Saturday 2 May 2015

বাংলা নববর্ষ আবাহন উৎসব - আমাদের যাত্রা হল শুরু






বাংলা নববর্ষ আবাহন উৎসব



১৪ ই এপ্রিল ২০১৫ , ৩০ শে চৈত্র ১৪২১ কোলকাতার উপকণ্ঠে বিপুল উদ্দীপনায় পালিত হল বাংলা নববর্ষের আবাহন। স্থান বাংলা সাহিত্যে 'আলালের ঘরের দুলাল' খ্যাত প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেক চাঁদ ঠাকুরের মঠবাড়ি। বেলঘরিয়া। উদ্যোগে সামিল হয়েছিলেন 'তবু বাংলার মুখ', 'জনপদ', 'কথাসাময়িকী'র মত সাহিত্যপত্র আর মুর্শিদ এ.এম এর 'স্বর' নামের সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসেছিলেন সহমর্মী মানুষজন।  

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সকাল ১১ টায়। প্রথমেই প্যারীচাঁদের উত্তরপুরুষ অনুষ্ঠানের অন্যতম হোতা পূর্ণব্রত  স্বাগত জানালেন সবাইকে। পূর্ণব্রত আশা প্রকাশ করেন এই সমাবেশে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালীর মিলনের যে সুর বাঁধবার সূত্রপাত হতে চলেছে তা অব্যাহত থাকবে। তবু বাংলার মুখের পক্ষ থেকে অসিত বরণ রায় ওপার বাংলার দৃষ্টান্তে এ বাংলাতেও অখণ্ড বাঙালী জাতীয়তার অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসাবে ১লা বৈশাখ পালনের প্রয়োজন ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। সুভাষ দাস এই উপলক্ষে রচিত প্রচারপত্রটি পাঠ করে শোনান। পার্থ বসু বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারে ডা মেঘনাদ সাহার প্রস্তাবের আলোয় বাংলা সন দু বাংলায় দু খাতে বয়ে যাওয়ার কারণ গুলি সংক্ষেপে তুলে ধরেন। কবি শামসুল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন-- এক বাঙালী , দুই দেশ। এ বাংলাতেও ১৪ ই এপ্রিল ১ লা বৈশাখ হিসাবে গণ্য করার পক্ষে সওয়াল করেন তিনি।   

উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলেন মোহব্বত হোসেন। এরপর কথায় কথায় ও গানে গানে ভরে উঠল সারাদিনের সভা। কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী ও কবি রামচন্দ্র পাল। ছড়া পাঠ করেছেন ছড়াকার অলোক সেনগুপ্ত। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছেন পার্থ বসু।

গানে মোহিত করেছেন , উদ্দীপ্ত করেছেন সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বাপী। গীটারে আকাশ। তবলায় কৌস্তভ। বাপী গান শোনালেন দু পর্বে । প্রথম পর্বে কবীর সুমন এবং বাংলা ব্যান্ড ঘরানার গান। জারী , গম্ভীরা, আর বাংলার লোকগীতি আনিসুল করিমের ভাষ্য সহ পরিবেশন করলেন শ্রীমতী রিজিয়া করিম। প্রসাদ দাশগুপ্ত সাঁওতালী ভাষায় , পাশাপাশি বাংলা ভাষায়, গান গেয়ে এই জনজাতির ভাষার কাছে বাংলা ভাষার ঋণের প্রসঙ্গ আলোচনা করেন। বাংলা ভাষার পুষ্টি ও বিকাশের স্বার্থে অখণ্ড বাঙালী জাতীয়তার এই উপাদান গুলিকে চেনা ও বোঝার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বীরভূমে সাঁওতালী ভাষার গানের আর এক গবেষক আয়েষা খাতুন। তাঁর কথায় কেয়াফুল কাঁটার জঙ্গলে ফোটে। আমরা জানতে পারি না। কিন্তু তার গন্ধ আমাদের টেনে নিয়ে যায়। আয়েষা জানালেন সাঁওতালী সংস্কৃতির ব্যাপ্তি পাহাড় থেকে সাগরে। শিখর থেকে মোহনায়।

শ্রুতিনাটক পরিবেশন করলেন সুমিতা চক্রবর্তী ও দেবাশিস।

সকালে চা আর দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি ছিল।

কথা বলেছেন, আলোচনায় অংশ নিয়েছেন অনেকেই। উদ্যোক্তারা বহুস্বরে কান পেতেছেন। বহু মতে। এসেছিলেন মধুরা থেকে আবু বকর সিদ্দিকী। শোনালেন বীরভূমে ১৪০০ বঙ্গাব্দ উদযাপনের সফল উপাখ্যান। দূরদর্শনের সেই শুরুর যুগে হিন্দির দাপট আর বাংলার উপেক্ষার প্রতিবাদে তাদের নজরকাড়া আন্দোলনের কথা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ স্মরণ দিবস পালনের কথা । তারা শুরু করলেন। পরে রাজনীতি মঞ্চে এল কি ভাবে সে সব কথাও। খুলি , নিউ টাউনের মাদ্রাসা শিক্ষক শাহজাহান আলী সন্ত্রাস আর ইসলামকে এক সাথে গুলিয়ে ফেলার সাম্প্রতিক প্রবণতায় উদ্বেগ জানান। প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক মুস্তাক আহমেদ স্মৃতি থেকে কবি রামচন্দ্র পালের কবিতা আবৃত্তি করলেন। রামচন্দ্র শুনিয়েছিলেন নিজের লেখা দুটি আর পার্থ বসুর একটি রচনা। মুস্তাক সরস ভঙ্গীতে জানালেন একই উৎসের দুটি শব্দ জল আর পানি একটি হিন্দুর আর অন্যটি মুসলমানের হয় কি করে কে জানে ? আবার দুটো ভিন্ন ভাষার শব্দ মিন্নত আর বিজ্ঞপ্তি মিলে মিশে মিনতি হতে যেখানে বাধছে না দুটো মানুষ যারা আপাতভাবে ধর্মে আলাদা কিন্তু ভাষায় এক কেন মিলতে পারবে না ? 

স্ফুলিঙ্গের মইনুল ইসলাম আর কথাসাময়িকীর সমীরণ মজুমদার বাঙালী জাতীয়তার প্রশ্নে বামপন্থী নেতাদের মূল্যায়নের বিচ্যুতি নিয়ে আবেগময় কিন্তু নির্মোহ বিশ্লেষণ রাখেন। 

গর্গ চ্যাটারজি যা বলেছেন তার ভাষায় তুলে দিচ্ছি --

কাল ভোর-বেলা নতুন বছরের শুরু। আজকে বর্ষবরণের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম - মূলত উদ্যোক্তা 'তবু বাংলার মুখ' পত্রিকা ও পাঠকচক্র। সভা হলো প্যারীচাঁদ মিত্রের (ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর) বাগান-বাড়িতে, বেলঘরিয়া থানার কাছে - তার উত্তরসুরী পূর্ণব্রত মিত্র উপস্থিত ছিলেন অন্যতম হোতা হিসেবে। হলো আলোচনা ও গান - যার মধ্যে অনেকগুলি শিল্পীদের স্বরচিত। আলোচনা, গান ও আবৃত্তি, তিনেরই মূল বিষয় ছিল বাংলার সংস্কৃতি ও জনজীবনের উপর, ভাষাগত অধিকারের উপর পশ্চিম (মহাপশ্চিম না, এই বাংলার প্রভু যে পশ্চিম , সেটা) যে আধিপত্য কায়েম করেছে, হিন্দি-ইংরেজি-বাজার-অর্থের মাধ্যমে ও একশ্রেনীর শহুরে বঙ্গসন্তানের এলিয়েনেশনের সুযোগ নিয়ে। বললাম আমি, বললেন আরো অনেকে। আমি আশার কথা বললাম, যেখানগুলি এখন গ্রাস হয়নি, তাদের স্বাভাবিক যাপনের মধ্যে যে দ্রোহ আছে, তার থেকে শিক্ষার কথা বললাম। আরো অনেকে বললেন। কাল পয়েলা বৈশাখ। এই বাংলায়েও তো সেটাই সবচেয়ে বড় উত্সব হবার কথা ছিল। বদলে, আজকে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহর কলকাতায় সবচেয়ে বেশি করে আওয়াজ শোনা গেল অন্য এক 'উত্সব'এর - 'ইন্ডিয়া কা তেওহার' অর্থাৎ আইপিএল । যারা এখনো ইন্ডিয়ান ওশান-এ চান করে উন্নত হননি, তাদেরই জমায়েত হয়েছিল আজ প্যারীচাঁদ মিত্রের বাড়িতে। বাড়ির চারপাশে অনেক গাছে কাঁচা আম আর জলে ব্যাং-এর দেখা পেলাম। আসছে বার আশা করি, এই মহতী সভা কলেবরে আরো বাড়বে, আরো ইন্ডিয়ান ওশান-এ চান না করা মানুষ আসবেন। ভিড় বাড়লে হয়ত একদিন আমরা বঙ্গোপসাগরে স্নান করতে যাব। সেদিনের স্বপ্ন নিয়েই, সেই নতুন মানুষ তৈরীর, নিজেদের তৈরীর স্বপ্ন নিয়েই অপেক্ষায় আছি বৈশাখের। সকলের জীবন সুন্দর হোক। আগামীর মানুষ এক মহাসুন্দর বাংলা পাক উত্তরাধিকার সূত্রে।  

আগামী বছরের উৎসব মধুরায়। দাওয়াত দিলেন সিদ্দিকী সাহেব। সভা শেষ হয়েও শেষ হল না। 




No comments:

Post a Comment