Wednesday 6 April 2016

ঘটা দাদুর জুতোর দোকান ------- বাপী চেনা আধুলি

ছোটবেলায় পুজোয় নতুন জুতো হত।
দাদু আমাদের দুভাইকে পাড়ার জুতোর দোকানে নিয়ে যেতেন। দোকানি ভদ্রলোক দাদুর অত্যন্ত কাছের লোক ছিলেন। দাদু তাঁকে ঘটা বলে ডাকতেন বলে আমরাও ডাকতাম ঘটা দাদু। এমন অদ্ভুত নাম কেন - দাদুর কাছে আমরা কখনও জানতে চাইনি। আমাদের বাড়ির এবং পাড়ার আর সবার সব জুতো ঘটা দাদুই তৈরি করতেন। আমরা দোকানে গিয়ে সটান ডান পা বাড়িয়ে দিতাম। একটা সাদা কাগজে কালি দিয়ে ছাপ তুলে নিতেন তিনি। পঞ্চমীর দিন স্কুল ছুটি হত। সেদিনই বিকেল গরিয়ে গেলে নতুন জুতো নিয়ে হাজির হতেন পাড়ার একমাত্র চর্মকার।
কোন ক্যাটালগ নেই, তৈরি করা 'স্যাম্পল' নেই। ঘটা দাদুর ইচ্ছে মত 'ডিসাইনে' আমাদের দিব্যি চলে যেত। পায়ে পায়ে আনন্দ আমাদের নেহাত কম ছিল না।
তারপর আমরা একটু বড় হলাম। আমাদের শহর একটু বড় হল। আমরা পাড়া ছেড়ে বেরুলাম।
ভারত সু ! ঝলমলে বাহারি শোরুমে কী চোখ ধাঁধানো আলো। কত কত কত ধরণের জুতো, চটি ! সুন্দর সুন্দর ডিসাইন ! পুজো, তাই সঙ্গে 'আকর্ষণীয় গিফট' ! জুতো চাই মনের মত। এমন ! দশটা দেখব - তার মধ্যে একটা পছন্দ করে নেব। আহা। দাম একটু বেশি। ও ঠিক আছে। ঘটা দাদুর জুতো কেমন যেন...! একঘেয়ে। পানসে। ধুর।
ঘটা দাদুর দোকানে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর দিন গেল। কলকাতা অনেক কাছে চলে এলো। আমাদের শহরে শপিং মল, নেটে অনলাইন শপিং। শহর ছেড়ে, কলকাতা ছেড়ে সারা পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। আমরা ভালই আছি। আমরা ভালই আছি !
নাটকের অভিনয় করতে গেছি কত শহরে। অমৃতসরে গেছি, দেখি স্বর্ণমন্দিরের পাশেই, রাস্তার দুধারে ঐতিহ্যবাহী তরবারি আর চটির দোকান। কিন্তু মূল শহরের বাজারের সঙ্গে আমাদের এখানকার বাজারের খুব একটা ফারাক নেই। শহরটা দেখতেও প্রায় একই রকম। আশ্চর্য, আমি যে ধরণের জুতো জামা প্যান্ট পড়ে আছি একজন পাঞ্জাবী যুবকও সেই ধরনেরই জুতো জামা প্যান্ট পড়ে রয়েছেন ! ঐ আলো ঝলমলে বাহারি শোরুমের হাজার ডিসাইনের মধ্যেও আমাদের ‘অপশন’গুলো এক হয়ে গেল কখন? পাঞ্জাবী জুতোর দোকানে পাঞ্জাবীদের ভিড় নেই কেন? আমার ছোট্ট পায়ে ঘটা দাদুর হাতে বানানো জুতোর ফোস্কার দাগ এখনো কি লেগে নেই?
বাড়ি ফিরে পরেরদিনই ঘটা দাদুর দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
ঘটা দাদুর দোকান-জমি প্রমোটারের হাতে চলে গেছে।

No comments:

Post a Comment