Wednesday 6 April 2016

বিদ্যুৎ চাই 'আমরা' মরছ 'তোমরা'-- একে এম জাকারিয়া প্রথম আলো ৪ এপ্রিল ২০১৬

বিদ্যুৎ চাই ‘আমরা’, মরছ ‘তোমরা’!

এ কে এম জাকারিয়া | আপডেট:  | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষের প্রাণের চেয়ে দামি কী আছে?উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রে কিছু ছাড় দেওয়া জায়েজ—এমনটাই কয়েক বছর ধরে সরকার আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। সরকারি দলের নেতাদের কথাবার্তায় আমরা এর ইঙ্গিত পেয়েছি। সরকারের এ ধরনের অবস্থানের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী মহলেরও কেউ কেউ সুর মিলিয়েছেন। তাঁরা বলতে চাইছেন, উন্নয়ন চাইলে আপাতত গণতন্ত্রে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে হবে। গণতন্ত্র ও মুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে যে আধুনিক উন্নয়ন ধারণার সম্পর্ক রয়েছে বা উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়—এসব তাঁদের কে বোঝাবে! এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাক। উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রে না হয় ছাড় দেওয়া গেল, কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রাণও দিতে হচ্ছে! মানুষের প্রাণের চেয়ে দামি কী আছে? আমরা তো মনে হয় উন্নয়নের নেশায় এতটাই মজেছি যে এর কাছে মানুষের জীবনও কিছু নয়।
উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি—এগুলো সবই আমরা চাই। এর জন্য কম পয়সায় বিদ্যুৎ দরকার, সেতু, রাস্তা ও রেলপথ দরকার, শিল্প-কলকারখানা দরকার, বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। বাঁশখালীতে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা কেন নেওয়া হয়েছে? কারণ আমাদের বিদ্যুৎ চাই এবং তা কম পয়সায় উৎপাদন করতে হবে। এই যে আমরা এসব চাই, এই ‘আমরা’ কারা? সাধারণভাবে দেশের মানুষ। কিন্তু এই ‘আমরা’-এর মধ্যে ‘তোমরা’ বলে একটি ব্যাপার রয়েছে। তা না হলে আমাদের এই চাওয়া পূরণ করতে আমরা নিজেরা নিজেদের মারতে পারতাম না! আমাদের চাহিদা পূরণ করতে আমরা যাদের মারছি তারা আসলে ‘তোমরা’! শেষ পর্যন্ত বাঁশখালীতে যদি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়, তখন সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের সঙ্গে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া চারটি প্রাণের হাহাকারও যে প্রবাহিত হবে, সেটা ‘আমরা’ হয়তো কোনো দিনই টের পাব না।
যেকোনো উন্নয়নের কিছু খেসারত থাকে এবং দেশের জনগণকেই তা দিতে হয়। উন্নয়নে পরিবেশের ক্ষতি হয়, যুগ যুগ ধরে বা বংশপরম্পরায় বসবাস করছে এমন অনেক জনগোষ্ঠীকে তাদের জমি-জিরাত হারাতে হয়, ছাড়তে হয় দীর্ঘদিনের জীবন-জীবিকা। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো ডব্লিউ কোর্টল্যান্ড রবিনসন নানা ধরনের উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন। এ নিয়ে লেখা তাঁর বইটির শিরোনাম রিস্ক অ্যান্ড রাইটস: দ্য কজেস, কনসিকোয়েন্স অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব ডেভেলপমেন্ট-ইনট্রোডিউসড ডিসপ্লেসমেন্ট। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, সারা দুনিয়ায় উন্নয়নের খেসারত দিচ্ছে লাখ লাখ মানুষ, এ জন্য তারা তাদের বাড়িঘর, জীবন-জীবিকা, এমনকি জীবনও হারাচ্ছে। উন্নয়নের কারণে যারা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, তারা আসলে সবচেয়ে হতভাগা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার উদ্বাস্তুরা অন্তত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা ও সহানুভূতি পায়। রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়, তারাও বিশ্বের নজর কাড়ে। কিন্তু উন্নয়নের শিকারে পরিণত উদ্বাস্তুরা পড়ে সবচেয়ে বিপদে।
উন্নয়নের কারণে যে মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের এই ক্ষতি শুধু সম্পদ হারানো বা আর্থিক নয়; এর মানসিক ও মানবিক নানা দিক রয়েছে, রয়েছে আবেগ ও কষ্টের সম্পর্ক। ক্ষতিপূরণে তা পূরণ হয় না। এসব অমূল্য। এই দীর্ঘশ্বাসকে মেনে নিয়েই উন্নয়ন হয়, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু এই যুগে এসে উন্নয়নের ধারণা ও পরিকল্পনায় কিছু বিষয় মেনে চলা হয় এবং এ ক্ষেত্রে কিছু স্বীকৃত ও স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম রয়েছে। টেকসই উন্নয়নের ধারণা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হওয়ার পর ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ‘ব্রুন্টলান্ড রিপোর্ট’ নামে পরিচিত এই প্রতিবেদনে টেকসই উন্নয়নের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে সেই উন্নয়ন, যা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতাকে হ্রাস করবে না। আমাদের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প এই টেকসই উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে মেলে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার উদ্বাস্তুরা অন্তত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য-সহযোগিতা ও সহানুভূতি পায়। রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়, তারাও বিশ্বের নজর কাড়ে। কিন্তু উন্নয়নের শিকারে পরিণত উদ্বাস্তুরা পড়ে সবচেয়ে বিপদে
বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বাঁশখালীর মানুষ এত মরিয়া আচরণ দেখাল কেন? উত্তরটি খুব সহজ; তারা কেউ তাদের জমি-জিরাত হারাতে চায় না, তারা কেউ উন্নয়নের উদ্বাস্তু হতে চায় না। আগেই বলেছি, উন্নয়নের উদ্বাস্তুরা দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় উদ্বাস্তু। কারণ একই রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে ‘আমরা’ আমাদের চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে ‘তাদের’ উদ্বাস্তু করি। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে বিদ্যুৎ চাই ‘আমরা’ আর মরছ ‘তোমরা’! আধুনিক যুগের উন্নয়ন উদ্যোগ ও ধারণার মধ্যে সংবেদনশীলতা বিষয়টি সে কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। জমি-জিরাত হারানোর ভয় যে জনগোষ্ঠীকে পেয়ে বসে, যারা উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তাদের আশ্বস্ত করা ও আস্থায় নেওয়ার দায়টি সরকার ও রাষ্ট্রের।
একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। এ কাজের জন্যও বিপুলসংখ্যক লোককে তাদের বসতবাড়ি থেকে সরতে হয়েছে। বাপ-দাদার ভিটামাটি হারাতে তাদের যতই কষ্ট হোক, সেটাকে সামাল দেওয়া গেছে পরিকল্পিত পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমে। উন্নয়ন উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবিলার এটাই পথ। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে যা পারা গেল, বাঁশখালীর ক্ষেত্রে তেমন হলো না কেন? বোঝা যায়, বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণকে আস্থায় নেওয়ার যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
উন্নয়ন যদি দেশ বা জনগণের স্বার্থে হয়, তবে সেখানে মানুষের কথা শুনতে হবে, তাদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নিয়েই কাজে হাত দিতে হবে। জনসম্মতি নিয়ে উন্নয়ন করতে সমস্যা কোথায়? উন্নয়ন তো কোনো জবরদস্তির বা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। উন্নয়নের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করা হলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে—এই নিশ্চয়তা ও আস্থা না পেলে লোকজন তার জমি-জিরাত ছাড়বে কেন? উদ্বাস্তু হতে কে চায়! বাঁশখালীতে এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছিল আগে থেকেই। জনগণকে বোঝানো বা আস্থায় নেওয়ার চেষ্টা সম্ভবত কর্তৃপক্ষের কাছে দরকারি মনে হয়নি। এর চেয়ে চরম পথ বেছে নেওয়াটাই তাদের কাছে সহজ মনে হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর কাজটি সহজ হলো না আরও কঠিন হলো? জমি ও ভিটামাটি রক্ষায় জীবন দেওয়ার পর সেখানকার লোকজনের পক্ষে তো এখন পেছানো কঠিন। তাদের তো আরও মরিয়া হয়ে ওঠার কথা।
উন্নয়নের আধুনিক ধারণায় সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য সমন্বিত মনোভঙ্গির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বলা হয়, মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাইলে উন্নয়ন পরিকল্পনা, নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদান যুক্ত করতে হবে। বর্তমান সময়ে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতের ও আঞ্চলিক উন্নয়নের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। একই সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ, দূষণ, নারী, বাসস্থান, ক্ষুধা ও কর্মসংস্থানের মতো ইস্যুগুলো একটার পর একটা সামনে চলে আসে। ফলে সম্পদের বণ্টনসহ এগুলোর প্রতি সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্ব দেওয়া দরকারি হয়ে পড়ে। যেকোনো উন্নয়ন উদ্যোগে যে দুটি সমসাময়িক বিষয়ে নজর দেওয়ার দরকার, তা হলো মানবিক নিরাপত্তা ও টিকে থাকার সক্ষমতা। বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথাই বলি বা রামপালের কথাই বলি, উন্নয়ন চিন্তার আধুনিক ধ্যানধারণার কিছুই এসব ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
কোনো উন্নয়ন উদ্যোগ বা বাস্তবায়নে যদি ‘আমরা’ বা ‘তোমরা’ চলে আসে, তখনই সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাঁশখালীর জনগণকে যেহেতু ‘উন্নয়ন’ উদ্যোগের সঙ্গী বা ‘আমরা’য় পরিণত করা যায়নি, তাই যা হওয়ার কথা তা-ই হয়েছে। সামনের যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাঁশখালী আমাদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকুক। মানুষকে যেন আর কখনো আমরা উন্নয়নের শিকারে পরিণত না করি।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments:

Post a Comment