একটি বিশেষ মহিলা সততার প্রতীক বলে তিনি স্বয়ং এবং তাঁর অনুগামীরা গত দু’তিন দশক পশ্চিম বাংলাকে অবিশ্রান্ত তোলপাড় করে দিয়েছেন। শহরে গ্রামে ছড়িয়ে লক্ষ লক্ষ অভাবী মানুষজন, বেকারত্বের চাপ বাড়ছে, গ্রামে কিছু কিছু কৃষক যাঁরা আগে নেহাতই খেতমজুর ছিলেন, তাঁরা এক ছটাক দু’ছটাক করে হয়তো জমি পেয়েছেন, কিন্তু তা চাষ করে স্বচ্ছন্দ বেঁচে থাকার উপায় নেই, শহরে ও শহরতলিতে শিল্পবাণিজ্যের প্রসার সীমিত, কোনও ক্রমে বেঁচে থাকার তাগিদে ক্রমবর্ধমান গরিব মানুষদের উদ্ভ্রান্ত ছোটাছুটি। সততার প্রতীক মহিলাটি খাঁটি প্রাকৃত ভাষায় তাঁদের যথার্থ শত্তুর বলতে কী বোঝায় তা ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন— ওই গোলগাল চেহারা, অ্যাম্বাসাডর চড়নেওয়ালা, নধর বেটাগুলোই সব সর্বনাশের জন্য দায়ী, তিনি সততার প্রতীক, তাঁকে যদি সর্বগোত্রের অভাবী মানুষগুলি সমর্থন জ্ঞাপন করেন, তা হলেই পশ্চিম বাংলা স্বপ্নরাজ্যে পরিণত হবে, সততা, সততা, সততা: সততার বাইরে থেকে গেলে, সততাকে পরিপূর্ণ সমর্থন না জানালে কৃষক মজুর মধ্যবিত্তের আর কোনও আশা নেই। মধ্যবিত্ত পরশ্রীকাতরতা দিনদরিদ্রদের মানসে অনুপ্রবেশ ঘটানোর কাজে ওই বিশেষ ভাষা ব্যবহার আশ্চর্য সাফল্য এনে দিল, এমনকী লেখাপড়া-জানা অতি-বামপন্থী বলে খ্যাত কিছু মানুষজনও এই সততার প্রতীকে মজে গেলেন।
অথচ মহিলাটির পূর্ব ইতিহাস এমন তো অজানা ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে হাতেখড়ির মুহূর্তে তিনি ডক্টর পদবিটি সযত্নে ব্যবহার করতেন, মার্কিন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি নাকি ডক্টরশ্রী-তে ভূষিত হয়েছিলেন। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটিত, ও-রকম নামে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই নেই। তাতে কী? পৃথিবীতে প্রতারকদের তো অভাব নেই, সততার প্রতীক তাদেরই কারও খপ্পরে পড়ে একটু বিব্রত, সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, তিনি রাজ্যের শাসনভার হাতে পেলেই সমস্ত অন্যায় বিলুপ্ত হবে, ন্যায়ের বন্যায় পশ্চিম বাংলা প্লাবিত হবে। পাঁচ বছর আগে রাজ্যের ভোটদাতাদের একটি অ-তুচ্ছ অংশ এ-রকম প্রতীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে সততার প্রতীকটিকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী করলেন— স্বপ্নরাজ্য এখন হাতের মুঠোয়।
তার পর অবশ্য অবিশ্বাস্য উলটপুরাণের অধ্যায়ের পর অধ্যায়। সততার স্বরূপ যে কত বিভঙ্গে, কত বৈচিত্রে বিচ্ছুরিত হতে পারে, গোটা পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষ ক্রমে-ক্রমে হাড়ে-হাড়ে টের পেতে শুরু করলেন। অর্থব্যবস্থার আলোচনা থেকেই শুরু করা যাক। কী কৃষিতে, কী শিল্পে বা পরিষেবায়, গত পাঁচ বছরে এই রাজ্যে উন্নয়নের ছিটেফোঁটা হয়নি। পরিবর্তে চোখ-ছানাবড়া-করা আজব নানা ঘটনা। কালিম্পঙের উপকণ্ঠে এক শোখিন অতিথিশালায় নিভৃত বৈঠকে কে কে এবং কী কারণে উপস্থিত ছিলেন, তা নিয়ে অনেক বয়ান, অথচ কোনও একটিকেও সততার প্রতীক মহিলা ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে সোচ্চার হননি। কিন্তু মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-অতিনিম্নবিত্ত মানুষগুলি তাঁদের সামান্য সঞ্চয় যে একটি-দুটি অসাধু বিনিয়োগ সংস্থার কাছে গচ্ছিত রাখতে শুরু করেন, শাসক দলের নেতানেত্রীদের প্রবল উৎসাহে ও প্ররোচনায় তা উধাও হয়ে গেল, মাসে মাসে যে টাকা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কথা, তা-ও পুরোপুরি বন্ধ।
পাশাপাশি, অন্য একটি গভীর ব্যঞ্জনাপূর্ণ তথ্য, বহু বছর ধরে ডাকঘরে-জমা-পড়া স্বল্পসঞ্চয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশে সর্বাগ্রগণ্য। এই সঞ্চয়ের দুই-তৃতীয়াংশ রাজ্য সরকারের ঋণ হিসেবে প্রাপ্য, রাজ্য সরকার তাই এই প্রকল্পের ব্যাপ্তিসাধনে বরাবর সচেষ্ট থেকেছেন। দিদিমণির মুখ্যমন্ত্রিত্বে প্রথম দু’বছর অন্য ইতিহাস রচনা করল। রাজ্যে ডাকঘরে-জমা-পড়া অঙ্কের পরিমাণ অতি সংকুচিত, অথচ কালিম্পঙের উপকণ্ঠে সেই ঐতিহাসিক সভায় যে যে বেসরকারি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলির মালিকরা উপস্থিত ছিলেন বলে ধারণা, তাদের সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ প্রায় একশো গুণ বেড়ে গেল। যে বেকার বা গৃহবধূদের সম্প্রদায় ডাকঘরের জন্য টাকা তুলতেন, তাঁরা বেসরকারি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলির জন্য অর্থ সংগ্রহে শশব্যস্ত। সব মিলিয়ে বিভিন্ন অসাধু সংস্থা কত হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে, তার নানা হিসেব। সাধারণ মানুষের অসন্তোষ চাপা দিতে সংস্থাগুলির চাঁইদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করা হল। ক্রমশ অভিযোগ প্রকাশ পেল, উধাও হওয়া মধ্যবিত্ত গরিব মানুষের টাকা কিছু কিছু সততার প্রতীক দলটির নেতানেত্রীদের কুক্ষিগত। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মাননীয় সাংসদ, কেউ কেউ হয়তো বা প্রখ্যাত শিল্পী বা অভিনেতা-অভিনেত্রী। আরও বিচিত্র দৃশ্যের সম্মুখীন আমরা। দুরাচারী এক বিনিয়োগ সংস্থার কারাগারে আটক নায়ক আদালতে আবেদন পেশ করলেন: হুজুর ধর্মাবতার, কী সব আজেবাজে গুজব শুনছি, যেহেতু আমাদের প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহান ব্রতে নিযুক্ত ছিল, কেউ কেউ নাকি বলছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরিয়ে নিয়ে মামলাটি খোদ সর্বোচ্চ আদালতের হাতে অর্পণ করা হোক। বন্দিমহোদয়ের আকুল আবেদন: আমি হলফ করে বলছি, রাজ্য সরকার আমার বিরুদ্ধে অতি দক্ষতার সঙ্গে মামলাটি পরিচালনা করছে, সুতরাং সুপ্রিম কোর্টে সরিয়ে নেওয়ার মতো বিদঘুটে ব্যাপার দয়া করে হতে দেবেন না।
শেষ পর্যন্ত যদিও সেই মামলা এখন দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে, কবে সেই মামলা শেষ হবে, কেউ জানে না। সত্যের প্রতীক দলটির আরও অনেক নেতানেত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এক জন রাজ্য মন্ত্রীকে জামিন না দিয়ে বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছে। যদিও তিনি আর মন্ত্রী নেই, তেমন ক্ষতি নেই তাতে, বন্দিশালায় তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পুরোপুরি ভোগ করছেন।
আর্থিক দুরাচারের আরও এত এত দৃষ্টান্ত ক্রমশ উদ্ঘাটিত, কোনটা ছেড়ে আগে কোনটা বলব? এখন তো দেখা যাচ্ছে, দলের নেতা মন্ত্রী সাংসদরা প্রায় প্রকাশ্যে উৎকোচ গ্রহণ করছেন। দলের মহানেত্রী শখ করে মাঝে মধ্যে ছবিটবিও আঁকেন। তাঁর ছবির বাজারদর খোলাবাজারে দশ-বারো টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে নাকি একটি বিশেষ ছবি কেড়ে নিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা দাম ধরিয়ে দিয়েছে কোনও বেসরকারি সংস্থা। রাজ্য প্রশাসনের প্রত্যেকটি দফতর থেকে এটা-ওটা-সেটা উপলক্ষ করে বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে অর্থব্যয় করা হয়। ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে, প্রকল্পের সুযোগ পেতে হলে দলের কোনও না কোনও কেউকেটাকে দস্তুরি দিতে হয়। সর্বশেষ উদাহরণ জোড়াসাঁকোর ভেঙে-পড়া উড়ালসেতু।
এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা থেকে পাঠকদের অব্যাহতি দিয়ে সততার প্রতীক নেত্রীর স্পষ্ট ঘোষণায় পৌঁছে যাওয়া যাক। তিনি গর্বসহকারে নিজেই জানিয়েছেন, এন্তার সমাজবিরোধীর ওপর তিনি কর্তালি করেন। প্রকৃত অর্থেই তাঁর দল সব গোত্রের সব স্তরের সমাজবিরোধীদের আশ্রয়দাতা। রাজ্যের শাসনকারী দলের সাংসদ প্রকাশ্যে গলা ফুলিয়ে বলছেন, যদি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে টু শব্দটি করে, তাঁর ছেলেরা গিয়ে সেই উদ্ধত ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের ধর্ষণ করে আসবে। সাংসদটির বিরুদ্ধে কোনও কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা দূরে থাক, ধর্ষণ নাকি বড়জোর দুষ্টু ছেলের সামান্য নষ্টামি। কোনও বহিরাগত গিয়ে যদি কোনও কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যাপককে পেটায়, তা হলে যে পেটাল তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে অধ্যক্ষ বা অধ্যাপক বেচারিকে লাঞ্ছনার উদ্যোগ। পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণটি নাকি সাজানো ঘটনা, কামদুনির ধর্ষণ তথা খুন সিপিএম-মাওবাদীদের চক্রান্ত। বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথের বাংলাকে সভ্যতা সংস্কৃতির কোন অতলে গত পাঁচ বছরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, তা অবলোকনে নির্বাক না হয়ে উপায় নেই। ন্যায়পরায়ণতা সম্পূর্ণ অদৃশ্য। মানবাধিকার কমিশনকে মুখ ভেঙচিয়ে তার নির্দেশকে কলা দেখানো হচ্ছে, মহিলা কমিশনেরও একই অভিজ্ঞতা। এমনকী মাননীয় বিচারপতি যদি শাসকের প্রসাদধন্য সমাজবিরোধীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন, পুলিশের ঘাড়ে ক’টা মাথা, তার কাছাকাছি যায়?
পুলিশ নিছক নিষ্ক্রিয় নয়, এখন শাসক দলের অনুশাসনেই তার ঘোরাফেরা। গোটা প্রশাসনই সেই পথের পথিক। রমেশচন্দ্র দত্ত থেকে শুরু করে অন্নদাশংকর রায় পর্যন্ত রাজপুরুষরা ঋজু, বলিষ্ঠ ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসনের যে ঐতিহ্য স্থাপন করে গিয়েছিলেন, তা এখন ক্লেদাক্ত ধুলোয় লুটোচ্ছে। গোটা প্রশাসন জুড়ে জো-হুজুর-তালিমকারীদের ঠাসাঠাসি ভিড়। একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী, কঠিন পরীক্ষায় সসম্মান উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনে প্রবেশ, তাঁরা কেন সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের যূপকাঠে নৈতিকতা তথা আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়েছেন, তা অবশ্যই গভীর গবেষণার বিষয়। সব মিলিয়ে একটি আশ্চর্য নবদর্শন পশ্চিম বাংলায় গত পাঁচ বছরে রচিত: মিথ্যা মানে সত্য, অন্যায় মানে ন্যায়পরায়ণতা, বেআইনিই আইন, অজ্ঞতাই প্রজ্ঞা, যে অত্যাচারিত, সে-ই আসলে অত্যাচারী, আসল অত্যাচারী পারিতোষেকরই যোগ্যতা অর্জন করেছে।
এই উপাখ্যান, মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, সত্যিই অন্তহীন। পাঁচ বছর আগে মহিলাটি দাবি করেছিলেন, জঙ্গলমহলে কোনও মাওবাদী নেই, সিপিএমই মাওবাদী সেজে গোলমাল পাকাচ্ছে। আজ তিনি বলছেন, জঙ্গলমহলে একমাত্র তিনি আছেন আর মাওবাদীরা আছে, আর কেউ নেই। আসানসোলের হিন্দিভাষী-প্রধান এলাকায় নির্বাচনী সভায় পৌঁছে শাসাচ্ছেন: জো হামসে লড়েগা, চুরচুর হো জায়েগা। একটু বাদেই কুলটিতে গিয়ে হাতজোড় করে সকাতর প্রার্থনা: ভুলত্রুটি করে থাকলে ক্ষমা করবেন, মুখ ফিরিয়ে নেবেন না।
এখন মনে হয়, ঘৃণার একটি মস্ত সামাজিক সার্থকতা আছে। জীবনের অন্তিম লগ্নে পৌঁছে আমি স্পষ্টোক্তি করে অত্যন্ত শান্তি পাচ্ছি, মস্ত তৃপ্তি পাচ্ছি: এই স্বৈরাচারিণীকে আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা, ঘৃণা, ঘৃণা। আমার ঘৃণা প্রকাশ পড়শিদেরও ঘৃণা-নিষ্কাশনের সাহস সঞ্চার করে। কী সৌভাগ্য, সেই ঘৃণাকে ব্যক্ত করার একটি সুযোগ বর্তমান রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন আমাকে এনে দিয়েছে। যে এলাকায় আমার বসবাস, এখন তা ভবানীপুর কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত। ভোটের দিবসে যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে যাব, আমার মতো শারীরিক অসমর্থদের জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থা যদি না-ও থাকে, হামাগুড়ি দিয়ে হলেও ভোট-পরিচালকের সামনে উপস্থিত হয়ে পরিচয়পত্র দেখিয়ে পর্দায় ঘেরা যন্ত্রে মহিলাটির বিরুদ্ধে আমার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করব।