Sunday 10 April 2016

চাকমাদের নববর্ষ -------শহিদ মানিক

বিজু পেক্কোন ডাহের বিজু বিজু
‘বিজু পেক্কোন ডাহের বিজু বিজু/তুরুর তুরুর বাঁশি বাজেরদে, পাড়ায় পাড়ায় বেড়েবোং বেকোন মিলিনে, অ্যাজ্জে বিজু বিজু-বিজু’ (বিজু পাখিগুলো ডাকছে বিজু বিজু/তুরু তুরু বাঁশির সুর বাজছে, চল সবাই পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ঘুরে বেড়াই, আজ যে বিজুর দিন)। চাকমা ভাষার এমন গানই মনে করিয়ে দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবির কথা।
বৈসাবি শব্দের কোনো অর্থ নেই বাংলা কিংবা আদিবাসীদের ভাষার তালিকায়। ত্রিপুরা সম্প্রদায়রা চৈত্র সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসবকে বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই এবং চাকমারা বিজু নামে পালন করে। তিন উৎসবের আদ্যক্ষর নিয়েই বৈসাবি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈসাবি এখন আর আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসব নয়, এটি এখন সর্বজনীন উৎসবে রূপ পেয়েছে। বৈসাবির সময় পার্বত্য তিন জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে দেশ বিদেশের শত শত পর্যটক ছুটে আসে আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, রীতিনীতি, কৃষ্টি ও পোষাক পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত উৎসব দেখতে। আদিবাসীদের স্ব স্ব গোত্র ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচির পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়েছে বিবিধ কর্মসূচি।
ত্রিপুরাদের বৈসু: বাংলা পঞ্জিকা মতে চৈত্রের শেষ দুই দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন বৈসু উৎসব হিসেবে পালন করে। উৎসবের প্রথমদিনে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের ছড়া বা পুকুর থেকে পানি তুলে স্নান (গোসল) করায় ছোটরা। এরপর শুরু হয় ঘরবাড়ির সাজসজ্জা ও অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। বাড়িতে বাড়িতে চলে হরেক রকম রান্নার প্রস্তুতি।
ত্রিপুরারা বৈসুর সময় অর্ধশতাধিক রকমের তরিতরকারি দিয়ে সবজি রান্না করে। যেটি পাঁচন নামে পরিচিত। তাদের বিশ্বাস এ পাঁচন তরকারি ওষুধি হিসেবে কাজ করে। পাঁচন ছাড়াও নানা পিঠাপুলি, মিষ্টান্ন ও বিভিন্ন খাবারের ব্যবস্থা করা হয় সাধ্য মতো।
বৈসুর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে গরিয়া নৃত্য। ত্রিপুরারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের উৎসবে আমেজে রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। গরিয়া নামক জুম দেবতার পূজা দেয় ত্রিপুরারা। ত্রিপুরাদের মূল পেশা জুম চাষ বা কৃষি কাজ। আর গরিয়া হচ্ছে সে জুম দেবতা। তাদের বিশ্বাস গরিয়া দেবতার পূজা দিয়ে দেবতাকে সন্তোষ করা গেলে পারিবারিক, পেশা ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। তাইতো এ দেবতার পূজা দিতে দল বেঁধে গরিয়া নৃত্যের শিল্পীরা ঘুরে বেড়ায় ত্রিপুরা পল্লীগুলোতে। আর ত্রিপুরারা তাদের সাধ্য মতো মানস (ইচ্ছে পোষণ) পূরণের জন্য দেবতাকে পশু পাখি, খাবার ও টাকা পয়সা উৎসর্গ করে।
বর্তমানে খাগড়াছড়িতে গরিয়ার সাদৃশ্য প্রতিযোগীরা এ নৃত্যের আয়োজন করেছে। ২০১৪ সাল থেকে ‘য়ামুক’ নামে একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী জেলা সদরে এ প্রতিযোগীতার আয়োজন করে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় এ বছরও গরিয়া নৃত্যের প্রতিযোগীতা করা হয়েছে।
মারমাদের সাংগ্রাই: মারমাদের উৎসবের নাম সাংগ্রাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা ও রাখাইনরা অন্যান্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের মতো সাংগ্রাই উৎসব পালন করে থাকে। সাংগ্রাই উৎসবের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন দিক হচ্ছে জলকেলি বা পানি খেলা। বাংলা নববর্ষের একদিন পরে মঘাব্দ শুরু হওয়ায় ১৫ই এপ্রিল থেকে শুরু হয় মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব।
ঐতিহ্যবাহী কাপড় এবং বর্ণিল সাজগোজে তরুণীরা তরুণদের সাথে জলকেলি উৎসবে মেতে উঠে। জনশ্রুতি আছে নিজেদের পছন্দের জুটিরা জলকেলিতে অংশগ্রহণ করে। একে অন্যকে পানি ছিটিয়ে এবং নেচে গেয়ে মারমারাও পুরানো বছরকে বিদায় দেয় এবং নতুন বছরকে আগমন করে। পাড়ায় পাড়ায় চলে সাংগ্রাই উপলক্ষে দড়ি, হা-ডু-ডু, ঘিলাসহ ঐতিহ্যবাহী নানান খেলাধুলা। অনেকে আবার বিশ্বাস করে জলকেলির মাধ্যমে পুরো বছরের পাপাচার ধুয়ে মুছে যায়।
চাকমাদের বিজু: চাকমা সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা ১২ এপ্রিল সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নিজেদের ইচ্ছেমতো বর্ণিল পোষাক পরিচ্ছদ পরে স্থানীয় ছড়ায় বা খালে জলদেবতার উদ্দেশে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করে। এটিকে ফুল বিঝু বলা হয়। আর ফুল বিঝুর মধ্য দিয়ে চাকমাদের বিঝুর আনুষ্ঠানিকতা আরম্ভ হয়। ফুল ভাসিয়ে বাড়িতে এসে চলে অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি। ঘর দুয়ার সাজিয়ে গুছিয়ে চলে রান্নাবান্না।
ত্রিপুরাদের মতো চাকমারাও পাঁচন রান্না করে। যেটিকে চাকমা ভাষায় চাকমা তুন বলা হয়। চাকমারা অতিথি আপ্যায়নে বেশ আন্তরিক। পাঁচন, ফলমূল, মিষ্টি, খাবার দাবার ও কোমল পানীয় দিয়ে চাকমারা অতিথিদের আপ্যায়ন করে। ফুল বিঝুর পরের দিন অর্থাৎ দ্বিতীয় দিন হচ্ছে মূল বিঝু। ওইদিন নতুন জামা কাপড় পরে শিশুকিশোর, তরুণ তরুণীরা দল বেঁধে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়। খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি চলে আর্শীবাদ নেয়ার ব্যাপারও। ছোটরা বড়দের প্রণাম করে। অনেকে প্রণামীও পেয়ে থাকেন।
তৃতীয় দিন বাংলা নববর্ষের দিনও চাকমারা বিঝু পালন করে। সেদিনও ঘরে ঘরে চলে অতিথি আপ্যায়ন ও ঘোরাঘুরি। চাকমা গ্রাম বা আদাম গুলোতে বিঝুর সময় নানা রকম খেলাধুলার আসর বসে। এছাড়া চলে রাতভর পালাগান ও গ্রাম্য নাটকের আসর। পাড়ায় পাড়ায় চলে হৈ-হুল্লোড় ও উৎসবের আমেজ।
পাহাড়ের বাংলা নববর্ষ: পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতেও বৈসাবির পাশাপাশি পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় সর্বজনীনভাবে। পাহাড়ি বাঙালিরা বৈসাবির মতো বাংলা বছরের প্রথম দিনকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে। ওই দিন সকালে প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এপ্রিল মাসের শুরু থেকে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে চলে বৈসাবি উৎসব পালনের নানা প্রস্তুতি। চলে পাক্ষিক ও সপ্তাহব্যাপী মেলা। এরই পরিপেক্ষিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে বসেছে বৈসাবি মেলা। প্রতিদিন বিকেলে সেখানে চলছে নাচ,গানসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. মজিদ আলী জানান, পাহাড়বাসী ও দেশ বিদেশ থেকে আগত পর্যটকরা যেন পাহাড়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে সেজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী জেলাবাসীকে বৈসাবির শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বৈসু, সাংগ্রাই, বিঝু ও বাংলা নববর্ষ পৃথক কোনো উৎসব নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি বাঙালিরা আমরা একই মায়ের অভিন্ন সন্তান। বৈসাবি ও বাংলা নববর্ষ আমাদের সকলের প্রাণের উৎসব।’
এ বছরও দ্বিতীয় বারের মতো জেলার গুণীজনদের সম্মাননা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। গুণীজনদের সম্মান করলে গুণীজন জন্ম নেবে বলেও আশা প্রকাশ করেন কংজরী চৌধুরী।

No comments:

Post a Comment