Thursday 21 April 2016

আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত ----------------- শর্মিষ্ঠা নাথ

আমার মুখে অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনার ক্ষত

‘আমার বুকে পালানোর পালানোর আরো পালানোর দেশজোড়া স্মৃতি’। কোনও ক্ষত, কত

গভীর ও দুরারোগ্য হলে তাকে ‘অন্তহীন আত্মলাঞ্ছনা’র মত শব্দবন্ধ দিয়ে ধরা যায়

গেইল তুরিনের ‘আতঙ্কের দেওয়ালঃ বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত’ (অনুবাদ- অসিত রায়,

প্রথম প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ, জানু ২০১৬) বইটি দেখতে দেখতে সেই অনুভূতি

হচ্ছিল। হ্যাঁ পড়া নয়, দেখা শব্দটাই ব্যবহার করলাম। কারণ বইটিতে রয়েছে মূলতঃ

তুরিনের তোলা ১৯৯২ সাল থেকে তৈরি ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর ৩,২০০

কি.মি. ব্যাপী দেওয়াল ও কাঁটাতারের বেড়ার দু’পাশের মানুষের রোজকার জীবন

সংগ্রামের বেশ কিছু ফটোগ্রাফ। ফটোগুলি রঙীন নয়, সাদা-কালো কারণ যাদের

জীবনচর্যার ছবি তিনি ধরেছেন তাদের জীবনে অন্য কোনও রঙ নেই।তাদের

জীবনযুদ্ধ  কোনও মহত্তর উত্তরণের স্বপ্ন দেখায় না, বরং তা প্রতিপদে সন্তর্পণে

মৃত্যুকে এড়িয়ে চলে।কাঁটাতারের বেড়ার জিরো পয়েন্ট থেকে ৮কিমি অর্থাৎ ১৮,০০০

ব্যাপী গ্রাম ও কৃষিজমিতে অবস্থানকারী দুইকোটি মানুষের দণ্ডমুণ্ডের মালিক

বি.এস.এফ যারা সীমান্তে নজর রাখে ও দেশান্তরী মানুষের চলাচলকে প্রতিহত করে।

তাদের আইন, স্বেচ্ছাচার, জুলুম, আত্যাচার ও সর্বোপরি ঐ মানুষগুলোর সঙ্গে তাদের

মানসিক সংযোগহীনতা রোজকার ঘটনা। মানবাধিকার সংগঠন Human Rights

Watch- এর মতে বি এস এফের হাতে ১০ বছরে হাজারখানেক মানুষের মৃত্যু

হয়েছে। তুরিনের তোলা ফটোগ্রাফ গুলির নীচে পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু তা প্রায় প্রতেই

হয় না কারণ ফটোগুলি ‘speak for themselves’।এদের চরিত্রগুলির চোখে, মুখে ও

সমস্ত শরীরী বিভঙ্গে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক, অসহায়তা, মূঢ়তা, বিস্ময়, প্রশ্ন ও

বোবাকান্না। কোনও ছবিতে কোনও মুখরতা বা উচ্ছ্বাস নেই। এক ব্যাপক

ভাষাহীনতায় তারা আক্রান্ত। কোন পাপের উত্তরাধিকার বহন করছে জীবন মৃত্যুর

কাঁটাতারের উপর ঝুলতে থাকা এই মানুষগুলো? কোন দুঃসহ অতীত এই বিপন্ন

বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্ম দিয়েছে? তাকে বারবার ফিরে দেখা কি আমাদের

ঔচিত্যবোধের অন্তর্গত নয়? নাকি সেই ইতিহাস নঞর্থকতাকে, বীভৎসতাকে ও

হিংস্রতাকে তুলে ধরে বলে তাকে লালন করবার কোনও দায় আমাদের থাকবে না।

অনেকেই এ প্রসঙ্গ তুলেছেন যে দেশভাগের সময় ’৪৭-এ সমস্ত মানুষকে যেহেতু

সাম্প্রদায়িক ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাই সেই সময়ের ঘটনা দেখতে গিয়ে

একজন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় হিসাবে খানিকটা সতর্ক হওয়াটাই কি কাম্য নয়?

নৈতিকতার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন উর্বশী বুটালিয়া তাঁর ‘The Other Side of

Silence’ লিখতে গিয়ে। তাঁর প্রশ্ন, যা আমি জেনেছি তার সব প্রকাশ করলে

দক্ষিনপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের হাতে কি বিপজ্জনক মালমশলা তুলে দেওয়া হবে না? ‘ I

am torn between the desire to be honest and to be careful’, ‘Seminar’

পত্রিকার ৪৬১ নং সংখ্যায় জাবিদ আলম বলেছিলেন যে, নতুন প্রজন্মের কাছে

দেশভাগ এক দূরের ঐতিহাসিক ঘটনা, সে অভিজ্ঞতার বীভৎসতাকে ভুলে গেলেই

আমাদের নিত্যকার জীবনযাপন স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এই বক্তব্যের প্রতিবাদ

করেছেন জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে তাঁর ‘Remembering Partition’ গ্রন্থে। তাঁর মতে, আমাদের

নীরবতাই বরং দক্ষিনপন্থী ঐতিহাসিকদের হাত শক্ত করবে। আর পাণ্ডে যেটা

বলেননি তা  হল, ভুলে গেলেই যদি নিত্যদিনের জীবনযাপন স্বাভাবিক হত,

তাহলে গুজরাটের নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটতোনা। তাই আমাদের রাজনীতির

অতীত, ভবিষ্যতকে বুঝতে গেলে, বর্তমানকে চিনতে গেলে, বারবার আমাদের

দেশভাগের দিনগুলি পুনরালোচনা করতে হবে।

       ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়কর ঘটনা দেশভাগ।

যুদ্ধ নেই, আপাতত সব শান্তিকল্যান হয়ে আছে এমন পরিস্থিতিতে মানব

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণপ্রব্রজন ঘটেছে ভারতভাগের ফলে। Reflections

on Exile প্রবন্ধ সঙ্কলনে Edward Said বর্তমান যুগকে ‘the age of

refugees, of displaced persons, mass immigration’ বলেছেন। তার

মধ্যে বঙ্গবিভাগ বৃহত্তম ‘never before or since, in human history,

there has been such a mass exodus of people ’।ছিন্নমূল মানুষ

ভিটেমাটি, দেশ, চিরাভ্যস্ত জীবন ছেড়ে অনির্দেশ্যের পথে পাড়ি দিয়েছিল।

গণনাতীত মৃত্যু, অগণিত ধর্ষণ, চূড়ান্ত নির্মমতা তাদের জন্য রাস্তায় ওত

পেতে বসেছিল। অনেক জীবন পথে বিপথে, শিবিরে, দেশান্তরে চিরকালের মত

হারিয়ে যায় আর যারা থেকে যায় তারা বেশিরভাগই ‘রুগ্ন, অভুক্ত, অস্নাত,

হাজার লোকের পুতিগন্ধ জনতা’। শিকড়ের সঙ্গে যে চিরকালীন বিচ্ছেদ সূচীত

হল তাদের ‘ the unhealable rift forced between a human being and

a native place, between the self and the true home’ তার বেদনা

কোনোদিন তারা অতিক্রম করতে পারেনি।এবং এটাতো আজ তর্কাতীত ভাবে

প্রমাণিত যে পূর্বপাকিস্তান/ পূর্ববঙ্গ/বাংলাদেশ থেকেই মূলত হিন্দু

জনগোষ্ঠী যূথবদ্ধভাবে ও ধারাবাহিক ভাবে ভারতে চলে এসেছে বা আসছেন।

একথা বিধান রায়ের মন্ত্রিসভাতেই পুনর্বাসনমন্ত্রী রেণুকা রায়

বলেছিলেন ‘the exodus was an one-way affair’. ১৯৪৬-৪৭ সালে

নোয়াখালির ত্রিপুরার দাঙ্গায়, ইস্লামিক রাষ্ট্রে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির

নাগরিকে পর্যবসিত হওয়ায়, হায়দ্রাবাদের মত পূর্ববঙ্গেও ভারত

আক্রমণ করতে পারে এই অনুমানে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ফলে তাদের

দেশত্যাগ ঘটে। অথচ নেহরু-লিয়াকত চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের

নিরাপত্তা দেওয়ার ফলে বহু চলে যাওয়া মুসলমান বাঙালি এখানে ফিরে

এসেছে। কিন্তু পূর্বপাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দুরা চলে এসেছে তাদের

সম্পত্তি সম্পর্কে কঠোর আইন প্রবর্তিত হয়েছে। ১৯৫২-৬০ কালপর্বে

বাঙালি হিন্দুর দেশত্যাগ ঘটে পাসপোর্ট প্রবর্তনের ফলে, দাঙ্গার ফলে ও

সম্পত্তি বিক্রয় সংক্রান্ত আইনের ফলে।বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের দরুন ২০ লাখ একরের বেশি

জমি হারিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এই নির্গমন অব্যাহত।

খালেদা জিয়ার নির্বাচন জয়ের পরই চলে আসা হিন্দুর পরিমাণ আরও বেড়ে

গেছে। ১৯৯৪ সালে Holiday প্রত্রিকায় প্রকাশিত The Missing

Population প্রবন্ধে মহীউদ্দিন আহমেদ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে,

১৯৭৪ সাল থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪৭৫ জন হিন্দু বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে

হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রেম হুগো তাঁর ‘Illegal International Migration in Asia”

প্রবন্ধে বাংলাদেশের ১ কোটি হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা বলেছেন। এরা শুধু

হিন্দু না, মুসলমানও যাদের বেশির ভাগ ভারতে এসেছে।

     একথা ঠিকই যে পূর্ববঙ্গে বর্ণহিন্দুদের দ্বারা উপেক্ষিত ও শোষিত নিম্নবর্ণের

হিন্দুরা, মূলত নমঃশূদ্র কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী ইত্যাদিরা প্রথমে পূর্বপাকিস্তান ছাড়ার

কথা ভাবেনি। মুসলিম কৃষিজীবী ও নমঃশূদ্র দুই social underdog হাত মেলানোয়

বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধি কংগ্রেস অখণ্ড বাংলায়

ক্ষমতাচ্যুত ছিল।পাকিস্তান কায়েম হওয়ার সময়ে মুসলিম লীগ তাদের প্রতি নিপীড়ন

অবসানের যে ওয়াদা দিয়েছিল তা পূরণ করেনি। প্রথম দিকে দেশ না ছাড়লেও

মধ্যবিত্ত হিন্দুভদ্রলোকেরা চলে গেলে তারা নিরাশ্রয় বোধ করতে থাকে। সবচেয়ে

মর্মান্তিক আঘাত এরা পেয়েছিল ‘ধর্মান্তরিত করায় ও মেয়েদের সম্ভ্রমহানিতে’।

ফরিদপুর, ঢাকা, মৈমনসিং, বরিশাল, যশোর ও খুলনা জেলায় বসবাসকারী শ্রমমাত্র

সম্বল এই মানুষগুলি ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেন।

   বর্ণহিন্দু মানুষজন , যারা পূর্বপাকিস্তানে থাকাকালীনই ভারতে সম্পত্তি বিনিময়

করতে বা কিনতে পেরেছিলেন তাঁরা মুলতঃ কলকাতা ও তার আশেপাশে উত্তর চব্বিশ

পরগণায় বসতি গড়েছিলেন। দক্ষিণদিকে ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, বিজয়গড় থেকে উত্তরে

দমদম, বরানগর, নিউব্যারাকপুর ইত্যাদি অঞ্চলে জবরদখল কলোনি গড়ে ওঠার যে

ইতিহাস উদ্বাস্তু জনগণ তৈরি করেছিলেন, তাতেও মুলতঃ বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ই অগ্রণী।

আর তপশিলী জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় বাঙালি হিন্দু শেয়ালদা রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম হয়ে

রাণাঘাট, ধুবুলিয়ার ভয়াবহ ক্যাম্প থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন আন্দামান, নৈনিতাল

বা দণ্ডকারণ্যে। এই ‘lesser mortals, situated at the periphery’- র কী হল?

আন্দামানে পাঠানো বাঙালিরা যেন অন্তর্ধান করে গেল বাঙালির চৈতন্য থেকে। আর

মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, অন্ধ্রের বনাঞ্চল দণ্ডকারণ্যে পাথুরে রুক্ষ জমি, বৃষ্টিপাত বিরল

অঞ্চলে  যেসব নদীর দেশের মানুষ গুলিকে পাঠানো হল তাদের মর্মান্তিক পরিণতি তো

আজ সকলেরই জানা। বিরোধী পক্ষে থাকাকালীন বামফ্রন্ট তাদের পশ্চিমবাংলায়

ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, যা শাসক হওয়ার পরে তারা অচিরে ভুলে যায়। তবু

তাদেরই কিছু মন্ত্রীর প্ররোচনায় দণ্ডকারণ্য থেকে ১৯৭৮-এ ফিরে আসা সুন্দরবনের

মরিচঝাঁপিতে উপনিবেশ গড়ে তোলা মানুষগুলি বামফ্রন্টের পরিকল্পিত দমননীতির

শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে ১৯৭৯-এ। তথাপি আগেই বলেছি বাংলাদেশ থেকে

নির্গমনের স্রোত অব্যাহত রয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগণা ও নদীয়ার প্রান্তবর্তী

অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত হাবড়া, গাইঘাটা, বনগাঁ, বাগদা, অথবা উত্তরদিকে মালদা,

বালুরঘাট ইত্যাদি অঞ্চলে অভিবাসী মানুষদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। ভোটব্যাঙ্ক

বাড়ানোর তাগিদে বহুসময় শাসকদল তাদের তোষণ করে, যদিও যথাযোগ্য সুবিধা বা

অধিকার কিছুই তারা পায়না।

                    গেইল তুরিনের বইটি দেখতে গিয়ে অনিবার্য ভাবে যে

প্রশ্নটি মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছিল তা হল এই ছিন্নমূল মানুষ তো সেভাবে স্থান

পেলনা বাংলার সামাজিক ইতিহাসে বা শিল্পসাহিত্যে? এই নির্যাতিত মানবতাকে

চিত্রায়িত করে কেন কালজয়ী বাংলা সাহিত্য রচিত হলনা বা কেন সাহিত্য নীরবতার

দ্বারা নিজেকে দরিদ্র করলো তার উত্তরে অনেক কবি সাহিত্যিক জানিয়েছেন যে

কোনও কোনও বীভৎসতা মানুসের কল্পনা শক্তিকে অসার করে দেয় তা এতই

“uniquely unique’ এবং ‘non narratable’। ঋতু মেনন ও কমলা ভাসিন তাদের

Borders & Boundaries গ্রন্থে বলেছেন,দেশভাগের কাহিনী ‘reverberate with things

unsaid’।আসলে পার্টিশন ভোলা যেমন শক্ত,মনে করা ততই বিপজ্জনক। আবার এ ও

দেখান হয়েছে যে একটি জন গোষ্ঠী যেখানে ‘ যৌথ দুর্ভাগ্যের’ কথা ভুলে থাকতে

চায়, সেখানে শিল্পী কিই বা করতে পারেন।দেশ ভাগের অনেক পরে ১৯৬৪ সালের

দাঙ্গা নিয়ে ‘The shadow Lines’লিখতে গিয়ে অমিতাভ ঘোষ জানাছেন যে এর

প্রতিটি ঘটনা নীরবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখা। এই নিরবতা স্মৃতির অসমৃদ্ধতাজনিত

নয়, দমনকারী রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া না, ‘it lies outside the reach of

my intelligence, beyond words –that is why silence must win, must

inevitably defeat me.’তাহলে যে ঘটনা প্রবাহের কোনও অর্থ হয় না, তা নিয়ে

কিছু বলাও যায় না। প্রশ্ন উঠেছে, জীবনধর্মী শিল্পী অবক্ষয়ের রূপকল্প কি রচনা

করতে পারেন? কারন “ এ যে স্বদেহ কণ্ডূয়ন করে স্বদেহ ভক্ষনের চিত্র”।

            তথাপি, নীরবতার কাছে আত্মসম্মান তো ‘surrender to cynicism’

তাই বরশার্ট, এলি হ্বিজেল, প্রাইমো লেভি, পল সেলানের মতো কবি ও লেখকরা

নৃশংসতার একটি ভাষা আবিষ্কারে উদ্যোগী হয়েছেন। বাস্তব দুঃস্বপ্নের ভয়ংকর

দিনযাপনের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন এক নতুন ‘art of

atrocity’। তুরিনের ফটোগ্রাফ গুলি তাই সামাজিক ইতিহাসের একটা বড় ফাঁককে

পূরণ  করেছে। ভারতীয় সীমানার জিরো পয়েন্ট থেকে দেড়শ মিটার ভিতরে যে

স্থলভূমি, অতীতে কিন্তু তা ছিল বাংলার মানুষের দৈনন্দিন আদানপ্রদান ও চলাচলের

স্থান। এই দেয়ালের অথনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক প্রতিক্রিয়া তাই খুবই

মারাত্মক। শুধু দেশান্তরি মানুষের জন্যই নয়, বরং উভয় দেশের মানুষের

জন্যও।পুরো সীমান্তবর্তী অঞ্চলে - তা বাংলাদেশে হোক বা ভারতে, এই দেয়াল

মানুষের সামাজিক চলাচল ও স্বাধীনঅর্থনৈতিক কাজকর্মের অধিকার লঙ্ঘন করছে।

তুরিনের ক্যামেরায় উঠে এসেছে বি এস এফের হাতে নিগৃহীত এইসব জীবন মৃত্যুর

তীরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের বৃত্তান্ত। সেই বৃত্তান্তে  আছে ১৪ বছরের ফেলানি, যে

এক নতুন জীবনের আশায় কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে বি এস এফের গুলিতে প্রাণ

হারায়,আছেন মইজুদ্দীন, যিনি  নিগ্রহের পর আর ভালোভাবে হাঁটতে পারেননা, আছে

৩০ বছরের বাবুন যে ২০১২-তে গরু পাচার করতে গিয়ে বি এস এফ –এর ছোঁড়া

পাথরে থেতলে যায়, আছেন উত্তরবঙ্গের (লালমণিরহাট) থেকে ঢাকায় রাস্তা সারাইয়ে

কর্মরত এক সর্বস্বান্ত নারী যিনি বি এস এফ ও বি এস জি-র সংঘর্ষে আজ গৃহহারা।

শুধু নিগ্রহ বা অত্যাচার নয়, এই ছবিগুলো সামাজিক মনস্তাত্বিক অবক্ষয়ের এক

জীবন্ত দলিল হওয়া উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাচার হওয়া কাসির সিরাপ ফেনসিডিল

কিভাবে নেশাগ্রস্ত করে ফেলেছে বাংলাদেশীদের, কিভাবে ধর্মীয় শিক্ষার মোড়কে ঢাকার

মাদ্রাসাগুলো শিশুদের নরম হৃদয়কে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত করছে বা কিভাবে বাংলাদেশের

ভিতরেই সীমান্ত অঞ্চল থেকে উন্নত জীবনের আশায় ঢাকায় চলে গিয়ে হাজার হাজার

মানুষ মনুষ্যেতর জীবনযাপন করছে তার ছবি গেইল ক্যামেরাবন্দি করেছেন

অকুতোভয়ে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে।

         বইটি অনুবাদ করে অসিত রায় আমাদের কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন।

এই খণ্ড খণ্ড চিত্রের কোলাজ করে ঘটমান বর্তমান ও অদূর অতীতের  যে ভাষ্য

তিনি  আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন তাতে আবার মাথা নিচু করে উচ্চারণ করতে

হয়-‘ এ আমার , এ তোমার পাপ’।

                                       ...............শর্মিষ্ঠা নাথ

No comments:

Post a Comment