Tuesday 5 April 2016

কবি কাহিনী নির্মলেন্দু গুন

কবি-কাহিনি
................
আপনারা কবিত্ব-হারানো একজন কবির সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন? কবিতা পাঠের আসরে দাঁড়িয়ে কবি জানতে চাইলেন।
দর্শকদের ভিতর থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললঃ "আমরা তাঁর বই কেনা বন্ধ করে দেব।"
কবি হাসলেন। বই না-কেনা বা কবিতা না-পড়ার হুমকিতে কবিকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হল না।
অন্য একজন দাঁড়িয়ে বললেনঃ "আমরা অনুসন্ধান চালাব তাঁর জীবনের গোপন-পৃথিবীতে। জানব, সেখানে কোনো ত্রুটি ঘটেছে কি না।"
এবারও কবি মুচকি হাসলেন। মনে হল তাতে পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছুই হবে না। কবির জন্য এটা একেবারেই কোনো কাজের কথা নয়।
ঐ যুবকের বক্তব্য শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালেন এক প্রৌঢ়। তিনি বললেনঃ "আমরা তাঁর কবিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকব।তাঁর বেশ কিছু ভালোকবিতার কথা আমাদের মনে আছে। তিনি যদি আর লিখতে নাও পারেন, তবু তিনি আমাদের প্রিয়-কবি হিসেবেই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।"
কবি খুব মনোযোগ সহকারে, কৃতজ্ঞ চিত্তে ঐ প্রৌঢ়ের কথা শুনলেন।
তখন লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ। তিনি বললেনঃ "আমরা কবির জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব। কেন না কবিত্ব হচ্ছে ঈশ্বর প্রদত্ত এক ধরনের সৃষ্টি-শক্তি; যা
কবির মাধ্যমে ঈশ্বর সমাজকেই দান করেন। কবিত্ব হারানোর জন্য আমি তাই শুধু কবিকেই দায়ী বলে মনে করি না। আমি মনে করি, সমাজে ঘটে-যাওয়া নানাবিধ অপরাধের কারণেও একজন কবি কবিত্ব হারাতে পারেন। তাই, কবির জীবনচরিতে নয়, আমরা অনুসন্ধান চালাব আমাদের সমাজচরিতের মধ্যে। সমাজের কোথায় ঘটেছে সেই অপরাধ, আমাদের কাজ হবে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা।
এবার কবির চোখ অশ্রুসিক্ত হল। তিনি করজোড়ে বৃদ্ধের উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করলেন। মনে হল, হঠাৎ করেই কবির বুকের ভিতর থেকে সেইপাথরটি সরে গেছে, যা তাঁর আবেগের প্রবাহকে দীর্ঘদিন রুদ্ধ করে রেখেছিল। তাঁর ডান হাতের মধ্যমার অগ্রভাগে চোখের একবিন্দু অশ্রুকে ধারণ করে তখন কবি বললেনঃ "এই হচ্ছে কবিত্ব, এ ছাড়া কবিতা হয় না।"
-নির্মলেন্দু গুণ

No comments:

Post a Comment