Monday 4 May 2015

ইয়াসিন পাঠানের গল্প শুনুন। ইরফান নয়, ইয়াসিন। ইরফান ক্রিকেটের। সবাই প্রায় এক ডাকেই চিনি বা চেনেন। ইয়াসিন ?

পাঠান ডাক পাঠালেন মৈত্রীর / পার্থ বসু
কাগজে পাকিস্তানে হোলি উৎসবে হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে ছাত্ররা মানববন্ধন করেছেন এই খবরে মন ভালো হয়ে গেল। এর আগে বালুচ প্রদেশে একটি বিষ্ণু মন্দিরের ছবি পেয়েছিলাম। পাকিস্তানের দুই মহিলা চিত্র সাংবাদিক ছবি গুলি তুলেছিলেন। মন্দিরের পরিচয় লিপি আরবী হরফে মন্দিরগাত্রে প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ। ওঁ শব্দটি শুধু দেবনাগরীতে লেখা। গ্রামটি আজও হিন্দু প্রধান। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মুসলিম পুরুষ ও রমণীরা মন্দিরে জড় হয়েছেন। পুরোহিত জানাচ্ছেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ এই মন্দিরে আসেন। মানত করেন। দোয়া চান। পীরের দরগাতেও যেমন জাতপাতের বিচার হয় না।
পাঠান, ইয়াসিন পাঠানের গল্প বলি শুনুন। শুন শুন সর্বজন। এ বাংলায়। ও বাংলায়। এই পাঠান মেদিনীপুরের বাঙালী। থাকেন হাতিহোল্কা । মেদিনীপুর থেকে ১০ কি মি দূরে পাথরা। পাথরা থেকে আরও ২ কি মি উজিয়ে তাঁর গ্রাম। এখন প্রৌড়। স্থানীয় হাই স্কুলে পিওনের চাকরি করতেন। কিন্তু আকৈশোর একাই যাত্রা শুরু করে যা করেছেন জবাব নেই। নমস্য এই ব্যক্তির কথা সাধ্যমত নিবেদন করছি। তার আগে পাথরা গ্রামের কিছু কথায় প্রদীপের সলতে পাকাই।
বাংলা সন ১৭৩২। নবাব আলীবর্দি খাঁ রত্নচক পরগণায় তহশীলদার করে পাঠালেন এক ঘোষাল ব্রাহ্মণকে। বিদ্যানন্দ ঘোষাল।
পাথরায় গুপ্ত যুগ থেকেই হিন্দু জৈন আর বৌদ্ধরা বাস করে আসছেন। ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর নানা প্রত্নচিহ্ন আবিস্কার হয়েছে এই গ্রামে। ৯ম শতাব্দীর লোকেশ্বর বিষ্ণু মূর্তি তার একটি। বিদ্যানন্দ জমিদারি পেয়ে মন দিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠায়।
বেশী দিন অবশ্য নবাবের নেক নজরে থাকতে পারেন নি বিদ্যানন্দ। কপাল পুড়ল। কয়েদ হলেন। ব্রিটিশ আমলে মেদিনীপুরের আরেক রাজা নন্দকুমারের কথা মনে আসতে পারে। নবাব বিদ্যানন্দকে লটকে দিলেন ফাঁসীতে। বিচারপ্রহসন বা গল্পে যাচ্ছি না। বিদ্যানন্দের বিত্ত বৈভবে খামতি ছিল না। নীল চাষ আর রেশম সিল্ক রপ্তানি করে তাঁর উত্তর পুরুষ আরও সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। ইতিমধ্যে আরও মন্দির স্থাপন করেছেন তারা। কালক্রমে গ্রাম ছাড়লেন। মন্দিরের অবক্ষয় শুরু হল অনাদরে অবহেলায়।
প্রতিষ্ঠাতা পরিবার গ্রামে নেই। ভগ্ন মন্দিরের ইট পর্যন্ত চুরি হয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। না ছিল সরকারী নজরদারি, , না কোন বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ।
ঠিক এখান থেকেই ইয়াসিন পাঠানের গল্প।
বয়স তখন সতেরো। গ্রাম থেকে পাথরায় প্রায় ছুটে আসতেন ইয়াসিন। এইসব ভগ্ন মন্দির , জীর্ণ দীর্ণ দেবালয় কি এক অমোঘ আকর্ষণে টানত তাঁকে। এই সব অমুল্য ইতিহাসের নিদর্শন এভাবেই লুপ্ত হয়ে যাবে ? হিন্দুদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন। পাত্তা পেলেন না। তুমি বিধর্মী, এইসব মন্দির নিয়ে মাথা ঘামাও কেন? নিজের সম্প্রদায় থেকে পেলেন তীব্র বিরোধিতা। ওসব মূর্তিপূজা কাফেরদের ব্যাপার। ইসলামে এর অনুমোদন নেই। মোদ্দা কথা কি হিন্দু কি মুসলমান কারও কাছ থেকেই উৎসাহ বা সমর্থন জুটল না। তো বেশ। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে। ইয়াসিন হাল না ছেড়ে কাজে নাবলেন। ১৯৭১ এ শুরু হল তাঁর মন্দির বাঁচাও আন্দোলন।
বিদ্বজ্জনেরা এলেন। লোক সংস্কৃতির প্রখ্যাত গবেষক তারাপদ সাঁতরা, ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ন – এঁরা এসে পৌঁছলেন। তারাপদবাবু শেখালেন এই মন্দিরগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা। একশ বছর পার হলেই তা যে আমাদের অতীত নিদর্শন, আমাদের উত্তরাধিকার এই বোধের পুষ্টি দিলেন তাঁর মনে। শেখালেন ক্ষেত্রসমীক্ষার করণ কৌশল। চার দেওয়ালে বদ্ধ ঘরে একাডেমিক জ্ঞানচর্চায় কালক্ষেপ না করে তারাপদবাবু কত পাঠানকে যে গড়ে তুলেছেন। ২০১০ সালে ঢাকায় আজিজ মার্কেটে তাঁর 'হাওড়া জেলার গ্রামনাম' বইটি বিক্রি হতে দেখেছি। তারাপদবাবুর যা কিছু গবেষণা পশ্চিমবাংলার চতুঃসীমায়। তবু তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের আজকের প্রজন্মের এই আগ্রহ আমার যুগপৎ বিস্ময় ও শ্রদ্ধার কারণ এই ফাঁকে কবুল করছি।
আবার ইয়াসিনের কথায় আসি। এখানে ইয়াসিনের মুখে তাঁর অনুভবের কথা কিছুটা শুনে নেওয়া যাক--- “ ছেলেবেলা থেকেই এই মন্দিরগুলি, জমিদারী অট্টালিকা , এগুলির ভগ্নদশা আমাকে বিষণ্ণ করত আর করত বিস্ময় বিমুঢ়।বড় হতে হতে বুঝতে শিখলাম এগুলি আমাদের ঐতিহ্য আর পরম্পরার অন্তর্গত। শতাব্দীর অবহেলায় ক্রমে জীর্ণ , কিছু গ্রাস করেছে কংসাবতী। বাকিগুলির ইট পাথর খুলে নিয়ে যাচ্ছে অসচেতন গ্রামবাসীরা।”
পাঠান নিজের মত করে প্রচার শুরু করলেন। মানুষকে বোঝাতে শুরু করলেন এ গুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব। বোঝালেন মন্দির সংস্কার করে এই গ্রামকে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে তুলে আনা যায়। গ্রামে তখন বিদ্যুৎ আসবে, পানীয় জল আসবে। তৈরি হবে পাকা সড়ক।
নিমরাজি গ্রামবাসীরা প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে ক্রমে পাশে দাঁড়ালেন। প্রথমে শুরু হল মন্দির ঘিরে গজিয়ে ওঠা বনজঙ্গল সাফ করার কাজ। কিছু বিশিষ্ট বিদ্যান মানুষের পদার্পণ ঘটল। পাথার প্রচারে এল। পাঠান থেমে নেই। সবাইকে নিয়ে মিছিল, সবাইকে নিয়ে ধর্নায় বসলেন জেলা সদরে। মানে তখনকার মেদিনীপুর সদরে। সরকারী সাহায্য পাওয়া গেল কিছু। প্রযুক্তিগত দরকারি সাহায্য যোগালেন আই আই টি , খড়গপুর।
১৯৯০ এ পাঠান তৈরি করলেন পাথরা আরকিওলজিকাল প্রিজারভেশন কমিটি। পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ সমিতি। এটি একটি এন.জি.ও। সদস্য হিন্দু মুসলমান এবং আদিবাসী নির্বিশেষে সারা গাঁয়ের মানুষ। উদ্দেশ্য মন্দির রক্ষনাবেক্ষনের প্রয়াস অব্যাহত রাখা। তবে বাস্তবে মন্দির ছাপিয়ে এই সংগঠন হয়ে উঠল হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের এবং আদিবাসীদের এতদিন পাশে থেকেও পরস্পরকে না চেনার পাপস্খালনের মঞ্চ। বন্ধুত্ব আর বিশ্বাসের মঞ্চ। কত আর বেতন পেতেন পাঠান ! হাই স্কুলে সামান্য পিওনের চাকরি। তবু অদম্য উৎসাহে পকেটের কড়ি্ খরচা করে কোলকাতা দিল্লী করেছেন। সরকারী অফিসে দফতরে দরবার করেছেন। লিফলেট ছাপিয়েছেন। পুস্তিকা ছাপিয়েছেন। পাথরার মন্দির নিয়ে গবেষণামূলক বই অব্দি লিখেছেন, ছেপেছেন।আদিতে ১০০ পাতার গ্রন্থ এখন ৩৫০ পাতার সংকলন। অবিভক্ত মেদিনীপুরের ১০৬১ টি মন্দির, মসজিদ, গির্জা, কেল্লা বা প্রাসাদের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। নিঃস্ব হয়ে। কপর্দকশূন্য হয়ে।
প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ার পারসন তখন প্রনব মুখোপাধ্যায়। যিনি এখন রাষ্ট্রপতি। সে ১৯৯৮ সালের কথা। প্রথম সরকারী অনুদান এল বিশ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর ২০০৩ এ এ.এস.আই অধিগ্রহণ করলেন মন্দিরগুলি। এ এস আই সাড়ে চার কোটি অর্থ মঞ্জুর করেছেন পাথরা পুরাকীর্তির তত্ত্বাবধানে।
২৮ টি মন্দির পুনর্নিমান করা হয়েছে। অনন্য টেরাকোটার কাজ ও বাংলা ঘরানার গঠনশৈলী সম্পন্ন মন্দিরগুলি , যাতে ইসলামি স্থাপত্যেরও ছোঁয়া, এখন শুধু পাথরা নয় সারা দেশের গর্ব।
পাঠান ভারত সরকারের কাছ থেকে কবীর পুরষ্কার পেয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সম্পসেতির প্রতীক পাঠান তার থেকেও বড় যে পুরষ্কার যা পেয়েছেন তা মানুষের ভালোবাসা।
আসুন আমরা ভালবাসায় স্নাত হই। পবিত্র হই।
প্রসঙ্গত আর একটা কথা মনে পড়ল। ফেসবুকেই কেউ জানিয়েছিলেন খবরটি। শেয়ার করেছিলাম। কুমিল্লার এক গ্রামে প্রাচীন এক শিবমন্দির সংস্কারের তাগিদে মন্দির সংলগ্ন প্রাচীন বটগাছটি বিক্রির জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। এক প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলমান বাঙালী বিজ্ঞাপনটি দেখামাত্র লক্ষাধিক টাকায় কিনে নেন গাছটি। তারপর সেই টাকাই দান করেন মন্দির সংস্কারের জন্য। গাছ বাঁচল। বাঁচল মন্দির। বাঁচল ঐতিহ্য। পরম্পরা।



No comments:

Post a Comment