Monday 4 April 2016

পরিবর্তন কি কিছু হল? দীপঙ্কর দে



পরিবর্তন কি কিছু হল?        দীপঙ্কর দে

পরিবর্তন কি কিছু হল? অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে পারি হয়েছে। সাথে উন্নয়নও। এই লেখা যারা অর্ন্তজালে পড়বেন তাঁরা পরিসংখ্যান প্রিয়। তাই একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করি। ২০১০-১১ সালে এ রাজ্যের বার্ষিক উৎপাদন(GSDP) ছিল ৪.৬১ লক্ষ কোটি টাকা। চার বছর বাদে ২০১৪-১৫ তে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.০১ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬-র হিসেব পাওয়া যায়নি এখনও। তবে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১২.৫% ধরলে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৯ লক্ষ কোটি টাকা। যার অর্থ, গত পাঁচ বছরে রাজ্যের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এবং এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যভিত্তিক জিএসডিপি’র নিরিখে পাঁচ নম্বর স্থানে (সূত্র-state domestic product and other aggregates 2004-05 series, ministry of statistics and programmed implementation, Gov. of India)। এখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে এগিয়ে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট আর তামিলনাড়ু। এ রাজ্য এখন ধান উৎপাদনে ভারতের মধ্যে প্রথম। গত কয়েক বছরে মাছ, সব্জি, ডিম, মুরগী ইত্যাদি দৈনন্দিন সামগ্রীর উৎপাদন ও যোগান বেড়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। প্রায় প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে, কমেছে স্কুল ছুটের সংখ্যা। ‘কন্যাশ্রী’ এখন প্রধান আলোচিত প্রকল্প। ‘জল ধরো জল ভরো’ কর্মসূচী বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। পরিকাঠামো তৈরী হয়েছে – মান হয়তো ততটা বাড়েনি। একই কথা প্রযোজ্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। দুটো ক্ষেত্রেই মূল কারণ, ঘুঘুর বাসা ভাঙ্গা যায়নি বা ভাঙ্গা হয়নি। মোটা দাগে এগুলিই হচ্ছে আর্থিক উন্নয়নের মাপকাঠি। পরিসংখ্যান দিয়ে এ’লেখা অহেতুক ভারী করলাম না। বরং কি করে এই অসাধ্য সাধন হল সেটাই ভেবে দেখব আমরা। পাঁচবছরে রাজ্যের একটা বিধ্বস্ত অর্থব্যবস্থাকে টেনে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়।
গ্রাম বাংলার হাল কেমন ছিল ২০১০-১১ সালে, বামফ্রন্টের ৩৪ বছর শাসনের পর? এখন সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক (সূত্র:SECC 2011)। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলার ৭৭.৩৬ শতাংশ পরিবার বাস করতেন গ্রামে। নিরক্ষরতার হার ছিল ৩৩.৫৮ শতাংশ। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে উত্তরণের হার ছিল যথাক্রমে ৬.৮ শতাংশ ও ৩.৫ শতাংশ। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর উত্তরণের হার ছিল মাত্র ২.৬৭ শতাংশ। সেই সময় গ্রামবাংলার মাত্র ৮.৫ শতাংশ গৃহে কেউ স্থায়ী চাকরী করতেন। ৮২.৪৭ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারের কারও সর্বোচ্চ মাসিক আয় ৫০০০ টাকার বেশী ছিল না। উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শাসন শেষ হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলোই ছিল নগর কলকাতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। সেই ১৭৪১ সালে বর্গীরা গ্রাম বাংলা লুঠের যে পরম্পরা নির্মাণ করেছিল – তাই অব্যাহত রেখেছিল এ’রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার।
নূতন সরকার এসে সর্বপ্রথম অর্থনীতির এই অভিমুখটাকে বদলে দিল। বাংলার গ্রাম – নগর কলকাতার উপনিবেশ, এই প্রচলিত ধারণাকেই আঘাত করল। কলকাতা কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সরে গেল গঙ্গার ওপারে। উত্তরবঙ্গের জন্য শিলিগুড়িতে নির্মাণ হল ভিন্ন দপ্তর। এবং সরকারি কাজের তদারকি করতে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর গোটা মন্ত্রীসভা ও আমলাদের নিয়ে পৌঁছে গেলেন প্রতিটি জেলায়। এটা যে এ’দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার সাবেকি চিন্তাধারায় কতবড় পরিবর্তন তা কলকাতায় বসে অনুধাবন করা যাবে না।
মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন বড় শিল্পের মরীচিকার পিছনে ছুটে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তাঁরা ভরসা রাখলেন গ্রামীণ শিল্পের ওপর। তাঁতি, চাষি, কামার, কুমোর, ছুতোরের উপর। মাত্র কয়েকশো বছর আগেও তো বাংলা ছিল ‘পৃথিবীর তাঁত ঘর’। বাউল, চিত্রকর, পটচিত্রী, পুতুল, মিষ্টি, সুগন্ধী-চাল, কী নেই এ বাংলায়? দরকার শুধু একটু পরিকল্পনা। তৈরি হল ‘বিশ্ববাংলা’ ব্র্যান্ড। হোক না খণ্ডিত বাংলা তবু কম কিসে! পুনরুদ্ধার হল হারিয়ে যাওয়া মসলিন, লুপ্ত প্রায় পুতুল, হাজারো কৃষি বীজ। লৌকিজ্ঞান ভিত্তিক এক নূতন অর্থব্যবস্থার জন্ম দিল পশ্চিমবঙ্গ। যার ভরকেন্দ্র বাংলার প্রতিটি গ্রাম। চিরাচরিত অর্থনীতির দর্শনে এটাই মূল পরিবর্তন। এই অভিমুখটা বদলে দেওয়ার ফলে বাকী যা যা ঘটেছে তা অর্থনীতির নিয়মে ঘটেছে। যেমন ধরুন, বেসরকারী বড় পুঁজি বিনিয়োগ না হলেও, সরকারি ব্যয় বাড়ার দরুন (রাস্তাঘাট তৈরী ইত্যাদি) অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে, গ্রামীণ হস্তশিল্প, লোকশিল্পকে অনুদান দেওয়ার ফলে চাহিদা বেড়েছে, বাজারে-তার একটা ‘মাল্টিপ্লায়ার’ এফেক্ট হয়েছে। কাজে শৃঙ্খলা আসার দরুন শিল্পোৎপাদন বেড়েছে। এখন ব্যাঙ্কগুলোও বাংলায় বেশী করে ঋণ দিচ্ছে।
আরও একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে যা নিয়ে কেউ আমরা আলোচনা করছি না। ক’বছর আগেও এই রাজ্যে কয়েকশো NBFC, সারদা, রোজভ্যালী, ইত্যাদি গ্রামবাংলা থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা কলকাতা, শিলিগুড়ি, মালদা,আসানসোলে পাঠাত। সেই টাকার বেশীর ভাগই গ্রামে ফিরত না। সঞ্চয়িতার আমল থেকেই এই লুঠ চলছিল। হালে তা বন্ধ হয়েছে। গ্রামের টাকা গ্রামেই বিনিয়োগ হচ্ছে বা খরচ হচ্ছে। এটাও একটা বড় পরিবর্তন।
সব শেষে বলব, একটা আর্থিক পরিবর্তন কিন্তু তখনই সম্ভব যখন এক বিশাল জনগোষ্ঠী সত্যিই মনে করে তারা সফল হতে পারে। বিগত প্রায় পাঁচ দশকে বাংলা শুধু শুনে এসেছে ‘হবে না’ ‘চলবে না’ ‘বন্ধকরো’ ‘পিছন দিকে এগিয়ে যান দাদা’। কেউ বাংলার ঐতিহ্যময় ইতিহাস নিয়ে কথা বলেনি। এই প্রথম কেউ বলছে জোর গলায় ‘Bengal leads’, ‘এগিয়ে বাংলা’। ভেঙ্গে পড়া অর্থব্যবস্থার পুনঃনির্মাণে, বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশের পক্রিয়ায়, এই দুটি শব্দ কম কার্যকরী নয়।
কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন এই নূতন অর্থব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী? উত্তর – খুব ভালো, যদি না রাজনৈতিক পালাবদল হয়(যার সম্ভবনা কম)! প্রথমত, রাজ্যের ডেট–জিএসডিপি (debt GSDP ratio) অনুপাতের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। ২০১০-১১ সালে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লক্ষ টাকা। জিএসডিপি’র পরিমাণ ছিল প্রায় ৪.৬১ লক্ষ কোটি টাকা। তাহলে অনুপাত দাঁড়াল ৪৩ শতাংশ। প্রতি বছর কেন্দ্রকে ২৮,০০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ করতে ও নানা উন্নয়নমূলক কাজ করতে গত পাঁচ বছরে রাজ্য আরও প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের GSDP ২০১৫-১৬ তে প্রায় ৯ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মোট ঋণ (আগের ঋণসহ) যদি আনুমানিক ৩ লক্ষ কোটি টাকা হয় তবে বর্তমানে ডেট – জি এস ডি পির অনুপাত দাঁড়াবে ৩৩ শতাংশ। পাঁচবছর আগে যা ছিল ৪৩ শতাংশ। এ অবস্থায় রাজ্য অনেক কম সুদে টাকা ধার করতে পারবে। প্রয়োজনে বিদেশী ব্যাঙ্ক থেকেও ধার নিতে পারবে নাম মাত্র সুদে। সেই টাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ শোধ করলেই প্রতি বছর আর সুদের বোঝা বইতে হবে না। আরও একটি লক্ষনীয় পরিবর্তন ঘটেছে সরকারের কর আদায়ের ক্ষেত্রে। বামআমলের শেষ পাঁচ বছরে (২০০৬-৭ থেকে ২০১০-১১) রাজ্যের মোট কর আদায়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৭,৯৩৫ কোটি টাকা। পরবর্তী পাঁচ বছরে (২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬) তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৭৯,৮১৯ কোটি টাকায়। বৃদ্ধির পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশী। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে চোখের সামনে এক বিকল্প উন্নয়নের মডেল নির্মাণ হতে দেখছি প্রতিদিন। যা আমার কেতাবী শিক্ষার নাগালের বাইরে। এই উন্নয়নের কুশীলব গ্রাম বাংলার লক্ষ লক্ষ জ্ঞানী কারিগর। যাদের বহুবছরের অর্জিত ও লালিত জ্ঞানকে গত প্রায় তিনশো বছর ধরে আমরা অবজ্ঞা করেছি, অবহেলা করেছি, ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বার বার। কখনো সরাসরি কখনো বা মুখোশের আড়ালে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান অর্থব্যবস্থায় যারা কাণ্ডারী, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগপতিরা, তাদের প্রায় সবারই শিকড় এই বাংলায়। বামফ্রন্ট সরকার দীর্ঘদিন ধরে তাদের এক জগদ্দল পাথর দিয়ে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে স্রেফ রাজনৈতিক কারণে। নেতারা মনে করতেন স্থানীয় উদ্যোগপতিরা সবল হলে, তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ চাইবেন। বামফ্রন্টকে চ্যালেঞ্জ করবেন। তাই স্থানীয় উদ্যোগপতির পরিবর্তে বাম সরকার ভিনরাজ্যের, এমনকি ভিনদেশীয় উদ্যোগপতিদের স্বাগত জানাত, সেই সব উদ্যোগপতিদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আকাঙ্খা থাকবে না বলে। বর্তমান সরকার স্থানীয় উদ্যোগপতিদের উপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে চাপিয়ে রাখা জগদ্দল পাথরটা সরিয়ে দিয়েছে। পাথরচাপা সাদা ঘাসগুলো সবে আস্তে আস্তে সবুজ হতে শুরু করেছে। এবার তার বিস্তারের পালা।
ল‍েখক- ডিন, আই বি এস বিজনেস স্কুল, কলকাতা।

No comments:

Post a Comment