Thursday 28 April 2016

সিপিএম ফিরে এলে কার লাভ?---------------- সম্রাট সেনগুপ্ত

এই বাজারে সিপিএমের বিরোধীতা করলেই তৃনমূল ভাবছে লোকে। অথচ অতিবাম বুদ্ধিজীবিরা সেই আলথুজারের স্ট্রাকচারাল মার্ক্সিজমের ইকনমি ইন দা লাস্ট ইনস্টান্সের মতো বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাম বুদ্ধিজীবিদের যতই সিপিএম সমালোচনা থাক তাদের সমর্থনে সিপিএম ইন দা লাস্ট ইনস্টান্স। তৃনমূল সরকারে আছে তাই প্রবল সিপিএম বিরোধীতা তাদের সুবিধা করে দেবে এই ছুতোয় যারা সিপিএমের সমালোচনা করছেন তাদের বলা হচ্ছে সুবিধাবাদী আর যে হেতু তৃনমূল সরকারে আছে তাই তার বিরোধীতা করলেই সে বীর বিপ্লবী! তবে সেই সব বিপ্লবীদের স্মৃতি শক্তি বড়ই দূর্বল - পাঁচের আগের চৌঁত্রিশ বছর এতো সহজে ভুলে গেলেন - ভুলে গেলেন মরিচঝাঁপি থেকে নন্দীগ্রামের হত্যার জিনিওলজি! কেমন সরিশার মধ্যে প্রেত মনে হইতেছে না? সিপিএম ফিরে এলে কার লাভ? কেন বাঙালি স্বভাবতই বামপন্থি হওয়া স্বত্বেও - তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবির সংখ্যা এতো বেশি হওয়া স্বত্বেও কেন সিপিমের গণহত্যাগুলোর নন্দীগ্রাম পূর্ববর্তি পর্যায়ে কোন গুরুত্বপূর্ন সমালোচনা হয়নি? কেন? এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবিদের সাথে তবে কি সিপিএমের কোন আইডিওলজিকাল আন্তঃসম্পর্ক আছে? কেউ কেউ ভাবছেন নাকি তৃণমূল ক্ষমতায় এলে এবিভিপির মিছিল বুঝিবা আর যাদবপুরের গেট অবধি এসে ফিরে যাবে না - সরাসরি ভিতরে ঢুকবে। বাস্তব কি তাই বলে? এই রাজ্যের পুলিশ কর্তৃক এবিভিপিকে ফেরত পাঠানো হয় যাদবপুরের দোরগোড়া থেকে। সুগত বসু জেএনইউ কান্ডে ছাত্রদের কাজের কিছু সমালোচনা করেও (কেউ তা সমর্থন করবেন কি না অন্য কথা তবে গণতন্ত্রে সমালোচনা স্বাস্থ্যকর) প্রকারন্তরে ছাত্রদের উপর বিজেপির আক্রমনের নিন্দাই করেন। হোক কলরবে শেষ অবধি বিরোধীতা স্বত্বেও মূখ্যমন্ত্রি ছাত্রদের দাবী মেনে নেন। আচ্ছা দিল্লিতে এবিভিপির থেকে কি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলি যুব সংগঠন দূর্বল? যাদবপুরের আন্দোলন ভাঙতে যদি আশেপাশের কলেজের সব তৃণমূলি ছাত্রদের একত্রিত করা হতো পরিস্থিতিটা কি দাঁড়াতো। এবিভিপির আর অভিযানের দরকার পরত না, অনেক আগেই আক্রান্ত হতো যাদবপুর। তা হয় নি। তাহলে কেন এই বিপন্নতা? কেন র‍্যাডিকাল বামেরা ভুলে গেলেন যে কোন বিরুদ্ধ মতকে কি করে ম্যানেজ করত সিপিএম। সমাজতত্বের ছাত্র হিসেবে জেনেছি যখন মেটেরিয়াল বাস্তবের সাথে বোধের ফারাক থাকে তার ব্যাখ্যা দিতে পারে মতাদর্শ বা আইডিওলজি। পশ্চিমবঙ্গের বাম আইডিয়ালিজমের সাথে মধ্যবিত্ত আইডিওলজির একটা সংঘাত রয়েছে। তার রূপ আমরা দেখেছি নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় - সে ছিল মধ্যবিত্ত আইডিওলজির সাথে বাম আইডিয়ালিজমের সংঘাতের কাল। যার কারনে দু দুবার ভাঙে কমিউনিস্ট পার্টি। আর নকশাল দমনের পর বাম আদর্শবাদ ক্রমশঃ অন্তঃসার শূন্য একটি নাম সংকীর্তনে পরিণত হয় - কতগুলো স্লোগান, কতগুলো বার্তালাপ, কতগুলো নাম, কিছু গান আর কিছু অতীতের ঐতিহাসিক গল্প - এই আধারগুলি টিকিয়ে রাখে সিপিএম। নিওলিবারেল যুগে একটি যায়মান সময়ের ইতিবৃত্ত আঁকড়ে বাঁচে বাঙালি মধ্যবিত্ত বাম বুদ্ধিজীবি। তার কলোনিয়াল সুবিধাবাদী জারজ লেগাসি স্থিতাবস্থা টিকিয়ে রাখে বাম নাম সংকির্তনে। সর্বহারা, শ্রেণিবৈষম্য, সমাজতন্ত্র, লেনিন-স্ট্যালিন-মাও-হো লাল সেলাম, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশেনাল, সর্বহারার রাজনীতি সব এক ভাঙা রেকর্ডের মতো চালিয়ে বুঁদ হয়ে থাকে বাঙালি মধ্যবিত্ত। এদিকে ভাবের ঘরে চুরি হয়ে যায় - ঘটে যায় স্বজনপোষন, রাজনীতির দূর্বৃত্তায়ন, একাধিক গণহত্যা। নন্দীগ্রাম অবধি অপেক্ষা করতে হয় সুশিল সমাজকে বুঝতে যে কমরেডরা আর সর্বহারার পক্ষে নেই। তবে এই ফাটল ক্ষণস্থায়ী। মধ্যশ্রেণির স্মৃতিমেদুরতার মধ্যে হয়ত সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকেই যাবে - বুদ্ধিজীবিরা গল্প করবে কি করে তারা এনেছিলেন ১৩ই মে, ২০১১-র বিপ্লব, আনন্দবাজারও নিশ্চয়ই কিছু কৃতিত্ব দাবী করবে। থাকবে না নামপরিচয়হীন ভদ্রলোক শ্রেণীর বাইরের সেইসব নাম যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যারা এনেছিলেন এই বৈপ্লবিক মূহুর্ত যেখানে হয়ত বিশ্বের সেই দূর্লভ ঘটনা ঘটল - নিওলিবারেল এই অর্থব্যবস্থায় যেখানে জমিদখলকারী হেরে গেল। কারন ১৯৬৮-র ফরাসী ছাত্র বিপ্লবের স্লোগান অনুযায়ী সর্বহারাদের কিছু হারানোর থাকে না শিকল ছাড়া। সরকারী শিকল ভাঙল তারা, জিতল না যদিও, সাত ফসলি জমি নিস্ফসলি হয়ে গেলো কমরেডদের ঐতিহাসিক ভুলে। না না আমি এক নতুন শব্দ ব্যবহার করছি আজকাল। ঐতিহাসিক ঠিক। এটাই সিপিএমের প্রকৃত শ্রেণি চরিত্র - অতএব ঐতিহাসিক ঠিক - তা কিছু কিছু বিশেষ মূহুর্তে প্রকাশিত হয়। যারা এই জনগণতান্ত্রিক ঐতিহাসিক ঠিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল তাদের ভোটবাক্স ছাড়া অস্তীত্ব নেই। তারা বাঙালি ভদ্রলোকের ডিসকোর্সে অনুপস্থিত - অদৃশ্য। অপরদিকে রইল সাংস্কৃতিক পেশি সর্বস্ব বাম বুদ্ধিজীবি। সিপিএম কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশেনাল চালালে, লাল পতাকা দেখলে যাদের বুক হা হা করে। এরা কেউই নন্দীগ্রাম পূর্বে জমি অধিগ্রহনের বিরুদ্ধে কোন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি, কেবল নন্দীগ্রামের স্বতঃসফুর্ত প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়ে নাম কিনেছেন। তাই এরা সব কিছু খুব তারাতারি ভুলে যেতে বাধ্য। আইডিওলজি তো অনেকটাই নিশ্চেতনে থাকে। সব সময় তা সচেতন নয়। সিপিএম সংস্কৃতির নিশ্চেতনে আছে বাঙালি মধ্যবিত্ত মতাদর্শ যা নিজেদের শ্রেনীস্বার্থ রক্ষাকারী এবং সেই স্বার্থের সাথে সর্বহারা শ্রেণীর উত্থানের বুদ্ধিজৈবিক সমর্থনের যে সংঘাত আছে তাকে ভুলিয়ে রাখার আফিম। নিরপেক্ষ থাকাটা এই শ্রেণীর একটা ভান। সরকারে থাকা দলকে অন্ধ সমর্থন না করেও তাদের নির্বাচনে জয়ি হওয়ার আশা করাটা এদের কাছে লজ্জার। অথচ সিপিএম এবং কংগ্রেসের অশুভ জোটের আকাংখা করাটা এদের কাছে নিরপেক্ষতা। হবে নাই বা কেন? পাড়ার মোড়ে মোড়ে ফাটা রেকর্ডে রবীন্দ্রসংগীতের বদলে জাগো জাগো সর্বহারা বাজালে শুনতে আরেকটু ভালো লাগতো বৈকি! এই পাঁচ বছরে তৃণমূলের সব থেকে বড় ব্যর্থতা তাঁরা ইন্টেলেকচুয়াল হেজিমনি তৈরি করতে পারে নি। যাদবপুরের হোক কলরবের একাংশের স্লোগান শুনলেই সেটা বুঝবেন - "কালিঘাটের ময়না, এখানে এসব হয় না।" এদের কেউ কেউ আবার হোককলরবের বিরোধী মিছিলটাকে ঝি ক্লাসের মিছিল বলেছিল। শ্রেণি চরিত্রটা কি খুব অস্পস্ট? এবার যদি হোক কলরবের পক্ষে এতো কিছু লেখার পড়েও কোন কোন ভদ্রসন্তান আজকের এই পোস্টটা পড়ে মনে করেন আমি ঐ বিরোধী মিছিলটায় ছিলাম, তাহলে কি আমার 'বাবু' হয়ে বসতে পারি না বলে লজ্জিত হওয়া উচিত? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।

No comments:

Post a Comment