পুরনো
সেই দিনের কথা /
পার্থ বসু
মাও
সে তুং। সত্তর দশকে এই নামেই
চিনতাম। পরে কখন হয়ে গেলেন
মাও জে দং। যেমন পিকিং হয়ে গেল
বেজিং। বাঙালীর মা প্রীতি
চিরকালীন। বাঙালীর মাও প্রীতি
একটি কালখণ্ডকে প্লাবিত
করেছিল। আমার মনে পুরনো নামটাই
গেঁথে আছে।
বিজ্ঞানের
ছাত্র। তখন ডায়ালেক্টিক্স
পড়ছি। স্তালিন পড়ছি। বিজ্ঞানের
সুত্র ধরে ধরে কি অদ্ভুত
বোঝাচ্ছেন স্তালিন। এমন সময়
মাওয়ের একটি লেখায় চোখ আটকে
গেল-- বিপ্লব
হবে কি হবে না ডায়ালেক্টিক্স
দিয়েই বুঝতে হবে। যাকে বলে
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। একটি
পাথর আর একটি ডিম দিয়ে বোঝালেন।
ডিমে বাচ্চা হওয়া আর না হওয়ার
দ্বন্দ বিদ্যমান। বাহ্যিক
যে শর্তে তা ত্বরান্বিত হয়
সেটি হল ডিমে তা দেওয়া। পাথরে
কিন্তু হাজার তা দিলেও বাচ্চা
হবার নয়।
এই
যে কঠিন কথাও সহজে বলার লোকআঙ্গিক এর তুলনা কবি কথক শ্রী
শ্রী রামকৃষ্ণ। মাওয়ের কথাও
শুধু কথা নয় ,
কথামৃত।
ভাল
ছাত্র হিসাবে একটি পরিচিতি
ছিল আমার। কিন্তু কংগ্রেসি
বাড়ির ছেলে। নেতা কেউ নন ,
বাবা কাকারা
কংগ্রেসকে ভোট দিতেন এই যা।
অথচ বামপন্থা তখন যুগের হাওয়া।
আর তখন পড়তে হত। এত দৃশ্যমাধ্যম
ছিল না। দাস ক্যাপিটাল না হোক
ম্যানিফেস্টো না পড়ে কম্যুনিস্ট
হবার কথা ভাবাই যেত না। দাস
ক্যাপিটাল পড়ি নি তাতে কি,
সিরিয়াল
হোক দেখে নেব ঠিকই এই বিশ্বাসে
চাঁদা দিয়ে পার্টি মেম্বার
হওয়ারও চল ছিল না। আমি তো একটা
লিফলেট পড়েও মানে বুঝতে ঘেমে
যেতাম। এত পরিভাষা !
তো শুরু
করলাম তাত্ত্বিক পড়াশুনা।একসময়
হাতে এল মাও সে তুং এর নির্বাচিত
রচনাসমগ্র। অবাক হয়ে দেখলাম
পণ্ডিতি জাহির করার কোন ভান
অব্দি নেই। ১০ পাতার একটি
প্রবন্ধ লিখলে মাও প্রায় ৭
পাতা জুড়ে তাঁর দেশবাসীকে
মনে করাচ্ছেন--
চিন একটি
মহান দেশ। চিনারা একটি মহান
জাতি। লিখছেন চিনের হাজার
হাজার বছরের সংস্কৃতির কথা।
চিন কবে কাগজ আবিস্কার করেছিল,
কবে কত বছর
ধরে প্রাচীর গড়ল--
আরও যা যা
– এগুলি করেছেন কে?
রাজা ?
মাও
প্রশ্নটিকেই বদলে দিলেন। কে
নয় , কারা
? তাঁর
জবাব-- চিনের
মানুষ , সাধারণ
মানুষের শ্রম ও মেধায় নির্মাণ
করেছেন সব কিছু।
জাতীয়তার
এই আবেগেই জন্ম নিয়েছিল চাইনিজ
কমিউনিস্ট পার্টি ,
সংক্ষেপে
সি পি সি। কমিউনিস্ট পার্টি
অফ চায়না নয় । চিনের কমিউনিস্ট
পার্টি নয়। চিনা কমিউনিস্ট
পার্টি। এ দেশে ভারতের কমিউনিস্ট
পার্টি পেয়েছি। ভারতীয় কমিউনিস্ট
পার্টি না থাকায় জাতীয়তাবাদ
ব্যাপারটিই ঠিকমত বিকাশ পেল
না। যে জাতীয়তায় সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী আমজনতার আত্মিক প্রতিফলন
থাকত। ক্ষমতালোভীরা লুঠে নিল
জাতীয়তার শ্লোগান।
নর্মান
বেথুন এসেছেন দেখা করতে।
মাওয়ের সঙ্গে। মাও সরকারী
ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তিনি তো
মেন্টর। মাওয়ের বাসায় পৌঁছে
প্রথমে বাগানের মালীকে বললেন
তিনি এসেছেন মাওকে এই খবরটুকু
পৌঁছে দিতে। মালী হাতের খুপরি
রেখে ভিতরে গেল। যাওয়ার পথে
বেথুনকে বসতে বলে গেল। মালী
, মানে
মাও সে তুং ,
একটু পরেই
হাত পা ধুয়ে ফিরে এলেন। শুরু
হল কথাবার্তা। বেথুন জানতে
চেয়েছিলেন মাও কি জাতীয়তাবাদী
? মাওয়ের
তাৎক্ষনিক উত্তর--
নিশ্চয়।
তারপর ব্যাখ্যা -
আমার জাতীয়তা
গুণগত ভাবে হিটলারের জাতীয়তা
থেকে পৃথক। আমার জাতীয়তা
আন্তর্জাতিকতার একটি একক।
প্রখ্যাত
দার্শনিক রমা রঁলা শুধু ভারত
বিষয়ে একটি দিনলিপি রাখতেন।
নাম ইন্দে। তার পাতা থেকে আর
একটি গল্প পড়ে নেওয়া যাক।
রঁলা
এসেছেন সবরমতী। গান্ধী সকাশে।
মন তোলপাড়। কিছুদিন আগেই ইতালি
সফর করে ফিরেছেন গান্ধী।
হিটলারের সঙ্গী মুসোলিনির
ইতালি। রাশিয়াও ডেকেছিল।
গান্ধী যান নি। তাঁর বিবেক
সাড়া দেয় নি। রাশিয়ায় সহিংস
বিপ্লব হয়েছে । তিনি তো অহিংসার
পূজারী। রবীন্দ্রনাথও গেছিলেন
ইতালী। কবি মানুষ। মুসোলিনির
আপ্যায়নে প্রীত কবি উদার কিছু
প্রশংসাও করে এসেছিলেন। তিনি
অবশ্য রাশিয়াও গেছেন। তাঁর
রাশিয়ার চিঠি এখন একটি মানবিক
দলিল। রঁলা লিখেছিলেন কবিকে--
আপনি বিশ্ব
কবি। আপনার প্রতিটি কথায় কান
পেতে আছি আমরা। মুসোলিনিকে
নিয়ে আপনার মন্তব্য আহত করেছে
আমাদের। কবি নির্দ্বিধায়
প্রত্যাহার করেন তাঁর প্রশংসা।
এবার গান্ধীর কাছে এসেছেন ,
তাঁর স্বমুখে
শুনবেন একটি রাজ পরিবারের শত
শতাব্দীর হিংসা ও শোষণ যখন
পাল্টা বিপ্লবী হিংসায় উৎখাত
হয় তা তিনি সমর্থনে নাচার,
কিন্তু
মুসোলিনির হিংসা তাঁর অনুমোদন
পায় কি করে ?
গান্ধী
তখন মৌনীব্রত পালন করছেন।
রঁলা উত্তর না পেয়ে ফিরে
গেছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে
তাঁর দেখা হল নেতাজীর সাথে।
সে অভিজ্ঞতাও তিনি লিখে
রেখেছিলেন।--
সুভাষের
সঙ্গে দেখা হল। কথা হল। মনে
হল ভারতীয় যুবমানসের অনেক
কাছের মানুষ। এবার ভারতের
কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে বলছেন
– সুভাষকে নিয়ে এদের অবস্থান
আর মূল্যায়ন ভুল। চিনে
সান-ইয়াত-সেন
কে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি
বুঝতে ভুল করে নি। সুভাষকে
সাথে নিয়ে এরা সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধী লড়াই তীব্র করে তুলতে
পারে। সুভাষ এ দেশের সান ইয়াত
সেন।
সত্তর
দশকের আর একটি অভিজ্ঞতা। তখন
বোম্বাই শহরে । ওখানে মেট্রো
সিনেমায় সিনেমা দেখতে গেছি।
ছবি মৃণাল সেনের ভুবন সোম।
যারা ছবিটি দেখেছেন মনে করুন
শুরুর দৃশ্য। বিচিত্র বঙ্গাল
, সোনার
বঙ্গাল এইসব ধারাভাষ্যের
সঙ্গে জাতীয় নেতাদের ছবি ,
মিছিলের
ছবি--পর্দায়
সহসা ভেসে উঠলেন নেতাজী। সমস্ত
হল গর্জে উঠল--
নেতাজী
জিন্দাবাদ !
বোম্বাইয়ের
মত একটি বানিজ্যিক শহর নেতাজীকে
নিয়ে এত আবেগ পোষণ করেন দেখে
আনন্দ পেয়েছিলাম। আশ্চর্য
হয়েছিলাম বলা বাহুল্য। এমন
নয় নেতাজী ভক্তরা দল বেঁধে
সিনেমা দেখতে গেছেন। সংঘবদ্ধ
ধ্বনি দিয়েছেন। বোম্বাই এমনিই
সবসময় ধাবমান একটি শহর। সেই
তারা----- ! এ
আবেগ ছিল স্বতস্ফুর্ত। আন্তরিক।
খাঁটি।
আবার
সত্তর দশকে আসি। অন্য প্রসঙ্গে।
এ বাংলায় আওয়াজ উঠেছিল চিনের
চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।
স্লোগানটি মানুষ গ্রহণ করেন
নি। কিন্তু এক হাতে যে তীব্র
নির্মমতায় এশিয়ার মুক্তিসুর্য
নকশাল নিধন করলেন ,
অন্য হাতে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
বরাভয় আমি আজ অকপটে কবুল করি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কতটা
ভারত প্রযোজিত ,
ভারতীয়
স্বার্থ প্রযোজিত সংশয়ী ছিলাম।
পরে বুঝেছি মুজিব কিন্তু সুভাষ
যেমন হিটলারের সমর্থন চেয়েছিলেন
নিজত্ব না হারিয়ে মুজিবও
তেমনি। বাংলাদেশ ৩০ লক্ষ
প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা
অর্জন করেছে। ভারত পাশে না
দাঁড়ালে এ লড়াই দীর্ঘতর হত
সন্দেহ নেই। বাংলাদেশী বন্ধুদের
বলি ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস
করবে না কখনোই। কারণ সে ক্ষেত্রে
ভারতীয় রাজনীতির নিয়ন্তার
ভূমিকা উত্তর ভারতীয় হিন্দিবাদের
হাত থেকে ছিটকে যাবে।
শেষে
শিলচরের একটি ঘটনা বলি।
করিমগঞ্জেরও। কোন একটি সংকলনে
করিমগঞ্জের জন্মজিত রায়ের
একটি লেখার নির্বাচন নিয়ে
আপত্তি তুলেছেন বামপন্থী
শিবির। স্পষ্ট করে বলি আপত্তি
সি পি এমের। শিলচরে কমিউনিস্টরা
তখনও, বা
এখনও, ব্যালটের
জোয়ারে ক্ষমতায় এসে নষ্ট হয়ে
যান নি। আদর্শের চর্চায় তারা
তখনও, বা
এখনও, অধ্যবসায়ী।
জন্মজিত জ্ঞানী মানুষ।
প্রজ্ঞাবান। তিনি যে বিষয়ে
লিখবেন তাতে তাঁর যোগ্যতা
প্রশ্নাতীত। কিন্তু জন্মজিত
বি.জে.পি
র লোক। করিমগঞ্জে থাকতেন
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এশিয়ার
অহংকার শ্রদ্ধেয় সুজিত চৌধুরী
মহাশয়। তাঁর স্নেহ আর প্রশ্রয়
পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
সাহিত্যে কবিতা পড়ে ফোন করে
ভাল লাগা জানিয়েছেন। পাঠক
ক্ষমা করবেন এই আনন্দে ঈষৎ
আত্মপ্রচার রয়ে গেল হয়তো। তা
শক্তিদা, শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী,
আমায় পাঠালেন
সুজিতদার কাছে। সেই প্রথম
আমার সুজিতদার কাছে যাওয়া।
শক্তিদাও চাইছেন জন্মজিতের
লেখাটি থাকুক। সুজিতদার
নির্দেশ পেলে তা অমান্য করার
সাহস হবে না কারও। সুজিতদা
কথায় কথায় জানিয়েছিলেন তিনি
কংগ্রেসি ঘরানার লোক। কিন্তু
ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক
বিশ্লেষণে মার্ক্সবাদেই
আস্থা রাখেন। বরাক উপত্যকা
ম্লান হয়ে গেছে তাঁর প্রয়াণে।
মহার্ঘ্য । সমৃদ্ধ হলাম ।
ReplyDelete