ্চার, বন্দুক ইত্যাদি উঠে আসছে। তাই মুসলমানের সন্ত্রাসবাদী না হওয়ার সাফাই গাওয়া খুব বিপজ্জনক একটা প্রক্রিয়া, বিশেষত যে সময় ধর্মকে রাজনৈতিক মেরুকরণের হাতিয়ার হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। সাঁকো নাড়িয়ে দয়া করে এই প্রক্রিয়ায় ইন্ধন জোগাবেন না। হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় ব্যবধানকে মূলধন করে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল ফায়দা লুটতে চাইছে, তাদের চুপ করানোর দায়িত্ব প্রত্যেক বাঙালির। এই সহজ সত্যটা ভুলে গিয়ে সম্প্রীতির অজুহাতে শুধুমাত্র মুসলমানদেরই অগ্রণী হয়ে তাদের গা থেকে সন্ত্রাসবাদী স্টিকার ওঠাতে বলাটা অপমানজনক ও নিন্দনীয়। |
সম্প্রীতির মন ভালো করা খবর
Kamrul Islam Jewel এর পোস্ট। এই অসময়ে আলোর ঝলকানি হয়ে খবরটা থাক।সব্বাই ভালো থাকুক।
'জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল কুমিল্লার ব্রাহ্মন পাড়ার শ্রী শ্রী কালী মন্দির। উপাসনা ব্যাহত হচ্ছিল হিন্দুধরমাবলম্বীদের। মন্দির প্রাঙ্গণে ছিল শতবৎসরের পুরনো এক বটগাছ। সেই গাছটি ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে মন্দির সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রাচীন বটগাছটি বিক্রির খবর। খবরটি চলে যায় নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশী তরুন মোশাররফ হোসেনের কাছে। কালবিলম্ব না করে তিনি মন্দির কমিটির সাথে যোগাযোগ করেন। বিক্রি হওয়া গাছটি তিনি এক লাখ টাকায় কিনে নিয়ে দান করেন পুনরায় মন্দিরকে। গাছটি রক্ষা পায়। বর্তমানে গাছটি মন্দির কমিটির হাতেই আছে। মন্দিরটিও যথারীতি সংস্কার করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বর্তমানে সেখানে যথারীতি উপাসনা করছে।' |
Thursday, 7 May 2015
দুটি কবিতা
প্রভুকে / পার্থ বসু
নিজেই গিয়েছ ফেঁসে , কাকে বলব সমাধান দাও ?
তোমারই শরণাগত , কোনদিন স্বাবলম্বী নই !
যেভাবেই হোক বাঁচো , নইলে এই নাদান বান্দাও
নাচার আশ্রয় করে বসতে পারে দুর্বিনীত মই
নিজেই গিয়েছ ফেঁসে , কাকে বলব সমাধান দাও ?
তোমারই শরণাগত , কোনদিন স্বাবলম্বী নই !
যেভাবেই হোক বাঁচো , নইলে এই নাদান বান্দাও
নাচার আশ্রয় করে বসতে পারে দুর্বিনীত মই
যা দিয়ে স্বর্গের সিঁড়ি অব্দি জানি যাবে না পৌঁছন।
গোল্লায় ? সেখানেও অবশিষ্ট আছে কিছু গুড় ?
এই প্রশ্নে আজ বড় উদ্বেলিত জনগণমন ,
অর্থাৎ সুযোগ আর তদ্দৃষ্টে পুণ্যলোভাতুর
গোল্লায় ? সেখানেও অবশিষ্ট আছে কিছু গুড় ?
এই প্রশ্নে আজ বড় উদ্বেলিত জনগণমন ,
অর্থাৎ সুযোগ আর তদ্দৃষ্টে পুণ্যলোভাতুর
তীর্থের কাকের ভিড়ে সাধু, বেশ্যা , স্তাবক , নিন্দুক
যখন হল্লায় মাতবে আমি ওই মই বেয়ে বেয়ে
কাঙ্ক্ষিত আঙুর বড় টক জ্ঞানে হব ইন্দুভুক
তখন নেপোয় দই মেরে গেলে তুমি থাকবে হতভম্ব চেয়ে !
যখন হল্লায় মাতবে আমি ওই মই বেয়ে বেয়ে
কাঙ্ক্ষিত আঙুর বড় টক জ্ঞানে হব ইন্দুভুক
তখন নেপোয় দই মেরে গেলে তুমি থাকবে হতভম্ব চেয়ে !
বাসী হলে মিঠা হয় কথা যাহা গরীব উবাচ ।
সুইস ব্যাঙ্কের বই স্ফীত করে যেন তেন প্রকারেণ বাঁচো।।
সুইস ব্যাঙ্কের বই স্ফীত করে যেন তেন প্রকারেণ বাঁচো।।
সতীত্বঃ
April 30, 2015 at 8:06pm আয়শা ঝর্না
অসংখ্য লোকের ভিড়ে কুঁকড়ে পড়ে থাকি, হাত-পা ভাঁজ করে।
এ আসে ও আসে আমার চোখ খুবলে নেয়, চক্ষুশূন্য কোটর থেকে
ঝরে রক্ত..। কেউ একজন আমার নাক খুবলে নেয় নাকছাবি খুঁজতে
যেয়ে। কেউে এসে খোঁজে আমার সতীত্ব, কেউ খোঁজে শাখাসিঁদুর।
সিঁদুর খুঁজতে যেয়ে মাথার চামড়া তুলে ফেলে। চুড়ি ভাঙলে আমার
হাতের হাঁড় বেরিয়ে আসে আমি তবু পাথর। কুঁকড়ে পড়ে থাকা বিন্দু।
অসংখ্য ছুরির আঁচড় খেয়ে মা আমাকে আঁকড়ে ধরে বুকে। আর বলে,
’মেয়ে আমার, আয় এই বুকে, নেই তোকে জঠরে আবার।’ আমি তখন,
ঠিক তখনি জেগে উঠি পাথরঘুম থেকে। গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকি মায়ের
বুকে।
মা আমার মৃত্যুকে সহজ করতে গায় ঘুমপাড়ানিয়া গান। সে গান ছড়িয়ে
পড়ে নদীর স্বচ্ছ জলে যেখানে টুপটাপ রক্ত ঝরে অবিরাম মৃত্যুনামধারী
গাছ থেকে।
এ আসে ও আসে আমার চোখ খুবলে নেয়, চক্ষুশূন্য কোটর থেকে
ঝরে রক্ত..। কেউ একজন আমার নাক খুবলে নেয় নাকছাবি খুঁজতে
যেয়ে। কেউে এসে খোঁজে আমার সতীত্ব, কেউ খোঁজে শাখাসিঁদুর।
সিঁদুর খুঁজতে যেয়ে মাথার চামড়া তুলে ফেলে। চুড়ি ভাঙলে আমার
হাতের হাঁড় বেরিয়ে আসে আমি তবু পাথর। কুঁকড়ে পড়ে থাকা বিন্দু।
অসংখ্য ছুরির আঁচড় খেয়ে মা আমাকে আঁকড়ে ধরে বুকে। আর বলে,
’মেয়ে আমার, আয় এই বুকে, নেই তোকে জঠরে আবার।’ আমি তখন,
ঠিক তখনি জেগে উঠি পাথরঘুম থেকে। গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকি মায়ের
বুকে।
মা আমার মৃত্যুকে সহজ করতে গায় ঘুমপাড়ানিয়া গান। সে গান ছড়িয়ে
পড়ে নদীর স্বচ্ছ জলে যেখানে টুপটাপ রক্ত ঝরে অবিরাম মৃত্যুনামধারী
গাছ থেকে।
Wednesday, 6 May 2015
পুরনো সেই দিনের কথা / পার্থ বসু
পুরনো
সেই দিনের কথা /
পার্থ বসু
মাও
সে তুং। সত্তর দশকে এই নামেই
চিনতাম। পরে কখন হয়ে গেলেন
মাও জে দং। যেমন পিকিং হয়ে গেল
বেজিং। বাঙালীর মা প্রীতি
চিরকালীন। বাঙালীর মাও প্রীতি
একটি কালখণ্ডকে প্লাবিত
করেছিল। আমার মনে পুরনো নামটাই
গেঁথে আছে।
বিজ্ঞানের
ছাত্র। তখন ডায়ালেক্টিক্স
পড়ছি। স্তালিন পড়ছি। বিজ্ঞানের
সুত্র ধরে ধরে কি অদ্ভুত
বোঝাচ্ছেন স্তালিন। এমন সময়
মাওয়ের একটি লেখায় চোখ আটকে
গেল-- বিপ্লব
হবে কি হবে না ডায়ালেক্টিক্স
দিয়েই বুঝতে হবে। যাকে বলে
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। একটি
পাথর আর একটি ডিম দিয়ে বোঝালেন।
ডিমে বাচ্চা হওয়া আর না হওয়ার
দ্বন্দ বিদ্যমান। বাহ্যিক
যে শর্তে তা ত্বরান্বিত হয়
সেটি হল ডিমে তা দেওয়া। পাথরে
কিন্তু হাজার তা দিলেও বাচ্চা
হবার নয়।
এই
যে কঠিন কথাও সহজে বলার লোকআঙ্গিক এর তুলনা কবি কথক শ্রী
শ্রী রামকৃষ্ণ। মাওয়ের কথাও
শুধু কথা নয় ,
কথামৃত।
ভাল
ছাত্র হিসাবে একটি পরিচিতি
ছিল আমার। কিন্তু কংগ্রেসি
বাড়ির ছেলে। নেতা কেউ নন ,
বাবা কাকারা
কংগ্রেসকে ভোট দিতেন এই যা।
অথচ বামপন্থা তখন যুগের হাওয়া।
আর তখন পড়তে হত। এত দৃশ্যমাধ্যম
ছিল না। দাস ক্যাপিটাল না হোক
ম্যানিফেস্টো না পড়ে কম্যুনিস্ট
হবার কথা ভাবাই যেত না। দাস
ক্যাপিটাল পড়ি নি তাতে কি,
সিরিয়াল
হোক দেখে নেব ঠিকই এই বিশ্বাসে
চাঁদা দিয়ে পার্টি মেম্বার
হওয়ারও চল ছিল না। আমি তো একটা
লিফলেট পড়েও মানে বুঝতে ঘেমে
যেতাম। এত পরিভাষা !
তো শুরু
করলাম তাত্ত্বিক পড়াশুনা।একসময়
হাতে এল মাও সে তুং এর নির্বাচিত
রচনাসমগ্র। অবাক হয়ে দেখলাম
পণ্ডিতি জাহির করার কোন ভান
অব্দি নেই। ১০ পাতার একটি
প্রবন্ধ লিখলে মাও প্রায় ৭
পাতা জুড়ে তাঁর দেশবাসীকে
মনে করাচ্ছেন--
চিন একটি
মহান দেশ। চিনারা একটি মহান
জাতি। লিখছেন চিনের হাজার
হাজার বছরের সংস্কৃতির কথা।
চিন কবে কাগজ আবিস্কার করেছিল,
কবে কত বছর
ধরে প্রাচীর গড়ল--
আরও যা যা
– এগুলি করেছেন কে?
রাজা ?
মাও
প্রশ্নটিকেই বদলে দিলেন। কে
নয় , কারা
? তাঁর
জবাব-- চিনের
মানুষ , সাধারণ
মানুষের শ্রম ও মেধায় নির্মাণ
করেছেন সব কিছু।
জাতীয়তার
এই আবেগেই জন্ম নিয়েছিল চাইনিজ
কমিউনিস্ট পার্টি ,
সংক্ষেপে
সি পি সি। কমিউনিস্ট পার্টি
অফ চায়না নয় । চিনের কমিউনিস্ট
পার্টি নয়। চিনা কমিউনিস্ট
পার্টি। এ দেশে ভারতের কমিউনিস্ট
পার্টি পেয়েছি। ভারতীয় কমিউনিস্ট
পার্টি না থাকায় জাতীয়তাবাদ
ব্যাপারটিই ঠিকমত বিকাশ পেল
না। যে জাতীয়তায় সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী আমজনতার আত্মিক প্রতিফলন
থাকত। ক্ষমতালোভীরা লুঠে নিল
জাতীয়তার শ্লোগান।
নর্মান
বেথুন এসেছেন দেখা করতে।
মাওয়ের সঙ্গে। মাও সরকারী
ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তিনি তো
মেন্টর। মাওয়ের বাসায় পৌঁছে
প্রথমে বাগানের মালীকে বললেন
তিনি এসেছেন মাওকে এই খবরটুকু
পৌঁছে দিতে। মালী হাতের খুপরি
রেখে ভিতরে গেল। যাওয়ার পথে
বেথুনকে বসতে বলে গেল। মালী
, মানে
মাও সে তুং ,
একটু পরেই
হাত পা ধুয়ে ফিরে এলেন। শুরু
হল কথাবার্তা। বেথুন জানতে
চেয়েছিলেন মাও কি জাতীয়তাবাদী
? মাওয়ের
তাৎক্ষনিক উত্তর--
নিশ্চয়।
তারপর ব্যাখ্যা -
আমার জাতীয়তা
গুণগত ভাবে হিটলারের জাতীয়তা
থেকে পৃথক। আমার জাতীয়তা
আন্তর্জাতিকতার একটি একক।
প্রখ্যাত
দার্শনিক রমা রঁলা শুধু ভারত
বিষয়ে একটি দিনলিপি রাখতেন।
নাম ইন্দে। তার পাতা থেকে আর
একটি গল্প পড়ে নেওয়া যাক।
রঁলা
এসেছেন সবরমতী। গান্ধী সকাশে।
মন তোলপাড়। কিছুদিন আগেই ইতালি
সফর করে ফিরেছেন গান্ধী।
হিটলারের সঙ্গী মুসোলিনির
ইতালি। রাশিয়াও ডেকেছিল।
গান্ধী যান নি। তাঁর বিবেক
সাড়া দেয় নি। রাশিয়ায় সহিংস
বিপ্লব হয়েছে । তিনি তো অহিংসার
পূজারী। রবীন্দ্রনাথও গেছিলেন
ইতালী। কবি মানুষ। মুসোলিনির
আপ্যায়নে প্রীত কবি উদার কিছু
প্রশংসাও করে এসেছিলেন। তিনি
অবশ্য রাশিয়াও গেছেন। তাঁর
রাশিয়ার চিঠি এখন একটি মানবিক
দলিল। রঁলা লিখেছিলেন কবিকে--
আপনি বিশ্ব
কবি। আপনার প্রতিটি কথায় কান
পেতে আছি আমরা। মুসোলিনিকে
নিয়ে আপনার মন্তব্য আহত করেছে
আমাদের। কবি নির্দ্বিধায়
প্রত্যাহার করেন তাঁর প্রশংসা।
এবার গান্ধীর কাছে এসেছেন ,
তাঁর স্বমুখে
শুনবেন একটি রাজ পরিবারের শত
শতাব্দীর হিংসা ও শোষণ যখন
পাল্টা বিপ্লবী হিংসায় উৎখাত
হয় তা তিনি সমর্থনে নাচার,
কিন্তু
মুসোলিনির হিংসা তাঁর অনুমোদন
পায় কি করে ?
গান্ধী
তখন মৌনীব্রত পালন করছেন।
রঁলা উত্তর না পেয়ে ফিরে
গেছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে
তাঁর দেখা হল নেতাজীর সাথে।
সে অভিজ্ঞতাও তিনি লিখে
রেখেছিলেন।--
সুভাষের
সঙ্গে দেখা হল। কথা হল। মনে
হল ভারতীয় যুবমানসের অনেক
কাছের মানুষ। এবার ভারতের
কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে বলছেন
– সুভাষকে নিয়ে এদের অবস্থান
আর মূল্যায়ন ভুল। চিনে
সান-ইয়াত-সেন
কে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি
বুঝতে ভুল করে নি। সুভাষকে
সাথে নিয়ে এরা সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী লড়াই তীব্র করে তুলতে
পারে। সুভাষ এ দেশের সান ইয়াত
সেন।
সত্তর
দশকের আর একটি অভিজ্ঞতা। তখন
বোম্বাই শহরে । ওখানে মেট্রো
সিনেমায় সিনেমা দেখতে গেছি।
ছবি মৃণাল সেনের ভুবন সোম।
যারা ছবিটি দেখেছেন মনে করুন
শুরুর দৃশ্য। বিচিত্র বঙ্গাল
, সোনার
বঙ্গাল এইসব ধারাভাষ্যের
সঙ্গে জাতীয় নেতাদের ছবি ,
মিছিলের
ছবি--পর্দায়
সহসা ভেসে উঠলেন নেতাজী। সমস্ত
হল গর্জে উঠল--
নেতাজী
জিন্দাবাদ !
বোম্বাইয়ের
মত একটি বানিজ্যিক শহর নেতাজীকে
নিয়ে এত আবেগ পোষণ করেন দেখে
আনন্দ পেয়েছিলাম। আশ্চর্য
হয়েছিলাম বলা বাহুল্য। এমন
নয় নেতাজী ভক্তরা দল বেঁধে
সিনেমা দেখতে গেছেন। সংঘবদ্ধ
ধ্বনি দিয়েছেন। বোম্বাই এমনিই
সবসময় ধাবমান একটি শহর। সেই
তারা----- ! এ
আবেগ ছিল স্বতস্ফুর্ত। আন্তরিক।
খাঁটি।
আবার
সত্তর দশকে আসি। অন্য প্রসঙ্গে।
এ বাংলায় আওয়াজ উঠেছিল চিনের
চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।
স্লোগানটি মানুষ গ্রহণ করেন
নি। কিন্তু এক হাতে যে তীব্র
নির্মমতায় এশিয়ার মুক্তিসুর্য
নকশাল নিধন করলেন ,
অন্য হাতে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
বরাভয় আমি আজ অকপটে কবুল করি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কতটা
ভারত প্রযোজিত ,
ভারতীয়
স্বার্থ প্রযোজিত সংশয়ী ছিলাম।
পরে বুঝেছি মুজিব কিন্তু সুভাষ
যেমন হিটলারের সমর্থন চেয়েছিলেন
নিজত্ব না হারিয়ে মুজিবও
তেমনি। বাংলাদেশ ৩০ লক্ষ
প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা
অর্জন করেছে। ভারত পাশে না
দাঁড়ালে এ লড়াই দীর্ঘতর হত
সন্দেহ নেই। বাংলাদেশী বন্ধুদের
বলি ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস
করবে না কখনোই। কারণ সে ক্ষেত্রে
ভারতীয় রাজনীতির নিয়ন্তার
ভূমিকা উত্তর ভারতীয় হিন্দিবাদের
হাত থেকে ছিটকে যাবে।
শেষে
শিলচরের একটি ঘটনা বলি।
করিমগঞ্জেরও। কোন একটি সংকলনে
করিমগঞ্জের জন্মজিত রায়ের
একটি লেখার নির্বাচন নিয়ে
আপত্তি তুলেছেন বামপন্থী
শিবির। স্পষ্ট করে বলি আপত্তি
সি পি এমের। শিলচরে কমিউনিস্টরা
তখনও, বা
এখনও, ব্যালটের
জোয়ারে ক্ষমতায় এসে নষ্ট হয়ে
যান নি। আদর্শের চর্চায় তারা
তখনও, বা
এখনও, অধ্যবসায়ী।
জন্মজিত জ্ঞানী মানুষ।
প্রজ্ঞাবান। তিনি যে বিষয়ে
লিখবেন তাতে তাঁর যোগ্যতা
প্রশ্নাতীত। কিন্তু জন্মজিত
বি.জে.পি
র লোক। করিমগঞ্জে থাকতেন
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এশিয়ার
অহংকার শ্রদ্ধেয় সুজিত চৌধুরী
মহাশয়। তাঁর স্নেহ আর প্রশ্রয়
পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
সাহিত্যে কবিতা পড়ে ফোন করে
ভাল লাগা জানিয়েছেন। পাঠক
ক্ষমা করবেন এই আনন্দে ঈষৎ
আত্মপ্রচার রয়ে গেল হয়তো। তা
শক্তিদা, শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী,
আমায় পাঠালেন
সুজিতদার কাছে। সেই প্রথম
আমার সুজিতদার কাছে যাওয়া।
শক্তিদাও চাইছেন জন্মজিতের
লেখাটি থাকুক। সুজিতদার
নির্দেশ পেলে তা অমান্য করার
সাহস হবে না কারও। সুজিতদা
কথায় কথায় জানিয়েছিলেন তিনি
কংগ্রেসি ঘরানার লোক। কিন্তু
ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক
বিশ্লেষণে মার্ক্সবাদেই
আস্থা রাখেন। বরাক উপত্যকা
ম্লান হয়ে গেছে তাঁর প্রয়াণে।
Tuesday, 5 May 2015
আমাদের পরিচয় লিপিতে ( About Me ) তে শব্দ সংখ্যার গণ্ডী মেনে আমাদের শুরুর সব কথাগুলি বলা যায় নি। এখানে আর একটু বিশদে বলি।
'তবু বাংলার মুখ' চব্বিশ বছরের যাত্রায় আজ ব্লগজিন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। আমরা বাঙালীর অখণ্ড জাতীয়তায় বিশ্বাসী। বিশ্বাস করি -- এক বাঙালী, দুই দেশ। হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা এই মিথ্যা প্রচারের বিপ্রতীপে আমরা ভারতে হিন্দি সহ সব ভাষার সমান মর্যাদা দাবী করি। আমরা যে কোন ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে। নজরুলের বর্ণিত একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান যাতে পরস্পরের কাছে আসতে পারেন বা পাশাপাশি থেকেও তেলে জলে মিশ না খাওয়ার মত পরস্পরকে না চেনা না বোঝার ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেন এই ব্লগজিন সেই সমন্বয়ের চর্চায় নিয়োজিত থাকবে। নিখিল বঙ্গের সকল বাঙালীকে স্বাগত জানাই।
আমাদের লিঙ্ক tobubanglarmukh.blogspot.com
এ বাংলায় যে কেন্দ্র প্রযোজিত উগ্র হিন্দি হিন্দুবাদের দাপটে অস্তিত্বের এবং জীবিকার সংকটে ভুগছে বিশেষ করে বাঙালী এবং অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষজন( সাঁওতাল, মুন্ডা,নেপালি---)এই ব্লগজিনে তাদের আর্তি, প্রতিবাদ, এবং অধিকার অর্জনের শপথ বাঙময় হয়ে উঠুক। আমরা এই ব্লগজিনের পাতায় সমগ্র বাঙালীর স্পন্দন অনুভব করতে চাই। বাঙালী জাতিসত্তার প্রথম ভুবন যে বাংলাদেশ, রক্তের বিনিময়ে যারা বাঙলা ভাষাকে একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষার পরিণতি দিয়েছেন, সেই সুবাদে বাংলা ভাষাকে আবিশ্ব নতুন করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাও দিয়েছেন এই ব্লগজিন আমাদের আরশিনগরের সেই প্রতিবেশীদের উদ্বাহু অকুণ্ঠ সমর্থন সর্বতোভাবে প্রত্যাশা করে। ভুল ভারতের ভুল আসামের যে বরাক বাংলা, যে মাটিতে ১৯৬১ র ১৯ শে মে বাংলা ভাষার অধিকারের জন্য উগ্র অসমীয়া প্রাদেশিকতার মোকাবিলায় প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো শহীদ, পরবর্তীতে আরও, সেই বরাক উপত্যকা আর ত্রিপুরাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের যে তৃতীয় ভুবন এই ব্লগজিন তাদেরও
সহযোগী হিসাবে পেতে চায়। এর পরেও থাকছেন আন্দামান আর তামাম ভারতে এমনকি প্রবাসে আছেন যে বাঙালীরা তারাও। আমরা খুব বড় করেই স্বপ্ন দেখছি।
এই দেশে বিভিন্ন ভাষা ও জাতিসত্তার অব্যাহত বিকাশ হোক এই আকাঙ্ক্ষার সলতে পাকাবো ব্রতচারীর নিষ্ঠায়। পাশে আসুন। পাশে থাকুন।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলায় দেখা হবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পরিচয় হয়েছিল প্রিয় কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন তার মধ্যে একটি হল বাঙালিত্বের পুনর্নিমান করতে গেলে সাধ্যমত বাঙালির অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বিচ্ছিন্নতা কাটাতে হবে। একুশে আমরা ভাষা- মতিন স্মরণ সভা করি কলেজ স্কোয়ারে। তারপর বেছে নিই পয়লা বৈশাখ। শর্ত ছিল যে বন্ধুরা আসবেন তারা পরিচিত উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালিকে হাজির করাবেন যাতে সংলাপের মধ্য দিয়ে আবেগ,ক্ষোভ দিকনির্দেশ একটা পাওয়া যায়। গান,কবিতা,নাটকের অংশ, কথা ,আলেখ্য ও উদ্দীপনা ছিল। কিছু ছবি ব্লগে দেওয়া হল।১৪২৩ সিদ্দিকভাই আমাদের মধুরা গ্র্রামে দাওয়াত দিয়েছেন। তাই এখন আমার গন্তব্য মাসে অন্তত একবার করে বীরভূমের নলহাটির কাছে মুসলমান প্রধান মধুরা গ্রামে যাওয়া। আমি সিদ্দিক পরিবারেরই একজন তাই অসুবিধে হবে না। কাছেই সাঁওতাল পল্লী ওখানে আমার ভাষা চর্চাও জারি থাকবে। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে এর চেয়ে
আর কি চাইবার থাকতে পারে?
-অসিত রায়
আর কি চাইবার থাকতে পারে?
-অসিত রায়
Monday, 4 May 2015
ইয়াসিন পাঠানের গল্প শুনুন। ইরফান নয়, ইয়াসিন। ইরফান ক্রিকেটের। সবাই প্রায় এক ডাকেই চিনি বা চেনেন। ইয়াসিন ?
পাঠান
ডাক পাঠালেন মৈত্রীর /
পার্থ
বসু
কাগজে
পাকিস্তানে হোলি উৎসবে হিন্দুদের
নিরাপত্তা দিতে ছাত্ররা
মানববন্ধন করেছেন এই খবরে মন
ভালো হয়ে গেল। এর আগে বালুচ
প্রদেশে একটি বিষ্ণু
মন্দিরের ছবি পেয়েছিলাম।
পাকিস্তানের দুই মহিলা চিত্র
সাংবাদিক ছবি গুলি তুলেছিলেন।
মন্দিরের পরিচয় লিপি আরবী
হরফে মন্দিরগাত্রে প্রস্তরফলকে
উৎকীর্ণ। ওঁ শব্দটি শুধু
দেবনাগরীতে লেখা। গ্রামটি
আজও হিন্দু প্রধান। ছবিতে
দেখা যাচ্ছে মুসলিম পুরুষ ও
রমণীরা মন্দিরে জড় হয়েছেন।
পুরোহিত জানাচ্ছেন জাতি ধর্ম
নির্বিশেষে মানুষ এই মন্দিরে
আসেন। মানত করেন। দোয়া চান।
পীরের দরগাতেও যেমন জাতপাতের
বিচার হয় না।
পাঠান,
ইয়াসিন
পাঠানের গল্প বলি শুনুন। শুন
শুন সর্বজন। এ বাংলায়। ও বাংলায়।
এই পাঠান মেদিনীপুরের বাঙালী।
থাকেন হাতিহোল্কা । মেদিনীপুর
থেকে ১০ কি মি দূরে পাথরা।
পাথরা থেকে আরও ২ কি মি উজিয়ে
তাঁর গ্রাম। এখন প্রৌড়। স্থানীয়
হাই স্কুলে পিওনের চাকরি
করতেন। কিন্তু আকৈশোর একাই
যাত্রা শুরু করে যা করেছেন
জবাব নেই। নমস্য এই ব্যক্তির
কথা সাধ্যমত নিবেদন করছি।
তার আগে পাথরা গ্রামের কিছু
কথায় প্রদীপের সলতে পাকাই।
বাংলা
সন ১৭৩২। নবাব আলীবর্দি খাঁ
রত্নচক পরগণায় তহশীলদার করে
পাঠালেন এক ঘোষাল ব্রাহ্মণকে।
বিদ্যানন্দ ঘোষাল।
পাথরায়
গুপ্ত যুগ থেকেই হিন্দু জৈন
আর বৌদ্ধরা বাস করে আসছেন।
৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর নানা
প্রত্নচিহ্ন আবিস্কার হয়েছে
এই গ্রামে। ৯ম শতাব্দীর লোকেশ্বর
বিষ্ণু মূর্তি তার একটি।
বিদ্যানন্দ জমিদারি পেয়ে মন
দিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠায়।
বেশী
দিন অবশ্য নবাবের নেক নজরে
থাকতে পারেন নি বিদ্যানন্দ।
কপাল পুড়ল। কয়েদ হলেন। ব্রিটিশ
আমলে মেদিনীপুরের আরেক রাজা
নন্দকুমারের কথা মনে আসতে
পারে। নবাব বিদ্যানন্দকে
লটকে দিলেন ফাঁসীতে। বিচারপ্রহসন
বা গল্পে যাচ্ছি না। বিদ্যানন্দের
বিত্ত বৈভবে খামতি ছিল না।
নীল চাষ আর রেশম সিল্ক রপ্তানি
করে তাঁর উত্তর পুরুষ আরও
সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে
আরও মন্দির স্থাপন করেছেন
তারা। কালক্রমে গ্রাম ছাড়লেন।
মন্দিরের অবক্ষয় শুরু হল
অনাদরে অবহেলায়।
প্রতিষ্ঠাতা
পরিবার গ্রামে নেই। ভগ্ন
মন্দিরের ইট পর্যন্ত চুরি
হয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই।
না ছিল সরকারী নজরদারি,
, না কোন
বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক
উদ্যোগ।
ঠিক
এখান থেকেই ইয়াসিন পাঠানের
গল্প।
বয়স
তখন সতেরো। গ্রাম থেকে পাথরায়
প্রায় ছুটে আসতেন ইয়াসিন।
এইসব ভগ্ন মন্দির ,
জীর্ণ
দীর্ণ দেবালয় কি এক অমোঘ আকর্ষণে
টানত তাঁকে। এই সব অমুল্য
ইতিহাসের নিদর্শন এভাবেই
লুপ্ত হয়ে যাবে ?
হিন্দুদের
কাছে প্রশ্ন রাখলেন। পাত্তা
পেলেন না। তুমি বিধর্মী,
এইসব মন্দির
নিয়ে মাথা ঘামাও কেন?
নিজের
সম্প্রদায় থেকে পেলেন তীব্র
বিরোধিতা। ওসব মূর্তিপূজা
কাফেরদের ব্যাপার। ইসলামে
এর অনুমোদন নেই। মোদ্দা কথা
কি হিন্দু কি মুসলমান কারও
কাছ থেকেই উৎসাহ বা সমর্থন
জুটল না। তো বেশ। যদি তোর ডাক
শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল
রে। ইয়াসিন হাল না ছেড়ে কাজে
নাবলেন। ১৯৭১ এ শুরু হল তাঁর
মন্দির বাঁচাও আন্দোলন।
বিদ্বজ্জনেরা
এলেন। লোক সংস্কৃতির প্রখ্যাত
গবেষক তারাপদ সাঁতরা,
ডেভিড
ম্যাকাচ্চিয়ন – এঁরা এসে
পৌঁছলেন। তারাপদবাবু শেখালেন
এই মন্দিরগুলির ঐতিহাসিক
গুরুত্বের কথা। একশ বছর পার
হলেই তা যে আমাদের অতীত নিদর্শন,
আমাদের
উত্তরাধিকার এই বোধের পুষ্টি
দিলেন তাঁর মনে। শেখালেন
ক্ষেত্রসমীক্ষার করণ কৌশল।
চার দেওয়ালে বদ্ধ ঘরে একাডেমিক
জ্ঞানচর্চায় কালক্ষেপ না করে
তারাপদবাবু কত পাঠানকে যে
গড়ে তুলেছেন। ২০১০ সালে ঢাকায়
আজিজ মার্কেটে তাঁর 'হাওড়া
জেলার গ্রামনাম'
বইটি বিক্রি
হতে দেখেছি। তারাপদবাবুর যা
কিছু গবেষণা পশ্চিমবাংলার
চতুঃসীমায়। তবু তাঁকে নিয়ে
বাংলাদেশের আজকের প্রজন্মের
এই আগ্রহ আমার যুগপৎ বিস্ময়
ও শ্রদ্ধার কারণ এই ফাঁকে
কবুল করছি।
আবার
ইয়াসিনের কথায় আসি। এখানে
ইয়াসিনের মুখে তাঁর অনুভবের
কথা কিছুটা শুনে নেওয়া যাক---
“ ছেলেবেলা
থেকেই এই মন্দিরগুলি,
জমিদারী
অট্টালিকা ,
এগুলির
ভগ্নদশা আমাকে বিষণ্ণ করত আর
করত বিস্ময় বিমুঢ়।বড় হতে হতে
বুঝতে শিখলাম এগুলি আমাদের
ঐতিহ্য আর পরম্পরার অন্তর্গত।
শতাব্দীর অবহেলায় ক্রমে জীর্ণ
, কিছু
গ্রাস করেছে কংসাবতী। বাকিগুলির
ইট পাথর খুলে নিয়ে যাচ্ছে
অসচেতন গ্রামবাসীরা।”
পাঠান
নিজের মত করে প্রচার শুরু
করলেন। মানুষকে বোঝাতে শুরু
করলেন এ গুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
বোঝালেন মন্দির সংস্কার করে
এই গ্রামকে বাংলার পর্যটন
মানচিত্রে তুলে আনা যায়।
গ্রামে তখন বিদ্যুৎ আসবে,
পানীয়
জল আসবে। তৈরি হবে পাকা সড়ক।
নিমরাজি
গ্রামবাসীরা প্রাথমিক দ্বিধা
কাটিয়ে ক্রমে পাশে দাঁড়ালেন।
প্রথমে শুরু হল মন্দির ঘিরে
গজিয়ে ওঠা বনজঙ্গল সাফ করার
কাজ। কিছু বিশিষ্ট বিদ্যান
মানুষের পদার্পণ ঘটল। পাথার
প্রচারে এল। পাঠান থেমে নেই।
সবাইকে নিয়ে মিছিল,
সবাইকে
নিয়ে ধর্নায় বসলেন জেলা সদরে।
মানে তখনকার মেদিনীপুর সদরে।
সরকারী সাহায্য পাওয়া গেল
কিছু। প্রযুক্তিগত দরকারি
সাহায্য যোগালেন আই আই টি ,
খড়গপুর।
১৯৯০
এ পাঠান তৈরি করলেন পাথরা
আরকিওলজিকাল প্রিজারভেশন
কমিটি। পাথরা পুরাতত্ত্ব
সংরক্ষণ সমিতি। এটি একটি
এন.জি.ও।
সদস্য হিন্দু মুসলমান এবং
আদিবাসী নির্বিশেষে সারা
গাঁয়ের মানুষ। উদ্দেশ্য মন্দির
রক্ষনাবেক্ষনের প্রয়াস অব্যাহত
রাখা। তবে বাস্তবে মন্দির
ছাপিয়ে এই সংগঠন হয়ে উঠল হিন্দু
মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের
এবং আদিবাসীদের এতদিন পাশে
থেকেও পরস্পরকে না চেনার
পাপস্খালনের মঞ্চ। বন্ধুত্ব
আর বিশ্বাসের মঞ্চ। কত আর বেতন
পেতেন পাঠান !
হাই স্কুলে
সামান্য পিওনের চাকরি। তবু
অদম্য উৎসাহে পকেটের কড়ি্
খরচা করে কোলকাতা দিল্লী
করেছেন। সরকারী অফিসে দফতরে
দরবার করেছেন। লিফলেট ছাপিয়েছেন।
পুস্তিকা ছাপিয়েছেন। পাথরার
মন্দির নিয়ে গবেষণামূলক বই
অব্দি লিখেছেন,
ছেপেছেন।আদিতে
১০০ পাতার গ্রন্থ এখন ৩৫০
পাতার সংকলন। অবিভক্ত মেদিনীপুরের
১০৬১ টি মন্দির,
মসজিদ,
গির্জা,
কেল্লা
বা প্রাসাদের কথা লিপিবদ্ধ
করেছেন। নিঃস্ব হয়ে। কপর্দকশূন্য
হয়ে।
প্ল্যানিং
কমিশনের ডেপুটি চেয়ার পারসন
তখন প্রনব মুখোপাধ্যায়। যিনি
এখন রাষ্ট্রপতি। সে ১৯৯৮ সালের
কথা। প্রথম সরকারী অনুদান এল
বিশ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর
২০০৩ এ এ.এস.আই
অধিগ্রহণ করলেন মন্দিরগুলি।
এ এস আই সাড়ে চার কোটি অর্থ
মঞ্জুর করেছেন পাথরা পুরাকীর্তির
তত্ত্বাবধানে।
২৮
টি মন্দির পুনর্নিমান করা
হয়েছে। অনন্য টেরাকোটার কাজ
ও বাংলা ঘরানার গঠনশৈলী সম্পন্ন
মন্দিরগুলি ,
যাতে ইসলামি
স্থাপত্যেরও ছোঁয়া,
এখন শুধু
পাথরা নয় সারা দেশের গর্ব।
পাঠান
ভারত সরকারের কাছ থেকে কবীর
পুরষ্কার পেয়েছেন। সাম্প্রদায়িক
সম্পসেতির প্রতীক পাঠান তার
থেকেও বড় যে পুরষ্কার যা পেয়েছেন
তা মানুষের ভালোবাসা।
আসুন
আমরা ভালবাসায় স্নাত হই।
পবিত্র হই।
প্রসঙ্গত
আর একটা কথা মনে পড়ল। ফেসবুকেই
কেউ জানিয়েছিলেন খবরটি। শেয়ার
করেছিলাম। কুমিল্লার এক গ্রামে
প্রাচীন এক শিবমন্দির সংস্কারের
তাগিদে মন্দির সংলগ্ন প্রাচীন
বটগাছটি বিক্রির জন্য কাগজে
বিজ্ঞাপন দেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।
এক প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলমান
বাঙালী বিজ্ঞাপনটি দেখামাত্র
লক্ষাধিক টাকায় কিনে নেন
গাছটি। তারপর সেই টাকাই দান
করেন মন্দির সংস্কারের জন্য।
গাছ বাঁচল। বাঁচল মন্দির।
বাঁচল ঐতিহ্য। পরম্পরা।
Sunday, 3 May 2015
আর একটি ছবি। নববর্ষ অনুষ্ঠানের
তিন পয়সার পালায় রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের জবানে একটি উক্তি ছিল--- কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। দর্শকের ইচ্ছায় নাটক। এখানে যে নাটকীয় সমাবেশ ঘটেছিল প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের আলো ছাড়াই আমরা অভিভূত। আপ্লুত। এখানে সবাই ছিলেন বিশিষ্ট জন। দর্শক ও শ্রোতার আসনে সেই রকম বিশিষ্ট কয়েকজনের ছবি। একদম সামনের সারিতে ডান দিকের জন শ্রদ্ধেয় প্যারিচাঁঁদ মিত্রের উত্তরপুরুষ পূর্ণব্রত মিত্র। বাঁ দিকের জন বাপী। বাপী অসাধারণ গান গেয়েছিল নানা ঘরানার। ডান দিকের শেষ প্রান্তে কনুইয়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছেন কবি ছড়াকার অলোক সেনগুপ্ত। দেখতে পাচ্ছি গোলাম মর্তুজাকেও। রিজিয়া শেষের সারিতে বসে আছেন। বাকি সকলের নাম এই প্রতিবেদকের জানা নেই বা মনে আসছে না। পাঠক পরিচিত কাউকে পেয়ে যেতেই পারেন। বন্ধু , তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও। আমাদের পরস্পরকে চেনা জানার এও এক শুরু।
১লা বৈশাখ ১৪২২ এর অনুষ্ঠানের কিছু ছবি পাঠকদের জন্য। প্রথম ছবিতে এ.এম. মুর্শিদ আর সুভাষ দাস। দ্বিতীয় ছবিতে আকাশ । তৃতীয়তে ভাষ্য পাঠে আনিসুল করিম, তবলায় কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়। চারে গানে রিজিয়া করিম, তবলায় কৌস্তভ। পাঁচে কৌস্তভ, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, আর তবু বাংলার মুখের আঠারো বছরের দুঃসহ স্পর্ধার অর্ণব বসু
Saturday, 2 May 2015
বাংলা নববর্ষ আবাহন উৎসব - আমাদের যাত্রা হল শুরু
বাংলা নববর্ষ আবাহন উৎসব
১৪ ই এপ্রিল ২০১৫ , ৩০ শে চৈত্র ১৪২১ কোলকাতার উপকণ্ঠে বিপুল উদ্দীপনায় পালিত হল বাংলা নববর্ষের আবাহন। স্থান বাংলা সাহিত্যে 'আলালের ঘরের দুলাল' খ্যাত প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেক চাঁদ ঠাকুরের মঠবাড়ি। বেলঘরিয়া। উদ্যোগে সামিল হয়েছিলেন 'তবু বাংলার মুখ', 'জনপদ', 'কথাসাময়িকী'র মত সাহিত্যপত্র আর মুর্শিদ এ.এম এর 'স্বর' নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসেছিলেন সহমর্মী মানুষজন।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সকাল ১১ টায়। প্রথমেই প্যারীচাঁদের উত্তরপুরুষ অনুষ্ঠানের অন্যতম হোতা পূর্ণব্রত স্বাগত জানালেন সবাইকে। পূর্ণব্রত আশা প্রকাশ করেন এই সমাবেশে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালীর মিলনের যে সুর বাঁধবার সূত্রপাত হতে চলেছে তা অব্যাহত থাকবে। তবু বাংলার মুখের পক্ষ থেকে অসিত বরণ রায় ওপার বাংলার দৃষ্টান্তে এ বাংলাতেও অখণ্ড বাঙালী জাতীয়তার অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসাবে ১লা বৈশাখ পালনের প্রয়োজন ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। সুভাষ দাস এই উপলক্ষে রচিত প্রচারপত্রটি পাঠ করে শোনান। পার্থ বসু বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারে ডা মেঘনাদ সাহার প্রস্তাবের আলোয় বাংলা সন দু বাংলায় দু খাতে বয়ে যাওয়ার কারণ গুলি সংক্ষেপে তুলে ধরেন। কবি শামসুল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-- এক বাঙালী , দুই দেশ। এ বাংলাতেও ১৪ ই এপ্রিল ১ লা বৈশাখ হিসাবে গণ্য করার পক্ষে সওয়াল করেন তিনি।
উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলেন মোহব্বত হোসেন। এরপর কথায় কথায় ও গানে গানে ভরে উঠল সারাদিনের সভা। কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী ও কবি রামচন্দ্র পাল। ছড়া পাঠ করেছেন ছড়াকার অলোক সেনগুপ্ত। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছেন পার্থ বসু।
গানে মোহিত করেছেন , উদ্দীপ্ত করেছেন সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বাপী। গীটারে আকাশ। তবলায় কৌস্তভ। বাপী গান শোনালেন দু পর্বে । প্রথম পর্বে কবীর সুমন এবং বাংলা ব্যান্ড ঘরানার গান। জারী , গম্ভীরা, আর বাংলার লোকগীতি আনিসুল করিমের ভাষ্য সহ পরিবেশন করলেন শ্রীমতী রিজিয়া করিম। প্রসাদ দাশগুপ্ত সাঁওতালী ভাষায় , পাশাপাশি বাংলা ভাষায়, গান গেয়ে এই জনজাতির ভাষার কাছে বাংলা ভাষার ঋণের প্রসঙ্গ আলোচনা করেন। বাংলা ভাষার পুষ্টি ও বিকাশের স্বার্থে অখণ্ড বাঙালী জাতীয়তার এই উপাদান গুলিকে চেনা ও বোঝার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বীরভূমে সাঁওতালী ভাষার গানের আর এক গবেষক আয়েষা খাতুন। তাঁর কথায় কেয়াফুল কাঁটার জঙ্গলে ফোটে। আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তার গন্ধ আমাদের টেনে নিয়ে যায়। আয়েষা জানালেন সাঁওতালী সংস্কৃতির ব্যাপ্তি পাহাড় থেকে সাগরে। শিখর থেকে মোহনায়।
শ্রুতিনাটক পরিবেশন করলেন সুমিতা চক্রবর্তী ও দেবাশিস।
সকালে চা আর দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি ছিল।
কথা বলেছেন, আলোচনায় অংশ নিয়েছেন অনেকেই। উদ্যোক্তারা বহুস্বরে কান পেতেছেন। বহু মতে। এসেছিলেন মধুরা থেকে আবু বকর সিদ্দিকী। শোনালেন বীরভূমে ১৪০০ বঙ্গাব্দ উদযাপনের সফল উপাখ্যান। দূরদর্শনের সেই শুরুর যুগে হিন্দির দাপট আর বাংলার উপেক্ষার প্রতিবাদে তাদের নজরকাড়া আন্দোলনের কথা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ স্মরণ দিবস পালনের কথা । তারা শুরু করলেন। পরে রাজনীতি মঞ্চে এল কি ভাবে সে সব কথাও। খুলি , নিউ টাউনের মাদ্রাসা শিক্ষক শাহজাহান আলী সন্ত্রাস আর ইসলামকে এক সাথে গুলিয়ে ফেলার সাম্প্রতিক প্রবণতায় উদ্বেগ জানান। প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক মুস্তাক আহমেদ স্মৃতি থেকে কবি রামচন্দ্র পালের কবিতা আবৃত্তি করলেন। রামচন্দ্র শুনিয়েছিলেন নিজের লেখা দুটি আর পার্থ বসুর একটি রচনা। মুস্তাক সরস ভঙ্গীতে জানালেন একই উৎসের দুটি শব্দ জল আর পানি একটি হিন্দুর আর অন্যটি মুসলমানের হয় কি করে কে জানে ? আবার দুটো ভিন্ন ভাষার শব্দ মিন্নত আর বিজ্ঞপ্তি মিলে মিশে মিনতি হতে যেখানে বাধছে না দুটো মানুষ যারা আপাতভাবে ধর্মে আলাদা কিন্তু ভাষায় এক কেন মিলতে পারবে না ?
স্ফুলিঙ্গের মইনুল ইসলাম আর কথাসাময়িকীর সমীরণ মজুমদার বাঙালী জাতীয়তার প্রশ্নে বামপন্থী নেতাদের মূল্যায়নের বিচ্যুতি নিয়ে আবেগময় কিন্তু নির্মোহ বিশ্লেষণ রাখেন।
গর্গ চ্যাটারজি যা বলেছেন তার ভাষায় তুলে দিচ্ছি --
কাল ভোর-বেলা নতুন বছরের শুরু। আজকে বর্ষবরণের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম - মূলত উদ্যোক্তা 'তবু বাংলার মুখ' পত্রিকা ও পাঠকচক্র। সভা হলো প্যারীচাঁদ মিত্রের (ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর) বাগান-বাড়িতে, বেলঘরিয়া থানার কাছে - তার উত্তরসুরী পূর্ণব্রত মিত্র উপস্থিত ছিলেন অন্যতম হোতা হিসেবে। হলো আলোচনা ও গান - যার মধ্যে অনেকগুলি শিল্পীদের স্বরচিত। আলোচনা, গান ও আবৃত্তি, তিনেরই মূল বিষয় ছিল বাংলার সংস্কৃতি ও জনজীবনের উপর, ভাষাগত অধিকারের উপর পশ্চিম (মহাপশ্চিম না, এই বাংলার প্রভু যে পশ্চিম , সেটা) যে আধিপত্য কায়েম করেছে, হিন্দি-ইংরেজি-বাজার-অর্থের মাধ্যমে ও একশ্রেনীর শহুরে বঙ্গসন্তানের এলিয়েনেশনের সুযোগ নিয়ে। বললাম আমি, বললেন আরো অনেকে। আমি আশার কথা বললাম, যেখানগুলি এখন গ্রাস হয়নি, তাদের স্বাভাবিক যাপনের মধ্যে যে দ্রোহ আছে, তার থেকে শিক্ষার কথা বললাম। আরো অনেকে বললেন। কাল পয়েলা বৈশাখ। এই বাংলায়েও তো সেটাই সবচেয়ে বড় উত্সব হবার কথা ছিল। বদলে, আজকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহর কলকাতায় সবচেয়ে বেশি করে আওয়াজ শোনা গেল অন্য এক 'উত্সব'এর - 'ইন্ডিয়া কা তেওহার' অর্থাৎ আইপিএল । যারা এখনো ইন্ডিয়ান ওশান-এ চান করে উন্নত হননি, তাদেরই জমায়েত হয়েছিল আজ প্যারীচাঁদ মিত্রের বাড়িতে। বাড়ির চারপাশে অনেক গাছে কাঁচা আম আর জলে ব্যাং-এর দেখা পেলাম। আসছে বার আশা করি, এই মহতী সভা কলেবরে আরো বাড়বে, আরো ইন্ডিয়ান ওশান-এ চান না করা মানুষ আসবেন। ভিড় বাড়লে হয়ত একদিন আমরা বঙ্গোপসাগরে স্নান করতে যাব। সেদিনের স্বপ্ন নিয়েই, সেই নতুন মানুষ তৈরীর, নিজেদের তৈরীর স্বপ্ন নিয়েই অপেক্ষায় আছি বৈশাখের। সকলের জীবন সুন্দর হোক। আগামীর মানুষ এক মহাসুন্দর বাংলা পাক উত্তরাধিকার সূত্রে।
আগামী বছরের উৎসব মধুরায়। দাওয়াত দিলেন সিদ্দিকী সাহেব। সভা শেষ হয়েও শেষ হল না।
Subscribe to:
Posts (Atom)